গত কয়েক শতাব্দী যাবত মুসলমানরা যে দুঃখজনক বিপর্যয়ের সম্মুখীন এর বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ সম্পর্কিত এ পর্যন্ত অনেক কিছুই লেখা হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে শায়খুল হিন্দ হযরত মাহমুদুল হাসান (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত দুটি বাক্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বস্তুত তিনি ছিলেন খোদাপ্রেমে চির আত্মহারা সেসব মানুষের একজন, যারা শত শত বছর যাবত দারুল উলূম দেওবন্দে বসে কোরআন ও হাদীসের দরস দিয়েছেন। কিন্তু যখনই উপমহাদেশকে ইংরেজদের দাসত্ব থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করার মনোবাসনা তাদেরকে অস্থির করে তুলেছে, তখন তারা দারুল উলূমের সেই খেজুর পাতার মাদুরে বসেই ভারত স্বাধীনতার এমন মহাসংগ্রাম গড়ে তুললেন, যার একপ্রান্ত কাবুল এবং অন্যপ্রান্ত কনস্টান্টিনিপোল পর্যন্ত স্পর্শ করেছিল। যার দরুন মাল্টার বন্দীশালায় তাঁকে তিন বছর কারাভোগ করতে হয়।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধান মুফতি হযরত মুফতি শফী (রহ.) বলতেন, শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান (রহ.) মাল্টার কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একদিন দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের সামনে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন-
“আমি আমার সমস্ত জীবনে একটিমাত্র শিক্ষা পেয়েছি, আর তা হচ্ছে মুসলমানদের পতনের দু’টি কারণ।
এক. কোরআন ছেড়ে দেয়া,
দুই. নিজেদের মধ্যকার পারস্পরিক মতানৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা।
এখন আমার জীবনের মিশন হল, এই দুইটি কারণ অপসারণের চিন্তা। কোরআনের শিক্ষা ও প্রচার এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজের সামগ্রিক সামর্থ্য ব্যয় করা।”
বস্তুত মুসলমানদের ইতিহাস নিয়ে যতই গবেষণা করা হবে এতে তাদের পতনের মূল কারণের সারসংক্ষেপ এই দুটি বিষয়ই হবে। ফলে আজকের এই দিনেও মুসলমানদের সাফল্য ও উন্নতি এ দুইটি বিষয়ের উপরই নির্ভর করছে। যুগ যুগ ধরে ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের ধ্বংসের চেষ্টা করে আসছে। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা সম্ভাব্য সকল অস্ত্রই প্রয়োগ করেছে। প্রথমদিকে অস্ত্রের বলে তারা মুসলমানদের দমানোর চেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী দল ও শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু আল্লাহপাক মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে এমন অপরাজেয় করে দিয়েছিলেন যে, সমস্ত ইসলামবিরোধী শক্তি এক হয়েও তাদের সাথে লড়াই করে কেবল নিজেদেরই ধ্বংস ডেকে এনেছে। পরবর্তীতে ওরা তথ্য-উপাত্ত ও দর্শনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে পরাজিত করতে চেয়েছে। কিন্তু একথা সুস্পষ্ট যে, তথ্য-উপাত্ত, দলিল-প্রমাণ ও দর্শনের ক্ষেত্রেও ইসলামের সমকক্ষ কিছু নেই। এ ক্ষেত্রেও শত্রুরা মুসলমানদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
অতঃপর ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের ধ্বংসের জন্য এমন মারাত্মক ও বিষাক্ত কৌশল অবলম্বন করল, যার আক্রমণ থেকে আজ পর্যন্তও মুসলমানরা মুক্ত হতে পারছে না। আর তা হচ্ছে, মুসলমানদেরকে কোরআন ও হাদীসের শিক্ষা থেকে পশ্চাৎগামী করে, তাদের মধ্যে বংশ ও বর্ণবাদের শ্রেণী সমস্যা সৃষ্টি করা এবং ভাষা ও আঞ্চলিকতায় পারস্পরিক বিবাদে জড়িয়ে দেয়া। এভাবে মুসলিমবিশ্বকে আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে আটকে এক সাথে দু’টি উদ্দেশ্য হাসিল করে নিচ্ছে। একদিকে মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম ও খোদাদ্রোহী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করা, অন্যদিকে বংশ ও অঞ্চলপ্রীতিতে উদ্বুদ্ধ করে এক অঞ্চলের লোকজনকে অন্য অঞ্চলের লোকজনের বিরোধিতায় লিপ্ত করে রাখা। দুর্বলতা সত্ত্বেও ওসমানী খেলাফতের শেষদিন পর্যন্তও মুসলমানদের জন্য তা একটি শক্ত ঘাঁটি হিসেবেই ছিল, যার প্রতি চোখ উঠিয়ে তাকালেই শত্রুদের কাঁপন ধরে যেত। কিন্তু যখন আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে তাদের মধ্যে আরবী ও তুর্কি সমস্যা দেখা দিল, তখন সেই অপরাজেয় দুর্গটি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল। যেসব ছোট ছোট এলাকা খেলাফতের সময়ে সাধারণ জেলার পর্যায়ে ছিল, সে সর্ব আজ সহসাই স্বাধীন” রাষ্ট্রে পরিণত হল। ফলে যে মুসলিমবিশ্বের ভয়ে পৃথিবীর সব বৃহৎ শক্তি সর্বক্ষণ কম্পমান থাকত, তা আজ পাশ্চাত্যের এমন শিকারে পরিণত যে, সেখানে মুসলমানদের কোন অধিকারই নেই। নিকট অতীতের শেষ পর্যায়ে যখন সমগ্র পৃথিবীতে মুসলমানদের পতন ঘটতে ছিল ঠিক তখনই তারা অনায়াসে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ উপকরণের অধিকারী হল, সমগ্র ইসলামী ইতিহাসে যার কোন দৃষ্টান্ত নেই। পৃথিবীর মানচিত্রের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যাবে, প্রকৃতি মুসলিম দেশগুলোকে ভৌগোলিকভাবে এক শিকলে বেঁধে রেখেছে। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রায় সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্র সীমান্ত পরস্পরে মিলিত। গোলাকৃতির এ পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে মুসলিমবিশ্ব যে অংশের ভাগীদার হয়েছে, তা মূলত সমগ্র পৃথিবীর হৃদপিণ্ডের মত।
পৃথিবীর বড় বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরসমূহ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। খনিজ পদার্থে আল্লাহপাক তাদেরকে সমগ্র বিশ্ববাসীর থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। বিংশ শতাব্দী থেকে মূলত মানুষের জীবনধারা ‘তেলের’ উপর নির্ভর। এসব এলাকায় সেই তরল ঐশ্বর্যেরই মালিকানা তাদেরকে দেয়া হয়েছে। এমনকি একথা প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে,
“যেখানে মুসলমান সেখানে তেল”। বিশ্ববাসী অবলোকন করেছে যে, কিছু আরব দেশ কয়েক মাস তেল সরবরাহে সামান্য বিঘ্ন সৃষ্টি করে সমগ্র পশ্চিমাবিশ্বকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। মানব সম্পদের দিক দিয়েও মুসলিমবিশ্ব যথেষ্ট প্রাচুর্যপূর্ণ।
পৃথিবীর এক পঞ্চামাংশে আমাদের বসতি। এই মুহূর্তে বিশ্বে যতগুলি রাজনৈতিক ঐক্য আছে এর মধ্যে কোন একটাও সংখ্যার দিক থেকে মুসলমানদের সমকক্ষ নয়। আমেরিকান, রাশিয়ান, আফ্রিকান ঐক্যের সব অধিবাসী পৃথক পৃথকভাবে আমাদের থেকে কম। চীন কেবল জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলমানদের সমান। তারপরও স্থান বা ভৌগোলিক পরিধির ক্ষেত্রে চীনও অনেক পেছনে। এই বিরাট সংখ্যার জনগণ পৃথিবীর এমন অংশে বসবাসরত, যা ইতিহাসের সমস্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জীবন্ত সাক্ষী। অথচ প্রকৃতির অকৃত্রিম দান এই তরল ঐশ্বর্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে আমরা হচ্ছি পৃথিবীর সর্বাধিক বঞ্চিত, অসম্মানিত ও দুর্বল জাতি। যার মূল কারণ অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা। যেমন জাতিসংঘে মুসলিম সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা প্রায় চল্লিশের মত এবং আফ্রিকা মহাদেশীয় রাষ্ট্র সংখ্যাও প্রায় এমনই। অথচ আফ্রিকান ঐক্যের দৃঢ়তা বিশ্ববাসীকে অভিভূত করছে। সময়ে তারা জাতিসংঘকে তাদের দাবী ও প্রস্তাব মানতে বাধ্য করছে।
পক্ষান্তরে মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা বেশী হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের কোন সম্মানজনক স্থান নেই। তাদের কথার কোন গুরুত্ব নেই। যার একমাত্র কারণ হল, রাজনৈতিক ঐক্যের অনুপস্থিতি; বরং শত্রুরা তাদের ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে রেখেছে। বিষয়টি একেবারে সুস্পষ্ট, যার জন্য কোন নাতিদীর্ঘ দার্শনিক আলোচনার প্রয়োজন নেই। মুসলিমবিশ্বের নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব ছিল, ইসলামের শত্রুদের চালবাজি পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করে এর প্রতিরোধের চিন্তা-ভাবনা করা। আজ থেকে বিশ বছর পূর্বে যদি মুসলমানরা এই প্রয়োজনীয়তার যথার্থ অনুভব করে মুসলিমবিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করত তাহলে আজ বিশ্ব মানচিত্র অন্যরকম হয়ে যেত। মুসলিম বিশ্বকে আজ আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন হত না। সমগ্র পৃথিবীই অত্যাচারিতদের আশ্রয়স্থল হত এবং মুসলিমবিশ্বের বুক চিরে ইসরাইল ও ভারতের মত এমন রক্তাক্ত ক্ষত সৃষ্টি হত না।
দেরীতে হলেও বিশ্ব মুসলিম ঐক্যসংস্থা হিসাবে OIC বা ইসলামী সম্মেলন সংস্থা গঠিত হয়েছে [১]। যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি মুসলমান একান্তভাবে কামনা করে আসছিল এ ধরনের কোন সংস্থা প্রতিষ্ঠা, তা-ই বাস্তবায়িত হল। এখন কথা হচ্ছে, এই OIC র শীর্ষ সম্মেলন যেন শুধু আপ্যায়ন ও দেখা-সাক্ষাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং মুসলিমবিশ্বের ঐক্যের জন্য এমন এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যা মুসলমানদের মধ্যে নিজের শক্তি ও সামর্থের যথাযথ অনুভূতি জাগাবে এবং নবজীবনবোধ সঞ্চার করবে। পারস্পরিক বিবাদের ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা হবে। অধিকন্তু মুসলিমবিশ্ব তার প্রাপ্য হারানো সেই গৌরব ও স্থান পুনরুদ্ধার করবে। নচেৎ মজলুম মুসলমানদের আশা-আকাঙ্ক্ষাই কেবল মাঠে মারা যাবে না; বরং সমগ্র মুসলিমবিশ্ব হতাশার অন্ধকার তিমিরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।
টীকাঃ
১. দুঃখজনক হলেও সত্য, একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওআইসি তার লক্ষ্যের শতভাগের একভাগও পূরণ করতে সক্ষম হয়নি।


