(প্রবন্ধটি ১৯৭২ সালের ১২ আগস্ট দারুল উলূম দেওবন্দের দারুল হাদীসে মাওলানা মিন্নাতুল্লাহ রহমানী আমীরে শরীয়ত বিহার-এর এক মাহফিলের সভাপতিত্বে ছাত্রদের এক সভায় পাঠ করা হয়। পরে তা মজলিসে তাহকীকাত থেকে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়)
আমি নিজেকে আপনাদের থেকে পৃথক মনে করি না। কারণ আমি তখনও তালেবে ইলম ছিলাম এবং এখনও তালেবে ইলম আছি। আর তালেবে ইলম হয়েই থাকতে চাই। আমার জীবন জ্ঞান ও চিন্তার সাথে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। তাই আমি চাই যে, এ ধারা যেন আজীবন গাঁথা থাকে। আমি আপনাদের সামনে ঐ শব্দ বলতে চাই যা প্রিয় নবী (সা.) আনসার ও মদীনাবাসীদের শানে ইরশাদ করেন :
الْمَحْيَا مَحْيَاكُمْ وَالْبَمَاتُ مَبَاتُكُمْ
“আমার জীবন তোমাদের সাথে এবং আমার মৃত্যুও তোমাদের সাথে।” আল্লাহ্ আমার এ দু’আ যেন কবুল করেন।
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার আসল কারণ ছিল দ্বীনি আত্মমর্যাদাবোধঃ
আমার প্রিয় তালেবে ইলম! আমি আপনাদের কাছে জানতে চাই যে, আপনাদের এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হবার পিছনে আসল ভূমিকা কী ছিল? আপনাদের এ দারসগাহের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কী? নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে এ ক্ষেত্রে বড় বড় যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য উত্তর থাকবে। আপনি যদি বলেন যে, জ্ঞানের পুনর্জাগরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত, ইখলাস, আখলাক, মারহামাত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত, সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করার জন্য বা হাদীসের দারস প্রদানের জন্য এর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তাহলেও কেউ তা নিয়ে মতবিরোধ করতে পারবে না। এ সকল বিষয় শতবার বরকতময় বস্তু এবং তার উপর যতই ফখর করা হোক না কেন, তা অতি নগণ্য। কিন্তু এ সকল বিষয় এমন, যাতে ভারতীয় উপমহাদেশের সকল মাদরাসা দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে শরীক। তবে, হয়ত এ ক্ষেত্রে স্তর ও মর্যাদাগত পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু সকল মাদরাসা এ সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠিত। এ সকল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মাদারাসাসমূহ নিজের বক্ষে ধারণ করে আছে এবং এর মাঝেই তার সঠিক মূল্য ও মূল্যায়ন নিহিত রয়েছে। কিন্তু যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের উপর আপনাদের এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যা তার ভিত্তি প্রস্তর রাখার মূল উদ্দেশ্য, (এটি এমন কোন ভিত্তি প্রস্তর রাখা নয়, যা সাধারণত সম্মানিত ব্যক্তি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে রাখা হয়ে থাকে এবং যার উপলক্ষ্য করে বড় বড় মাহফিল ও জলসার আয়োজন করা হয়ে থাকে) তা হলো দ্বীনি আত্মমর্যাদাবোধ ও ইসলামের রক্ষা বা পুনর্জাগরণী বার্তা নিয়ে আসা। বস্তুত এটিই হলো দারুল উলূম দেওবন্দের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
পাশ্চাত্য সভ্যতার ও শিক্ষার ফিতনার মুকাবিলাঃ
ঐ সময় যখন ভারতীয় উপমহাদেশের একটি নতুন সভ্যতার আগমন হয়, তখন এ দেশে একটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছিল। ঠিক ঐ সময় দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত দারুল উলূম দেওবন্দ এ চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত হয় যে, এখন ভারতীয় উপমহাদেশে যে যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে, তা আসলে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিধান অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত কোন যুগের বা সভ্যতার উদ্ভব হচ্ছে না বরং যে সভ্যতার সূচনা হতে যাচ্ছে, তার মূলনীতি হলো বস্তুবাদী জীবনকে আসল মনে করা, অনুভব করা বস্তুর ও লৌকিকতার পূজা।
সঠিক কর্মক্ষেত্র নির্ধারণঃ
ঐ সময় যখন মোঘল শাসনামলের আলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তখন সে যুগের নূরানী কলবসম্পন্ন আলেমগণ এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেন যে, মৃতপ্রায় রাষ্ট্রকে বাঁচাতে আমাদের সময় ব্যয় করা এবং এ নিভু নিভু চেরাগ, যার তেল শেষ হয়ে গিয়েছে এবং যার সলতে পুড়ে গেছে, তাকে আবার প্রজ্জ্বলিত করা শুধু মুশকিল কাজই নয়; বরং একটি নিরর্থক কাজ। কারণ, যে গাছ শুকিয়ে গেছে, তা বাঁচার যোগ্যতা হারিয়েছে এবং তার সজীবতা শেষ হয়ে গেছে, তাকে বাইরের কোন উপকরণ দ্বারা সজীব রাখা বা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। যেন ঐ সকল আলেমের সামনে বিশিষ্ট দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ইবন খালদূনের এ প্রজ্ঞাময় উক্তি ছিল যে ” أَلْهَرَمُ إِذَا نَزَلَ بِالدَّوْلَةِ لَا يَرْتَفِعُ . “যখন কোন রাষ্ট্র বার্ধক্যে উপনীত হয় তখন তার বার্ধক্য দূর করে নতুনভাবে তাকে যৌবন দান করা সম্ভব নয়।”
তাঁরা মনে করেন যে, যদি কোন প্রতিষ্ঠান জীবন শেষ করে মৃত্যুপথের পথিক হয়ে যায় এবং তার প্রাণবায়ু উড়ে যাবার সময় হয়ে যায়, তাকে কোন তেলেসমাতির কারিশমা দ্বারা বাঁচিয়ে রাখা যায় না। ফলে, তাঁরা নিজেদের যোগ্যতাসমূহের দ্বীনদারী ও আমানতদারীর সাথে বাস্তবসম্মত পর্যালোচনা করেন। অতঃপর নিজেদের যোগ্যতাসমূহকে অত্যন্ত চিন্তা-ভাবনা করে ইসলামী সভ্যতা ও ইসলামী জ্ঞানের পুনর্জাগরণের জন্য স্থির করেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর মাধ্যমে আমাদেরকে যে জীবন বিধান ও যে কিতাব প্রদান করা হয়েছে, শরী’আতের যে বিধি-বিধান প্রদান করা হয়েছে, যে সভ্যতার উত্তরসূরী বানানো হয়েছে, আমাদেরকে যে সকল উসূল ও মূলনীতি প্রদান করা হয়েছে তার সাথে শীত ও বসন্ত, যৌবন ও বার্ধক্য, উন্নতি ও অবনতি, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন, হায়াত ও মওতের এ স্বাভাবিক নিয়ম কার্যকর নয়; যদিও তা গোটা বিশ্বজগতের মাঝে কার্যকর রয়েছে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা হলো:
لَّا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ .
“তার কাছে মিথ্যা না আগে থেকে আর না পিছে থেকে আসতে পারে। এ তো প্রশংসিত ও মহা প্রজ্ঞাময়ের পক্ষ হতে নাযিলকৃত।” [সূরা হামীম সাজদা : ৪২]
• এর হাকীকত হলো এই যে,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا .
“আজকে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেছি এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করেছি ও তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে পছন্দ করেছি।” [সূরা মায়িদা: ৩]
এ ঘোষণা তার স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের যামিন। তাই তাঁরা তাদের সকল শক্তি ইসলামী জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও ইসলামী সভ্যতাকে স্বস্থানে শুধু যে বহাল রাখার ক্ষেত্রে ব্যয় করেছেন তা নয়; বরং তার পরিধি বিস্তৃত করেছেন এবং জীবনের সাথে তার সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ব্যয় করেছেন। এটি আল্লাহ্ তা’আলার খাস তাওফীক ও সহযোগিতা ছিল। ফলে, তাঁরা নিজেদের চেষ্টা ও প্রচেষ্টার জন্য সঠিক কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করতে সক্ষম হন। এ সময় তাঁদের ন্যূনতম ভুল শত শত বছর পিছনে নিয়ে যেত এবং এ ক্ষতি আর কখনো পূরণ হবার ছিল না।
মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবী সাহেব (রহ.)-এর আসল বিশেষত্বঃ
হযরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবী (রহ.) ও তাঁর মহান সঙ্গী মাওলানা রশীদ আহমদ সাহেব গাঙ্গুহী (রহ.) ও অন্যান্য সাথীগণের মাঝে যে জযবা কার্যকর ছিল, তা হলো দ্বীনি আত্মমর্যাদাবোধের জযবা। এ জযবাই তাঁদেরকে এ দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবী (রহ.) দ্বীনি ইলমের ক্ষেত্রে ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখতেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে ইলমে কালাম ও মাআরিফে ইলাহির ক্ষেত্রে দরাজ হস্ত ও রহস্য উদঘাটনের অসাধারণ যোগ্যতা ও দৌলত প্রদান করেন। এর প্রমাণ হলো তাঁর মূল্যবান গ্রন্থসমূহ। যেমন ‘আবে হায়াত’, ‘তাকরিরে দিলপযীর’, এবং ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে ইসলামী আত্মমর্যাদাবোধ পূর্ণমাত্রায় দান করেছিলেন এবং আল্লাহ্ তাঁকে অস্থির হৃদয় ও উত্তাল দিল প্রদান করেন। তিনি দেখতে পান যে, যে ভারতীয় উপমহাদেশে আমাদের পূর্বসূরীগণ নিজেদের সর্বোত্তম যোগ্যতাসমূহ ব্যয় করেছেন এবং যারা ইসলামের খেদমতে এবং দ্বীনি ইলমের ময়দানে এমন উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন যার নজীর বড় বড় ইসলামী দেশ পেশ করতে অক্ষম।
ইসলামী ইতিহাসের স্বর্ণালি অধ্যায় ছিল মুসলমানদের প্রখর মেধা ও তাঁদের ইজতিহাদী শক্তি, তাঁদের সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতা প্রকাশের সর্ববৃহৎ ময়দান। তাঁরা যে শুধু ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের খেদমতে অংশগ্রহণ করেছেন, তা নয়; বরং তাঁরা তাঁকে সমৃদ্ধি করেছেন। তাঁরা ইসলামী কুতুবখানাতে এমন কিছু গ্রন্থ সংযোজন করে তাকে সমৃদ্ধি করেন যার নজির ইসলামের সুবিশাল ইতিহাসে পাওয়া দূরুহ ব্যাপার। তাই এত সহজেই কী এ বিশাল দেশকে পাশ্চাত্য সভ্যতার গ্রাসে পরিণত হতে দেওয়া এবং পাশ্চাত্যের পতাকাবাহীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে? আমরা কী স্বচক্ষে দেখব যে, মুসলমানদের নতুন প্রজন্ম, সিদ্দীকী, ফারুকী, উসমানী, আলাবী এবং সৈয়দ ও শেখ পরিবারের চোখের মণিরা, যাদের মহান পূর্বসূরীগণের আন্তরিক প্রচেষ্টায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং ইসলামী শিক্ষালাভে ধন্য হয়েছে, যারা ইসলামের নূরকে নিজেদের দিলের সাথে স্থাপন করেছেন এবং বড় বড় তুফান, টর্নেডোতেও তা নিষ্প্রভ হতে দেননি, তাঁরা ইসলামী সভ্যতা, সামাজিক রীতিনীতি এবং সুন্নত ও শরীআতের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে শুধুমাত্র বস্তুবাদী পাশ্চাত্যের হাতের মুঠোয় চলে যাবে এবং তাদেরকে নিজেদের নতুন সভ্যতা ও শিক্ষার আদলে গড়ে মুসলমানদের এক নতুন প্রজন্ম, বরং এক অর্থে দুনিয়াতে এমন একটি নতুন প্রজন্ম প্রস্তুত করা হবে; যারা নাম ও জাতীয়তা ছাড়া পূর্বের মুসলিম উম্মাহর সাথে আর কোন জিনিসে মিল ও সম্পর্ক করা যাবে না।
এ প্রশ্নটিই হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর সামনে একটি সমস্যা হিসেবে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। সমস্যা শুধু যে একটি মাদরাসা বা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ছিল না, বরং আমি মনে করি যে, দারুল উলূম দেওবন্দের মর্যাদাকে খাটো করে দেখার অপরাধ হবে যদি বলা হয় যে, দারুল উলূম মাত্র গুটি কয়েক বিশেষ কিতাব পাঠদানের জন্য এবং দারস ও তাদরীসের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এ থেকে বড় জুলুম তার প্রতিষ্ঠাতাদের ক্ষেত্রে আর হতে পারে না। যারা এরূপ মনে করে, তাদেরকে অবশ্যই ঐ আলেমদের রূহের সামনে লজ্জিত হতে হবে। যদি কখনো বলা হতো যে, দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু একটি মাদরাসা, তাহলে হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.) আঁতকে উঠতেন। কারণ তাঁর কাছে এটি ইসলামের একটি দূর্গ ছিল, ইসলামী সৈন্য দলের ও ধর্ম প্রচারকদের জন্য একটি ট্রেনিং ক্যাম্প এবং মোঘল শাসনামলের নিষ্প্রভ বাতির পরিপূরক; বরং উত্তম পরিপূরক ছিল।
তাই, মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর সামনে এটিই ছিল আসল সমস্যা। তাহলে কী ভারতকে ইংরেজ ডাকাতদের হাতে তুলে দেয়া হবে? আমরা
কী আমাদের চিন্তাশীল যুবসমাজ, যাদেরকে আমরা আমাদের কলিজার রক্ত দ্বারা লালন পালন করেছি, যাদের ধমনীতে উলামা ও নেককারদের রক্ত প্রবাহিত ও সঞ্চালিত, তারা কী আমাদের চোখের সামনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার ছত্রছায়ায় বড় হবে ও আমাদের থেকে পরিপূর্ণভাবে ভিন্ন ও অপরিচিত হয়ে বের হয়ে আসবে? তিনি ইংরেজ সরকারের এ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতামহ হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.)-এর ভাষায় বলেন যে-
أَيَنْقُصُ الدِّينُ وَأَنَا حَيٌّ
“আল্লাহর দ্বীন ধ্বংস হয়ে যাবে আর আমি বেঁচে থাকব?”
আজ থেকে সাড়ে তের শ’ বছর পূর্বে হযরত আবূ বকর (রা.)-এর মুখ হতে যে বাক্য নির্গত হয়েছিল, তা হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর অবস্থার বাস্তব চিত্র ছিল। এ ঐতিহাসিক বাক্যটি ইতিহাসের ধারাকে পাল্টে দেয় এবং যুগের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। এটি একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য নয়; বরং এটি একটি যুগের শিরোনাম এবং একটি ইতিহাসের সারসংক্ষেপ। যদি হযরত আবু বকর (রা.)-এর কোন জীবনী গ্রন্থ রচিত নাও হত, তবু তাঁর এ বাক্যটি তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ হবার জন্য যথেষ্ট ছিল। এটি আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি ইলহামী বাক্য ছিল, যা তাঁর মুখ হতে নির্গত হয়েছিল। একটি সিংহ যদি প্রকম্পিত হয়ে, লম্প ঝাম্প দিয়ে এসে গর্জন করে এবং তার গর্জনে যদি পুরা জঙ্গল প্রকম্পিত হয়ে উঠে, তা থেকেও অধিক দুঃসাহসিকতা ও আক্রমণাত্মক এবং তা থেকেও অধিক বীরত্বপূর্ণ ও আত্মমর্যাদাপূর্ণ ভাব এ বাক্যের মাঝে রয়েছে। আমি মনে করি যে, দারুল উলূম দেওবন্দ ও দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা-এর প্রতিষ্ঠাতাগণকে যে বস্তু রাহনুমায়ী করেছিল, তা ছিল এ অনুভূতি। তাঁদের কখনোই এ উদ্দেশ্য ছিল না যে, তাঁরা শুধুমাত্র নাহু ও সরফের শিক্ষা প্রদান এবং উলুমে শরীআহ ও উলুমে ফালসাফা শিক্ষা দানের জন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করবেন। এ জন্য তো মিসরের আল- আযহার, তিউনিসের জামেয়া যাইতুনিয়া, মরক্কোর জামেয়া কুরুনিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েকটি বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান যথেষ্ট ছিল। ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে টক্কর দিয়ে কোন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা এবং এ সহায়- সম্বলহীন অবস্থায় শুধুমাত্র তালিম ও তায়াল্লুমের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান করা বুদ্ধিমত্তা ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতো না।
অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক ও চিরন্তন প্রতিশ্রুতিঃ
মূলত এ দ্বীনি আত্মমর্যাদাবোধ মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবী (রহ.)-. কে অস্থির করে রেখেছিল। ফলে, তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদরাসাটি অতি ক্ষুদ্র পরিসরে এবং অনুপলব্ধ পদ্ধতিতে কাজ শুরু করে। এ বিষয়টি হয়ত সে সময়ের অনেক ভালো ভালো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিও উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। কিন্তু তাঁর মাকসাদ বা উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহান ও মহৎ ছিল। আর সে মাকসাদ হলো, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতা, ইসলামী সমাজ, ইসলামী জ্ঞান ও ইসলামী শরী’আতের জন্য নতুন সভ্যতা বিনির্মাণ করা এবং এ দাওয়াতকে কর্মতৎপর করে তোলা:
لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ، وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِه.
“এবং এ বিষয়টিকে নিজের ভবিষ্যত প্রজন্মের চিরন্তন বাণী রেখে গেছে যাতে তারা আল্লাহ্র দিকে ফিরে আসে।” [সূরা যুখরফ: ২৮]
তাঁর সকল প্রচেষ্টার সারসংক্ষেপ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যতদিন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান জীবিত থাকবে, তাদের সম্পর্ক যেন মিল্লাতে ইব্রাহিমী ও শরীআতে মুহাম্মদীর সাথে চির অটুট থাকে এবং তারা যেন এ দ্বীন ও শরীআতকে মেনে চলে, যা তাদের কাছে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুল (সা.)- এর মাধ্যমে এসে পৌঁছেছিল। আবার, যখন তার মৃত্যু হয় তখনো যেন সে এ ধর্মের অনুগত ও তার জন্য আত্মোৎসর্গকারী হিসেবে যেতে সক্ষম হয়। এ যেন ঐ অসীয়ত ও চুক্তিপত্রের বাস্তব নমুনা, যার কথা পবিত্র কুরআন মাজীদে উল্লেখ করা হয়েছে:
وَ وَى بِهَا ابْرُهِمُ بَنِيْهِ وَ يَعْقُوبُ يُبَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُّسْلِمُونَ.
“আর ইব্রাহীম স্বীয় পুত্রকে এবং ইয়াকূবও এ কথার অসীয়ত করেন যে, বৎস! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে নির্বাচন করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করবে না।” [সূরা বাকারা: ১৩২]
নতুন যুগ, নতুন ফিতনাঃ
প্রিয় চিন্তাশীল ছাত্রসমাজ! আপনাদের এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দ্বীনি আত্মমর্যাদাবোধের ভিত্তিতে এবং আপনাদের এ প্রতিষ্ঠানের মৌলিক উদ্দেশ্যই হলো যুগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। তাই বর্তমান যুগের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে আপনি থাকতে পারবেন না। বিশেষ করে, দারুল উলূম দেওবন্দ ও নদওয়ার পক্ষে এ চ্যালেঞ্জের প্রতি দৃষ্টিপাত না করার কোন বৈধতা নেই। কারণ যুগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্যই এর বুনিয়াদ রাখা হয়েছে। কেননা, পশ্চিমা সভ্যতা ও সমাজ ব্যবস্থা এবং ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থা, যার সাথে কোন প্রকার ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা এবং আখলাকী তালিম ও তরবীয়তের কোন প্রকার ব্যবস্থা ছিল না, তা সে যুগের ফিতনা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
কিন্তু ফিতনা কখনো যুগের গন্ডির সাথে আবদ্ধ থাকে না এবং এক ফিতনাই সব সময় আসে না; বরং নতুন নতুন ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে, ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নতুন নতুন বিপদ সামনে আসে। ফিরাউনিয়্যাত নবরূপে আবির্ভূত হয় এবং অত্যন্ত উদ্যমের সাথে ময়দানে নামে। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইকবাল মিথ্যা বলেননি।
তিনি বলেন:
اگرچہ پیر ہے مؤمن جواں ہیں لات و منات
“যদিও মুমিন বার্ধক্যে উপণীত হয়ে গেছে কিন্তু লাত ও মানাত তো এখনো ভরা যৌবনে রয়েছে।”
এটি অত্যন্ত ভয়ংকর কথা যে, এখনো লাত ও মানাত অর্থাৎ বাতিল শক্তি ও পুরাতন জাহিলিয়াত তো জীবন ও উদ্যমতায় পরিপূর্ণ। আর মুমিন, যে সাইয়্যিদিনা ইব্রাহীম (আ.) এর ওয়ারিস ও তার প্রতিনিধি, তার মাঝে অকর্মণ্যতা, অলসতা, হীনম্মন্যতা, অক্ষমতা, পিছুটান ও নির্লিপ্ততা থাকার মানসিকতা সৃষ্টি হচ্ছে। লাত ও মানাত নতুন উদ্যমের সাথে, নতুন স্বপ্ন ও গর্জনের সাথে, নতুন প্রস্তুতি ও নতুন কর্মপদ্ধতির সাথে, নতুন নতুন স্লোগান ও নতুন নতুন হুংকারের সাথে ময়দানে আবির্ভূত হচ্ছে আর মুমিন এখনো সুখ নিদ্রার মৃত্যুপুরীতে বিভোর হয়ে রয়েছে। তার শক্তিতে ভোঁতা-ভাব ও জরাজীর্ণতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। সে জীবনের কর্মক্ষেত্র হতে পালিয়ে অথবা নির্লিপ্ত হয়ে কোন নিরাপদ আশ্রয় তালাশ করছে এবং সে জীবনের বাকি দিন নিরাপদে কাটিয়ে দিচ্ছে। আর লাত ও মানাত বুক ফুলিয়ে ময়দানে এসে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতার আহবান জানাচ্ছে।
আধুনিক যুগের ভয়ংকর ফিতনাঃ
প্রিয় ছাত্রসমাজ! এ যুগের ফিতনা ও চ্যালেঞ্জ কী? এ যুগের ফিতনা ও চ্যালেঞ্জ হলো ইসলামকে তার নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি, তার নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা, তার নিজস্ব পারিবারিক আইন, তার নিজস্ব শিক্ষানীতি, তার নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও লিপি হতে এবং তাকে তার পূর্ণ ঐতিহ্য হতে পৃথক করে গুটি কয়েক ইবাদত ও রীতিনীতি এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাঝে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা। যা অন্যান্য ধর্মের সর্বসাকুল্যে সম্পদ এবং কোন কোন ধর্মের একটি নিদর্শন মাত্র। যেমন, বিয়ে-শাদি ও দুঃখ-বেদনার সময় কি করা উচিত, মৃত ব্যক্তিকে তার জীবনের শেষ স্তর কিভাবে অতিক্রম করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন ইসলামও তদ্রূপ একটি ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতির সমষ্টিতে পরিণত হয়ে থাকবে।
আমি জানি না যে, আগামী কাল কি ঘটবে? কিন্তু তারপরেও বলতে চাই যে, সম্ভবত এ অবস্থা এখনো অনেক দূরে রয়েছে যে, হয়ত একদিন উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে বলা হবে যে, এ দেশে তোমাদের নামায পড়ার অনুমতি নেই। তোমাদের কোন বিশেষ আক্বীদা-বিশ্বাস রাখার অধিকার নেই, তুমি রোযা রাখতে পারবে না, তুমি যাকাত দিতে পারবে না। কিন্তু এ অবস্থা অবশ্যই এসে গেছে যে, এ দেশে ইশারা ও ইঙ্গিতে, আবার কখনো সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হচ্ছে যে, মুসলমান যেন স্বেচ্ছায় ও সানন্দে নিজেদের স্বতন্ত্র সভ্যতা ও রীতিনীতি এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হতে সম্পর্ক ছিন্ন করে নেয়। কারণ, ঐ সকল বস্তু তাদেরকে একটি ভিন্ন মিল্লাত এবং একটি স্বতন্ত্র সভ্যতার দাবিদার হবার অনুভূতি সৃষ্টি করে। তারা যেন নিজ থেকে ঘোষণা করে যে, তারা কোন পৃথক সভ্যতার ধারক ও বাহক নয়।
তারা নিজেরাই মুসলিম পারিবারিক আইনের পরিবর্তন ও সংস্কারের দাবি করে এবং নিজেদের জন্য ঐ একই ধরনের আইনের দাবি করে, যা সারা দেশের জনগণের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। তারা যেন নিজেদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা তারা নিজেদের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠা করেছিল, স্বেচ্ছায় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তর করে এবং এর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা হতে নিজেরা যেন অবসর গ্রহণ করে। যাতে ঐ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতেও একই ধরনের মানুষ তৈরি হয়, যারা এ সেক্যুলার ও সমাজতান্ত্রিক দেশে বসবাসের উপযুক্ত হয়। সরকার ইসলামের বিরোধিতা করে না এবং তাদের ইসলাম ধ্বংসের কর্মতৎপরতার প্রতি কোন আগ্রহও নেই। কারণ তারা তো ফখর করে যে, এ দেশে বিশ্বের অধিক সংখ্যক মুসলমান বসবাস করে।
তাই, তাদের বসবাস করা ও তাদের ফলপ্রসু হয়ে অবস্থান করা উচিত। কারণ তাদের দ্বারা মহৎ ও মহান কাজ করা সম্ভব এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ও রাজনৈতিক বিষয়ে তাকে দলীল হিসেবে পেশ করা যেতে পারে। তথাপি, আজকে এ দেশে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হচ্ছে যে, মুসলমান যদি এ দেশে বসবাস করতে চায়, তাহলে তাদেরকে জাতীয় ধারাতে বিলীন হয়ে যাওয়া উচিত। আর জাতীয় ধারার অর্থ হলো এই যে, মুসলমানগণ নিজেদের যাবতীয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হতে মুক্ত হয়ে যাবে। তাই আজকের দাবি হলো মুসলমানকে মুসলমান হয়ে বসবাস করতে হবে। কেউ তাকে নিষেধ করবে না। এ সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা একটি রোগীর পাগলামী ভাব যা সবসময় থাকে না।
আপনারা লক্ষ্য করছেন যে, তা কমে আসছে এবং আমি আরো ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, তা আরো কমে যাবে। আমার নিকট এটি আসল সমস্যা নয়। আসল সমস্যা জন্ম নিয়ন্ত্রণও নয়; বরং আসল সমস্যা হলো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যা, ও সাংস্কৃতিকভাবে অন্যের দাসে পরিণত হওয়া। এ সমস্যাকে দেখা ও উপলব্ধি করার জন্য চিন্তাশীল এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। এ তো দেয়ালে খোদাই করে লিখিত বস্তুর মত সকলেই তা পড়তে সক্ষম। আল্লাহ্ তা’আলা যাদেরকে চক্ষু প্রদান করেছেন, তারা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে যে, আজকে আলীগড়ের সমস্যা তো আগামীকাল দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামার সমস্যায় পরিণত হবে। সময় ও অবস্থার মাসয়ালা। এ সকল সমস্যার সমাধান নির্ভর করছে এ বিষয়ের উপর যে, আমরা আলীগড়ের সমস্যাতে কতটুকু প্রাণের স্পন্দন ও উদ্যমতা এবং কতটুকু গায়রত ও আত্মমর্যাদাবোধের প্রমাণ পেশ করতে পেরেছি।
বিদ’আত মুকাবিলাকারীদের উত্তরসূরী ও তাদের যিম্মাদারীঃ
আমার প্রিয় তালেবে ইলম! আপনাদের মহান পূর্বসূরীগণ তো এমন ছিলেন যে, তাঁরা কখনো বিদ’আতের সাথে সামান্যতম আপোস করেননি। সংস্কৃতি এবং ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলেননি। কত অসংখ্য রসম ও রেওয়াজ মুসলমানদের জীবনে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তা ধর্মীয় আমল ও রীতিনীতির মর্যাদা লাভ করেছে। কিন্তু আপনি যে, চিন্তাধারা ও মাসলাকের সাথে সম্পৃক্ত, তার আলেমগণ সবসময় এগুলোর বিরোধিতা করেছেন এবং এগুলোকে বিদ’আত ও ভিত্তিহীন ঘোষণা করেছেন। আর এ কারণে তাঁদেরকে সামাজিকভাবে ও সংগ্রামমুখর জীবনে অনেক কুরবানী দিতে হয়েছে। তাঁদেরকে বয়কট করা হয়েছে, তাঁদেরকে মসজিদ হতে বের করে দেয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কাফির ও গোমরাহ্ ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে এবং তাঁদেরকে অসংখ্য দুনিয়াবী স্বার্থ ও আরাম-আয়েশ থেকে মাহরূম হতে হয়েছে।
তারপরেও তাঁরা ঐ সকল কার্যকলাপের ব্যাপারে সামান্যতম শিথিলতা প্রদর্শন করেনেনি এবং কোন প্রকার আপোসের দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেননি।
আমার রূহানী, খান্দানী ও মানসিক সম্পর্ক হযরত সাইয়িদ আহমদ শহীদ (রহ.) ও মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর সাথে, যাঁরা এ দেশে তাওহীদ ও সুন্নাতের পুনঃজীবন প্রদানের আহবান জানিয়েছিলেন ও তার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন এবং এ জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন। যদি আমার এ দুঃসাহসিকতাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে আমি বলব যে, আপনাদের এ প্রতিষ্ঠানে এ চিন্তাধারা ও এ দাওয়াত এবং এ হামিয়ত ঐ চিন্তা থেকেই এসেছে। এ কারণে আমার নিকট ইতিহাসের এ পূর্ণাঙ্গ ধারা অতি প্রিয়। আমি গোটা ঐতিহ্যকে সীনার সাথে; বরং চোখের মণিতে লাগিয়ে রাখি। আমি তা নিয়ে লজ্জাবোধ করি না এবং তা থেকে পিছু হটতেও রাজি নই। আমার সকল রচনা, আমার নগণ্য প্রয়াস ও প্রচেষ্টার সবকিছুই ঐ ঐতিহ্যের হিফাযত, তার তাবলীগ ও ইশাআত এবং তার দাওয়াতে ব্যয় হয়েছে।
مین کہ میری نوا میں ہے آتش رفتہ کا سراغ
میری تمام سرگذشت کھوئے ہوؤں کی جستجو
“আমি ও আমার অস্থি-মজ্জায় রয়েছে দূর্বার আগুনের ঠিকানা আমার সকল প্রয়াস তো স্বজনহারাদেরই প্রচেষ্টা।”
আপনারা ঐ সকল ব্যক্তির উত্তরসূরী যাঁরা দ্বীনের সামান্য বিকৃতি এবং মুসলমানদের সামান্য বিচ্যুতি বরদাশত করেননি। কিন্তু আজকের সমস্যা বিদ’আতের নয়, আজকের সমস্যা ইংরেজী শিক্ষার নয়, আজকের সমস্যা হলো একদিকে প্রকাশ্য শির্ক ও মূর্তি পূজার, প্রকাশ্য পৌত্তলিক আক্বীদা-বিশ্বাস গ্রহণ করার, আজকের সমস্যা হলো হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি গ্রহণের প্রবণতা। অন্যদিকে আজকের সমস্যা হলো কমিউনিজম ও পুরাপুরি ধর্মহীন-তাকে গ্রহণ করাকে প্রতিরোধ করার। আজকের সমস্যা হলো এমন এক জাতির মর্যাদা গ্রহণ করা যারা ধর্মকে নিজেদের সকল কুরবানী ও ভবিষ্যতকে এ দেশের সাথে জুড়ে দিয়েছে যা থেকে আমাদের দেহের বাহ্যিক কাঠামো গঠিত হয়েছে। এ দেশের জন্যই জীবন ও মরণ। আজকের চ্যালেঞ্জ ও আজকের সমস্যা বিগত দিনের চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাসমূহের তুলনায় অনেক অনেক গুণ বেশি ভয়ংকর। এ সব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য আরো বেশি সৎসাহস, আরো অধিক ঈমান ও আত্মবিশ্বাস এবং আরো অধিক ত্যাগ ও সংগ্রামের প্রয়োজন।
বর্তমান যুগের ইনকিলাব বিদ্যুৎ গতিসম্পন্ন ও বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতঃ
আগের দিনের সমস্যাসমূহ অত্যন্ত ধীর গতিসম্পন্ন হতো এবং তা ধীরে ধীরে আসত। যেমন যুগ ছিল, তেমনি পরিবর্তন ছিল। তখন গরুর গাড়ি ও হাতি বা উটের পিঠে চড়ে আসার যুগ ছিল; বরং বেশি থেকে বেশি দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে আসার যুগ ছিল। তাই, সময়ের ইনকিলাবসমূহ ঐ সকল সওয়ারীর গতিতে আসত। অতঃপর, ট্রেন যুগের সূচনা হয়। তখন ইনকিলাব ট্রেনে সফর করে আসত। আবার, যখন বিমানের যুগের সূচনা হলো, তখন ইনকিলাবের গতি ত্বরান্বিত হয়। এখন ইনকিলাব এটমিক এনার্জি প্রয়োগ করছে। ফলে, ফিতনা শব্দের গতিতে, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে।
গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রের ব্যাপক বিস্তৃত পরিধিঃ
বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যুগ। আমাদের উপর পার্লামেন্ট সরকারের ক্ষমতা চলছে। তাদের রয়েছে স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা। এখন রাষ্ট্রের কাজ শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও ট্যাক্স আদায় করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা এখন জীবনের সকল শাখা-প্রশাখা এবং শিক্ষা-দীক্ষার সকল উপকরণ নিয়ন্ত্রণ করছে। ঘরের ভিতর ও বাইরের কোনকিছুই তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। রাতে যদি পার্লামেন্টে কোন আইন পাশ হয় তো দিনে তা সারা দেশে বাস্তবায়িত হয়। এখন আমরা এখানে বসা রয়েছি কিন্তু এখন হয়ত পার্লামেন্টে কোন অধিবেশন হচ্ছে এবং সেখানে কোন আইন পাশ হচ্ছে এবং তা আমাদের জীবনে কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করছে। আপনারা অবগত আছেন যে, পূর্বের সরকার প্রাইভেট বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ করত না। ব্যক্তিগত বিষয়াদী নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা ছিল না। স্বাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের কোন পেরেশানী ছিল না। আপনি যাকে পারিবারিক আইন বলেন, যেমন বিয়ে-শাদি, দাফন-কাফন ও মীরাসের বন্টন ইত্যাদি বিষয়ে তাদের কোন হস্তক্ষেপ ছিল না।
শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ কোন আক্বীদা- বিশ্বাস ও বিশেষ কোন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর পীড়াপীড়ি ছিল না। কিন্তু আজকে দুনিয়া বদলে গেছে। আপনার চিন্তা করা উচিত যে, আপনি যে স্থানে এখন বসা আছেন, সেখানে কি যুগের পরিবর্তন হঠাৎ এনে বসিয়েছে? আজ আপনারা একটি সীমাবদ্ধ স্থানে বসে অত্যন্ত আনন্দিত। আজ এখানে চারপাশে নূরানী চেহারা নজরে আসছে, আপনার কানে ‘কুলাল্লাহ’ ও ‘কুলার রসূল’ ছাড়া অন্য কোন আওয়াজ গুঞ্জরিত হচ্ছে না। এটি আপনাদের দারুল হাদীস, ঐটি আপনাদের দারুত-তাফসীর, এইতো মসজিদের রূহানী মহল এবং মাদরাসার ইলমী পরিবেশ। কিন্তু, কাল যখন আপনি এখান থেকে চলে যাবেন, আর কাল বলতে আমার উদ্দেশ্য এই নয় যে, যখন আপনি এখান থেকে পাশ করে চলে যাবেন, বরং আমার উদ্দেশ্য হলো, যখন আপনি ছুটিতে বাড়ি যাবেন, তখন আপনি সেখানে দুনিয়াকে অনেক পরিবর্তিত দেখতে পাবেন। আমি বলতে পারবো না যে, আপনাদের ছুটি পর্যন্ত এ দেশে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটবে। আপনি যদি আপনার আশেপাশের দুনিয়া পর্যবেক্ষণ না করেন তাহলে আপনি নিজেই এ জগতে অপরিচিত হয়ে যাবেন।
অভ্যন্তরীন বিপদঃ
বর্তমান মুসলমানদের জন্য বড় ভয়ের কারণ এই যে, স্বয়ং মুসলমানদের ভিতরে এমন একটি দল সৃষ্টি হয়েছে যারা অমুসলিমদের তুলনায় দাবিদার ধীর গতির আর সাক্ষী সরব প্রকৃতির এ প্রবাদ বাক্যের বাস্তব নমুনাতে পরিণত হয়েছে। তারা যদি কোন কথা একটু আধটু ও অস্পষ্ট ভাষায় বলে, তো এরা ডংকা বাজিয়ে বলতে প্রস্তুত। এরা সুস্পষ্ট ভাষায় আহবান জানায় যে, মুসলমানদের এখানে সাধারণ সভ্যতার মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়া উচিত এবং সকল ইসলামী বৈশিষ্ট্য, এমন কি চীনা মুসলমানদের মত আরবী ও ইসলামী নাম না রাখা উচিত। তাদের দাবি হলো, যদি আমাদেরকে ভারতে থাকতে হয়, তাহলে সবকিছু হতে মুক্ত হতে হবে যাতে ‘আমি ও তুমি’-এর পার্থক্য শেষ হয়ে যায় এবং যা মসজিদ ও গীর্জার মাঝে পার্থক্য করে, তা হতেও মুক্ত হয়ে যায়। বর্তমানে যে ধরনের মানসিকতার লোকেরা ভারতের নেতৃত্ব প্রদান করছে, তারা এমন কোন বস্তু দেখলেই, যাতে ন্যূনতম স্বাতন্ত্র্যবোধ থাকে, তাদের গাত্র দাহ হয়।
স্বকীয়তা ও স্বচ্ছতা ইসলামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যঃ
কিন্তু আমাদের ধর্মের সীমারেখা নির্ধারিত, বহু ধর্মের এ দেশে আমাদের ধর্মের নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও আকৃতির সাথে বিদ্যমান থাকার পিছনে রহস্যই হলো এই যে, তাতে আর্যধর্মের মত মুক্তমনা ও স্বাতন্ত্র্য বিমুখিতা নেই, নেই তার মাঝে কোমলতা ও নমনীয় মনোভাব; বরং আমাদের এখানে ঈমান ও কুফর, শিরক ও তাওহীদ, ভ্রষ্টতা ও হিদায়াত এবং হালাল ও হারামের মাঝে সুস্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنُ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ
“আর যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করল, সে তো এমন এক মজবুত রশিকে শক্ত করে ধরল যা কখনো ছিন্ন হবার নয়।” [সূরা বাকারা: ২৫৬]
সকল ধর্মই এক নয়, বরং হক একটিঃ
ইসলাম সকল ধর্মই এক হবার পক্ষে কথা বলে না, বরং তার আহবান হলো হক্ব একটি। অর্থাৎ সকল ধর্মই এক নয় বরং সত্য ধর্ম হলো একটি। তাই ইসলামের সুস্পষ্ট ঘোষণা হলো:
فَمَا ذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَلُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ.
“আর হক কথা সুস্পষ্ট প্রকাশিত হবার পরে গোমরাহী ছাড়া আর কী থাকে? সুতরাং তোমরা কোথায় চালিত হচ্ছো?” [সূরা ইউনুস: ৩২]
ইসলামের কাছে আক্বীদার সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত মুলনীতি রয়েছে। তার রয়েছে একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা, পরিপূর্ণ জীবন বিধান ও পূর্ণাঙ্গ সমাজ ব্যবস্থা। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে:
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম ও ধর্ম হিসেবে ইসলামকে তোমাদের জন্য পছন্দ করলাম।” [সূরা মায়িদা: ৩]
এখানে কেউ নিজকে যেমন ধোঁকা দিতে সক্ষম নয়, তেমনি অন্যকেও ধোঁকা দিতে পারে না। এখানে রয়েছে দিবালোকের আলোক রশ্নি। তাতে সাদা ও কালো সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।
অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন দু’জন মহাপুরুষঃ
প্রিয় তালেবে ইলম! দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবী (রহ.) ও নদওয়াতুল উলামার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুঙ্গিরী (রা)-কে কোন জিনিস অস্থির করে তুলেছিল? একজনকে এখানে এবং আরেকজনকে ওখানে। আমি তাঁদের দু’জনের মাঝে কোন পার্থক্য আছে বলে মনে করি না। আমি তাঁদের দু’জনকে একটি সুন্দর চেহারার দু’টি চোখের মত মনে করি। তাঁরা উভয়েই রৌশন ও পাক-পবিত্র। বরং উভয়ের মাঝে একই নূরে বাতেন ও একই ফেরাসতে ঈমানী কাজ করেছে। তারা উভয়েই-
يَنْظُرُ بِنُورِ اللَّهِ اتَّقُوا فِرَاسَةَ الْمُؤْمِنُ فَإِنَّه
“তোমরা মুমিনের ফেরাসতকে ভয় কর। কারণ, মুমিন আল্লাহর নূর দ্বারা অবলকন করে।”
এ হাদীস শরীফের বাস্তব নমুনা ছিলেন। উভয় শিক্ষা কেন্দ্রের পাঠ্যসূচি একটি উপকরণ ছিল মাত্র, মাকসাদ ছিল না। তাঁদের মাঝে সৃষ্ট মতবিরোধ মৌলিক কোন মতবিরোধ ছিলনা। মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুঙ্গিরী (রহ.) ও তাঁর সহকর্মীদের লেখা পাঠ করুন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এ ধরনের ছোটখাট বিষয়ের অনেক ঊর্ধ্বে ছিল। কেউ যদি মনে করে যে, তিনি আরবী সাহিত্যকে প্রাধান্য দেবার জন্য বা ইসলামের ইতিহাস ও আধুনিক জ্ঞান- বিজ্ঞানকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নদওয়াতুল উলামার আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তাহলে এ থেকে বড় জুলুমের কথা তাঁর শানে আর কিছু হবে না। বরং সত্য কথা হলো এই যে, তাঁরা উভয়ে নিজের নিজের যুগের ফিতনার মুকাবিলা করেন এবং একজন এখানে দূর্গ নির্মাণ করেন, আর অপরজন ওখানে। উভয়ে নিজ নিজ যুগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং পরিবর্তনশীল যুগের চাহিদা অনুযায়ী দ্বীনের রক্ষক ও হকের দাঈ এবং শরীআতের মূখপাত্র প্রস্তুত করার প্রচেষ্টা করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদের উভয়কে সুউচ্চ মর্যাদা দান করুন এবং তাঁদের সহকর্মী ও বিরোধিতাকারীদেরকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন এবং আমাদেরকে তাদের সহীহ মাকাসিদ বুঝার ও তাঁদের নকশে কদমে চলার তৌফিক দান করুন।
ইসলাহ ও তাজদীদের ইতিহাসে ব্যক্তির মর্যাদা ও কাজঃ
প্রিয় তালেবে ইলম! ইসলামী তাজদীদ ও ইসলাহের পূর্ণ ইতিহাসই হলো ব্যক্তির পাহাড়সম দৃঢ়তার ইতিহাস। বলার জন্য তো বলা হয় যে, তা জাতি ও মিল্লাতী ইতিহাস এবং নিঃসন্দেহে তা এরূপ। কিন্তু বাস্তবে তা শুরু হতে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির যোগ্যতা, তাদের দৃঢ় সংকল্প ও হিম্মতের বহিঃপ্রকাশ। কারণ যখনই ইসলাম হায়াত ও মওতের সন্ধিক্ষণে এসে পতিত হয়, যখন কোন এক দিক থেকে ইসলামকে আক্রমণ করা হয় তখনই কোন একজন মরদে কামিল পাহাড়সম সংকল্পের অধিকারী ব্যক্তি সামনে অগ্রসর হন। এমন নাজুক মুহূর্তে কোন কাউন্সিল বা পরামর্শ অনুষ্ঠিত হয় না। কোন একজন সাহেবে ইকীন সামনে আসেন এবং হালতের ধারাকে পালটে দেন। হযরত উমর ইবন আব্দুল আযীয (রহ.) ও হযরত হাসানুল বসরী (রহ.) থেকে শুরু করে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রহ.)-এর খান্দান এবং এ সকল দ্বীনী মারকাযের প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমান দ্বীনী দাওয়াত ও প্রচেষ্টার পতাকাবাহীগণ সকলে একই সুতায় গাঁথা।
کار زلف تست مشک افشانی اما عاشقان
مصلحت را تمتے برآ ہوے چیں بسته اند
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রহ.)-এর অবদান
আল্লামা ইকবাল (রহ.) হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সম্পর্কে বলেন:
وہ ہند مین سرمائے ملت کا نگہباں
اللہ نے بروقت کیا جس کو خبردار
“তিনি ছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের নেগাহবান আল্লাহ তাকে সময় মত করেন হুঁশিয়ার।”
তাঁর প্রচেষ্টার কারণে ভারতীয় মুসলমানদের সম্পর্ক দ্বীনে হিজাযী ও মুহাম্মদে আরবী (সা.) থেকে বিছিন্ন হতে পারেনি এবং হিন্দু সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ব্রাহ্মণ্য আক্বীদা-বিশ্বাসের ছত্রছায়ায় চলে যাবার পরিবর্তে ইসলামী ও শরীআতে মুহাম্মদীর সুশীতল ছায়াতলে এবং তার আমানতে থাকা পছন্দ করেছে। সম্রাট আকবরের রাজ-সিংহাসনে মহিউদ্দীন আলমগীরের মত একজন ইসলামী চেতনার অধিকারী ও ফকীহ বাদশাহ উপবিষ্ট হবার ক্ষেত্রে তাঁর গোপন হাত ছিল। এর পরে এ দেশে তাজদীদ ও দ্বীনী জাগরণের যে সকল কাজ হয়েছে, তা শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রহ.) ও তাঁর খান্দানের অবদান। দারুল উলূম দেওবন্দের কথা বলুন আর সাহারানপুরের কথা বলুন, অথবা লাক্ষ্ণৌর কথা বলুন, আমরা সকলেই তাঁদের দস্তরখান হতে নিয়ামত গ্রহণ করছি। দারুল উলুম দেওবন্দ, মাজাহির উলুম সাহারানপুর ও দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা এবং কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দানের সকল মারকায ঐ এক চেরাগ হতেই আলোকিত হয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের সনদের সিলসিলা হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রহ.) ও তাঁর সম্মানিত পরিবার এবং বিজ্ঞ ছাত্রদের পর্যন্ত গিয়ে পৌছে।
یک چراغیست دریں خانه که از پر تو آن
هر کجا می نگری انجمنی ساخته اند
“একটিমাত্র প্রদীপ ছিল এ ঘরে, তার স্নিগ্ধ আলো যেখানে গিয়েছে,
সেখানেই গড়ে উঠেছে নূরের মাহফিল।”
দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্রদের যিম্মাদারীঃ
আপনি যে মাদরাসায় তালিম গ্রহণ করছেন আপনার উপর এ মাদরাসার দাবি রয়েছে। আর তা হলো এই যে, আপনি যুগের এ চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করুন। এখানে যদি কেউ আসে, তো এখানে কোন ধরনের উচ্ছ্বাস তার নজরে পড়বে না। কিন্তু এর গভীরে এক জলোচ্ছাস ঘূর্ণায়িত হচ্ছে। এখনো যদি কোন একটি ঊর্মিমালা জলোচ্ছাসের আকারে উঠে আসে এবং ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিকদের মসনদ প্রকম্পিত করতে পারে, তাহলে তা এ সুমদ্র থেকেই উঠবে।
اسی دریا سے اٹھتی ہے وہ موج تند جوالاں بھی
نہنگوں کے نشیمن جس سے ہوتے ہیں تہہ و بالا
“এ সুমদ্র হতেই উঠে জলোচ্ছ্বাসের ঊর্মিমালা যাতে তছনছ হয়ে যায় বাতিলের সিংহাসন।”
অত্যন্ত নাজুক মুহূর্তঃ
আমি ইতিহাসের একজন ছাত্র। ইতিহাস আমার অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। আমি ভারতের ইতিহাস যতটুকু অধ্যয়ন করেছি, তার আলোতে বলতে পারি যে, ভারতের হাজার বছরের ইতিহাসে এমন নাজুক সময় ইতিপূর্বে আর কখনো আসেনি। কারণ এ যুগে অবস্থার পরিবর্তন সাধনে, দিল ও দেমাগকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে, মানুষের সদিচ্ছাসমূহকে ধ্বংস করতে, জযবাসমূহ খতম করতে, ক্ষমতার পট পরিবর্তন করতে, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার পদ্ধতিতে বিপ্লব সাধন করার ক্ষেত্রে এত অসংখ্য উপকরণের আয়োজন হয়েছে, যা ইতিপূর্বে আর কখনো ছিল না। পূর্বে যে সকল যুগ অতিবাহিত হয়েছে, সে সময় কী এ ধরনের উপকরণ ছিল? তখন কী রাজনীতির এ মিষ্টি ও চটকদার কথা ছিল? গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের এ স্লোগান ছিল কী? পত্রিকা, মিডিয়া, প্রেস, রেডিও, টেলিভিশন ও অন্যান্য গণমাধ্যমের এরূপ শক্তি ছিল কী? এ ধরনের বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছিল কী? এ ধরনের মিটিং সিটিং, সমাবেশ ও প্রোপাগান্ডার দক্ষতা ছিল কী?
যুগের আবুল ফয়েজ ও ফয়জীঃ
বিগত যুগের সর্ববৃহৎ ফিতনা ছিল আকবরের দ্বীনে ইলাহীর ফিতনা। তার পরেও কী ঐ সময়ের সরকার প্রধানের নিকট এ ধরনের বৃহৎ শিক্ষা কেন্দ্র ছিল? এ ধরনের লক্ষ লক্ষ কপি পত্রিকা প্রকাশিত হত কী? এ ধরনের নিত্য নতুন আবিষ্কার ছিল কী? মুহূর্তের মধ্যে পশ্চিমের খবর পূর্বে পৌছে দিবার মত গণমাধ্যম ছিল কী? নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আকবরের নিকট আবুল ফয়েজ ও ফয়জীর মত দক্ষ ও বিজ্ঞ লোক ছিল। আমি আবুল ফজল ও ফয়জীর বিচক্ষণতা ও তীক্ষ্ণ মেধার কথা শুধু যে স্বীকার করি তা নয়; বরং তার কারণে আমি প্রভাবিত। কিন্তু আজকে তো অসংখ্য আবুল ফজল ও ফয়জী রয়েছে। তারা সে সময় মাত্র ছিল দু’জন। কিন্তু আজকে তাদের কার্য সম্পাদন করার জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। আবুল ফয়েজ ও ফয়জীর মাঝে কখনো কখনো দ্বীনী জযবা জাগ্রত হতো। আর এ কারণে ফয়জীর কলম থেকে ‘সাওয়াতুল ইলহাম’-এর মত বিস্ময়কর তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু আজকের আবুল ফজল ও ফয়জীর মাঝে এতটুকু আল্লাহভীতিও নেই যা তাদের যুগের লোকদের মাঝে ছিল। সে সময়ের আধুনিকতাপ্রিয় ও প্রগতিশীল লোকদের মাঝে ইসলামের ব্যাপরে যে জযবাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তা এ যুগের মানুষের মাঝে নেই।
ধর্মহীনতা ও সংশয়ের নতুন দরজাঃ
প্রিয় তালেবে ইলম! দর্শন ও ইলমে কালাম আজকে তার অনেক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সায়েন্সের বিষয়ে আজ লেখাপড়া করিয়ে ধর্মহীন করা, সন্দেহ সৃষ্টি করা ও নাস্তিক করার ঐ শক্তি নেই, যে শক্তি ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ছিল। বর্তমানে তার এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই, বরং তার কাছে এখন তার পতাকাবাহীদের অবস্থার পরিবর্তনের কারণে দ্বীনের অসংখ্য বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে এবং আল্লাহ্ ও আলিমুল গায়বের অস্তিত্ব সম্পর্কে অসংখ্য নতুন নতুন দলিল-প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। তাই বলা যায় যে, বর্তমান যুগের দর্শন ও সায়েন্সের মাধ্যমে ঐ ধরনের নাস্তিকতা, ধর্মহীনতা ও ধর্মের ক্ষেত্রে সংশয় সৃষ্টি করা সম্ভব নয় যা ঊনবিংশ শতাব্দীর উলামায়ে হককে অস্থির ও পেরেশান করে রেখেছিল। বর্তমানে তার স্থানে রাজনীতি ও অর্থনীতি এবং সাহিত্য ও ইতিহাসের মাধ্যমে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার কাজ নেয়া হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞান ও ইংরেজী সাহিত্যের মাধ্যমে ধর্ম বিদ্বেষী ও মানসিকভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। আপনার কাছে নিশ্চয়ই বিস্ময়কর ঘটনা মনে হবে যে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও উর্দু বিভাগ নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ দ্বীনী বিষয়ে সর্বাধিক দূর্বল।
বাস্তবসম্মত পর্যলোচনা ও ব্যাপক প্রস্তুতিঃ
আমাদেরকে এ সকল বিষয়ে গভীর দৃষ্টি, প্রশস্ত হৃদয় এবং বাস্তব-প্রিয়তার সাথে পর্যলোচনা করতে হবে এবং দেখতে হবে যে, আমাদের জীবনের কর্মক্ষেত্রে নামার পূর্বে এবং ইসলামী দাওয়াত ও ইসলামী শরীআতের হিফাযতের পবিত্র যিম্মাদারী নিজেদের স্কন্ধে নেবার পূর্বে কোন ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত এবং কোন ধরনের আধুনিক উপকরণ গ্রহণ করা ও আধুনিক রণকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা ও তাতে দক্ষতা অর্জন করা জরুরী।
আপনাদের জন্য তাকদীরে ইলাহী এ যুগকে নির্বাচন করেছে। তাই সর্ব প্রথম আপনাকে জানতে হবে যে, আপনাকে কোন যুগের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি চিন্তার যেমন বিষয়, তেমনি খুশিরও বিষয়। সহানুভুতি পাবারও বিষয় এবং মুবারকবাদী পাবারও বিষয়। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে এর যোগ্য মনে করেছেন এবং এক মহৎ খিদমত আপনার যিম্মায় প্রদান করেছেন। আপনি এ যিম্মাদারীকে কবুল করুন, সময়ের এ ফিতনা ও যামানার নিষ্ঠুরতাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন এবং আল্লাহ্র কাছে তাওফীক লাভের জন্য দু’আ করুন। কারণ, আপনার পূর্বপুরুষগণ স্বীয় যুগের বিদ’আত ও বিগাড় এবং যামানার ফিতনা ও গোমরাহীকে যেমন গ্রহণ করেননি, ঠিক তেমনি আপনি যেন এ যুগের বিদ’আত ও বিগাড় এ যামানার ফিতনা ও গোমরাহী এবং জাহিলিয়তকে গ্রহণ না করেন।
ধর্মের পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি ও তার ফিতনাঃ
আপনি ঐ চ্যালেঞ্জকে কবুল করুন যা ধর্মকে সব ধরনের প্রভাব ও রাহনুমায়ী করা হতে এবং জীবনে তার প্রভাব বিস্তার করা হতে বিরত রাখে। ধর্মবিমুখ ইউরোপ এ ধ্যান-ধারণা পোষণ করে যে, ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিষয় এবং তা সব ধরনের স্বাধীন শিক্ষানীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এবং পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী। যদি এ দৃষ্টিভঙ্গি এখানে বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে ভারতে ঐ অবস্থায় সৃষ্টি হবে যার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন পঞ্চাশ বছর পূর্বে আল্লামা ইকবাল :
ملا کو جو ہے ہند میں سجدہ کی اجازت
نادان سمجھتا ہے کہ اسلام ہے ازاد
“মোল্লাকে যতটুকু দেয়া হয়েছে ভারতে সিজদার অনুমতি
নাদান তাতেই মনে করে যে, ইসলাম এখানে স্বাধীন।”
দেওবন্দের আলিমগণ অত্যন্ত সফল ও প্রভাব সৃষ্টিকারী হতে পারেন, যদি শুধুমাত্র দারুল উলুম দেওবন্দের আলিমগণ দৃঢ় সংকল্প করেন এবং আল্লাহ্র তাওফীক তাদের সাথে থাকে, তাহলে এ অবস্থার পরিবর্তন সাধনে তাঁরা যথেষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ, সাধারণ জনগণের সাথে তাঁদের যে ধরনের সুসম্পর্ক রয়েছে তা অন্য কোন ধর্মীয় জামাতের সাথে নেই। তারা সারা ভারতে দ্বীনী মাদরাসা বা আরবী মাদরাসার জাল বিছিয়ে দিয়েছেন। ঐ সকল মাদরাসায় তাঁরা শিক্ষকতা করেন, সাধারণ মুসলমানদের কাছে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং মসজিদ ও মাহফিলে তাঁদের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু এর জন্য কালান্দরের মত ইশক ও ইয়াকীনের প্রয়োজন যা দেখে বাস্তবতা উপলব্ধিকারী কবি চিৎকার দিয়ে বলে উঠে:
ہوا ہے گوتند و تیز لیکن چراغ اپنا جلا رہا ہے
وہ مرد در پیش جس کو حق نی دئے ہیں انداز خسروانہ
” ক্ষণে ক্ষণে যদিও আসে ঝড়ের ঝাপটা, তবু মর্দে মুমিন জ্বালান দ্বীনের বাতি আল্লাহ যাকে দিয়েছেন হিম্মত বুলন্দ, ক্বলবে আছে যার ঈমানের দ্যুতি।”
মানসিক প্রস্তুতি ও ব্যক্তিত্ব গঠনঃ
এ সকল নিত্য নতুন ফিতনা মুকাবিলা করার জন্য আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং ইলমী, আখলাকী ও রূহানীভাবেও নিজকে গঠন করতে হবে। একদিকে আপনাকে আধুনিক ফিতনা, চিন্তা ও দর্শনের বাস্তবতা ও গভীরতা, তার প্রেক্ষাপট, কারণ ও উপকরণ এবং তার অগ্রগতির ইতিহাসকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে হবে। যাতে নিজের প্রতিপক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বি সম্পর্কে পুরাপুরি অবহিত হওয়া যায়, তার শক্তি ও কৌশল, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। কারণ, মুকাবিলার জন্য এ সকল বিষয় প্রথম শর্ত। অন্যদিকে যথেষ্ট পরিমাণ অভ্যন্তরীণ পরিপক্ততা ও অবিচলতা, প্রচুর পরিমাণে আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মপরিচয় ভাব সৃষ্টি করতে হবে। যাতে কেউ যেন আপনার বিবেককে, আপনার আক্বীদাকে, আপনার দ্বীনী চেতনাকে সওদা করার স্বপ্নও না দেখতে পারে। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি তার শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে এক মুঠো খাবারের বিনিময়ে বিক্রি হওয়া এবং নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞানকে নিলামে বিক্রি করা শেখায়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা নীতি এ কথায় বিশ্বাসী যে:
ہر دو عالم قیمت خود گفتنی
نرخ بلا کن که ارزانی ہنوز
“আমার মূল্য যদি মনে করো দু’জাহান
তাহলে তুমি আমাকে বড়ই সস্তা মনে করেছ।”
বিবেকের সওদাবাজীর যুগঃ
বর্তমান যুগ হলো বিবেক-বুদ্ধি, দ্বীন ও ঈমানের সওদাবাজীর যুগ। বর্তমানে এমন অসংখ্য পন্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি এবং বিজ্ঞ লেখক রয়েছেন যাদের মেধা ও জ্ঞান-গবেষণার সামনে আমাদের কোন তুলনা নেই। কিন্তু বিবেক নামের কোন বস্তুর ঠাঁই তাদের কাছে নেই। তাদের দেমাগের স্থানে দেমাগ রয়েছে এবং তাদের দিলের স্থানেও দেমাগ রয়েছে। বরং তাদের বুকের ভিতর স্পন্দনকারী হৃদয়ের পরিবর্তে একটি চলমান ও গতিশীল কলম রাখা হয়েছে। যা সকল বস্তু লিখতে সক্ষম। তাদের নিকট আখিরাতে জবাবদিহিতা, বিবেকের দংশন ও অনুশোচনা বলতে কোনোকিছু নেই। তাদের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ও তার দাবিসমুহের প্রচার প্রসার করার সীমাহীন যোগ্যতা রয়েছে।
নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজনঃ
আপনি এখান থেকে শিক্ষক হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করুন, তাতেও মুবারকবাদ, আপনি কোন পাঠ্য পুস্তকের শরাহ লেখেন, তাতেও মুবারকবাদ, আপনি যদি খতীব ও বক্তা হোন, তাতেও মুবারকবাদ, আপনি যদি লেখক হোন, তাতেও মুবারকবাদ, আমি নিজেও এ ধরনের কাজের অপরাধী। কিন্তু বর্তমান যুগে এ থেকেও অধিক অন্য কাজের জরুরত। বর্তমানে এমন মর্দে মুমিনের প্রয়োজন, যিনি এ আধুনিক যুগকে একটি নতুন চিন্তার নেতৃত্ব, একটি নতুন ধর্মীয় আত্মবিশ্বাস এবং নতুন রূহানী ও আখলাকী শক্তি উপহার দিতে সক্ষম। এমন যদি না হয়, তাহলে তা হবে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বিরাট বিপদের কথা এবং সেই সাথে তা হবে এ দেশের জন্য একটি ভয়াবহ ট্রাজেডী। বর্তমানে আমাদের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরতে শুরু হয়েছে এবং ঐ অবস্থা সৃষ্টি হতে চলেছে যা পবিত্র কুরআন
মুজেযাময় ভাষায় উল্লেখ করেছে:
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا نَأْتِي الْأَرْضَ نَنْقُصُهَا مِنْ أَطْرَافِهَا .
“তারা কী দেখছে না যে, আমি ওদের দেশকে তার আশপাশ হতে সংকুচিত করে চলেছি?”
[সূরা রাদ : ৪১]
এবং অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:
إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ
“যমীন তার প্রশস্ততা সত্ত্বেও তাদের উপর সংকীর্ণ হয়েছিল এবং তাদের জন্য তাদের প্রাণও সংকুচিত হয়ে ছিল।” [সূরা তাওবা : ১১৮]
আজকে আমরা যে দেশে বসবাস করছি এবং যে দেশে দ্বীন ও ইলমের দূর্গ নির্মাণ করছি তা পাথরের টিলা বা শক্ত ময়দান নয়, বরং তা বালুময় প্রান্তর, যার বালুকণাকে প্রতিটি মুহূর্ত ঘূর্ণিঝড় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং তা আমাদের নীচ থেকে সরে যাচ্ছে। এটি এমন এক যমীন যাকে পবিত্র কুরআন كثيبا مهیلا. “বহমান বালুকাস্তুপ” বলে আখ্যায়িত করেছে।
বাস্তবতাবোধ ও আত্ম পরিচয়ঃ
প্রিয় তালেবে ইলম! যামানা আপনাকে শিক্ষা দেবার পূর্বে, যামানার নিষ্ঠুরতা ও নির্মম বাস্তবতা আপনার চক্ষু খুলে দেবার পূর্বে আপনি নিজেই চক্ষু খোলার ও আলো হাসিল করার চেষ্টা করুন। আশপাশের জগতকে পর্যবেক্ষণ করুন এবং দেখুন যে, হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া ইনকিলাব আপনাকে কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। কোথায় মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবী (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুন্সিরী (রহ.) ও মাওলানা শিবলী নুমানী (রহ.)-এর যুগ আর কোথায় আজকের যুগ! সুতরাং আপনি দৃঢ়তার সাথে এ ধারণা নিয়ে নিজের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করুন এবং আসাতেযায়ে কিরাম আপনাকে রাহনুমায়ী করবেন, যাতে আপনি যখন এ ক্ষুদ্র পরিসর হতে বের হয়ে বিশাল বিস্তৃত জগতে বসবাসের জন্য অবস্থান করবেন, তখন যেন আপনি বাস্তবতার সাথে চোখ মিলাতে পারেন এবং প্রতিকূল পরিবেশের সাথে পাঞ্জা লড়তে সক্ষম হন।
আপনাদের এ জামাতের ভিতর এবং এ ধরনের ছিঁড়াফাটা কাপড় ও জীর্ণ- শীর্ণ শরীরের মাঝে একটি জীবন্ত সিংহ ঘুমিয়ে রয়েছে। আপনারই মাঝে একটি পবিত্র আত্মা দাঈ ও একজন মুখলিস নিবেদিত প্রাণ সমাজ সংস্কারক বিদ্যমান
রয়েছে, যার ব্যাপারে আপনি নিজেই বেখবর এবং আপনার সম্মানিত উস্তাদগণ ও আপনার বন্ধু-বান্ধবগণও বেখবর রয়েছেন। আমি আমার দূর্বল ও ক্ষীণ আওয়াজ দ্বারা ঐ সকল ঘুমন্ত যোগ্যতাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। হায়! যদি আমার এ আওয়াজ দরওয়াজার ভিতর প্রবেশ করত এবং ঘুমন্ত ব্যক্তিদের মাঝে চেতনা সৃষ্টি হতো! আর আপনিও আপনার ঘুমন্ত প্রতিভা সম্পর্কে অবহিত হতে পারতেন! আল্লামা ইকবাল নতুন চাঁদকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, আর আমি আপনাদেরকে সম্বোধন করে বলছি:
بر خود نظر کشاز تہی دامنی مرنج
در سینی تو ماه تمامی نهاده اند
“নিজের শূন্য আঁচলের দিকে তাকিয়ে তুমি ব্যথিত হয়ো না
তোমার সীনায় তো লুকিয়ে আছে- পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদ।”