বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য সবুজ বিদ্যুতের ভবিষ্যৎ কী?

জীবাশ্ম জ্বালানির বিপুল ব্যবহার, লাগামহীন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু ঝুঁকির ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চিন্তক ও উদ্ভাবকরা পৃথিবীকে একটি নিরাপদ বাসযোগ্য গ্রহ হিসেবে সুরক্ষাদানের পথ ও পদ্ধতিগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিরন্তর। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষের পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি, কৃষি, অর্থনীতি ও জীবন রক্ষার সংগ্রাম বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বাংলাদেশ সবসময় পরিবেশ দূষণ সৃষ্টিকারী প্রধান দেশগুলোর কাছে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের নিজের নদী হত্যা, পরিবেশ দূষণ ও জীবাশ্ম জ্বালানির একমুখী নির্ভরতা নিয়েও চিন্তিত হওয়ার এবং দীর্ঘমেয়াদে বায়ু, পানি, পলিথিন ও রাসায়নিক দূষণ থেকে বেরিয়ে এসে গ্রিনহাউস গ্যাস নিরপেক্ষ হওয়ার রূপকল্প তৈরি করতে হবে। এজন্য দরকার একটি টেকসই নবায়নযোগ্য ও সবুজ জ্বালানি মহাপরিকল্পনা।

নবায়নযোগ্য সবুজ শক্তি নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, জ্বালানি বৈচিত্র্যের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করে, বর্ধিতহারে কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং পাশাপাশি আমদানি করা জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সহায়তা করে। নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ গ্রহ পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের জন্য সার্বিক মঙ্গল নিয়ে এসেছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধমান শক্তির চাহিদা মিটাতে সৌর ও বায়ুর মতো সবুজ শক্তির উৎসগুলো পৃথিবীর জলবায়ু, পরিবেশ, অর্থনীতি ও সামাজিক আন্তঃসম্পর্কগুলোর মধ্যে একটি নিরাপদ মিথস্ক্রিয়া তৈরি করছে।

  • নবায়নযোগ্য সবুজ বিদ্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান

বিদ্যুতের স্থাপিত সক্ষমতা ২১ হাজার ২৩৯ মেগাওয়াট এবং প্লান্ট-ফ্যাক্টর বিবেচনায় প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার ৭৪৮ মেগাওয়াট। তবে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট (বিপিডিবি, জানুয়ারি ২০২১)। মোট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ৭৫০ মেগাওয়াট, প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র তিন দশমিক ৬০ শতাংশ। বিদ্যুতের মাস্টার প্ল্যান পিএসএমপি-২০১৬ মতে, ২০২১ সালের মধ্যেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ মোট সক্ষমতার অন্তত ১০ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি-৭ মতে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১২ শতাংশ নবায়নযোগ্য করার শর্ত আছে। বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের শক্তিশালী প্রার্থী বলে মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১৭ শতাংশ নবায়নযোগ্য রাখার শর্ত মানা উচিত, যা নিম্নমধ্য আয়ের দেশের জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থানীয় ও বৈশ্বিক টেকসই লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশ পিছিয়ে।

  • সবুজ বিদ্যুতের রোডম্যাপ

২০৪১ সালের প্লাটিনাম জয়ন্তীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মিশ্রণ কী হবে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো মাস্টারপ্ল্যান রচিত হয়নি। তবে পিএসএমপি-২০১৬ কিছু সম্ভাব্য গাইডলাইন দিয়েছে। স্রেডা ও ইউএনডিপি’র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনমতে, জমিস্বল্পতা সত্ত্বেও সৌর বিদ্যুতায়নের মধ্যমানের কৌশলে ২০৪১ সালের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অন্যদিকে নদী অববাহিকা উন্নয়নের পাঁচ শতাংশ ভূমি, শিল্পাঞ্চলের রুফটপ ১৫ শতাংশ ভূমি প্রভৃতি নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের সৌর স্থাপনা মডেলে এই সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানো সম্ভব। ছোট ও মাঝারি আইপিপি সৌরশক্তি কেন্দ্র, ইউটিলিটি সোলার, এপিজেড-এসইপিজেড শিল্প ছাদ-অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিনি সৌরগ্রিড, সেচ, সোলার হোম, সোলার চার্জিং স্টেশন, কাপ্তাই লেক, ডেল্টা প্ল্যান, যমুনা-পদ্মা-তিস্তা-মেঘনা রিভার বেসিন রিস্টোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের ভূমি, হাওর এবং সুবিস্তৃত উপকূলকেন্দ্রিক সমন্বিত সৌর মহাপ্রকল্প নিয়ে একটি উচ্চ স্থাপনার মডেলে ২০৪১ সালের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ পরিকল্পনা সম্ভব। অর্থাৎ শুধু মধ্যপর্যায়ের সৌর বিনিয়োগেই ২০৪১ সালের স্থানীয় এবং বৈশ্বিক সবুজ বিদ্যুতের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।

 

 

  • সৌরবিদ্যুৎ: অমিত সম্ভাবনা  বাস্তবতা

সৌরবিদ্যুতের প্রসঙ্গ উঠলেই বাংলাদেশের জমিস্বল্পতার আলাপ উঠে যায়, কিন্তু আধুনিক বিশ্বের উদ্ভাবনী ইউজকেইসগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় না। উপরন্তু বাংলাদেশের সোলার ইর‌্যাডিয়ান্স সূচক বৈশ্বিক গড়মানের চেয়ে বেশ ভালো (নেদারল্যান্ডসের এক দশমিক ৪৩ গুণ)। CRESL অনুসারে বাংলাদেশের বার্ষিক ফোটো-ভোল্টায়িক সৌরশক্তিমান এক হাজার ৪০০ কিলোওয়াট পাওয়ারের বেশি। ভাসানচর, চরফ্যাশন, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোয় বিকল্প হিসেবে সৌর-বায়ুবিদ্যুতের সমন্বয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কমিউনিটি গ্রিডের সাশ্রয়ী মডেল দাঁড় করানো যায়। এই অঞ্চলে সৌর ও বায়ুশক্তির পটেনশিয়াল দেশের অপরাপর অঞ্চলের চেয়ে ভালো প্রমাণিত। ত্রুটিযুক্ত স্থাপনা ও দুর্নীতির পরে বায়ুবিদ্যুতের পাইলট সফল না হওয়ার বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। দেশের অন্যত্র স্বল্প বায়ুপ্রবাহজনিত সমস্যা থাকলেও উপকূলীয় ও চরাঞ্চলে গড় বায়ুপ্রবাহ মান লো-উইন্ড-ফ্লো টার্বাইনের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট। উপকূলীয় ও চরাঞ্চলে স্থানীয়ভাবে সৌর-বায়ুর মিশ্র সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন মডেল ও কমিউনিটি বিতরণ ব্যবস্থা দাঁড় করানো নিশ্চয়ই একটি টেকসই কাজ হবে। প্যারিসভিত্তিক নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা সংস্থা রেন২১-এর নির্বাহী পরিচালক রানা আবিদের মতে, ‘স্থানীয়ভাবে বিতরণকৃত বিকেন্দ্রীভূত সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত একটি জ্বালানি ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের ঘনঘন ঝুঁকি ও ধাক্কার বিপরীতে অনেক বেশি নমনীয় এবং স্থিতিশীল।’ (বিস্তারিত দেখুন)

সৌরবিদ্যুতের জমি সমস্যার বিষয়টি সত্য। তবে যেহেতু বিকল্প স্থানীয় সমাধান আছে, তাই সেগুলোকে কাজে লাগাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা দরকার। সৌরশক্তির স্টোরেজ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মানসম্পন্ন স্থানীয় ব্যাটারি উৎপাদন কিংবা আমদানি নিশ্চিত করতে হবে; দরকার সুলভে উচ্চমান কনভার্টার ও ডিসি সামগ্রীর নিশ্চয়তা। ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরের বিদ্যুৎ স্টোরেজ (যেমন টেসলা স্টোরেজ সাউথ অস্ট্রেলিয়া) নিয়ে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিই একমাত্র সৌর স্টোরেজ বিকল্প নয়, আছে ফ্লো-ব্যাটারি (যেমন প্রাইমাস পাওয়ার), আয়ন-সল্ট-ওয়াটার ব্যাটারি (যেমন ইএসএস), গ্র্যাভিটি স্টোরেজ (যেমন এনার্জি-ভল্ট)।

  • জলবিদ্যুৎ কতটা সবুজ?

১০০ বছর ধরে জলবিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের বৃহত্তম বৈশ্বিক উৎস হলেও আধুনিক গবেষণা বলছে, জলবিদ্যুৎ পুরোপুরি সবুজ নয়। এতে বিস্তৃত অঞ্চলের ইকোলজি-ভেজিটেশন (প্রতিবেশ) নষ্ট হয়। বৃহৎ নির্মাণযজ্ঞে কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অপরাপর গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। গবেষণা সংস্থা ‘এনার্জি মিনিট’-এর মতে, বর্তমান বিশ্বের ২৩ শতাংশ এনথ্রোপোজেনিক মিথেন উৎপাদনের জন্য দায়ী বিশ্বের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো। কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও মিথেন ৩০ গুণ বেশি ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস (সূত্র: এনার্জি-মিনিট)। ‘নেপালের জলবিদ্যুৎ খাতের চ্যালেঞ্জ ও সুবিধার মূল্যায়ন’ নামক গবেষণা প্রবন্ধে শর্মা তেজস্বী বলেছেন, ‘হিমালয়ান নদীগুলোর বেশিরভাগ জলবিদ্যুৎকেন্দ্র অত্যধিক ভাঙন, পলিপতন ও অবক্ষেপে পড়ে। এতে জলাধারের ক্ষমতা ও জীবনকাল সংকুচিত হয়।’ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের হাত ধরে অনিয়মিত বন্যার অভিশাপ অমূলক নয়। একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধের জলাধার ভরাটে কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। এ সময়ে জলপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে ভাটিতে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পলিবাহিত নদীতে বাঁধ দেয়ায় তা ভাটিতে পলিপতনজনিত উর্বরতা হ্রাস করে। এতে ম্যানগ্রোভ বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্বাদুপানিতে লবণাক্ততা বাড়ে এবং ব-দ্বীপায়ন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। ভারতে তাই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে পরিবেশবাদী আন্দোলন সক্রিয়।

  • জলবিদ্যুৎ আমদানি

বাংলাদেশে নন-নিউক্লিয়ার নবায়নযোগ্য বা সবুজ বিদ্যুতের কথা উঠলেই ভারত থেকে ‘চিপ অ্যান্ড ক্লিন’ জলবিদ্যুৎ আমদানির পরামর্শ আসে। বস্তুত ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের হিমালয়ান কম্পোনেন্ট অর্থাৎ অরুণাচলে পরিকল্পিত ১৫৪ টি জলবিদ্যুৎ বাঁধের পরিকল্পনা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এই অঞ্চলে বহুপক্ষীয় ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করবে। এর মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রে ইয়ারলাং সাংপো জলবিদ্যুতের মতো অতি বৃহৎ প্রকল্পগুলোর বৈধতা খুঁজবে চীন। ব্রহ্মপুত্রের বিপুল পানিসম্পদ ব্যবহার করে তিব্বতের বিদ্যুৎ ঘাটতি কমাতে চারটি বৃহৎ বাঁধ আগেই পরিকল্পিত হয়ে আছে। বাংলাদেশে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রে বহমান পানির বড় অংশ আসে অরুণাচল ও আসামে বিপুল মৌসুমি বৃষ্টি থেকে। তাই ভারতের বাঁধে শুধু মৌসুমি পানিপ্রবাহকেন্দ্রিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থাকবে না, বরং এতে বৃহৎ জলাধার ভরাট ও আন্তঃসংযোগের বিষয়ও জড়িত থাকবে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মৌলিক ও বৃহৎ লক্ষ্য হচ্ছে, ‘ওয়াটার সারপ্লাস’ অঞ্চল থেকে ‘ওয়াটার স্কার্সিটি’ অঞ্চলের দিকে পানীয় জল ও সেচের পানি প্রবাহিত করা।

‘ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানিসম্পদ প্রতিযোগিতা: চীন, ভারত ও বাংলাদেশ’ সিএনএ-২০১৬ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে (পৃ-৩৩) বলা হয়েছে,

‘ভারতে পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশ যে বোধগম্য হুমকির মুখোমুখি হয়েছে, তা তিব্বতে চীনের বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগের কাউন্টার প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন চীনা বিশ্লেষণে ভারতের জল প্রত্যাহার পরিকল্পনাকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাইলাইট করে বলা হয়েছে, এটি ভাটির প্রতিবেশীর ওপর মারাত্মক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বেইজিংয়ে সিএনএ’কে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে চীনের এক বিশেষজ্ঞ যুক্তি দিয়েছিলেন, সম্ভাব্য ভারতীয় ডাইভার্সন পরিকল্পনাগুলো বাংলাদেশের স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে এবং প্রবাহিত নদীর ভাটির অঞ্চলে হুমকি থাকায় বাংলাদেশের কিছু বলার অধিকার রয়েছে। মোদ্দাকথা হচ্ছে, ভারত চীনের উজানের উন্নয়নের উদ্যোগের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে দ্বৈত-নীতি প্রয়োগ করছে।’

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় ভারতের সীমানা মার্জিনাল (জনসংখ্যার তিন শতাংশ, ভূমির ছয় শতাংশ)। অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল এই অঞ্চল চীনের ভূমির তিন শতাংশ। ব্রহ্মপুত্র বেসিন বাংলাদেশের ভূমির ২৭ শতাংশ। এখানে জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বসবাস। সিএনএ গবেষণামতে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বর্তমানে বাংলাদেশের সেচ চাহিদার অন্তত ২৫ শতাংশ পানি ঘাটতি রয়েছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের যমুনা চলমান শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ৭০০ মিটারে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে চীন ও ভারতের উপর্যুপরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় চরম পানি সংকট দেখা দেবে, যা বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন স্বাদুপানির প্রধান উৎস। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অরুণাচলকেন্দ্রিক জলবিদ্যুৎ আমদানিতে অংশ নেয়া মোটেই সমীচীন নয়।

যেহেতু ভারতে কয়লা উৎপাদিত বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত রয়েছে এবং ভারত বৈশ্বিক নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের লক্ষ্য অর্জনে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, তাই অরুণাচলের অতি খরুচে জলবিদ্যুৎ আদতে ভারতের প্রয়োজন নেই, দরকার আসলে পানি প্রত্যাহারের। বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ করিডোরের অনুমতি দেয়, তবে ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) নদী ও এর শাখা নদীর ওপর পরিকল্পিত ১৫০+ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হয়ে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পকে এগিয়ে নেবে। আশঙ্কা হয়, এই প্রক্রিয়া ভাটির ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) নদীটিকে ধীরে ধীরে হত্যা করবে। তদুপরি এই বাঁধগুলোর অনেকগুলো জলাধার হিসেবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে চ্যানেল দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, মানস-শঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে এরই মধ্যে যমুনা নদীর শাখা নদী মানস ও শঙ্কোশের পানি সরিয়ে নেয়ার মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে। (সূত্র: ইন্ডিয়া ওয়াটার পোর্টাল/ন্যাশনাল-রিভার-লিংকিং-প্রজেক্ট)। মোটকথা, নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের নামে বাংলাদেশকে কোনোভাবেই জলবিদ্যুৎ আমদানির ফাঁদে পড়া যাবে না।

  • সর্বোচ্চ কী পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করা যাবে?

‘হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার ইভাকুয়েশন মাস্টার প্ল্যান অব অরুণাচল (ইন্ডিয়া)’ (সূত্র: জেটিটি রিপোর্ট, ২০১৪) ছয়টি সাত হাজার ও একটি ছয় হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৮০০ কেভি হাই-ভোল্টেজ বাই-পোলার গ্রিড সঞ্চালন লাইনের জন্য বাংলাদেশের ভূমি দরকার। এতে প্রতীয়মান হয়, বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ রপ্তানির প্রস্তাব মূলত বিদ্যুৎ করিডোরের মূল লক্ষ্য (ড্রপ অ্যান্ড ক্যারি ওভার বাংলাদেশ)। যেখানে বাংলাদেশে সড়ক প্রশস্ত করার কিংবা সৌরবিদ্যুতের জমিস্বল্পতা বহুল আলোচিত বিষয়, সেখানে সাতটি হাই-ভোল্টেজ সঞ্চালন লাইনের ভূমি বরাদ্দ পুরোপুরি অসম্ভব। এরই মধ্যে বিপিডিপি-পিজিসিবি-পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের অধিগ্রহণকৃত জমির বিষয়ে শত শত মামলা রয়েছে।

গ্রীষ্মকালীন চাহিদা আমলে নিয়েই বর্তমানে বাংলাদেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ সক্ষমতার প্রায় ৫৯ শতাংশ অলস। বিপিডিবি হিসেবে ২০৩০ সালে অন্তত ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অলস থাকবে। ফলে ১৮তম জেএসসি মিটিংয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন নেই বলেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ আমদানির নির্দেশনা দেয়া আছে পিএসএমপি-২০১৬-তে। বাংলাদেশ বর্তমানে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে ভারত থেকে। নতুন আমদানির চুক্তি হয়েছে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের। আমদানি বিদ্যুৎ রেকর্ড উৎপাদনের ২১ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে কৌশলগত জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আমদানির সুযোগ নেই।

যেহেতু ভারত ও চীন সৌরবিদ্যুতায়নে খুবই আশাব্যঞ্জক অবস্থান তৈরি করেছে, তাই দেশ দুটোর সঙ্গে সৌরবিদ্যুতায়নের দ্বিপক্ষীয়/বহুপক্ষীয় বিনিয়োগ মডেল তৈরি করা যেতে পারে। সবদিক বিবেচনায় ব্যক্তি ও বাণিজ্যিক স্টোরেজসহ সৌরবিদ্যুৎই বাংলাদেশের টেকসই জ্বালানির প্রধানতম ভবিষ্যৎ। সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির অবকাঠামো তৈরি করা গেলে আরবান সোলার-হোম বিপ্লব হবে। অন্যদিকে সর্বোচ্চ ঘনবসতির দেশে বায়োবিদ্যুতের প্রসার চাই। সীমিত আকারে জিও-থার্মাল, উপকূলীয় বায়ুবিদ্যুৎ, ওশান পাওয়ার (অনশোর উইন্ড ও হাইড্রো টার্বাইন মিক্স) নিয়েও স্থির লক্ষ্যনির্ভর কাজ করা উচিত। পাশাপাশি কার্বন ট্যাক্স চালু করে বিকল্প স্থানীয় সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারে ব্যক্তিগত, শিল্প ও করপোরেট প্রণোদনা দানও সময়ের চাহিদা।

 

১১২৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ফয়েজ আহমদ তৈয়ব

ফয়েজ আহমদ তৈয়ব

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ, ১৯৮০ সালে কুমিল্লা জেলার লাকসাম (মনোহরগঞ্জ) উপজেলার খিলা ইউনিয়নের বান্দুয়াইন গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক। তিনি ১৯৯৭ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৯৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল-এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সময়কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ অধ্যয়ন করেন। ২০০৫ থেকে অদ্যাবধি টেলি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিসবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি সিনিয়র সফটওয়্যার সল্যুশন আর্কিটেক্ট হিসেবে ‘ভোডাফোন জিজ্ঞো’ নেদারল্যান্ডস-এ কর্মরত আছেন। ইতিপূর্বে তিনি এলকাটেল লুসেন্ট বাংলাদেশ, টেলিকম মালয়েশিয়া বাংলাদেশ একটেল (বর্তমান রবি), এমটিএন কমিউনিকেশনস নাইজেরিয়া, এরিকসন নাইজেরিয়া, এরিকসন ঘানা, এরিকসন দক্ষিণ কোরিয়া, এরিকসন নেদারল্যান্ডস এ কাজ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ এবং পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডিজাইন ও বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। জনাব ফয়েজ তৈয়্যব একজন ‘টেকসই উন্নয়ন ও অবকাঠামো’ বিষয়ক প্রবন্ধকার। টেকসই উন্নয়নের নিরিখে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের কাঠামোগত সংস্কার, সুশাসন, প্রতিষ্ঠানিক শুদ্ধিকরন এবং প্রযুক্তির কার্যকরীতার সাথে স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশের ছোট বড় সমস্যা সমাধানের পর্যালোচনা করে থাকেন। তিনি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের আর্থ সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চান। তাই এসকল বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মুক্ত চিন্তা স্বাধীন ভাবে প্রকাশের প্রয়াস করেন। তাঁর লিখায় যা বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পায়ঃ সাস্টেইনএবল ডেভেলপমেন্ট এর নিরিখে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পদ্ধতিগত দিক, বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের ডিজাইন ত্রুটি, অর্থনীতি শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কৃষি ইত্যাদি খাতের কারিগরি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তনের কারিগরি প্রস্তুতি, ম্যাক্রো ও মাইক্রো ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টের কারিগরি দিক এবং অটোমেশন। সামাজিক সংযোগের দিক থেকে উনি একজন টেকসই উন্নয়ন কর্মী, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। গ্রীণপিস নেদারল্যান্ডস এর সদস্য। দৈনিক বণিকবার্তা, দৈনিক শেয়ারবিজ ও দৈনিক প্রথম আলো অনলাইনের উপ সম্পাদকীয় কলাম লেখক।
Picture of ফয়েজ আহমদ তৈয়ব

ফয়েজ আহমদ তৈয়ব

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ, ১৯৮০ সালে কুমিল্লা জেলার লাকসাম (মনোহরগঞ্জ) উপজেলার খিলা ইউনিয়নের বান্দুয়াইন গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ইলেক্ট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক। তিনি ১৯৯৭ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৯৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল-এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সময়কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ অধ্যয়ন করেন। ২০০৫ থেকে অদ্যাবধি টেলি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিসবে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি সিনিয়র সফটওয়্যার সল্যুশন আর্কিটেক্ট হিসেবে ‘ভোডাফোন জিজ্ঞো’ নেদারল্যান্ডস-এ কর্মরত আছেন। ইতিপূর্বে তিনি এলকাটেল লুসেন্ট বাংলাদেশ, টেলিকম মালয়েশিয়া বাংলাদেশ একটেল (বর্তমান রবি), এমটিএন কমিউনিকেশনস নাইজেরিয়া, এরিকসন নাইজেরিয়া, এরিকসন ঘানা, এরিকসন দক্ষিণ কোরিয়া, এরিকসন নেদারল্যান্ডস এ কাজ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ এবং পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ডিজাইন ও বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। জনাব ফয়েজ তৈয়্যব একজন ‘টেকসই উন্নয়ন ও অবকাঠামো’ বিষয়ক প্রবন্ধকার। টেকসই উন্নয়নের নিরিখে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের কাঠামোগত সংস্কার, সুশাসন, প্রতিষ্ঠানিক শুদ্ধিকরন এবং প্রযুক্তির কার্যকরীতার সাথে স্থানীয় জ্ঞানের সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশের ছোট বড় সমস্যা সমাধানের পর্যালোচনা করে থাকেন। তিনি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের আর্থ সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চান। তাই এসকল বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মুক্ত চিন্তা স্বাধীন ভাবে প্রকাশের প্রয়াস করেন। তাঁর লিখায় যা বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পায়ঃ সাস্টেইনএবল ডেভেলপমেন্ট এর নিরিখে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন পদ্ধতিগত দিক, বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের ডিজাইন ত্রুটি, অর্থনীতি শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কৃষি ইত্যাদি খাতের কারিগরি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তনের কারিগরি প্রস্তুতি, ম্যাক্রো ও মাইক্রো ইকোনমিক ম্যানেজমেন্টের কারিগরি দিক এবং অটোমেশন। সামাজিক সংযোগের দিক থেকে উনি একজন টেকসই উন্নয়ন কর্মী, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট। গ্রীণপিস নেদারল্যান্ডস এর সদস্য। দৈনিক বণিকবার্তা, দৈনিক শেয়ারবিজ ও দৈনিক প্রথম আলো অনলাইনের উপ সম্পাদকীয় কলাম লেখক।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top