মানুষ তার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই নিজের অস্তিত্ব, চারপাশের পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে জানার চেষ্টা করেছে। আর এ বিষয়টি মানুষের স্বভাবতাড়িত। সে অপর জনগোষ্ঠীর আচরণকে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করেছে। তবে এই বোঝাপড়ার প্রক্রিয়াটা সবসময় নিষ্কলুষ কিংবা নিষ্পাপ ছিলো না। যার কারণে এ জানাশোনার সূত্রেই বিভিন্ন চিন্তার বিনির্মাণ ও উৎপত্তি ঘটেছে। চিন্তাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান দুনিয়া দুটি ভাগে বিভক্ত; আর তা হলো- প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য। তবে এই আলোচনায় মূল বিষয়বস্তু হলো ‘পাশ্চাত্য ও তার চিন্তার ভিত্তি’। আধুনিক যুগে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা হলো পাশ্চাত্য চিন্তাধারা। যা আমাদের অস্তিত্ব এবং চিন্তার মাঝে এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে, যার দরুন আমাদের দ্বীন, সমাজ-সংস্কৃতি এবং জীবনাদর্শের প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে নড়বড় করে দিয়েছে। যা কেবল মুসলমানদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানবতার জন্য চরম অধঃপতন, জুলুম এবং শোষণের দিকে ধাবিত করছে।
পাশ্চাত্য চিন্তা কিংবা ধর্মহীন যে পাশ্চাত্য তা নিয়ে আলোচনার শুরুতেই কয়েকটি প্রশ্ন আমাদের সামনে হাজির হয়। সেগুলো হলো-
- পাশ্চাত্য বলতে আসলে কী বুঝায়?
- পাশ্চাত্য চিন্তার অভিন্ন বা কমন বিষয়সমূহ কি কি?
- পাশ্চাত্য চিন্তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ (Hypothesis)।
যে সকল বিষয়সমূহের উপর ভিত্তি করে পাশ্চাত্য চিন্তা গড়ে উঠে-
- মানুষ হলো পরিত্যক্ত একটি সৃষ্টি, যা ইলাহী সমর্থন ও সাহায্য থেকে মাহরুম/বঞ্চিত।
- মানুষকে একাকী ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তার কাজে হস্তক্ষেপ করার মতো কেউ নাই।
- সকল কিছুই সময় তথা নির্দিষ্ট কিছু শর্তের আলোকে নির্ধারিত হয়ে থাকে।
- সকল কিছুই মানুষ তৈরি করে, এমনকি দ্বীনও মানুষ তৈরি করে থাকে।
- সকল কিছুই সম্ভব। যা কিছু মওজুদ (বিদ্যমান) আছে সকল কিছুই মুমকিন মওজুদ[1] থেকে সৃষ্টি হয়।
- মুমকিন মওজুদের বাইরে অন্য কোনো সৃষ্টি নেই।
- মানুষ তার নিজের জন্য নিজেই যথেষ্ট।
পাশ্চাত্য বলতে মূলত পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান ধর্মকে বুঝিয়ে থাকে। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ক্যাথলিক ধর্ম পাশ্চাত্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো, পরবর্তীতে ১৭ শতাব্দীতে এসে (মার্টিন লুথার কিং এঁর মাধ্যমে) প্রটেস্ট্যান্টরা যুক্ত হয়। পাশ্চাত্যের একটি সংজ্ঞা আছে; তা হচ্ছে- we and the rest অর্থাৎ, আমরা এবং অন্যরা। এখানে “আমরা” বলতে বুঝায় মূলত পাশ্চাত্য বসবাসকারী খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীকে। তবে ল্যাটিন অ্যামেরিকা বা ব্রাজিল কিংবা উরুগুয়ের খ্রিস্টানরা পাশ্চাত্যের অন্তর্ভুক্ত নয়; পাশাপাশি অর্থডক্স খ্রিস্টান অর্থাৎ রাশিয়ান খ্রিস্টানরাও পাশ্চাত্যের অর্ন্তভুক্ত নয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে স্পেনের ক্যাথলিকরা পাশ্চাত্যের অন্তর্ভুক্ত কিনা, সেটা নিয়েও তাঁদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। যার ফলে পাশ্চাত্য চিন্তার প্রতিনিধিত্বকারী মূলত ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন, হল্যান্ড এবং আংশিকভাবে ইতালির চিন্তাকে বুঝানো হয়ে থাকে। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে এসে অ্যামেরিকা ও কানাডার চিন্তাও এর সাথে (we বা আমরা) যুক্ত হয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর পরে এসে আধুনিক পাশ্চাত্য গঠিত হয়। আমাদের সামনে যে পাশ্চাত্য বিদ্যমান তা মূলত ষোড়শ শতাব্দী পরবর্তী পাশ্চাত্য। এ সময়ে ইউরোপে জ্ঞানের যে বিভিন্ন ধারা তৈরি হয়, সেটাই পরবর্তীতে সুগঠিত হয়ে নতুন পাশ্চাত্য গঠন করা হয়। আর সপ্তদশ শতাব্দীতে গঠিত পাশ্চাত্য যে মূলনীতিকে তার movement point হিসেবে গ্রহণ করে –
من عرف نفسه فقد عرف ربه–
অর্থাৎ, “যে নিজেকে চিনে সে তাঁর রবকেও চিনতে পারে।”
কারণ, এ মূলনীতি ক্যাথলিক চিন্তাকে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের মতে, যদি আমরা মানুষ ও প্রকৃতিকে জানতে পারি তাহলে স্রষ্টাকেও চিনতে পারবো। মারেফাতুল্লাহ (স্রষ্টাকে চিনা)-ই উপনীত হওয়ার জন্য ক্যাথলিক চার্চের প্রয়োজন নেই। মুসলমানদের মতো আমরাও প্রকৃতি এবং মানুষকে বিশ্লেষণ করে মারেফাতুল্লাহ-ই উপনীত হতে পারবো। আর এক্ষেত্রে সঠিক পন্থা হলো, মানব সত্ত্বা ও প্রকৃতিকে আকলের মাধ্যমে গবেষণা করা। আকলের মাধ্যমে গবেষণা করার বিষয়টা ক্যাথলিক চিন্তাধারায় ছিলো না। তাই ঐ সময়ের প্রভাবশালী চিন্তা ইসলামী সভ্যতার চিন্তাধারার মাধ্যমে প্রভাবিত ছিলো। তাদের এ চিন্তা ঊনবিংশ শতাব্দী অর্থাৎ ২০০ বছর পর্যন্ত জারি ছিলো। পরবর্তীতে তারা এটাকে পরিত্যাগ করে।
আর এটা পরিবর্তন করার কারণ হলো- ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তারা একটি চিন্তায় পৌঁছায় সেটা হলো, আকলের মাধ্যমে রবকে জানা সম্ভব নয়। এখানে জ্ঞানের বিষয়বস্তু পরিবর্তন হয়ে যায় এবং মারেফাতুল্লাহকে জ্ঞানের বিষয় থেকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়।
ষোড়শ শতাব্দী পরবর্তী সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য চিন্তায় মূল বিষয়সমূহ ছিলো-
- প্রাকৃতিক দ্বীন (Natural religion)
- প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব (Natural theology)
- প্রাকৃতিক আইন (Natural law)
- তাবিয়াত দর্শন বা প্রাকৃতিক দর্শন (Natural philosophy)
- প্রাকৃতিক দ্বীন হলো, মানুষের ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ দ্বীন। তারা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি দ্বীনের অনুসন্ধান করতো। কারণ তাঁরা ক্যাথলিক চিন্তার মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি কিংবা তাঁদের চিন্তাকে সমাজে প্রভাবশালী করতে পারছিলো না। তারা যে পিছিয়ে ছিলো বা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিলো, তা থেকে বের হওয়ার জন্য একটি প্রাকৃতিক দ্বীনের অনুসন্ধান করছিলো। পরবর্তীতে তারা পরিকল্পনা করে, যেহেতু এই দ্বীনের মাধ্যমে মুক্তি সম্ভব নয় এবং এর মধ্য থেকে আমরা নতুন কিছু তৈরি করতে পারবো না, এজন্য আমাদের এমন একটা দ্বীন প্রয়োজন যেটা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা প্রাকৃতিক দ্বীন। ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যতা খোঁজার পেছনে অন্যতম কারণ হল, ইসলামী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া।
প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব হলো, প্রকৃতির মধ্যকার বিধান নিয়ে গবেষণা করে তথা “আসার’ (পৃথিবীতে যা কিছু আছে বা সৃষ্টি) থেকে “মুয়াসসির” তথা স্রষ্টার অস্তিত্ব ও সিফাতসমূহকে নির্ণয় করার প্রচেষ্টা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের খালক বা মহান সৃষ্টির মধ্যে যে বিধি-বিধান আছে সেটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। তারই প্রকৃতির মধ্যে যে বিধান দিয়ে দিয়েছেন সেটা গবেষণা করে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং সিফাতসমুহকে নির্ণয় করা। এজন্য তারা একটি থিওলজি দাঁড় করায়। তবে সৃষ্টি যার আইন তার, এই বিধান অর্থে না। এমনকি নিউটনের ‘Principia mathematica physics’ বইয়ে এরকম একটা লাইন হুবহু আছে, “সৃষ্টিকে দেখে স্রষ্টাকে খুঁজে বের করা তথা ‘আসার’ দেখে ‘মুয়াসসির’কে খুঁজে বের করা।” এটা ছিলো তাদের ন্যাচারাল থিওলজি। নিউটনের এ বইটি ফিজিক্স, একই সাথে কালামের সাথে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব মূলত ইলমুল কালাম দ্বারা প্রভাবিত, বিশেষ করে ইবনে সিনার থিওরী/তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলো।
প্রাকৃতিক আইন হলো, মানুষের প্রকৃতির মধ্যে মওজুদ (বিদ্যমান) এবং আকলের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া সম্ভব, এমন মূলনীতিসমূহকে খুঁজে বের করে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিধানকে মওজুদিয়্যাত ও আকলের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া বিধানের উপর প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ যে ব্যবস্থাপনা হবে সেটা আকল কর্তৃক নির্ধারিত হবে এবং মানুষের প্রকৃতির মধ্যে যে সকল বিষয় আছে সে সকল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। প্রত্যেকটা বিষয়েই তারা ব্যাপকভাবে ইসলামী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিলো।
ন্যাচারাল ফিলোসফি বা প্রাকৃতিক দর্শন হলো, এস্ট্রোনমি, ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি ও বায়োলজির মতো জ্ঞানসমূহ। ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলমানগণ এ সকল বিষয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিলো। পাশ্চাত্য চিন্তার গঠনগত পর্যায়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা ইসলামী চিন্তা থেকে অনেক বেশী প্রভাবিত এবং উপকৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামী সভ্যতার অসংখ্য বই পাশ্চাত্য নিজেদের মতো ভাবার্থ করে নিজেদের নামে চালিয়ে দিয়েছে। সে সময়ের বইগুলোতে এক পাশে ইংরেজি আর অন্যপাশে আরবী, এভাবে অনুবাদ করা হতো।
যেমন – জন লক ও গ্রটিউস আরবী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। Hugo Grotius এর On the law of War and Peace গ্রন্থটি ইমাম সারাখসীর শারহু সিয়ারুল কাবির গ্রন্থের সাথে অনেক মিল পাওয়া যায়, অর্থাৎ এই বই থেকে নকল করা হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয়ে ঘাটতি আছে। সেটা হল- তারা এসব বিষয় আমাদের কাছ থেকে নিলেও, আমাদের কাছ থেকে যেটা গ্রহণ করেনি তা হলো- নবুয়ত। তারা যা কিছু নিয়েছে, সুন্নতকে একপাশ রেখে, বাইরে রেখে যেভাবে নেওয়া যায়; সেভাবে নিয়েছে। তাই, আমরা এখন তাদের কাছ থেকে যে চিন্তাই গ্রহণ করি না কেন, তা সুন্নতের বাইরে যায়, আমাদের সমাজ বা মন-মানসের সাথে মিলে না। যা আমাদের জন্য মোটেই উপযোগী নয়।
সপ্তাদশ শতাব্দীতে উসমানী খেলাফতের (শুধু উসমানী না, সাফাভী, মুঘল এবং উসমানী) প্রভাবের কারণে তারা আরও একটি বিষয় উপলব্ধি করে, মানুষ তার প্রতিষ্ঠিত দুনিয়াতে বসবাস করে। অর্থাৎ আমরা যে শহরে বাস করি সেটা আমাদের পূর্বপুরুষ বা আমাদের তৈরি করা। এটাকে ইমাম মাওয়ার্দী বা ইসলামী সভ্যতার ভাষায় বলে العقل المكتسب বা মুকতাসাব আকল, যা এক অর্থে সমগ্র মানবতার আর্কাইভ [এখানে মানুষের সকল কিছু রয়েছে]। এটা তারা মুসলমানদের চিন্তাধারা থেকে জানতে পারে।
ইবনে খালদুনের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী মওজুদাতকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয় –
- তাবিয়াত বা প্রকৃতি (যেখানে মানুষের কোনো হাত নেই)।
- সংস্কৃতি বা সভ্যতা বা উমরান অথবা কাসবি (যা মানুষের নিজের তৈরি)। এটাকে দুনিয়া বা দুনিয়ার জীবন বলা হয়ে থাকে।
ইলমুল কালামের ক্ষেত্রে ‘কাসব’ পরিভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আমরা আমাদের অর্জিত বা কাসবী দুনিয়ায় বসবাস করি। এসব চিন্তা দ্বারা তারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।
সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে যখন তারা ক্যাথলিক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত ছিলো, তাদের মধ্যে একটি ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল সেটা হলো- এ দুনিয়ায় মানুষের খুব বেশী কিছু করা সম্ভব নয়। এই দুনিয়া রুহুল কুদস বা পবিত্র আত্মা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আর এই পবিত্র আত্মার প্রতিনিধিত্ব করে গির্জা বা গির্জা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুনিয়া। এখানে যা কিছু ঘটছে তা আমাদের চিন্তার বাইরে। ফলে মানুষের কিছু করার নেই বা মানুষ সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। এটাই ছিলো তাদের প্রভাবশালী দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু দুনিয়া, সভ্যতা বা সংস্কৃতি বিনির্মাণ করার ক্ষেত্রে ‘ইমারত’ সম্পূর্ণভাবে মানুষের উপর নির্ভরশীল৷ মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা দায়িত্বের অংশ হিসেবে কিংবা আখেরাতে সে যে পরিণতি পাবে, দুনিয়াতে ইমারতের দাবি হিসেবে আল্লাহ তাকে পাঠিয়েছেন। “তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা পৃথিবীকে বিনির্মাণ করো।” বিনির্মাণের এই চিন্তা পরবর্তীতে ইলমুল উমরান হিসেবে আমাদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো। এই মূলনীতির কারণে এর উপর ভিত্তি করে আমরা সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি।
কিন্তু, ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাদের চিন্তার মূল বিষয়সমূহ পরিবর্তন হয়ে যায়। এই সময়ে তাদের কিছু নতুন চিন্তা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। সেগুলো হলো-
- ইমানুয়েল কান্ট (Critique of pure reason নামক গ্রন্থে) এর মতে, মানুষ শুধুমাত্র তার আকল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিষয়কে-ই জানতে পারে।
- সংজ্ঞাগত কারণেই মানুষের পক্ষে তার আকল দ্বারা স্রষ্টাকে (ইনশা ও ইহাতা) বুঝতে পারা সম্ভব না। অর্থাৎ, রবকে আকলের মাধ্যমে জানা সম্ভব নয়; মারেফাতুল্লাহ জ্ঞানের বিষয় নয়; এই বিষয়ে কান্ট সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন।
- স্রষ্টা জ্ঞানের কোনো বিষয় নয়। অর্থাৎ, মারেফাতুল্লাহ সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে কান্টের সিস্টেমের মধ্যে দ্বৈত একটি বিভাজন রয়েছে–
- Numen (নুমেন)- ইলাহী বিষয় এবং যা মানুষ জানতে পারবে না।
- Phenomen- মানুষের মস্তিস্ক কর্তৃক তৈরিকৃত বিষয়কে জানতে পারবে; অর্থাৎ মানুষের মস্তিস্ক কর্তৃক তৈরিকৃত বিষয়কে জানতে পারবে। সকল ধরনের বিষয়কে মানুষ তৈরি করে; যেমন- পাথর, গাছপালা, সূর্য, মহাকাশ, নিহারিকা, খাবার-দাবার ইত্যাদি।
কান্টের চিন্তাধারা Will and Representation (ইরাদা এবং তাসাউর) এবং ফরাসি বিপ্লব- সকল কিছুকে পরিবর্তন করে নতুন একটা বিশ্বব্যবস্থার পথে যাত্রা শুরু করে। এ বিষয়ের ক্ষেত্রে কান্টের পাশাপাশি ফরাসি বিপ্লবও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরাসি বিপ্লবের মূল কথা হলো- মানুষ তার পছন্দনীয় ও ইচ্ছাকৃত ব্যবস্থাকে নিজের মতো প্রতিষ্ঠা করতে পারে; একইসাথে তা ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রেও। পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সব-ই মানুষ তৈরি করছে, একই সাথে যে ব্যবস্থাপনা রয়েছে তাও মানুষ তৈরি করেছে। কান্টের চিন্তার ভিত্তি হলো, যে নিজেকে চিনতে পারবে, সে নিজেকে চিনতে পারবে। জগতে যা কিছু আছে, তা মানুষ তার নিজের আকলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তাই রব এখানে Out of subject অর্থাৎ এ সকল কিছুর বাইরে। তারা আকলের মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থা (خلق) পরিবর্তন করে দিলো। আরেকটা হলো امر (পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা – রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা নিজামে আলাম)-কে পরিবর্তন করলো।
উনবিংশ শতাব্দীতে আরেকটি চিন্তা ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে উঠে, তা হলো- কান্টের আখলাকী অটনমি চিন্তা।
অটনমি শব্দটি এসেছে, nomos- অর্থ হলো বিধান। Autonomy অর্থ হলো, যে নিজের আইন নিজেই প্রণয়ন করতে পারে। সুতরাং আখলাকী অটনমি হলো, নিজের আখলাককে নিজেই তৈরি করার যোগ্যতা। অর্থাৎ মানুষ তার নিজের আখলাকী বিধানকে নিজেই প্রণয়ন করে। এই ক্ষেত্রে নিজের বিবেক-ই মূল। বিবেক সম্মতি দিলে সে যা ইচ্ছা করতে পারবে। ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে ভালো ও খারাপ নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে। এটাকে তিনি এই বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন- Volenti non fit injura, অর্থাৎ মানুষ তার নিজের ব্যাপারে নিজের ইচ্ছায় যে সিদ্ধান্ত দিবে সেটাকে জুলুম বলা যাবে না। এতে সে আত্মহত্যা বা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তার সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানুষ তার নিজের উপর জুলুম করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে মানুষ তার নিজের সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত দিবে সেটাকে আখলাকী দিক থেকে ভুল বলে অভিহিত করা যাবে না।
কিন্তু কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী মানুষ নিজের উপর জুলুম করতে পারে, এবং তার নিজের সম্পর্কে অজ্ঞও হতে পারে। যার পরবর্তী ধাপ-ই হলো ইস্তিগনার চিন্তা অর্থাৎ মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে। মানুষ যখনই তার নিজেকে অমুখাপেক্ষী মনে করবে তখনই সে ভ্রান্তিতে নিপতিত হবে।
إن الإنسان ليطغى أن رآه استغنى
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে অপর একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়, রোমান্টিক তথা কল্পনাপ্রবণ আন্দোলন (Romantic Movement)। যার মূল কথা,
- মানুষ সকল কিছুকে তার নিজের মত বিনির্মাণ করতে পারে; আর এক্ষেত্রে কোন সীমারেখা নাই।
- এ বিষয়ে হেগেলের একটি মৌলিক চিন্তা হলো, ‘স্রষ্টা আছে’। এখানে স্রষ্টা আছে এর অর্থ, মওজুদ আছে।
আর যেহেতু মওজুদ (বিদ্যমান বিষয়) তাদের হাতে আছে, এজন্য আল্লাহ বা স্রষ্টার প্রয়োজন নাই। স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শুধু মওজুদের উপর ভিত্তি করে তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারবে। পরবর্তীতে হেগেল এই অন্টোলজির মাধ্যমে বা মওজুদিয়াতের উপর ভিত্তি করে সবকিছুকে দাঁড় করায়।
- স্রষ্টা নামক শব্দকে ব্যবহার না করেও “মওজুদ” নামক পরিভাষা উপর ভিত্তি করে সকল কিছুকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে পারবে।
- হেগেলের পরবর্তী সময়ে এমন একটি ধারণা প্রভাবশালী হয়ে উঠে, স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে সমগ্র মওজুদাতকে বিবেচনায় নিয়ে চিন্তা ও জ্ঞান উৎপাদন করা সম্ভব। [এরই মাধ্যমে হিস্টোরিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজমের বা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের জন্ম হয়।]
রোমান্টিক আন্দোলন (Romantic Movement)-এর অন্যতম একজন দার্শনিক শিলায়েমাখার (Schleiermacher) নামে একজন জার্মান দার্শনিক (মৃত্যুঃ ১৮৩৪ ) ছিলেন। যিনি একইসাথে একজন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত্ববিদ। তার মতে, মানুষ পরিপূর্ণভাবে তার রবকে ইহাতা বা পরিগ্রহ করতে পারবে না। তবে এর সাথে সম্পৃক্ত বিষয় হিসেবে মানুষ স্রষ্টা (মুতলাক বা absolute) সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবে। পরবর্তীতে এই সকল অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে দ্বীনকে (ইনশা) বিনির্মাণ করতে পারে। এক্ষেত্রে এ দার্শনিক দু’টি বিষয় উল্লেখ করেন-
- অনুরূপভাবে স্রষ্টা সম্পর্কে তাসাউর (ধারণা), এই অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তৈরি হবে।
- যেহেতু স্রষ্টাকে ইহাতা বা পরিগ্রহ করা যাবে না, এজন্য দ্বীনের ভিত্তি হলো ইর্যাশনাল বা অযৌক্তিক।
পাশ্চাত্য চিন্তা মুসলমানদের দ্বীনকে হক্ব দ্বীন হিসেবে বিবেচনা করে না, কারণ এই দ্বীন আকলের সাথে অনেক বেশী সঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু এই দ্বীন আকল কর্তৃক গঠন করা সম্ভব। তাই এটা হক দ্বীন হতে পারে না। কারণ ইলাহ বা স্রষ্টাকে ইহাতা করা সম্ভব নয়। এজন্য সে পরবর্তীতে সেই মানুষ কর্তৃক একটি দ্বীন এবং ধর্মীয় ভাষা প্রবর্তিত হবে। শিলায়েমাখার এটাকে মানুষের তৈরি বলেন, যার ভিত্তি হলো যুক্তিহীন। এটা অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে এবং এ অভিজ্ঞতা যেহেতু একজন মানুষ করে, এটা কোন ভাষায় কীভাবে করেছে সেটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না; একইসাথে এটাকে অবশ্যই যুক্তিহীন হতে হবে। এই সময় একটা বিষয় পরিলক্ষিত হয়, যে দ্বীন যত বেশি অযৌক্তিক হবে, সে দ্বীন তত বেশি হক দ্বীন বলে বিবেচিত হবে। যেমন- খ্রিস্টান ধর্মের যত অযৌক্তিক বিষয় আছে সকল অযৌক্তিক বিষয়কে সে এমন ভাবে সামনে নিয়ে আসছে যেন সেটাই একমাত্র হক্ব দ্বীন। এভাবে শিলায়েমাখার এর এই চিন্তার উপর ভিত্তি করে দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞানকে বিকশিত করা হয়।
এই শতাব্দীতে প্রভাবশালী আরেকটি বিষয় হলো, তারা ইসলামী জ্ঞান ও সভ্যতার দ্বারা উপকৃত হলেও নবুয়তকে গ্রহণ না করার কারণে ধীরে ধীরে নববী হিকমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। এতে তারা শুধু নিজেরাই নয় সমগ্র মানবতাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে।
আধুনিক পাশ্চাত্যের মূলনীতিসমূহ–
পাশ্চাত্য চিন্তা বলতে শুধুমাত্র একটি বিষয় নয়; একইসাথে positivism, historicism, idealism, empiricism, rationalism, existentialism, constructivism, marxisim এই সবগুলো বিষয়ই পাশ্চাত্য চিন্তা। এ সকল বিষয়ের অভিন্ন বিষয়সমূহ আলোচনা করা যাক! এই সকল চিন্তাধারার অভিন্ন কিছু দিক রয়েছে।
- প্রথম মূলনীতি হলো, মানুষ (স্রষ্টার পক্ষ থেকে) পরিত্যক্ত একটি জীব।
এক্ষেত্রে পরিত্যাগের বিষয়টি দুইভাবে হতে পারে- একটি আধ্যাত্মিক এবং অপরটি জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে পরিত্যক্ত বিষয়টা হচ্ছে passive তথা নিষ্ক্রিয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে; যাতে কর্তা নির্দিষ্ট না। তবে খ্রিস্টান ধর্ম অনুযায়ী মানুষ স্রষ্টা কর্তৃক পরিত্যক্ত। খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের মতে, স্রষ্টা মানুষকে পরিত্যাগ করেছে। জন পল সার্ত্রে বলেন, মানুষকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাই সে নিজের মত করে জীবন গঠন করতে বাধ্য অর্থাৎ সে আকলের ওপর নির্ভরশীল।
তবে খ্রিস্টান থিওলজিস্টদের মতে,
- মানুষ স্রষ্টা কর্তৃক পরিত্যক্ত একটি জীব।
- মানুষের একার পক্ষে তার আমল দ্বারা মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। Original sin বা আদিপাপের কারণে আধ্যাত্মিক বা জাগতিকভাবে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। এই জন্য স্বয়ং স্রষ্টাকে এসে এই অরিজিনাল সিন বা আদি পাপ থেকে মানুষকে মুক্ত করার প্রয়োজন।
- এক্ষেত্রে, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জুলুম, তারা একজন পয়গম্বরকে স্রষ্টা বানিয়েছে আবার ইলাহকে তার মাঝে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। ত্রিত্ববাদ তথা পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে।
আবার, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কালে ডেইস্টরা (যারা নবুয়তকে অস্বীকার করে) বলে থাকে যে, আল্লাহ (স্রষ্টা) দুনিয়াকে সৃষ্টি করেছেন এবং এটাকে পরিচালনা করছেন। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ মানুষকে জাগতিক ভাবে পরিত্যাগ করেননি, একই ভাবে আধ্যাত্মিকভাবেও পরিত্যাগ করেননি। তিনি মানুষকে আকল দিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে তারা জাগতিক বা ফিজিক্যাল দুনিয়াকে এবং মানুষের আধ্যাত্মিক জগতকে বিশ্লেষণ করে স্রষ্টা সন্তুষ্ট হবেন এমন একটি জীবন ধারা তৈরি করতে পারবে। এটা ইসলামী সভ্যতার প্রভাবে করলেও তারা এটা কখনো স্বীকার না করার কারণে মনে হত, তারা আকলের মাধ্যমে এটাকে খুঁজে পেয়েছে।
[তবে, এখানে মূল বিষয় হচ্ছে আল্লাহ যদি আধ্যাত্মিক বা জাগতিকভাবে পরিত্যাগ করেন তাহলে কি মানুষের টিকে থাকা সম্ভব? মোটেও সম্ভব না। বরং মহান আল্লাহ মানুষকে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রত্যেক যুগে যুগে নবী প্রেরণ করেছেন। শুধু তাই নয়, হযরত পয়গম্বর (স) এর মাধ্যমে বিশ্বজনীন সুন্নত তথা আল্লাহর রাসূলের ওফাত বা মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর সুন্নত বা সুন্নতের মাধ্যমে তিনি সবসময় আমাদের সাথে আছেন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সুন্নত ছাড়া এক মুহূর্তও টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে পরিত্যাগ করেছেন এ কথাটা মোটেও ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে সঠিক নয়। আমরা যদি পয়গম্বরদের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে পড়ি তাহলে আমরা বুঝতে পারবো এটা একটা বানোয়াট চিন্তাধারা। তবে উনবিংশ শতাব্দীর পরে এরকম কোন চিন্তা আর পরিলক্ষিত হয়নি।]
- তাদের দ্বিতীয় মূলনীতি হলো, মানুষকে একাকী ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
যেমন ফিটশের মতে, কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত হচ্ছে, সেই কাজ করার সক্ষমতা। আর সক্ষম হলে সেটা গ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়।মানুষকে যেহেতু একাকী ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাই তাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
লাগামহীন ভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তবে তাঁদের সীমারেখা কে নির্ধারণ করবে? মানুষের সীমারেখা নির্ধারণ করবে অন্যরা। মানুষ যদি নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে তাহলে এই সমঝোতা সকল কিছুর মূলভিত্তি হিসেবে গণ্য হবে। মূলত থমাস হবস, জন লক এবং জ্ জ্যাক রুশোর সোসাল কনট্রাক্টের ভিত্তি মাধ্যমেই এই মূলনীতির উৎপত্তি।
তাদের মতে, মানুষের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত-ই সঠিক। এ ক্ষেত্রে মুতলাক হাকীকত বা প্রকৃত সত্য বলতে কোনো বিষয় নেই। কারণ তারা সমঝোতার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন, উদাহরণস্বরূপ সমকামিতা এবং মদকে বৈধকরণের বিষয়টি আমরা বিবেচনা করতে পারি। [এ সকল কিছু তাদের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সঠিক। আজকে এটা সঠিক, কালকে এটা ভুলও হতে পারে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে ধ্রুব সত্য বলতে কিছু নেই।] তাই তাদের নীতি – by the people, of the people, for the people. সার্বভৌমত্ব জনগণের, কথাটার উৎপত্তি এখান থেকেই। আর এভাবেই তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার উৎপত্তি হয়েছে।
ফলশ্রুতিতে আল্লাহ কিংবা কোন শক্তির সামনে তারা কোনো ধরণের জবাবদিহিতা করতে বাধ্য নয়।
- পাশ্চাত্যের তৃতীয় মূলনীতি হলো, সময়। সকল কিছুই সময় কর্তৃক নির্ধারিত। এই ক্ষেত্রে কোরআনের এই আয়াতটি প্রণিধানযোগ্য –
وَ قَالُوْا مَا هِیَ اِلَّا حَیَاتُنَا الدُّنْیَا نَمُوْتُ و نَحْیَا وَ مَا یُهْلِكُنَاۤ اِلَّا الدَّهْرُ-
অর্থাৎ, আমাদেরকে কোনো কিছুই ধ্বংস বা বিনাশ করতে পারবে না একমাত্র দাহর বা সময় ছাড়া।
এখানে সময় বা যামান হলো, প্রদত্ত অবস্থা ও শর্তসমূহ। ফলশ্রুতিতে সত্য হলো, শর্তভিত্তিক বা অবস্থাভিত্তিক। অবস্থা ও শর্তের দাবী যা, সেটাই সঠিক। ধ্রুব সত্য বলে কিছু নেই। মূলত Historicism তথা ঐতিহাসিকতাবাদ এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
সময়ের সাথে এবং শর্তের সাথে সম্পৃক্ত আরেকটি বিষয় হলো, মানুষের চাওয়া এবং দাবি। তাদের মতে, এটাও সঠিক। যেহেতু এটা সময়ের সাথে সম্পৃক্ত। যাকে নিহিলিজম (Nihilism) বলা হয়ে থাকে।
নিহিলিজম হলো- Universal law of ethics বা বিশ্বজনীন আখলাকী বিধান বলতে কিছু নেই। মূলত মানুষ তার চিন্তার আলোকে সকল কিছুর অর্থবহতা দান করে। অর্থাৎ বিশ্বজনীন কিছু নেই, যা আছে তা টার্ম (শর্ত) এবং কন্ডিশনের (অবস্থা) আলোকে পরিবর্তিত হতে পারে।
[হক এবং সঠিক এর মধ্যে পার্থক্য কী? হক হচ্ছে অপরিবর্তনীয়, ধ্রুব এবং কনস্ট্যান্ট। আর হকের পারিভাষিক অর্থ হলো, সকল অবস্থায় এবং সকল পরিবেশে যা সঠিক। তাদের মতে সঠিক হলো, টার্মস (শর্ত) এবং কন্ডিশন (অবস্থা)। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযীর মতে, মানুষের আকল যখন যে অবস্থায় থাকুক না কেনো, যেভাবে চিন্তা করুক না কেনো যে সময় এবং শর্ত যাই থাকুক না কেনো, সর্বাবস্থায় যা চিরন্তন বলে দাবি করে সেটা হক এবং হাকিকত। যা হক এবং সঠিকের মাঝে মৌলিক পার্থক্য।]
- চতুর্থ মূলনীতি হল, দ্বীন মানুষের তৈরি।
শিলায়েমাখেরের মতে, মানুষ মুতলাককে ইহাতা করতে পারবে না। আর ক্ষেত্রে তিনি কান্টের চিন্তার সাথে সমন্বয় করে বিকশিত করেছেন।
তার মতে মানুষ মহাজগত ও প্রকৃতিকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়, যেখানে সে সৃষ্টির সীমারেখাকে খুঁজে পায়। এটা আকলের সর্বোচ্চ চূড়া। আকল তাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সে এমন এক সীমানায় এসে উপনীত হয় যেটা সে অতিক্রম করতে পারে না। এই অবস্থায় সে মুতলাকের মুখোমুখি হয়, আর যখন যে এই মুতলাকের অভিজ্ঞতা লাভ করে তখন তার জীবনধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তবে মুতলাককে আকলের মাধ্যমে ইহাতা করে, পাশাপাশি তাকে বুঝে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না সে কারণে শুধুমাত্র সে নিজে সেই অভিজ্ঞতাকে লাভ করে৷ সেই বিষয়কেও ভাষায় প্রকার করার মত কোন ভাষা না থাকায় সে সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন একটি ভাষাকে তৈরি করে।
আর এটাকে দ্বীনি অভিজ্ঞতা (Religious Experience) এবং দ্বীনি ভাষা (Religious Language) বলা হয় । এটা মানুষের তৈরি, যা সে গবেষণা করতে করতে এমন অবস্থায় পৌঁছে, যেখানে আকল আর ইহাতা করতে পারে না। সে যা অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং সেটা মানুষের মাঝে প্রকাশ করে। যেহেতু এটা সে মানুষের সামনে তাদের ভাষায় তুলে ধরতে পারবে না, সে এটাকে অযৌক্তিকভাবে তুলে ধরবে।
আর এই সকল অভিজ্ঞতা ও ভাষা মানুষ কর্তৃক বর্ণিত হওয়ায় সেখান থেকে দ্বীন তৈরি হয়।ফলে দ্বীন হলো মানুষের তৈরি।
তাদের মতে, সবচেয়ে হাকীকী দ্বীন হলো এমন দ্বীন যেটা আকল কর্তৃক সাব্যস্ত নয়। যে দ্বীন আকল থেকে যতবেশী দূরে, সেটা ততবেশী হক। এই জন্য খ্রিস্টান ধর্ম হল হাকিকি দ্বীন।
তাদের এই চিন্তা মতে, বাতিল দ্বীন হলো, যে দ্বীনের সাথে আকলের কোনো সমস্যা নেই; অর্থাৎ, ইসলাম। এজন্য পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদরা ইসলামকে মুতলাকের সাথে সম্পর্কিত দ্বীন হিসেবে দেখে না।
- পঞ্চম মূলনীতি হলো, সকল কিছুই সম্ভব। এটাকে তারা Contingency বলে থাকে।
Contingency এর অর্থ হলো, বর্তমানে যা কিছু মওজুদ (বিদ্যমান) আছে, সেগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করে জীবন ধারাকে পরিচালনা করা। আমাদের কালামী ধারায় যে শ্রেণীবিন্যাস তথা ওয়াজিবুল উজুদ ও মুমকিনুল উজুদ আছে। ওয়াজিবুল উজুদ হলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছু সৃষ্টি হওয়া আমরা কল্পনা করতে পারি না। আর আল্লাহ ছাড়া যা কিছু আছে সবকিছু মুমকিনুল উজুদ। তারা ওয়াজিবুল উজুদকে অস্বীকার করে। তাদের মতে গ্রহনযোগ্য হলো, মুমকিনুল উজুদ। যেমন – ঢাকা, আগে ছিলো না, এখন আছে। এর অর্থ এটার অস্তিত্ব বা উজুদ সম্ভবপর। যেমন – সংখ্যা, যা মানুষের যিহিনে থাকে। যদি যিহিন না থাকে, তাহলেও সংখ্যা হবে। সুতরাং যিহিনও মুমকিনুল উজুদ।
তাদের মতে, ওয়াজিবুল উজুদ[2] আমাদেরকে মেটাফিজিক্সের দিকে ধাবিত করবে। তাই আমরা এই মওজুদকে পরিত্যাগ করেছি। এটা পাশ্চাত্য চিন্তার মৌলিক একটি বিষয়। ওয়াজিবুল উজুদ ইলাহী জ্ঞান হওয়ার কারণে এর প্রয়োজন নেই। পাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেটাফিজিক্স পড়ানো হয় না।
তাদের মতে, ওয়াজিবুল উজুদ বা যারুরী, এটা মানতিকের (চিন্তা) সাথে সম্পর্কিত একটি ক্যাটাগরি, উজুদের সাথে সম্পর্কিত কোনো বিষয় নয়। যা চিন্তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়। এর উপর ভিত্তি করে কোনো জ্ঞান দাঁড় করানো যাবে না। এজন্য তারা এটা গ্রহণ করে না। যেগুলো উজুদের সাথে সম্পর্কিত, অস্তিত্বের (ম্যাটেরিয়ালস্টিক) সাথে সম্পর্কিত সেগুলোর সাথে যারুরিয়্যাত বা আবশ্যিকতাকে সম্পৃক্ত করা যাবে না। যেমন – ঢাকা আগে ছিলো না, এখন আছে।
কোনো কিছুর যারুরিয়্যাত আমরা শুধুমাত্র চিন্তা করতে পারি। অন্যথায় যেগুলো মওজুদ আছে, সেগুলার সাথে যারুরিয়্যাতকে সম্পৃক্ত করা যাবে না।
ফলে যা কিছু বাস্তবে আছে, সেগুলা থেকে নতুন নতুন জিনিশ তৈরি করা। আমাদের দুনিয়াতে মুমকিন উজুদ বা সম্ভাব্য সৃষ্টিগুলো সেগুলোকে একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত করে একটি জীবন ধারা পরিচালিত করতে পারি।
ফলশ্রুতিতে আমাদের জন্য স্থায়ী অপরিবর্তনীয় কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। যাকে দার্শনিক ভাষায় বলা হয় post truth (হাকীকত পরবর্তী অবস্থা)। ফলে অপরিবর্তনীয় বা সাবিত বলতে কোনো মূলনীতিকে তারা গ্রহণ করে না।
[কন্টেনজেন্সি আজকে আছে, কালকে নাও থাকতে পারে। এই যে বিভিন্ন নতুন নতুন আবিষ্কার, সকল বিষয়ে পরিবর্তনশীলতা এবং এর উপর ভিত্তি করে যা ইচ্ছা তা করতে পারা; এ চিন্তা থেকে তারা আমাদের যে পতনের দিকে ধাবিত করছে, মানুষ বলতে যে জিনস, ইনসান বলতে যে প্রজাতি এই পৃথিবীতে আছে, তা মুমকিন উজুদ বা সম্ভাব্য সৃষ্টি৷ অর্থাৎ, মানুষ না থাকলেও কোনো সমস্যা নাই। তারা রোবটিক টেকনোলজির মাধ্যমে অথবা বায়োলজিকাল টেকনলোজির মাধ্যমে নারী-পুরুষ বা জিনস থাকবে না, এ ধরনের বা আরও উন্নত সৃষ্টি তৈরি করতে পারে। তাদের এখানে কন্টেনজেন্সি মূল বিষয়।
যে সভ্যতা পৃথিবী থেকে আশরাফুল মাখলুকাতের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিতে চায়; তাঁরাই মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু। যা তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রমাণিত। তারা মানুষকে হোমো-সেপিয়েন্স বা একটি প্রজাতি হিসেবে দেখে। যেমন – মানুষ বানর থেকে বিবর্তিত হয়েছে। মানুষ হলো বিবর্তনের সর্বোচ্চ চূড়া। তার নিচের সকল সৃষ্টি সেকেন্ডারি বা গৌণ সৃষ্টি। যা থাকা বা না থাকায় কিছু যায় আসে না। তাদের মতে, মানুষের চেয়ে উন্নত সৃষ্টি তৈরি করা যায়, তাহলে মানুষের অস্তিত্বের প্রয়োজন নেই। এই পৃথিবীতে মানুষ টিকে থাকবে কিনা এ দায়িত্ব মুসলমানদের। আমাদের আন্দোলন মানুষ রক্ষার আন্দোলন। মানুষ রক্ষা হলে ঈমান রক্ষা হবে। এই কারণে এটা বলা যায় যে পাশ্চাত্য সভ্যতা সমগ্র মানবতার শত্রু। কেননা সে মানুষকে তার অবস্থা থেকে সরানোর জন্য সকল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।]
- ষষ্ঠ মূলনীতি হলো, মানুষ নিজে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। অর্থাৎ, মানুষ হলো মুসতাগনি। সূরা আলাক্ব-এ বলা হয়েছে –
كَلَّا إِنَّ الْإِنسَانَ لَيَطْغَىٰ- أَن رَّآهُ اسْتَغْنَىٰ-
মানুষ নিজেকে যখন মুসতাগনি হিসেবে দেখে, তখন সে তুগইয়ান তথা ভ্রষ্টতায় নিপতিত হয়। সীমানাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে। যখন এই অবস্থায় উপনীত হয় তখন কি হয়? ইন্না ইলা রাব্বিকা রুজয়া। মানুষ যখন নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে তখন সে ফাসাদ সৃষ্টি করে বা সীমালঙ্ঘন করে। তাই মানুষকে এই চিন্তা থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আগেই মুক্তির উপায় দিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, রবের কাছে ফিরে আসতে হবে যেহেতু সীমালঙ্ঘন করেছে।
- মানুষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন যেহেতু সে মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারবে না। এই জন্য তাকে তার রবের কাছে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।
- মানুষ কেন মুসতাগনি নয়? মানুষ মানুষের মুখাপেক্ষী, প্রকৃতির মুখাপেক্ষী, একই ভাবে পয়গম্বর ও আল্লাহর প্রতিও মুখাপেক্ষী। যা আমাদের ভ্রাতৃত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা মুসতাগনি নই। তখন নিজে মুসতাগনির চিন্তায় নিপতিত হবো না।
- ইবাদত আমাদের ইহসানের এর পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এই ক্ষেত্রে যে উবুদিয়্যাত এটা হল মূলত মানুষ যে অমুখাপেক্ষী নয় এটার সর্বোচ্চ চূড়া এবং প্রতিটি ইবাদত বার বার আমাদেরকে এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমি মুসতাগনি নই।
এর উপর ভিত্তি করে রিসালাত, আমানত এবং শাহাদাতের মিসাক এ বিষয়গুলোকে পরিপূর্ণভাবে পড়তে পারলে মুসতাগনি বা স্বয়ংসম্পূর্ণ চিন্তাধারা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আর সকল পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনের মধ্যে একটা বিষয়ই মানুষকে রক্ষা করতে পারে; তা হলো ইসলাম বা ইসলামী মূল্যবোধ।
অনুবাদ ও সংকলনঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ।
[1] এই পরিভাষাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন ইবনে সিনা। মহান আল্লাহ ছাড়া সৃষ্টিজগতের সকল কিছুকে বুঝানোর জন্য এই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
[2] ওয়াজিবুল উজুদ ইসলামী দর্শন ও কালামে বহুল পরিচিত একটি পরিভাষা। এই পরিভাষার উদ্ভাবন করেন ইবনে সিনা। কালাম ও ইসলামী দর্শনে ওয়াজিবুল উজুদ বলতে আল্লাহ রাবুল আলামিনকে বুঝানো হয়ে থাকে।