ইতিহাসের গতিপথ কে পরিবর্তন করে?
ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন!!
তবে এই বিষয় নিয়ে দুই ধরণের মত রয়েছে,
১। অনেক বড় বড় ব্যক্তিগণ আছেন যারা ইতিহাসের গতিপথকে পরিবর্তন করে দেন।
২। ইতিহাস মূলত তার নিজস্ব গতিতেই চলতে থাকে, এই চলার পথে যে সকল ঘটনা ঘটে কিংবা যে সকল ব্যক্তিগণই আসে তারা মূলত ইতিহাসের অংশ বিশেষ, ইতিহাস কেবলমাত্র তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে!
তবে, এই দুইটি বিতর্কের চেয়ে যে বিষয়টি বেশী গুরুত্ত্বপূর্ণ এই পরিবর্তনের পেছনে মূল চালিকা শক্তি কি? কোন কারণে মানুষ পরিবর্তনের দিকে ছুটে চলে? কোন বিষয়টি মানুষকে মুক্তির নেশায় পাগল করে তুলে?
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই অনেক বড় বড় ব্যক্তিগণ এসেছেন তারা মানব সভ্যতার গতিপথকে পরিবর্তন করে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণ হলেন আল্লাহর নবীগণ। অনেকেই আবার দার্শনিকগণকে অনেক পরিবর্তনের অনেক বড় প্রভাবক বলে বিবেচনা করে থাকেন।
হ্যাঁ! দার্শনিকগণ অনেক পরিবর্তন আনতে পারেন তবে নবীগণ যে পরিবর্তন আনেন, দার্শনিকগণ তার কল্পনাও কখনো করতে পারেন না। এটা ইতিহাস দ্বারা প্রমানিত।।
আমরা যদি আধুনিক ইতিহাসের কথা ধরি তাহলে দেখতে পাই যে, ইতিহাসের আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে রাসূলে আকরাম (সঃ) এর মধ্য দিয়ে। ১৮০০ সালের আগপর্যন্ত প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যে ইতিহাস বিষয়ক যত বই লেখা হয়েছে সকল বইয়েই আধুনিক যুগ শুরু হয়েছে রাসূল (সঃ) মধ্য দিয়ে।
এর জন্য আবার হয়ত বা কেউ কেউ আমার কাছে দলীল চাইবে। এর অনেক দলীল রয়েছে একটু খুঁজে দেখলেই ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। আমি শুধুমাত্র একটি উদাহরণ দিচ্ছি, বিখ্যাত ঐতিহাসিক Will Durant, বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীকে The Age of Voltaire বলে অভিহিত করেছেন। যদিও তিনি Enlightenment Philosopher এবং অষ্টাদশ শতাব্দী ইউরোপিয়ান চিন্তা দর্শনের ইতিহাসে এনলাইটেনমেন্টের যুগ বলে পরিচিত। এই ভলতেয়ারও তার লেখা ইতিহাসের বইয়ে আধুনিক যুগের সূচনা করেছেন মুহাম্মদ (সঃ) মাধ্যমে। যদিও ভলতেয়ার ছিল চরম ইসলাম বিদ্বেষী। তাহলে কেন তিনি মুহাম্মদ (সঃ) কে এমন জায়গায় স্থান দিলেন? তিনি নিজের ইচ্ছায় দেন নাই, তিনি দিয়েছেন বাধ্য হয়ে। কারণ অষ্টদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাসের পর্যায় ছিল দুইটি,
১। প্রাচীন যুগ,
২। আধুনিক যুগ।
আর এই আধুনিক যুগ শুরু হত রাসূলে আকরাম (সঃ) এর মাধ্যমে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ইতিহাসে মধ্যযুগ বলতে কিছু ছিল না।
তো যাই, হোক এখন ফিরে আসি মূল কথায়, কোন বিষয়টি রাসূলে আকরাম (সঃ) মানব সভ্যতার আধুনিক রূপকারে পরিণত করেছিল? কোন বিষয় সমূহের কারণে এমন একদল সাহাবীকে তিনি পেয়েছিলেন যারা তাঁর বাণীকে মানুষের নিকট পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছড়িয়ে পড়েছিলেন সমগ্র বিশ্বে?
বড় বড় মুসলিম মনিষীগণ মনে করেন এর পেছনে মূল চালিকা শক্তি ছিল তাঁর ভিশন! তিনি মানুষকে ভিশন দেখিয়েছিলেন গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্ত করার। সূরা বালাদের এই আয়াত সমূহই ছিল তার ভিশন, মানুষকে দাসত্ত্ব থেকে মুক্ত করা, এতিম ও অভাবীদেরকে খাদ্য দেওয়া।
তিনি করেছিলেনও তাই। তিনি মানুষকে বলেছিলেন ইসলাম আসলে; তোমরা সকল প্রকার দাসত্ত্ব থেকে মুক্তি পাবে, ইসলাম আসলে; কেউ না খেয়ে মরবে না। ইসলাম আসলে মানুষ আদালত থেকে বঞ্চিত হবে না।
মক্কী যুগে অবতীর্ণ এই আয়াতগুলোই পরবর্তীতে উচ্চারিত হয়েছিল জা’ফর বিন আবু তালেবের মুখে বাদশাহ নাজ্জাশীর সামনে, রাবীয়া ইবনে আমরের মুখে পারস্যের সেনাপতি রুস্তমের সামনে, দাহিয়াতুল কালবীর মুখে রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সামনে, হাতেব ইবনে আবী বালতাআ মুখে আলেকজান্দ্রিয়ার সম্রাট মুকাউকিসের সামনে এবং সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহর মুখে বসনিয়ান নির্যাতিত জনতার সামনে।
মূলত রাসূলে আকরাম (সঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে যে এক ভিশন দিয়েছিলেন এই ভিশনের কারণে তিনি মানব সভ্যতার আধুনিক যুগের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মানুষকে আহবান করে বলেছিলেন,
أيها الناس إن ربكم واحد وإن أباكم واحد كلكم لآدم وآدم من تراب
হে মানুষ সকল, তোমাদের সকলের রব এক। তোমাদের আদি পিতাও একজন। তোমরা সকলেই আদম (আ.)-এর সন্তান; আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট।
তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থায় রাসূল (সঃ) এই সকল আহবান মানুষের মধ্যে কাজ করেছিল চুম্বকের মত। তাইতো ইসলামের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে মিন্দানাও থেকে কর্ডোভা পর্যন্ত মানুষ ইসলামের ছায়া তলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল।
ইসলামী চিন্তার ইতিহাসে পর্যায়কালের আলোকে ক্ল্যাসিক্যাল যুগের বিখ্যাত ফকিহ ও রাজনৈতিক দার্শনিক আল মাওয়ারদি তাঁর বই ‘ আল আহকামুস সুলতানিয়া’ নামক কালজয়ী গ্রন্থে বলেন, একটি রাষ্ট্রকে স্থায়িত্ব দান করে সেই রাষ্ট্রের আগামীকালের ওয়াদা। অর্থাৎ সেই রাষ্ট্রের যারা শাসকবর্গ তার জনগণকে ভবিষ্যৎ দেখাচ্ছে কিনা? ভিশন বা ওয়াদা এতটাই গুরত্বপূর্ণ।
দুঃখজনক হলেও সত্য আজ আমাদের মধ্যে এমন নেতা কিংবা দল নেই, যারা আমাদের জাতির সামনে ভিশন তুলে ধরবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে ‘ আগামীর বাংলাদেশ’ ‘ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ’ , ইসলামী সভ্যতার ভবিষ্যৎ এমন ভিশন তুলে ধরে, যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করবে।
আজ আমাদের প্রয়োজন এমন নেতার যারা আমাদের সামনে বাস্তুবধর্মী কর্মপন্থা তুলে ধরবে।।
আজ যদি আমরা এই কাজ না করতে পারি তাহলে হয়তো আমাদেরও অবস্থা হবে অন্যান্য ধর্মের মত, বা আদর্শের মত। যারা আজ ইতিহাসের কোন ফ্যাক্টর নয়। কেউ আজ যাদেরকে নিয়ে কোন প্রশ্ন করে না, কোন আগ্রহও বোধ করে না।