আবুল হাসান আল মাওয়ার্দী ৯৭২ সালে বর্তমান ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৪৫০ হিজরীতে (১০৫৮) সালে বাগদাদে মৃত্যু বরণ করেন। ইসলামী চিন্তার ইতিহাসের পর্যায়কালের আলোকে চিন্তা করলে তিনি ক্লাসিক যুগের দ্বিতীয় পর্যায় তথা শ্রেণী বিন্যাস ও সুবিনস্তকরণের সময়কালের একজন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। ইসলামী চিন্তার ইতিহাসে যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ শীর্ষে রয়েছেন তিনি তাদের একজন।
তবে যদি মাওয়ার্দীর চিন্তা ও দর্শনকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত চিন্তাবিদ রয়েছেন তাদেরকে যদি তাদের ফিল্ডের আলোকে বিবেচনা করা হয় তাহলে সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিখ্যাত দশ জনের একজন।
আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দীকে বর্তমান সময়ে ভুল ভাবে তুলে ধরার কারণে, আমি মাওয়ার্দীর অজানা বিষয় সমূহ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
প্রথমেই মাওয়ার্দী যে যুগে বসবাস করেছেন সেই যুগ নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। মাওয়ার্দী এমন সময়ে বসবাস করেন যখন উসূলে ফিকহকে সুবিন্যস্ত ভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। এই সময়ে উসূল সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করা হয়। তার এক শতাব্দী পূর্বের সময় তথা ৩৫০-৪০০ হিজরীকে ইলমূল কালামের যুগ বলে ধরা হয়। এই যুগেই ইলমূল কালামের সবচেয়ে বড় বড় গ্রন্থ সমূহ লেখা হয় এবং ইলমুল কালামকে সুবিন্যস্ত ভাবে আলেম সমাজের সামনে তুলে ধরা হয়। এর পূর্বের শতাব্দী তথা ২৫০-৩৫০ হিজরী সালে হাদীস শাস্র নিয়ে বেশী কাজ হয় এবং হাদীসের বড় বড় ইমামগণ এই সময়েই তাদের গ্রন্থ সমূহ রচনা করেন।
ইসলামী চিন্তার ইতিহাসের দৃষ্টিকোন থেকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, প্রথমে যে সকল গ্রন্থ লেখা হয় সেগুলো ছিল রেওয়ায়েত ভিত্তিক এবং পরবর্তীতে লিখিত গ্রন্থ সমূহ ছিল দিরায়েত ভিত্তিক। বিশেষ করে ইলমুল কালাম ও সিস্টেমেটিক চিন্তা সম্পর্কিত বই সমূহ লেখা হয়। এই দুইটি জ্ঞান একটি অবস্থানে পৌঁছালে উসূলে ফিকহ একটি অবস্থানে পৌঁছে। আবুল হাসান আল-মাওয়ার্দী এই শতাব্দীতেই বসবাস করেন।
রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে কিছু কিছু সমস্যা শুরু হওয়া আরম্ভ হয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা আস্তে আস্তে গ্রহণযোগ্যতা হারানো শুরু করে। আল-মাওয়ার্দী এই সময়ে বসবাস করেন। তিনি ছিলেন অনেক বড় একজন ফকিহ এবং একই সাথে তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।
তাই বই পুস্তকে সমূহে দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, তাই লেখা বই সমূহের বড় একটি অংশ ফিকহ সম্পর্কে এবং রাষ্ট্রপরিচালনা ও সরকার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। তবে তার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হল ‘أدب الدين والدنيا’ (আদাবুদ দ্বীন ওয়াদ দুনিয়া)। এটা সমাজ গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে লেখা একটি বই, যদি বর্তমানের জনপ্রিয় ভাষায় বলতে বলি তাহলে সমাজ বিজ্ঞানের থিওরী সম্পর্কে লেখা আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। আমি একটু আগেই উল্লেখ করেছি যে, তিনি একজন কাজী বা বিচারক ছিলেন, ফিকহ সম্পর্কে লেখা তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল ‘الحاوي الكبير’ (আল-হাবি উল কাবীর)। উসূলে ফিকহ নিয়ে আল-মাওয়ার্দীর আলাদা কোন গ্রন্থ না থাকলেও তিনি তার এই ‘الحاوي الكبير’ (আল-হাবি উল কাবীর) নামক গ্রন্থে উসূল নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। সেই দৃষ্টিকোন থেকে উসূলে ফিকহের ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের একজন।
‘الحاوي الكبير’ (আল-হাবি উল কাবীর) অনেক বড় একটি গ্রন্থ, এই গ্রন্থটি মূলত তার পূর্বে লিখিত একটি গ্রন্থের ব্যাখা। তবে এটি অন্য একটি গ্রন্থের ব্যাখা হলেও আল মাওয়ার্দী অনেক নতুন বিষয়ের অবতারণা করেছেন এবং সেই সকল বিষয়ে বিস্তর ব্যাখা পেশ করেছেন। এই জন্য এই বইটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীতে এসে মাওয়ার্দীর গ্রন্থ সমূহকে বারংবার ইউরোপীয়ান ভাষায় বিশেষ করে ফরাসী ভাষায় অনুবাদ হওয়া শুরু হলে তিনি জগতজুড়ে ব্যপক পরিচিত লাভ করেন। এর পাশাপাশি তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল আহকামুস সুলতানিয়া নামক গ্রন্থকে ইসলামী রাজনীতির ডকট্রিনাল গ্রন্থ হিসেবে তুলে ধরা হয়। তার এই গ্রন্থে ঐ সময়ের খিলাফতের গ্রহণযোগ্যতার সমস্যাকে সিস্টেম্যাটিকভাবে তুলে ধরে খিলাফতকে গ্রহণযোগ্য একটি পন্থা ও পদ্ধতি বলে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। সেই সময়ে সৃষ্ট সমস্যা সমূহকে কিভাবে সমাধান করতে হবে সেই সকল সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি কিছু প্রস্তাবনাও পেশ করেন।
এছাড়াও আদাবুল ওজীর (মন্ত্রীর আদব) নামে একটি বই রয়েছে। এই বইয়ে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান বা খলিফার চেয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গদের কোন কাজ কিভাবে করা প্রয়োজন, এই ব্যপারে তিনি গুরত্ত্বপূর্ণ পরামর্শ ও প্রস্তাবনা প্রদান করেন। এটাও তার গুরুত্বপূর্ণ একটি বই।
তবে মাওয়ার্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল, “ أدب الدين والدنيا “ (আদাবুদ দ্বীন ওয়াদ দুনিয়া)। তার এই গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, মানুষকে সামগ্রিক ভাবে বুঝে তার পর পর্যায়ক্রমে মানুষ কিভাবে আকলী একটি সৃষ্টি হবে অথবা কিছু সম্ভাবনা নিয়ে দুনিয়ায় আসার পরে, তাকে দেওয়া সম্ভাবনা সমূহকে কিভাবে উন্নত করে দুনিয়াকে কিভাবে বিনির্মাণ করেছে এবং দুনিয়াকে বিনির্মাণ করার সময় কোন ধরণের সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করেছে? সে যে সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নতুন সম্ভাবনাকে কিভাবে সৃষ্টি করেছে ? কোন কোন সম্ভাবনাকে মানুষ কাজে লাগাতে পারেনি এবং সেই সকল সম্ভাবনাকে কাজে না লাগানোর কারণে মানুষকে কোন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে? এই সকল বিষয়কে তিনি খুব সুন্দর ভাবে রূপায়ন করেছেন।
তার এই গ্রন্থের অধ্যায় সমূহের দিকে যদি ভালোভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায় যে, তিনি তার এই গ্রন্থকে আকলের মাধ্যমে শুরু করেন। العقل الغريزي (আকলুল গারিযি ) العقل المكتسب (আকলুল মুকতাসাব) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই ক্ষেত্রে তিনি বলেন, العقل المكتسب (আকলুল মুকতাসাব) মূলত العقل الغريزي (আকলুল গারিযি ) কে ব্যবহার করার মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। এবং এটি এত বেশী সম্প্রসারিত ও বিস্তৃত হতে পারে যে, যার কোন সীমানারেখা নেই। অর্থাৎ মুকতাসাব আকলের কোন সীমানা নেই। তিনি বলেছেন যে, মানুষের আকলকে নির্দিষ্ট কিছু ফর্ম বা ধরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। মানুষের আকল যে সম্প্রসারিত ও উন্নত হতে পারে এমন একটি বিষয় হিসেবে তিনি আকলকে তুলে ধরেন। এই দৃষ্টিকোন থেকে ভাষা এবং দ্বীন মানুষের আকলকে কিভাবে উন্নত ও বিস্তৃত করে, একই সাথে তাকে কিভাবে নতুন নতুন মাত্রা দান করে এই বিষয়কে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন।
এর মাধ্যমে মূলত তিনি একটি বিষয়কে উল্লেখ না করেই সমাধান করেছেন। সেই বিষয়টি হল আকল ও নাকল, দ্বীন ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোন বিরোধ আছে কিনা এই সকল বিষয়কে উল্লেখ না করেই তিনি এর সমাধান দিয়েছেন। আমরা অনকে সময় আকল ও নাকলের মধ্যকার সম্পর্ক কি? দ্বীন কি বিজ্ঞানের উন্নতির পথে অন্তরায় কিনা এই সকল বিষয় নিয়ে বিতর্ক করে থাকি। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, আকল কে ভালোভাবে বুঝতে পারলে এই সকল বিষয়ে কোন প্রশ্নই সৃষ্টি হবে না। সামগ্রিকতাই এর সমাধান এনে দিবে।
আমরা যদি মাওয়ার্দীর আকলুল মুকতাসাবকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই যে, এই পরিভাষাটি বহুমাত্রিক একটি পরিভাষা। মানুষের ব্যক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সমূহ এবং এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে সামাজিকভাবে মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং এই সকল প্রতিষ্ঠান সমূহের স্মৃতি হিসেবে উদ্ভাসিত (সৃষ্ট) সকল জ্ঞানসমূহকে তিনি আকলুল মুকতাসাবের বিভিন্ন প্রকার হিসেবে তুলে ধরেন। এমনকি আমরা এই কথা বলতে পারি যে, মাওয়ার্দী মূলত ‘আকলুল মুকতাসাব’ নামক পরিভাষাকে বর্তমান সময়ে আমাদের ব্যবহৃত সভ্যতা এবং সংস্কৃতি শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন । মাওয়ার্দী তার এই গ্রন্থে العقل الغريزي (আকলুল গারিযি ) কে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরে আকলের বিকাশ ও বিস্তৃতির ক্ষেত্রে ভাষা, জ্ঞান এবং দ্বীন কোন ধরণের ভূমিকা পালন করে থাকে এই সকল বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।
এই সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পর তিনি দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করেন। এই ক্ষেত্রে তিনি বলেন দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা কেবলমাত্র আদালত প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে সম্ভব আর আদালতকে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি কিছু মূলনীতি পেশ করেন। এই সকল মূলনীতিকে পেশ করার সময় কিছু কিছু বিষয় যা আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য না হলেই নয়, এমন একটি বিষয় হল ‘দ্বীন’। এমন একটি দ্বীনের প্রয়োজন সমগ্র ব্যবস্থাপনা যার অনুগত হবে। অর্থাৎ এটাকে এই ভাবে বলা যেতে পারে, ‘ দুনিয়ার ব্যবস্থাপনাকে সুন্দর ভাবে বিন্যস্ত করার জন্য সর্বপ্রথম শর্ত হল সকলের জন্য প্রযোজ্য নরমেটিভ একটি ব্যবস্থার অনুগত হওয়া’। তিনি বলেন মানুষ যতদিন পর্যন্ত সকলকে সম্পৃক্তকারী এমন একটি নরমেটিভ ব্যবস্থার অনুগত না হবে ততদিন পর্যন্ত তারা দুনিয়াতে সত্যিকারের একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। তবে এটাই যথেষ্ট নয়, মানুষ যেন নিরাপদে বসবাস করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে, এটাও যথেষ্ট নয় মানুষ যেন তার প্রয়োজনকে পূরণ করতে পারে এই জন্য প্রাচুর্যতা থাকতে হবে।, এটাও যথেষ্ট নয়, মানুষের নিকট ভবিষ্যৎ যেন সুন্দর হয় এমন একটি আশা তুলে ধরতে হবে।
এই সকল বিষয় ছাড়াও অন্য যে সকল শর্ত তিনি দিয়েছেন তার মধ্যে একটু হল, মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কেউ যেন বিশৃঙ্খল করতে না পারে, রাষ্ট্রে যেন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে এই জন্য শক্তিশালী নিরাপত্ত্বা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে যারা সমাজের সকলের নিরাপত্ত্বা দান করবে। এই সকল বিষয়কে নিয়ে আলোচনা করার সময় তিনি উমরান শব্দ ব্যবহার করেন যা পরবর্তীতে ইবনে খালদুন আর বড় একটি থিওরীতে রূপান্তরিত করে পূর্ণতা দান করেন।
এই উমরানকে সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বপ্রথম শর্ত হল আদালত প্রতিষ্ঠা। আর আদালতকে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটু আগে উল্লেখিত শর্ত সমূহকে বাস্তবায়ন করা।
তবে যে বিষয়টি আল মাওয়ার্দীকে ও তার চিন্তাকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রেখেছে সেটি হল তার এই গ্রন্থের সর্বশেষ অধ্যায়ে বর্ণিত বিষয় সমূহ। সেখানে তিনি বলেন মুকতাসাব আকল, দ্বীন এবং জ্ঞান এই সকল কিছুর উদ্দেশ্য হল এই দুনিয়াতে প্রতিটি ব্যক্তিকে সুখী ও খুশি রাখা। যে দুনিয়াতে ব্যক্তিগণ সুখী নন সেই দুনিয়া কখনো প্রত্যাশিত কোন দুনিয়া নয়। এই জন্য সকল ব্যবস্থা ও জ্ঞানের চরম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানুষকে সুখে রাখা। মাওয়ার্দী মনে করেন আর এটা কেবল আখলাকে কামাল (পরিপূর্ণ আখলাক) এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
তিনি আরও একটি বিষয় তুলে ধরেন সেটি হল; মানুষের ব্যক্তিজীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্যান্য মানুষের সাথে এক সাথে বসবাস করা প্রয়োজন। তবে অন্যান্য মানুষের সাথে বসবাস করার সময় মানুষের সামগ্রিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে উৎপাদিত; জ্ঞান, রাষ্ট্রব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, বিশ্বব্যবস্থার মত বিষয় সমূহকে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। ব্যক্তির মূল্য থেকে কোন কিছুকেই বিসর্জন না দিয়ে এই উমরানের মধ্যে ব্যক্তিকে মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সমগ্র মানব সভ্যতার চিন্তার ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়ে মাওয়ার্দীর চিন্তা দর্শনকে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে অনায়াসেই এই কথা বলা যায় যে, এরিস্টটলের Politics , প্লেটোর Republic, মন্টেস্কোর The Spirit of Laws, জ্যাক রুসোর The Social Contract, উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সমূহের মধ্যে হেগেলের লেখা Elements of the Philosophy of Right, জন রাউলসের A Theory of Justice চেয়ে মাওয়ার্দীর ‘আদাবুদ দিন ওয়াদ দুনিয়া’ র স্থান অনেক উপরে।
এই সকল গ্রন্থের সাথে যদি তুলনা করি তাহলে দেখতে পাই যে, এই সকল দার্শনিক যা বুঝাতে চেয়েছেন আল মাওয়ার্দী তাদের সকলের চাহিদাকে পূরণ করে অনেক উন্নত চিন্তা পেশ করেছেন। এই জন্য আমি এই গ্রন্থকে মানব সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মনে করি। শুধু তাই নয়, আজো যদি তার এই সকল চিন্তাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করি তাহলে আমাদের আজকের অনেক সমস্যার সমাধানই তার এই গ্রন্থে রয়েছে যা থেকে আমরা উপকৃত হতে পারব।
এখন মাওয়ার্দীর অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা কি বলতে পারি? অন্যান্য সকল চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও আলেমদের মত শুন্য থেকে উঠে আসেননি। সব কিছুর আগে তিনি শাফেয়ী মাজহাবের একজন আলেম। শাফেয়ী মাজহাবের হওয়ার কারণে সেই মাজহাবের ধারাকে ও ঐতিহ্যকে তিনি ধারণ করতেন। তবে শুধু শাফেয়ী মাজহাবের ধারার আলেমগণই নন, আরো অন্যান্য আলেমগণকেও তিনি গভীর ভাবে অধ্যয়ন করেন ও উপকৃত হন। বিশেষ করে তিনি সুফি, মুতাকাল্লিম ও মুফাসসির আল মুহাসিবিকেও তিনি অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে আকলুল গারিযি ও আকলুল মুকতাসাব নামে আকলের যে প্রকারভেদ তিনি করেছেন এটা তিনি মুহাসিবির কাছ থেকে নিয়েছেন। মুহাসিবির পরেও অনেক আলেমগণ এই আকল নিয়ে আলোচনা করেছেন তবে, মাওয়ারদী এই বিন্যাসকে পূর্ণতা দান করেন। আল-মাওয়ারদীর পরে ইমাম গাজ্জালী সহ অনেক আলেমগণ এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন তবে সবচেয়ে বেশী আলোচনা করেছেন ইবনে খালদুন। আল মাওয়ারদী ও ইবনে খালদুনের মধ্যকার চিন্তাগত সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
উসমানী খিলাফতের সময়েও আল-মাওয়ার্দী ব্যাপক ভাবে পঠিত হয়েছে বিশেষ করে রাজনীতি নিয়ে লেখা তার আল আহকামুস সুলতানিয়া নামক গ্রন্থটি। তবে আদাবুত দ্বীন ওয়া দুনিয়া নামক গ্রন্থটি উসমানী মাদরাসা সমূহে পাঠ্য হিসেবে পড়ানো না হলেও আলেম সমাজে ব্যাপক পঠিত একটি গ্রন্থ ছিল।
তবে বর্তমান সময়ে এসে আল মাওয়ার্দী আল-আহকামুস সুলতানিয়ার মাধ্যমে অনেক প্রসিদ্ধ হলেও আরো অন্যান্য দিক থেকে অনেকটাই অজানা ও অপ্রসিদ্ধ। বিশেষ করে তার কালজয়ী গ্রন্থ আদাবুত দ্বীন ওয়াদ দুনিয়া সম্পর্কে খুব কম মানুষই অবহিত।।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ