জ্ঞান ও সভ্যতা একটি অপরটির পরিপূরক। একটি ছাড়া অপরটির বিকাশ অকল্পনীয়। আমরা যদি ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সমূহের একটি হল মঙ্গোলদের আক্রমণ।
এই আক্রমণ আব্বাসী খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। মঙ্গোলদের আক্রমণের পর সমগ্র মানবতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় এবং জ্ঞানের কেন্দ্র হওয়ার মর্যাদার আসন থেকে ছিটকে পড়ে। এই আক্রমণের প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে আক্রমণের পরে আলেমদের একটি অংশ কিয়ামতের দিনক্ষণ গুণছিলেন আর দুনিয়ার সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়ে কিয়ামতের কয়টি আলামত প্রকাশ পেল আর কয়টি বাকি আছে সেটা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে এই সংক্রান্ত বই রচনা করছিলেন। তখন কোন বিষয়টি ইতিহাসের মোড়কে এই ভাবে ঘুরিয়ে দিয়ে আরও ৬০০ বছর সমগ্র দুনিয়ায় মুসলিম শাসনের বদৌলতে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করল?
এই বিষয় নিয়ে অনেক বড় বড় আলেমদেরকে প্রশ্ন করেছি, নিজে জানার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন মুতাফাক্কির উস্তাজ এবং গ্রহণযোগ্য বই পুস্তক পড়ে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে সেটা হল, জ্ঞানের পুনর্জাগরণই ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ এনে দিয়েছিল। সভ্যতা ও জ্ঞানের জাগরণ একে অপরের পরিপূরক। সভ্যতার পুনর্জাগরণ ছাড়া জ্ঞানের এবং জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ছাড়া সভ্যতার পুনর্জাগরণ সম্ভভ নয় । মঙ্গোলদের আক্রমনের পর থেকে নিয়ে উসমানী খিলাফতের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত প্রায় ২৫০ বছর যেন উম্মাহ জ্ঞানের ক্ষেত্রে নব উদ্যমে যাপিয়ে পড়েছিল।
এই কঠিন সময়ে মুসলমানগণ আলস্যে বসে না থেকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নতুন করে জ্ঞানের আন্দোলন শুরু করেন। এই সময়ে বলতে গেলে সমগ্র মুসলিম অঞ্চল সমূহে অসংখ্য মাদরাসা গড়ে উঠে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল; বাগদাদের আল মুসতানসিরিয়া মাদরাসা, কায়রো ও মিশরে কামিলিয়্যা মাদরাসা, কাহিরিয়্যা মাদরাসা, সালিহিয়্যা মাদরাসা মামলুকীদের সময়ে এই মাদরাসা সমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়। শামের যাহিরিয়্যা মাদরাসা, অনেকেই জানেন যে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হস্তলিখিত গ্রন্থাগারের একটি এই যাহিরিয়্যা লাইব্রেরী। বর্তমানে যে যাহিরিয়্যা লাইব্রেরী রয়েছে তা মূলত মাদরাসা ছিল, আইয়ুবীদের সময়ে এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদরাসা খুবই শক্তিশালী ধারার অধিকারী একটি মাদরাসা। সুলতানুল উলামা ইয বিন আব্দুস সালাম শামের এই যাহিরিয়্যা মাদরাসা এবং মিশরের সালিহিয়্যা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এই সকল বড় বড় মাদারাসা সমূহ মঙ্গোলদের আক্রনের পরে মুসলিম উম্মাহ যখন শতধা বিভক্ত এবং ছিন্ন ভিন্ন তখন প্রতিষ্ঠিত হয়।
জ্ঞানের এই সকল কেন্দ্রের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের মুতাফাক্কিরগণ মুসলিম উম্মাহ যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রচেষ্টা চালান। অর্থাৎ জ্ঞানই এই অবস্থা থেকে মুক্ত করতে পারে এই লক্ষ্যে আলেমগণ জ্ঞানের একটি নতুন আন্দোলন শুরু করেন। এই সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন অনেক দুর্বল ও গতিহীন হলেও ইলমী হায়াত তথা জ্ঞানগত জীবন ছিল অনেক প্রাণবন্ত ও গতিশীল।
আলেমদের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, ফখরুদ্দিন রাযি এই সময়ের, ইবনুল আসীর এই সময়ের, ইবনে কুদামা এই সময়ের, আমিদি এই সময়ের, শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ারদী এই সময়ের, ইবনে আরাবী (সুফি) এই সময়ের, ইবনে হাজার আসকালানী, ইবনে সালাহ, ইমাম নববী, ইবনে তাইমিয়া, ইয বিন আব্দুস সালাম সহ আরও জগৎবিখ্যাত অনেক আলেম ছিলেন এই সময়ের।
তুরস্কের স্কলারগণ এই সময়ের নাম দিয়েছেন নবায়নের সময়কাল। এই সময়ে বড় বড় আলেমগণ আসেন এবং তারা দ্বিতীয় ধাপের ক্ল্যাসিক রচনা শুরু করেন। যেমন;
* মাতুরিদি ধারার ক্ষেত্রে আবু মুইন আন নাসাফি মাতুরিদি ধারাকে নবায়ন করে নতুন ভাবে তুলে ধরেন,
*আশয়ারী ধারার ক্ষেত্রে ফখরুদ্দিন রাযি সব কিছুকে যেন নতুন করে বিন্যস্ত করে তুলেন।
*আকবরী ধারার ক্ষেত্রে সাদরেদ্দিন কনেবি সহ আরও অনেক বড় বড় মুতাফাক্কির, আলেম ও দার্শনিক কাজ করেন। তাদের তৈরি করা জ্ঞানই পরবর্তীতে মুসলিম উম্মাহর চিন্তাকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে।
আমার কাছে মনে হয়েছে দ্বিতীয় বড় সঙ্কটের পরে সৃষ্ট হওয়া জ্ঞানের এই আন্দোলন ও নেতৃত্বে থাকা বড় বড় আলেমগণই ইসলামী সভ্যতাকে ধারাবাহিকতা দান করে আরও ৬০০ বছর টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাদের রেখে যাওয়া মিরাসের উপরেই উসমানী খিলাফত তিন তিনটি মহাদেশে ইসলামের আদালত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।
শুধুমাত্র উসমানী খিলাফতই নয়, সাফাবি রাষ্ট্র এবং মোঘল সালতানাত এই মিরাসকে ধারণ করে এগিয়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত আমেরিকান ঐতিহাসিক, মার্শাল হাডসন বলেন;
“ষোড়শ শতাব্দীতে যদি কেউ মার্সে গিয়ে দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখত তাহলে সে একথা বলতে বাধ্য হত যে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে সমগ্র দুনিয়া ইসলামের ছায়াতলে আসবে”।
কারণ তখন এই বড় বড় তিনটি রাষ্ট্র জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং আদালতে এতটাই এগিয়ে গিয়েছিল যে দুনিয়ার সকল মানুষ তখন এই তিনটি রাষ্ট্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল। বর্তমানে আমরা যেমনটা অ্যামেরিকা ও ইউরোপকে নিয়েছি। সেই সময়ে মুসলমানরা যা বলত সেটাই ছিল গ্রহণযোগ্য!
কিন্তু যখন জ্ঞানের এই চর্চা স্তিমিত হয়ে পড়ে তখন মুসলমানদের মধ্যে চিন্তানায়ক ও গবেষকের আবির্ভাব যখন বন্ধ হয়ে গেলো, মুসলমানগণ যখন তাকলীদের রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষমতার পূজারী হয়ে বসল তখন আস্তে আস্তে তারা দুনিয়ার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়ে অনুসরনীয় হওয়ার পরিবর্তে অনুসরণকারী হয়ে গেল।
আজ মুসলিম উম্মাহর যে অবস্থা সেটা যেন মঙ্গোল পরবর্তী অবস্থার চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। বাইতুল মাকদিস আজ ইয়াহুদিদের দখলে, অর্থনীতিতে সুদভিত্তিক পুঁজিবাদ আজ মানবতাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, পাশ্চাত্যে বস্তুবাদী দর্শন আমাদের মস্তিষ্ককে করেছে বিকৃত!
অথচ যে ইসলাম সমগ্র মানবতাকে হক্ব ও আদালতের পথ দেখিয়ে মরক্কো থেকে মিন্দানাও, স্পেন থেকে খাজান ও ভলগা অঞ্চলকে কোরআনের আলোকে আলোকিত করেছিল সেই কোরআন তো এখনো আমাদের হাতে।
তাহলে কেন আমরা এখনো এত আত্মবিশ্বাসহীন!
এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের পথ কি? আমার মনে হয়েছে পথ একটাই জ্ঞানের আন্দোলন, যে আন্দোলন গড়ে তুলবে যুগের ফখরুদ্দিন রাযি, সোহরাওয়ারদী, ইয বিন আব্দুস সালাম, আমিদি সহ আরও বড় বড় চিন্তা নায়কদের। যারা পাশ্চাত্য সভ্যতার পূতিগন্ধময় দূষিত চিন্তা থেকে মানুষকে দূষণমুক্ত চিন্তার উপহার দিতে সক্ষম হবে। আর এই চিন্তার উপর ভিত্তি করে তৈরি হবে বসবাস যোগ্য নতুন একটি দুনিয়া।।



