ইবনে খালদুনের পরিচয়
ইবনে খালদুনের পূর্ণ নাম হল, আবু যায়েদ ওয়ালীউদ্দিন আব্দুর রহমান। তিনি ৭৩২ হিজরি সালের পহেলা রমজান, ১৩৩২ সালে তিউনিশিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের বড় একটি অংশ উওর আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবাহিত করেন।
এর পর তিনি আন্দালুসিয়াতে যান এবং সেখানে একটি সময়কাল ধরে অবস্থান করেন। সেখান থেকে আবার তিনি তিলিমসানে আসেন সেখান বসবাস করেন।
তাঁর নিজের জীবন অনেক ঘটনাবহুল এবং তিনি যে সময়ে বসবাস করেন সেই সময়ে ঐ সকল অঞ্চল ছিল রাজনৈতিকভাবে খুবই অস্থিতিশীল। খমতার পালাবদল খুব দ্রুত হচ্ছিল। এই অস্থিতিশীলতার সময়ে ইবনে খালদুনও বিভিন্নভাবে প্রভাবত হন। ইবনে খালদুনের অন্যতম একটি অন্যতম একটি বিষয় হল তিনি তাঁর জীবনীকে অসাধারন ভাবে লিপিবদ্ধ করেন। যা আমাদের মুসলিম আলেমদের মধ্যে খুবই বিরল।
ইবনে খালদুন আমাদের জন্য কেন গুরুত্ত্বপূর্ণ?
ইবনে খালদুনের সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, তিনি ইমাম ফখরুদ্দিন রাযীর মেটাফিজিক্সকে ঐতিহাসিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন এবং ইতিহাস ও সামাজিক ক্ষেত্রকে এক ধরণের সামাজিক মেটাফিজিক্স হিসেবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ইবনে খালদুনের কাজকে আমরা সামাজিক মেটাফিজিক্স বলে থাকি তবে অনেকেই সেটাকে সামাজিক বা সোসাল অন্টলজি নামেও অভিহিত করে থাকেন। বর্তমান সময়ে যদিও সোসাল অন্টলজি-নামক পরিভাষাটি বেশী প্রসিদ্ধ।
তাঁর রচিত গ্রন্থ সমূহ
ইবনে খালদুন কর্তৃক রচিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশী নয়। তাঁর সবচয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হল কিতাবুল ইবার। একথা বলা যায় যে কিতাবুল ইবার তিনটি অধ্যায়ের সমন্বয়ে গঠিত। তবে এটাকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বলা যায় যে এটি চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। একটি হল গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় যেটাকে তিনি মুকাদ্দিমা হিসেবে রচনা করেছেন। পরবর্তীতে যা আলাদা গ্রন্থ হিসেবে রচিত হয় এবং মুকাদ্দিমা নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। অপর দুই অধ্যায়ে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তিনি দুনিয়ার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। চতুর্থ অধ্যায় নামে অভিহিত করতে পারি সেটা হল তাঁর নিজের আত্মজিবনী এটাকে তিনি বিশ্বের ইতিহাসের সর্বশেষ অধ্যায় হিসেবে যুক্ত করেন। কেউ যদি তাঁর জিবনী সংক্রান্ত এই গ্রন্থটি হাতে নিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন তাহলে তাঁর কাছে মনে হবে যে তিনি যেন সমগ্র দুনিয়ার ইতিহাসকে তিনি যে সময়ে বসবাস করেছেন সেই সময় ও তাঁর জীবনকালকে ব্যাখ্যা করার জন্য রচনা করেছেন।
তবে এটা যদি ইতিহাসকে দেখার একটি দৃষ্টিভঙ্গী হয়ে থাকে তাহলে দেখা যায় যে ইতিহাস তাঁর নিজের জন্য অর্থবহ হওয়ার চেয়ে বর্তমানকে বুঝার জন্য। অর্থাৎ ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের গুরুত্ত্ব অবশ্যই আছে তবে সেটার দ্বারা যদি বর্তমানকে বুঝা যায় তাহলে সেটা বেশী গুরুত্ত্বপূর্ণ।
ইবনে খালদুনের চিন্তাধারা
ইবনে খালদুনকে যে বিষয়টি অমরত্ব দান করেছেন বা বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাসংগিক করে তুলেছে সেটা হল জ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম বারের মত সোসাল অন্টলজির প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, সমাজকে স্বতন্ত্র একটি সত্ত্বা হিসেবে গ্রহণ করে, সে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটার মূল ক্যাটাগরি সমূহকে বিবেচনায় নিয়ে সিস্টেম্যাটিকভাবে বিশ্লেষণ করা।
ইবনে খালদুন এই তত্ত্বকে দাঁড় করানো সময় তাঁর পূর্বের বড় বড় চিন্তাবিদগণের নিকট থেকে উপকৃত হয়েছেন। তিনি তাঁর পূর্বের মাসউদী, তাবারী, মাতুরিদি সহ অনেক চিন্তাগণের চিন্তাদ্বারা প্রভাবিত ছিলেন তবে তাঁর এই সমাচিন্তার ক্ষেত্রে যিনি সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছেন তিনি হলেন ইমাম মাওয়ারদী। তবে অন্যান্য চিন্তাবিদগণ থেকে ইবনে খালদুনকে যে বিষয়টি স্বাতন্ত্রতা দান করেছে সেই বিষয়টি হল, তাঁর ব্যবহৃত আসাবিয়াত নামক পরিভাষা ও এই আসাবিয়াত নামক পরিভাষাকে বিবেচনায় নিয়ে সমাজের অস্তিত্বকে বায়োলজিক্যাল (জীবতাত্ত্বিক) দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করেন এবং এর সাথে ধাপে ধাপে আবেগ, চিন্তা ও ইরাদা (ইচ্ছা) কেও এর মধ্যে সম্পৃক্ত করে আরও মিশ্র একটি পদ্ধতি দাঁড় করান।
ইবনে খালদুন ও মাওয়ারদীর সম্পর্কের আরেকটি দিক হল উমরান নামক পরিভাষার উপর ভিত্তি করে। ইবনে খালদুন এই পরিভাষাটিকে মাওয়ারদী থেকে নিয়েছেন তবে আকল ও জ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়কে নিয়ে আলোচনা করার সময় তিনি ইমাম গাজ্জালী, ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি এবং মাওয়ারদী সহ আরও অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ চিন্তাবিদগনের নিকট থেকে সাহায্য নিয়েছেন।
ভবিষ্যৎকে তিনি যেভাবে প্রভাবিত করেছেন
ইবনে খালদুন তাঁর পরবর্তী সময়ের চিন্তা ও চিন্তাবিদের অনেককেই ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছেন। বিশেষ করে তাঁর পরে আসা চিন্তাবিদগণ ইবনে খালদুন থেকে অনেক বেশী উপকৃত হয়েছেন। উসমানী খেলাফতের সীমানার মধ্যে বসবাসকারী আলেমগণ সহ সমগ্র দুনিয়ার চিন্তাবিদগণ ব্যাপকভাবে উপকৃত হন।
ইবনে খালদুন কর্তৃক শুধুমাত্র মুসলমানগণ কিংবা ইসলামী চিন্তাধারাই প্রভাবিত হয়নি, একই সাথে পাশ্চাত্য চিন্তাদর্শনও অনেক বেশী উপকৃত হয়েছে। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদগণ কর্তৃক রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান নিয়ে লিখিত চিন্তা সমূহকে যদি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে ইবনে খালদুনের সাথে তাদের চিন্তার মধ্যে অনেক সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
তবে এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা হুবুহু তাঁকে কপি করেছে, আমরা বুঝাতে চাচ্ছি যে ইবনে খালদুনের চিন্তার সাথে অনেক সাদৃশ্যতা রয়েছে।
সাধারণভাবে যদি আমরা ইবনে খালদুনের গুরুত্ত্বকে তুলে ধরতে চাই, তাহলে আমরা এই কথা বলতে পারি যে, ইবনে খালদুন ইতিহাস দর্শন এবং একই সাথে সমাজ দর্শনের ক্ষেত্রে বড় চেয়ে বড় চিন্তাবিদ।
ইবনে খালদুনকে যদি আমরা বর্তমানে খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই যে আমরা যে সকল সমস্যার সম্মুখীন সে সকল সমস্যার সমাধান কল্পে একই সাথে থিওরী তৈরি করার ক্ষেত্রে আবার একই সাথে সমাধান তৈরি করার ক্ষেত্রে এবং অতীতের ঘটনা বুঝার ক্ষেত্রে অনেক সহাইয়ক হবে। অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বুঝার দৃষ্টিকোন থেকে ইবনে খালদুন আমাদের জন্য অনেক বড় একটি ইলহামের উৎস হতে পারেন।।
অনুবাদ: বুরহান উদ্দিন আজাদ