বছরের বারোটি মাসের মাঝে গোটা একটি মাস রোজা পালন করা আল্লাহ তায়া’লা ফরজ করে দিয়েছেন তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়াবান হতে পারো”।
রোজা শুধুমাত্র পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই নয়, বরং মানব-শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়েই রোজা রাখতে হয়। হযরত পয়গম্বর (সা.) একটি হাদীসে বলেছেন, “তোমাদের খাওয়া বা পান কোনোটারই প্রয়োজন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নেই”। অর্থাৎ রোজা আল্লাহ তায়া’লা তাঁর কোনো প্রয়োজনে আমাদের উপর ফরজ করেননি, বরং আমারা যাতে আমাদের ইরাদা বা ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং শিক্ষা নিতে পারি, সেজন্যই এই বিধান দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ রোজার প্রয়োজন শুধু আমাদের নিজেদের।
এই রোজা তথা সাওমের একটি অর্থ হচ্ছে ইমসাক। ইমসাক বলতে কোনো কিছুকে ধরে রাখা বুঝা বুঝায়। এজন্য আমরা যদি শুধু আমাদের পেটকে নয়, বরং আমাদের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও ইমসাক তথা ধরে রাখতে (নিয়ন্ত্রণ করতে) পারি, তাহলেই এটি সত্যিকারের রোজা বলে গণ্য হবে। এই প্রেক্ষাপটে হযরত পয়গম্বর (সা.) বলেছেন, “কেউ যদি তোমাদের সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাহলে তুমি তাকে বলে দাও ‘আমি রোজাদার’।” মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে প্রেরিত এই রোজার বিধান পূর্ণতা পায় তখনই, যখন কয়েকটি বিষয় একইসাথে পালন করা হয়। সেগুলো হচ্ছে-
- সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারসহ সকল প্রকার মানবিক ইচ্ছা থেকে বিরত থাকা।
- মুখ দিয়ে খারাপ কথা উচ্চারণ না করা।
- অযথা বিতর্কে লিপ্ত না হওয়া।
- কারো মন না ভাঙা।
এগুলোর সবকটিই রোজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, যা হযরত পয়গম্বর (সা.) নিজে রোজার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।
হযরত মরিয়ম (আ.)-এর জীবনীতেও দেখা যায়, যখন তার উপর অপবাদ দেওয়া হচ্ছিলো এবং তিনি যখন এগুলো সহ্য করতে না পেরে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছিলেন, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে নির্দেশ দেন- তুমি বলো ‘আমি রোজাদার’। হযরত মরিয়ম (আ.)-এর রোজা ছিলো তার উপর আরোপিত অপবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার যুক্তি-তর্কে জড়িত না হয়ে চুপ থাকা। আমাদের রোজা ভঙ্গের কারণের ভেতরে ঝগড়া করা বা কারো সাথে দ্বন্দে লিপ্ত হওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব না দিলেও আমরা হযরত মরিয়ম (আ.)-এর এই ঘটনা থেকে আমাদের জীবনের জন্য বড় একটি শিক্ষা পাই।
মাহে রমজানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে, মুকাবালা তথা কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করা। মুকাবালা অর্থ হচ্ছে- পারস্পরিক আলোচনা করা। আমরা জানি প্রতি রমজানে হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূল (সা.)-এর নিকট আসতেন এবং সে সময় পর্যন্ত যতটুকু কুরআন নাজিল হয়েছে, তা একজন আরেকজনকে পাঠ করে শুনাতেন। মূলত এখান থেকেই ’মুকাবালা’ শব্দটি এসেছে। আমরা কোরআনকে কীভাবে পাঠ করবো এবং কীভাবে বুঝবো তার জন্য এই বিষয়টা আমাদের জন্য অনেক সুন্দর একটি উপমা।
কোরআন নাজিলের মাস রমজান এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) এই মাসে কোরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং অনেক ফজিলত বর্ণনা করেছেন। হযরত আলী (রা.) বলেন, চিন্তা না করে কোরআন পাঠের কোনো অর্থ হয়না। এজন্য কোরআনকে শুধু খতম দেওয়া বা দ্রুততার সাথে পাঠ করে শেষ করার জন্য নয়; বরং প্রত্যেকটি আয়াত নিয়ে যতটুকু সম্ভব চিন্তা-ভাবনা করাই হচ্ছে মুকাবালার সবচেয়ে বড় শিক্ষা। তাই, আমরাও যেন কোরআনকে পাঠ করার সময় চিন্তা করে পাঠ পারি। ইমাম মালিক (র.) সহ অনেক বড় বড় আলেমগণ রমজান মাসে তাদের জ্ঞানগত যাবতীয় কাজকে একপাশে রেখে এই মাসকে সম্পূর্ণরূপে কোরআনকে বোঝার জন্য ব্যয় করতেন। তারা বলতেন, “এটি হচ্ছে কোরআনের মাস। এই মাসে আমি আমার সমগ্র সময়কে কোরআনকে বুঝার ক্ষেত্রে এবং কোরআন নিয়ে চিন্তা করার ক্ষেত্রে ব্যয় করবো”। আমরাও যেন এই কোরআনের মাসে কোরআনের সাথে আমাদের সম্পর্ককে আরো মজবুত করার প্রচেষ্টা করতে পারি, এটা আমার পক্ষ থেকে আপনাদের বোন হিসেবে একটা উপদেশ।
রমজান নামক মক্তবের অন্যতম আরেকটি প্রোগ্রাম হচ্ছে “ইফতার”। আমরা তাহাজ্জুদের মধ্য দিয়ে রাত অতিবাহিত করে ফজরের ওয়াক্ত শুরুর পূর্বে সেহরি করার পর থেকে ইমসাকের মাধ্যমে অনেক হালাল বিষয়কে পরিত্যাগ করে থাকি। আমরা মুকাবালার পর ইফতারে এসে উপনীত হয়ে থাকি। ইফতারের সময়টি এমন একটি সময়, যে সময় সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “ইফতারের পূর্ব মুহূর্ত হচ্ছে দোয়া কবুলের মুহূর্ত”। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই সময়টি আমরা পরিবারের সকল সদস্য একত্রে পার করতে পারি। হযরত পয়গম্বর (সা.) বলেছেন, “ইফতারের জন্য যে পরিবার একত্রিত হয়, সে পরিবারকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রহমতের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন”। আমরা যেন আমাদের পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে একসাথে ইফতার করতে পারি, আমাদের বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশি ও অভাবী মানুষের জন্য যেন আমাদের ইফতারের দস্তরখানা উন্মুক্ত করতে পারি এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেভাবে চান, সেভাবে স্মরণীয় করে ইফতার করতে পারি – এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিপাত করা উচিত।
হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর খাবার নিয়ে অসাধারণ একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তিনি বলেছিলেন, তোমাদের খাবার সমূহ যেন সৎকর্মশীলগণ খায়, রোজাদরগণ তোমাদের পাশে এসে ইফতার করে। এতে ফেরেশতাগণ তোমাদের জন্য দোয়া করে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকটে যারা রয়েছে, তারা তোমাদের প্রশংসা করে। হযরত পয়গম্বর (সা.)-এর এই উপদেশ যেন আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত হয়, সেজন্য একইসাথে ইফতার করা এবং অন্য রোজাদারদেরও ইফতার করানো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রোজাদারদের প্রতিদানের কথা বলতে গিয়ে হযরত পয়গম্বর (সা.) তাদের জন্য দু’টি খুশির মুহূর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে- ইফতারের মুহূর্ত এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্ত। সারাদিন না-খেয়ে রোজা রাখা আমাদেরকে যেমন অভাবী-অনাহারীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনিভাবে এটি আমাদের নিজেদেরকেও পরিশুদ্ধ করে। এজন্য এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ স্মরণে রাখা প্রয়োজন। তা হচ্ছে- আমরা যেন তাদের কথা স্মরণে রেখে আমাদের ইফতারিকে বিশাল বহরে পরিনত না করি। বরং একজন মানুষের জন্য যতটুকু ইফতার প্রয়োজন, আমরা যেন ঠিক সেভাবেই নিজেদের ইফতার সাজাই এবং সেখান থেকে অন্যের সাথেও ভাগ করতে পারি – এই মানসিকতা আমাদের ভেতর লালন করতে হবে।
ইফতার করার পর আমরা মাগরিবের নামাজ আদায় করি, এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে তারাবী নামাজের প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকি। রমজান নামক মক্তবের প্রোগ্রামে তারাবী সংযোজন করেছিলেন হযরত পয়গম্বর (সা.) এবং বর্তমানে আমরা যেভাবে তারাবী পড়ে থাকি, এটার রূপ দিয়েছিলেন হযরত উমর (রা.)। তারাবী যাতে মুসলমানদের উপর ফরজ বিধান না করা হয় এবং তারা যেন এটি আদায় করতে সামর্থ্য হয়, এজন্য রাসূল (সা.) তারাবীর সব নামাজ মসজিদে পড়েননি; বরং এক অংশ মসজিদে এবং এক অংশ ঘরে পড়েছেন। পরবর্তীতে হযরত উমর (রা.) ইজতিহাদই হচ্ছে বর্তমান তারাবী’র এই রূপ।
তুরস্কসহ মুসলিম দেশের প্রায় দেশগুলোতেই মেয়েরাও তারাবীহর নামাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। তারা মসজিদে গিয়ে তারাবীহর পূর্ণ ফজিলত ও সওয়াব নেওয়ার চেষ্টা করে। এখানে জুমা ও ঈদের নামাজে নারীরা সেই অর্থে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হতে না পারলেও তারাবীহ তারা খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে আদায় করে করে থাকে।
বাংলাদেশে যেহেতু বেশিরভাগ মসজিদেই নারীদের জন্য নামাজের আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই, এর বিকল্প হিসেবে যেখানে পুরুষরা সবাই একসাথে পড়ে সেখান থেকে অর্ধেক পুরুষ কমিয়ে নারীদের জায়গার ব্যবস্থা করা যায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হযরত মরিয়ম (আ.)। সেসময় নারীদের মসজিদে প্রবেশ নিষেধ ছিলো। এর বিরুদ্ধে তাঁর মা যেন তাঁকে মসজিদের জন্য উৎসর্গ করেন, আল্লাহ তার উপর আয়াত নাজিল করে তা বুঝিয়ে দেন। অতএব, আমাদের প্রত্যেকটি সমাজেই প্রথা হিসেবে না থাকলেও উৎসবের সাথে মসজিদে তারাবি আদায়ের ব্যাপারে নারীদের উৎসাহ দেয়া দরকার। এ বিষয়টি আমি বলছি কারণ, হযরত পয়গম্বর (সা.) যে জামাতই পড়েছিলেন না কেন, সব জামাতেই নারীরা অবশ্যই অবশ্যই ছিল।
রমজানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম হচ্ছে “যাকাত”। রমজানে যাকাত আদায় করা অসাধারণ একটি ঐতিহ্য। এই কারণে অনেক সময় রমজান মাসকে যাকাত আদায়ের মাস হিসেবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশে সাধারণত রমজান মাসেই সবাই যাকাত দিয়ে থাকে। রমজানেই যে যাকাত দিতে হবে, এমন কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। বছরের যেকোনো সময়েই এটি দেয়া যায়। তবুও বিভিন্ন দেশে এটিকে সুন্দর একটি সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে।
আমরা জানি, যাকাত দেয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ বা মালের অধিকারী হতে হয় এবং সেই সম্পদ পুরো এক বছর অতিক্রম করতে হয়। আমাদের দেশে এটাকে এক রমজান থেকে আরেক রমজান এভাবে হিসাব করা হয়ে থাকে। এমনকি রমজান মাসে যাকাত দেয়ার ফলে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সবাইকে আর্থিকভাবে একটি সহযোগিতা রমজানের সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করে থাকে। এখন প্রশ্ন জাগে, যাদের যাকাত দেয়ার সামর্থ্য নেই, তারা কী তাহলে এই বরকতময় মাসে কোনো প্রকার ইনফাক (সদকা, দান) করবে না? হ্যাঁ, তারাও করবে। যাদের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই, তারা ফিতরা দিবে। সমাজের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি করার জন্য সাদাকাতুল ফিতরকে রমজানের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যাকাত যেসকল মানুষদের দেয়া যায়, সাদাকাতুল ফিতরও ঐ সকল মানুষদের দেয়া যাবে।
রমজানের অন্যতম আরেকটি প্রোগ্রাম হচ্ছে “ইতিকাফ”। এটি করা হয়ে থাকে রমজানের শেষ সময়ে। সাধারণত আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য মসজিদে ইতিকাফের নিয়ত করা হয়ে থাকে। ইতিকাফের সময় ইতিকাফকারীরা খুব সামান্য ইফতার ও সাহরির মধ্য দিয়ে নিজেদেরর প্রয়োজন পূরণ করে থাকেন। এছাড়া সমগ্র সময় জুড়ে তাঁরা দোয়া, জিকির ও সালাতের মধ্য দিয়ে এটি পালন করেন। এজন্য, একজন মানুষ দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে নিজের মাঝে ফিরে আসার অন্যতম একটি উপায় হলো এই ইতিকাফ। এর মাধ্যমে সে নিজের সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে এবং নিজের জীবন সম্পর্কে নতুন করে ভাবার সময় পেয়ে থাকে।
যদিও আমাদের সমাজে সাধারণত পুরুষরাই ইতিকাফ করে থাকে, তবুও এটা জেনে রাখা উচিৎ যে, নারীরাও ইতিকাফ করতে পারে। নারীদের মধ্যে যারা ইতিকাফ করতে চায়, তারা নিজেদের ঘরে ইতিকাফের নিয়ত করতে পারে। অথবা মসজিদে গিয়েই যে একেবারে থাকতে হবে তাও না। সকালে গিয়ে দুই নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে যেখানে কোনো সুযোগ আছে, এমন কোনো মসজিদে গিয়ে সে ইতিকাফের নিয়ত করতে পারে। আবার রাত হওয়ার আগেই সে ঘরে ফিরে আসতে পারে। আশা করা যায়, মহান রাব্বুল আলামীন তার এই নিয়তের কারণে ইতিকাফের যে সাওয়াব, তা দান করবেন।
রমজান নামক মক্তবের অন্যতম আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রোগ্রাম হচ্ছে “শবে কদর”। আমরা জানি যে, মহাগ্রন্থ আল কোরআন এই রাতেই মানবজাতির উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। সূরা কদরে বলা হচ্ছে, “এই রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম”। এই ফজিলতপূর্ণ রজনীকে আমরা যাতে ভালোভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি, সেজন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাদেরকে শেষ দশকে কদরের রাত সন্ধান করতে বলেছেন। বিশেষ করে বিজোড় রাত্রিগুলোতে কদর তালাশের ব্যাপারে আরও বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, বর্তমান সময়ে শুধু ২৭ই রমজান কে শবে কদর দেখিয়ে এই রাত্রিকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এমন নয়। রমজানের শেষ ১০ রজনীর সবকটিই আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই রজনীগুলোতে আমাদের বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, দোয়া করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং অন্যান্য ইবাদতও খুব বেশি বেশি করা প্রয়োজন।
রমজান মাসের প্রোগ্রাম শেষ করার পূর্বে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরী। তা হচ্ছে, যেসকল মানুষ রোজা রাখতে পারেনা, তাদের কী করণীয়?
কোনো মানুষ তার বার্ধক্যের কারণে বা দূরে কোনো সফরের কারণে কিংবা কোনো রোগের কারণে যদি রোজা রাখতে না পারে, তাহলে বাকি ১১ মাসের যেকোনো সময়েই এই রোজাসমূহ কে আদায় করতে পারে। কিন্তু তার রোগ যদি এমন হয় যে, রোজা রাখার কারণে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে এবং পরবর্তীতেও রাখা সম্ভব না, তাহলে সে রোজার জন্য ফিদিয়া দিবে। এক্ষেত্রে জেনে রাখা প্রয়োজন, কেউ যদি বয়সের কারণে রোজা রাখতে না পারে, এর অর্থ এই না যে সে রমজানে অন্য কোনো কিছুই করতে পারবে না। বরং সে তারাবী পড়তে পারে, ইফতার করতে পারে এবং সদকাতুল ফিতর দিতে পারে। এছাড়াও তার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য ইবাদতও সে করতে পারে। অর্থাৎ তার স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন সকল ইবাদতেই সে অংশগ্রহণ করতে পারে। এতে অবশ্যই সে সওয়াবপ্রাপ্ত হবে।
রমজান নামক প্রোগ্রামেরর শেষ অনুষঙ্গ হচ্ছে ঈদ। ঈদ হচ্ছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের প্রতি সম্মান বা ইকরাম। এমনকি এই দিনে রোজা রাখাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ঈদ ফজর নামাজের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়। সকল মানুষ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া এই সম্মানকে গ্রহণ করে সকলের মাঝে যে ভ্রাতৃত্ব সেটাকে আরো সুদৃঢ় করতে পারে। এই সময়ে বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব ও মুরুব্বিদের সাথে দেখা করা, তাদের দোয়া নেয়া এবং অভিবাদন জানানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ঈদের সময় আমাদের সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত বা সতর্ক দৃষ্টি দেয়া উচিত, যারা ঈদের আনন্দে অংশীদার হতে পারে না, তাদের প্রতি। তারাও যাতে মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য সকল ধরনের বন্দোবস্ত করা উচিৎ। সকল ঘরেই যেন এই আনন্দ পৌঁছে যায় সেজন্য রাস্তাঘাটে, বাসা বাড়িতে এই আনন্দ উদযাপন করা এবং এই আমেজ সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া ঈদেরই অংশ।
এই জন্যই আমরা ঈদ কে ঈদের মতোই উদযাপন করবো। ঈদকে আমরা যেন সাধারণ ছুটি হিসেবে না দেখি, এবং ঈদের যে আধ্যাত্মিকতা তা থেকে যেন দূরে সরে না যাই। ঈদকে আমাদের প্রতি আল্লাহ যে উপহার হিসেবে দিয়েছেন – নিজের জীবনে, পারিবারিক জীবনে এমনকি সামাজিক জীবনেও যাতে খুব ভালোভাবে তা পালন করা যায়, সেভাবেই আমাদের সকল ধরণের কর্মপন্থা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
আর এই রমজান নামক মক্তবের শেষে পয়গম্বর (সা.) মাগফিরাতের সুসংবাদ দান করেছেন। এখানে মাগফিরাত শুধু ক্ষমা নয়, এটি একইসাথে অতীত গুণাহের ক্ষমা এমনকি ভবিষ্যতের গুণাহ থেকে নিজেদের রক্ষা করা অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি হাদীসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করে, পর্যালোচনা করে, হিসাব করে রোজা রাখবে, মহান আল্লাহ তার পূর্বের সকল গুণাহ ক্ষমা করে দিবেন”।
অতএব, আমরা যেন দৃঢ় ঈমানের সাথে রাসূল (সা.) সীরাতের শিক্ষা অনুযায়ী রোজা পালন করতে পারি এবং মহান রাব্বুল আলামীনও যেন আমাদের সেই রোজাকে কবুল করেন সেই দোয়া করি। আর পাশাপাশি রোজা যেই উদ্দেশ্য আমাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে এবং এর যে রূহানিয়্যাত, তা যেন আমরা পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ে লালন করে পালন করতে পারি, মহান রাব্বুল আলামীন যেন আমাদের সেই তাওফীক দান করেন। আমীন।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ