পাশ্চাত্য চিন্তা ও দর্শনের ঐতিহাসিক পর্যায়কাল সমূহ রয়েছে। এক এক দেশের দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ তাদের মত করে এই পর্যায়কালকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও সমধিক পরিচিত পর্যায়কাল সমূহ হল,
১। প্রাচীন (Ancient)
এই প্রাচীনকালকে আবার চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হল,
ক) প্রি-সক্রেটিস (খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী – পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত)
খ) সক্রেটিক (খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী – চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত)
গ) হেলেনিস্টিক (খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী – তৃতীয় শতাব্দী (খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত)
ঘ) রোমান (প্রথম শতাব্দী – পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত)
২। মেডিভাল ( Medieval)
এই মেডিভাল যুগকে আবার ২ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, সেগুলো হল,
ক) মেডিভাল ( ষষ্ঠ শতাব্দী – চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত)
খ) রেনেসাঁ ( পঞ্চদশ শতাব্দী – ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত)
৩। আধুনিক
একে আবার ৩ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হল,
ক) এইজ অফ রিজন (Age of Reason), সপ্তদশ শতাব্দী।
খ) এইজ অফ এনলাইটেনমেন্ট ( Age of Enlightenment) অষ্টাদশ শতাব্দী।
খ) আধুনিক সময়কাল, ( Modern Era) উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী।
আর একবিংশ শতাব্দীকে এখন অনেক চিন্তা ও দার্শনিক পোস্ট-ট্রুথ, পোস্ট হিউম্যান ইত্যাদি নামে অভিহিত করছেন।
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস এই ভাবে বিভাজিত করার কারণে এর ধারাবাহিকতা দেখাও যেমন সহজ তেমনিভাবে পাশ্চাত্য চিন্তা ও দর্শন কোন কোন পর্যায়কাল অতিক্রম করেছে এবং এখন কোন পর্যায়ে আছে সেটাও বুঝা যায় অতি সহজেই। যার ফলে পাশ্চাত্যে বেড়ে উঠা একজন যুবক বা শিক্ষার্থী সে কোন যুগে আছে তার কাজ কি হবে এটা সে খুব সহজেই নিরূপণ করতে পারে।
এখন আসা যাক ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসের দিকে। আমাদের চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে এইভাবে সাজানো হয়নি। আমরা এখনো ওরিয়েন্টালিস্টদের সাজিয়ে দেওয়া পর্যায়ের আলোকে আমাদের চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে অধ্যয়ন করে থাকি। যেমন তারা আমাদের চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে ‘গাজালী পূর্ব ইসলামী চিন্তা ও দর্শন’ এবং ‘গাজালী পরবর্তী চিন্তা ও দর্শন’ এই ভাবে সাজিয়ে দিয়েছে আমরাও এখনো এই বিভাজনের আলোকেই লিখছি ও পড়ছি!!
আর ওরিয়েন্টালিস্টরা খুব সূক্ষ্ম ভাবে গাজালী পরবর্তী সময়কালকে ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের পতন যুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন! এই প্রশ্নেরও জবাব আমরা দিতে পারিনি।
অনেক ইসলামী স্কলার ও চিন্তাবিদই এই বিষয় নিয়ে এখনো আলোচনা করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বলেন যে, ইসলামী উসমানী খিলাফতের পতনের আগ পর্যন্ত তথা উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের চর্চা মুসলিম বিশ্বের অনেক জায়গাতেই জারী ছিল। যেমন উসমানী খিলাফতের রাজধানী ইস্তানবুলে তখনো আলেমগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, মরক্কোতে আন্দালুসিয়ার ধারা অনেক শক্তিশালীভাবে জারী ছিল, মিশরের আল-আযহারে ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ধারা জারী ছিল। যার ফলে মুসলমানগণ আলাদা করে কোন পর্যায় কালে বিভক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেননি।
কিন্তু উসমানী খিলাফতের পতন ও সমগ্র বিশ্বে পাশ্চাত্য চিন্তা-দর্শন মুসলমানদের সকল অঙ্গনকে গ্রাস করে ফেললে মুসলিম যুবকগণ পাশ্চাত্য শিক্ষার কারণে নিজেদের অতীত ইতিহাসকে ভুলে যেতে থাকে এবং সত্যিকার অর্থে ইসলামী চিন্তা ও দর্শন বলতে কিছু ছিল কিনা এই বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তুলতে থাকে। কারণ যে সকল মুসলমানগণ ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাস লিখেছেন তাদের মধ্যে প্রায় সবাই ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে আংশিক ভাবে এনেছেন। কেউ আবার নিজেদের দেশের চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে হাইলাইট করতে গিয়ে অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিম চিন্তাবিদদের ইতিহাসকে ইচ্ছাকৃত ভাবে গোপন করেছেন।
আর পাশ্চাত্যের ওরিয়েন্টালিস্ট ও লেখকগণ তো রীতিমত ইসলামী চিন্তা ও দর্শনকে অস্বীকারই করেছেন। কোন কোন লেখক তাদের লেখায় স্থান দিলেও এই এক হাজার বছরের চিন্তা দর্শনের ইতিহাসকে ৫০ পৃষ্ঠা বা তার চেয়েও কম স্থান দিয়েছেন।
অবস্থা যখন এমন, সেই সময়ে ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে পূর্ণাংগভাবে তুলে ধরা দরকার ছিল। পাশ্চাত্যের জবাব দেওয়ার জন্য নয় কিংবা পাশ্চাত্যের তৈরি করে দেওয়া বৃত্তের মধ্যে থেকে নয়, যুবকগণ যেন ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে সামগ্রিক ভাবে অধ্যয়ন করে ইসলামী সভ্যতাকে সামনে নিয়ে যেতে পারে এই জন্য প্রয়োজন ছিল ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে পর্যায়ক্রমিক ভাবে তুলে ধরার । আর এই কাজে এগিয়ে আসেন তুরস্কের ইসলামী স্কলারগণ। প্রায় ২০০ র বেশী গবেষক দীর্ঘ ৩ বছর গবেষণা করে ২০১৭ সালে ‘ইসলামী চিন্তার এটলাস ‘ নামে ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের সামগ্রিক একটি রূপরেখা তুলে ধরেছেন। আর ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ধারাবাহিকতাকে তুলে ধরার জন্য ইসলামী চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাসকে ৪ টি পর্যায়কালে বিভক্ত করেছেন। সেগুলো হল,
১। ক্ল্যাসিক পর্যায় (Classical Period)
( সপ্তম শতাব্দী / প্রথম হিজরী – একাদশ শতাব্দী / পঞ্চম হিজরী পর্যন্ত),
এই সময়কালকে আবার ২ ভাগে ভাগ করেছেন,
ক) উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশকাল (সপ্তম শতাব্দী / প্রথম হিজরী – অষ্টম শতাব্দী / দ্বিতীয় হিজরী পর্যন্ত)
খ) শ্রেণীবিন্যাস ও সুবিন্যস্ত করণ ( নবম শতাব্দী / তৃতীয় হিজরী- একাদশ শতাব্দী / পঞ্চম হিজরী পর্যন্ত)
২। নবায়ন পর্যায় (Renewal Period)
( দ্বাদশ শতাব্দী / ষষ্ঠ হিজরী – ষোড়শ শতাব্দী / দশম হিজরী পর্যন্ত)
এই নবায়নের (Renewal Period) পর্যায়কে আবার ২ ভাগে ভাগ করেছেন,
ক) নবায়ন পর্যায়কাল (I) ( Early Renwal Period) (দ্বাদশ শতাব্দী / ষষ্ঠ হিজরী – চতুর্দশ শতাব্দী/ অষ্টম হিজরী পর্যন্ত)
খ) নবায়ন পর্যায়কাল (II) ( Late Renewal Period) ( পঞ্চদশ শতাব্দী/ নবম হিজরী – ষোড়শ শতাব্দী/ দশম হিজরী পর্যন্ত)
৩। পুনঃমূল্যায়নের পর্যায়কাল ( Evaluation Period)
( সপ্তদশ শতাব্দী / একাদশ হিজরী – অষ্টাদশ শতাব্দী / দ্বাদশ হিজরী পর্যন্ত)
এই পুনঃমূল্যায়নের পর্যায়কালকে আবার দুইভাবে ভাগ করেন।
ক) কাদীম বা প্রাচীনের বিবেচনায় পুনঃমূল্যায়ন (সপ্তদশ শতাব্দী / একাদশ হিজরী)
খ) জাদিদ বা নতুনের বিবেচনায় পুনঃমূল্যায়ন (অষ্টাদশ শতাব্দী / দ্বাদশ হিজরী পর্যন্ত)
৪। অন্বেষনের পর্যায়কাল (Period of Questing) (উনবিংশ শতাব্দী / ত্রয়োদশ হিজরী – বিংশ শতাব্দী / চতুর্দশ হিজরী)
ইসলামী চিন্তা দর্শনের ইতিহাসকে এইভাবে বিভক্ত করে এই সময়কে মুসলমানগণ জ্ঞানের কোন কোন শাখায় কি কি করেছেন? কোন কোন চিন্তাবিদ, আলেম, স্কলার ও দার্শনিক কি কি অবদান রেখেছেন তা তুলে ধরেছেন।
এই ভাবে তুলে ধরার ফলে আজ আমাদের মত মুসলিম যুবকদের কাছে এটা স্পষ্ট যে, আমরা এখন কোন সময়ে আছি ? আমরা এখন অনুসন্ধান বা অন্বেষণের যুগে আছি? কিসের অন্বেষণ করব? কিসের অনুসন্ধান করব ?
আমরা সকলেই জানি আজ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ পাশ্চাত্য চিন্তা, দর্শন, সংস্কৃতি ও সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত। আজ আমরা মুসলিম জাতি হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। মুসলিম উম্মাহকে অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গোলামী থেকে মুক্ত করার জন্য আমাদেরকে ইসলামের মূলনীতির আলোকে নতুন সমাধান দাঁড় করাতে হবে। ইসলামী সভ্যতা যেন পুনরায় ইতিহাসের অণুঘটকে ভূমিকা পালন করে সমগ্র মানবতাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার কবল থেকে রক্ষা পেতে পারে এই জন্য আমাদেরকে অনুসন্ধানী হতে হবে।।