ইকবালের চিন্তায় আত্মার পুনর্গঠন ও আধ্যাত্মিক উন্নতি

যদি কেউ ইসলামের প্রচলিত রূপের পুনর্গঠন করতে চায় যা ইতিহাসের পাতায় ইসলামকে পদদলিত করার জন্য তৈরি হয়েছে, এবং এটিকে এমনভাবে একত্রিত করে যাতে আত্মা একটি পূর্ণ দেহ ফিরে যায় এবং বর্তমান বিপন্ন উপাদানগুলোকে সেই আত্মারূপে রূপান্তর করতে পারে যাতে বিংশ শতাব্দীতে মৃত সমাজের উপর ইসরাফিলের ডঙ্কা বেজে উঠে এবং তার আন্দোলন, শক্তি ও আত্মাকে জাগিয়ে তোলে, তাহলে এমন আদর্শ মুসলিম ব্যক্তিত্বের পুনর্গঠন হবে যারা হবে আল্লামা ইকবালের প্রতিচ্ছবি।

আল্লামা ইকবাল কোনো রহস্যময় সাধক নন, যিনি শুধুমাত্র অতীন্দ্রিয়বাদ (অস্পষ্ট মতবাদ) কিংবা মারেফতের প্রতি উদ্বিগ্ন, যেমনটা ছিলেন ইমাম গাজ্জালী, মহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী, রুমী। তাঁরা ব্যক্তিগত পরিবর্তন, অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও আভ্যন্তরীণ সত্তার আলোকিতকরণ কে গুরুত্ব দিতেন। তারা কেবল নিজেদের মত অল্পসংখ্যক মানুষকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তোলেন। কিন্তু মোঙ্গল আক্রমণ এবং পরবর্তী স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার প্রতি অনেকটা অসচেতন ভূমিকায় থেকে বাইরের জগতের প্রতি অনেকাংশেই গুরুত্বহীন ছিলেন।

ইকবাল এমনকি আবু মুসলিম, হাসান সাবাহ, সালাহউদ্দীন আইয়্যুবীদের মত ছিলেন না যাদের জীবন তরবারি, ক্ষমতা, যুদ্ধ, সংগ্রাম নির্ভর ছিল। ছিলেন না তাদের মতো, যারা ভাবতেন, মানুষের মন ও সামাজিক সম্পর্কের সংস্কার সাধনের জন্য বা বিপ্লবের প্রতি অনুপ্রাণিত করার জন্য ক্ষমতার প্রয়োগ ও শত্রুকে পরাজিতকরণই যথেষ্ট।

ইকবাল সেসব ভারতীয় পন্ডিতদের সমসাময়িক ছিলেননা যেমন ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। যিনি মনে করতেন পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, আধুনিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ বয়ান অথবা বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যা, ইসলামী মতবাদ, কোরআনের আয়াত এবং গভীর দার্শনিক পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার মাধ্যমে ইসলামী সমাজের পুনর্গঠন সম্ভব (যদিও তা কোন ব্রিটিশ রাজার শাসনাধীন হয়)।

ইকবাল ঐসকল পাশ্চাত্য অনুগামী লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না যারা মনে করতো, মানবতার মুক্তি, ক্রমবিকাশ এবং দুঃখ-দুর্দশার প্রতিষেধক হিসাবে বিজ্ঞানই যথেষ্ট। তিনি ঐসকল দার্শনিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না যারা মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদা পূর্ণ করাকেই সর্বপ্রধাণ কাজ মনে করতো। তিনি এমনকি তার এমনসব স্বদেশবাসী হিন্দু বা বৌদ্ধ চিন্তাবিদদের মতো ছিলেন না, যারা মনের প্রশান্তি এবং আধ্যাত্মিক পরিত্রাণকে পুনর্জন্ম হিসাবে বিবেচনা করতো। অথবা যারা কান্না থেকে স্বর্গে গমনের প্রক্রিয়াকেই মানবতার মিশনের পরিপূর্ণতা বলে মনে করতো। আবার তারা মনে করতো, যে সমাজে একজন ক্ষুধার্ত মানুষ, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, মর্যাদাহানি বিদ্যমান সেখানেও খাঁটি, শৃঙ্খলিত, উন্নত মস্তিষ্কসম্পন্ন, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ তৈরি হওয়া সম্ভব!

না। ইকবাল তাঁর ইসলাম সম্পর্কিত চিন্তা ও দর্শন দ্বারাই এসব প্রকাশ করেছেন, যখন পৃথিবীর প্রতি এবং মানবসমাজের প্রয়োজনাদির প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া মানবসমাজকে একটি বিশাল হৃদয় উপহার দিয়ে গেছেন যা তিনি নিজেই বলেছেন

“উদয় থেকে ভোরে আমি জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ধাপগুলো খুঁজে পাই আকুলতা আর ধ্যানের মাঝে” 

তিনি একজন বড় রহস্যময় সাধক এবং জড়তা থেকে নিষ্কৃত একজন পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী। একইসাথে তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং  বর্তমান যুগের মানবীয় আকলের অগ্রগতিকে সম্মান করেন। তিনি এমন কোন চিন্তাবিদ নন যিনি সুফীবাদ, খৃষ্টানী মতবাদ, লাও যূ’র ধর্ম বা বৌদ্ধদের থেকে প্রাপ্ত আবেগ বশত বিজ্ঞান, আকল, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে অবমূল্যায়ন করেছেন। তিনি ফ্রান্সিস বেকন বা ক্লদ বার্নার্ড এর মতো কোন শুষ্ক বিজ্ঞানের প্রবক্তা ছিলেন না যারা শুধু ঘটনা বা বস্তুগত প্রতিবিম্বের মধ্যকার সম্পর্কের উদ্ভাবন এবং পার্থিব জীবনের জন্য প্রাকৃতিক শক্তি নিয়েই সীমাবদ্ধ।

একইসাথে তিনি এমন চিন্তাবিদ ছিলেন না যিনি বিজ্ঞান, দর্শন, উদ্ভাসন, ধর্ম, উদঘাটনকে অন্যান্যদের মতো একত্রে বেমানানভাবে চর্চা করেছেন। বরং বিশ্বের বুকে তার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, তিনি বিজ্ঞান ও আকলকে গভীর অনুভূতি দিয়ে বিবেচনা করতেন; মানবাত্মার বিকাশে যাদেরকে ভালোবাসা, আবেগ এবং অনুপ্রেরণার মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তিনি তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করেননি।

মানবজাতির প্রতি আল্লামা ইকবালের সবচেয়ে বড় উপদেশ- “যিশুখ্রিস্টের মতো হৃদয়ের অধিকারী হও, সক্রেটিসের মতো চিন্তার অধিকারী হও, সীজারের  মতো হাত শক্ত কর কিন্তু সবকিছু মিলে যেন একটা মানবসমাজ হয়”। লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট মূলনীতির উপর নির্ভর করে একক মানব সমাজ সৃষ্ট হবে। যা ইকবাল নিজেই; তিনি এমন একজন মানুষ যিনি তার সময়ের রাজনৈতিক জ্ঞানের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছেন। এমনকি অনেকে বিশ্বাস করতো তিনি প্রধানত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনচেতা, জাতীয়তাবাদী নেতা যিনি বিশ শতকের একজন উপনিবেশ  বিরোধী। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি দার্শনিক চিন্তাশক্তির দ্বারা এত উঁচুতে আরোহণ করেছেন যে তাকে পাশ্চাত্যের বার্গস অথবা ইসলামের ইতিহাসের ইমাম গাজ্জালীর সমতুল্য  বর্তমান সময়ের একজন দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

একই সময়ে তিনি এমন একজন মানুষ যাকে ইসলামী সমাজের সংস্কারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ইসলামী সমাজব্যবস্থা এবং মানবজাতির অবস্থা নিয়ে চিন্তা করতেন। এমন সমাজে তিনি বাস করতেন যেখানকার মুসলমানদের মুক্তির জন্য, সচেতনতার জন্য, স্বাধীনতার জন্য তিনি জিহাদ করে গেছেন।

ইকবাল ইউরোপে গিয়েছেন, দার্শনিক হয়েছেন। তিনি ইউরোপের দর্শনের স্কুল সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তাদেরকে অন্যদের সম্পর্কে অবগত করেন। সবাই তাকে বিংশ শতাব্দীর দার্শনিক হিসেবে গণ্য করেন কিন্তু তিনি কখনও পশ্চিমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। বিপরীতে তিনি ইউরোপ জয় করে এসেছেন। তিনি ব্যতিক্রম চিন্তার অধিকারী ছিলেন এবং পশ্চিমা সভ্যতায় পাওয়ার অব চয়েজ লালন করতেন। তিনি মাওলানা রুমীর অনুরাগী এবং ভক্ত ছিলেন যা খাঁটি ইসলামী মননের সাথে অসামঞ্জস্য বা বিপরীত ছিলনা।

সুফীবাদ বলে, যেহেতু আমাদের ভাগ্য আমাদের অনুপস্থিতিতে পূর্বনির্ধারিত, যদি এটা তোমাদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী না হয় তাহলে অভিযোগ করোনা। অথবা, যদি পৃথিবী তোমার কাজে সম্মতি না দেয় তবে তুমি পৃথিবীর সম্মতিতে সব করো।

কিন্তু ইকবাল বলেছেন-

“যদি পৃথিবী তোমার কাজে সম্মতি না দেয় তবে তুমি এটার বিপরীতে চলো”।

এখানে পৃথিবী বলতে মানুষের জীবন এবং গন্তব্যস্থলকে বুঝানো হয়েছে। মানবজাতি হচ্ছে তরঙ্গের মতো, কোন বদ্ধ জমি নয়। মানুষের জীবনাচরণ এবং উত্থান সবই হচ্ছে আন্দোলন।

আমি কি বুঝাতে চেয়েছি? এটা পুরোটাই হচ্ছে আন্দোলন। ইকবালের অতীন্দ্রিয়বাদ হিন্দুত্ববাদের অস্পষ্টতা বা ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়। এটা ছিল কুরআনের অতীন্দ্রিয়বাদ, মানবজাতি অবশ্যই পুরো বিশ্ব পরিবর্তন করবে।

জীবনের দর্শন, জীবনের মূলনীতি, মানবতাবাদ এবং উদার বুদ্ধিজীবীরা ধর্মের বিরুদ্ধে সমান এবং অব্যাহতভাবে যে বৃহত্তর সমালোচনা করেছেন তা হলো, যেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাসকে পরম স্থিরতাবাদ/নিয়তিবাদ বা স্বর্গীয় সত্তার  উপর প্রতিষ্ঠিত বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সেহেতু মানুষের ইচ্ছার পরম পরাধীনতা মানুষের নিরঙ্কুশ পছন্দের জায়গায় দুর্বল হওয়ার দরুন যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা হয়েছে। যদি এটি সত্য হয়, তাহলে এটি অপমানজনক হবে। এটি দাসত্ব, ক্ষমতা, স্বাধীনতা এবং দায়িত্ব অবহেলার একটি উপায় হবে। এটি স্থিতাবস্থার কাছে জমা দেওয়া, “যা কিছু হবার, তা হবেই” এই পৃথিবীতে মানুষের উপর চাপানো যে কোনও ভাগ্যকে গ্রহণ করা এবং জীবনের নিরর্থকতা এবং অসারতা স্বীকার করতে হবে।

যেমন অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ঘটনা ভাগ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে এবং অব্যাহত থাকবে, এই দৃষ্টিতে, তখন যে কোনও সমালোচনা বা আপত্তি, বা আমাদের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা অর্জন করার বা পরিস্থিতি পরিবর্তনের প্রচেষ্টা অবশ্যই বশীভূত হতে হবে “আমাদের জন্য যা পূর্ব নির্ধারিত ছিল।” এইভাবে, মানুষের স্থিতাবস্থা পরিবর্তন, রূপান্তর এবং সংশোধন করার ক্ষমতা অসম্ভব, অযৌক্তিক এবং অসুস্থ পরামর্শদাতায় পরিণত হয়।

ইসলামী দর্শনে যদিও একমাত্র আল্লাহরই পরাক্রমশালী ক্ষমতা রয়েছে, বিশ্বজগতের সৃষ্টি, নির্দেশনা, উপযোগিতা, নিয়ন্ত্রণ তার হাতে রয়েছে “সৃষ্টি যারা হুকুম তার” (৭:৫৪)।

তবুও একইসাথে মানবকে এই বিস্তৃত মহাবিশ্বে এমনভাবে বিবেচনা করা হয় যে যখন কেউ নিজেকে আল্লাহর শাসন এবং সার্বভৌমত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পারে, তবুও সে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে।

একজন মুসলিমের স্বাধীন ইচ্ছা এবং বিদ্রোহ ও আত্মসমর্পণের ক্ষমতা রয়েছে। সুতরাং, ব্যক্তি তার কর্মের জন্য দায়ী এবং তার নিজের ব্যক্তিসত্ত্বার প্রস্তুতকারক। “প্রত্যেক ব্যক্তিই তার কৃতকর্মের কাছে দায়বদ্ধ” (৭৪:৩৮)। “এবং মানুষ যে চেষ্টা সাধনা করে, তাছাড়া তার আর কিছুই প্রাপ্য নেই” (৫৩:৩৯)।

কোরআনের সাথে তার এমন আধ্যাত্মিক আলাপে ইকবাল এই মূলনীতি অর্জন করেছেন যে, কাজের সত্যতা এবং মানবজাতির প্রতি যে মানবিক দায়িত্ববোধ, যেখানে বস্তুবাদী বা মৌলবাদীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন মানবতাকে সাহায্য করার জন্য ধর্ম এবং প্রভুকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে।

এইসব মানুষেরা প্রকৃত অর্থে ধর্ম এবং প্রভুকে দেখেন মানবজাতির চিন্তার মাধ্যমে। যা মানবমুক্তি, শ্রদ্ধা, সত্যতা, এবং দায়িত্ববোধের সাথে বেমানান। যেখানে ইসলাম কোন দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা ছাড়া পরিষ্কারভাবে ঘোষণা দিচ্ছে যে, “সেদিন মানুষ দেখতে পাবে যে, তার দুই হাত তখন কি পাঠিয়েছিল” (৭৮:৪০)।

তার আখলাক, বিশ্বাসের প্রখরতা এবং ইসলামের প্রতি আধ্যাত্মিকতা দিয়ে তিনি তাঁর সময়ের সকল দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক পর্যায় অতিক্রম করেছিলেন। এটা বলা যেতে পারে যে, তিনি একজন মুসলিম অভিবাসী যিনি ভারত মহাসাগরের গভীর থেকে ঐশ্বর্যশালী ইউরোপের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে অবস্থান করেননি। তিনি আমাদের দিকে ফিরে এসে তাঁর জাতিকে সেসকল ঐশ্বর্যের প্রতি প্রলুব্ধ করেছেন যা তিনি তার এই বিস্ময়কর অভিযাত্রায় অর্জন করেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে আমি দেখতে পেয়েছি যে বিংশ শতাব্দীতে ইসলাম আবারও মডেল এবং উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে এই উদ্বিগ্ন  এবং চিন্তিত জাতির সামনে, যারা এটা নিয়ে সচেতন।

সম্পূর্ণ প্রাচ্যের অনুপ্রেরণা সমৃদ্ধ একটি মার্জিত মনন/চেতনা আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি এবং এবং উদ্ভাসন থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমাদের দুর্দান্ত চিন্তাধারা, সভ্যতার কেন্দ্রস্থল, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, সৃজনশীল ক্ষমতা এবং অগ্রগতির জ্ঞান তার ছিল। এসবকিছুর মধ্য দিয়ে তিনি বিংশ শতাব্দীর জ্ঞানী হয়ে উঠেন।

তিনি সেসকল প্রতিক্রিয়াশীল বা উপাসকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, যারা পাশ্চাত্য এবং নতুন কিছুর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়া নব্য সভ্যতার বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা করতো। তিনি এমনকি তাদের মতো ছিলেন না, যারা যাচাই বাচাই করা ছাড়াই পশ্চিমাদের অনুকরণ করতো। অন্যদিকে তিনি বিজ্ঞান চর্চা করতেন পাশাপাশি মানবতার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অক্ষমতা এবং ত্রুটি নিয়ে সাড়া জাগিয়েছেন। তার অভিযুক্ত ক্ষেত্রগুলোতে তিনি সমাধান দিয়েছেন। ইকবাল এমন একজন ব্যক্তি যার দর্শন বিশ্বব্যাপী। তিনি দার্শনিক, আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করেছেন।

ইকবালের চিন্তায় আলীর সমপর্যায়ের বলতে কি বুঝানো হয়েছে ? এর অর্থ প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য মনন যুক্ত মানুষ। এর অর্থ এমন একটি ব্যক্তি যিনি গভীরভাবে চিন্তা করেন। এর অর্থ এমন একজন মানুষ যিনি একটি সুন্দর এবং জাঁকজমকপূর্ণ ভালবাসা প্রকাশ করেন। এটি এমন ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি আত্মার যন্ত্রণা ও জীবনের দুর্ভোগের সাথে ভালভাবে পরিচিত। এর অর্থ এমন একজন মানুষ যিনি খোদা এবং মানুষ উভয়কেই চেনেন। সে এমন এক ভক্ত যার জ্ঞানের আলো রয়েছে, যা প্রেম এবং বিশ্বাসে জ্বলে ওঠে এবং যার অনুপ্রবেশকারী চোখ দাসত্বপ্রাপ্ত জাতির ভাগ্য নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ না করে কখনও অবহেলা ও অজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে দেয় না। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি সংস্কার, বিপ্লব এবং মানসিক মনোভাবের পরিবর্তন চান।

একজন চিন্তাবিদ হিসাবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বিজ্ঞানের আত্মাহীন চোখ (ফ্রান্সিস বেকন অনুসারে) মহাবিশ্বের সমস্ত বাস্তবতা দেখতে অক্ষম। তিনি আরও অনুভব করেন যে, অসুস্থ হৃদয় প্রেমের কিছুই অর্জন করতে পারে না যদি এটি কেবল ইবাদত, আত্ম-লাঞ্ছনা এবং শুদ্ধির সাথে সম্পর্কিত থাকে। কারণ মানুষ সমাজের সাথে সম্পর্কিত এবং জীবনের সাথে যুক্ত উপাদান যা থেকে কেবল নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। একজন ব্যক্তি সমাজের কাফেলার সাথে চলাফেরা করে এবং এর থেকে আলাদা কোনও পথ বেছে নিতে পারে না।

এ কারণেই আমরা এমন একটি চিন্তাভাবনা এবং ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই যা আমাদের দর্শন চর্চার প্রয়োজনের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানায় এবং একইসাথে এমন একটি চিন্তার বিকাশ ঘটায় যাকে বিশ্ব গ্রহণ করে। এটি সভ্যতা দ্বারা স্বীকৃত এবং বিশ্বের নতুন এক সংস্কৃতি যা আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আমরা এমন একটি চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ডের প্রত্যাশা করি, এমন একটি মানবকে লালন করি যা আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের সমস্ত আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় সম্পদ সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে অবগত, যিনি যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এবং যারা চতুর্থ  বা পঞ্চম শতাব্দীতে বাস করেন না। আমরা এর জন্য এমন একজন মানুষের বিকাশ প্রত্যাশা করি যিনি ভাবতে পারেন, যার বৈজ্ঞানিক চিন্তা আছে, কিন্তু তার উম্মতের যন্ত্রণা, জীবন, বন্দীদশা এবং কষ্টের প্রতি অবহেলা থাকে না। আমরা এমন একজন মানুষের বিকাশ কামনা করি যিনি মানবতার আসল ও বৈষয়িক যন্ত্রণার কথা এবং মানব সমাজ বা তার সমাজের বর্তমান বিভ্রান্তি ও অসুবিধা সম্পর্কে চিন্তা করেও তিনি আদর্শ মানুষ বা মানুষের গুরুত্বকে ভুলে যান না। ইতিহাসে মানবতার চিরন্তন মিশন এবং সমস্ত মানবিক আদর্শিক উপাদান ব্যবহারের স্তরে নামিয়ে দেয় না।

এই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যা যা আবিষ্কার করি, খুঁজে পাই, প্রয়োজন অনুভব করি, তা সবই ইকবালের মধ্যে দেখা যায় কারণ একমাত্র ইকবাল যা করেছিলেন এবং বিংশ শতাব্দীতে একটি ইসলামী সমাজে একজন মুসলিম হিসাবে ইকবালের সবচেয়ে বড় সাফল্য-এটির সমৃদ্ধ নতুনত্বের সাথে তাঁর জ্ঞানের ভিত্তি ছিল এবং পুরানো সংস্কৃতি হলো তাঁর আদর্শিক বিদ্যালয় যা ইসলাম দিয়েছে এমন মডেলের ভিত্তিতে নিজেকে তিনি বিকশিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটি বিংশ শতাব্দীতে একটি ইসলামী সমাজে ইকবালের সবচেয়ে বড় সাফল্য।

আমরা বলি না যে তিনি একজন নিখুঁত মানুষ। বলি না যে তিনি প্রতীকী ব্যক্তি। তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি বিংশ শতাব্দীতে তাঁর বিচ্ছেদ হওয়ার পরে একজন সম্পূর্ণ মুসলিম ব্যক্তি এবং একটি নিখুঁত ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসাবে পুনর্গঠিত হয়েছিল। এই পুনর্গঠনটি সেই সূচনাবিন্দু, যা থেকে আমাদের মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের শুরু করা উচিত। নিজেকে এবং আমাদের সমাজের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব অনুভব করতে হবে। সাইয়্যেদ জামালই প্রথম যিনি পুনরায় জাগরণের অনুভূতি তৈরি করেছিলেন। ইকবাল সেই আন্দোলনের বীজের প্রথম ফল যা সাইয়্যেদ জামাল এই প্রজন্মে রোপণ করেছিলেন। প্রথম ফলটি একটি দুর্দান্ত মডেল, একটি উদাহরণ এবং খুব জাগ্রত। প্রাচ্যবাসী হিসাবে আমরা বিশ্বের এই অংশের সাথে অনুমোদিত। আমরা এই ইতিহাসের সাথে সংযুক্ত রয়েছি। আমরা প্রকৃতি ও পাশ্চাত্যের মুখোমুখি মানুষ।

তবে যখন আমরা বলি ইকবাল একজন সংস্কারক ছিলেন তখন আমরা কি বুঝিয়ে থাকি? সংস্কার কি কোনও সমাজকে তার সমস্ত দুর্ভাগ্য, যন্ত্রণা ও অসুবিধাগুলি থেকে বাঁচাতে পারে? হঠাৎ, তীব্র, গভীর-মূল বিপ্লবটি কি চিন্তাভাবনা এবং সমাজের সাথে সম্পর্কিত হওয়া উচিত নয়? আমরা যখন বলি ইকবাল একজন সংস্কারক ছিলেন, তখন শিক্ষিত শ্রেণী মনে করেন, সংস্কার মানে আর্থ-রাজনৈতিক দিক থেকে বিপ্লবের বিপরীত কিছু। প্রায়শই যখন আমরা সংস্কার বলি তখন এর দ্বারা ধীরে ধীরে পরিবর্তন বা সুপার স্ট্রাকচারের পরিবর্তন বুঝায় এবং যখন আমরা বিপ্লব বলে থাকি তখন বুঝায় অবকাঠামোগত আকস্মিক পরিবর্তন, সম্পূর্ণ পতন এবং অবশেষে পূর্ণ পুনর্গঠন।

কিন্তু যখন এই পরিবর্তনগুলিতে আমরা বলি যে ইকবাল একজন সংস্কারক ছিলেন, আমরা সমাজের ধীর পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করছি না। আমাদের উদ্দেশ্য ধীরে ধীরে পরিবর্তন বা বাহ্যিক সংস্কার নয় তবে আমরা এই শব্দটিকে সাধারণ অর্থে ব্যবহার করি যার মধ্যে বিপ্লবও অন্তর্ভুক্ত।

যখন আমরা বলি ইকবাল একজন সংস্কারক ছিলেন বা সাইয়েদ জামালের পরের মহান চিন্তাবিদ, শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক হিসাবে পরিচিত, তখন এর অর্থ এ নয় যে তারা সমাজে ক্রমশ এবং বাহ্যিক পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন করেছিল। না তারা গভীর বীজযুক্ত বিপ্লবের সমর্থক। যাদের চিন্তা একটি বিপ্লব। যাদের মতামত, অনুভূতি একটি আদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল। ইকবাল, সাইয়েদ জামাল, কাওকেবী, মুহাম্মদ আবদুহু, ইব্রাহিম এবং মকরিব জামেআ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা এমন একেকজন মহান পুরুষ যারা গত একশত বছরে এই প্রাচ্যকে নাড়া দিয়েছিলেন।

একজন ব্যক্তি নিজেকে এমনভাবে ভাবতে পারবেনা বা বেঁচে থাকতে পারে না যে সে নিজের পছন্দেই সব বেছে নিয়েছে, বা তার বয়স বা সমাজ দ্বারা কোনভাবে প্রভাবিত নয়। এবং যে  নিজেকে একজন খাঁটি ও সত্যিকারের মানুষ হিসাবে এই দুর্নীতির দুনিয়ায় এবং অধঃপতিত সমাজে গড়ে তুলতে পারবে।  যদি এমনটি হয়ে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে যে  সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং প্রতিশ্রুতি কোনক্রমে  অর্থবোধক নয়।

অনুবাদকঃ ফজলে এলাহী

১৬৯৪ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top