ইসলামে মিউজিক দৃষ্টিভঙ্গি (দ্বিতীয় পর্ব)

যারা গান হালাল মনে করেন, তাদের দলিল

ওপরে যারা গান-বাজনা হারাম মনে করেন, তাদের দলিলসমূহ একে একে উপস্থাপন করা হয়েছে। ওসব দলিল পর্যালোচনা করার পর তার সবগুলোই অসার প্রমাণিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি দলিলও মজবুত প্রমাণিত হয়নি। যখন গান হারাম হওয়ার দলিলগুলো অযথার্থ প্রমাণিত হলো, তখন গানের হুকুম ‘সাধারণত সবকিছু হালাল’- এই মূলনীতির ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে হালাল সাব্যস্ত হবে।

হারাম হওয়ার দলিলগুলো অযথার্থ প্রমাণিত হওয়ার পর হালাল হওয়ার পক্ষে কোনো নস বা দলিল না থাকলেও এই মূলনীতির ভিত্তিতে তা হালাল হিসেবে গণ্য হবে। তবে এর সাথে যুক্ত হচ্ছে সুস্পষ্ট ও সহিহ অনেকগুলো নস, ইসলামের সহনশীল স্পিরিট, সাধারণ মূলনীতি এবং সাধারণ সর্বজনীন নীতিমালা। আমরা তার বিবরণ পেশ করছি-

 

প্রথমত: ইসলামি নসের (কুরআন-সুন্নাহর) আলোকে গান-বাজনা

যারা গান-বাজনা হালাল মনে করেন, তারা বেশ কিছু সহিহ হাদিস দ্বারা দলিল দিয়েছেন। তার একটি হলো, নবি কারিম সা.-এর বাড়িতে আয়িশা রা. এর ঘরে দুই গায়িকার গান করা সংক্রান্ত হাদিস। আবু বকর রা. তাদের এ কথা বলে তাদের ধমক দেন, “রাসূলের বাড়িতে শয়তানের স্তুতি গান করা হচ্ছে?”

এ থেকে প্রমাণিত হয়, গায়িকা দু জন ছোটো ছিল না, যেমনটি কেউ কেউ মনে করেন। কারণ, তারা ছোটো হলে আবু বকর রা. এর মতো একজন সজ্জন মানুষের এভাবে জোরে তাদের ধমক দেওয়ার কথা নয়।

নবি কারিম সা. আবু বকর রা. কে ধমক দিতে নিষেধ করেন। কারণ, তিনি এই গানের মাধ্যমে ইহুদিদের জানাতে চাচ্ছিলেন, আমাদের দ্বীনে আনন্দ-বিনোদনের সুযোগ আছে। তিনি তাদের আরও জানাতে চাচ্ছিলেন, আল্লাহ তাকে সহনশীল স্বভাবজাত এক দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয়, অন্যের কাছে ইসলামকে উত্তমভাবে উপস্থাপন করা এবং দ্বীনের সহনশীলতা ও সহজতা প্রকাশ করা আবশ্যক।

 

ইমাম বুখারি ও আহমাদ আয়িশা রা. এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি তাঁর এক আত্মীয়া মেয়েকে এক আনসারির সাথে বিয়ে দেন। তখন রাসূল সা. বললেন, ‘তোমরা কি মেয়েটিকে কোনো উপহার-সামগ্রী দিয়েছ?’ তারা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তারপর তিনি বললেন, ‘তার সাথে গান গাইতে পারে এমন কাউকে কি পাঠিয়েছ?’ আয়িশা রা. বললেন, ‘না।’ তখন রাসূল সা. বললেন, ‘আনসাররা এমন এক সম্প্রদায়, যাদের মাঝে গান গাওয়ার রেওয়াজ আছে। যদি তার সাথে এমন কাউকে পাঠাতে, যে গান গাইত (তা হলে ভালো হতো)

أتيناكم أتيناكم- فحيانا وحياكم

আমরা তোমাদের তরে এসেছি,

তোমাদের তরে এসেছি,

আমাদের প্রতি স্বাগত জানাও,

তোমাদের প্রতিও স্বাগত!’

এ হাদিস প্রমাণ করে, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর প্রথা ও মেজাজ-মর্জির প্রতি লক্ষ রাখা এবং তা মূল্যায়ন করা জরুরি। কারও নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ও মেজাজ-মর্জি অন্য সকলের জীবনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

নাসায়ি ও হাকিম আমির ইবনে সাদ থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেন এবং হাকিম তা সহিহ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “আমি কুরযা ইবনে কাব ও আবু মাসউদ আনসারি রা. এর বাড়িতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। সেখানে কয়েকজন দাসী গান করছিল। তখন আমি বললাম, “রাসূল সা. এর বদরি সাহাবিদের সামনে এভাবে গান গাওয়া হচ্ছে!’ তখন তাঁরা বললেন, ‘তোমার ইচ্ছা হলে আমাদের সাথে বসে গান শোনো, আর ইচ্ছা না হলে চলে যাও। কারণ, বিয়ের অনুষ্ঠানে গানের অনুমতি আমাদের দেওয়া হয়েছে।”

ইবনে হাযম তাঁর সনদে ইবনে সিরিন থেকে বর্ণনা করেন, “এক লোক মদিনায় কতিপয় দাসী বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসে। সে দাসীগুলো আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের কাছে এনে দেখাল। তখন তিনি এক দাসীকে গান গাইতে আদেশ করলে দাসীটি গান গাইল। সেখানে ইবনে উমর রা.ও তা শুনেছিলেন। ইবনে জাফর দাসীটির দরদাম ঠিক করে কিনে নিলেন। পরে লোকটি ইবনে উমরের কাছে এসে বলল, ‘হে আবু আবদুর রহমান। আমি সাতশত দিরহামের বিনিময়ে দাসীটি বিক্রি করে ঠকেছি।’ ইবনে উমর রা. লোকটিকে নিয়ে পুনরায় ইবনে জাফরের কাছে এসে বললেন, ‘সে মনে করছে সাতশত দিরহামে দাসীটি বিক্রি করে সে ঠকেছে। হয় আপনি কিছু দিরহাম তাকে বেশি দিন, না হয় বেচা-কেনা বাতিল করে তার দাসী তাকে ফেরত দিয়ে দিন।’ ইবনে জাফর বললেন, ‘আমি দাসীটি ফেরত দেবো’।”

ইবনে হাযম বলেন, এতে লক্ষণীয় বিষয় হলো- ইবনে উমর রা. নিজে দাসীর গান শুনেছেন এবং একজন গায়িকা দাসীর বেচা-কেনার মধ্যস্ততাও করেছেন। এ হাদিসের সনদ সহিহ; এটি কোনো বানোয়াট জাল হাদিস নয়।

যারা গান হালাল মনে করেন, তারা আল্লাহ তায়ালার নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةٌ أَوْ لَهْوًا انفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا قُلْ مَا عِندَ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ اللَّهْوِ وَمِنَ

التِّجَارَةِ وَاللَّهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ

“যখন তারা ব্যাবসা ও ক্রীড়া-কৌতুক দেখল, তখন আপনাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে গেল। বলে দিন- আল্লাহর নিকট যা আছে, তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যাবসার চেয়ে উত্তম। আর আল্লাহই উত্তম রিযিকদাতা।” (সূরা জুমুআ : ১১)

আলোচ্য আয়াতে ক্রীড়া-কৌতুককে ব্যাবসার সাথে একাকার করে আলোচনা করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে ব্যাবসা হালাল। (সুতরাং ক্রীড়া-কৌতুকও হালাল হওয়ার কথা।) এখানে এতদুভয় কাজকে কেবল এ কারণেই নিন্দা করা হয়েছে যে, সাহাবিরা রাসূলে কারিম সা. কে খুতবারত অবস্থায় রেখে বাইরে ব্যবসায়ী কাফেলার আগমন উপলক্ষ্যে খুশি হয়ে বাজনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা সেসব হাদিস দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন, যাতে বর্ণিত হয়েছে যে- কিছু কিছু সাহাবি কার্যতই গান শুনেছিলেন এবং গান শোনাকে সমর্থনও করেছিলেন। তাঁরা এমন এক আদর্শ প্রজন্ম, যাদের অনুকরণ-অনুসরণ করলে হিদায়াত পাওয়া যায়।

তারা গান শোনা হালাল হওয়ার পক্ষে ইজমার কথাও বলে থাকেন, যা কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন। আমরা সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করব।

 

দ্বিতীয়ত: ইসলামের প্রাণসত্তা ও মৌলিক নীতিমালার আলোকে গান

ক. গান মূলত এক ধরনের মনোতুষ্টকারী উপকরণ। মানুষের মন ও বিবেক তা পছন্দ করে, মানবপ্রকৃতি তা আনন্দদায়ক মনে করে, তাদের শ্রবণেন্দ্রিয় তা শোনার প্রতি আগ্রহবোধ করে। গান কানের খোরাক, যেমনিভাবে সুস্বাদু খাবার পাকস্থলির খোরাক, সুদৃশ্য চোখের খোরাক, সুঘ্রাণ নাসিকার খোরাক। এসব পবিত্র ও উপভোগ্য জিনিসগুলো ইসলামে হারাম না হালাল?

 

এটা প্রসিদ্ধ যে, আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলের জন্য তাদের অপকর্মের শাস্তিস্বরূপ দুনিয়ার কিছু পবিত্র জিনিস হারাম করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

فَبِظُلْمٍ مِنَ الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَن سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرًا * وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِين مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

“ইহুদিদের পাপের কারণে এবং আল্লাহর পথে অধিক পরিমাণে বাধা দেওয়ায় আমি তাদের জন্য হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র বস্তু- যা মূলত তাদের জন্য হালাল ছিল। এটা এ কারণে যে, তারা সুদ গ্রহণ করত, অথচ এ ব্যাপারে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল। আর এ কারণেও, তারা অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ জবরদখল করত। বস্তুত আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা নিসা: ১৬০-১৬১)

আল্লাহ তায়ালা সাইয়িদুনা মুহাম্মাদ সা. কে নবি হিসেবে পাঠানোর সুসংবাদ এবং তাঁর রিসালাতের শিরোনাম পূর্বের গ্রন্থগুলোতে এভাবেই দিয়েছেন-

يَأْمُرُهُم بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَزِمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ

وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالُ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ

“তিনি তাদের নির্দেশ দেবেন সৎকর্মের, বারণ করবেন দুষ্কর্ম থেকে। তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করবেন এবং নিষিদ্ধ করবেন হারাম বস্তুসমূহ। আর তাদের ওপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেবেন এবং বন্দিত্ব অপসারণ করবেন, যা তাদের ওপর বিদ্যমান ছিল।” (সূরা আরাফ: ১৫৭)

সুতরাং সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ পছন্দ করে, এমন কোনো পবিত্র বস্তু ইসলামে সাধারণত হারাম করা হয়নি। যেহেতু এ দ্বীন চিরস্থায়ী ও সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত, তাই তিনি এ উম্মাহর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে সকল পবিত্র জিনিস হালাল করে দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-

يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ

“তারা আপনার কাছে জানতে চায়- তাদের জন্য কী কী হালাল করা হয়েছে? আপনি বলে দিন- তোমাদের জন্য পূত-পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করে দেওয়া হয়েছে।” (সূরা মায়িদা: ৪)

আল্লাহ তায়ালা কোনো মানুষকে এ অধিকার দেননি যে, সে নিজের জন্য বা পরের জন্য- যেসব পবিত্র জিনিস আল্লাহ তায়ালা রিযিক হিসেবে দিয়েছেন, তা হারাম ঘোষণা করবে; এমনকি এক্ষেত্রে তার নিয়ত শুদ্ধ হলেও কিংবা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কাম্য হলেও। কারণ, হারাম-হালাল করাটা একমাত্র আল্লাহর হক ও অধিকার। এ অধিকার কোনো বান্দা প্রয়োগ করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

قُلْ أَرَأَيْتُم مَّا أَنزَلَ اللهُ لَكُم مِّن رِزْقٍ فَجَعَلْتُم مِنْهُ حَرَامًا وَحَلَالًا قُلْ اللَّهُ أَذِنَ لَكُمْ أَمْ عَلَى

اللَّهِ تَفْتَرُونَ .

“হে নবি। আপনি বলে দিন- তোমরা নিজেরাই লক্ষ করে দেখো, যা কিছু আল্লাহ তোমাদের জন্য রিযিক হিসেবে অবতীর্ণ করেছেন, তোমরা সেগুলোর মধ্য থেকে কোনোটাকে হারাম আর কোনোটাকে হালাল সাব্যস্ত করছ? বলো, তোমাদের কি তা আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করছ?” (সূরা ইউনুস: ৫৯)

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ কর্তৃক হালালকৃত পূত-পবিত্র জিনিসকে হারাম করা এবং হারামকৃত অপছন্দনীয় জিনিসকে হালাল করা একই ধরনের অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। উভয় কর্ম আল্লাহর ক্ষোভ ও গযব নিয়ে আসে এবং এতদুভয় কর্মের কর্তাকে সুস্পষ্ট ক্ষতির গভীর গর্তে এবং চরম গোমরাহিতে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ তায়ালা জাহিলি যুগের যেসব লোক এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত ছিল তাদের প্রসঙ্গে বলেন-

قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ قَتَلُوا أَوْلادَهُمْ سَفَهَا بِغَيْرِ عِلْمٍ وَحَرَّمُوا مَا رَزَقَهُمُ اللَّهُ افْتِرَاءِ عَلَى اللَّهِ قَدْ

ضَلُّوا وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ .

“যারা নিজ সন্তানদের নির্বুদ্ধিতাবশত কোনো প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে এবং আল্লাহ তায়ালা তাদের যেসব রিযিক দিয়েছেন, সেগুলোকে হারাম করে নিয়ে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে, নিশ্চয় তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে; তারা সুপথগামী হয়নি।” (সূরা আনআম: ১৪০)

 

 

খ. আমরা চিন্তা করলে দেখতে পাই যে, গানের প্রতি অনুরাগ ও আকর্ষণ এবং মিষ্টি সুরের প্রতি মোহ মানুষের স্বভাবজাত ও মজ্জাগত ব্যাপার। এমনকি সুরেলা গান দোলনায় ক্রন্দনরত শিশুর কান্না পর্যন্ত থামিয়ে দেয়। এ কারণেই যুগ যুগ থেকে মায়েরা এবং শিশু লালনকারী মহিলারা ও নার্সরা গান করে শিশুদের ঘুম পাড়ায়। এমনকি পশু-পাখি পর্যন্ত সুমিষ্ট সুরের মূর্ছনায় সুললিত গানের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

ইমাম গাযালি তাঁর এহইয়াউ উলুমুদ্দিন গ্রন্থে বলেন, “যাকে গান প্রভাবিত করে না, সে অস্বাভাবিক, ত্রুটিপূর্ণ ও আত্মাহীন, সৌন্দর্যবোধহীন এবং প্রাণীর প্রতি মায়া-দয়াহীন মানুষ।”

এমনকি কিছুটা নির্বোধ স্বভাবের প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও উটকে চালকের গান এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, সে গানের সুরের মূর্ছনায় ভারী বোঝাকে হালকা এবং দূরের কঠিন পথকে সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাবতে থাকে। এ সুর তার মধ্যে এক প্রকারের প্রশান্তি নিয়ে আসে। ফলে দেখা যায়- সে গান শুনতে পেলে তার গলা বাড়িয়ে দেয়, কান সজাগ করে তোলে এবং দ্রুত চলতে আরম্ভ করে, যার কারণে পিঠের ভারী বোঝা পর্যন্ত নড়াচাড়া করতে থাকে।”

গানের প্রতি অনুরাগ যদি স্বভাবগত ব্যাপার হয়ে থাকে, তাহলে কি এ দ্বীন মানুষের স্বভাব ও মজ্জাগত ব্যাপারের বিরুদ্ধাচরণ এবং তা প্রত্যাখ্যান করতে এসেছে? না, কখনও নয়; বরং দ্বীন এসেছে তাকে সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত করতে। তাকে যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিতে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, “নবিগণ মানুষের স্বভাব ও ফিতরাতকে পূর্ণতা দান করতে ও সুবিন্যস্ত করতে এসেছেন; তাকে পরিবর্তন ও বিকৃত করতে আসেননি।”

এ কথার একটি প্রমাণ হলো- “মহানবি সা. যখন হিজরত করে মদিনায় এলেন, তখন মদিনাবাসীরা দুটি দিন উৎসব হিসেবে পালন করত। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ দুটি দিন কীসের?’ তারা জবাবে বলল, ‘আমরা এ দুদিন জাহিলি যুগ থেকেই আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে পালন করে আসছি।’ তখন রাসূল সা. বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এ দুই দিনের পরিবর্তে তোমাদের আরও উত্তম দুটি দিন উপহার দিয়েছেন- ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিন’।”

আয়িশা রা. বলেন, “আমি নবি সা.-কে দেখলাম, তিনি আমাকে তাঁর চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। তখন আমি মসজিদে খেলাধুলারত হাবশিদের খেলা দেখছিলাম। আমি খেলা দেখে পরিতৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাকে ঢেকে রেখেছিলেন।” এক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় যে, নবি কারিম সা. বিনোদনের প্রতি উৎসাহী এক তরুণীর আগ্রহের যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন।

 

গান যদি হয় বিনোদনের অন্তর্ভুক্ত, তাহলে বিনোদন তো হারাম নয়। আর মানুষ তো সর্বদা আনন্দ ও বিনোদনবিহীন গম্ভীর হয়ে থাকতে পারে না।

“সাহাবি হানযালা রা. এর একবার মনে হলো, তিনি বউ-বাচ্চা নিয়ে আনন্দ-বিনোদন করার কারণে এবং রাসূলের সামনে থাকাবস্থা ও নিজের বাড়িতে থাকাবস্থার মধ্যে মনের বৈপরীত্যের কারণে মুনাফিক হয়ে গেছেন। রাসূল সা. তাকে বললেন, ‘হানযালা, কিছু সময়ের জন্য ওরকম হওয়া যায়’।”

আলী ইবনে আবু তালিব রা. বলেন, “তোমরা তোমাদের মনকে কিছুক্ষণ পর পর প্রশান্তি দাও। কারণ, মনকে বাধ্য করা হলে তা অন্ধ হয়ে যায়।” তিনি আরও বলেন, “মানুষের শরীর যেমন পরিশ্রান্ত হয়, তেমনি মনও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং তাকে উজ্জীবিত করার কৌশল অনুসন্ধান করো।”

আবু দারদা রা. বলেন, “আমি বিনোদনের মাধ্যমে নিজের মনকে কখনও কখনও পরিতৃপ্ত করি- যাতে এর দ্বারা উত্তম কাজ করতে শক্তি পাই।”

 

যারা বলেন, গান বা খেলতামাশা (সুতরাং বর্জনীয়); ইমাম গাযালি তাদের প্রতিউত্তরে বলেন-

“হ্যা, তা অবশ্যই তা-ই। গোটা দুনিয়াটাই তো খেল-তামাশা। নারীদের সাথে সব ধরনের খুনশুটি তো খেল-তামাশাই; তবে সন্তান লাভের উদ্দেশ্যে যে মিলিত হওয়া তা এরূপ নয়। তেমনিভাবে অশ্লীলতাবিহীন ক্রীড়া-কৌতুকও হালাল। রাসূল সা. স্বয়ং নিজে এবং তাঁর সাহাবিগণও সময়ে সময়ে তা করেছেন বলে বর্ণিত আছে।

হাবশিদের বিভিন্ন কসরত প্রদর্শনের চেয়ে বেশি ক্রীড়া-কৌতুক আর কোথায় আছে? তা-ও হাদিস দ্বারা বৈধ প্রমাণিত হয়েছে। তাই আমরা বলতে চাই- ক্রীড়া-কৌতুক অন্তরকে পরিতৃপ্ত ও দুশ্চিন্তামুক্ত করে। যখন মনকে বাড়াবাড়ি রকম বাধ্য করা হয়, তখন তা অন্ধ হয়ে পড়ে। তাকে তৃপ্ত করা মানে কর্মমুখী করার জন্য তৈরি করা।

 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সার্বক্ষণিক দ্বীনি শিক্ষায় নিয়োজিত থাকলে জুমার দিনের ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, একদিনের ছুটি বা কর্মবিরতি বাকি দিনগুলোতে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে; সব সময় নফল নামাজে ব্যস্ত থাকলে কোনো কোনো সময় ফরজ ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারণেই কিছু কিছু সময় নামাজ আদায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ, কিছু সময়ে বিরতি কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির সহায়ক, আর আনন্দ-বিনোদন কর্মশীল হতে সাহায্য করে।

সাধারণ মানুষ এক নাগাড়ে কর্মব্যস্ত ও সৎকর্মের কঠোর সাধনায় লিপ্ত থাকতে পারে না। কেবল নবি-রাসূলগণই তাতে টানা কর্মব্যস্ত থাকতে পারেন।

অতএব, আনন্দ-বিনোদন হলো হৃদয়-মনের অলসতা ও জড়তা কাটিয়ে উঠার মহৌষধ। সুতরাং তা বৈধ হওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু তা অতিরঞ্জিত হওয়া উচিত নয়। যেমন- ওষুধের ব্যবহার প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি হওয়া উচিত নয়। কাজেই এ নিয়তে আনন্দ-বিনোদনে সম্পৃক্ত হওয়াও ইবাদত।

যে ব্যক্তি কিছু বিনোদনের মাধ্যমে ভালো কোনো কাজ করার প্রেরণা পায়, তার জন্য গান শোনা মুস্তাহাব হওয়া উচিত- যাতে সে এর মাধ্যমে পূর্বে উল্লিখিত উদ্দেশ্যে উপনীত হতে পারে। হ্যাঁ, এটা কামিল বা শীর্ষচূড়ায় উপনীত ব্যক্তিদের বেলায় ত্রুটি প্রমাণ করে। কারণ, কামিল লোকদের অনর্থক বিনোদনের মাধ্যমে মনে প্রশান্তি আনার প্রয়োজন হয় না। তবে দুর্জনের উত্তম কর্মও অনেক সময় সুজনের কুকর্মের সমতুল্য হয়।

অন্তরের চিকিৎসা, হৃদয়ে প্রশান্তির উপায় এবং তাকে সঠিকপথে পরিচালিত করার বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে যারা অবগত, তারা অবশ্যই এ কথাও জানেন যে, এসব উপকরণ মনে প্রশান্তি আনার এমন মহৌষধ- যার বিকল্প নেই।”

ইমাম গাযালির উপর্যুক্ত বক্তব্য অতি মূল্যবান ও বাস্তবানুগ- যা তাঁর ইসলামের মূল প্রাণসত্তাকে গভীরভাবে অনুধাবনের প্রমাণ বহন করে।

 

যারা গান বৈধ মনে করেন

এ-তো গেল কুরআন-হাদিস ও ইসলামের মূলনীতির আলোকে গান হালাল ও বৈধ হওয়ার দলিল। কোনো ফকিহ তা বৈধ বলে অভিমত না দিলেও এসব দলিল গান বৈধ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। তবে তা বৈধ হওয়ার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন অনেক সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়ি ও ফকিহ।

মদিনাবাসীগণ তাকওয়া-পরহেজগারিতে কিংবদন্তিতুল্য হওয়া সত্ত্বেও, যাহেরি মাযহাবের অনুসারীগণ কুরআন-হাদিসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণে কড়াকড়ি করা সত্ত্বেও, সুফিগণ রুখসত বাদ দিয়ে আজিমত গ্রহণ ও কঠোর নীতি অবলম্বন করা সত্ত্বেও তারা সকলেই গান হালাল মনে করতেন।

ইমাম শাওকানি নাইলুল আউতার-এ বলেন, “মদিনাবাসী, যাহেরি মাযহাবের অনুসারী এবং সুফিরা গান বৈধ হওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন; এমনকি সাথে গিটার ও সেতার বাজানো হলেও।”

উসতায আবু মানসুর বাগদাদি আশ-শাফেয়ি গান সংক্রান্ত তাঁর এক গ্রন্থে বলেন, “আবদুল্লাহ ইবনে জাফর গান শোনার ব্যাপারে কোনো বাধা আছে বলে মনে করতেন না। তিনি তাঁর দাসীদের জন্য নিজে সুর নির্মাণ করতেন এবং তাদের কণ্ঠে সেই সুরে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান শুনতেন। আর তাও তিনি আলী রা. এর খিলাফতকালে করতেন।” তিনি কাজী শোরাইহ, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব, আতা ইবনে রাবাহ যুহরি ও শাবি থেকেও অনুরূপ গান শোনার কথা বর্ণনা করেছেন।

 

ইমামুল হারমাইন আন-নিহায়া গ্রন্থে এবং ইবনে আবিদ দুনিয়া বলেন, “ইতিহাসবিদগণ গান শোনার ব্যাপারে এমন কথাও বর্ণনা করেছেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা.-এর কয়েকজন দাসী ছিল- যারা সেতার বাজাতে পারত। একবার আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাঁর কাছে গেলেন, তখন তাঁর পাশে একটি সেতার ছিল। তখন তিনি বললেন, ‘হে রাসূলের সাথি! আপনার পাশে ওটা কী?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘ওটা হলো শাম দেশের একটা পাল্লা: এর মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি মাপা হয়’।”

হাফেজ আবু মুহাম্মাদ ইবনে হাযম তাঁর গান সংক্রান্ত এক পুস্তিকায় তাঁর নিজের সনদে ইবনে সিরিন থেকে বর্ণনা করেন, “এক লোক কিছু দাসী নিয়ে বিক্রির জন্য মদিনায় এলেন, লোকটি ইবনে উমরের বাড়িতে মেহমান হলেন। দাসীদের মধ্যে এক দাসী বাজনা বাজিয়ে গান গাইতে পারত। তখন এক লোক এসে তার সাথে দাসীটি কেনার জন্য দরদাম করল, কিন্তু তার পছন্দ হলো না। ইবনে উমর রা. বললেন, ‘তুমি এদের নিয়ে এমন কারও কাছে যাও, যে এই লোকের চেয়ে তোমার জন্য বেশি উপকারী হবে।’ তিনি বললেন, ‘তেমন লোক কে?’ ইবনে উমর বললেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে জাফর।’ লোকটি দাসীদের তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তাদের মধ্য থেকে এক দাসীকে আদেশ করে বললেন, বীণা নিয়ে গান গেয়ে শোনাও। দাসীটি গান গেয়ে শোনাল। তারপর দাসীটি আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের কাছে বিক্রি করে লোকটি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এর কাছে ফিরে এলেন এবং পুরো ঘটনাটি তাকে অবহিত করলেন।”

ইকদুল ফরিদ-এর লেখক বিশিষ্ট সাহিত্যিক আল্লামা আবু আমর বর্ণনা করেন, “আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. একদিন ইবনে জাফরের কাছে গেলেন। তখন সেখানে এক দাসীকে দেখতে পেলেন, যার কোলে একটি সেতার ছিল। তখন তিনি ইবনে উমরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এতে কি আপনি কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন?’ ইবনে উমর রা. জবাবে বললেন, ‘না, এতে সমস্যা নেই’।”

মাওয়ারদি মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, তাঁরা উভয়ে ইবনে জাফরের কাছে বীণা বাজানো শুনেছিলেন। আবুল ফারজ ইসফাহানি বর্ণনা করেন, “হাসসান ইবনে সাবিত রা. আজজালা আল মিলার কাছে ড্রাম বাজিয়ে তাঁর নিজের রচিত একটি কবিতাকে গান হিসেবে শুনেছিলেন।” আবুল আব্বাস মুবাররাদও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।

আদফাবি উল্লেখ করেছেন, উমর ইবনে আবদুল আজিজ খিলাফত লাভের পূর্বে তাঁর দাসীদের গান শুনতেন। ইবনে সামআনি তাউস থেকে গান শোনার অনুমতি দিতেন বলে বর্ণনা করেছেন। ইবনে কুতাইবা ও আল ইমতা গ্রন্থের লেখক উভয়ে মদিনার তাবেয়ি কাজী সাদ ইবনে ইবরাহিম ইবনে আবদুর রহমান যুহরি থেকে গান শোনার অনুমতি আছে বলে বর্ণনা করেছেন। আবু ইয়ালা আল খলিলি তাঁর ইরশাদ নামক গ্রন্থে এ অনুমতির কথা মদিনার মুফতি আবদুল আজিজ ইবনে সালামা আল-মাজেশুন থেকে বর্ণনা করেছেন।

 

বুইয়ানি কাফালের সূত্রে বর্ণনা করেন, মালেক ইবনে আনাসের মাযহাব মতে- বীণা সহকারে গান শোনা বৈধ। আবু তালিব মাক্কি তাঁর কুতুল কলুব নামক গ্রন্থে শুবা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বিখ্যাত মুহাদ্দিস মিনহাল ইবনে আমরের বাড়িতে তানপুরা বাজিয়ে গান শুনেছিলেন।

আবুল ফযল ইবনে যাহের তাঁর গান সংক্রান্ত এক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, মদিনাবাসীদের মধ্যে বীণা বাজিয়ে গান শোনা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে কারও দ্বিমত ছিল না।

ইবনে নাহাবি তাঁর আল ওমদা নামক গ্রন্থে বলেন, ইবনে তাহির বলেছেন, গান হালাল হওয়ার বিষয়ে মদিনাবাসীদের ইজমা হয়েছে। ইবনে তাহির বলেন, সমস্ত যাহেরি মাযহাবিরাও এ অভিমত গ্রহণ করেছেন।

আদফাবি বলেন, সাদ ইবনে ইবরাহিম থেকে গান বৈধ হওয়া সংক্রান্ত অভিমত বর্ণনার ব্যাপারে কোনো বর্ণনাকারী দ্বিমত পোষণ করেননি। তাঁর হাদিস সকল মুহাদ্দিস বর্ণনা করেছেন; অর্থাৎ সিহাহ সিত্তাহ তথা বুখারি, মুসলিম ও সকল সুনানে বর্ণিত হয়েছে।

মাওয়ারদি বীণা বাজানো হালাল হওয়ার কথা কোনো কোনো শাফেয়ি মাযহাবের অনুসারীদের থেকে বর্ণনা করেছেন। আবুল ফযল ইবনে তাহির ইসহাক ইবনে সিরাজি থেকে; আসনাবি তাঁর মুহিম্মাত গ্রন্থে বুইয়ানি ও মাওয়ারদি থেকে; ইবনে নাহাবি উসতায আৰু মানসুর থেকে; ইবনে মুলকান ওমদা গ্রন্থে ইবনে যাহির থেকে; আদফাবি শায়খ ইযযুদ্দিন ইবনে আবদুস সালাম থেকে; ইমতা গ্রন্থের লেখক আবু বকর ইবনে আরাবি থেকে তা বৈধ হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন। এমনকি আদফাবি তা বৈধ হওয়া সম্বন্ধে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

এরা সকলেই কোনো না কোনো প্রসিদ্ধ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গেয়ে শোনা বৈধ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

আর বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গান শোনা সম্পর্কে আদফাবি আল ইমতা নামক গ্রন্থে বলেন, ইমাম গাযালি তাঁর ফিকহ গ্রন্থে তা হালাল হওয়ার পক্ষে ফকিহদের ঐকমত্য উল্লেখ করেছেন। আর ইবনে তাহির এ ব্যাপারে সাহাবি ও তাবেয়িদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তাজ আল ফাজারি ও ইবনে কুতাইবা এ ব্যাপারে হারামাইনবাসীদের ইজমা আছে বলে মন্তব্য করেছেন। মাওয়ারদি বলেন, হিজাযের আদিবাসীরা বছরের সেরা দিনগুলোতে পর্যন্ত-যাতে কিনা ইবাদত-বন্দেগি ও যিকির-আযকার করার আদেশ আছে- গান-বাজনা করার অনুমতি দিতেন।

 

ইবনে নাহাবি ‘আল-উমদা’ নামক গ্রন্থে বলেন-

একদল সাহাবি ও তাবেয়ি গান শুনেছেন এবং গেয়েছেন বলে বর্ণিত আছে। সাহাবিদের মধ্যে উমর রা. গান শুনেছিলেন বলে ইবনে আবদুল বার প্রমুখ বলেছেন; উসমান রা, গান শুনেছিলেন বলে মাওয়ারদি এবং আল-বামাখ গ্রন্থের লেখক ও রাফেয়ি বলেছেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. এর গান শোনার কথা ইবনে আবু শাইবা বর্ণনা করেছেন।

সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. এর গান শোনার কথা ইবনে কুতাইবা বলেছেন। আবু মাসউদ আনসারি রা.-এর গান শোনার কথা বায়হাকি বর্ণনা করেছেন। বিলাল, আবদুল্লাহ ইবনে আরকাম ও উসামা ইবনে যায়েদ রা.-এর গান শোনার কথা বাইহাকি বর্ণনা করেছেন। হামযা রা.-এর গান শোনার কথা সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

ইবনে উমর রা. এর গান শোনার কথা ইবনে জাফর ও ইবনে আবদুল বার বর্ণনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. এর গান শোনার কথা আবু তালিব মাঝি উল্লেখ করেছেন। হাসসান রা. এর গান শোনার কথা আবুল ফরজ ইস্পাহানি বর্ণনা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. এর গান শোনার কথা যুবাইর ইবনে বাককার বর্ণনা করেছেন। কারযা ইবনে কাব রা. এর গান শোনার কথা আল আগানির লেখক বর্ণনা করেছেন। মুগিরা ইবনে শুবা রা. এর গান শোনার কথা আবু তালিব মাক্কি বর্ণনা করেছেন। আমর ইবনুল আস রা. এর গান শোনার কথা মাওয়ারদি বর্ণনা করেছেন। আয়িশা ও রুবাই রা. এর গান শোনার কথা সহিহ বুখারি ইত্যাদিতে বর্ণিত আছে।

তাবেয়িদের মধ্যে যাদের গান শোনার কথা বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা হলেন- সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব, সালেম ইবনে আবদুল্লাহ, উমর ইবনে হাসসান, খারিজা ইবনে যায়েদ, কাজী শুরাইহ, সাঈদ ইবনে যুবাইর, আমর আশ-শাবি, আবদুল্লাহ ইবনে আবু আতিক, আতা ইবনে আবু রাবাহ, মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরি, উমর ইবনে আবদুল আজিজ, সাদ ইবনে ইবরাহিম যুহরি প্রমুখ।

তাবে-তাবেয়িদের মাঝে এ সংখ্যা তো অগণিত। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধরা হলেন চার মাযহাবের ইমাম, ইবনে উয়াইনা ও শাফেয়ি মাযহাবের সকল অনুসারী প্রমুখ।” ইবনে নাহাবির কথা এখানেই শেষ। এসব কথা শাওকানি তাঁর নাইলুল আউতার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

 

গান বৈধ হওয়ার জন্য অবশ্যই কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, গান শোনা বৈধ হওয়ার জন্য বেশ কিছু জরুরি শর্ত রয়েছে- যা অবশ্যই পূরণ করতে হবে।

 

১. আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, সব ধরনের গান হালাল নয়। এ বিষয়টির প্রতি আমরা পুনর্বার জোর দিতে চাই। আমরা বলতে চাই- গান হালাল হওয়ার জন্য অবশ্যই তার বিষয়বস্তু ইসলামের শিক্ষা ও শিষ্টাচারের সাথে সংগতিশীল হতে হবে। সুতরাং আবু নওয়াসের নিম্নোক্ত গান কিছুতেই বৈধ হতে পারে না-

“আমার নিন্দা করো না, তোমার নিন্দা আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করে;

আমার চিকিৎসা করো সেই জিনিস দিয়ে, যা নিজেই রোগ।” (অর্থাৎ মদ দ্বারা)

 

তেমনিভাবে কবি শাওকির এ গানও বৈধ হতে পারে না-

“চলে গেছে রমজান,

অতএব, সাকি! দাও মোরে সুরার পাত্র,

সুরার আগ্রহে হৃদয় মোর ভারাক্রান্ত।”

 

এর চেয়ে আরও জঘন্য হলো ইলিইয়া আবু মাযির রচিত আত-তালাসিম নামক গানের এই উক্তি-

“এসেছি আমি এ ধরায় জানি না কোথা থেকে,

তবে আমি এসেছি এটা সত্য,

সামনে রাস্তা দেখেছি তাই চলেছি,

কিভাবে এসেছি? কী করে রাস্তা দেখেছি, জানি না।”

 

কারণ, এ গানে ঈমানের মূল কথা তথা- স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, পরকাল ও নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাসকে অস্বীকার করা হয়েছে।

অনুরূপভাবে অঞ্চলিক ভাষায় রচিত ‘কে মোরে বানাল’ গানটিও ইলিয়া আবু মাযির গানের মতো ঈমানের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে।

তেমনিভাবে ‘দুনিয়াটা সিগারেট আর সুরার পাত্র বৈ আর কী?’ গানটি ইসলামি মূল্যবোধের পরিপন্থী। কারণ, ইসলাম মাদকদ্রব্যকে নাপাক ও শয়তানের প্ররোচনার ফল বলে ঘোষণা দিয়েছে। যারা সুরা পান করে, বানায়, বিক্রি করে, বহন করে, এমনকি তা তৈরিতে যে কোনো রকমের সহযোগিতা করে, তাদের সকলকেই ইসলামে লানত ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে। তেমনিভাবে ধুমপানও একটা আপদ- তা মানুষের দেহ, মন ও অর্থের বিরাট ক্ষতি করে। এটি নানান রোগ-ব্যাধিরও কারণ।

 

যেসব গান জালিম স্বৈরাচারী ফাসিক শাসকদের প্রশংসা করে-যারা আমাদের এ উম্মাহকে শাসনের আবরণে মূলত শোষণ করেছে ও করছে- তাও ইসলামি শিক্ষার পরিপন্থি। কারণ, ইসলাম জালিম, জালিমদের দোসর এমনকি যারা জালিমের জুলুমের প্রতিবাদ করে না, তাদের সকলকে লানত করে। সুতরাং যে গানে তাদের প্রশংসা করা হয়, সে গান সম্বন্ধে ইসলামের অবস্থান কী ধরনের হতে পারে- তা সহজেই অনুমেয়।

যে গান সীমালঙ্ঘনকারী ইভটিজার, ব্যভিচারী ও লোভী চোখের নারী কিংবা পুরুষদের প্রশংসা করে, সে গানও ইসলামি শিষ্টাচারবিরোধী। কারণ, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন আহবান জানায়-

قُل لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ

“মুমিনদের বলুন, তারা যেন নিজ দৃষ্টিকে অবনত রাখে।” (সূরা নূর: ৩০)

وَقُل لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِ هِنَ

“আর মুমিন নারীদের বলুন, তারাও যেন দৃষ্টিকে নত রাখে।” (সূরা নূর: ৩১)

নবি কারিম সা. আলী রা. কে বলেছিলেন, “হে আলী! একবার চোখ পড়ে গেলে, দ্বিতীয়বার চোখ দিয়ো না। কারণ, প্রথমবারের দৃষ্টি ক্ষমাযোগ্য হলেও, দ্বিতীয়বারের দৃষ্টি ক্ষমাযোগ্য হবে না।”

 

২. তা ছাড়া গান গাওয়ার পদ্ধতিও তা হালাল বা হারাম হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো গানের বিষয়বস্তু ইসলামি মূল্যবোধ ও শিক্ষার পরিপন্থি নয়; কিন্তু গায়ক-গায়িকার গাওয়ার পদ্ধতি, গানের সুর অথবা তাদের অঙ্গভঙ্গিতে সুড়সুড়ির উপাদান থাকে: কিংবা গায়ক-গায়িকার ইচ্ছায় সুপ্ত যৌনতাকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা থাকে অথবা অসুস্থ মনের মানুষকে উত্তেজিত করার বাসনা থাকে। তাহলে গান হালালের সীমানা থেকে হারামের সীমায় উপনীত হবে কিংবা অন্তত সন্দেহজন বা মাকরুহর স্থানে চলে যাবে। এমন অনেক গান প্রচার করা হয়- যাতে গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে এমন মাদকতা ও আকর্ষণ থাকে; যা প্রবৃত্তি ও যৌনবৃত্তিকে জাগ্রত করে কিংবা প্রেম-প্রীতিতে শ্রোতা মাতাল হয়ে পড়ে। বিশেষত যুবক-যুবতিদের উত্তেজিত ও মাতাল করার জন্য এসব ধরনের উত্তেজক ক্রিয়াকাণ্ড করা হয়ে থাকে।

কুরআন নবি কারিম সা. এর স্ত্রীগণকে সম্বোধন করে বলে-

فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ

“তোমরা (পরপুরুষের সাথে) কোমল ভঙ্গিতে কথা বলো না- তা করলে অন্তরে ব্যাধি আছে এমন কেউ কুবাসনা করতে পারে।” (সূরা আহযাব: ৩২)

সুতরাং যদি কোমল কণ্ঠস্বরের সাথে ছন্দ, সুর, মিউজিক ও উত্তেজিত করার মতো প্রক্রিয়া থাকে, তাহলে তার হুকুম কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

 

৩. তৃতীয় আরেকটি বিষয় হলো, গানের সাথে হারাম কিছু থাকা চলবে না। যেমন- মদপান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বেপর্দা ও বেহায়াপনা ইত্যাদি। প্রাচীনকাল থেকেই গান-বাজনার আসরে এসব হয়ে আসছে। যখনই গান-বাজনার অনুষ্ঠানের কথা আসে, তখনই এসব বিষয়ের কথাও মনে পড়ে। বিশেষত দাসী ও নারীদের গান-বাজনার অনুষ্ঠানে এসব হয়ে থাকেই।

সুনানে ইবনে মাজাহ সহ বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদিসে এ কথাই বোঝানো হয়েছে- “আমার উম্মতের কিছু লোক মদপান করবে। এমনকি মদকে তারা অন্য নামে নামকরণ করবে। তাদের সামনে গায়িকারা গান- বাজনা করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের সহ ভূমিধস করাবেন এবং তাদের বানর ও শূকরে পরিণত করবেন।”

আমরা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করতে চাই। সেটি হলো- অতীতে গান শোনার জন্য গানের আসরে যাওয়ার প্রয়োজন হতো, গায়ক-গায়িকা ও তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গদের সাথে মেলামেশা করতে হতো। এসব আসরে প্রায়ই শরিয়ত ও দ্বীনবিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত হতো। কিন্তু আজকের দিনে গানের আসর ও গায়ক-গায়িকাদের থেকে দূরে অবস্থান করেও গান শোনা যায়। নিঃসন্দেহে এ বিষয়টি গানের হুকুমকে কিছুটা হালকা ও সহজতর করার একটা দিক হিসেবে বিবেচিত হবে।

 

৪. গানের ক্ষেত্রে অন্যান্য মুবাহ ও বৈধ জিনিসের মতো অতিরঞ্জন পরিহার করা আবশ্যক। বিশেষত আবেগতাড়িত গান শোনার ব্যাপারে- যাতে প্রেম- প্রীতি নিয়ে কথা থাকে। কারণ, মানুষ কেবল আবেগসর্বস্ব প্রাণী নয়, আর আবেগও কেবল প্রেমে সীমাবদ্ধ নয়, প্রেমও কেবল নারীর সাথে সুনির্দিষ্ট নয়, নারীও শুধু দেহসর্বস্ব কোনো সত্তা নয়। এ কারণেই আবেগতাড়িত এসব প্রেমের গান কম শোনাই বাঞ্চনীয় । তাতে গা ভাসিয়ে না দেওয়াই কর্তব্য। এ আমাদের জীবনের অন্যান্য সব পরিকল্পনা ও গান শোনার মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা আবশ্যক। দ্বীন পালন ও দুনিয়া উপভোগের মধ্যেও থাকতে হবে একটা সমতা ও ভারসাম্য। দুনিয়া পালনের ক্ষেত্রেও থাকতে হবে ব্যক্তির অধিকার ও সমষ্টির অধিকার আদায়ে সাম্য। ব্যক্তিকেও রাখতে হবে তার বৃদ্ধি-বিবেক ও আবেগের মধ্যে সামঞ্জস্যতা। তেমনিভাবে মানুষের সমস্ত আবেগ যথা- প্রেম-প্রীতি, হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, সৌর্যবীর্য, সাহসিকতা, স্নেহ-মমতা, মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সততা ইত্যাদির মধ্যেও থাকতে হবে ভারসাম্য। কারণ, মানুষের সব ধরনের আবেগেরই রয়েছে হক ও অধিকার।

বিশেষ কোনো আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি অবশ্যই অপরাপর আবেগ ও অধিকারে কমতি করে ব্যক্তির বিবেক-বুদ্ধি, আত্মা ও ইচ্ছাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এভাবে তা সমাজের অধিকার, বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে। সর্বোপরি এই অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি দ্বীন, ধর্ম, নৈতিকতা ও আদর্শকে নিঃশেষ করেই হয়ে থাকে।

ইসলাম সব ক্ষেত্রেই এমনকি ইবাদত-বন্দেগিতেও অতিরঞ্জন এবং বাড়াবাড়ি হারাম ঘোষণা করেছে। কাজেই এ দ্বীন কী করে খেল-তামাশায় বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জনকে প্রশ্রয় দেবে? তা বৈধ হলেও তাতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকাকে কীভাবে সমর্থন করবে?

যারা গান-বাজনা নিয়ে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকে, তা প্রমাণ করে- তাদের মন-মস্তিষ্ক বড়ো বড়ো দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের ব্যাপারে অসতর্ক। আরও প্রমাণ করে যে, তারা অনেক হক ও অধিকার আদায়কে তুচ্ছজ্ঞান করে- যা মানুষের এই সংক্ষিপ্ত জীবনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আদায় করা আবশ্যক ছিল। ইবনে মুকাফফা যথার্থই বলেছেন, “আমি এমন কোনো অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি দেখিনি- যেখানে অধিকার হরণ ও হক বিনষ্টকরণ নেই।” হাদিসে আছে, “বুদ্ধিমান মানুষ কেবল তিনটি বিষয়ের প্রতিই লোভ করতে পারে- জীবনযাপনে সচ্ছলতা, পরকালের সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং হারাম নয় (হালাল) এমন আনন্দ-বিনোদন।”

অতএব আমাদের উচিত, এই তিনটি বিষয়ের জন্য সময়কে পরিকল্পিত ও যথার্থভাবে ভাগ করা। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে তার জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন- কীসে তার জীবনের মূল্যবান সময় অতিবাহিত করেছে? কোন কাজে তার যৌবনকাল কাটিয়েছে?

 

৫. এ আলোচনার পর আরও কিছু বিষয় থাকে, যে ক্ষেত্রে প্রত্যেক গানের শ্রোতাকেই নিজের জন্য নিজেকে ফকিহ ও মুফতি হতে হয়। যদি গান অথবা বিশেষ কোনো গান তার প্রবৃত্তিকে তাড়িত করে, তাকে অশ্লীল কাজে উদ্বুদ্ধ করে, তাকে সর্বদা কল্পজগতে নিয়ে যায়, তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে পশুত্বকে উজ্জীবিত করে, তখন তাকে সে গান-বাজনা পরিহার করতে হবে। তাকে সেই জানালা বন্ধ করে দিতে হবে, যে জানালা দিয়ে তার মন-মানসিকতায়, তার দ্বীন-ধর্ম ও চরিত্রের অভ্যন্তরে ফিতনার বাতাস ঢুকে পড়ে। এভাবেই তাকে সিদ্ধান্ত নিয়ে সুস্থির হতে হবে।

 

মুসলিমদের বাস্তব জীবনে গান-বাজনা

যারা মুসলিমদের বাস্তব অবস্থার দিকে তাকায়, তাদের জীবনযাপন দেখে তারা দ্বীনদার মুসলিমের জীবন এবং পূত-পবিত্র গান শোনার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য দেখতে পায় না।

একজন সাধারণ মুসলিমের শ্রবণেন্দ্রিয় শ্রুতিমধুর সুর ও কণ্ঠস্বর দ্বারা প্রতিদিন আন্দোলিত ও পরিতৃপ্ত হয়। হয়তো কুরআন তিলাওয়াত দ্বারা- যা সুললিত কণ্ঠে তাজবিদ সহকারে কারীদের তিলাওয়াতের মধ্যে পাওয়া যায়। অথবা আযান দ্বারা- যা প্রতিদিন পাঁচবার সুমধুর সুরে ধ্বনিত হয়। এটা নবির যুগ থেকে প্রজন্মান্তরে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। যে সাহাবি এক সত্য স্বপ্নে আযানের নির্দেশনা পেয়েছিলেন, তিনি তা নবির কাছে বর্ণনা করলে নবিজি সা. তাকে বলেছিলেন, “তা বিলালকে শিখিয়ে দাও। কারণ, সে তোমার চেয়ে বেশি সুমধুর সুরের অধিকারী।” কিংবা মুনাজাত দ্বারা- যা সুমিষ্ট সুরে সুললিত কণ্ঠে করা হয়। ফলে হৃদয় নম্র হয় এবং অনুভূতিকে নাড়া দেয়। তেমনিভাবে নাতে রাসূলের মাধ্যমেও- যা মুসলিমরা যুগ যুগ ধরে শুনে আসছে সেই সময় থেকে, যখন রাসূল সা. এর মদিনায় আগমন উপলক্ষ্যে আনসারি মেয়েরা সুমিষ্ট কণ্ঠে গেয়েছিলেন-

طلع البدر علينا من ثنيات الوداع

وجب الشكر علينا ما دعى الله داع

আমার মনে পড়ে, প্রায় বিশ বছর আগে একবার এই সংগীতটি ইন্দোনেশিয়ার এক মাদরাসায় ছোটো ছোটো মেয়েদের কণ্ঠে শুনে অভিভূত হয়েছিলাম, তারা সুমধুর সুরে সমস্বরে কোরাস গাচ্ছিল। আমরা সেখানে কাতারের একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিলাম। এ সংগীতের সুললিত সুর তখন আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত ও হৃদয় আর্দ্র করে দিয়েছিল।

 

অতীতের মুসলিমরা এমন কিছু শ্রুতিমধুর সুর আবিষ্কার করেছিলেন, যার মাধ্যমে তারা মনে প্রশান্তি আনয়ন করতেন এবং জীবনকে আনন্দে ভরে দিতেন; বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে। আমরা শৈশব ও যৌবনের প্রারম্ভে এসব সুমধুর লোকসংগীত শুনেছি, যার সবই ছিল পরিবেশ থেকে সৃষ্ট স্বভাবজাত গান, হৃদয়ের গাঁথা। তাতে তাদের মূল্যবোধ প্রতিফলিত হতো এবং এর পরিপন্থী কোনো কিছু থাকত না।

এর মধ্য হতে ‘মোয়াবিল’ নামক লোকসংগীতের কথা বলা যায়। লোকেরা এসব সংগীত নিজেরা গাইত এবং তা শোনার জন্য জমায়েত হতো। তা গাইত তাদের মধ্য থেকে মিষ্টি কণ্ঠের অধিকারী কেউ। সেসব সংগীতে থাকত ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি, মিলন-বিরহ ইত্যাদি বিষয়। কোনো কোনো সংগীতে থাকত দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের কথা এবং মানুষের জোর-জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয়ও।

এসব সংগীত গাওয়া হতো বাদ্যযন্ত্রের বাজনাবিহীন, কিছু কিছু গাওয়া হতো বাঁশের এক ধরনের আরগুল (Arghul) নামক বাঁশিসহ। এসব স্বভাবশিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ ‘মাওয়াল’ নামক গণসংগীত রচনা করত, আর তা সুর দিয়ে নিজেই তাৎক্ষণিকভাবে গাইত।

এর মধ্যে আর কিছু হলো ছন্দোবদ্ধ গল্প সংবলিত পুথি। এসব পুথিসাহিত্যে জাতীয় বীরদের জীবনী গেয়ে শোনানো হতো। তাদের বীরত্ব, প্রতিরোধ ও ধৈর্যের কাহিনি শোনানো হতো। লোকেরা তা শুনত আর নিজেরাও গাইত। এমনকি অনেকে পুরো গল্পটিই মুখস্ত করে নিত। যেমন- আদহাম শারকাবির গল্প, শফিকা ও মুতাওয়াল্লির কিচ্ছা, আইয়ুব মিশরি ও ইয়াতিম সাদ ইত্যাদি।

এর মধ্যে আর কিছু হলো জাতীয় বীরদের জীবনীকেন্দ্রিক মহাকাব্য। যেমন- আবু যায়েদ হিলালি নামক মহাকাব্য। এ মহাকাব্যের গল্প শোনার জন্য লোকেরা আসর বসাত এবং গল্প ও এর নায়কদের গানগুলোও লোককবিদের মুখ থেকে ‘রাবাবা’ নামক সুরে শোনা হতো। এ সুর কেবল এ জাতীয় মহাকাব্যের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল। অনেকেই এসব মহাকাব্যের বিশেষ অনুরাগী ছিল। এসব মহাকাব্য গাওয়া হতো অনেকটা আজকের দিনের ধারবাহিক নাটকের মতো পর্ব পর্ব করে।

আরেক ধরনের গান ছিল ঈদ ও বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে গাওয়ার জন্য। যেমন- বিয়ে, জন্মদিন, শিশুর খতনা অনুষ্ঠান, কারও আগমন, অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান, রোগমুক্তি উৎসব এবং হাজিদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ইত্যাদির গান।

সাধারণ মানুষ নিজে নিজেই অনেক ধরনের গান ও সুর নির্মাণ করে এবং তা বিভিন্ন উৎসবে গায়, যেমন- ফসল কাটার গান, নবান্নের গান ইত্যাদি।

শ্রমিক ও কামলাদের কোরাস গাওয়াও অনুরূপ, যারা নির্মাণকাজ করতে গিয়ে বা কোনো ভারী কিছু উত্তোলন করতে গিয়ে সমস্বরে- হেইয়্যা, হেইয়্যা, আল্লাহর নামে হেইয়্যা, আরও জোরে হেইয়্যা ইত্যাদি গান গায়। এসব গান গাওয়ার পেছনে সাহাবাদের যুগ থেকে শরিয়তের ভিত্তি আছে। সাহাবায়ে কেরাম যখন মসজিদের নববি নির্মাণের জন্য দূর থেকে নিজেদের কাঁধে পাথর বহন করে নিয়ে আসছিলেন, তখন তারা সমস্বরে কোরাশ গাচ্ছিলেন-

اللهم إن العيش عيش الآخرة فأغفر للأنصار والمهاجرة

“হে আল্লাহ! জীবন তো নেই আখিরাতের জীবন ছাড়া,

ক্ষমা করে দিন সকলকে তাদের, আনসার-মুহাজির যারা।”

এমনকি মায়েরা যখন তাদের শিশুদের আদর করেন বা তাদের ঘুম পাড়াতে চান, তখনও তারা ঘুমপাড়ানির গান গেয়ে থাকেন। এরূপ কিছু বিখ্যাত ঘুমপাড়ানি গানের একটি হলো-

يا رب ينام يا رب ينام

“হে রব! ঘুম পড়িয়ে দাও। হে রব! ঘুম এনে দাও।”

আমার এখনও রমজান মাসে সেহরির সময়ের ডাকুয়াদের কথা মনে পড়ে। তারা মধ্য রাতের পর লোকদের ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ঢোল বাজিয়ে সুরেলা কন্ঠে ঘুম জাগানো গান গাইত।

এখানে আরও যে চমৎকার গানের কথা উল্লেখ করা যায় তা হলো- হকার ও ফেরিওয়ালাদের গান। তারাও তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য সুর দিয়ে চমৎকার গান গায়। এসব গানের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করার জন্য পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে। যেমনটি সাধারণত কাপড় বিক্রেতা হকার এবং সবজি বিক্রেতা ফেরিওয়ালারা করে থাকে।

এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, গান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওপপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানুষ এমনি এমনি স্বাভাবিকভাবেই তা গেয়ে যায়। এর সাথে দ্বীনের কোনো সংঘাত আছে বলে তারা মনে করে না। আর আলেমরাও এসব সামাজিক গানের মধ্যে নিন্দা করার মতো কিছু আছে বলে মনে করেন না; বরং দেখা যায়- এসব গানে প্রায়ই ধর্মের বাণী, ঈমানের কথা, মূল্যবোধ ও উত্তম চরিত্রের কথা একাকার হয়ে আছে। তাতে আছে তাওহিদের বাণী, আল্লাহর জিকির, দুআ, দরুদ ইত্যাদি।

এসব আমি মিশরেও দেখেছি, শ্যাম ও অন্যান্য আরব দেশসমূহেও দেখেছি।

 

অনুবাদঃ ড. মাহফুজুর রহমান।

 

টীকাঃ

১. ইবনে হাযম, মুহাল্লা, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৬৯।

২. গাযালি, এহইয়াউ উলুমুদ্দিন।

৩. আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ি।

৪. মুসলিম।

৫. এহইয়াউ উলুমুদ্দিন, পৃষ্ঠা ১১৫২-১১৫৩।

৬. শাওকানি, নাইলুল আউতার (বৈরুত দারুল জিল), খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ২৬৪-২৬৬।

৭. সামাজিক গানে ধর্মীয় দৃষ্টিতে নিন্দনীয় কিছু সাধারণত পাওয়া যায় না। তবে কান্নার জন্য ভাড়াখাটুনি মহিলারা যেসব গান গেয়ে থাকে, তাতে কান্না উদ্রেককারী, ভয়ভীতি সৃষ্টিকারী এবং বিপদগ্রস্ত লোকদের ধৈর্য হারানোর ও আল্লাহর ফয়সালা মেনে না নেওয়ার মতো উপাদান থাকে- যা শরিয়তে নিন্দনীয়।

 

<< প্রথম পর্ব

২৯২ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top