হযরত আয়েশা (রা.) এর ইলমী হায়াত

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।

সালাম এবং দরূদ মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি। এই প্রবন্ধে আমি কেবল উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা.)-এর গতানুগতিক জীবনচরিত নিয়ে নয়, বরং তাঁর জ্ঞানগত যে জীবনী, তিনি কীভাবে জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং এজন্য কীভাবে তাঁর জীবনকে অতিবাহিত করেছেন, সেসব নিয়ে আলোকপাত করব।

আয়েশা (রা.) পিতা আবু বকর (রা.) এর ঔরসে এবং মাতা উম্মে রুম্মান (রা.)-এর গর্ভ থেকে দুনিয়াতে আগমন করেন। রাসূল (সা.)-এর নিকট ওহী আসার ৫-৬ বছর পূর্বে তাঁর জন্ম। আমি এটা বিশেষভাবে উল্লেখ করছি এজন্য যে, অনেকেই বলে থাকেন আয়েশা (রা.) আল্লাহর রাসূলের (সা.) নবুয়াত প্রাপ্তির পর জন্মগ্রহণ করেন। এমনকি ৬ বছর বয়সে তাঁর আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাথে বিয়ে হয় এবং ৯ বছর বয়সে তাঁর সংসার শুরু করেন। আমি এটা সঠিক মনে করি না এবং এর বিরোধিতা করি। আমি আমার গবেষণার মাধ্যমে আমি প্রমাণ করতে পারবো যে, ছয় বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়নি। যেহেতু তিনি নবুয়তের ৫-৬ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন, এজন্য তিনি যখন আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং সংসার শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮-২০ বছর।

হযরত আয়েশা (রা.) তাঁর পিতা আবু বকরের (রা.) নিকট হতে শিশুকাল থেকেই অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন‌। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে কবিতা, সাহিত্য ও বংশ সংক্রান্ত জ্ঞান। কারণ আবু বকর (রা.) তৎকালীন সময়ে এইসকল বিষয়ে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। শুধু তাই নয়, এইসকল বিষয়ে আবু বকরকে (রা.) মক্কায় পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখা হতো।

আয়েশা (রা.) প্রথম যুগে ঈমান আনয়নকারী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এই কারণে তিনি তাঁর পিতা আবু বকর (রা.) -এর নিকট থেকে কোরআন এবং ওহী সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর বাবার কাছ থেকে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত শুনে যেসকল আয়াতকে বুঝতে পারতেন না, সেগুলো সম্পর্কে আবু বকর (রা.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করতেন। আবু বকর (রা.) জবাব দিতে না পারলে তিনি সরাসরি হযরত পয়গম্বরকে (সা.) জিজ্ঞাসা করতেন, অথচ তখন তাঁর বয়স ছিলো খুবই কম। আর এটি সহজ ছিলো কারণ তাদের ঘর, হযরত পয়গম্বরের (সা.) ঘরের খুবই নিকটবর্তী ছিলো।

আয়েশা (রা.) হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সাথে মদিনায় হিজরতের পরপরই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর জ্ঞানগত জীবন বলতে আমরা যা বুঝি অর্থাৎ তাঁর জ্ঞানের যে সফর; এই সফর পয়গম্বর (সা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর জ্ঞানার্জনের মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সর্বক্ষণ হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সাথে অতিবাহিত করার কারণে তিনি তাঁর এই সময়গুলোকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগান। তাঁর হায়াতের সমগ্রটাই তিনি এভাবে জ্ঞান অর্জনের জন্য ব্যয় করেন এবং এই জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষক ছিলেন রাসূ্লে আকরাম (সা.) স্বয়ং নিজে।

 

আয়েশা (রা.)-র এই জ্ঞান অর্জন করার পিছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে সেটি হচ্ছে- “সুফফা”। আল্লাহর রাসূল (সা.) যেখানে নিয়মিত সাহাবীদের সাথে জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতেন; তা ‘সুফফা’ হিসেবে পরিচিত ছিলো। সেই সুফফাটি ছিলো হযরত আয়েশার (রা.) ঘরের পাশেই। আর এই কারণে রাসূল (সা.) সাহাবীদের সাথে যেসকল আলোচনা করতেন এবং সাহাবীরা তাদের নিজেদের মধ্যেও যেসকল বিষয় আলোচনা করতেন, সেইসকল বিষয় থেকে তিনি উপকৃত হতে পারতেন। ঐ সুফফা ছিলো মূলত মদিনার বিশ্ববিদ্যালয়। আল্লাহর রাসূল (সা.) সমগ্র মানবতাকে জ্ঞান এবং তাঁর উপর নাজিল হওয়া মৌলিক বিষয়সমূহ সমগ্র মানবতাকে শিক্ষা দিয়েছেন; এই সুফফার মাধ্যমেই। সুফফায় যেসকল বিষয়ে দারস হতো আয়েশা (রা.) তাঁর ঘর থেকে সেগুলো শুনতেন। আবার কখনো কখনো তিনি সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত হতেন। যেসব বিষয় তিনি বুঝতে পারতেন না, সেসব বিষয় তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করতেন। আবার নিজেও সেগুলোর গভীরতা নিয়ে গবেষণা করতেন। হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সবচেয়ে নিকটবর্তী যে শিক্ষার্থীগণ ছিলেন, তাদের মধ্যে হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন অন্যতম।

কোরআনের আয়াত সমূহও না বুঝতে পারলে তিনি আল্লাহর রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করতেন। এই জিজ্ঞাসাকে তিনি একটা সংস্কৃতিতে পরিণত করেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) যখন সময় পেতেন, তখন তিনি (আয়েশা) নিজে আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাথে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত নিয়ে আলোচনা করতেন, মুতালাআ’ করতেন। হযরত আয়েশার (রা.) জন্য জ্ঞান সহজকারী বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আয়েশার (রা.) কোনো প্রশ্নকেই আল্লাহর রাসূল (সা.) জবাবহীন রাখতেন না। হযরত আয়েশার (রা.) প্রশ্নগুলো কখনোই শেষ হতো না, কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.) কখনোই বিরক্ত না হয়ে তাঁর সকল প্রশ্নের সুন্দরভাবে জবাব দিতেন। এমনকি রাত্রিবেলায় যখন একসাথে কোথাও যেতেন, তখনও এই সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই তথা জ্ঞানগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন।

এটা বললে অতিরঞ্জিত হবে না যে, সেই কঠিন সংগ্রামের সময়েও হযরত আয়েশার (রা.) জ্ঞানের প্রতি যে আকর্ষণ ও প্রচেষ্টা ছিলো, সেটা অন্য কোনো সাহাবীর মাঝে ছিলো না। একইভাবে হযরত পয়গম্বরের (সা.) মতোও কোনো শিক্ষক ছিলেন না, যারা নবুয়তের কঠিন দায়িত্ব পালনকালেও এত ধৈর্য্যের সাথে তাঁর স্ত্রীর সকল প্রশ্নের জবাব দিতেন। হযরত আয়েশা (রা.) এইভাবে নববী একটি ঘরে প্রতিপালিত হন এবং আল্লাহর রাসূলের (সা.) নিকট থেকে ইসলামের মূলনীতিসমূহকে নিয়ে সেগুলো অন্যান্য মুসলিম নারীদের শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে তিনি মুসলিম নারীদেরকে জ্ঞানের একটি আন্দোলনে শরীক করাতে পেরেছিলেন। একইভাবে হযরত আয়েশা (রা.) হযরত পয়গম্বর (সা.) -এর ওফাতের পর কোরআনের আয়াত সমূহকে বোঝার ও তাফসিরের ক্ষেত্রে এবং ইসলামের যে আইন‌ ও বিধান আছে, সেগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

যেসকল সাহাবীদেরকে আলেম সাহাবী হিসেবে গণ্য করা হতো, হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন তাদের সবচেয়ে অগ্রগণ্যদের মধ্যে একজন। ইসলামের মূলনীতির আলোকে ইসলামকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হযরত পয়গম্বরের (সা.) পর সাহাবীদের মধ্য থেকে বড় একটি অংশ তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এইসকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধুমাত্র পুরুষরাই ছিলেন না বরং নারীরাও তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। হযরত আয়েশা (রা.) হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং ওফাতের পর যে সাতচল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন, তিনি এই সমগ্র সময়কাল জ্ঞান অর্জনের জন্য এবং জ্ঞানকে শিক্ষা দান করার জন্য ব্যয় করেন। তাঁর এই জ্ঞানের আলোকে নতুন একটি ধারা ও নতুন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলেছিলেন। এই কারণে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে হযরত আয়েশার (রা.) ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম।

 

হযরত আয়েশা (রা.) ইতিহাসের পাতায় লিখিত মিথলজি কিংবা কোনো উপখ্যান নয়, এমনকি তিনি শুধুমাত্র আল্লাহর রাসূলের (সা.) একজন স্ত্রীও নন। তিনি একইসাথে ঐতিহাসিক একটি সত্য এবং নারীদের ব্যাপারে ইসলামে যে তাসাওউর রয়েছে, সেই তাসাওউরের সবচেয়ে বড় প্রতিফলিত রূপ হচ্ছেন হযরত আয়েশা (রা.)। হযরত আয়েশা (রা.) আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় যে মিরাস বা উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছেন, তারমধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে – বিভিন্ন সভ্যতা এবং সংস্কৃতি কর্তৃক তৈরিকৃত নারীদের ব্যাপারে যে বিরূপ ধারণা ছিলো, সেগুলোকে সঠিক পন্থায় বিশুদ্ধ করে তিনি আমাদের সামনে তাঁর নিজের জীবনকে উপমার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এটি আমাদের জন্য বড় একটি সম্পদ।

হযরত আয়েশা (রা.) যখন কোনো‌ রেওয়ায়েত বা হাদীস শুনতেন এবং সেটা যদি তাঁর অভিজ্ঞতা, কোরআন ও আকলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হতো, তাহলে সেটা নিয়ে তিনি গবেষণা করতেন এবং এর উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন। এটাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতেন, যেটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি উদাহরণ।

হযরত আয়েশা (রা.) শুধু জ্ঞান অর্জনই করেননি, বরং হাদীস বর্ণনার পাশাপাশি ফতোয়াও দিতেন। সাহাবীদের মধ্য থেকে যে সাতজন শ্রেষ্ঠ ফতোয়া দানকারী সাহাবী ছিলেন, হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন তাদের একজন। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, হযরত উমর (রা.)-এর সময়ে কেবলমাত্র হযরত আয়েশার (রা.) অধিকার ছিলো ফতোয়া দেওয়ার, অন্য কাউকে সেই অনুমতি দেয়া হয়নি। হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.) -এর সময়েও তিনি স্বতন্ত্রভাবে ফতোয়া দান করতেন এবং তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। হযরত আয়েশার (রা.) সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন হযরত মুয়াবিয়া (রা.)। এরপরও তিনি যেসকল বিষয় বুঝতে পারতেন না, সেসকল বিষয়ে জানার জন্য হযরত আয়েশার (রা.) কাছে দূত পাঠিয়ে ফতোয়া এবং সমাধান জেনে নিতেন।

 

হযরত আয়েশা (রা.) শুধু জ্ঞানগত দিক থেকেই একজন অথরিটির অধিকারী ছিলেন না, একই সাথে তিনি হযরত পয়গম্বরের (সা.) সুন্নত ও সীরাতের সঠিক বাস্তবায়ন করেছেন এবং আল্লাহর রাসূলের (সা.) জীবনের বিশেষ বিষয়সমূহকেও তিনি সবচেয়ে সঠিকভাবে, বিশুদ্ধ পন্থায় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর রাতের ইবাদত কেমন ছিলো, তিনি কোন দোয়া সমূহ পড়তেন, কীভাবে পড়তেন, নামাজের মধ্যে কোন ধরনের সূরা পড়তেন, কোন কোন সূরা তিনি বিশেষভাবে পড়তেন, তাঁর বিশেষ বিশেষ উপদেশসমূহ কী ছিলো – এই সকল বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন উম্মুল মু’মিনীন‌ হযরত আয়েশা (রা.)।

মদিনার জীবনে নাজিল হওয়া ওহীর বড় একটি অংশ হযরত আয়েশার (রা.) সামনে আসায় তিনি এর সরাসরি সাক্ষী ছিলেন। এই বিষয়টি হযরত পয়গম্বর (সা.) নিজেই উল্লেখ করেছেন। ওহী আসার সময় হযরত পয়গম্বরের (সা.) শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক কোন কোন বিষয়ে কী কী পরিবর্তন আসতো, তিনি কীভাবে ঘামতেন – এই সকল বিষয় পর্যন্ত আমাদের সামনে উল্লেখ করেছেন আয়েশা (রা.)।

এইসকল বিষয়ের পাশাপাশি হযরত আয়েশা (রা.) সব থেকে ভালো বন্ধু এবং সব থেকে ভালো স্ত্রী হিসেবে আমাদের সামনে উপমা হয়ে আছেন। হযরত পয়গম্বর (সা.) হযরত আয়েশার (রা.) সাথে যে ঘরে বসবাস করতেন, সেটা ছিলো খুবই ছোট একটি ঘর। এই ঘরটি জ্ঞানের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। আয়েশা (রা.) তাঁর সমগ্র জীবনকাল ধরে হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সাথে তাঁর এই জ্ঞান অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও যাত্রাকে জারি রেখেছিলেন। হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। হযরত পয়গম্বর (সা.) -এর ওফাতের পূর্ব মুহূর্তের বিষয়সমূহকেও আমাদের সামনে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাবে বর্ণনা করেন তিনি। ইলাহী ইশারায় হযরত পয়গম্বর (সা.) যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন এ অসুস্থতার সমগ্র সময়কাল হযরত আয়েশা (রা.) তাঁর সবচেয়ে কাছে ছিলেন। এমনকি আমরা সবাই এটা জানি যে, হযরত পয়গম্বর (সা.) তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হযরত আয়েশার (রা.) কোলে। আমরা হযরত আয়েশার (রা.) মাধ্যমে হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সর্বশেষ কথাগুলোও জানতে পারি। তিনি বলেছিলেন যে, “আমি তোমাদের নিকট দুইটি বিষয় রেখে যাচ্ছি। তোমরা যতদিন পর্যন্ত এই দুটি উৎসকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে ততদিন পর্যন্ত তোমরা সত্য ও হেদায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত হবেনা। একটি হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল কোরআন এবং অপরটি হচ্ছে আমার সুন্নত।” তিনি আরও বলেছিলেন, “নামাজ আমার চোখের মণি বা কুররাতু-আইনাইন। এই নামাজকে তোমরা কখনোই পরিত্যাগ করবে না।” একথা বলে তিনি বলেন, “আমি রফিকে আ’লার কাছে চলে যাচ্ছি, তোমরা সবসময় নামাজের প্রতি যত্নবান হবে”।

হযরত পয়গম্বর (সা.) আয়েশা (রা.)-র মেধা ও জ্ঞানের প্রতি প্রচণ্ড স্পৃহা দেখে বলেছিলেন, “তোমরা তোমাদের দ্বীনের অর্ধেক হুমায়রা থেকে নিও”। ‘হুমায়রা’ হচ্ছে হযরত পয়গম্বর (সা.) কর্তৃক হযরত আয়েশাকে (রা.) দেওয়া বিশেষ নাম। তিনি আয়েশা (রা.) কে আদর করে হুমায়রা বলে ডাকতেন। ইফকের ঘটনার কারণে হযরত পয়গম্বর (সা.) তাকে ‘মুবাররা’ নামেও অভিহিত করেন।

 

খাদিজা (রা.), ফাতেমা (রা.) সহ হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর নিকটবর্তী আরও যেসকল মহিলা সাহাবী ছিলেন, তাদের মর্যাদাও অবশ্যই উচ্চে। তবে, জ্ঞানগত দিকে আয়েশা (রা.)-এর মর্যাদা ও অবস্থানের ধারে-কাছেও ছিলেন না কেউ। একজন পয়গম্বরের স্ত্রীর কথা চিন্তা করুন, যিনি পয়গম্বরের ঘরে লালিত-পালিত হয়েছেন এবং যে ঘরে তিনি প্রতিপালিত হয়েছেন সে ঘরটি হযরত পয়গম্বরের (সা.) পরে সমগ্র উম্মাহর জন্য জ্ঞানের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ছোট-বড় কিংবা নারী-পুরুষ, তৎকালীন সময়ের সকল সাহাবী আয়েশার (রা.) এই জ্ঞানের মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন।

সাহাবীগণ আয়েশা (রা.)-এর ব্যপারে বলতেন – “আমাদের কাছে যেসকল বিষয় কঠিন মনে হতো, বুঝতে পারতাম না, সেগুলো আমরা হযরত আয়েশার (রা.) কাছে জিজ্ঞাসা করে সঠিক জবাব পেতাম”। আয়েশা (রা.) হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর ওফাতের পর প্রতি বছরই হজ্জে যেতেন এবং তিনি তাঁর চাদরটিকে হেরা গুহা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে স্থাপন করতেন। সেই চাদরে বসে মূলত তিনি শিক্ষা দান করতেন। বিভিন্ন অঞ্চল, দেশ ও শহর থেকে হজ্জে আগত অনেক মানুষ সেই চাদরের সামনে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করতেন। যেসব বিষয় তারা বুঝতে পারতেন না বা সমাধান করতে পারতেন না, সে সমস্ত বিষয় আয়েশা (রা.) থেকে শিখে নিতেন। আয়েশা (রা.) শুধুমাত্র মক্কা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী কিংবা হজ্জে আগমনকারী ব্যক্তিদের প্রশ্নের জবাব দিতেন না, একইভাবে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর নিকট আগত চিঠিরও জবাব দিতেন চিঠির মাধ্যমে। তাঁর সেই সমস্ত চিঠি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, কিছু কিছু আলেম সেই চিঠিগুলোকে একত্রিত করে গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেছেন এমনকি সেগুলো আমাদের পর্যন্তও এসে পৌঁছেছে।

হযরত আয়েশা (রা.) চিঠি লেখার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ লিখতেন। এরপর লিখতেন, “হাবিবুল্লাহর ভালোবাসার এবং আবু বকর (রা.)-এর কন্যা মুবাররা আয়েশার পক্ষ থেকে” – এভাবে তিনি তাঁর চিঠি শুরু করতেন। কোরআন হযরত আয়েশাকে (রা.) পবিত্র বলে ঘোষণা দেওয়ায় তিনি এই লকবটাকে সবসময় ব্যবহার করতেন। হযরত আয়েশার (রা.) অন্যতম আরেকটি অবদান হচ্ছে, হযরত পয়গম্বর (সা.) -এর নিকট থেকে যেসকল হাদীস এসেছে এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সহীহ হাদীস এসেছে হযরত আয়েশার (রা.) পক্ষ থেকে। তাঁর রেওয়ায়েতকৃত এই সহীহ হাদীসের সংখ্যা কিছু উৎস মতে ২২১০ টি, আবার কিছু উৎস মতে ২৪১০ টি।

 

হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে হযরত আয়েশার (রা.) অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো, তিনি সকল হাদীসই “হযরত পয়গম্বর (সা.) থেকে শুনেছেন” – এভাবে বলে বর্ণনা করেননি। তিনি যেসকল রেওয়ায়েত সরাসরি নিজে শোনেননি, সেসকল রেওয়ায়েত বর্ণনা করার সময় তিনি সর্বপ্রথম এর উৎস নিয়ে গবেষণা করতেন, এরপর মতন নিয়ে গবেষণা করতেন। পাশাপাশি কোরআনের নিকট পেশ করে যদি কোরআন ও আকলের আলোকে সেটাকে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবতেন, তাহলে সেটা বর্ণনা করতেন।

হযরত আয়েশা (রা.) অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে মুখস্থ করার প্রখর শক্তি দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি কোনো বিষয়কে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে স্মৃতিতে ধারণ করতে পারতেন। তিনি একইসাথে অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। যার কারণে মানুষ খুব সহজেই তাঁর কথা দ্বারা প্রভাবিত হতো। তিনি বালাগাত এবং ফাসাহাতের দৃষ্টিকোণ থেকে আরবি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ উপমার একজন।

তাঁর পিতা হযরত আবু বকর (রা.) ইন্তেকাল করলে তাকে দাফনের পর তিনি বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে খুতবা পেশ করেন ও দোয়া করেন। একইভাবে যুদ্ধের প্রাক্কালে, যেমন আমাদের ইতিহাসে ‘জঙ্গে জামাল’ হিসেবে পরিচিতি ঘটনার ক্ষেত্রেও তিনি বালাগাত এবং ফাসাহাতের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই উচ্চ মানের একটি খুতবা পেশ করেন। “বালাগাতুল নিসা” নামে একটি গ্রন্থ আছে, যেখানে হযরত আয়েশার (রা.) দেওয়া বিভিন্ন খুতবা ও বক্তব্য লিপিবদ্ধ আছে।

 

হযরত আয়েশার (রা.) আরেকটি গুণ হচ্ছে, তিনি অনেক কবিতা মুখস্থ পারতেন। বলা হয়ে থাকে, আরবী সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ইয়াবিদের এক হাজার লাইনের কবিতা তিনি মুখস্থ করেছিলেন। তিনি নিজেও কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি অনেক বেশি জোর দিয়েছিলেন। একইভাবে শিশুদেরকেও কবিতা ও সাহিত্য শিক্ষা দেওয়ার ব্যপারে অনেক বেশি জোর দিতেন। তিনি আমাদের উপদেশ দিয়েছেন যে, “তোমরা তোমাদের শিশুদেরকে কবিতা ও সাহিত্য শেখাও, যাতে তাদের ভাষা সুন্দর হয়”।

হযরত আয়েশাকে (রা.) অন্য মহিলা সাহাবীদের থেকে পৃথককারী কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সেগুলো হচ্ছে,

  • হযরত আয়েশা (রা.) ছাড়া কোরআনের আয়াতসমূহকে ব্যাখ্যাকারী অন্য কোনো মহিলা সাহাবী আমরা দেখতে পাই না।
  • হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর কথা ও কোরআনের আয়তসমূহকে আকল ও বুদ্ধির মাধ্যমে ভিত্তি স্থাপন এবং যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার সূচনা বলতে গেলে তিনিই করেছিলেন।

অনেক বড় বড় আলেমগণ হযরত আয়েশার (রা.) সুস্পষ্ট যে গুণাবলিগুলো ছিলো, সেগুলোকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরেন।

হযরত আয়েশার (রা.) ইস্তিদরাক তথা আপত্তিসমূহকে নিয়ে গবেষণাকারী ইমাম জারকাশি তার “ইস্তিদরাকু উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা” নামক গ্রন্থে বলেন, “হযরত আয়েশা (রা.) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো সাহসী এবং ভীতিহীন একজন নারী ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনী বা যুদ্ধ পরিচালনার মতো নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন।”

 

আহমদ ইবনে হাম্বল বলেন, আহলে বায়াতের মধ্যে হযরত আয়েশার (রা.) শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। হযরত আয়েশাকে (রা.) সবচেয়ে বেশি ভয় পেতেন এবং তাঁর সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন হযরত মুয়াবিয়া (রা.)। তিনিও হযরত আয়েশার (রা.) জ্ঞানের অনেক সম্মান ও প্রশংসা করতেন। একদিন মুয়াবিয়া (রা.) তার আশেপাশে থাকা ব্যক্তিদেরকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমাদের মতে সবচাইতে বড় আলেম কে?’ তারা জবাব দেয়, “আপনি হচ্ছেন সব থেকে বড় আলিম”। তখন মুয়াবিয়া (রা.) আবার জিজ্ঞেস করেন, “সত্য কথা বলো, কে সবচেয়ে বড় আলেম?” তখন সকলে বলে ওঠে “হযরত আয়েশা (রা.)”।

আবু সালামা (রা.) হযরত আয়েশার (রা.) মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সুন্নত ও ইসলামের বিধানকে এবং আল্লাহর রাসূলের উপর অবতীর্ণ হওয়া আয়াতসমূহকে ও অন্যান্য সকল জ্ঞানকে হযরত আয়েশার (রা.) চেয়ে কেউ ভালো জানে না”।

ইমাম ইবনুল কাইয়ুম এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়া হযরত আয়েশা (রা.) সম্পর্কে বলেন, “আখিরাতে একজন মানুষের ফজিলত কী হবে যদি এ বিষয়ে বলতে চাই, তবে এটা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জানেন না। যদি বংশ মর্যাদার দিক থেকে বিবেচনা করি, তবে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন ফাতিমা (রা.), কারণ তিনি হযরত পয়গম্বরের (সা.) মেয়ে। যদি ঈমানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তবে ইসলামের প্রথম যুগে ইসলাম যে কঠিন সমস্যার মোকাবেলা করেছে সেই সমস্যার ক্ষেত্রে হযরত পয়গম্বরকে (সা.) সবচাইতে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন হযরত খাদিজা (রা.) – এই ক্ষেত্রেও কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু আপনারা যদি আমলের পরিপূর্ণতা, দ্বীনের খেদমত এবং হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সুন্নতকে সমগ্র মানবতার নিকটে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কাউকে সবচেয়ে বেশি শ্রেষ্ঠ হিসেবে দেখে থাকেন, তিনি হচ্ছেন হযরত আয়েশা (রা.)।”

অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম শাওকানি বলেন, “হযরত আয়েশা (রা.) মুমিন নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ‌ ছিলেন। তিনি তাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে গভীর শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাদেরকে আদব শিক্ষা দিয়েছেন।”

ইমাম জুহুরি হযরত আয়েশা (রা.) সম্পর্কে বলেন, “যদি জ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত আয়েশাকে (রা.) এক পাল্লায় রাখা হয় এবং অপর পাল্লায় যদি হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর অন্যান্য সকল স্ত্রী ও সকল মহিলা সাহাবীকে রাখা হয়, তবুও হযরত আয়েশার (রা.) পাল্লা ভারী হবে।”

মুস্তাদরাক নামক গ্রন্থে বলা হচ্ছে, “যদি এই উম্মতের সকল নারীদের জ্ঞান একত্রিত করা হয়, তবু তাদের সকল জ্ঞান হযরত আয়েশার (রা.) জ্ঞানের সমতুল্য হবেনা।”

 

পাশ্চাত্যের একজন গবেষক স্পলবার্গ হযরত আয়েশার (রা.) জীবন নিয়ে গবেষণা করেন এবং তাঁর জীবনী লিখেন। তার এই গবেষণার নাম “রাজনীতি, লিঙ্গবাদ ও ইসলামের অতীত”। তার এই গবেষণার জন্য পুরষ্কারও লাভ করেন তিনি। স্পলবার্গ এই পুরস্কার গ্রহণের সময় বলেন, “এই পুরস্কারটি আমাকে দেওয়া হয়নি, বরঞ্চ হযরত আয়েশাকে (রা.) দেওয়া হচ্ছে। কারণ তিনি নারীদেরকে অসাধারণভাবে প্রতিনিধিত্ব করে অন্ধকার যুগে সমগ্র নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন।” এ কারণে হযরত আয়েশা (রা.) শুধুমাত্র মুসলমানদের মধ্যেই নয়, সমগ্র মানবতার পক্ষ থেকে যারা সুস্থ বিবেকের অধিকার্‌ তাদের কাছে তিনি প্রশংসিত হয়েছেন।

উম্মাহর বিখ্যাত আলেম মূসা জারুল্লাহ হযরত আয়েশা (রা.) সম্পর্কে বলেন, “মদিনার জীবনে রাসূল (সা.)-এর পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র ছিলেন হযরত আয়েশা (রা.)। তৎকালীন সময়ে তিনি যে ঘরে বসবাস করতেন, সে ঘরে সবচেয়ে বেশি আয়াত নাজিল হয়। মদিনার প্রত্যেকটি সময়কে তিনি খুব কাছ থেকে অবলোকন করেন। তার স্বচক্ষে দেখে, পর্যবেক্ষণ করে যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, সে জ্ঞানকে তিনি পরবর্তীতে সাহাবীদের নিকটে এমনকি সমগ্র মানবতার নিকটে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে হযরত আয়েশা (রা.) মুজতাহিদগণের ইমাম এবং উম্মুল মু’মিনীনের মর্যাদা লাভ করেছেন। একইসাথে তিনি ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি হিসেবে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত করতে সক্ষম হয়েছেন।”

এ বিষয়ে তুর্কির অন্যতম বিখ্যাত একজন আলেম যিনি এখনও বেঁচে আছেন, সাইয়্যিদ হাতিবওলু বলেন, “আমাদের এমন মানুষের প্রয়োজন যারা ইসলামী সংস্কৃতি, ইসলামী সভ্যতাকে হযরত আয়েশা (রা.)-এর দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের সামনে উত্থাপন করবেন, আমাদের সামনে তুলে ধরবেন। এ ধরণের মানুষের আজ অনেক বেশি প্রয়োজন।”

এজন্য, পুরুষ হোক কিংবা নারী, একজন মানুষ যে নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে, তার উচিৎ- হযরত আয়েশা (রা.)-এর জ্ঞানগত রেখে যাওয়া মিরাস সম্পর্কে অবগত হওয়া, এটা নিয়ে গবেষণা করা এবং তা সমগ্র মানবতার সামনে তুলে ধরা।

 

আমরা যদি উপরোক্ত সম্পূর্ণ আলোচনাকে পর্যালোচনা করি তাহলে বলতে পারি যে, হযরত আয়েশা (রা.) ওহীর জীবন্ত সাক্ষী ছিলেন। কোরআনের আয়াত নাজিল হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি শানে নুযুল হয়েছেন। ওহী নাজিল হওয়ার সময় হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর প্রতিটি ক্ষণকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। এমনকি ওহীর একটি অংশ নাজিল হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন: তায়াম্মুম সংক্রান্ত আয়াত, ইফকের ঘটনার আয়াত, সূরা তাহরীমের একটি অংশ হযরত আয়েশা (রা.) কে কেন্দ্র করে নাজিল হয়।

এমনকি কুরআনের আয়াতসমূহের একটি বড় অংশ তিনি নিজে তাফসীর করেছেন। যখন তিনি কোনো ধরনের ভুল কিংবা অসম্পূর্ণ কোনো কিছু শুনতেন, সেগুলোকে তিনি কুরআন, হাদীস এবং তার জ্ঞানের মাধ্যমে সংশোধিত করে নতুনভাবে উত্থাপন করতেন। তার স্বামী হযরত পয়গম্বর (সা.) এর সাথে কোরআনসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে আমাদের তিনি দেখিয়েছেন যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন ধরনের কথা হতে পারে বা কোন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে; এ উপমাও তিনি আমাদের সামনে পেশ করেছেন।

সংক্ষেপে বলতে গেলে হযরত আয়শা (রা.) সিদ্দিকের মেয়ে, “সিদ্দিকা”; রাসুল (সা.) এর প্রিয়তমা, “হুমায়রা” – কুরআনে কারীমের মধ্যে যার সম্পর্কে আয়াত নাজিল হয়েছে। তাকে যে অপবাদ দেয়া হয়েছিল, কুরআন এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কুরআনের মাধ্যমে তিনি “মুবাররা” হিসেবে উম্মাহ’র নিকটে পরিগণিত হয়েছিলেন। একইভাবে তিনি তার জীবদ্দশায় অনেক এতিমকে প্রতিপালন করেছেন, লালন-পালন করেছেন। অনেক যুবকের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন; তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বড় বোনের ভূমিকা পালন করেছেন। এভাবে তিনি একজন দয়াশীল নারী হিসেবে সকলের অন্তরে স্থান করে নিয়েছিলেন।

 

তিনি প্রায় ৭৬ বছর এ পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন। তার এই জীবনের বড় একটি অংশ ব্যয় করেছেন তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্য, জ্ঞান দানের জন্য। এক্ষেত্রে তিনি অনুপম একজন শিক্ষার্থী এবং অনুপম একজন জ্ঞানসম্রাজ্ঞী বা শিক্ষিকা হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে তার স্থানকে দখল করে নিয়েছেন। ইসলামের বড় বড় আলেমদের ভাষায়, “হযরত পয়গম্বর (সা.) কর্তৃক আমাদের জন্য রেখে যাওয়া সবচেয়ে বড় মিরাসের একটি হচ্ছে হযরত আয়েশা (রা.)”। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে হযরত পয়গম্বর (সা.) কর্তৃক রেখে যাওয়া এই মিরাসকে ধারণ করা, এই মিরাস থেকে উপকৃত হওয়া।

হযরত আয়েশা (রা.) হচ্ছেন- একজন নারী কীভাবে জ্ঞানে, গুণে সমৃদ্ধ হতে পারে তার সবচেয়ে বড় উপমা। কেউ কেউ যেমন বলে থাকে, তিনি শুধুমাত্র খুব অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া একজন ছোট্ট নারী, তিনি তেমনটি নন। আবার, যেভাবে বিভিন্ন কিতাবে লেখা হয়ে থাকে তিনি তার স্বামীকে ঈর্ষাকারী, এমন কোন নারীও তিনি নন! এবং এরকম কোন নারীও নন, যেমনটা আমাদের সামনে তাকে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়ে থাকে। একইভাবে আমাদের মাসয়ালা-মাসায়েলের গ্রন্থে যেভাবে লেখা হয়ে থাকে যে, আল্লাহর নবীগণ এইজন্য বিবাহ করেছেন, যাতে করে তারা তাদের নারীদের জীবনকে পরবর্তীতে অন্য নারীদের সামনে তুলে ধরতে পারেন; সেই সকল বিষয়কে উত্থাপনকারী বা তুলে ধরা একজন নারীও তিনি ছিলেন না।

তিনি মূলত সকল বিষয়ে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপমা। তার সমগ্র জীবনকাল ধরে মু’মিন নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের অধিকারকে তিনি সংরক্ষণ করেছেন। একজন মু’মিন নারী একজন মু’মিন পুরুষের মতই ব্যক্তিত্ববান হতে পারে, সাহসী হতে পারে, এমনকি জ্ঞানীও হতে পারে – এটা তিনি তার জীবনের মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রমাণ করেছেন, উত্থাপন করেছেন।

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের নিকট এই কামনা করি, হযরত আয়েশা (রা.) আমাদের জ্ঞানের সফরে অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা পালন করুন। হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর সাথে তাঁর যে আচরণ ছিল, যে সম্পর্ক ছিল, তা যাতে আমাদের ঘরের সুন্নত হিসেবেও প্রবর্তিত হয়, এই প্রত্যাশাও করি। সর্বোপরি মহান রব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদেরকে হযরত আয়েশা (রা.)-এর প্রতিবেশি হওয়ার এবং তার পথে যাত্রাকারী একেকজন ব্যক্তি হিসেবে পরিণত হওয়ার জন্য কবুল করেন। একইসাথে হযরত আয়েশা (রা.)-কে একজন উপমা হিসেবে গ্রহণ করার এবং তার জীবনকে আমাদের জীবনে অনুসরণ করার তাওফিক যেন আল্লাহ দান করেন, আল্লাহুম্মা আমীন।।

 

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

৯৬১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top