ইসলামে মিউজিক দৃষ্টিভঙ্গি (প্রথম পর্ব)

ইসলাম নান্দনিকতার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলাম মানুষের সৌন্দর্য উপলব্ধিকারী ইন্দ্রিয়কে সজীব করতে চায়। কিছু কিছু নান্দনিকতা মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, আবার কিছু দর্শনেন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত। অন্যান্য ইন্দ্রিয়সমূহের সাথেও কিছু কিছু নান্দনিকতার সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমি এখন গান সম্বন্ধে আলোচনা করতে চাই, হোক তা মিউজিক সহকারে বা মিউজিকবিহীন। এখানে আমরা সেই বিখ্যাত প্রশ্নটির উত্তর আলোচনা করতে চাই- গান ও মিউজিক সম্বন্ধে ইসলামের হুকুম কী?

 

গান ও মিউজিক সম্বন্ধে ইসলামের হুকুম কী?

এটি একটি বহুল আলোচিত প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তরে মুসলিমরা দ্বিধাবিভক্ত। জবাবের দ্বিধাবিভক্তির কারণে তাদের আচার-আচরণও বিভিন্ন ধরনের হয়েছে। তাদের কেউ সব ধরনের গান ও মিউজিক কান পেতে শোনে। তারা এরকম দাবিও করে যে, গান অপরাপর হালাল বস্তুর মতো একটি। এটি হালালই। কারণ, আল্লাহ পাক এটাকে তাঁর বান্দাদের জন্য হারাম করেননি।

আবার কেউ যেকোনো ধরনের গানের শব্দ কানে এলেই রেডিও বন্ধ করে দেন কিংবা নিজের কান বন্ধ করে নেন। তারা বলেন, গান হলো শয়তানের বাঁশি ও বেহুদা কথা, যা আল্লাহর যিকির ও নামাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে। বিশেষত গায়ক যদি হয় কোনো নারী। কারণ, তাদের মতে নারীর কণ্ঠস্বর গান ছাড়াই সতরের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি তা গানের হয় তা হলে (তা হরাম হওয়ার কথা সহজেই অনুমেয়)। তারা তাদের অভিমতের পক্ষে কুরআনের কয়েকটি আয়াত, রাসূলের কিছু হাদিস এবং কিছু আলেমের অভিমত ও উক্তি দলিল হিসেবে পেশ করেন। আবার তাদের কেউ যেকোনো ধরনের মিউজিক প্রত্যাখ্যান করেন, এমনকি রেডিও টেলিভিশনে সংবাদের পূর্বে প্রচারিত মিউজিক পর্যন্ত বর্জন করেন।

তৃতীয় আরেক দল এ উভয় দলের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন। তারা কখনও এক পক্ষে, আবার কখনও অন্য পক্ষে অবস্থান নেন। তারা অবশ্য এ বিষয়ে আলেমদের কাছে প্রশান্তিদায়ক চূড়ান্ত ফতোয়া কামনা করেন। কারণ, বিষয়টি মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। বিশেষত শ্রবণীয় ও দর্শনীয় প্রচারমাধ্যম মানুষের বাড়িঘরে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রবেশ করেছে: এর ফলে গান-মিউজিকও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাদের শ্রবণেন্দ্রিয়কে আকৃষ্ট করছে। তাই তারা গান ও মিউজিক সম্পর্কে মনে প্রশান্তি আসার মতো ফয়সালা প্রত্যাশা করেন।

মিউজিক সহ ও মিউজিক ছাড়া গান এমন একটা বিষয় যা নিয়ে আলেমদের মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। তারা কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন, আবার কিছু বিষয়ে মতভেদে লিপ্ত রয়েছেন।

তারা ওইসব গান হারাম হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন- যাতে অশ্লীলতা ও ফাসিকি বিদ্যমান এবং যা গুনাহর দিকে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ, গানের কথাই তো মূল- তার মধ্যে যা ভালো তা ভালোই, আর যা মন্দ তা মন্দই। যেসব উক্তিতে হারাম কিছু রয়েছে তা হারাম। অতএব, তার সাথে যদি ছন্দ, সুর ও হৃদয়গ্রাহী কিছু থাকে, তাহলে তার অবস্থা কীরূপ হতে পারে? তা সহজেই অনুমেয়।

একইভাবে তারা অশ্লীলতা ও ফাসিকিমুক্ত গান হালাল হওয়ার ব্যাপারেও ঐকমত্যে উপনীত হয়েছেন- যা বাদ্যযন্ত্রমুক্ত ও উত্তেজক নয় এমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাওয়া হয়ে থাকে। আর তা যদি হয় বৈধ আনন্দ-বিনোদনের স্থানে, যথা- বিয়ের অনুষ্ঠানে, কাউকে স্বাগত জানানোর সময়, ঈদের দিন ইত্যাদিতে। তবে শর্ত হলো- তা পরপুরুষের সামনে কোনো নারীর কণ্ঠে গাওয়া যাবে না।

এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াত ও হাদিস রয়েছে; আমরা পরে তা আলোচনা করব।

এ ছাড়া বাকি অন্যান্য গানের ব্যাপারে তারা সুস্পষ্ট মতপার্থক্যে লিপ্ত। তাদের মধ্যে কেউ সব ধরনের গানকে হালাল বলেন- তা বাদ্যযন্ত্র সহ হোক কিংবা বাদ্যযন্ত্র বিহীন। আর কেউ কেউ সব ধরনের গান-বাজনা হারাম ঘোষণা করেন- তা বাদ্যযন্ত্র সহ হোক বা বাদ্যযন্ত্র ছাড়া। এমনকি তারা তা কবিরা গুনাহ বলেও উল্লেখ করেছেন।

বিষয়টির গুরুত্বের কারণে এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা জরুরি বলে মনে করি। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ প্রসঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা করাও আবশ্যক মনে করি- যাতে মুসলিমরা অকাট্য দলিলের অনুসরণ করে হালাল ও হারাম আলাদা করে নিতে পারে। তাদের যেন কারও কথার অন্ধ অনুসরণ করতে না হয়। তারা যেন দলিলের ভিত্তিতে এ বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হতে পারে এবং যথার্থ অবস্থান গ্রহণ করতে পারে।

 

সাধারণত সবকিছুই হালাল

আলোচনার শুরুতে আমাদের একটি মূলনীতি জেনে নেওয়া আবশ্যক। তা হলো- আলেমগণ এ সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, মূলত সকল বস্তু হালাল। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

“তিনিই তোমাদের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা বাকারা: ২৯)

কাজেই সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ নস (কুরআন-সুন্নাহর উক্তি) কিংবা নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত ইজমা ছাড়া কোনো কিছু হারাম হতে পারে না। অতএব, নস ও ইজমা না থাকলে; অথবা নস সুস্পষ্ট, কিন্তু সহিহ না হলে; কিংবা সহিহ, কিন্তু সুস্পষ্ট না হলে; সে নস কোনো কিছু হালাল হওয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে না। এ অবস্থায় বস্তুটি বিস্তৃত হালালের গণ্ডিতেই থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَقَدْ فَضَلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ

“তোমাদের জন্য যা হারাম করা হয়েছে, তা বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও হালাল যদি তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও।” (সূরা আনআম: ২৯)

রাসূল সা. বলেছেন, “যা আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাবে হালাল করেছেন তা হালাল, আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যেসব বিষয়ে নিরবতা অবলম্বন করেছেন তা ক্ষমাকৃত। সুতরাং তোমরা আল্লাহর ক্ষমাকৃত বস্তু গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ কোনো কিছু ভুলে যান না।”

অতঃপর রাসূল সা. তিলাওয়াত করেন- وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا – ‘তোমার রব কোনো কিছু ভুলে যান না’ আয়াতটি।” রাসূল সা. আরও বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা কিছু কাজ ফরজ করে দিয়েছেন, তোমরা তা কখনও বর্জন করেবে না। আর কিছু ব্যাপারে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা লঙ্ঘন করবে না। তিনি দয়াপরবশ হয়ে (ভুলে গিয়ে নয়) কিছু ব্যাপারে নীরব থেকেছেন, সেসব ব্যাপারে অনুসন্ধান করবে না।

এটি যেহেতু শরিয়াহর একটি মূলনীতি, তাই কোন নস বা দলিলের ওপর ভিত্তি করে কেউ গান হারাম ঘোষণা করেছেন, আবার কেউ গানকে বৈধ ঘোষণা করেছেন- তা জানা আবশ্যক।

 

গান হারাম ঘোষণাকারীদের দলিল ও তার পর্যালোচনা

ক. গান হারাম ঘোষণাকারীগণ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও কোনো কোনো তাবেয়ি থেকে বর্ণিত এক বর্ণনার ওপর নির্ভর করেছেন। তারা নিম্নোক্ত আয়াতকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে গান হারাম বলে মন্তব্য করেছেন-

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهُوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَ هَا هُزُوًا أُولَئِكَ

لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِين

“এক শ্রেণির লোক মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা (লাহওয়াল হাদিস) সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা দ্বারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্যই অবমাননাকর শাস্তি।” (সূরা লুকমান: ৬)

তারা এ আয়াতের لَهُوَ الْحَدِيثِ (অবান্তর কথাবার্তা)-কে গান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ব্যাখ্যার পর্যালোচনায় ইমাম ইবনে হাযম বলেন, “কয়েকটি কারণে এ দলিল গ্রহণযোগ্য নয়-

এক. রাসূল সা. ছাড়া আর কারও কথা হুজ্জত বা প্রমাণ নয়।

দুই. অপরাপর সাহাবি ও তাবেয়িগণ এ ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত করেছেন।

তিন. স্বয়ং আয়াতের বাক্যাবলিই তাদের এ ব্যাখ্যাকে বাতিল করে। কারণ তাতে বলা হয়েছে- ‘এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করে।’ নিঃসন্দেহে যারা এ কাজ করবে তারা তো কাফিরই গণ্য হবে। কেননা, তারা আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তু বানায়।”

তিনি আরও বলেন, “কোনো মানুষ যদি এ উদ্দেশ্যে আল-কুরআনও খরিদ করে যে, তা দ্বারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে, তাহলে তো সে-ই কাফির হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা এ আয়াতে এরূপ কর্মেরই নিন্দা করেছেন।

আর যারা অবান্তর কথাবার্তা বা গান আনন্দ-বিনোদন ও মনে প্রশান্তি আনার জন্য খরিদ করে, আর এর মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্য না থাকে- এ আয়াতে তাদের নিন্দা করা হয়নি। অতএব, তাদের উপর্যুক্ত বক্তব্যের সাথে আয়াতের সম্পর্ক নেই বলে প্রমাণিত হলো।

তেমনিভাবে যারা কুরআন তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, অবান্তর কথাবার্তা, গানবাজনা কিংবা অন্য যেকোনো কাজে ব্যস্ত থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দেয়, তারা ফাসিক ও আল্লাহর নাফরমান। আর যারা উপর্যুক্ত যেকোনো কাজে সময় কাটায়, কিন্তু কোনো ফরজ কাজ থেকে গাফেল হয়ে পড়ে না তারা অবশ্যই সৎকর্মশীল।”

 

খ. তারা মুমিনের প্রশংসায় অবতীর্ণ এ আয়াতকেও দলিল হিসেবে নিয়েছেন-

وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ

“যখন তারা (মুমিনরা) অনর্থক কোনো কথাবার্তা শুনে, তা এড়িয়ে যায়। (সূরা কাসাস: ৫৫)

তাদের মতে গানও اللَّغْوَ বা অনর্থক কথাবার্তার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।

এ বক্তব্যের পর্যালোচনায় বলা যায়, এ আয়াতের স্বাভাবিক অর্থ হলো- এখানে اللَّغْوَ বা অনর্থক কথাবার্তা বলতে গালাগালি, ভর্ৎসনা, তিরস্কার জাতীয় মন্দ কথা বোঝানো হয়েছে। আয়াতের বাকি অংশ তা-ই প্রমাণ করে-

وَإِذَا سَمِعُوا اللَّهُوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا تَبْتَغِي

الْجَاهِلِينَ

“তারা যখন অবাঞ্ছিত কথাবার্তা শুনে, তা এড়িয়ে যায় এবং বলে- আমাদের জন্য আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।” (সূরা কাসাস: ৫৫)

মূলত আয়াতটি রহমানের বান্দাহদের প্রশংসায় আসা এ আয়াতের মতোই-

وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا

“যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদের সম্বোধন করে, তখন তারা বলে- তোমাদের প্রতি সালাম।” (সূরা ফুরকান: ৬৩)

যদি আমরা ধরেই নিই যে, উক্ত আয়াতের বা অনর্থক কথাবার্তা গানকেও শামিল করে; তাহলেও আমরা দেখতে পাই যে, আয়াতটি গান শোনা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব প্রমাণ করে, ওয়াজিব প্রমাণ করে না। কারণ, لغو শব্দটি باطل শব্দের মতোই ‘অনর্থক’ অর্থ দেয়। আর অনর্থক কিছু শোনা হারাম নয়, যতক্ষণ না কারও হক বিনষ্ট হয় বা তা কোনো ওয়াজিব কর্ম থেকে বিরত রাখে।

ইবনে জুরাইয থেকে বর্ণিত আছে, তিনি গান শোনা বৈধ মনে করতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘গান কিয়ামত দিবসে আপনার সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে, না অসৎকর্মের?’ তিনি বললেন, ‘তা না সৎকর্মের আর না অসৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে। কারণ, তা তো لغو বা অনর্থক কথার মতোই। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

لا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ

“আল্লাহ পাক তোমাদের বা অর্থহীন শপথের জন্য পাকড়াও করবেন না।” (সূরা বাকারা: ২২৫, সূরা মায়িদা: ৮৯)

ইমাম গাযালি বলেন, “যদি আল্লাহর নামে অর্থহীন শপথ করার কারণে (যাতে দৃঢ় প্রত্যয় ও ইচ্ছা থাকে না এবং বিরোধিতা করার চিন্তাভাবনাও থাকে না) আল্লাহ তায়ালা কাউকে পাকড়াও না করেন; তা হলে কি করে ভাবতে পারি যে, গান গাওয়ার জন্য পাকড়াও করবেন?”

আমরা বলতে চাই, সব গান لغو বা অর্থহীনও নয়। গানের হুকুম হবে তার গায়ক ও শ্রোতার নিয়ত অনুযায়ী। সৎ নিয়ত খেলাধুলা ও রসিকতাকেও ইবাদত এবং সৎকর্মে পরিণত করে। আর মন্দ নিয়ত বাহ্যত ইবাদতকে ধ্বংস ও পণ্ড করে দেয়, যেমন প্রদর্শনেচ্ছাযুক্ত ইবাদত- “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা ও বাহ্য আমলের দিকে তাকান না; তিনি তাকান তোমাদের অন্তর ও প্রদর্শন ইচ্ছাহীন আমলের দিকে।”

আমরা এখানে ইমাম ইবনে হাযমের আল-মুহাল্লায় উল্লিখিত একটি চমৎকার উক্তি উল্লেখ করতে চাই। তিনি কথাটি যারা গান নিষেধ করেন, তাদের কথা প্রত্যাখ্যান করেই বলেছেন, “তারা বলেন, গান কি হক না নাহক? তৃতীয় কোনো কিছু হওয়ার তো অবকাশ নেই! কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ .

“হকের পর গোমরাহি ছাড়া তো আর কিছু নেই।” (সূরা ইউনুস: ৩২)

এ প্রসঙ্গে আমাদের জবাব হলো- রাসূল সা. বলেছেন, ‘আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকেই তাই পাবে যা সে নিয়ত করে।’ সুতরাং যে আল্লাহর নাফরমানির উদ্দেশ্যে গান শোনার নিয়ত করবে, সে ফাসিক। অন্যসব বিষয়েও একই কথা। আর যে মানসিক প্রশান্তি পেতে, আল্লাহর ইবাদত- বন্দেগির জন্য নিজেকে সতেজ করতে কিংবা ভালোকাজে নিজেকে সক্রিয় করার উদ্দেশ্যে গান শুনবে, সে আল্লাহর আনুগত্যকারী সৎকর্মশীল বলে গণ্য হবে। তার এ কর্মও সত্য ও হক বলে পরিগণিত হবে।

আর যে ব্যক্তি গান শোনার ক্ষেত্রে কোনো ইবাদত বা নাফরমানির নিয়ত করে না, তার সে গান শোনা হবে অর্থহীন বৈধ কর্ম। যেমন- বাগানে পয়চারি করা, বাড়ির আঙিনায় নিরিবিলি বসে থাকা, পোষাকে বিভিন্ন কালার ব্যবহার ইত্যাদি কাজ। এগুলো যেমন বৈধ, গান শোনাও ঠিক তেমনই বৈধ।”

 

গ. তারা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারাও দলিল পেশ করেন- “মুমিনের জন্য তিন ধরনের খেল-তামাশা ছাড়া বাকি সব খেল-তামাশা বাতিল। নিজ স্ত্রীর সাথে খেল-তামাশা, নিজের ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দান এবং নিজের তীর থেকে তীর নিক্ষেপ করা।”

গান যেহেতু এই তিনটির বাইরের বিনোদন, সুতরাং তা বাতিল ও অবৈধ।

যারা গান বৈধ বলে অভিমত পোষণ করেন, তারা এর জবাবে বলেন- উপর্যুক্ত হাদিসটি দুর্বল। আর হাদিসটি সহিহ হলেও তা গান হারাম হওয়ার দলিল হবে না। কারণ, হাদিসে ব্যবহৃত ‘বাতিল’ শব্দটি হারাম বোঝায় না; বরং তা অর্থহীন কর্ম বোঝায়। আবু দারদা রা. বলেন, “আমি নিজেকে কখনও কখনও বাতিল কাজে ন্যস্ত করি- যাতে এর মাধ্যমে হক কাজ করার শক্তি পাই।”

তা ছাড়া হাদিসটির উদ্দেশ্য কেবল এ তিনটি কাজকে সীমাবদ্ধ করাও নয়। কারণ, সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত মসজিদে নববিতে হাবশিদের খেলা প্রদর্শন এবং তা থেকে আনন্দ উপভোগ করাও উপযুক্ত তিন কর্মের বাইরের একটি খেলাধুলা। তা ছাড়া বাগানে বা পার্কে ঘোরাফেরা করা, পাখ-পাখালির কাকলি শোনা অথবা খেলাধুলা করা ইত্যাদি- যা দ্বারা সাধারণত মানুষ নিষ্কলুষ আনন্দ-বিনোদন উপভোগ করে তার কিছুই হারাম নয়; যদিও এসব কাজকে বাতিল ও অনর্থক কাজ বলা যায়।

 

ঘ. তারা ইমাম বুখারি কর্তৃক আবু মালিক ও আবু আমির আশআরির বরাতে মুআল্লাক সনদে রাসূল সা. থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন। সে হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “অচিরেই আমার উম্মাহর মধ্যে এমন কিছু লোক হবে, যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও মাআযিফকে হালাল মনে করবে।”

তাদের মতে ‘মাআযিফ’ শব্দের অর্থ হলো বাদ্যযন্ত্র ও খেলাধুলা।

এ হাদিসটি সহিহ বুখারিতে থাকলেও ধারাবাহিক সনদে বর্ণিত নয়; বরং মুআল্লাক তথা বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত। এ কারণেই ইমাম ইবনে হাযম এ হাদিসটি দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তা ছাড়া তিনি আরও বলেছেন, এ হাদিসটির সনদ এবং মতনও ইজতিরাব তথা বিভ্রাটমুক্ত নয়।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি হাদিসটি মুত্তাসিল (ধরাবাহিক সনদযুক্ত) প্রমাণ করার জন্য চেষ্টা করেছেন। কার্যতই তিনি তা নয়টি মুত্তাসিল সনদে বর্ণনাও করেছেন। তবে সব সনদেই এমন একজন রাবি আছেন, যার সম্পর্কে হাদিস যাচাই শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ নানান কথা বলেছেন। তিনি হলেন হিশাম ইবনে আম্মার। তিনি দামেশকের একজন খতিব, আলেম, মুহাদ্দিস ও কারি ছিলেন। ইবনে মুঈন ও আল আজালি তাকে নির্ভরযোগ্য রাবি বলে মন্তব্য করলেও ইমাম আবু দাউদ তার সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন- “তিনি ভিত্তিহীন চল্লিশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।”

আবু হাতিম বলেন, “তিনি সত্যবাদী, তবে তার অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল। তার কাছে যা কিছু দেওয়া হয়েছিল তিনি সবকিছু পড়েছিলেন, আর যা কিছু শুনানো হয়েছিল তা সবই গ্রহণ করেছিলেন।” ইবনে সাইয়ারও তার সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করেছেন।

ইমাম আহমাদ তার সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “তিনি বাউন্ডুলে, হালকা স্বভাবের মানুষ।” ইমাম নাসায়ি বলেন, “তাকে নিয়ে তেমন সমস্যা নেই।” (তবে এ বক্তব্য তাকে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ করে না)। হাফেজ যাহাবি তার পক্ষাবলম্বন করা সত্ত্বেও বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “তিনি সত্যবাদী, বেশি হাদিস বর্ণনাকারী। তবে তার বর্ণিত এমন কিছু হাদিস আছে যা মুনকার (দুর্বল) পর্যায়ের।১০

তাঁর সম্বন্ধে আরও মন্তব্য করা হয়েছে যে, “তিনি পারিশ্রমিক ছাড়া কোনো হাদিস বর্ণনা করতেন না।”

এ ধরনের ব্যক্তির হাদিস বিতর্কিত বিষয়ে গ্রহণ করা যায় না। বিশেষত তা যদি হয় এমন বিষয়, যা সর্বসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এ তো গেল হাদিসটি সহিহ হওয়ার ব্যাপারে কথা। হাদিসটির তাৎপর্য ও অর্থের ব্যাপারেও নানা কথা আছে। হাদিসে উল্লেখিত ‘মাআযিফ’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী- সে ব্যাপারেও কোনো ঐকমত্য হয়নি। বলা হয়েছে, এর অর্থ হলো- খেলাধুলা। এ অর্থটি অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্টবাচক। আর কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হলো- ছয় বা আট তারের গোলাকৃতির বাদ্যযন্ত্র বিশেষ।

যদি ধরে নিই যে তার অর্থ বাদ্যযন্ত্র, তাহলেও বুখারির উক্ত মুআল্লাক হাদিসটির বাক্য সুস্পষ্টভাবে মাআযিফ বা বাদ্যযন্ত্রকে হারাম প্রমাণ করে না। কারণ, ইবনে আরাবির মতে, “হালালজ্ঞান করবে- বাক্যটির দুই ধরনের অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম অর্থ হলো, তারা মনে করবে এসব কর্ম হালাল। আর দ্বিতীয় অর্থটি হলো রূপক; অর্থাৎ এসব জিনিস তারা ব্যাপকহারে ব্যবহার করবে। যদি প্রথম অর্থটি অর্থাৎ ‘হালালজ্ঞান করবে’ এটাই এ হাদিসের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তো তারা কাফির হয়ে যাবে! কারণ, ইজমা মতে নিশ্চিত হারাম জিনিসকে যথা- মদ, যিনা, ইত্যাদিকে হালাল বলে বিশ্বাস করা কুফরি।”

আর যদি আমরা মেনে নিই যে, তা হারাম বোঝায়, তাহলে তা থেকে কি বোঝা যায় যে, উক্ত সবকিছু যথা- যিনা, রেশম, মদ, বাদ্যযন্ত্র সম্মিলিতভাবেই হারাম? নাকি প্রত্যেকটি আলাদা আলাদাভাবেই হারাম? প্রথম অর্থটি সঠিক ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। কারণ হাদিসটি প্রকৃতপক্ষে এমন একদল মানুষের স্বভাব বোঝানোর জন্য ব্যক্ত হয়েছে, যারা লাল রজনিতে মদ্য পান করে মাতাল হয়ে থাকে। নারী, মাদকদ্রব্য, গান-বাজনা, রেশমি পোশাক ও ব্যভিচার ইত্যাদিতে মত্ত থাকে।

ইবনে মাজাহ হাদিসটি আবু মালেক আশআরি থেকে নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক মদ পান করবে, যারা একে অন্য নাম দেবে। তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকাদের গান গাওয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের নিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করবেন এবং তাদের মধ্য হতে বানর ও শূকর বানানো হবে।” হাদিসটি ইবনে হিব্বান তাঁর সহিহ-তে এবং ইমাম বুখারি তার তারিখ-এ বর্ণনা করেছেন।

আর যারাই হাদিসটি হিশাম ইবনে আম্মারের সূত্র ছাড়া অন্য সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তারা তাতে মূলত মদ্যপানের জন্য তিরস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন। আর ‘মাআযিফ’ বা বাদ্যযন্ত্রের কথা তার অনুগামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

 

ঙ. যারা গান হারাম বলে অভিমত পোষণ করেন, তারা আয়িশা রা. এর নিন্মোক্ত হাদিস দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন- “আল্লাহ তায়ালা গায়িকা দাসীর বেচাকেনা, তার মূল্য গ্রহণ এবং তাকে গান শেখানো হারাম করেছেন।”

এর জবাব হলো-

প্রথমত: হাদিসটি দুর্বল, এমনকি গায়িকা দাসীর ক্রয়-বিক্রয় সম্বন্ধে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা সবই দুর্বল।১১

দ্বিতীয়ত: ইমাম গাযালি বলেন, হাদিসে যে দাসীর কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা সেসব দাসীর কথাই বোঝানো হয়েছে, যারা পানশালায় পুরুষদের গান গেয়ে শোনায়। পরনারীর জন্য ফাসিক-ফাজির যাদের ফিতনায় পড়ার আশঙ্কা আছে তাদেরকে গান শোনানো হারাম। তারা ফিতনা বলতে নিষিদ্ধ কর্ম বুঝিয়ে থাকেন। এ হাদিস থেকে দাসী কর্তৃক তার মালিককে গান শোনানো হারাম সাব্যস্ত করা যায় না; বরং মালিক ছাড়া অন্য কাউকে শোনানো- যদি তাতে ফিতনার সম্ভাবনা না থাকে, তাও হারাম প্রমাণ হয় না। বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আয়িশা রা.-এর বাড়িতে দুই দাসীর গান করা সংক্রান্ত হাদিসটি তাই প্রমাণ করে।১২

তৃতীয়ত: ওইসব গায়িকা দাসীরা ছিল দাসপ্রথার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যে দাসপ্রথাকে ইসলাম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিল। ইসলামের এই চিন্তা-দর্শনের সাথে ইসলামি সমাজে তাদের বাকি রেখে তাদের বেচা-কেনা করা সংগতিশীল ছিল না। কাজেই হাদিসে যদি গায়িকা দাসীদের মালিক হওয়া ও বেচা-কেনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনো বাণী এসে থাকে, তাহলে তা এজন্য যে, ঘৃণিত দাসপ্রথা যেন বিলুপ্ত হয়ে যায়।

 

চ. তারা আরও দলিল দেন নাফে কর্তৃক ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা। তাতে বলা হয়েছে, “ইবনে উমর রা. একবার এক রাখালের বাঁশির শব্দ শুনতে পান, তখন তিনি তাঁর দুই কানে আঙুল দিয়ে রাস্তা পরিবর্তন করে অন্য রাস্তা দিয়ে তাঁর বাহন চালিয়ে যান। তখন তিনি বলছিলেন, ‘নাফে, তুমি কি (বাঁশির শব্দ) শুনতে পাচ্ছ?’ তখন আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ।’ তখন তিনি আরও কিছু দূর চলে গেলেন। পরিশেষে যখন আমি বললাম, ‘এখন শোনা যাচ্ছে না’, তখন তিনি তাঁর দুই কান থেকে আঙুল বের করে নিলেন এবং বাহন পূর্বের রাস্তায় নিয়ে এলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আমি রাসূল সা. কে এক রাখালের বাঁশির শব্দ শুনে এরূপ করতে দেখেছিলাম’।”১৩

ইমাম আবু দাউদ বলেন, “এ হাদিসটি মুনকার বা দুর্বল।”

এ হাদিসটি সহিহ হলে তা গান হারামকারীদের বিরুদ্ধে দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হবে, তাদের পক্ষে নয়। কারণ, বাঁশির শব্দ শোনা হারাম হলে রাসূল সা. কখনও ইবনে উমর রা.-কে তা শুনতে দিতেন না। আর ইবনে উমর রা.ও তা হারাম মনে করলে নাফেকে তা শুনতে দিতেন না; বরং নবি কারিম সা. অবশ্যই এ নিষিদ্ধ কাজ বন্ধ করার জন্য আদেশ দিতেন। নবি কারিম সা. ইবনে উমর রা. কে তা শুনতে দেওয়া থেকে প্রমাণ হয় যে, তা শোনা হালাল।

আর রাসূল সা. এর তা না শোনার ব্যাপারটি ছিল দুনিয়ার অনেক মুবাহ বা বৈধ কাজ থেকে তাঁর বিরত থাকার মতোই। যেমন- তিনি কোনো কিছুর ওপর ঠেক লাগিয়ে পানাহার পরিহার করতেন, তাঁর কাছে দিনার ও দিরহাম রেখে ঘুমাতেন না ইত্যাদি।

 

ছ. গান হারাম মন্তব্যকারীরা আরও দলিল দিয়েছেন সেই বর্ণনা দ্বারা- যাতে বলা হয়েছে, “গান মানুষের মনে মুনাফিকি জন্ম দেয়।” এটি রাসুল সা. -এর হাদিস হিসেবে প্রমাণিত নয়। এটি জনৈক সাহাবি বা কোনো কোনো তাবেয়ির কথা বলে প্রমাণিত।

এটি এমন কিছু মানুষের বক্তব্য যারা মাসুম নন; আর এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত করেছেন এমনই আরও কিছু মানুষ। কিছু মানুষ বিশেষ করে সুফিদের কেউ কেউ বলেছেন- গান মানুষের হৃদয়কে নম্র করে। আল্লাহর নাফরমানির জন্য মনের মধ্যে বিবেকের দংশন সৃষ্টি করে। মানুষকে লজ্জিত করে। আল্লাহর ভালোবাসা লাভের জন্য উৎসাহিত করে।

এ কারণে তারা নতুন প্রেরণা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি, প্রত্যয়কে শাণিত করা এবং অন্তরের আগ্রহকে মজবুত করার জন্য গানকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারা আরও বলেছেন, এটি এমন একটি বিষয়- যা বাস্তব জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি ছাড়া বোঝা সম্ভব নয়। যারাই তা শোনেন, শুধু তারাই তা বোঝেন। কারণ, বাস্তব চাক্ষুস অভিজ্ঞতা আর কারও কাছ থেকে শোনা কথা এক নয়।

ইমাম গাযালি বলেন, “হাদিসের ‘মুনাফিকি জন্ম দেয়’ বাক্যটি শ্রোতার ক্ষেত্রে নয়; বরং গায়কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে জানিয়েছেন। যদি গায়কের উদ্দেশ্য হয় অন্যের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করা এবং তার নিজের গান মানুষের মাঝে জনপ্রিয় করা, তবে গান তার হৃদয়ে নিফাকি সৃষ্টি করে। সে যদি মানুষকে তার গানের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য মুনাফিকি করতে থাকে, তবে গান তার হৃদয়ে তা জন্ম দেয়।”

ইমাম গাযালি আরও বলেন, “এ যুক্তিতে গানকে হারাম সাব্যস্ত করা যায় না। কারণ, ভালো ও সুন্দর পোশাক পরিধান, চমৎকার ঘোড়ায় আরোহণ, সৌন্দর্য উপকরণ ব্যবহার ইত্যাদিকে হারাম বলা যায় না। অথচ এগুলোতেও রিয়া থাকে। হৃদয়ে মুনাফিকি কেবল আল্লাহর নাফরমানি থেকে সৃষ্টি হয় এমন নয়; বরং অনেক মুবাহ ও বৈধ কাজও যার ওপর সাধারণত মানুষের দৃষ্টি পড়ে- তা অনেক সময় নিফাকি সৃষ্টির ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রভাব রাখে।”

 

জ. গান হারাম বলে মন্তব্যকারীরা নারীদের গানকে হারাম বলে প্রমাণ করতে বহুল প্রচলিত এ কথাটিও বলেন যে, “নারীর কণ্ঠস্বরও সতরের অন্তর্ভুক্ত।” নারীরা রাসূল সা. কে বিভিন্ন বিষয়ে সাহাবাদের সামনেই নানা প্রশ্ন করতেন। সাহাবারাও উম্মুল মুমিনিনদের কাছে বিভিন্ন ফতোয়া জিজ্ঞাসা করার জন্য যেতেন, আর তাঁরাও ফতোয়া দিতেন, তাদের সাথে কথাও বলতেন। কিন্তু কেউ কখনও বলেননি যে, মা আয়িশা রা. ও অন্যান্যদের এ কর্ম পর্দা লঙ্ঘন, যা ওয়াজিব ছিল। অথচ নবি কারিম সা.  এর স্ত্রীদের প্রতি পর্দা অবলম্বনের ব্যাপারে বিশেষ ধরনের কড়া নির্দেশ ছিল- যা অন্যদের প্রতি অত কঠোর ছিল না। আল্লাহ তায়ালা তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-

يَانِسَاءِ النَّبِيِّ لَسْتُنَ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاء إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ

مرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا .

“নবির স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও। সুতরাং পরপুরুষের সাথে কোমল স্বরে কথা বলো না, যেন যার অন্তরে রোগ আছে সে প্রলুব্ধ না হয়; বরং প্রথামত ন্যায়সংগত কথা বলবে।” (সূরা আহযাব: ৩২)

যদি বলা হয়, এ এটি সাধারণ কথা-বার্তা প্রসঙ্গে প্রযোজ্য, গানের ক্ষেত্রে নয়, তাহলে আমরা বলব- বুখারি মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, নবি কারিম সা. দুই দাসীর গান শুনেছিলেন, তাদের গান করতে নিষেধ করেননি। আবু বকর রা. যখন তাদের নিষেধ করলেন, তখন বলেছিলেন, “তাদের গাইতে দাও।” ইবনে জাফর ও অন্যান্য সাহাবি এবং তাবেয়িগণও দাসীদের গান শুনেছেন।

 

ঝ. তারা তিরমিযিতে আলী রা. থেকে মারফু সনদে বর্ণিত একটি হাদিস দ্বারাও দলিল দিয়ে থাকেন। সে হাদিসে আছে- “আমার উম্মত যখন পনেরোটি কাজ করতে থাকবে তখন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে।” তার মধ্যে উল্লেখ আছে- “যখন তারা গায়িকা দাসী গ্রহণ করবে এবং বাদ্যযন্ত্র তৈরি করবে।” এ হাদিসটি সকল মুহাদ্দিসের ঐকমত্যে একটি দুর্বল হাদিস। সুতরাং তা দলিল দানের উপযোগী নয়।

মোদ্দা কথা, যেসব নস দ্বারা গান হারাম হওয়ার দলিল দেওয়া হয়, সেসবের কোনোটি হয়তো সহিহ, কিন্তু সুস্পষ্ট নয়। অথবা কোনো কোনোটি স্পষ্ট, কিন্তু সহিহ নয়। গান সুস্পষ্টভাবে হারাম বলার মতো রাসূলে কারিম সা. থেকে একটি মারফু হাদিসও সহিহ সনদে বর্ণিত হয়নি। তাদের বর্ণিত সকল হাদিসকে জাহেরি, মালেকি, হাম্বলি ও শাফেয়ি মাযহাবের এক দল আলিম দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন।

কাজী আবু বকর ইবনে আরাবি তাঁর আল-আহকাম গ্রন্থে বলেন, “এ ক্ষেত্রে হারাম বলার মতো কোনো হাদিস সহিহ বলে প্রমাণিত হয়নি।” ইমাম গাযালি ও ইবনে নাহাবিও উমদা নামক গ্রন্থে অনুরূপ কথা বলেছেন। ইবনে তাহির তাঁর আস-সিমা নামক গ্রন্থে বলেন, “এর (গানের হাদিসের) একটি বর্ণও সহিহ বলে প্রমাণিত হয়নি।”

ইমাম ইবনে হাযম বলেন, “এ প্রসঙ্গে একটি হাদিসও সহিহ বলে প্রমাণিত নয়। বরং এর সব কিছুই জাল ও বানোয়াট। আল্লাহর কসম! যদি এর সবগুলো হাদিস বা একটি হাদিস কিংবা একাধিক হাদিস রাসুলে কারিম সা. থেকে নির্ভরযোগ্য রাবিদের বর্ণনা মতে সহিহ বলে প্রমাণিত হতো, তাহলে আমরা তা গ্রহণ করতে মোটেও দ্বিধা করতাম না।”১৪

 

অনুবাদঃ ড. মাহফুজুর রহমান।

 

টীকা:

১. হাকিম আবু দারদা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন এবং সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন। হাদিসটি বাযযারও বর্ণনা করেছেন। আর আয়াতাংশটির সূত্র- (সূরা মারইয়াম: ৬৪)।

২. দারে কুতনি কর্তৃক আবু সালাবা আল খশনি থেকে বর্ণিত। হাফেজ আবু বকর মুসআলি তাঁর আমানি নামক গ্রন্থে আর ইমাম নববি তাঁর আরবাঈন গ্রন্থে হাদিসটি হাসান বলে মন্তব্য করেছেন।

৩. ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, (মুনিরিয়া) ৯, পৃ. ৬০।

৪. গাযালি, এহইয়াউ উলুমুদ্দিন, (মিশর দারুশ শাবাব), কিতাবুস সিমা, পৃ. ১১৪৭।

৫. আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত। মুসলিম কিতাবুল বির ওয়াছিলা ওয়াল আদাব, বাবু তাহরিমু যুলমিল মুসলিম।

৬. বুখারি, মুসলিম। উমর ইবনে খাত্তাব রা. বর্ণিত।

৭. ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, খণ্ড ৯, পৃ. ৬০।

৮. হাদিসটি চার সুনানে বর্ণিত হয়েছে। এর সনদে ইজতিরাব বা বিভ্রাট রয়েছে। হাফেজ ইরাকি এ কথা বলেন এহইয়াউ উলুমুদ্দিন-এর তাখরিজে।

৯. ইবনে হাজার, তাগলিকুত তালিক, খণ্ড ৫. পৃষ্ঠা ১৭-২২, বৈরুত: মাকতাবাতুল ইসলামি থেকে প্রকাশিত।

১০. যাহাবি, মিযানুল ইতিদাল, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩০২। ইবনে হাজার, তাহযিবুত তাহযিব, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৫১-৫৪।

১১. দেখুন, ইবনে হাযমের আল মুহাল্লা-র গান সম্বন্ধে আলোচনায় এসব হাদিস নিয়ে তাঁর পর্যালোচনা- খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৫৯।

১২. গাযালি, এহইয়াউ উলুমুদ্দিন, পৃষ্ঠা ১১৪৮।

১৩. আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ।

১৪. ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৫৯।

 

দ্বিতীয় পর্ব >>

৩২৪ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top