আজ নতুন একটি যুগের এবং নতুন একটি বিজয়ের প্রয়োজন, যার জন্য সমগ্র মানবতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। নতুন এক শান্তিময় দুনিয়া গঠন করার জন্য আমাদের এই মুসলিম উম্মাহ পুনরায় নেতৃত্ব দিবে। সম্মানিত একটি জাতির এবং সম্মানিত এক ইতিহাসের উত্তরাধিকারীগণ এ বিজয়ের পতাকাবাহী হিসেবে কাজ করবে।
ইস্তাম্বুল বিজয়ের খুব বেশি আগে নয়, মাত্র ৫০ বছর পূর্বে ১৪০০ সালের শুরুর দিকে তৈমুর লং আনাতোলিয়াতে (Anadolu) আক্রমণ করেছিল। সবাই ভেবেছিল সবকিছুই বুঝি ধ্বংস হয়ে গেছে। মুসলিম বিশ্ব সবচেয়ে বড় দুর্দশায় পতিত হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে আমাদের এ জাতি সবকিছু আবার সাজিয়ে-গুছিয়ে, ইস্তাম্বুল বিজয়ের মধ্যদিয়ে একটি যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন এক সোনালী যুগের সূচনা করেছিল। তেমনিভাবে আজও একটি নতুন যুগের সূচনার জন্য নতুন একটি বিজয়ের প্রয়োজন। এজন্য ইস্তাম্বুল বিজয়কে খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
আমাদের প্রিয় নবী, মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ (স.) নিমোক্ত হাদীসের মাধ্যমে আমাদেরকে ইস্তাম্বুল বিজয়ের সুসংবাদ দান করেছিলেন।
لَتُفْتَحَنَّ الْقُسْطَنْطِينِيَّةُ فَلَنِعْمَ الْاَمِيرُ اَمِيرُهَا وَلَنِعْمَ الْجَيْشُ ذَلِكَ الْجَيْشُ
অর্থাৎ “অবশ্যই অবশ্যই, ইস্তাম্বুল বিজিত হবে। কতই না উত্তম সে যুদ্ধের সেনাপতি আর বিজয়ী সৈনিকগণ।” (মুসনাদে আহমাদ)
এ হাদীস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কী বলা হয়েছে এ হাদীসে?
لَتُفْتَحَنَّ الْقُسْطَنْطِينِيَّةُ (লাতুফতাহান্নাল কুসতান্তিনিয়্যাহ)-এ কথা বলা হয়েছে। এখানে রয়েছে লামে তাকিদ এবং নুনে সাকিলা। মানে এর দ্বারা বক্তব্যকে জোরালো করা হয়েছে। অর্থাৎ ইস্তাম্বুল অবশ্যই অবশ্যই বিজিত হবে। বিজয়ের জন্য মৌলিক শর্ত হল এমনি দৃঢ় বিশ্বাস।
অর্থাৎ যদি বিজয়ী হতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের নিজেদেরকে নিখাদ বিশ্বাস করতে হবে, দৃঢ়ভাবে এবং সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করতে হবে। মুহাম্মাদ (স.)-এর “অবশ্যই অবশ্যই বিজয় হবে” এ কথাটি বলার কারণে মুসলমানগণ এ সম্মানের অংশীদার হওয়ার জন্য বহুবার বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের মধ্য থেকে এই সম্মান মহান সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহকে নসীব করেছেন।
সুলতান ফাতিহ তার বাল্যকাল থেকেই ইস্তাম্বুল বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। উক্ত হাদীস শরীফে বর্ণিত এই বিরল সম্মানের অংশীদার হওয়ার জন্য তিনি রাত-দিন কঠোর সাধনা করেছিলেন। ইস্তাম্বুল বিজয়ের জন্য তিনি পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও তাকে এই বিরল সম্মানে সম্মানিত করেছিলেন।
সুতরাং আমরা যে দাওয়াত ও আন্দোলনকে বিশ্বাস করি, সেই দাওয়াত ও আন্দোলনকে তার লক্ষ্যপানে পৌঁছানোর জন্য আমাদেরকেও পাগলপারা হতে হবে।
সুলতান ফাতিহ সিংহাসনে সমাসীন হওয়ার সাথে সাথেই দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করে ইস্তাম্বুলের বিজয়ের জন্য সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শহর ইস্তাম্বুলের বিজয়ের জন্য তিনি সবকিছু সুসংহত করেছিলেন। তিনি দুই লাখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করেন, পাশাপাশি অধিক পরিমাণে আগুনের গোলা তৈরি করেন। এগুলো ছিল সেই সময়ের যুদ্ধের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি। “ঈমান খাসী ছাগল থেকেও দুধ বের করতে পারে”-এ কথার ওপর আস্থা রেখে তিনি পাহাড়ের ওপর দিয়ে জাহাজ চালিয়েছিলেন।
এমনি একটি বিজয় চাইলে ঈমান, আত্মবিশ্বাস, আগ্রহের পাশাপাশি সমকালীন সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী হতে হবে এবং সবচেয়ে উন্নত পন্থা-পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল তিনি বাইজান্টাইন সম্রাটকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। এটি ইসলাম ও মুসলিমদের মূলনীতি। রক্তপাত যাতে না হয় এজন্য তিনি এ আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাইজান্টাইনগণ এটিকে গ্রহণ না করে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সুলতান ফাতিহও আক্রমণের নির্দেশ দান করেন। এর আগে তিনি তার সেনাবাহিনীর সবাইকে নিয়ে নামাজ আদায় করে বিজয়ের জন্য মহামহীম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে দোয়া করেন। দোয়ার পর সেনাবাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দেন। (ঘোড়ার পীঠে আরোহণ করার সময় তাকে এমন দেখাচ্ছিল যিনি পাহাড়সমূহ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন।)
ইয়া আল্লাহ! কত বিশাল এক যুদ্ধ! কত বড় উদ্যম! কত মহান এক প্রয়াস! ২৯ মে ফজরের সময়ে প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল। ইস্তাম্বুলের বিজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। বাইজান্টাইনের প্রাচীরে সর্বপ্রথম ইসলামের পতাকা উত্তোলন করার সৌভাগ্য হয়েছিল উলুবাতলি হাসানের। সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহর সেনাবাহিনী ভেঙ্গে ফেলা প্রাচীরের ভেতর দিয়ে তীব্রবেগে স্রোতের মতো ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করেছিল। এভাবে একটি যুগের পতন হয়ে অন্য যুগের সূচনা হয়েছিল।
ইস্তাম্বুল বিজয়ের পর বিজয়ী সেনাপতি সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করার জন্য আয়াসোফিয়াকে (Hagia Sophia) মসজিদে রূপান্তরিত করে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারী (রা.)-এর কবর যিয়ারত করতে যান। এভাবে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতিহ এত বড় বিজয়ের পর অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া জ্ঞাপনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত পেশ করেন।
আজ আমরা মুসলিম হিসেবে, প্রাচীরের সামনে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর মতো। আমরা আজ নতুন এক বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। আগামী দিনের বিজয়ের জন্য নতুন উদ্যমে লড়ে যাচ্ছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি, তিনি আমাদেরকে এমন মর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতির উত্তরাধিকারী করেছেন। ইস্তাম্বুলের বিজয় থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি তার মধ্যে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারী (রা.)।
জিহাদের ঘোষণা শোনার সাথে সাথে হযরত আবু আইয়ুব আল-আনসারী (রা.) কোরআনে কারীম বন্ধ করে উঠে দাঁড়ান। তাঁর সন্তানরা তাঁকে এই বলে বাধা দেন, “বাবা! তুমি বসো। বসে বসে কোরআন পড়। নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিও না।” উত্তরে তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, “আমার প্রিয় সন্তানরা! তোমরা আমাকে বলছ তুমি বসো, বসে কোরআন পড়। কিন্তু আমি যখন কোরআন পড়ি, কোরআন আমাকে বলে, উঠে দাঁড়াও, জিহাদ কর।”
এই মহান সাহাবী ৯০ বছর বয়সে ইস্তাম্বুলের প্রাচীরের কাছে আসেন। তাঁর বয়সের কারণে তাঁর নিরাপত্তার জন্য সৈনিকরা তাঁকে তাদের পেছনে রাখতে চেয়েছেন কিন্তু তারা সেটা পারেননি। যুদ্ধের সেই চরম মুহূর্তে আগুন এবং তীরের নিচে দাড়িয়ে তিনি সৈন্যদেরকে “জাগতিক কাজে মশগুল হয়ে জিহাদ থেকে দূরে থেকে নিজেদেরকে হুমকির মুখে ঠেলে দিও না” এই আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তরুণ সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়েছিলেন। এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে বাইজান্টাইনের প্রাচীরের পাদদেশে শাহাদাত নাসীব করেন।
“ইসলাম কেমন দ্বীন?” এ বিষয়ে কেউ জানতে চাইলে সে যেন ৯০ বছর বয়সে ইস্তাম্বুল বিজয়ের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে আসা হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারী (রা.)-এর দিকে তাকায়। ইসলামের মূল রূপ এবং রূহই হল এটি। ইসলাম হল, জিহাদের দ্বীন। এজন্য ‘শুধু নামাজ পড়বেন, তাসবিহ তাহলিল পাঠ করবেন’-এ কথা বলা মূর্খতা। যদি তা-ই হতো এই মহান সাহাবী, (রাসূল (স.) মদিনায় হিযরত করার পর যার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন) তিনি মদিনা থেকে পৃথক না হয়ে সেখানে সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতিতে নামাজ পড়তেন এবং তাসবীহ-তাহলীলে মশগুল থাকতেন।
ইস্তাম্বুুলের বিজয়ের জন্য হযরত আকা শামসেদ্দিন এর ভ‚মিকাও অতি বিশাল। তাকেও আমাদেরকে আমাদের আদর্শ হিসাবে স্মরণ করতে হবে। তিনি ছিলেন একজন বড় আলেম। ইস্তাম্বুলের বিজয়াভিযানে তিনি আমাদের জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত। ফাতিহর উস্তাজ হিসাবে, প্রতিটি গুহায় গিয়ে গিয়ে তিনি সৈন্যদেরকে উৎসাহ-উদ্দীপনা জুগিয়েছিলেন। এর থেকে আমাদের বর্তমানের আলেমগণের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। কেননা এটি ধারণা করা হয়ে থাকে, তারা শুধু নামাজ পড়ে তাসবীহ তাহলীল করার মধ্যেই ইবাদতকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। নতুন একটি দুনিয়া প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা সর্বাত্মকভাবে সকল শক্তি দিয়ে প্রচেষ্টা না চালালে নিজেদেরকে সত্যিকারের ঈমানদার বলে আমরা দাবি করতে পারব না।
সুলতান ফাতিহ ইস্তাম্বুল বিজয়ের সময় ২১ বছরের টগবগে যুবক। ইস্তাম্বুলের বিজয় যেমন অনেক বড় এবং মহান একটি ঘটনা ঠিক তেমনি যারা ২১ বছর বয়সে এ বিজয়ের জন্য ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে কাজ করেছেন, তারাও তেমন মহান ও মর্যাদাবান। একটি দেশের আসল শক্তি ট্যাঙ্ক, ক্ষেপণাস্ত্র এবং অর্থবিত্ত নয়, বরং সে দেশের আসল শক্তি হল ঈমানের বলে বলীয়ান যুবসমাজ।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ