সৃষ্টির প্রথম মানবযুগল আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) থেকে শুরু করে যুগে যুগে নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে সুমহান বার্তা, খিলাফত ও ইমারতের দায়িত্ব অর্পণের মাধ্যমে নারী-পুরুষ উভয়কে আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদায় আসীন করেছে যে ইলাহী নূর, তার নাম ইসলাম। ইসলামে মর্যাদার দিক দিয়ে পুরুষের থেকে একজন নারীকে কখনোই ভিন্ন করে দেখা হয়নি। বরং নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় এবং সম্মানের সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। অন্যান্য ধর্ম ও সভ্যতা যেখানে নারী-শিক্ষার কোনো অধিকারই স্বীকার করেনি, ইসলাম সেখানে নারীশিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। তথাকথিত আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বও যেখানে নারীশিক্ষাকে ঘৃণার চোখে দেখতো প্রথমদিকে, তার বিপরীতে ইসলাম একেবারে শুরু থেকেই নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য শিক্ষার সমান অধিকার ঘোষণা করে এসেছে। ইসলামের আগমনেই নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত নারী সমাজ পেয়েছে মুক্তির সন্ধান।
ইতিহাসের নানা পটভূমিকায় সামাজিক জীবনে মুসলিম নারীদের পদচারণা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ছিলো। ইসলামী সভ্যতায় সামাজিক জীবনে নারীদের অবস্থান কেমন ছিলো, তা নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে প্রাক- ইসলামী যুগের বিভিন্ন সভ্যতায় নারীদের সামাজিক অবস্থান কেমন ছিলো তা নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসি। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, নারীদের অবস্থান সমসময় পুরুষের নিচে ছিলো। নারীদেরকে পুরুষদের তুলনায় একধাপ নিচে গণনা করা হতো।
এশিয়া মহাদেশের ইতিহাস পর্যবেক্ষণে প্রাচীন চীন সভ্যতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন নারীদের সামাজিক অবস্থা কতটা করুণ ছিলো। নারীকে একটি আলাদা সত্তা হিসেবে মূল্য দেওয়া হতো না। ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো না বলে তাদের নামও দেয়া হতো না। চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের মতে, পুরুষদের ওপরে নারীদের কোনো কর্তৃত্ব বা অধিকার থাকতে পারে না। কারণ নারীরা যদি পুরুষের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়, তা অপকার বয়ে আনবে। পরিবারে একজন নারীর মর্যাদা ছিলো দাসীর সমতুল্য। ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রও অনেকটাই এমন ছিলো। প্রাচীন ভারতে নারীদেরকে দুর্যোগ বা অশুভ কিছুর চিহ্ন হিসেবে দেখা হতো। হিন্দুসমাজের ‘সতীদাহ’ প্রথা প্রমাণ করে দেয়, নারীর অবস্থা সেখানে কতটা করুণ। পারস্য এবং রোমান সভ্যতায় বিতর্ক হতো নারীরা মানুষ কিনা, তা নিয়ে। নারীকে মনে করা হতো সকল অনিষ্টের মূল এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মে নারীকে অভিশপ্ত মনে করা হতো, ক্ষেত্রবিশেষে এখনও হয়। নারীর দেহে রূহ আছে কি-না, এ নিয়েও ছিলো তুমুল তর্ক-বিতর্ক। ইহুদিদের সাহিত্যে প্রচলিত আছে যে, তারা ঘুম থেকে উঠে তাদের রবের প্রতি শুকরিয়া আদায় করতো কারণ তিনি তাদেরকে নারী হিসেবে সৃষ্টি না করে পুরুষরূপে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ইহুদি ধর্মে নারীদের ঘরের বাইরে যাওয়া পর্যন্ত নিষেধ। শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজকর্মেই তাদের আবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সমগ্র ভরণপোষণ পুরুষের দায়িত্ব বিধায় শুধুমাত্র পুরুষই ঘরের বাইরে অবাধে বিচরণ করতে পারবে। সম্পূর্ণ স্বাধীনতার সাথে কাজ করতে পারবে। কিন্তু নারী তো আলাদা কোনো সত্তা নয়, তার জন্মই যেন হয়েছে শুধু পুরুষের সেবা করার জন্য। এমনকি নারীরা ধর্মীয় কাজ বা অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণের জন্যও বাইরে যেতে পারবে না। যদি বা যায়ও তবে এমন জায়গায় অবস্থান করবে যেখানে তাদের অবস্থান পুরুষের সমতুল্য না দেখায়। ক্যাথলিক খ্রিস্টানরীতি অনুযায়ী নারীদের সাথে এক সভায় বসে এক টেবিলে খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ এবং এটি এখনও বহুল প্রচলিত। খ্রিস্টান থিওলজিতে হযরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)- কে নিয়ে যেভাবে ঘটনা বিবৃত করা হয়েছে সেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, সম্পূর্ণ দোষ হযরত হাওয়া (আ.) এর উপর বর্তানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে মূলত, তিনিই হযরত আদম (আ.)-কে নিষিদ্ধ ফল খেতে প্ররোচিত করেন। আর একারণেই আল্লাহ তায়ালা হাওয়া (আ.)- কে শাস্তিস্বরূপ প্রতিমাসে মাসিকের যন্ত্রণা ও সন্তান প্রসবের মতো কষ্টকর যাতনা দান করেছেন।
ইউরোপিয়ান সভ্যতা- যারা নিজেদেরকে আজ সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে জাহির করতে চায়, জোরপূর্বক এ দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সেই তথাকথিত আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বের নারীরাও নিগ্রহ-নির্যাতনের স্বীকার হয়ে এসেছে এতকাল। আর এখন পণ্যরূপে তাদেরকে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। মুখেই শুধু স্বাধীনতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের অস্তিত্বকে নষ্ট করা হচ্ছে। আমাদের সমাজে এখনও এসব ভ্রান্ত ধারণা বহুল প্রচলিত- যার সংক্ষিপ্ত ভূমিকা শেষে আলোচনা করবো। এখন আসি, সেই সোনালী গৌরবময় মুসলিম সভ্যতায় নারীদের অংশগ্রহণ কেমন ছিলো।
মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণতা দান করলাম। তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করলাম।” এর মাধ্যমে আল্লাহ ইসলামকে পরিপূর্ণতা দান করেছেন। ইসলাম সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ও পরিবর্ধনের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। নারী ইস্যুতে ইসলামের আগমনের পর আরব সংস্কৃতিতে নারীদের ব্যাপারে যে সকল প্রথা প্রচলিত ছিলো, সেগুলোর কোনোটাকে সংস্কার করেছে, কোনোটাকে পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার পন্থা বেছে নিয়েছে।
ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি একজন নারী। হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর ওহী প্রাপ্তির পর বিবি খাদিজাই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজন সকলের তোপের মুখে পড়েও নারীরা তৎকালীন সময়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। শত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিন্দুমাত্র পিছু হটেননি। অটল-অবিচল থেকেই সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। রাসূল (স.) এর হিজরতের পূর্বে যে বাইয়াত সংঘটিত হয় সেখানে পুরুষ সাহাবীদের পাশাপাশি নারী সাহাবীরাও বাইয়াতে যোগ দেন এবং তারা সেখানে পুরুষের ন্যায়ই সরব ছিলেন। ঠিক এভাবেই সকল সংগ্রামে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরাও সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করে আমরণ সংগ্রামের অংশীদারিত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
আল্লাহর রাসূল (স.) যে সকল ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো নারীদের ক্ষেত্রে আনিত বিপ্লব। আল্লাহর রাসূল নারীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে সব সময় সুন্দর আচরণ করেছেন এবং তাদেরকে কখনোই কঠোরতা প্রদর্শন করেননি। এ মূলনীতি অনুসরণ করার জন্য তিনি পুরুষদেরকে সবসময় সতর্ক করেছেন। আল্লাহর রাসূল নারীদের ক্ষেত্রে এ অবস্থান গ্রহণ করার ফলে নারীরা সেসময়ে দৈনন্দিন জীবনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তারা মসজিদে নামাজ আদায় করতে যেতেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। একইভাবে যখন প্রয়োজন হতো, তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। জাহেলি যুগে নারীদের অঙ্গপ্রদর্শনের যে বিষয়টি ছিলো, সেটিকে বাতিল করে ইসলামের শালীনতা-লজ্জাশীলতাকে সামনে এনে পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ইতিহাস বিশ্লেষন করলে দেখি, নববী যুগের পরে সাহাবী এবং তাবেয়িদের সময়ে নারীদের যে প্রাপ্য অধিকার তা ধীরে ধীরে হাতছাড়া হতে থাকে। আর এ বিষয়টি ত্বরান্বিত করে আল্লাহর রাসূলের ওফাত, কেননা আল্লাহর রাসূল না থাকার অর্থ হচ্ছে ওহীও আর আসেনি বা ওহীর আসার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, একটি হাদীস এ চিত্র আমাদের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরে। তিনি বলেন,
“আল্লাহর রাসূলের ওফাতের পূর্বে আমরা নারীদেরকে কখনোই গালিগালাজ করতাম না, প্রহার করতাম না- এই ভয়ে যে, আমাদের উপর কোনো আয়াত নাজিল হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর রাসূল মৃত্যুবরণ করার পর আমরা আমাদের আগের অভ্যাসে ফিরে যাই।”
হযরত ওমর (রা.) সব সময় সরাসরি বলতেন যে, তিনি নারীদের মসজিদে যাওয়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু তারপরও নারীরা মসজিদে যেতেন, এমনকি ওমর (রা.)-কে যখন শহীদ করা হয়, তার স্ত্রী আতিয়া তখন মসজিদে ছিলেন। এ বিষয়টি দেখায় যে, নারীরা ধীরে ধীরে তাদের অধিকার হারিয়ে ফেলে। যেহেতু সেটি খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ ছিলো, সেখানে সামান্য কিছু সমস্যা হলেও সে সময় নারীরা খুব বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। আল্লাহর রাসূল কর্তৃক যে অধিকার দেয়া হয়েছিলো, সেটি পালন করতে এবং সে আলোকে তাদের জীবনধারাকে অতিবাহিত করতে পেরেছিলো। কিন্তু চার খলিফার পরে বিশেষ করে উমাইয়া এবং আব্বাসীয়দের সময়ে নারীদের সামাজিক অবস্থান আস্তে আস্তে নিচে নামতে থাকে। এ সময়ে নারীরা গৃহস্থালির কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে এখানে একটি বিশেষ ব্যপার আছে যেটি আমাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে, বিশেষ করে যারা স্বাধীন এবং ধনী নারী ছিলেন, তারা নিজেদের অধিকার জানার কারণে ব্যতিক্রম একটি ধারা তৈরি করেন। এক্ষেত্রে ইসলাম প্রদত্ত জীবনধারাকে ধারণ করে তারা তাদের জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। এ সময়ে যারা সুলতানের স্ত্রী বা মেয়ে ছিলেন তারা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব রাখেন এবং বিভিন্ন ঘটনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। উমাইয়া শাসনামলে বিভিন্ন বিজয়াভিযানের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ভূমি বিজয় করতে থাকে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় শহরের সৃষ্টি হয়; যেখানে নারীরা সামাজিক জীবন থেকে ধীরে ধীরে গৃহের জীবন এবং গৃহস্থালির কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের কিছুটা পার্থক্য হলো- গ্রামের নারীরা গরু-বাছুর পালন ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতো।
আমাদের রাসূল (স.) সবসময় নারীদের যথাযোগ্য সম্মান করেছেন এবং তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করেছেন। কখনোই তাদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করেননি; বরং সকলকে এ সম্পর্কে সতর্ক করে গিয়েছেন। মূলত পয়গাম্বর রাসূল (স.)-এর হাত ধরেই নারীদের সম্মানের পুনঃবিনির্মাণ ঘটে। নারীর সেই মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ওমর (রা.) এর ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর বলেছিলেন, তারা তাদের স্ত্রী-কন্যাকে গালি দিতে বা প্রহার করতেও ভয় পেতেন, যদি আল্লাহর তরফ থেকে কোনো আয়াত নাজিল হয়ে যায়। কিন্তু রাসূল (স.) এর মৃত্যুর পর কালক্রমে নারীরা আবারও তাদের অধিকার ও সম্মান থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। মূলত উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের সময় থেকে নারীদের সামাজিক অবস্থানের ধীরে ধীরে অবনতি ঘটতে থাকে।
ইসলাম মধ্যপ্রাচ্যকে পরিগ্রহ করার পর মুসলমান নারীদের জীবনে এক ধরনের ভিন্নতা আসে। আমি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন সংস্কৃতির আলোকে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই। এ সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের ইসলাম গ্রহণ করা বা ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। নারীদের ব্যাপারে ইসলামের যে ধারণা এটি তুর্কিদের সংস্কৃতির সাথে মিলে যায় এবং অন্য জাতির সাথে তাদের ভিন্নতা ছিলো যে তারা নারী-পুরুষকে সমান চোখে দেখতো। যেমন সেলজুক রাষ্ট্র এর মধ্যে অন্যতম একটি উদাহরণ।
তুরস্কের সেলজুক ও মামলুকি রাষ্ট্র এবং উসমানীয় খেলাফত ইসলামী জীবনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলো। সেসময় নারীদেরকে পুরুষদের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তারা লেখাপড়ার পাশাপাশি পুরুষদের ন্যায় বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়ে সমাজ গঠনে অভাবনীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। তুরস্কের হাত ধরেই মূলত মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী বিপ্লবের সূচনা ঘটে। ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব অঙ্গনেই নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত পদচিহ্ন রাখতে দেখা যায়।
উসমানী খেলাফতের শুরুর দিককার সময়ে মুসলমান নারীরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। এ সময়ে সুলতানের মেয়েরা বা মায়েরা রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, বিভিন্ন সময়ে সুলতানদের ব্যর্থতায় নারীরা দায়িত্ব পালন করেছিলো। তখনকার সময়ে শহরের নারীদের চাইতে গ্রামের নারীরা বেশি স্বাধীন ছিলো। একজন পুরুষ একইসাথে চাষাবাদ করবে, আবার ফসল তুলে আনবে, আবার অন্যান্য কাজ করবে, এটি সম্ভব নয়। তাই পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এসব কাজ করতো। আবার উসমানীয়দের সময়ে কাজের ক্ষেত্রে নারীরা একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা লাভ করে এবং তাদের কার্যক্রম আরও বেশি বৃদ্ধি করে। এ সময়ে নারীগণ শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়, বিভিন্ন উচ্চতর প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষা লাভ করেন। বিভিন্ন নারী সংগঠন, নারী কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিন এ সময়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুসলমান নারীগণ এ সময়ে আরও অনেক পেশায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে শুরু করে। যেমন – শিক্ষক, ব্যবসায়ী, নার্স, গাইনী, সুরকার, লেখক, সাংবাদিক ইত্যাদি।
কালানুক্রমিকভাবে দেখলে, মামলুকি রাষ্ট্রটি ইসলামী রাষ্ট্র ছিলো। নারীদের ব্যাপারে তাদের অনুশীলনের মাঝে ভিন্নতা দেখতে পাই। সে সময়ের গ্রাম বা শহরের নারীদের ব্যাপারেখুব একটি তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও রাজপ্রাসাদ বা রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোর ক্ষেত্রে নারীগণ খুব সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। সুলতানদের স্ত্রী এবং মেয়েরা রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ও ভূমিকা রাখতে পেরেছে। তবে এ সময় নেতিবাচক কিছু কার্যক্রম প্রসারিত হয়েছে। সুলতান বাইবার্সের শাসনামলে এক কঠিন মহামারির আবির্ভাব দেখা দেয়। এবং তৎকালীন আলেমগণ ফতোয়া দেন যে, নারীদের অবাধ চলাফেরা, অশালীন আচরণ ও বেহায়াপনাই এ দুর্যোগের একমাত্র প্রধান কারণ। তখন সুলতান বাইবার্স বাধ্য হয়ে নারীদের রাস্তায় বের হওয়া নিষিদ্ধ করে দেন।
আন্দালুসিয়ার নারীরা তৎকালীন ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের তুলনায় জ্ঞান ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ ছিলো। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সবাই আন্দালুসিয়ায় জ্ঞান অন্বেষণের হেতু ছুটে আসতো। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, সেখানকার নারীগণ জ্ঞান, রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে আলাদা একটি শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলো। তারা বিবাহ, ডিভোর্স, জ্ঞান ও সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের নারীদের তুলনায় অগ্রগামী ছিলেন। আন্দালুসিয়ার মুসলিম নারীরা সে সময়কার ইউরোপীয় খ্রিস্টান নারীদের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রগামী ছিলো। আন্দালুসিয়ায় তখন সংস্কৃতি ছিলো যে, বিয়ের পূর্বে নারীরা কোরআন হিফজ সম্পন্ন করতো, ইমাম মালিকের মুয়াত্তার বড় একটি অংশ মুখস্থ করতো। আন্দালুসিয়ার জ্ঞানগত মর্যাদা এতটাই উচ্চ ছিলো যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার মানুষ এখানে আসতো জ্ঞান অর্জন করতে এবং এখানকার পরিবেশ থেকে উপকৃত হতে।
আধুনিক সময়ে এসে মুসলমান নারীগণ পাবলিক প্লেসে আরেকটু বেশি অধিকার লাভ করেছে এবং তাদের দৃশ্যমান ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা ম্যাগাজিন, বিভিন্ন বই পুস্তক, পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি মাধ্যমে তাদের চিন্তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ সময়ে এসে নারীদেরকে আগের বিভিন্ন সংজ্ঞায়নের মধ্য দিয়ে পরিচিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। নারীদেরকে কীভাবে তাদের প্রাপ্য অধিকার দেওয়া যায় এটি নিয়ে আলোচনা করার পরিবর্তে বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়গুলো যেমন নারীদেরকে সাক্ষ্য দানের বিষয়, বিবাহের বিষয়, অল্প বয়সে মেয়েদেরকে বিবাহ দেওয়ার বিষয় এবং আঞ্চলিক যে বিষয়গুলো, এছাড়া মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারবে কিনা এ ধরনের বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে, সমাধানের পরিবর্তে। এ সকল সমস্যা ইসলামের মধ্যে সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়; বরং প্রাচ্য থেকে কিংবা পাশ্চাত্য থেকে হোক ঐ সময় ও সমাজের ঐতিহ্যগত বিভিন্ন সমস্যার সাথে সম্পৃক্ত করে এগুলো দেখানো হয়েছে। এছাড়া এগুলোর সাথে ইসলামের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। একইভাবে আমরা যদি দেখি মুসলিম নারীগণ রাজনৈতিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে নয়; বরং ইতিহাসের বিভিন্ন গতিধারায় জ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন বিভিন্ন সময়। কিন্তু নারীদের এ অবদানটাকে সাহিত্যে খুব বেশি জায়গা দেওয়া হয়নি। আমার মতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরুষগণ বেশি প্রভাবশালী থাকার কারণে নারীদেরকে তারা বেশি জায়গা দেয়নি। আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, নারীদের সামাজিক জীবনে সক্রিয় না হওয়া। তবে সাহিত্যে নারীদের নাম থাকুক আর না থাকুক এর মানে এ নয় যে ইসলামী সমাজে ও সভ্যতায় নারীদের অবদান ছিলো না। বরং আমরা যদি ইসলামের সামগ্রিক ব্যাখ্যা করি তাহলে দেখতে পাই যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের ভূমিকা ছিলো এবং তারা এক্ষেত্রে অনেক বড় বড় অবদান রেখেছেন। অতীতে লিখিত না হলেও অনেক ডকুমেন্ট আছে যেগুলো দিয়ে ইসলামে নারীদের যে অবদান এবং ভূমিকা এটি তুলে আনা সম্ভব এবং আমি মনে করি, এসব সোর্স থেকেও ডকুমেন্ট বা লিখিত আকারে এ বিষয়গুলো আপনারা তুলে আনতে পারেন।
আমি ইসলামে নারীদের অবদান কেমন ছিলো এ সম্পর্কে ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু ভারত উপমহাদেশের যে সভ্যতা সেখানে নারীদের ভূমিকা কেমন ছিলো এ ব্যাপারে আমি বেশি কিছু জানি না, কিন্তু আপনাদের এটি দায়িত্ব যে ভারত উপমহাদেশে নারীদের সামাজিক অবস্থা কেমন ছিলো তা নিয়ে গবেষণা করা।
যুগে যুগে নানান ফতোয়া পেশ করে, আল্লাহ-রাসূলের আদেশের ভুল ব্যাখ্যা, ভুল-ভাল ধর্মীয় বয়ানের মাধ্যমে ইসলামকে অন্যভাবে তুলে ধরে নারীদেরকে দাবিয়ে রাখার, পশ্চাদপদ করে রাখার অবিরাম চেষ্টা করে গেছে তথাকথিত আলেম ও মাওলানা সমাজ; যা আজও দ্রুতবেগে চলমান। তাই নারীরা আজও পুরুষের তুলনায় কয়েকগুণ পিছিয়ে রয়েছে। তাদেরকে পিছিয়ে রাখা হয়েছে, বলতে গেলে বাধ্য করা হয়েছে। নারীরা তাই তাদের অধিকার সম্পর্কে অনবগত। তাদের আত্মপরিচয় সম্পর্কে সন্দিহান ও বিভ্রান্ত। নারীকে হয় একেবারে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে, গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। নয়তো পণ্যরূপে দুনিয়ার সামনে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে। আর তাই তাদের আত্মবিশ্বাস আজ যেন সমাজের অবহেলায়-অনাচারের পদতলে প্রায় পিষ্ট।
ইসলাম নারীদের কতোটা মর্যাদা-সম্মান দিয়েছে, মূল্য দিয়েছে সেটিই ছিলো আমাদের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিভিন্ন সভ্যতায় নারীর অবস্থান কেমন ছিলো সে বিষয়েও আমরা আজ সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুস্পষ্ট একটি ধারণা পেলাম। আমরা সবাই মিলে বা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে চেষ্টা করবো এ বিষয়গুলো জানার। নিজেদের প্রকৃত অবস্থান, প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হলে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধেও জানতে হবে। আত্মপরিচয় উপলব্ধির প্রয়োজনে গবেষণা করতে হবে। এটি এখন আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আপনারা সবাই আশা করি আমার এ কাজে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ সাহায্য করার চেষ্টা করবেন, তবেই আমি কৃতার্থ থাকবো।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ