এক,
একালের জার্মানভাষী নওমুসলিম, যারা মনীষা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় এক শতাব্দী আগে আর এক জার্মানভাষী অস্ট্রিয়ান লিউপোল্ড উইস ইসলাম কবুল করে। রীতিমত হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আসাদ নামে মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তির জগতে তিনি যে হীরায় দ্যুতি ছড়িয়েছেন তার তুলনা আজও নেই। তারও আগে জার্মান মহাকবি গ্যোয়েটে ইসলামকে নিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন প্রীতির ভাষণ, ইসলামের নবীকে নিয়ে লিখেছিলেন তার অন্যতম এক বিখ্যাত সংগীত। সবশেষে তার বিখ্যাত দিউয়ান-এ (West Eastern Divan) গ্যোয়েটে নিজের সম্পর্কে উচ্চারণ করেছিলেন এক নিগূঢ় ও রহস্যময় বাক্য: The poet does not deny the suspicion that he himself was a Muslim. এর থেকে অনেকে এই ধারণা করেন মুসলমান না হলেও কবি বোধ হয় অন্তরের গভীরতম প্রদেশে ইসলামের জন্য এক বিশেষ স্থান করে রেখেছিলেন। জার্মানীতে মুসলিম মনীষা, বুদ্ধিজীবিতা ও মননশীলতার চর্চা ও বিশ্লেষণ নতুন কোন ঘটনা নয়। বলা চলে অষ্টাদশ শতকে তুর্কী খলিফা ও জার্মান রাজাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর প্রক্রিয়া শুরু হয়। জার্মান প্রাচ্যবিদরা এ ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এসব প্রাচ্যবিদরা ইউরোপের অন্যান্য বিশেষ করে বিলাতী ও ফরাসী প্রাচ্যবিদদের মত করে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনেবিশবাদকে সহায়তা করেননি। তাদের জীবনব্যাপী সাধনা, মননশীলতা ও সৃজনসমৃদ্ধ মনীষার জোরে ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বের জগত অনেকখানি সম্প্রসারিত হয়েছে। এরা প্রকৃতই ইসলাম বান্ধব। ফ্রেডারিখ ব্রুকার্ট (Freidrich Ruckert), থিওডর নলডিকি (Theodor Noldecke), রুডি প্যারেট (Rudi Paret), আনমারী শিমেলের (Anne Marie Schimmel) নাম কে না জানে। নওমুসলিমদের মধ্যে শেখ রিনি গুইনন (Shyakh Rene Guenon), গ্যুসফ স্যুন (Frithjof Schuon), আহমদ ভন ডেনফারের (Ahmad Von Denffer) নাম করা যেতে পারে। এরা মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তির দিগন্তকে নানা আঙ্গিক ও সুষমায় সাজিয়ে তুলেছেন। এই দীর্ঘ সিলসিলার সর্বশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হচ্ছেন হফম্যান।
দুই,
পাশ্চাত্যের একাধারে বস্তুবাদী অন্যদিকে নাস্তিক্যপুষ্ট আবহাওয়ায় বড় হয়ে, জীবন ধারণ করে এক সময় সেই সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সহজ কথা নয়। যে সমাজে কিনা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা কাজ করে স্রষ্টায় বিশ্বাস ও আধুনিক হওয়ার মধ্যে এক ধরনের বিরোধ আছে, যে সমাজে জড়বাদী, সংশয়ী কিংবা নাস্তিক (কিন্তু কখনোই ঈশ্বর বিশ্বাসী নয়) হওয়া মানে আধুনিকতার উপযোগী হয়ে ওঠা, যে সমাজ কিনা নিয়ন্ত্রিত হয় ভোগ আর ভোগ্যপণ্যবাদের সূত্র ধরে, সেই সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে কারো পক্ষে ধ্যান-ধারণায়, বিশ্বাসে-আচরণে এমন একটা আদর্শের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া যার মূল কথা হচ্ছে স্রষ্টার আনুগত্য ও পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফার দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া, তা কিন্তু রীতিমত বৈপ্লবিক ঘটনা। মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান সেই অসাধ্য সাধন করেছেন এবং পাশ্চাত্য সমাজের ভিতরে থেকেই বুঝতে পেরেছেন যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, আধুনিকতা কোনটিই তার প্রতিশ্রুতি মাফিক এ দুনিয়ায় শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিরতা আনতে পারেনি। বরং ধর্মহীন ও সংস্কারমুক্ত মানুষরাই আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ, হানাহানি ও রক্তক্ষয়ে মেতে উঠেছে বেশি করে। আগ্রাসী বস্তুবাদ একালে মানবীয় বিবেকে ধস নামিয়ে দিয়েছে এবং লোভ, লালসা, লুণ্ঠন ও পরস্পাপহরণ হয়ে উঠেছে আজকের বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি। মুরাদ হফম্যান তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার রস নিংড়ে উপলব্ধি করেছেন এই ব্যবস্থা যদি বাধাহীনভাবে চলতে থাকে তবে মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ কোনভাবেই আশঙ্কামুক্ত হবে না। তা আজকের সাম্রাজ্যবাদের মুখপাত্ররা যতই ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে বলে হাঁকডাক করুক না কেন। মুরাদ হফম্যান গভীর প্রত্যয়ের সাথে বলেছেন ইতিহাস শেষ হয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না এবং ইতিহাস কারো ইংগিতে স্থবির হয়ে যায় না যদি না আল্লাহর ইচ্ছা সেরকম হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এখন পুঁজিবাদী দর্শনের ডাটার টান শুরু হয়েছে এবং বিশ্বব্যবস্থার মূলে ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করার সময় এসেছে।
মুরাদ হফম্যান তার ইসলাম কবুলের অভিজ্ঞতার কথা আমাদের শুনিয়েছেন Journey to Makkah নামক বইয়ে। কিভাবে তিনি ধীরে ধীরে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন আবার ইসলাম তাকে কিভাবে চুম্বকের মত কাছে টেনে নিয়েছে তারই এক মধুর বর্ণনা রয়েছে এখানে। Journey to Makkah পড়লে স্বভাবত অনেকের মনে হতে পারে হফম্যান তার গুরু মোহাম্মদ আসাদের লেখা Road to Makkah গভীরভাবে মন্থন করেছেন, যদিও তিনি গুরুর লেখনশৈলী ও বর্ণনাভঙ্গি আদৌ অনুকরণ করেননি। হফম্যান বিশেষ করে তার ইসলাম কবুলের তিনটি নির্দিষ্ট কার্যকারণের কথা লিখেছেন। ইসলামের মানবীয়, নান্দনিক ও দার্শনিক রূপ তাকে কিভাবে আলোড়িত করেছে, একটু একটু করে তার হৃদয় ইসলামের জন্য কিভাবে উন্মুখ হয়ে উঠেছে তার কথা তিনি বলেছেন ।
তিন,
জার্মানীর এ্যাশফেনবার্গে (Aschaffenburg) এক ক্যাথলিক পরিবারে ১৯৩১ সালের ৬ জুলাই মুরাদ হফম্যানের জন্ম। তার জন্মের শহর ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের রণক্ষেত্র। নাজী জার্মানী ও পুঁজিবাদী ইউরোপের হিংস্রতা ও মারণযজ্ঞের মধ্যে তার শৈশব কাটে। তিনি লেখাপড়া করেন নিউইয়র্ক, মিউনিক এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আইনশাস্ত্রে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডি নেন। মিউনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেয়া তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল Contempt of Court by Publications under American and German Law (1957)। ১৯৬০ সালে তিনি আইনের উপর হার্ভার্ড থেকে LLM ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ১৯৬১ সালে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৯৯৪ সালে। চাকরির শুরুতেই এই তরুণ ভাবুক ও বুদ্ধিমান কূটনীতিক পদায়ন পান আলজেরিয়ায়। মুরাদ হফম্যানের ভাষায় এই আলজেরিয়াই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। চাকরি জীবনে পরবর্তীকালে তিনি আলজেরিয়া (১৯৮৭-৯০) ও মরক্কোতে (১৯৯০-৯৪) জার্মানীর রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন এবং মাঝখানে বেশকিছু সময় ন্যাটো সদর দফতরে প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মহাপরিচালক। (১৯৮৩-৮৭) হিসেবেও কাজ করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরির সুবাদে তিনি প্রতিরক্ষা ও আণবিক ভীতি নিবৃত্ত করার কৌশলের বিষয়াদিতে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন। কিন্তু তার সেই প্রথম পদায়নের স্মৃতি হফম্যানকে আজও গভীর এক নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে রাখে। আলজেরিয়ার বীর জনতা তখন ফরাসী উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়ছে। অন্যদিকে ফরাসী সৈনিকরা আজাদী পাগল এইসব আলজেরীয়দের নির্মমভাবে দমনের পথ বেছে নিয়েছে। সেদিনের তরুণ হফম্যান নিজের চোখে দেখেছেন ফরাসীরা কি হিংস্রতার সাথে আলজেরীয়দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নির্বিচারে নিরীহ ও বেগুনাহ মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিয়েছে। মোটকথা তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধা করেনি। তারপরেও হফম্যানের মনে হয়েছে তাদের ধৈর্য, সাহস, শৃঙ্খলা তাদের কষ্টকে পরাজিত করেছে এবং এটি কেবল সম্ভব হয়েছে তাদের ধর্ম ইসলামের গভীর এক মূল্যবোধের কারণেই। একই কারণে গভীর দুর্যোগ ও বেদনার মধ্যেও আলজেরীয়রা তাদের মানবিক মূল্যবোধকে কখনো হারিয়ে ফেলেনি। হফম্যানের নিজের কথা উদ্ধার করছি :
Deplorable events such as these informed my first intimate encounter with living Islam. I witnessed the patience and resilience of the Algerian people in the face of extreme suffering, their overwhelming discipline during Ramadan, their confidence in victory, as well as their humanity amidst such misery, and I felt that their religion played a major role in all that.
তরুণ বয়সে দেখা ইসলামের এই রূপ হফম্যান আর কখনো ভুলতে পারেননি। এটিই তার মন কেড়ে নেয় এবং হয়তো একটু একটু করে তখন থেকেই তিনি ইসলামের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
তরুণ বয়সের আর একটি স্মৃতির কথা হফম্যান খুব বেশি করে মনে করেন। হফম্যান ছিলেন সৌন্দর্য রসিক যুবক । তার নিজের ভাষায় beauty freak । সৌন্দর্য (aesthetic art) নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি একবার ব্যাভারিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি পুরস্কার পেয়ে যান। এ সময় তিনি আর্টের নানা দিগন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন এবং তার কাছে মনে হয় Static art এর চেয়ে Representational art-ই বেশি আকর্ষণীয় ও মনোরঞ্জক । এইভাবে তিনি ব্যালে নাচের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ বিষয়ে তার একাগ্রতা কালক্রমে তাকে একজন ব্যালে বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক ও প্রশিক্ষক হতে সাহায্য করে। ব্যালে নাচের উত্থান ও এর নান্দনিক খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি এ সময় লেখালেখিও করেন। তার লেখা Of Beauty and the Dance Towards an aesthetics of Ballet, ব্যালে নৃত্যের উপর তার অসাধারণ অধিকারের পরিচায়ক।
আর্ট ও সৌন্দর্য্যের খোঁজ করতে করতেই হফম্যান খোঁজ পেয়ে যান মুসলিম আর্টের এক নতুন দিগন্ত। তার কাছে মনে হয় ব্যালে নৃত্যের কোরিওগ্রাফীর সাথে মুসলিম আর্টের যেন কোথাও সাদৃশ্য রয়েছে। তার এই উপমার ধরনের সাথে হয়তো অনেক সৌন্দর্য রসিকই একমত হবেন না। কিন্তু তার মুসলিম আর্টকে নিয়ে এই অদ্ভূত সুন্দর সাদৃশ্যের অবতারণা ও উপস্থাপনা পদ্ধতি রীতিমত চিত্তাকর্ষক ও হৃদয়গ্রাহী। তার কাছে মুসলিম আর্টকে মনে হয়েছে বিমূর্ততা (abstraction), মানবীয় বিস্তার (Human dimension), অন্তঃস্রোত (inner dynamics) ও অসীমতার (reach towards infinity) গুণে অনন্য যা মানবীয় মনকে এক অতীন্দ্রিয় ও অদৃশ্যমান জগতের দিকে খেয়ে নিয়ে যায় ।
মুরাদ হফম্যান যখন প্রথমবারের মতো আল হামরা ও কর্ডোভার মসজিদ দেখেন তখনই তার মনে হয় এগুলো নিছক স্থাপত্যকর্ম নয়, এক মহান সংস্কৃতির নিগূঢ় রসে ভেজা মহান শিল্পকর্ম। জার্মান মহাকবি রাইনার মারিয়া রিলকে যখন প্রথম কর্ডোভার মসজিদ দেখেন তখন তার মনেও এমনি সৌন্দর্যানুভূতির জন্ম হয়েছিল। খ্রিস্টানরা স্পেনের পুনর্দখলের (Reconquista) পর এই মসজিদকে ক্যাথেড্রালে পরিণত করে এবং এ সময় তার স্থাপত্য সৌন্দর্যের বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়। এই সৌন্দর্য হস্তারক খ্রিস্টানদের রিলকে কখনো ক্ষমা করেননি। তার কবিমন বিপুল ব্যথায় মুচড়ে উঠেছে। রিলকের উদ্ধৃতি দিয়ে হফম্যান তার নিজের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কথাই বলেছেন :
Ever since Cordova, I am full of rabid anti-christian sentiments. I am reading the Quran, and at times it assumes a voice in which I feel, ever so powerful, like the wind in the flute of the organ.
এমনিভাবে সৌন্দর্যরসিক হফম্যানের কাছে ধীরে ধীরে মুসলিম আর্টের নিগূঢ়তা উন্মোচিত হতে থাকে। তখন আর তিনি এই আর্টের আবেদনকে উপেক্ষা করতে পারেন না। তার বিশ্বাস জন্মে শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের আর্টের ইতিহাস দিয়ে মুসলিম আর্টকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এর রহস্য হচ্ছে মুসলিম আর্ট ও সৌন্দর্যের তলায় ইসলামের এক নীরব ও বৈশ্বিক উপস্থিতি লুকিয়ে আছে। মুসলিম আর্টকে তাই বুঝতে হলে ইসলামের অন্তর্গত সৌন্দর্যকেও বুঝতে হবে। হফম্যানের ভাষায় :
Its secret seems to lie in the intimate and universal presence of Islam as a religion in all of its artistic manifestations: Calligraphy, space-filling, arabesque ornaments, carpet patterns, mosque, and housing architecture, as well as urban planning. I am thinking of the brightness of the mosques which banishes any mysticism, of the democratic spirit of their architectural layout; I am also thinking of the introspective quality of Muslim palaces, their anticipation of paradise in gardens full of shade, fountains, and rivulets of the intricate socially functional structure of old Islamic urban centers (madinahs), which fosters community spirit and transparency of the market, tempers heat and wind and assures the integration of the mosque and adjacent welfare centers for the poor, schools and hostels into the market and living quarters.
এইভাবে হফম্যান আলজেরিয়া হয়ে, মুসলিম আর্টের জগত পরিভ্রমণ করে ইসলামের কাছাকাছি চলে আসেন। ক্যাথলিক পরিবারের ছেলে ভাবুক হফম্যান এবার মুখোমুখি হন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কতকগুলো গভীর প্রশ্ন নিয়ে। এসব প্রশ্নের উত্তর তিনি কখনো দর্শনগত, কখনো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে খোঁজার চেষ্টা করেন। আল্লাহর অস্তিত্ব অনস্তিত্ব, মানুষের নশ্বরতা, খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব যেমন স্যালভেশন, রিডামপশন, ইনকারনেশন, সেকরিফিসিয়াল ডেথ এবং ট্রিনিটির মত বিভিন্ন বিষয় তাকে আচ্ছন্ন করে। সভ্যতার মতই প্রাচীন এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিজ্ঞান ও দর্শন সবসময় হোঁচট খেয়েছে । সুতরাং হফম্যানকে ধর্মের কাছেই ফিরে আসতে হয় । তার লেখা উদ্ধার করছি :
I was convinced not only of the possibility, but the necessity of divine interference, since the histories of man, science, and the law demonstrate beyond the shadow of a doubt, that the mere empirical study of nature does not enable us to find the correct relationship to the world around us, God and ourselves. Are scientific discoveries not notoriously prone to obsolescence? Just witness the amusing history of economic theory, the law of nature, and physics.
ধর্ম তো অনেকগুলো আছে। এর মধ্যে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে একটি পেয়েছেন। হফম্যান এই বহুস্রোতের মধ্যে ইসলামকে গ্রহণ করেন। কারণ তার কাছে মনে হয় তার। বাপদাদার ক্যাথলিক ধর্মে অনেক গোঁজামিল ঢুকে গেছে। যীশুর ধর্মপ্রচারের বহুদিন পর পৌত্তলিক সম্রাট কনস্টানটাইনের প্রশ্রয়ে খ্রিস্টান ধর্মবেত্তারা একত্রে মিলিত হয়ে বিখ্যাত নিকিয়ান কাউন্সিলে আজকের খ্রিস্টান ধর্মের মূলতত্ত্ব Trinity ঠিক করে নেন। এই Trinity কে হফম্যান মনে করেন স্রষ্টার অবিনশ্বরতা ও অসীম ক্ষমতাকে খাটো করে দেখা। এটা ভাবতেও অবাক লাগে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টির দুর্বলতার জন্য নিজে আত্মাহুতি দিয়ে সৃষ্টিকে পাপমুক্ত করবেন। ইসলাম সম্পর্কে হফম্যানের মতামত হলো :
In short, I began to see Islam with its own eyes, as the unadulterated, pristine belief in the one and only, true God, Who does not beget, and was not begotten, Whom nothing and nobody resembles (Surah 112, al Ikhlas). I saw Islam as the undiluted original Abrahamic monotheism which had succeeded in avoiding both the Jewish and the Christian deviations; either to believe in an exclusive, contractual agreement between God and His chosen people or to exalt a prophet through a subsequent process of deification.
হফম্যানের ইসলাম কবুলের তারিখটি ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০।
১৯৯১ সালে মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান যখন মরক্কোয় জার্মান রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছেন, তখন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা নতুন একটি বই লেখেন । এর নাম End of History- ইতিহাসের সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর বিজয়োল্লাসে মত্ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ তাবৎ দুনিয়া শাসন করার মওকা খুঁজছে তখন ফুকুয়ামা সাহেব সাম্রাজ্যবাদীদের ইংগিতে এ বই লিখেন। কারণ সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব শাসনের পক্ষে একটা নৈতিক ভিত্তি দরকার। ফুকুয়ামা সাহেব সেই ভিত প্রস্তুত করে দিয়েছেন।
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ধরে নিয়েছিলেন কমিউনিজমের পতনের পর পুঁজিবাদী বিশ্বের সামনে আর কোন বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রইলো না। স্বাভাবিকভাবে তাদের আধুনিকায়ন প্রকল্প গ্রহণ ছাড়া বাকি বিশ্বের আর কোন পথ খোলা নেই। এখন থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই হবে বিশ্বের মানুষের শেষ ঠিকানা।
ফুকুয়ামার মতো, আর এক সাম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিক স্যামুয়েল হান্টিংটনতো ঘোষণা করে দিলেন সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন মুসলিম বিশ্ব বলে কিছু থাকবে না, পুঁজিবাদী বিশ্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। হান্টিংটন ও ফুকুয়ামা সাহেবদের ভবিষ্যদ্বাণী ইতিমধ্যে অকার্যকর হতে শুরু করেছে। ইতিহাস যে শেষ হয়নি তার প্রমাণ আজকের আফগানিস্তান ও ইরাক। পুজিবাদী ব্যবস্থা নিজেই একটা আগ্রাসী ব্যবস্থা। শোষণ, লুণ্ঠন ও আগ্রাসন হচ্ছে এই ব্যবস্থারই অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এই ব্যবস্থাকে ধরে রেখে বিশ্ব শান্তির আশা করা অনেকটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো।
পশ্চিমের সমাজপতিরা আজো বুঝতে পারেননি বস্তুবাদ ও ভোগ্যপণ্যবাদের পূজা করতে গিয়ে বিশ্বমানবতাকে তারা কোথায় এনে ঠেকিয়েছেন। হিটলারের ‘হলোকস্ট’, স্টালিনের ‘গ্রেট পারজেস’, বসনিয়ার ‘এথনিক ক্লিনসিং আর একালের ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ‘ নামক স্বৈরাচার ও পীড়ন কোনটি তাদের আত্মম্ভরিতাকে নাড়া দিতে পারেনি। উল্টো এক অন্ধ বিশ্বাস তাদের তাড়া করে ফিরছে পুঁজিবাদই মানব সভ্যতার একমাত্র আদর্শ এবং এটি দ্বারা পুরো পৃথিবী শাসিত হতে হবে। তাদের এই ঔদ্ধত্যের কারণেই আজও পৃথিবী জুড়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়নি।
মুরাদ হফম্যান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে উদ্ভূত এই সব মতিভ্রষ্ট ও বিকৃত ধারণার প্রতিবাদ করা একটা গুরুতর দায়িত্ব বিবেচনায় এগিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন আক্রমণাত্মক পুঁজিবাদ নয়, একবিংশ শতাব্দীর মানুষের জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে ইসলাম। পাশ্চাত্যের ভোগ্যপণ্যবাদের মূল্যবোধহীনতার বিপরীতে ইসলামের ধর্মসংস্কৃতি হতে পারে একমাত্র রক্ষাকবচ। সকলের গ্রহণযোগ্য এই জীবন বিধান আজ সাম্রাজ্যবাদের মিডিয়ার অযৌক্তিক আক্রমণের শিকার। মুরাদ হফম্যান তার Islam The Alternative বইয়ে ইসলামকে নিয়ে পশ্চিমের এই বিতৃষ্ণার যেমন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন তেমনি অনাগত ভবিষ্যতের কল্যাণমুখী জীবন বিধান হিসাবে ইসলামের ইতিবাচকতাকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন এ বই ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার একচোখা ও আমাসী দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যুত্তর।
হফম্যান আমাদের জানিয়েছেন ফুকুয়ামার বই প্রকাশের খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন এবং ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ভুল বুঝাবুঝি, মিথ্যাচার ও অন্ধতার জওয়াব দেন। এ বই প্রকাশের সাথে সাথেই জার্মান মিডিয়া এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেই পুরনো ইউরোপীয় কৌশলে লেখককে মৌলবাদী, নারী বিদ্বেষী, মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার সমর্থক ইত্যাদি বলে গাল দিতে শুরু করে। এমনকি জার্মান আইনসভা বুভোসটার্গ-এ এটি নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয় এবং সেখানকার নারীবাদী ও বামপন্থী সদস্যরা হফম্যানকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানায়। অবশ্য জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বইয়ের মধ্যে আপত্তিকর কিছু খুঁজে পায়নি এবং মুরাদ হফম্যান যথারীতি তার রাষ্ট্রদূতের চাকরির মেয়াদ শেষ করতে সমর্থ হন। হফম্যান অবশ্য তখন থেকে এটাও অনুভব করতে থাকেন ইউরোপের বুকে ইসলামের স্বপক্ষে কিছু বলতে যাওয়া বিপজ্জনকই বটে। তিনি এ ঘটনাকে বলেছেন Summary execution by the media।
এ বইতে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হলো উত্তর আধুনিকতা ও যন্ত্র শিল্পোত্তর পশ্চিমাসভ্যতার পটভূমিতে ইসলামই হবে শক্তিশালী ধর্মবিশ্বাস। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন পুঁজিবাদী প্রাচুর্য ও আধুনিকতার জ্বর সেখানকার মানুষের জাগতিক সাফল্য আনলেও মানুষের মানবীয়তাকে ছুড়ে ফেলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার মানুষ আজ খুঁজছে বিকল্প পথ। জড়বাদী দর্শন আর পশ্চিমের মানুষকে তৃপ্ত করতে পারছে না। হফম্যানের ভাষায় :
আধুনিক বিশ্বের প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশেই ইদানীং প্রকট দুর্ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব দেশে Green সম্প্রদায়ের পরিবেশ সংরক্ষণবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে তার বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠেছে। যে যন্ত্রশিল্প তাদেরকে সম্পদ আর প্রাচুর্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিল তা যেন আজ ক্রমেই যন্ত্রদানব-এ রূপ নিচ্ছে। এ সভ্যতা তাদেরকে সামাজিক স্বাধীনতা এনে দিলেও মুক্ত নির্মল বাতাসে শ্বাস নেবার স্বাধীনতাকে যেন ক্রমেই কোণঠাসা করে ফেলেছে। তাই তারা আজ সম্পদ, প্রাচুর্য আর স্বাধীনতার বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছে। এই সাধারণ দুর্ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের তরুণ সমাজের উপর তার বিশেষ বিশেষ যন্ত্রণাগুলো চাপিয়ে দিয়েছে, তার মাঝে রয়েছে বন্ধ মানসিকতা বা অবসন্নতা, সর্ববিস্তৃত ভীতি, স্নেহ মমতার দুর্ভিক্ষ, শিল্পের বিভিন্ন শাখায় অভিযান্ত্রিকায়নের কারণে কর্মচ্যুতির নিরবচ্ছিন্ন আশঙ্কা, ভোগ্যপণ্যের বাজারে সীমাহীন অনিশ্চয়তা যার পাগলপ্রায় সংকোচন ও প্রসারণের চাপে শ্রমিক সমাজের আজ নিত্য আতংকগ্রস্ত অবস্থা। জাতীয় অর্থনীতির দাপট-ই হোক আর প্রত্যাঘাতের ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে আণবিক বোমার আক্রমণ থেকে বিরত রাখার প্রক্রিয়াই-ই হোক, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর বুদ্ধিবাদ সেখানে প্রতিনিয়তই মানবিক আদর্শবাদকে পদদলিত করে চলছে। বিবেক বর্জিত দাপটে মানুষ আজ দিশেহারা।
শেষ কথা হলো, তারা যা খুঁজছে তা কেবল একই সাথে নীতিপ্রধান ও সংস্কৃতি প্রধান ইসলাম ধর্মের পক্ষেই দেয়া সম্ভব। হফম্যানের মতামতও সেটাই। পশ্চিমের পরিপ্রেক্ষিততো বোঝা গেলো। কিন্তু ইসলাম যাদের ধর্ম তাদের বিচ্যুতি, অধঃপতন ও ব্যর্থতার কারণ কি। মুরাদ হফম্যান বলেছেন কর্ডোভা ও বাগদাদের পতনের পর ইসলামের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি প্রায় অচল হয়ে যায়। তার ধাক্কা ইসলাম আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
দ্বিতীয়তঃ সামরিক পরাজয়ের সাথে সাথে ইসলামী বুদ্ধিজীবিতার জগতে এক ধরনের অদৃষ্টবাদী চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটে। যা জানার তা জানা হয়ে গেছে, জ্ঞানের মূল উৎস রসুল (স.) সুতরাং ভৌগোলিক ও সামরিক বিচারে যারা তার নিকটবর্তী ছিলেন তারাই বেশি জানবেন। এভাবে মুসলমানরাও একদিন পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে এবং তকলীদপন্থী হয়ে যায়। এরপরে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন এবং সেই শাসন থেকে বেরিয়ে আসবার পর নতুন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নানা রকম পশ্চিমা ‘বাদ’ ও ‘তন্ত্রের’ অনুসরণ এখানকার পুরো অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন ঘটায় না। এসব মুসলিম দেশগুলোর নিম্ন আয়, মূলধনের নিরুদ্দেশ যাত্রা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, ঋণগ্রস্থতা, মেধা পাচার উল্টো এসব দেশের ক্ষতকে আরো যাতনাময় করে তোলে । এরই প্রেক্ষিতে এখানকার জনগণের মধ্যে সত্তর ও আশির দশক থেকে এক ধরনের পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তারা অনুধাবন করতে শুরু করে ইসলাম থেকে বিচ্যুতি তাদের যাবতীয় দুর্গতির কারণ। সুতরাং তারা এক পুনঃইসলামীকরণের দিকে ধাবিত হয়। বলা বাহুল্য এই পুনঃইসলামীকরণের পশ্চিমী প্রতিক্রিয়াজাত নাম হচ্ছে ‘মৌলবাদ’।
আজকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে ইসলামী পুনর্জাগরণের এই ধারা মূলতঃ পশ্চিমী শাসন ও দর্শন উভয়কে প্রত্যাখ্যান করার ভিতর দিয়ে শক্তি অর্জন করেছে। হফম্যান বিশ্বাস করেন এই পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়া আজকের ঝিমিয়ে পড়া মুসলমানদের আত্মসম্মানবোধ ফিরিয়ে আনবে। তার ধর্মবিশ্বাস, ঐতিহ্যচেতনা, মূল্যবোধ পশ্চিমা সমাজের ভোগবিলাসের উন্নততা থেকে ঠেকিয়ে রাখবে এবং তাকে আবার বিজয়ীর আসনে। বসতে সাহায্য করবে।
চার,
মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যানের অন্যতম একটি বিখ্যাত বই হচ্ছে Journey to Islam: Diary of a German Diplomat (1951-2000) নামেই বইটির পরিচয়। এটি মূলতঃ হফম্যানের একটি রোজনামচা। দীর্ঘ ৫০ বছরের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা, অভিব্যক্তি ও অনুভূতির এটি সমাহার, যার পরিণতিতে তিনি ১৯৮০ সালে ইসলাম কবুল করেন। হফম্যান বলেছেন এ বই হচ্ছে নিজের সাথে এক ধরনের বোঝাপড়ার পরিণাম a dialogue with himself একজন জার্মান বুদ্ধিজীবীর মনের একান্ত বিশ্বাসের কথা, ethics, morality aesthetics নিয়ে তার মানবিক টানাপড়েনের কথা এবং সেই টানাপড়েন ভিতর দিয়ে তিনি কিভাবে ইসলামের দিকে এগিয়ে যান তার এক গভীর ও সুখদ বর্ণনা রয়েছে এ বইটিতে।
বইটির ভূমিকা লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ। এখানে তিনি বলেছেন এ কালের কারিগরী সভ্যতা ও বস্তুবাদী দর্শন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হফম্যান মানুষের এক আধ্যাত্মিক গন্তব্যের মধ্যে মুক্তির সন্ধান করেছেন। এটি করতে গিয়ে তিনি মুসলিম দুনিয়ার বহিরংগের সাথে এর জনগণের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের এক গভীর সমন্বয় খুঁজে পান। এই আবিষ্কার, তার কাছে মনে হয় মুসলিম সংস্কৃতি ও ইসলামী বিশ্বাসের পারস্পরিক গভীর সম্পর্কের ফল । অবশেষে ইসলাম গ্রহণের মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের চূড়ান্ত সত্যের অবলোকন করেন এবং তার এ যাবৎকালের যাবতীয় প্রশ্নের সুষ্ঠু সমাধানে তিনি তৃপ্ত হন। তার নতুন নাম হয় মুরাদ। এর অর্থ উদ্দেশ্য- Purpose। হয়তো জীবনের নিগূঢ় উদ্দেশ্য তিনি এইভাবে বুঝে নেন।
মুরাদ হফম্যানের এই রোজনামচায় যে কত বিষয় আলোচিত হয়েছে, আর কত বিষয়ে যে তার অধিকার দৃশ্যমান তা ভেবে বিস্ময় জাগে। নিজের জীবনে ঘটা এক সড়ক দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে আর্ট, কালচার, দর্শন, স্থাপত্য, ক্যালিগ্রাফি, কবিতা, ধর্মতত্ত্ব, সুফীতত্ত্ব, খ্রিস্টীয় গূঢ়তত্ত্ব, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন, অ্যালকোহল, নিউমারোলজী, হজ্জ্বের অভিজ্ঞতা, ইসলামে গণতন্ত্র, নারীর অধিকার, মার্কস, ইবনে খালদুন, মরিস বুকাইলি, মোহাম্মদ আসাদ ইত্যাকার কোন বিষয়ই তার অনালোচিত থাকেনি।
যেমন ১৯৮২ সালের ২৮ এপ্রিল হফম্যান তার রোজনামচার পৃষ্ঠায় ইবনে খালদুন ও মার্ক্সের তুলনা প্রসঙ্গে লিখেছেন যারা আজও ইসলামকে প্রগতির প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করেন তারা যেন ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা পড়েন। কাল মার্কস ও ম্যাক্সওয়েবারের পাঁচশ বছর আগে এই মহান সমাজ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসের দার্শনিক ইতিহাসচক্র, সভ্যতার উত্থান-পতন আর ইতিহাস লিখতে যে মৌলিক উৎসের আর অনুসন্ধানী মনের দরকার হয় সে সম্বন্ধে প্রথম আলোকপাত করেছিলেন। কালমার্কসসের আগে তিনি প্রথম লিখেছেন : Profit is the value realized from human labor এবং Differences among people are the result of different ways in which they make their living.
টমাসম্যানের বহু আগে ইবনে খালদুন ঘোষণা করেছিলেন:
Prestige lasts at best four generations in one lineage.
নীটশের বহু আগে তিনি বলেছেন:
While a nation is savage, its royal authority extends farther.
আর ফ্রেডারিখ হেগেলের আগে ইবনে খালদুনের ভাষ্য:
Dynasties have a natural life span like individuals.
জাঁজাক রুশোর আগে তিনি আমাদের ধারণা দিয়েছেন:
Relationship between the governing and the governed is based on a (social) contract.
ইবনে খালদুনের এই যুক্তিবাদী ও আধুনিক ভূমিকা এমনিতেই তৈরি হয়নি। হফম্যান মনে করেন ইবনে খালদুনের মনন ও মনীষা মূলতঃ ইসলামী সভ্যতার ফসল। এমনি করে এ বইয়ে অসংখ্য হীরকখন্ড ছড়িয়ে আছে, যার দ্যুতি আমাদের মন ভিজিয়ে দেয়।
পাঁচ,
মুরাদ হফম্যানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই হচ্ছে Islam 2000 । একবিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, তাদের উপর ধেয়ে আসা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদকে তারা কিভাবে মোকাবিলা করবে এবং এই শতাব্দীতে ইসলামকে কিভাবে যৌক্তিক পটভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত করা যাবে এসব জ্বলন্ত ইস্যুগুলো নিয়ে তিনি এখানে আলোচনা করেছেন। একই সাথে এ শতাব্দীতে ইসলামের বিচ্যুতি ও তার অনুসারীদের সফলতা ব্যর্থতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণও করেছেন তিনি এখানে। এ ব্যাপারে মুরাদ হফম্যানের নিজের ভাষ্য উদ্ধার করছিঃ
বর্তমানে বিরাজমান বিস্ফোরোণ্মুখ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে, মুসলমানদের অবশ্যই বিরাট পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি এমন অনেক ক্ষেত্র চিহ্নিত করবো, যেখানে মুসলমানদের করণীয় অনেক কিছু রয়েছে। কিন্তু শুরুতেই একটা কথা আমি স্পষ্টতঃই বলে দিতে চাই- আমি ইসলামী বিশ্বাসের প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের ব্যাপারে, যেমন ধরুন আল্লাহর নিজের বক্তব্য, পবিত্র কুরআন বা নবী (স.)-এর সহী হাদীসের বিষয়বস্তু ইত্যাদির ব্যাপারে কোনরূপ ছাড় দেয়ার ডাক কখনোই দেব না । ইসলামকে আধুনিকতার প্রয়োজন অনুযায়ী পুনর্বিন্যাস করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু আমি ইসলামের এমন পুনরুজ্জীবন চাই যেন, আধুনিক মানুষজন এর কার্যকারিতা অনুধাবন করতে পারেন; এমনকি সবেচেয়ে বীতশ্রদ্ধ পশ্চিমা মানুষটিও যেন বুঝতে পারেন ইসলাম কতখানি কার্যকর।
তিনি লক্ষ্য করেছেন পশ্চিমে ইসলামের কতকগুলো বিষয় নিয়ে অহেতুক মাতামাতি করা হয়, যেমন নারীমুক্তি, মানবাধিকার। মুরাদ হফম্যান জোরের সাথে বলেছেন এর জন্য ইসলাম দায়ী নয়। ইসলাম থেকে বিচ্যুতি হচ্ছে এর কারণ। মুসলিম সমাজে ইসলামের অনুপস্থিতির কারণে এরকম দুর্ঘটনা ঘটছে। মুসলিম সমাজের আজকের এই চেহারা বদলাতে হলে, নারীর সত্যিকার মর্যাদা পুনরুদ্ধারে, মানবাধিকারের অবস্থা উন্নয়নে ইসলামকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে।
মুসলিম রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারণাটা এখনো অস্পষ্ট হয়ে আছে। এর সাথে মুসলমানরা যেন অভ্যস্ত হতে পারছে না। ইসলামের আদর্শের কথা ভাবলে আজকের জাতীয় ও সেকুলার রাষ্ট্রসমূহের অসংগতির প্রশ্ন এসে যায়। মুরাদ হফম্যান তাই মনে করেন মুসলমানদের এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে জাতিসমূহ বিলুপ্ত হয়ে এক অভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। মুসলিম উম্মাহর ধারণা একালে শ্রেফ নামকা ওয়াস্তা হয়েই রয়েছে। কার্যকর অর্থেই মুসলিম উম্মাহর অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা করা চাই। তা না করা গেলে মুসলমানের জিল্লতির দিন শেষ হবে না।
ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে তার মতামত হলো এটি কখনোই পশ্চিমা অর্থনীতির মতো লাভজনক হতে পারে না। কারণ সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য নয়, তার লক্ষ্য মানবকল্যাণ। মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের কথা বলতে যেয়ে তিনি লিখেছেন ধর্মচ্যুত ও তথাকথিত সংস্কারমুক্ত কেউ মুসলিম বুদ্ধিজীবী হবার দাবি করতে পারেন না। তাকে অবশ্যই আল্লাহর আনুগত্যের ছায়ায় অবস্থান করতে হবে। একালের মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন তাদেরকে যথেষ্ট যোগ্যতার সাথে নাস্তিকতা ও পশ্চিমের দর্শনকে মোকাবিলা করতে হবে। আর তাদেরকে একাধারে সমকালীন সমস্যার বাস্তবানুগ জওয়াব দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। একই সাথে ইসলাম সম্পর্কে যে সব ভুল ধারণা জাকিয়ে বসেছে তাকে নির্মূল করতে হবে। ইজতেহাদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এখন আর বসে থাকার সময় নেই। তাদেরকে বর্তমান যুগকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। মুরাদ হফম্যান জোর দিয়ে বলেছেন মিছওয়াক নিয়ে দাঁত মাজা কিংবা দাড়ি কতদূর লম্বা হবে এই বিতর্ক না করে মুসলমানকে আজ ধৈর্য, দানশীলতা, সহিঞ্চুতা, দয়া এবং প্রার্থনার একাগ্রতার মতো চারিত্রিক গুণাবলীর নমুনা হাজির করতে হবে। এ ছাড়া ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক জাগরণের পথ প্রস্তুত হবে না।
এটা ভাবতে অবাক লাগে একজন নওমুসলিম হয়ে মুরাদ হফম্যান আমাদের মত মানুষের চোখে যে স্বপ্ন দেখাতে পারেন মুসলমানের ঘরে জন্ম নেয়া সন্তানেরা সেই কাজটি করতে একালে বলা চলে প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছেন। সেই কারণেই বোধ হয় হফম্যান লিখেছেন :
Every born Muslim must be reconverted to Islam sometime during his life; Islam can not be inherited.
আমরা যারা মুসলমানের ঘরে জন্মেছি, তাদের বিশ্বাসের সাথে কাজকর্মের তুলনা করলেই প্রকৃত অবস্থাটা বোঝা যায়। মুসলমানের শিরে আজ বিপর্যয়ের বোঝা, তার ললাটে পরাজয় লেখা। হফম্যান মনে করেন এর হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে মুসলমানের আজ দরকার নবজন্মের। ইসলামের আলোকস্মাত হয়ে সেই নবজন্মের ভোরের সূচনা হবে। সেই মুসলমান এগিয়ে যাবে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, বুদ্ধিতে, নৈতিকতায় আর মূল্যবোধের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে। মুরাদ হফম্যানের একান্ত মনের এ আনত প্রার্থনা কবুল হোক।
তথ্যসূত্রঃ
- Murad Hofmann, Journey to Makkah.
- মুরাদ হফম্যান, ইসলাম: দি অলটারনেটিভ, তরজমা: মঈন বিন নাসির। ঢাকা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৪।
- Murad Wilfried Hofmann, Journey to Islam: Diary of a German Diplomat 1951-2000. Mark field: The Islamic Foundation, 2001.
- ইসলাম ২০০০, মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান। ঢাকা: বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সো