উনবিংশ শতাব্দীতে যে সকল মহা মনীষী জন্ম গ্রহণ করেন তার মধ্যে আহমেদ জাওদাত পাশা হলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একই সাথে ছিলেন একজন ইতিহাসবেত্তা, সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং একজন মহান দার্শনিক। তার মেয়ে ফাতেমা আলিয়া তপুজও ছিলেন একজন যুগশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ ও উপন্যাসিক। উসমানী খিলাফতের আলেমদের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল, আর সেটি হল তারা সকলেই ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। অনেক বিষয়েই তাদের যোগ্যতা এত বেশী ছিল যা বর্তমান সময়ে সেই বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞেরও নেই। তাদের প্রতিভার ছাপ তাদের বই পুস্তক সমূহ পড়লেই উপলব্ধি করা যায়। আহমেদ জাওদাত পাশার অমর কীর্তি হল, “মাজাল্লা-ই-আহকামে-আদলিয়া (مجلة الأحكام العدلية )” । উসমানী খিলাফতে যখন পাশ্চাত্য চিন্তা ও দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ইসলামী আইনের বদলে একের পর এক ইউরোপীয়ান আইন ও শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছিলো এটাকে রোধ করার জন্য এগিয়ে আসেন, প্রখ্যাত আলেম ও দার্শনিক আহমেদ জাওদাত পাশা। তিনি সেই সময়ের বড় বড় আলেমদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করেন, সেই কমিশনের সদস্য ছিলেন ফিলিবেলি হালিল, সাইফুদ্দিন ইসমাইল, সাইয়্যেদ আহমেদ, আহমেদ হিলমি, বাগদাদের মুহাম্মাদ আমীন, ইবনে আবিদীন, যাদে আলাউদ্দিন, ওমর হুলুসি, শাইখুল ইসলাম কারা হালিল, ঈসা রুহি, ইউনুস ওয়াহবী, আহমেদ খালিদ সহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর আরও অনেক বড় বড় আলেমগণ। এই কমিশন ইখলাস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সাথে তাদের কাজ শুরু করেন, করতেই হবে কারণ ময়দান যদি ফাঁকা থাকে তাহলে পাশ্চাত্যের পুজারীরা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী আইনকে কপি করার জন্য এক পায়ে প্রস্তুত! না এটা হতে দেওয়া যায় না, কারণ বিশ্বমানবতাকে বস্তুপূজার হাত থেকে মুক্ত করে মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তির দিকে ধাবিত কারী দ্বীনে মুবিন ইসলামের আইন-কানুনকে বাদ দিয়ে পাশ্চাত্যের আইনে একটি ইসলামী খিলাফত কি করে চলতে পারে? দ্বীনে মুবিন ইসলামের আইন পদ্ধতি হল সর্ব সেরা আইন পদ্ধতি এই আইনের আওতাতেই কেবলমাত্র বিশ্বমানতার জন্য শান্তি রয়েছে। এই আইন দ্বারাই ইসলামী সভ্যতা সমগ্র বিশ্বকে এক হাজার বছর শাসন করেছে ন্যায়পরায়ণতার সাথে।মুসলিম উম্মাহর যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের নিয়ে গঠিত এই কমিশন ঐ সময়ের হুকুম আহকামকে পর্যালোচনা করা শুরু করেন। ইসলামী হুকুম আহকামকে পর্যালোচনা ও পুনঃমূল্যায়ন করে এই গুলোকে ধারাক্রম অনুসারে সাজান এবং কোরআন ও হাদীস থেকে রেফারেন্স দিয়ে উপমার মাধ্যমে লিবিবদ্ধ করেন। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আলেমগণ এটাকে প্রস্তুত করে তৎকালীন সুলতান সুলতান আব্দুল হামিদ হান (দ্বিতীয়) এর হাতে তুলে দেন। সুলতান আব্দুল হামিদ হান তাদের এই কাজ দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং সমগ্র খিলাফতে এই আইনকে জারী করার হুকুম দেন। এই مجلة الأحكام العدلية যেন উসমানী খিলাফতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। ঐ সময় পর্যন্ত ইউরোপ থেকে যত আইন কানুন কপি করে আনা হয়েছিল সেগুলোকে অচল বলে ঘোষণা করেন।মাজাল্লা-ই-আহকামে-আদলিয়া (مجلة الأحكام العدلية ) ১৮৫১ টি ধারা নিয়ে লিখিত। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয়ের হুকুম আহকাম এতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, যেমনঃ ভাড়া, সেবা, ঋণ, আমানত, ওয়াকফ, কোম্পানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সন্ধি, আন্তর্জাতিক আইন সহ আরও অনেক বিষয়। মাজাল্লা-ই-আহকামে-আদলিয়া (مجلة الأحكام العدلية ) প্রথম ১০০ ধারাকে কাওয়াইদী কুল্লিয়া নামে অভিহিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে এই প্রথম ১০০ টি ধারা এত গুরুত্ত্বপূর্ণ যা সকল মুসলমানেরই মুখস্ত করা উচিত। উসমানী খিলাফতে তথা ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই সকল ধারা মুখস্ত করা বাধ্যতামূলক ছিল। খিলাফত বিলুপ্তির পরেও অনেক মাদ্রাসায় এটাকে মুখস্ত করানো হত, এখনো মুখস্ত করার জন্য আলেমগণ অনেক জোর দিয়ে থাকেন। মাজাল্লা শুধুমাত্র মুসলিম দেশ সমূহে কিংবা উসমানী খিলাফতের অধিভুক্ত দেশ সমূহেই নয়, সমগ্র দুনিয়াতে সমাদৃত হয়েছে। উসমানী খিলাফতের পতনের পরেও সিরিয়া ১৯৪৯ পর্যন্ত, ইরাক ১৯৫১ পর্যন্ত,জর্ডান ১৯৬৭ পর্যন্ত এবং ইসরাইল ১৯৮৪ পর্যন্ত মাজাল্লা-ই-আহকামে-আদলিয়া (مجلة الأحكام العدلية ) এর আলোকে শাসিত হয়েছে। মাজাল্লা-ই-আহকামে-আদলিয়া (مجلة الأحكام العدلية ) কেবলমাত্র আইন কিংবা হুকুম আহকাম সম্বলিত কোন বইয়ের নামই নয়, একই সাথে সাহিত্য, বালাগাত ও ফাসাহাতের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
আইন-কানুন যে কেবলমাত্র কিছু ধারার নাম নয় এই বই না পড়লে কস্মিনকালেও তা উপলন্ধি করা সম্ভব নয়।এই গ্রন্থটিকে সাজানো হয়েছে হাদীসের আলোকে এবং প্রতিটি পৃষ্ঠাই শুরু করা হয়েছে দরূদ ও সালামের মাধ্যমে।মাজাল্লা শুধুমাত্র মুসলিম দেশ সমূহে কিংবা উসমানী খিলাফতের অধিভুক্ত দেশ সমূহেই নয়, সমগ্র দুনিয়াতে সমাদৃত হয়েছে। উসমানী খিলাফতের পতনের পরেও সিরিয়া ১৯৪৯ পর্যন্ত, ইরাক ১৯৫১ পর্যন্ত,জর্ডান ১৯৬৭ পর্যন্ত এবং ইসরাইল ১৯৮৪ পর্যন্ত মাজাল্লা-ই-আহকামে-আদলিয়া (مجلة الأحكام العدلية ) এর আলোকে শাসিত হয়েছে।