মুসলমানদের অনগ্রসরতার কারণ ও উত্তরণের উপায়

একই স্থানে ঘুরপাক খাওয়া, পরনির্ভরশীলতা, দারিদ্রতা এবং অনগ্রসরতা থেকে কি আপনারা মুসলমানদেরকে উদ্ধার করতে চান ? নতুন করে সামনের দিকে, সম্মানের সাথে এবং আলোর পথে নিজেদের ভবিষ্যতকে সুন্দর করে সাজাতে চান ? নৈতিকতা, প্রতিভা এবং সাহসিকতাকে সকল শক্তি দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করতে চান ? তাহলে এই পথে আমাদেরকে নিয়ে যেতে সক্ষম, সে পথের সুনির্দিষ্ট সন্ধান দিতে চাইঃ

ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের সকল স্তরে ইসলামী চিন্তা চেতনাকে নতুন করে সাজানো এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত ইসলামী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

এই লক্ষ্য অনেক দূর এবং অবাস্তব মনে হতে পারে কিন্তু প্রচেষ্টা চালালে এটা অবশ্যই সম্ভব এবং এটা আমাদের নাগালের বাহিরে নয়।

ইতিহাস আমাদেরকে একটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাবে এটা দেখায় যে; মুসলমানদের মধ্যে নতুন করে শিহরণ, শৃঙ্খলা, ইলহাম এবং চেতনা সৃষ্টি করতে পারবে একমাত্র ইসলাম। 

১৯৫০ এর দশকে শুধুমাত্র কয়েক হাজার সত্যিকারের মুসলিম মুজাহিদ ব্রিটিশ বাহিনীকে সুয়েজ খাল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। অপরদিকে আরব বর্ণবাদী শাসক গোষ্ঠীর সেনাবাহিনী ইসরাইলের কাছে তিন বার পরাজয় বরণ করে।  

মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্ক সমগ্র দুনিয়ার শাসন কর্তা ছিল। ইসলাম গ্রহণের পরে কোন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী অন্য কোন আদর্শকে ধারণ করে বেঁচে থাকতে কিংবা মৃত্যুবরণ করতে পারে না। একজন মুসলমানের নাম যাই হোক না কেন, যে কোন সম্রাট অথবা হুকুমদার একটি জাতির জন্য, দলের জন্য অথবা এর সাথে সাদৃশ্য কোন কিছুর জন্য নিজেকে কুরবানী করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। সত্যিকারের ইসলামী চিন্তা মতে সে এখানে মূর্তি পূজা কিংবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারবে না। মুসলমান কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার নামে এবং ইসলামের বিজয়ের জন্য জীবন  দিতে পারে অথবা যুদ্ধ থেকে পলায়ন করতে পারে।

এই জন্য মুসমানদের পশ্চাদপদতার মূল কারণ হল ইসলামের অনুপস্থিতি এবং সেই পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য মুসলিম বিশ্ব আজ প্রস্তুত নয়। সেগুলো মূলত মুসলমানদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার অনুপস্থিতির একটি প্রকাশ মাত্র।

এই বিষয় গুলোকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আমাদের কর্মের ফল হিসেবে গ্রহণ করে সুস্পষ্টভাবে একথা বলতে চাই যে, মুসলিম বিশ্ব ইসলাম ব্যতীত এবং ইসলাম বিরোধী হয়ে কখনোই নবচেতনায় উজ্জীবিত হতে পারবে না।  

ইসলাম, মানুষের সাথে ইসলামের সম্পর্ক, পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান, মানব জীবনের উদ্দেশ্য, মানুষের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক এবং মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ব্যাপারে মনোভাব, মুসলিম জনগণের অবস্থার উন্নতির জন্য সত্যিকারের সমাধান হিসাবে চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয় চরিত্র, দর্শন, চিন্তা এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসাবে অবশিষ্ট আছে।

এটা সুস্পষ্ট যে আমাদের সামনে বিকল্প কিছু নেই। হয় ইসলামী রেনেসাঁর জন্য সংগ্রাম করা অথবা অবক্ষয় ও অবনতি মেনে নেওয়া। মুসলমানদের জন্য তৃতীয় কোন পথ নেই।

উৎসঃ ইসলামী ডেক্লারেশন

অনুবাদক: বুরহান উদ্দিন আজাদ

 

 

১৪৮৫ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ হলেন গোটা দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের একজন মহান পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে জন্ম লাভ করা এই মহাপুরুষ দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করেছেন বিরল অনেক দৃষ্টান্ত। তিনি বসনিয়া হেরসেকের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, যার হাত ধরেই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মুক্তি পেয়েছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অসম যুদ্ধে জয়ী হয়ে শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছিলেন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে।

জন্ম ও শৈশবকাল:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ১৯২৫ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বস্নাকা ক্রুপা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিলো ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি পরিবার। কিন্তু আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলাম বিরোধী একটি বৈরী পরিবেশ ও ইউরোপিয়ানদের দারা দখলকৃত একটি ভূমিতে বেড়ে উঠেন। সারায়েভোর একটি জার্মান স্কুলে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। একজন মেধাবী ও সুশৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে সবার কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। তিনি তার স্কুল জীবনেই পাশ্চাত্য ও ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য তার সহপাঠীদের কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। সে সময়েই তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে গড়ে তুলেন মেলাদি মুসলমানি (মুসলিম যুবসংঘ) নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠন কায়েমকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু তার জ্ঞান এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে সবার কাছেই ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ। আর এই কারণেই তার প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্লাব না হয়ে পরিণত হয় সক্রিয় একটি সংগঠনে। যার ফলে এটি হয়ে ওঠে ছাত্রদের ক্যারিয়ার গঠন ও গঠনমূলক কাজের অন্যতম সূতিকাগার। অপরদিকে মেয়েদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠনটি দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ এর প্রতিষ্ঠিত এই মুসলিম যুবসংঘটি যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার এই যুগান্তকারী ভূমিকা তাকে ও তার সংগঠনকে সবার সামনে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী বসনিয়াতে ১ লাখেরও বেশি মুসলমান হত্যা করে।

কম্যুনিস্ট শাসনের জুলুম-নির্যাতন:
১৯৪৬ সালের ১৩ জানুয়ারি বসনিয়া পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। কিন্তু এই সংগ্রামে বামপন্থি নেতাদের আধিপত্য থাকায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বামপন্থিরা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। বসনিয়া একটি স্বায়ত্ত শাসিত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এক চুক্তি অনুযায়ী যুগোশ্লাভিয়ার সাথে আরও ৬টি দেশ মিলে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে। বসনিয়া হয় এই ৬টি দেশের একটি।
কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলামী আন্দোলনের নেতা হওয়ায় এবং নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকার কারণে কম্যুনিস্টদের টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৪৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। এবং তিনি একাধারে ৫ বছর বন্দি জীবন যাপন করেন।
১৯৫৩ সালে টিটু (Titu) ক্ষমতায় আসার পর আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের উপর জুলুম-নির্যাতন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি এ সকল জুলুম- নির্যাতনের পরেও তার বিপ্লবী ভূমিকা অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কাজকে অব্যাহত রাখেন, চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটানোর কাজে রত থাকেন। এ সময়ে তিনি অন্য একটি ইসলামী দলের নেতা হাসান দুজুর সাথে মিলে তার কাজের গতি বৃদ্ধি করেন।
১৯৭৪ সালে টিটুর নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসা নতুন করে উন্মুক্ত হয়। ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম-নির্যাতন কমে আসায় অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলোর উপর পরিমাণে স্বল্প হলেও জুলুম-নির্যাতন কমে আসে। ইসলামী সংগনগুলোর কাজের ফলে জনগণের মধ্যে ইসলামের একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়।

টিটুর মৃত্যু ও আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ইসলামী মেনিফেস্টো (Islamic Menifesto):
১৯৮০ সালে টিটুর মৃত্যুর পর ফেডারেশন প্রেসিডেন্টের বিষয়ে একটি চুক্তি প্রস্তাবিত হয়। আর এটি হলো ৬টি স্বায়ত্ত শাসিত দেশের প্রেসিডেন্টগণ সবাই এক বছর করে ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই চুক্তির কারণে স্বল্প পরিসরে হলেও গণতন্ত্র ফিরে আসে। চুক্তির আলোকে সকলেই কাজ করার সুযোগ পায়। আর এ সময়েই আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ছেলে তার পিতার বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধসমূহকে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে বই আকারে প্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে Islamic Declartion নামে একটি বই প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে এই বই প্রকাশিত হওয়ায় আলীয়া ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রে রেডিকেল ইসলামের প্রবর্তন করতে চাচ্ছেন, এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচকে আদালতে নেওয়া হলে তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বসনিয়া হেরসেককে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপর তারা তাকে এক অন্যায় আদেশের মাধ্যমে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এবং তার বইকেও নিষিদ্ধ করে। এতে করে এই বই এর প্রচার ও প্রকাশনা গোপনে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এবং এই বই (ডেক্লারেশন) লেখার কারণেই লেখক আজ কারাগারে এই বিষয়টি পাঠকের মনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে।

জেল জীবন:
উচ্চ আদালত তার ১৪ বছরের সাজা কমিয়ে ১১ বছরে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এক ক্ষমার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দান করে। ৫ বছরের জেল জীবনে আলীয়া তার চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটান। তার আগের চিন্তাগুলোকে সংশোধন করে মজবুত যুক্তির উপর দাঁড় করান। তার যুক্তিভিত্তিক যে লেখনীর কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তিনি তার সেই যুক্তিকে শাণিত করে কারাগারে বসেই লিখেন তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ Islam between East and West। তার এক বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সব জায়গায় তার এই বইটিকে ছড়িয়ে দেন। আর তিনি আলীয়ার এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষিত মুসলিমদেরকে আলীয়ার দলে ভিড়াতে থাকেন। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে তার এই জেল জীবন তাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলে এবং তিনি সকলের মাঝে একজন স্কলার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর জনগণ তাকে একজন মহান নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বসনিয়া হেরসেক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেগবান করেন।

রাজনৈতিক জীবন:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ যখন জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘণ্টা বেজে গিয়েছিলো। যুগোস্লাভিয়াতে স্বাধীনতা সংগ্রাম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। অপরদিকে ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোও একে একে স্বাধীনতার দিকে আগাতে থাকে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাতে তার নেতৃত্বে Democratic Action Party (SDA) নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে এবং আলীয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথম বার নির্বাচন করেই তার দল সরকার গঠন করে এবং পার্লামেন্টে ৮৬টি আসন লাভ করে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম:
১৯৯০ দশকের দিকে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশন স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফেডারেশন এর ৬টি দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ১ মার্চ ১৯৯২ সালের এক রেফারেনডামের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কারণ শতকরা ৬২% জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সার্বিয়া বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা করে মুসলিম নিধনের নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একই ফেডারেশনের দেশ ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাধুবাদ জানালেও মুসলিমদের দেশ বসনিয়া হেরসেক- এর উপর সার্বিয়ার হামলাকে সাধুবাদ জানায়। বসনিয়া হেরসেক-এর দুর্দশায় নতুন মাত্রা যোগ করে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী দেশ যুগোস্লাভিয়া। তারা সার্বিয়ার এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানিয়ে তাদেরকে সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি ছাড়া এ সময় কোনো মুসলিম দেশ নির্যাতিত বসনিয়ান মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহর শত্রুপক্ষ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসনে তারা লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে তারা ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত বিভিন্ন স্থাপনা ও মসজিদসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতা খুব একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। কারণ একথা সত্য যে, বাতিলরা কখনো মুখের কথায় তাদের জুলুম বন্ধ করে না। তাদের জুলুমকে বন্ধ করার জন্য তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং তারা কেবলমাত্র শক্তিকেই ভয় করে। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজারে। সব মিলিয়ে ১ মিলিয়ন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময়ে বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ। এই ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি তার নেতৃত্বের অসীম গুণাবলী দ্বারা ও সাহসিকতার সাথে তার দেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তার জাতিকে একত্রিত করে সার্বিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

ডেটন চুক্তি:
বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলিমদের এই সংগ্রামে বিশ্বের মুসলিমগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুবকগণ বসনিয়ার মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সংগ্রাম ও জিহাদের পাশাপাশি বসনিয়ান মুসলিমদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। তিনি তুরস্ক থেকে হাজার হাজার যুবক পাঠান বসনিয় মুসলিম ভাইদের সাহায্য করার জন্য। তার সম্পদের বিশাল এক অংশ দিয়ে বসনিয়ায় গড়ে তুলেন অস্ত্রাগার। OIC-ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে বসনিয় মুসলিমদের সাহায্যার্থে ভঙ্গ করেন জাতিসংঘের সকল চুক্তিকে। ইরানকে সাথে নিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের। এরবাকান তৎকালীন তুরস্ক সরকারকে বাধ্য করেন বসনিয় মুসলিমদের সাহায্য করতে। আর এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্বিয়াকে তাদের এক তরফা সমর্থন দিতে থাকে। তারা সার্বিয়ার সাথে চুক্তি করার জন্য বসনিয়াকে চাপ দিতে থাকে। পরবর্তীতে আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কারণ তিনি তাতে রাজি না হলে এই অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র বসনিয়ানরা আরও হত্যার শিকার হতো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তিতে বসনিয়া পায় ৫১% ভূমি আর ক্রোয়েশিয়াকে দেওয়া হয় ৪৯% ভূমি। এবং বিভিন্ন অসম চুক্তিতে বসনিয়াকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।

মৃত্যু:
এই মহান মানুষটি ১৯ অক্টোবর ২০০৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান মহান মনিবের দরবারে।
Picture of আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ হলেন গোটা দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের একজন মহান পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে জন্ম লাভ করা এই মহাপুরুষ দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করেছেন বিরল অনেক দৃষ্টান্ত। তিনি বসনিয়া হেরসেকের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, যার হাত ধরেই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মুক্তি পেয়েছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অসম যুদ্ধে জয়ী হয়ে শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছিলেন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে।

জন্ম ও শৈশবকাল:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ১৯২৫ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বস্নাকা ক্রুপা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিলো ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি পরিবার। কিন্তু আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলাম বিরোধী একটি বৈরী পরিবেশ ও ইউরোপিয়ানদের দারা দখলকৃত একটি ভূমিতে বেড়ে উঠেন। সারায়েভোর একটি জার্মান স্কুলে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। একজন মেধাবী ও সুশৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে সবার কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। তিনি তার স্কুল জীবনেই পাশ্চাত্য ও ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য তার সহপাঠীদের কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। সে সময়েই তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে গড়ে তুলেন মেলাদি মুসলমানি (মুসলিম যুবসংঘ) নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠন কায়েমকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু তার জ্ঞান এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে সবার কাছেই ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ। আর এই কারণেই তার প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্লাব না হয়ে পরিণত হয় সক্রিয় একটি সংগঠনে। যার ফলে এটি হয়ে ওঠে ছাত্রদের ক্যারিয়ার গঠন ও গঠনমূলক কাজের অন্যতম সূতিকাগার। অপরদিকে মেয়েদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠনটি দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ এর প্রতিষ্ঠিত এই মুসলিম যুবসংঘটি যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার এই যুগান্তকারী ভূমিকা তাকে ও তার সংগঠনকে সবার সামনে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী বসনিয়াতে ১ লাখেরও বেশি মুসলমান হত্যা করে।

কম্যুনিস্ট শাসনের জুলুম-নির্যাতন:
১৯৪৬ সালের ১৩ জানুয়ারি বসনিয়া পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। কিন্তু এই সংগ্রামে বামপন্থি নেতাদের আধিপত্য থাকায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বামপন্থিরা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। বসনিয়া একটি স্বায়ত্ত শাসিত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এক চুক্তি অনুযায়ী যুগোশ্লাভিয়ার সাথে আরও ৬টি দেশ মিলে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে। বসনিয়া হয় এই ৬টি দেশের একটি।
কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলামী আন্দোলনের নেতা হওয়ায় এবং নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকার কারণে কম্যুনিস্টদের টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৪৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। এবং তিনি একাধারে ৫ বছর বন্দি জীবন যাপন করেন।
১৯৫৩ সালে টিটু (Titu) ক্ষমতায় আসার পর আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের উপর জুলুম-নির্যাতন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি এ সকল জুলুম- নির্যাতনের পরেও তার বিপ্লবী ভূমিকা অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কাজকে অব্যাহত রাখেন, চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটানোর কাজে রত থাকেন। এ সময়ে তিনি অন্য একটি ইসলামী দলের নেতা হাসান দুজুর সাথে মিলে তার কাজের গতি বৃদ্ধি করেন।
১৯৭৪ সালে টিটুর নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসা নতুন করে উন্মুক্ত হয়। ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম-নির্যাতন কমে আসায় অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলোর উপর পরিমাণে স্বল্প হলেও জুলুম-নির্যাতন কমে আসে। ইসলামী সংগনগুলোর কাজের ফলে জনগণের মধ্যে ইসলামের একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়।

টিটুর মৃত্যু ও আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ইসলামী মেনিফেস্টো (Islamic Menifesto):
১৯৮০ সালে টিটুর মৃত্যুর পর ফেডারেশন প্রেসিডেন্টের বিষয়ে একটি চুক্তি প্রস্তাবিত হয়। আর এটি হলো ৬টি স্বায়ত্ত শাসিত দেশের প্রেসিডেন্টগণ সবাই এক বছর করে ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই চুক্তির কারণে স্বল্প পরিসরে হলেও গণতন্ত্র ফিরে আসে। চুক্তির আলোকে সকলেই কাজ করার সুযোগ পায়। আর এ সময়েই আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ছেলে তার পিতার বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধসমূহকে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে বই আকারে প্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে Islamic Declartion নামে একটি বই প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে এই বই প্রকাশিত হওয়ায় আলীয়া ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রে রেডিকেল ইসলামের প্রবর্তন করতে চাচ্ছেন, এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচকে আদালতে নেওয়া হলে তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বসনিয়া হেরসেককে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপর তারা তাকে এক অন্যায় আদেশের মাধ্যমে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এবং তার বইকেও নিষিদ্ধ করে। এতে করে এই বই এর প্রচার ও প্রকাশনা গোপনে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এবং এই বই (ডেক্লারেশন) লেখার কারণেই লেখক আজ কারাগারে এই বিষয়টি পাঠকের মনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে।

জেল জীবন:
উচ্চ আদালত তার ১৪ বছরের সাজা কমিয়ে ১১ বছরে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এক ক্ষমার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দান করে। ৫ বছরের জেল জীবনে আলীয়া তার চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটান। তার আগের চিন্তাগুলোকে সংশোধন করে মজবুত যুক্তির উপর দাঁড় করান। তার যুক্তিভিত্তিক যে লেখনীর কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তিনি তার সেই যুক্তিকে শাণিত করে কারাগারে বসেই লিখেন তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ Islam between East and West। তার এক বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সব জায়গায় তার এই বইটিকে ছড়িয়ে দেন। আর তিনি আলীয়ার এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষিত মুসলিমদেরকে আলীয়ার দলে ভিড়াতে থাকেন। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে তার এই জেল জীবন তাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলে এবং তিনি সকলের মাঝে একজন স্কলার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর জনগণ তাকে একজন মহান নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বসনিয়া হেরসেক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেগবান করেন।

রাজনৈতিক জীবন:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ যখন জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘণ্টা বেজে গিয়েছিলো। যুগোস্লাভিয়াতে স্বাধীনতা সংগ্রাম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। অপরদিকে ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোও একে একে স্বাধীনতার দিকে আগাতে থাকে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাতে তার নেতৃত্বে Democratic Action Party (SDA) নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে এবং আলীয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথম বার নির্বাচন করেই তার দল সরকার গঠন করে এবং পার্লামেন্টে ৮৬টি আসন লাভ করে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম:
১৯৯০ দশকের দিকে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশন স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফেডারেশন এর ৬টি দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ১ মার্চ ১৯৯২ সালের এক রেফারেনডামের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কারণ শতকরা ৬২% জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সার্বিয়া বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা করে মুসলিম নিধনের নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একই ফেডারেশনের দেশ ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাধুবাদ জানালেও মুসলিমদের দেশ বসনিয়া হেরসেক- এর উপর সার্বিয়ার হামলাকে সাধুবাদ জানায়। বসনিয়া হেরসেক-এর দুর্দশায় নতুন মাত্রা যোগ করে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী দেশ যুগোস্লাভিয়া। তারা সার্বিয়ার এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানিয়ে তাদেরকে সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি ছাড়া এ সময় কোনো মুসলিম দেশ নির্যাতিত বসনিয়ান মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহর শত্রুপক্ষ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসনে তারা লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে তারা ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত বিভিন্ন স্থাপনা ও মসজিদসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতা খুব একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। কারণ একথা সত্য যে, বাতিলরা কখনো মুখের কথায় তাদের জুলুম বন্ধ করে না। তাদের জুলুমকে বন্ধ করার জন্য তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং তারা কেবলমাত্র শক্তিকেই ভয় করে। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজারে। সব মিলিয়ে ১ মিলিয়ন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময়ে বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ। এই ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি তার নেতৃত্বের অসীম গুণাবলী দ্বারা ও সাহসিকতার সাথে তার দেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তার জাতিকে একত্রিত করে সার্বিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

ডেটন চুক্তি:
বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলিমদের এই সংগ্রামে বিশ্বের মুসলিমগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুবকগণ বসনিয়ার মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সংগ্রাম ও জিহাদের পাশাপাশি বসনিয়ান মুসলিমদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। তিনি তুরস্ক থেকে হাজার হাজার যুবক পাঠান বসনিয় মুসলিম ভাইদের সাহায্য করার জন্য। তার সম্পদের বিশাল এক অংশ দিয়ে বসনিয়ায় গড়ে তুলেন অস্ত্রাগার। OIC-ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে বসনিয় মুসলিমদের সাহায্যার্থে ভঙ্গ করেন জাতিসংঘের সকল চুক্তিকে। ইরানকে সাথে নিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের। এরবাকান তৎকালীন তুরস্ক সরকারকে বাধ্য করেন বসনিয় মুসলিমদের সাহায্য করতে। আর এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্বিয়াকে তাদের এক তরফা সমর্থন দিতে থাকে। তারা সার্বিয়ার সাথে চুক্তি করার জন্য বসনিয়াকে চাপ দিতে থাকে। পরবর্তীতে আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কারণ তিনি তাতে রাজি না হলে এই অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র বসনিয়ানরা আরও হত্যার শিকার হতো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তিতে বসনিয়া পায় ৫১% ভূমি আর ক্রোয়েশিয়াকে দেওয়া হয় ৪৯% ভূমি। এবং বিভিন্ন অসম চুক্তিতে বসনিয়াকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।

মৃত্যু:
এই মহান মানুষটি ১৯ অক্টোবর ২০০৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান মহান মনিবের দরবারে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top