আমরা এমন একটি গ্রন্থের প্রতি ঈমান এনে মু’মিন হয়েছি যে কিতাবের প্রথম আদেশ হল, পড়! প্রথমেই বলা হয়নি যে নামাজ আদায় কর ও রোজা রাখ। জ্ঞান, অস্তিত্বের পূর্বে আসে। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার জন্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। আর অস্তিত্বগত জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার জন্য এই তিনটি গ্রন্থকে একে অপরের থেকে পৃথক করা সমীচীন নয়;
১। ছোট বিশ্ব তথা মানুষ (হাকিকাতুল ইনসান)
২। বড় বিশ্ব (হাকিকাতুল কাওন)
৩। কোরআন (হাকিকাতুল কিতাব)
এই তিনটি গ্রন্থকে যদি আমরা একত্রে পাঠ করি কেবলমাত্র তখন-ই আমরা হাকিকতে উপনীত হতে পারব। ফলশ্রুতিতে প্রতিটি মুসলমানের উচিত হল এই তিনটি গ্রন্থকেই পাঠ করা এবং এগুলোর হাকিকত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা।
ইমাম মুহিউদ্দিন ইবনুল আরাবীর মতে, হাকিকতের তাজাল্লী (প্রতিফলন) দুইভাবে হয়ে থাকে। একটি হল; জ্ঞানের মাধ্যমে আর অপরটি হল উজুদ তথা সৃষ্টির মাধ্যমে। আমাদেরকে হাকিকতের দিকে ধাবিতকারী সবচেয়ে বড় উৎস হল উজুদ বা সৃষ্টি স্বয়ং নিজে। হাকিকতকে হয় আয়ান তথা চোখের মাধ্যমে দেখা যায় কিংবা বয়ানের মাধ্যমে শেখা ও শেখানো যায়। যদি আয়ান বা দৃষ্টিশক্তি না থাকে তাহলে বয়ানের মাধ্যমে হাকিকতে উপনীত হওয়া সম্ভবপর নয়। যদি কেবলমাত্র আয়ান (চোখে দেখা)- এর মাধ্যমে হাকিকতে উপনীত হওয়া সম্ভব হত তাহলে পয়গাম্বর পাঠানোর কোন প্রয়োজন হত না। এই জন্য ওহী প্রয়োজন।
শুধুমাত্র কিছু তথ্যের নাম-ই নাম নয়। জ্ঞান একই সাথে কোন কিছুর যথার্থতা, সত্যতা ও মূল্যকে জানার নাম। একইভাবে কোন বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে শুধুমাত্র ওয়াকিফহাল হওয়ার নাম-ই জ্ঞান নয়। জ্ঞান একই সাথে আমাদেরকে ঐ বিষয় বা বস্তুর হাকিকতের দিকে ধাবিতকারী একটি পথ। কোন কিছুর যথার্থতা, সত্যতা ও মূল্যকে নিরূপণ করে থাকে ‘হক্ব’। আর হক্ব এসে থাকে আসমাউল হুসনা থেকে। হক্ব নামক শব্দটি আমাদের জন্য একই সাথে একটি মিকইয়াস (পরিমাপক) ও মি’য়ার (মানদণ্ড)। আমাদের সভ্যতার সকল কিছুই তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে মহান প্রভু থেকে নিয়ে থাকে। তিনি যেটাকে হক্ব বলেছেন সেই হক্ব। হক্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কোন বিষয়-ই আমাদের সভ্যতায় হাকিকত নামে অভিহিত হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি হাদীসে বলেছেন;
“إنَّ اللهَ قد أعْطى كلَّ ذي حقٍّ حقَّه
নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রতিটি হকদারকে তার হক্ব দিয়েছেন”।
এর আলোকে ইসলাম সকল কিছুর হক্বকে আদায় করে থাকে; প্রতিটি হক্বদারকে তাঁর হক্বকে দিয়ে দেওয়া হল ইসলাম। এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ মানুষকে এই যোগ্যতা দেননি। এই ক্ষেত্রে মানুষের উচিত হবে মি’য়ার ও মিকইয়াস হিসেবে হক্ব কর্তৃক নির্ধারিত হাকিকতের মানদণ্ডকে উপেক্ষা না করা।
জ্ঞানের উদ্দেশ্য হল পৃথিবীতে হাকিকতকে ছড়িয়ে দেওয়া; হাকিকতের অধিকারী বানানো নয়। হিকমতের উদ্দেশ্য হল, হাকিকতে উপনীত হওয়ার পথের সন্ধান দেওয়া। আর মারেফতের উদ্দেশ্য হল, হাকিকতে উপনীত হওয়ার পথকে দেখিয়ে দেওয়া। ইসলামে জ্ঞানের যে দৃষ্টিভঙ্গী (তাসাউউর) সেখানে ইলম, হিকমত ও মারেফতকে একে অপরের থেকে পৃথক করা হয় না। এগুলোর একটিকে আহলে তাসাউফের নিকট রেখে, অপরটিকে আহলে হিকমতের নিকট রেখে এবং অন্য একটিকে ফকীহদের নিকট রেখে দিয়ে হাকিকতের পথে থাকা সম্ভবপর নয়।
আজকে আমাদের মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় সঙ্কটের একটি হল, কিছু কিছু ব্যক্তির কিংবা গোষ্ঠীর নিজেদেরকে হাকিকতের অনুসারী দাবি করার পরিবর্তে হাকিকতের অধিকারী দাবী করে বসা। শুধু তাই নয় কেউ কেউ আবার হাকিকত আমার কাছে এই দাবী করে হাকিকতকে নিজের অধিনস্ত করে রাখতে চায়। আজকে আমাদের মধ্যে যে ইখতিলাফ ও বিভাজন এর অন্যতম একটি কারণ হল নিজেদেরকে হাকিকতের অধিকারী বলে দাবি করা। অথচ হাকিকত এমন কোন বিষয় নয় যে, যেটার অধিকারী হওয়া যায়। বরঞ্চ হাকিকত হল এমন একটি বিষয় যেটার পথে থাকা যায়। ইসলামী সভ্যতায় জ্ঞানের যে দৃষ্টিভঙ্গী সেটার আলোকে মু’মিন হল হাকিকতের পথের একজন যাত্রী। সে যেন সর্বদায় হাকিকতের পথে থাকে এই জন্য তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কোন একজন ব্যক্তি, কোন একটি গোষ্ঠী কিংবা দল কেহই নিজেকে হাকিকতের অধিকারী বলে দাবি করতে পারে না। ইসলাম এই ক্ষমতা কাউকেই দেয়নি। এই কারণে একজন ব্যক্তির উচিত হবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পড়াশুনা থেকে দূরে থাকা।
কেননা স্থায়ী হাকিকতকে ক্ষণস্থায়ী কোন ব্যক্তি, দল কিংবা আইডিওলজির উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা যায় না। ব্যক্তি, দল কিংবা আইডিওলজি কেন্দ্রিক পড়াশুনার বদলে আমাদের সভ্যতার সকল ধারা ও বড় বড় ব্যক্তিদের নিকট থেকে উপকৃত হতে হবে। কেননা আমাদের সভ্যতায় একজন বড় ব্যক্তি নন, অনেক বড় বড় ব্যক্তিগণ রয়েছেন।
আপনারা জানেন কোরআনে কারীমে ইব্রাহীমের কিসসা রয়েছে। যেটা আমরা সাধারণত এই ভাবে পড়ে থাকি, “রাতের আঁধার যখন তাকে আচ্ছন্ন করল তখন সে নক্ষত্র দেখতে পেল, (তখন) বলল, এটাই হচ্ছে আমার প্রতিপালক। কিন্তু যখন তা অস্তমিত হল, সে বলল, যা অস্তমিত হয়ে যায় তার প্রতি আমার কোন অনুরাগ নেই। অতঃপর সে যখন চন্দ্রকে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখল তখন বলল, এটা হচ্ছে আমার প্রতিপালক। কিন্তু যখন তা অস্তমিত হল তখন সে বলল, আমার প্রতিপালক যদি আমাকে সঠিক পথের দিশা না দেন তাহলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর যখন সে সূর্যকে অতি উজ্জ্বল হয়ে উদিত হতে দেখল তখন বলল, এটাই হচ্ছে আমার প্রতিপালক, এটাই হচ্ছে সব থেকে বড়। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হল তখন সে বলল, হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা যেগুলোকে (আল্লাহর) অংশীদার স্থির কর সেগুলোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই”। কিসসাটি ভাবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
কোন পয়গাম্বর-ই এক মুহূর্তের জন্যও যে ঈমানের প্রতি দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন না এই বিষয়কে মনে প্রাণে বিশ্বাসকারী একজন মু’মিন হিসেবে শুধু মাত্র বলতে চাই যে এই কিসসাকে এই ভাবে বুঝা প্রয়োজন। কিসসার পূর্বোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে,
وَ کَذٰلِکَ نُرِیۡۤ اِبۡرٰهِیۡمَ مَلَکُوۡتَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لِیَکُوۡنَ مِنَ الۡمُوۡقِنِیۡنَ
“ইব্রাহীম যেন হাকিকতের ব্যাপারে ইয়াকিন, নিশ্চিত ও সত্যিকারের জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে এই জন্য আমি তাঁকে আকাশ ও যমীনের মালাকুতকে (মূলক/দৃশ্যমান জগতের সাথে মালাকুত/অদৃশ্য জগতের অর্থকে) অবলোকন করিয়েছি।”
এই আয়াতকে বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী আয়াতকে বুঝলে আরও বেশী সঠিক হবে। মূলত আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হাকিকতের জ্ঞানে উপনীত হওয়ার জন্য ইব্রাহীমের (আঃ) অনুসৃত পন্থাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে যদি হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মত হাকিকতের অধকারী হতে চাও তাহলে তাঁর মত হিকমতের তাঁরকা, জ্ঞানের চাঁদ ও মারেফতের সূর্যকে একত্রে বুঝতে হবে। শুধু তাই নয় এই কিসসা আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, হাকিকতে উপনীত হওয়ার জন্য শুধুমাত্র চন্দ্র, সূর্য ও তারকার আলো নয় একই সাথে ইলম, হিকমত ও মারেফতকেও আয়ত্ব করতে হবে। অর্থাৎ জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় জগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ফলশ্রুতিতে জ্ঞানকে; বিশ্বসৃষ্টি, মানুষ ও ওহীকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণকারী একটি দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে হবে।
অনুবাদ: বুরহান উদ্দিন আজাদ।