ইসলামী ব্যবস্থা এর দ্বারা আমরা কি বুঝি? আমাদের প্রজন্ম এটাকে কিভাবে বুঝেছে? যে প্রজন্ম এটাকে নিয়ে চিন্তা করেছে এর ব্যাপারে কথা বলেছে ও অনুপ্রাণিত হয়েছে।
খুবই সংক্ষিপ্তভাবে ইসলামী ব্যবস্থাকে এই ভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়ঃ ধর্ম ও আইন, শিক্ষা এবং শক্তি, আদর্শ ও স্বার্থ, আধ্যাত্মিক সমাজ ও রাষ্ট্র এবং স্বতঃস্ফূর্ততা ও জোরপূর্বকতার ঐক্য।
এই সকল উপাদান সমূহের সংশ্লেষণ হিসেবে ইসলামী ব্যবস্থার দুইটি মৌলিক ভিশন রয়েছে। একটি হল ইসলামী সমাজ অপরটি হল ইসলামী ক্ষমতা। প্রথমটি হল ইসলামী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু আর দ্বিতীয়টি হল এর বাহ্যিক অবয়ব। ইসলামী ক্ষমতা ছাড়া ইসলামী সমাজ অসম্পূর্ণ এবং শক্তিহীন; আর ইসলামী সমাজ বিহীন ইসলামী ক্ষমতা হয়ত ইয়টোপিয়া (কাল্পনিক) আর না হয় জুলুম।
সাধারণভাবে মুসলমানগণ ব্যক্তি হিসেবে অস্তিত্ববান নয়। মুসলমান হিসেবে যদি বসবাস করতে চায় ও টিকে থাকতে চায় তাহলে যদি ঐ পরিবেশ, ঐ সমাজ, এবং ঐ ব্যবস্থা তাকে সৃষ্টি করতেই হবে। সে দুনিয়াকে পরিবর্তন করতে বাধ্য আর না হয় দুনিয়া তাকে তার মত করে পরিবর্তন করে দিবে। ইতিহাসে সত্যিকারের এমন কোন ইসলামী আন্দোলন নেই যা একই সাথে রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। অর্থাৎ আমাদের ইতিহাসে প্রতিটি ইসলামী আন্দোলনই এক একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। এর কারণ হল ইসলাম একটি দ্বীন হওয়ার পাশাপাশি একই সাথে ইসলামের একটি দর্শন, আখলাক, ব্যবস্থা, পন্থা, আবহাওয়া রয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে ইসলাম সমগ্র জীবনকেই পরিগ্রহকারী একটি বিষয়। ইসলামী বিশ্বাস ও ধারণা নিয়ে, অনৈসলামী জীবন ধারা, বিনোদন এবং পরিচালনা মোটেই সম্ভবপর নয়। এই অবস্থা হয় মুনাফিক আর না হয় অসুখী ও বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের লোকদের জন্য প্রযোজ্য। (তারা না পারে কোরআনকে পরিত্যাগ করতে আর না পায় সেই শক্তি যে শক্তির মাধ্যমে তারা যে অবস্থায় বসবাস করছে সেই অবস্থাকে পরিবর্তন করতে)। যারা এক ধরণের সন্ন্যাসী জীবন এবং একাকীত্ত্বকে বেছে নেয় (দুনিয়া ইসলামী না হওয়ার কারণে তারা নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নেয়) কিংবা অবশেষে ইসলাম সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে যারা দ্বিধাদন্দে থাকে তারা ইসলামকে পরিত্যাগ করে প্রচলিত জীবন ব্যবস্থাকে এবং মওজুদ দুনিয়া যেভাবে চলছে সেটাকেই গ্রহণ করে থাকে। অন্য কথায় বলতে গেলে অন্যরা এই দুনিয়াকে যেভাবে গঠন করেছে সেটাকেই তারা গ্রহণ করে নেয়।
কিন্তু ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা এমন এক সমাজ ব্যবস্থা যে সমাজে এই ধরণের কোন বৈপরীত্য নেই। মুসলমানদের গঠিত সমাজ সকল কিছুর সমন্বয়ে সমাজে অসাধারণ এক ঐকতান তৈরি করে।
কেউ যদি আমাদের প্রশ্ন করে যে মুসলিম সমাজ কি?
আমরা এই প্রশ্নের জবাবে বলি মুসলমানদের তৈরি সমাজই হল মুসলিম সমাজ। আর এই সমাজ এমন এক সমাজ যে সমাজে কোন বৈপরীত্য নেই। সকল কিছুই চলে ঐকতানের মধ্য দিয়ে। মুসলিম সমাজ বলতে আমরা এটাই বুঝি এবং এটাই হল সমাজের পরিপূর্ণ রূপ।
কোন ব্যবস্থাই নিজে নিজে কখনো ইসলামী কিংবা অনৈসলামি হয় না। একটি ব্যবস্থাকে মানুষ যে ভাবে ও যে সকল মূলনীতির আলোকে গড়ে তুলে সেটা সেই সকল মূলনীতির আলোকে সেভাবেই গড়ে উঠে। আর এই কারণে সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে মানুষের তৈরিকৃত প্রতিষ্ঠান সমূহ, এই সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সম্পর্ক সমূহ ও আইন কানুন খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ।
ইউরোপীয়ানরা বিশ্বাস করে থাকে যে সমাজ মূলত আইন কানুনের মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্যে প্রবেশ করে। সেই একদম প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ থেকে শুরু করে উৎকৃষ্ট/পারফেক্ট একটি ব্যবস্থার ইউটোপিয়া পর্যন্ত, আর এই ইউটোপিয়া সমূহের মধ্যে মার্কসিজম পর্যন্ত, ইউরোপের রূহ, সমাজের মধ্যকার সম্পর্ক সমূহ খুব সাধারণ পরিবর্তন সমূহের মধ্য দিয়ে উৎকৃষ্ট/পারফেক্ট একটি সমাজে পরিণত হবে এর পেছনে ছুটে চলছে।
এই কারণে কোরআনে কারীমে খুব কম সংখ্যক ‘ আইন’ রয়েছে। কোরআন বহুলাংশে এমন একটি দ্বীনের প্রত্যাশা করে যে দ্বীনের আলোকে মানুষ তার জীবনকে পুনর্বিন্যাস করবে।
আইনের আধিক্যতা ও বিচার ব্যবস্থার জটিলতা সাধারণত সমাজে ‘কোন কিছুর ভঙ্গুরতা’ র দিকে ইশারা করে আমাদেরকে বলে থাকে যে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করার পরিবর্তে সমাজের মানুষকে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। সমাজের মধ্যকার ব্যধি যখন একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম ফেলে তখন আইন কানুন সমূহ অক্ষম (শক্তিহীন) হয়ে যায়। তখন ঐ সকল আইন কানুন সমূহ হয় দুর্নীতিবাজ ও মন্দ বিচারব্যবস্থার হাতে গিয়ে পড়ে আর না হয় ভঙ্গুর সমাজের প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য প্রতারণার উপাদানে পরিণত হয়।
মদ, জুয়া ও যাদু এই খারাপ বিষয় তিনটি মধ্য এবং নিকট প্রাচ্যে খুবই প্রচলিত ও সমাজের গভীরে প্রোথিত ছিল। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি আয়াতের মাধ্যমে ও একটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সে সকল বিষয়কে হারাম করেছেন এবং দীর্ঘ একটি সময়কাল পর্যন্ত ও অনেক বিশাল একটি অঞ্চল থেকে এই খারাপ বিষয় সমূহের মূলোৎপাটন করেছেন। এই দ্বীনের শিক্ষা ও শক্তি যখন দুর্বল হয়ে যায় তখন এই সকল খারাপ বিষয় সমূহ ও বিভিন্ন বাতিল মতবাদ সমূহ নতুন শক্তি নিয়ে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই সকল খারাপ বিষয় সমূহ পুনরায় মানব সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে এই সকল বিষয়কে বাঁধা দিয়ে দমন করার মত কোন শক্তি কিংবা সংস্কৃতি না থাকায় এই সকল বিষয় বাঁধাহীন ভাবে সমগ্র দুনিয়াতেই ছড়িয়ে পড়ে। অ্যামেরিকার Prohibition Law শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক গবেষণা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং দুনিয়ার সবচেয়ে সংগঠিত একটি সমাজের শক্তির মাধ্যমে প্রয়োগ করার পরেও বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ শতাব্দীর দিকে ব্যাপক বিক্ষোভ ও জনরোষের মুখে এই আইনকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। অ্যামেরিকা এই আইনকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ১৩ বছর ধরে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায় এবং জুলুমে পূর্ণ অনেক সহিংস কর্মকাণ্ড করে। কিন্তু এই আইনকে বলবদ রাখতে সক্ষম হয়নি। স্কেন্ডিনেভিয়ান দেশ সমূহেও এই আইন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু তারাও অ্যামেরিকার মত একই ভাবে ব্যর্থ হয়।
এই সকল উদাহরণ এবং এই ধরণের আরো অনেক উদাহরণ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে একটি সমাজকে কেবলমাত্র আল্লাহর নামে এবং মানুষকে শিক্ষা (তারবিয়া) দেওয়ার মাধ্যমেই সংশোধন করা সম্ভব। তাই আমরা যদি সমাজকে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজে পরিণত করতে চাই তাহলে আমাদেরকে এই নিশ্চিত এবং একমাত্র পথকেই অবলম্বন করতে হবে।
ইসলাম তার নীতি দর্শনকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক এবং অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতির উপরেই নির্ভর করেনি। ইসলাম একই সাথে শয়তানের হাতে থাকা উপাদান সমূহকে একের পর এক দুর্বল করে দেওয়ার জন্যও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ইসলামী যদি মানুষ ও দুনিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষকে কেন্দ্রে স্থান না দিত তাহলে দ্বীন বলে কিছু হত না। মানুষকে যদি কেন্দ্রে স্থাপন না করত তাহলে ঈসার নীতি ও আদর্শকে পুনরাবৃত্তিকারী একটি দ্বীন ছাড়া আর অন্য কিছু হত না। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর সুন্নত ও কোরআনে কারীমের মাধ্যমে ইসলাম মানুষকে ইনসানে কামিলে (পরিপূর্ণ মানুষ ) রূপান্তরিত করেছে। এবং এই কাজ করার ক্ষেত্রে দুনিয়ার সাথেও ইসলাম সম্পর্ক তৈরি করে বিশ্বকে বিনির্মাণ করেছে। এই সকল কিছুর মাধ্যমে ইসলাম মানুষের সমগ্র জীবনকে পরিগ্রহকারী একটি জীবন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। দ্বিনের সাথে আইন এবং তারবিয়ার সাথে শক্তি একত্রিত হয়েছে এবং ইসলাম এই ভাবে একটি বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
উৎসঃ ইসলামী ডেক্লারেশন
অনুবাদকঃবুরহান উদ্দিন আজাদ