ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষা চর্চা

ব্রাহ্মণরা কখনোই বাংলা ভাষা চর্চাকে ভালোভাবে নেয়নি। সেন আমলে তারা বাংলা ভাষাকে খতম করতে চেয়েছিল; মুসলিম আমলে হোসেন শাহের দরবারে যখন বাংলা সাহিত্য চর্চার সমারোহ চলছে তখনও ব্রাহ্মণরা এটি প্রথম দিকে সুনজরে দেখেনি। তবে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণার বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াবার সাহস করেনি। উপরন্তু অন্যান্য কবিরা যখন নিজেদের কাব্য রচনার জন্য সুলতানের কাছ থেকে প্রচুর ইনাম, খেতাব ও পুরস্কার বাগিয়ে নিতে লাগলো, তখনই কেবল তারা রাজ দরবারে এসে সাহিত্য সেবায় আত্মনিয়োগ করলো।

পলাশীর বিপর্যয়ের পর নতুন পরিস্থিতিতে ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে মিত্রতার সূত্রে ব্রাহ্মণরা আবার ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠে এবং তাদের ভিতরকার লুকানো স্নাতক্রোধ, ঘৃণা-বিদ্বেষ পুণরায় জেগে ওঠে। ঔপনিবেশিক শক্তির সহযোগে ব্রাহ্মণরা চেয়েছিল মুসলিম রাজশক্তিকে খতম করে দিতে এবং এতে তারা শতভাগ কামিয়াব হয়। রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি বাঙ্গালী মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোও তারা ধসিয়ে দেয়। বিশেষ করে কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলাদেশে যে বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছিলো, তার উপর ব্রাহ্মণরা অধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রশ্রয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে একদল পাদ্রী ও পণ্ডিত যৌথভাবে বাংলা ভাষার কাঠামো পরিবর্তন করতে না পারলেও আকৃতির ব্যাপক রদ-বদল করে ফেলে। ব্যাকরণ ঠিক থাকে কিন্তু ভাষা স্ফীত হয় হিন্দুদের দেবভাষা সংস্কৃতের শব্দাবলীতে। আদতে এই বাংলা ছিলো হিন্দুয়ানী বাংলা। ঔপনিবেশিক ইংরেজ ক্ষমতা নিয়েছিল মুসলমানদের হাত থেকে। তাই তারা পলাশীর রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর প্রথম সুযোগেই মুসলমানদের তৈরি ভাষাকে বিধ্বস্ত করে দিতে চেয়েছিলো, যাতে তাদের আত্ম-পরিচয়ের উৎসমুখ শেষ হয়ে যায় এবং কোনো প্রকার প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে না পারে। সেদিন বাংলাভাষাকে সংস্কৃত জননীর কন্যার মুখোশ পরিয়ে বাংলা ভাষার আর্যায়ন বা ব্রাহ্মণীকরণ এইভাবে সুসম্পন্ন হয়। সাহিত্যিক সজনীকা দাসের লেখায় এসব সত্যের সাক্ষ্য মেলেঃ

“১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে হ্যালহেড এবং পরবর্তীকালে হেনরি গিটস ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরী বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত জননীর সন্তান ধরিয়া আরবী পারসীর অনধিকার প্রবেশের বিরুদ্ধে রীতিমতো ওকালতি করিয়াছেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই তিন ইংলন্ডীয় পণ্ডিতের যত্ন ও চেষ্টায় অতি অল্প দিনের মধ্যে বাংলা ভাষা সংস্কৃত হইয়া উঠিয়াছে। ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এই আরবী পারসী নিসূদন যজ্ঞের সূত্রপাত এবং ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে আইনের সাহায্যে কোম্পানির সদর মফস্বল আদালতসমূহে আরবী-পারসীর পরিবর্তে বাংলা ও ইংরেজি প্রবর্তনে এই যজ্ঞের পূর্ণাহতি। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মও এই বৎসর। এই যজ্ঞের ইতিহাস অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক, আরবী-পারসীকে অশুদ্ধ পদ ধরিয়া শুদ্ধ প্রচারের জন্য সেকালে কয়েকটি ব্যাকরণ অভিধানও রচিত হয় ও প্রচারিত হইয়াছিলো। সাহেবেরা সুবিধা পাইলেই আরবী-পারসীর বিরোধিতা করিয়া বাংলা ও সংস্কৃতকে প্রাধান্য দিতেন। ফলে দশ-পনেরো বৎসরের মধ্যেই বাংলা গদ্যের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়াছিলো।”

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার আর্যীকরণের সাথে যুক্ত হন উপরে বর্ণিত খ্রিষ্টান পাদ্রী হ্যালহেড, উইলিয়াম কেরী, হেনরী গিটস ফরস্টার। এদের সাথে হাত মেলান ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামনাথ বিদ্যাবাচষ্পতি, রামরাম বসু প্রমুখ। সেদিন সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার ভিত্তিতে ঔপনিবেশিকতার উদরে এইভাবে জন্ম হয় আধুনিক বাংলা গদ্যের। যে গদ্যের সাথে বাংলাদেশের আমজনতার ভাষার কোনো সম্পর্ক ছিলো না সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট কিছু পাদ্রী ও ব্রাহ্মণের চেষ্টায় এইভাবে বাংলা ভাষাকে মুসলমান মুক্ত করা হলো এবং প্রচার করা হলো বাংলা ভাষার নবযুগ আরম্ভ হয়েছে। মূল বাংলা ভাষা ও তার স্রষ্টা মুসলমানদের প্রতি এদের অসূয়া কত গভীর ছিলো তা বুঝানোর জন্য মুহাম্মদ এনামুল হকের লেখা থেকে ধার করছি। এখানে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সংস্কৃতি জগতের সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে মুসলমান নামটা বিতাড়নে লাফ দিয়ে পড়েছিলোঃ

“হিসাব করে দেখা গেছে, যে ভাষা আমাদের নামজাদা সাহিত্যকরা তাদের লেখায় ব্যবহার করছেন, তার শতকরা দুটি অনার্য, পঁচিশটি সংস্কৃত-আধা সংস্কৃত, ষাটটি সংস্কৃত থেকে ভেঙ্গে সোজা করে নেওয়া আর আটটি হচ্ছে বিদেশী অর্থাৎ কিনা আরবী, ফারসী, পর্তুগীজ, ইংরেজী প্রভৃতি।”

অর্থাৎ উৎপত্তির দিক দিয়ে শতকরা হিসাব করলে বর্তমান বাংলা ভাষায় তুলনামূলক শব্দের পরিমাণ হচ্ছে এরকম-

১. অনার্য শব্দ (দেশি)-২

২ . সংস্কৃত শব্দ-২৫

৩. আধা সংস্কৃত শব্দ-৫

৪. সংস্কৃত থেকে ভেঙ্গে সোজা করে নেওয়া-৬০

৫. বিদেশী শব্দ (আরবী, ফারসী, ইংরেজী, পর্তুগীজ)-৮

সর্বমোট-১০০

উপরোক্ত চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয়, ফোর্ট উইলিয়ামের কল্যাণে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় শতকরা আশি ভাগেরও অধিক ।

বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন যে চর্যাপদকে বলা হয় সেখানেও সংস্কৃত শব্দের সংখ্যা মোট ২০০০ শব্দের মধ্যে ১০০টি শতকরা হিসাবে ৫টি । পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৫।

বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের আধিপত্য ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রশ্রয়ে পাদ্রী ও ব্রাহ্মণের যৌথ প্রযোজনার ফসল। পাদ্রী উইলিয়াম কেরী প্রথম জীবনে দিনাজপুরে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করতেন। সেখানে স্থানীয় লোকদের সাথে কথোপকথনে তার কাছে মনে হয়েছিলো বাংলা ভাষা আসলে একটি নয়, দুটো। একটি ব্রাহ্মণদের ব্যবহৃত বাংলা। অন্যটি আরবী-ফারসী মিশ্রিত বাংলা যা মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ব্যবহার করে।

এই কেরীকে ব্রিটিশরা বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিয়ে আসে। এখন তিনি পাদ্রী নন, রীতিমতো শিক্ষক। পাদ্রী থেকে পুনর্জন্মপ্রাপ্ত এই শিক্ষক বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লেখেন। ১৮০১ সালে লেখা ব্যাকরণের প্রথম সংস্করণে তিনি দাবি করেনঃ

“Multitudes of words originally Persian and Arabic are constantly employed in common conversation, which perhaps ought to be considered enriching rather than corrupting the Bangali language.”

অথচ কেরীই ১৮১৮ সালে লেখা ব্যাকরণের চতুর্থ সংস্করণে দাবি করেছেন বাংলার শতকরা আশিটি শব্দ হচ্ছে সংস্কৃত উদ্ভূত। এই কয় বছরের মধ্যে তার মনো পরিবর্তনের কারণ কি? কারণ ইংরেজ রাজশক্তির ক্ষমতা। তিনি এমনই বদলে গেলেন যে তিনি বাংলাকে প্রায় সংস্কৃত বানিয়ে দিলেন। তিনি লিখেছেনঃ

“The Bengalee may be considered as more nearly allied to the Sanskrit than any of the other languages of India……. Four fifths of the word in the language are pure Sangskrit.”

সংস্কৃত পণ্ডিতদের বাংলার প্রতি ছিল বিজাতীয় ঘৃণা; কিন্তু ইউরোপীয়রা যখন প্রথম দিকে বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলেন তখন তারা পণ্ডিতদের ভাষার অনুকরণে এটি লেখেননি । লিখেছেন আম জনতার ভাষার কথা ভেবে ।

খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক পর্তুগীজ পাদ্রী মানুয়েল দা আস-সুম্পসাঁও, যিনি ১৭৩৩ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত এই ২৪ বছর পূর্ববঙ্গে প্রধানতঃ গাজীপুরের ভাওয়ালে অবস্থান করেছিলেন। লিসবন থেকে যে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রকাশ করেন, সেখানেও তিনি বাংলা ভাষা বলতে দেশি শব্দ বুঝেছেন, সংস্কৃত নয়। হ্যালহেড সাহেব যিনি কেরীর সাথে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ছিলেন তিনি তার ব্যাকরণে স্বীকার করেছেন-

“At present those persons (the Bengalees) are thought to speak the compound idiom with the most elegance who mix with the pure Indian verbs, the greatest number of Persian and Arabic nouns.”

স্বীকার করলে কি হবে? ঐ ইংরেজের দাপট শেষ পর্যন্ত তাকেও কেরীর সাথে মিলিয়ে দিয়েছে, যেমন দিয়েছে পণ্ডিতদের, এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থ দেখভাল করার দায়িত্ব নিতে হয়েছে ।

পলাশীর যুদ্ধের সময়কালের কবি ভারতচন্দ্র যেখানে যাবনী মিশাল ভাষা দিয়ে রস সৃষ্টির কথা বলেছেন, পণ্ডিতেরা তার কথায় কর্ণপাত করেনি । পণ্ডিত ও পাদ্রীরা প্রচার করেছেন এর দ্বারা ভাষার শুদ্ধতা হানি হয়েছে ।

ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী বিংশ শতাব্দীর সাম্প্রতিক কালের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি লিখেছেনঃ

“মুসলমান আমলে ফার্সী বাধ্যতামূলক হওয়ায় বাংলা ভাষার মধ্যে বহু আরবী ফারসী শব্দ রয়েছে এবং তার তৎসম শুদ্ধতা/সাবলীলতা নষ্ট করেছে। তাঁর(হ্যালহেডের) খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (১৭৭৮) বাংলা ভাষার পুনর্জন্মেরই প্রথম প্রদক্ষেপ।“

এখানে তিনি যে ভাষা সংস্কৃতের বাহুল্যকেই বিশুদ্ধ বাংলার মানদণ্ড হিসেবে ধরেছেন, এ দৃষ্টিভঙ্গিটাকে কি হিন্দুয়ানী বলা চলে? হয়তো হিন্দুয়ানী ভাষার পুনর্জন্মটাই তার কাছে রেনেসাঁ। অমলেশ ত্রিপাঠী তার ইতালীর র‍্যানেশাঁস, বাঙালীর সংস্কৃতি বইয়ে আধুনিক বাঙ্গালী সংস্কৃতির আদর্শ সন্ধান করতে যেয়ে তিনি যা পেয়েছেন তা হলো ব্রিটিশের প্রশ্রয়ে লালিত কলকাতা কেন্দ্ৰিক বাঙ্গালী হিন্দুর এক জগৎ । এর পাশে বাঙ্গালী মুসলমানের যে একটা বিরাট জগৎ রয়েছে বা ছিলো তা তিনি বেমালুম বিস্মৃত হয়েছেন।

একই রকম চিন্তা করেছেন বাংলা ভাষার বিখ্যাত পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তিনি লিখেছেনঃ

“We have elaborate grammars of Sanskrit masquerading as Bengali grammar in which the genuine Bengali forms have been branded as vulgar (ashadhu) beside the so called polite (shadhu) forms borrowed from Sanskrit.”

সুনীতির চোখেও সংস্কৃত হচ্ছে শুদ্ধতম ভাষা। বাংলা হচ্ছে অসাধু এমনকি অশ্লীল। বাংলা ভাষার পণ্ডিতের এই সংস্কৃত প্রীতি কেন? কারণ সংস্কৃত ভাষার চোখ দিয়ে তিনি বাংলাকে দেখেছেন। এমনকি ভারতবর্ষকেও দেখেছেন। ভারত সংস্কৃতি বইয়ে সুনীতি লিখেছেনঃ

“সংস্কৃত ভাষাই হিন্দু ভারতকে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দ্বারা চালিত ভারতকে একসূত্রে বাঁধিয়া খণ্ড ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন নানা প্রদেশকে মিলিত করিয়া এক অখণ্ড দেশে পরিণত করিয়াছিলো।“১০

এই যে অখণ্ড ভারতের ধারণা এটা প্রচার করতো আর এস এস, হিন্দু মহাসভা, পরে প্রচার করেছে কংগ্রেস, এখন করছে বিজেপি। সুনীতিবাবুর এই অখণ্ড ভারতের ধারণা শুধুমাত্র ভৌগোলিক দেশের ধারণা নয় । এটি একটি সাংস্কৃতিক ধারণাও বটে । তবে এই ধারণা শুধুমাত্র সুনীতিবাবুর নয় । এরকম মহাভারতীয় জাতীয়তার ধারণা রবীন্দ্রনাথসহ আরও অনেকে করেছেন। দ্বিজাতি তত্ত্বতো এমনি এমনি খাড়া হয়নি ।

সুনীতিবাবু বলেছেন,

“বাঙালীরা হচ্ছে আট আনা ভারতীয়, আট আনা স্থানীয়। আকারে যেমন প্রকৃতিতেও তেমনি-বাঙালীরা ভারতীয় বটে।”১১

তিনি মানেন যে পশ্চিম বাংলার উপর ভারতীয় আধিপত্যের একটা দিক আছে। কিন্তু তবু তার কাছে অখণ্ড ভারতের সংস্কৃতির সত্যটাই বেশি রকমের সত্য ও উজ্জ্বল মনে হয়।

ঐ বই থেকে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি মতামতের উল্লেখ করা যেতে পারে। সাহিত্যিক ভূদেব মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি তাকে যথার্থ ব্রাহ্মণ পিতার সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেনঃ

“১৮৯২ সালের পূর্বেই তিনি সমগ্র ভারতের একতার অন্যতম সাধন স্বরূপ হিন্দী ভাষার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। তখন খুব অল্প সংখ্যক লোকই এদিকে অবহিত হয়েছিলেন।১২

বাংলা ভাষার পণ্ডিত বাংলা ভাষার কথা বলছেন না, বলছেন ধর্মের জোরের কথা। প্রথমে বলেছেন সংস্কৃত’র কথা যা প্রাচীনকালে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল । পরে বলেছেন হিন্দির কথা যা আধুনিককালের ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখবে। ভূদেব বাবুর মতো তিনিও চাইতেন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি, আর দেশের ভিত্তি হবে হিন্দি জাতীয়তাবাদ।

সুনীতি বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা বইয়ে হিন্দিকে ভাবী ভারতের রাষ্ট্রভাষা করবার দাবি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সুনীতিকুমারের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত ছিলেন।

বাঙ্গালীর ইতিহাস লিখে বিখ্যাত হয়েছেন নীহার রঞ্জন রায়। এ ইতিহাস আমাদের এখানকার সেক্যুলার ভাবুকদের কাছে খুবই আদৃত। কিন্তু যে আমলের ইতিহাস তিনি লিখেছেন সে সময় বাংলা, বাঙ্গালী ও বাংলা ভাষা বলে কিছু ছিলো না তিনি মূলতঃ লিখেছেন প্রাচীন হিন্দু আমলের ইতিহাস। তবু এ বইকে সমগ্র বাঙ্গালীর শুদ্ধ ইতিহাস হিসেবে কেন বিবেচনা করা হয় তা একটা বড় প্রশ্ন। এর পিছনে ইতিহাসগত বিবেচনার চেয়ে ধর্ম ও সংস্কৃতিগত বিবেচনাটাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে । সেই প্রাচীন হিন্দু আমলের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে নীহার রঞ্জন রায় লিখেছেনঃ

“গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সংহতির মধ্যে ধরা পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোত সবেগে বাংলাদেশে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে এবং দেখিতে দেখিতে এই দেশ ক্রমশ নিখিল ভারতীয় সংস্কৃতির এক অংশীদার হইয়া ওঠে।“১৩

এই যে নিখিল ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি টান এটা কিন্তু ঠিক বাংলা ও বাঙ্গালীর প্রতি টানের জন্য নয়। এটি হয়েছিলো হিন্দু ধর্ম ও মহাভারতীয় জাতীয়তার প্রতি এক ধরনের অতিরিক্ত আকর্ষণের কারণে । বাঙ্গালীর আদি ইতিহাস বইয়ের ভূমিকায় তিনি বঙ্গ বিভাগের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বাঙ্গালীর ২০০০ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, তার এই দুঃখের কারণ কিন্তু ঠিক বঙ্গ বিভাগের জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে বিভাগের ফলে বঙ্গের যে একাংশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এ কথাটা বিবেচনা করে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি নয়, এ দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ।

উনিশ শতকের বাংলার সবচেয়ে শক্তিমান লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ফোর্ট উইলিয়ামের সংস্কৃত বাংলায় তিনি তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলো লিখেছেন এবং ঐ বাংলাকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে ছাড়া আধুনিক বাংলা ভাষার আলোচনা সম্ভব নয় কিন্তু এটাও তো সত্য, ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত তার হাত ধরেই হয়েছে । সে কালের বিখ্যাত সাহিত্য সাময়িকী বঙ্গ দর্শনে’র তিনি সম্পাদক ছিলেন । কিন্তু তার বঙ্গ দর্শনটা সত্যিকারের বঙ্গ দর্শন হয়ে ওঠেনি, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের দর্শন হয়ে ওঠেছে । বঙ্কিম তার নিজের সম্পাদিত পত্রিকায় ১২৮৭ পৌষ সংখ্যায় বাঙ্গালীর উৎপত্তি নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। বঙ্কিম তার প্রবন্ধে একটি বিশেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েছিলেন। প্রশ্নটি হলো, লোক গণনায় স্থির হইয়াছে যে, যাহাদিগকে বাঙ্গালী বলা যায়, যাহারা বাংলাদেশে বাস করে, বাঙ্গালা ভাষায় কথা কয় তাহাদিগের মধ্যে অর্ধেক মুসলমান, ইহারা বাঙ্গালী বটে। কিন্তু ইহারাও কি সেই প্রাচীন বৈদিক ধর্মাবলম্বী জাতির সন্তান?

বঙ্কিম তার নিজের উঠানো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিজেই বলেছেন বাঙ্গালী এক ভাষায় কথা বললেও তারা আসলে এক জাতি নয়। বঙ্কিমের মতে, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলে তাদেরকে চার ভাগে বিভক্ত করা চলেঃ

১. আর্য হিন্দু

২. অনার্য হিন্দু

৩. আর্য-অনার্য মিশ্র হিন্দু ।

৪. বাঙ্গালী মুসলমান ।

এই চারভাগ পরস্পর থেকে পৃথক। এদের মধ্যে রক্তের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে না। বঙ্কিমের মতে,

“ইংরেজকে যে অর্থে এক জাতি বলা হয়, বাঙ্গালীদের সে অর্থে এক জাতি বলা সম্ভব নয়। ইংরেজদের মধ্যে এঙ্গল, স্যাকসন, নর্মানরা মিশে যেতে পেরেছে। এদের মধ্যে রক্তের বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে সেরকম কোনো বন্ধন সৃষ্টি হয়নি। তার নিজের ভাষায়, ইংরেজ এক জাতি, বাঙ্গালী বহু জাতি । বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি তাহাদের মধ্যে চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই । এক আর্য, দ্বিতীয় অনার্য হিন্দু, তৃতীয় আর্য-অনার্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারি ভাগ পরস্পর হইতে পৃথক থাকে। বাঙ্গালী সমাজের নিম্নস্তরেই বাঙ্গালী অনার্য বা মিশ্রিত আর্য ও বাঙ্গালী মুসলমান; উপরের স্তরে কেবলই আর্য। এই জন্য দূর হইতে দেখিতে বাঙ্গালী জাতি অমিশ্রিত আর্য জাতি বলিয়া বোধ হয় এবং বাঙ্গালীর ইতিহাস এক আর্য বংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিত হয়।“১৪

বঙ্কিমের এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিন্দু-বিসর্গ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি এখানে বাঙ্গালী নয়, আর্য হিন্দুর নেতৃত্বই চাচ্ছেন। বঙ্কিম বাংলাদেশে জন্মেছিলেন, বাংলা ভাষায় সাহিত্য সাধনা করেছেন এসবই সত্য। কিন্তু তিনি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষী ছিলেন না। ভাষার ভিতর দিয়ে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদ মজবুত করতে চেয়েছিলেন ।

এবার আমরা রবীন্দ্রনাথের দিকে যাবো উনিশ শতকে কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালী হিন্দুর মধ্যে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিলো তার শ্রেষ্ঠ রত্ন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার সৃষ্টিশীলতা অসাধারণ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ কিংবা বাঙ্গালীদের পৃথক রাষ্ট্র চাননি। রবীন্দ্রনাথ ফোর্ট উইলিয়ামের পণ্ডিতী বাংলা থেকে কিছুটা হলেও সরে এসেছিলেন। ঐ বিশেষ বাংলায় সাহিত্য সাধনা করা কষ্টকর এটা তিনি শিল্পী হিসেবে বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি শিবাজী উৎসব কবিতা লিখেছিলেন এটাও সত্য। এখানে তিনি এক ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। সেটা অবশ্য হিন্দু ধর্মরাজ্য । তার স্তাবকরা বলবেন, রবীন্দ্রনাথ ঐ ধ্যান ধারণা থেকে পরে সরে এসেছিলেন । তিনি তার শিবাজী উৎসব কবিতাটি কোনো গ্রন্থে স্থান দেননি। হতে পারে এটি সত্য কথা। কিন্তু এরপর তিনি শান্তি নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। এটাকে তিনি তপোবনের আদর্শে গড়তে চেয়েছিলেন। সেই আদর্শের কথা তিনি এমনিভাবে ত্রিপুরার রাজার কাছে বিবৃত করেছেন-

“আমি ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মচর্যের প্রাচীন আদর্শে আমার ছাত্রদিগকে নির্জনে নিরুদ্বেগে পবিত্র নির্মলভাবে মানুষ করিয়া তুলিতে চাই।…  বিদেশী ম্লে-চ্ছতাকে বরণ করা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়।…ইহা হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিও, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়; পরধর্মো ভয়াবহ ।“১৫

এর মধ্যে বাঙ্গালীও নেই, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদও নেই। এ দৃষ্টিভঙ্গি বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়েছে বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়নি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ

“হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিষ্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরস্পর লড়াই করিয়া মরিবে না – এইখানে তারা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবে। সেই সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না, তাহা বিশেষভাবে হিন্দু।“১৬

ধর্মান্তরের পরও হিন্দু হিন্দু থাকে কিনা এ প্রশ্ন উত্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ জবাব দিয়েছেন,

“ইহার মধ্যে পারাপারির তর্ক মাত্রই নাই। ইহা সত্য, বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে কিন্তু তাহারা হিন্দু মুসলমান। …… হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটা জাতিগত পরিণাম।“১৭

এখানেও রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির কাঠামোর ভিতরে একটি ভারতবর্ষীয় ঐক্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন। ভারতবর্ষ যে একটি বহুধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ এটি তার মাথায় আসছে না। একারণেই কি তিনি শেষ পর্যন্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভারতের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্রভাষা হিন্দির পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। হিন্দির পক্ষে মহাত্মা গান্ধীর কাছে লেখা রবীন্দ্রের চিঠির কিয়দংশ উদ্ধৃত করছিঃ

“Hindi is the only possible national language for inter provincial intercourse in India. But about its introduction at the Congress, I think we can not enforce it for a long time to come Hindi will have to remain optional in our national proceedings until a new generation of politicians, fully alive to its importance, pave the way toward its general use by constant practice as voluntary acceptance of a national obligation.”১৮

এ চিঠির ভাষার মধ্যে একজন ভারতবর্ষীয় সাধকের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যায়, বাঙ্গালী হিসেবে এতে ঠিক আস্বস্ত হবার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ তখন তাকে ভারতপথিক হিসেবে বেশি মানায়, বাংলা পথিক হিসেবে নয়। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাও ভূগোল ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক হয়ে ওঠেছে বেশি। কখনো কখনো তা হয়ে ওঠেছে প্রাচীন ভারতীয় উপনিষদিক। বাংলা ভাষার কবি হলেও এখানে বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা তার চিন্তায় বেশি ধরেনি। রবীন্দ্রনাথের বাঙ্গালীত্ব ছিলো ভারতীয় আয়নায় বাঙ্গালীকে দেখা, বাঙ্গালীর আয়নায় ভারতকে দেখা নয়। আমাদের দেশের সেক্যুলার ভাবুকরা, যারা রবীন্দ্রনাথকে বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের পুরোহিত হিসেবে মান্য করেন তাদের বিঘোষিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদও কি রবীন্দ্রের জাতীয়তাবাদের মতো অনুরূপ কিছু, না এর কিছু আলাদা তাৎপর্য আছে, সেটার বিচারও জরুরি ।

রবীন্দ্রনাথ হিন্দিকে শুধু ভাষা হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন মহানদী হিসেবে, যার ভিতরে ভারতের অন্যান্য ভাষারূপী নদীসমূহ আত্মহুতি দিয়েছে। যেমন করে ভারতীয় জাতীয়তার মধ্যে লুপ্ত হয়েছে ভারতের সমস্ত জাতিগোষ্ঠী প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক এম জে আকবর লিখেছেন-

“ভারতের বিভিন্ন ভাষাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণনা করছেন বিভিন্ন নদীর নামে। হিন্দীকে বলেছেন মহানদী, অর্থাৎ বিরাট নদী। শেষ পর্যন্ত দেশের মহানদীকে ভূমিকা দেওয়া হলো। কিন্তু সেই মহানদীর স্রোতধারা কার্যকরভাবে ব্যবহার করার জন্য দেশ প্রস্তুত হয়েছে কিনা, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।“১৯

শুধু হিন্দি প্রীতি নয়, রবীন্দ্রের সংস্কৃত প্রীতিও লক্ষ্যণীয। সংস্কৃত একটা মৃত ভাষা। কেননা, এটা কারো ভাষা নয়, মুখের ভাষাও নয়। কিন্তু হিন্দুদের ধর্মের ভাষা। এ ভাষায় রামায়ণ, মহাভারত লেখা হয়েছে৷ এ ভাষা মূলত ব্রাহ্মণরাই ব্যবহার করতো। শুদ্রের সংস্কৃত শিখবার অধিকার ছিলো না। তবুও রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ এই ভাষার প্রতি। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেনঃ

“বাংলা ভাষা সম্বন্ধে কবির প্রীতি সর্বজন বিদিত, কিন্তু তিনি ইহাও জানিতেন যে সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের বুনিয়াদ না হইলে ভারতীয় ভাষার উপর দখল হওয়া কঠিন। সেই জন্য তিনি বিশ্ব ভারতীর ছাত্রদের পক্ষে পানিনির ব্যাকরণ পাঠ প্রায় আবশ্যিক করিয়া তোলেন। … কবির বরাবরই ইচ্ছা ছিলো যে, বিদ্যালয়ের শেষ চারি বৎসর ছাত্রদের একখানা সংস্কৃত ব্যাকরণ, যেমন মধ্য ও লঘু কৌমুদী মুখস্থ করাইয়া দিতে পারিলে চিরকালের মতো সংস্কৃতের বুনিয়াদ গাঁথা হইয়া যাইবে।২০

এই যে সংস্কৃত ভাষার প্রতি রবীন্দ্রের এক ধরনের অতি আকর্ষণ এর পিছনে তো ধর্মের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। না হলে সংস্কৃত মৃত ভাষা হওয়া সত্ত্বেও হাজার হোক রামায়ণ মহাভারতের ভাষা। এর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রবীন্দ্রের কাছে মোটেই কিঞ্চিতকর নয়। এই কারণে তিনি বিশেষ উদ্যোগী হয়ে সংস্কৃত ভাষার একটি ব্যাকরণ লেখেন যার নাম সংস্কৃত শিক্ষা।

আমরা বেখবর-বেখেয়াল বাঙ্গালরা না জানলেও রবীন্দ্রনাথ ‘কালচার’ এর আদি তরজমা কৃষ্টির (উচ্চতর মূল্যবোধ ও রুচির চর্চা) বদলে সংস্কৃতি (ব্রাহ্মণ্য সংস্কার অনুযায়ী জীবন ধারা) চালু করেন এবং একসময় বাংলা ভাষাকে শুদ্ধ ভাষার (সংস্কৃত) খপ্পর থেকে মুক্ত করার ‘কেমেল পাশা’ বনার মহৎ ইচ্ছার কথা ভুলে গিয়ে বাঙ্গালী সংস্কৃতির তীর্থ স্থান হিসেবে পরিচিত শান্তি নিকেতনে বসে বাংলা ভাষাকে আরও বেশি সংস্কৃত অনুগত করার জন্য নিজস্ব পণ্ডিত হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়কে দিয়ে একটি সংস্কৃত বহুল বাংলা অভিধান তৈরি করান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় সমাজ বিজ্ঞানীদের বর্ণিত Sanskritization বা সংস্কৃতায়ন, সংস্কৃত গ্রন্থাবলীতে বিধৃত ব্রাহ্মণ্যবাদের গ্রেট ট্রাডিশনকে পুনরুজ্জীবিত করা। এই যে ধর্মীয় ভাষা সংস্কৃত, দেবনাগরী হরফে হিন্দি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তা-ভাবনা এর মধ্যে একটি সেতু বন্ধন তৈরি হয়েছে। এই বন্ধন তৈরিতে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাটি মোটেই কম নয়। এই বিশেষ চিন্তা-ভাবনা সেকালের হিন্দু মহাসভা এবং একালের বিজেপির চিন্তা ভাবনার সাথে খুব মেলে। একে Pan Hinduism বললেও অতিকথা হয় না। এই কারণেই ‘গুরুদেবের’ অনুকরণেই দিল্লির শাসকরা তাদের সংবিধানে উল্লিখিত দেশের সব ভাষাকে সংস্কৃতের সহায়তায় আরও সমৃদ্ধ করার আইনি নিদের্শ জারী করেন ।

অন্নদাশঙ্কর রায় রবীন্দ্রনাথের অনেক পরের মানুষ। আধুনিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি নিয়ে তার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি আছে। এপার বাংলায় তিনি চাকরি করেছেন বহুদিন। এপারের বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ নিয়ে তার জানাশোনাও ছিল । কলকাতায় বসে ১৯৫২ সালে এপার বাংলার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি গভীরভাবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন একথা তিনি তার লেখায় জানিয়েছেন। এপার বাংলাকে নিয়েও তিনি অনেক লেখালেখি করেছেন ও যা পড়ে আমাদের এখানকার কেউ কেউ মুগ্ধতার ঘোরে ডুবে থাকেন। এই অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলা সাহিত্যের সেবক হয়েও শেষ পর্যন্ত নিখিল ভারতীয় সংস্কৃতির মোহ অতিক্রম করতে পারেননি। বাংলাদেশ হওয়ার পর তিনি কয়েকবার ঢাকায় আসেন। নতুন দেশের অনেক নেতার সাথেও তার দেখা হয় কিন্তু তারও বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষা নিয়ে ভাবালুতা শুধু এপার বাংলার মানুষের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিলো। ওপার বাংলার জন্য বাংলা নিয়ে তার কোনো অতিরিক্ত আবেগ ছিলো না। ঢাকা থেকে ফিরে যেয়ে তিনি তার অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবেঃ

“সম্মেলনের বাইরেই আসল মিলন। ভাব বিনিময়ের অসংখ্য সুযোগ। কত জনের সঙ্গে কত জায়গায় যে দেখা হলো। বাংলাদেশের লোক যেমন বাংলাভাষা সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বদ্ধপরিকর, পশ্চিমবঙ্গের লোক তেমন নয় কেন? কেন ওরা ইংরেজীকে আকড়ে ধরে আছে? আমাকেই বেকায়দায় পড়ে জবাবদিহি করতে হয়। বলি, “ইংরেজীকে বিদায় দিলে তার শূন্যতা পূরণ করবে বাংলা নয় হিন্দী। তখন হয়তো হিন্দীর বিরুদ্ধে তেমনি লড়তে হবে যেমন লড়তে হয়েছিলো উর্দুর বিরুদ্ধে । তার মানে আর একটা একুশে ফেব্রুয়ারি, আর একটা মুক্তিযুদ্ধ, আরও ত্রিশ লক্ষের প্রাণহানি। পশ্চিমবঙ্গ স্বতন্ত্র হতে চায় না। চাইলেও তার দাম দিতে পার না। সবচেয়ে ভালো ইংরেজির জায়গায় শূন্যতা সৃষ্টি না করা। আমরা ভারতেই থাকতে চাই। তাই ইংরেজিকে আঁকড়ে ধরে আছি। কিন্তু যেখানে যতটা সম্ভব সেখানে ততটা বাংলা আমরাও প্রবর্তন করছি।”২১

প্রকৃত কথা হলো, অন্নদাশঙ্করও মহাভারতের জানালা দিয়ে বাংলাকে অবলোকন করেছেন। এপার বাংলায় বাঙ্গালীয়ানার উত্থানকে তিনি সুনজরে দেখেছিলেন বটে, কারণ তাতে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা দুর্বল হয়ে যাওয়ার বিলক্ষণ ইঙ্গিত ছিলো। কিন্তু ওপার বাংলার ক্ষেত্রে তিনি বাংলা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্চ্য করেননি, কারণ তাতে তার আরাধ্য মহাভারতের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়তো দুই বাংলা যে মোটেও এক নয় একথাও তিনি ভাষার মারপ্যাঁচ দিয়ে একরকম বুঝিয়ে দিয়েছেন ঐ একই প্রবন্ধে তিনি লেখেন—

“রাজনৈতিক অর্থে ওঁরা আর আমরা এক হতে পারবো না কেন, তার কারণ এ নয় যে, ওঁরা প্রধানত মুসলমান ও আমরা প্রধানত হিন্দু। পাকিস্তানিরাও তো প্রধানত মুসলমান। নেপালীরাও তো প্রধানত হিন্দু। কারণটা এই যে, একটা নেশন সৃষ্টি হয় সংগ্রামের কামারশালে, অনেক মার খেয়ে, অনেক পোড় খেয়ে। ভারত যে সংগ্রামের ভিতর দিয়ে নেশন হয়েছে বাংলাদেশ সে সংগ্রামের ভিতর দিয়ে নেশন হয়নি। হয়েছে স্বতন্ত্র এক সংগ্রামের ভিতর দিয়ে, হয়েছে স্বতন্ত্র একদল শহীদের রক্ত মেখে। দুই নেশনের মার্টারোলজি দুই রকম। ওরা যাদের স্মরণ করেন আমরা তাদের করিনে। আমরা যাঁদের স্মরণ করি ওঁরা তাদের করেন না। একুশে ফেব্রুয়ারি, সাতই মার্চ, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বর ওঁদের পত্রিকায় এক একটি চিরস্মরণীয় দিবস। কোনোটি শোকের সঙ্গে, কোনোটি আনন্দের সঙ্গে। সে সব দিবস আমাদের কাছে অর্থবহ নয়। তেমনি আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় আরও কয়েকটি দিবস। শোকের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে । আমাদের সুখ-দুঃখ এক নয়।“২২

আসল কথা হচ্ছে, ফোর্ট উইলিয়ামের পথ ধরে বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে যে জাতীয়তাবাদ তৈরি হলো তার হিন্দুয়ানী কাঠামোটাই প্রধান। অবস্থা এমন দাঁড়ালো রাজনৈতিক ক্ষমতার সূত্রে বাঙ্গালী-হিন্দুরা বাঙ্গালী শব্দটাই আত্মসাৎ করলো এবং বাঙ্গালী মানেই হিন্দু এই সমীকরণ তৈরি করলো। মুসলমানরাও যে বাংলাভাষী এটা তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় স্থান পেলো না। প্রগতিশীল লেখক এস ওয়াজেদ আলী, যিনি মুসলিম লীগের স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতিকে সমর্থন করেননি, বিভাগ পূর্বকালে হিন্দু-মুসলিম যৌথ জাতীয়তাবাদের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তার চোখেও এ জিনিসটা গভীরভাবে ধরা পড়েছিলো। তিনি লিখেছেন-

“বিশ্ব মানবতার বড় সমর্থক হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্ব মানবতার বিষয় নিয়ে যত লিখেছেন, আর কেউ বোধ হয় তত লেখেননি। তাঁরই লেখা পড়ে এবং বক্তৃতা শুনে একদল দেশপ্রেমিক আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছেন। আর তারা ইসলামী সভ্যতাকে বাঙ্গালা দেশ থেকে তাড়াবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন এবং হিন্দু ও মোসলেম সভ্যতার সমন্বয় করে নতুন একটা কিছু গড়বার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা এসব করেছেন। তিনি অশেষ কষ্ট করে ভারতবর্ষ থেকে বড় বড় পণ্ডিত সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদ্র বালী দ্বীপে যাচ্ছেন হিন্দু কালচারের পুনরুত্থানের জন্য; পটরাজের পালা লিখেছেন, বাঙ্গালী ছেলেদের হিন্দু পৌত্তলিকতার আধ্যাত্মিকতা শেখাবার জন্য বেদমন্ত্র পাঠে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি উৎসব সম্পন্ন হচ্ছে প্রাচীন হিন্দু আদর্শকে জাগিয়ে রাখবার জন্য। যে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ লিখলে দশবার তাতে উপনিষদের উল্লেখ করতে ছাড়েন না, তাঁরই নির্দেশিত পথের অনুসরণ করে আমাদের সমাজের কতিপয় সাহিত্যিক ইসলামিক কালচারের শত্রুতা সাধনে আত্মনিয়োগ করেছেন। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস।

এই সেই দিন মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণশীল ভারতে, মিশনারীদের তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার করতে দেবেন না। কারণ, তাঁদের নিজস্ব ধর্মবাদই ভারতবাসীর পক্ষে যথেষ্ট। হিন্দুরা তাঁদের জাতীয় কালচারের প্রয়োজন কতটা অনুভব করেন, রবীন্দ্রনাথের এবং মহাত্মা গান্ধীর সাধনা ও উক্তি থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। হিন্দু সভ্যতা এবং স্বাধীনতার পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বঙ্কিমচন্দ্ৰ দেখেছিলেন। সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য আজ সমস্ত হিন্দু সমাজ উঠে পড়ে লেগেছেন। হিন্দু যে ভবিষ্যৎ ভারতীয় কালচারের স্বপ্ন দেখেন, তা লুপ্ত হিন্দু সভ্যতার দ্বিতীয় সংস্করণ ছাড়া আর কিছু নহে। এইভাবে হোসেন শাহের বাংলা যেভাবে বাংলাভাষীদের একত্রিত করার চেষ্টা করেছিল, ফোর্ট উইলিয়ামের বাংলা তার উল্টো দিকে হাঁটলো এবং বাংলাভাষীদের বিচ্ছিন্ন করে দিলো।“২৩

 

তথ্যসূত্রঃ

১. সজণীকান্ত দাস, বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস: কলকাতা চিরায়ত সংস্করণ ।

২. মুহম্মদ এনামুল হক, পূর্ব পাকিস্তানের তমদ্দুন, মাসিক মাহে নও, শ্রাবণ, ১৩৬৩ ।

৩. জীনাত ইমতিয়াজ আলী, বাংলা বানান: তৎসম শব্দ, সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক, ১৪০৩।

৪. উদ্ধৃত: সজণীকান্ত দাস, বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস ।

৫. প্রাগুক্ত ।

৬. প্রাগুক্ত ।

৭. উদ্ধৃত: ২৫ বছর পূর্তি স্মারক, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ২০১০।

৭. উদ্ধৃত: ২৫ বছর পূর্তি স্মারক, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ২০১০।

৮. অমলেশ ত্রিপাঠী, ইতালির র‍্যনেশাঁস বাঙালীর সংস্কৃতি। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ২০০২।

৯.Suniti Kumar Chatterji, Origin and Development of Bengali Literature.

১০. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ভারত সংস্কৃতি ।

১১. প্রাগুক্ত ।

১২. প্রাগুক্ত ।

১৩. নীহার রঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস আদি পর্ব ।

১৪. বঙ্কিম চন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়, ‘বাঙালীর উৎপত্তি’, বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড।

১৫. ত্রিপুরার রাজা দেব মাণিক্য কে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি (৭ বৈশাখ ১৩০৯, এপ্রিল ১৯০২), প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪৭ (সেপ্টেম্বর-অক্টোরব ১৯৪১), পৃষ্ঠা ৬৫৭ ।

১৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আত্মশক্তি’, রবীন্দ্র রচনাবলী ।

১৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘পরিচয়’, রবীন্দ্র রচনাবলী ।

১৮. প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক। কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৪১০ ।

১৯. এম জে আকবর, ভারত / অন্দরের অবরোধ। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৯৯২।

২০. প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র জীবনী ও রবীন্দ্র সাহিত্য প্রবেশক ।

২১. অন্নদাশঙ্কর রায়, ‘ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশে”, প্রবন্ধ সমগ্র-৮। কলকাতা: পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ ২০০৩ ।

২২. প্রাগুক্ত ।

২৩. এস ওয়াজেদ আলী, বাংলা সাহিত্য ও বাঙ্গালী মুসলমান ।

 

১০৭৫ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

জন্ম
যশাের জেলায় ২৮ অক্টোবর, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে।

শৈশব ও কৈশাের
যশাের জেলা স্কুল ও যশাের এম. এম. কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্ এন্ড সার্জন থেকে মনােরােগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

ফাহমিদ-উররহমান মননশীল প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী। ছাত্র জীবন থেকে লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এবং পেশাগত জীবনের বাইরে তিনি নিরন্তর নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও বৈশ্বিকভাবে বাঙ্গালি মুসলমানের স্থান নির্ণয়ের কাজে। সাহিত্যের নেশা তাকে টেনেছে। পেশার প্রাচীর তার কলম আটকিয়ে রাখতে পারেনি। নেশা তার বিচিত্র। ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি - সকল বিষয়ে তার আগ্রহ। এর ভিতর দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী যা দিয়ে তিনি হাঁটেন বহু বিচিত্র পথে। শিখেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলতে। প্রবল সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসচেতনা তাকে তাড়িত করে, যার ফলে তার লেখায় থাকে তত্ত্ব, তথ্য ও ভাবুকতার এক অনন্যপূর্ব আস্বাদ, যা তাকে একজন মূলত আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে চিহ্নিত করে। তার এই সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসাকে বিদ্বৎসমাজ শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।
Picture of ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

জন্ম
যশাের জেলায় ২৮ অক্টোবর, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে।

শৈশব ও কৈশাের
যশাের জেলা স্কুল ও যশাের এম. এম. কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্ এন্ড সার্জন থেকে মনােরােগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

ফাহমিদ-উররহমান মননশীল প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী। ছাত্র জীবন থেকে লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এবং পেশাগত জীবনের বাইরে তিনি নিরন্তর নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও বৈশ্বিকভাবে বাঙ্গালি মুসলমানের স্থান নির্ণয়ের কাজে। সাহিত্যের নেশা তাকে টেনেছে। পেশার প্রাচীর তার কলম আটকিয়ে রাখতে পারেনি। নেশা তার বিচিত্র। ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি - সকল বিষয়ে তার আগ্রহ। এর ভিতর দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী যা দিয়ে তিনি হাঁটেন বহু বিচিত্র পথে। শিখেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলতে। প্রবল সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসচেতনা তাকে তাড়িত করে, যার ফলে তার লেখায় থাকে তত্ত্ব, তথ্য ও ভাবুকতার এক অনন্যপূর্ব আস্বাদ, যা তাকে একজন মূলত আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে চিহ্নিত করে। তার এই সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসাকে বিদ্বৎসমাজ শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top