মানবতাকে দীর্ঘ বারোশত বছর আদালত ও মারহামাতের সুশীতল ছায়া দানকারী এবং জ্ঞান ও মূল্যবোধের সর্বোচ্চ বিকাশ সাধনকারী ইসলামী সভ্যতার পতনের পরে মানবতাকে জাহেলিয়াত ও জুলুমের নিগূঢ় আধাঁরে নিপতিতকারী বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতার যে আধুনিক শোষণ চলছে, এ শোষণকে বুঝার জন্য লিবারেলিজম কী, লিবারেলিস্টদের ওয়াদা কী, তারা বিশ্বকে মূলত কী দিতে চায়, তাদের তাকলীফ তথা প্রস্তাবনা কী- এ বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝা জরুরী। লিবারেলিজম বিগত প্রায় তিন শতাব্দীব্যাপী প্রভাবশালী ও বিজয়ী একটি চিন্তা। আমরা বর্তমানে কেমন দুনিয়ায় বসবাস করছি, এ দুনিয়ায় কোন কোন চিন্তাধারা প্রভাবশালী, তা যদি আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে আমাদের পক্ষে ইসলামের আহ্বান, ইসলামের আদালত, ইসলাম কর্তৃক মানুষকে দেওয়া মর্যাদার বিষয়গুলোকে অন্য কোনো চিন্তার বিপরীতে যৌক্তিক ও বিজয়ী হিসেবে হাজির করা সম্ভব হবে না। লিবারেলিজমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই এ মুহূর্তে আমাদের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো বর্তমানের এ জাহেলিয়াতকে ভালোভাবে জানা ও বুঝা। হযরত উমর (রা.) এর ভাষায়- “যে জাহেলিয়াতকে ভালোভাবে চিনতে পারেনি, জানতে পারেনি, বুঝতে পারেনি, তার পক্ষে ইসলামকে খুব ভালোভাবে জানা সম্ভব নয়।” লিবারেলিজম এবং এর চিন্তাধারা পৃথিবীতে একটি প্রগতিশীল চিন্তাধারা হিসেবে পরিচিত। এ আলোচনার পূর্বে প্রাসঙ্গিকতার স্বার্থে প্রগতিবাদ সম্পর্কে আলোকপাত জরুরী। সাধারণত প্রগতিবাদের দুটি ধারণা পাওয়া যায়:
১. সমাজতান্ত্রিক প্রগতিবাদ ও
২. লিবারেল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদ।
কোনো চিন্তাধারার স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হলো তা আগামীর পৃথিবীকে কী দিতে চায়, মানুষকে কোন অবস্থায় নিয়ে যেতে চায়, তা তুলে ধরতে পারা: অন্যথায় তার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিটি চিন্তাধারার একটি ওয়াদা বা ভবিষ্যৎ দর্শন থাকা বাঞ্ছনীয়। যেমন- বর্তমান বস্তুবাদী World View বা বিশ্বদর্শনের একটি ধারণা হলো, যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবী তত সুন্দর এবং কল্যাণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একইভাবে আমাদের মুসলমানদের একটি শ্রেণির ইতিহাসের ব্যপারে ধারণা হলো যত দিন যাচ্ছে, মানুষ তত খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাস্তবতা হলো এ দুটির একটি ইফরাত, অন্যটি তাফরিত। কারণ সত্যিকারার্থে মানবজাতির ইতিহাসের প্রকৃতি শুধুমাত্র উর্ধ্বমুখী বা নিম্নমুখী নয়, বরং তা চক্রাকার। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ ব্যপারে বলেন,
“আমি মানুষের মধ্যে খারাপ দিন এবং ভালো দিনগুলোকে চক্রাকারে আবর্তন করি।”
ইবনে খালদুনের ইতিহাস দর্শনের দিকে লক্ষ্য করলে আমাদের ইতিহাসের প্রকৃতিতে অনেকটা এ রকমই দেখতে পাবো, কখনো তা উর্ধ্বমুখী, কখনো নিম্নমুখী, আবার কখনো ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়েছে, আবার নিম্নমুখী হয়েছে। অর্থাৎ তা একটি আবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এটিই সবচেয়ে যৌক্তিক ইতিহাস দর্শন। ওয়াদা বা ভবিষ্যৎ দর্শন থাকার ধারাবাহিকতায় সমাজতান্ত্রিক প্রগতিবাদ ও লিবারেল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদেরও আলাদা আলাদা ওয়াদা বা ভবিষ্যৎ দর্শন রয়েছে এবং তারা পৃথিবীকে তাদের ভবিষ্যৎ দর্শনের দিকেই ধাবিত করতে চায়। সমাজতান্ত্রিক প্রগতিবাদ ও লিবারেল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদ উভয়েই প্রগতি (Progress) চায়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো তাদের প্রগতির (Progress) সর্বশেষ পর্যায় কী, তারা কোথায় গিয়ে থামতে চায়? সমাজতান্ত্রিক প্রগতিবাদের ক্ষেত্রে প্রগতির সবচেয়ে বড় অনুঘটক হলো শ্রেণি বৈষম্য, অর্থাৎ বুর্জোয়া ও প্রলিটারিয়েতদের মধ্যকার সংঘাত। আর তাদের প্রগতির শেষ পর্যায় হলো শ্রেণিহীন একটি সমাজ বা Classless Society তৈরি, যে সমাজে ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো সম্পদ থাকবে না, সবাই সমান থাকবে এবং ধর্মের কোনো স্থান থাকবে না। বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রের যে ধরণ, তাদের আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের ধরণ তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের আকাঙ্ক্ষিত সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, পরিবারের সাথে পরিবারের সম্পর্কসহ এ ধরনের বিষয়গুলো নতুন করে বিন্যস্ত হবে। কোনো কোনো সমাজতান্ত্রিকের মতে তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবারের অস্তিত্বই থাকবে না। তারা তাদের এ চিন্তাধারাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, বলকান এবং আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই, তাদের কৃত ওয়াদা এবং তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য ছিল না।
এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের “অ্যানিমেল ফার্ম” (Animal Farm), যেখানে সুস্পষ্টভাবে এ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক প্রগতিবাদের ইতিহাস পড়লেই বুঝা যায়, এটি ছিল মূলত একটি ইউটোপিয়া, যার সাথে মানুষের ফিতরাত ও মানব ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। সেই সাথে এটি ছিল সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল একটি আন্দোলন, যে আন্দোলন মানুষের শক্তিকে পুঁজি করে, পুঁজিবাদের প্রতি মানুষের আক্রোশকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠেছিল। এটি ছিল একটি ব্যর্থ বিপ্লব, যা কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৪ কোটির বেশি, কিন্তু শুধুমাত্র সোভিয়েত রাশিয়ার ৭০ বছরের আমলে মারা গেছেন ৬ কোটিরও বেশি মানুষ। একটি বিপ্লব বা একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কী পরিমাণ মানুষকে খুন করা হয়েছে! এতগুলো মানুষ মারা যাওয়ার পরেই তাদের উপলব্ধিতে এসেছে যে, তাদের এ তথাকথিত মতবাদ প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে এবং এ মতবাদ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যদিও বিভিন্ন আদলে তাদের আন্দোলন এখনো জারি আছে, কিন্তু তার অনুভূতি যতদিন যৌবনের তেজ থাকে, শক্তি-সামর্থ থাকে, ততদিনই জারি থাকে, তারপর তারা কেউ ব্যবসা করে, কেউ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ঢোকে, তারপর তারা লিবারেলিস্ট হয়ে যায়। এটিই তাদের ইউটোপিয়া। এ ধরণের ইউটোপিয়া লিবারেল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদের প্রস্তাবিত ভবিষ্যত দর্শনেও পরিলক্ষিত।
সমাজতান্ত্রিক এবং লিবারেলিস্টদের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য হলো সমাজতান্ত্রিকরা বিপ্লবকে (Revolution) প্রাধান্য দিয়ে থাকে, অন্যদিকে লিবারেলিস্টরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক পরিবর্তন, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন, আইনের পরিবর্তন, সংস্কৃতির পরিবর্তনকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। মৌলিক এ পার্থক্যের দিক থেকে লক্ষ্য করলে উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই ব্রিটেনের কথা উল্লেখ করা যায়। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীল রাষ্ট্রের একটি হলো ব্রিটেন, যে রাষ্ট্র আমূল পরিবর্তনের (Radical change) মাধ্যমে স্থিতিশীলতা লাভ করেছে। ব্রিটেনে সে অর্থে কোনো রক্তাক্ত বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। অনন্য শক্তিধর দেশ জাপানও কোনো রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অন্যদিকে সমাজ পরিবর্তনের পন্থা হিসেবে রক্তাক্ত বিপ্লবকে বেছে নেওয়া অন্যতম প্রধান রাষ্ট্র হলো ফ্রান্স। ফ্রান্স আজও স্থিতিশীল হতে পারেনি, আজও হরতালে অগ্নি সংযোগে প্যারিসের রাজপথ পুড়ে যায়। নেপোলিয়নের ফ্রান্সে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছে, তা অকল্পনীয়। আর তাদের এ বিপ্লবের কারণ হলো যে কোনো মূল্যে প্রভাব বিস্তার। সমাজের একটি অংশ যখন তাদের মতাদর্শ গ্রহণ করবে এবং যখন তারা শক্তির অধিকারী হবে, তখন সমাজের বাকি অংশ যদি তাদের পক্ষে না আসে বা তাদের মতাদর্শের আলোকে কাজ করতে না পারে, তাহলে তারা যে কোনো মূল্যে তাদের প্রতিহত করবে। তারা হয় তাদের হত্যা করবে, না হয় নির্বাসনে পাঠাবে। এটিই তাদের বিপ্লবের মূল কথা।
একইভাবে লিবারেলিস্টদের চিন্তাধারায় বিপ্লবের পরিবর্তে বিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তাঁদের মূলনীতি হলো Revolution নয় Evolution। অর্থাৎ তারা মানুষকে ধাপে ধাপে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এমনকি রূপান্তরের মাধ্যমে তাদের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যায়। লিবারেলিজমের আলোকে সমাজ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো শিক্ষা, মিডিয়া, আইন এবং অন্যান্য উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ। যার কারণে আমরা তাদের পন্থা সহজে বুঝতে পারি না। বিষয়টা অনেকটা এমন যে, সমাজতান্ত্রিকরা সরাসরি মাথায় আঘাত করে, আর লিবারেলিস্টরা এনেস্থিসিয়া দিয়ে অচেতন করে ধীরে ধীরে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে যায়, অথচ আমরা টেরও পাই না। কিন্তু উভয়টিরই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো মানুষকে শোষণ করা এবং মানুষের উপর আধিপত্য কায়েম করা।
এ সমাজতান্ত্রিক এবং লিবারেলিস্টদের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যও রয়েছে, তা হলো উভয়েই নিজেদের চিন্তাধারাকে বৈজ্ঞানিক বলে দাবি করে এবং তারা দাবি করে যে তারা ডগম্যাটিক নয়। তাদের অন্যতম একটি চিন্তাধারা হলো ইউরোপের একজন নিউটনের পূর্বে বিজ্ঞান ছিল না, সবই ছিল থিওলজি বা হিকমা। যেহেতু তারা তার পরবর্তী যুগে বসবাস করছে, তাই তাদের জন্য প্রযোজ্য হলো; বৈজ্ঞানিক নয়, এমন বিষয়গুলোকে ধর্তব্যে না নেওয়া। তারা তাদের নিজ নিজ চিন্তাধারাকে বৈজ্ঞানিক দাবি করার কারণ হলো তারা মনে করে তাদের চিন্তাধারাকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে, এছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পন্থা নেই। আর তা বাস্তবায়িত হলে দুনিয়া একটি সুন্দর দুনিয়া হবে এবং এর ফলে দুনিয়া সমৃদ্ধির সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, তারপর আর কোনো ধরনের অনুসন্ধানের প্রয়োজন হবে না। তখন ইতিহাসও তার লক্ষ্যে উপনীত হবে। তারপর তাদের মধ্যে কেউ কেউ “The End of History” বই রচনা করবে! অতঃপর তাদের সজ্জিত দুনিয়ায় সকলকে বসবাস করতে হবে।
আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, সমাজতান্ত্রিক ও লিবারেলিস্টদের দর্শনকে বৈজ্ঞানিক বলার মূল কারণ হলো তাদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা। মুসলমানরা আখিরাতের প্রতি যেমন দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে, তাদের চিন্তাধারার প্রতি তাদের বিশ্বাসও অনুরূপ। অর্থাৎ যে বিষয়টি বৈজ্ঞানিক, সেটিই একমাত্র সত্য। গোটা বিশ্বকেও এ সত্য মেনে নিতে হবে, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, অন্যথায় পরিণতি হবে করুণ। তাদের মতে, তাদের এ প্রগতির সামনে যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকে যে কোনো মূল্যে, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে সরিয়ে দিতে হবে, এ দুনিয়াতে বসবাস করার কোনো অধিকার তার নেই। সোভিয়েত রাশিয়া এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তৎকালীন সময়ে যারা পুঁজিবাদ এবং বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল, তাদেরকে হত্যা করা হতো বা নির্বাসনে পাঠানো হতো। বর্তমানে বলকান, ককেশাস এবং সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তার মূল কারণও এটিই। তাদের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সামনে যারাই দাঁড়াবে, যারাই তাদের ভিশনের বিরোধী, তারা একইসাথে উন্নতি, অগ্রগতি এবং প্রগতির বিরোধী, আর এজন্য তাদের যে কোনো মূল্যে নিঃশেষ করতে হবে। লিবারেলিজম নিয়ে আলোচনার সর্বাগ্রে লিবারেলিজমের সংজ্ঞা নিয়ে আলোকপাত জরুরী।
এন্ড্রো হেইউড (Andrew Heywood) তার “Politics” নামক গ্রন্থে লিবারেলিজমের মূল ধারণা (key-idea) হিসেবে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলো হলো-
- ১. Individualism.
- ২. Freedom.
- ৩. Reason.
- ৪. Equality.
- ৫. Toleration.
- ৬. Consent.
- ৭. Constitutionalism.
এখানে তারা reason এর ক্ষেত্রে progress বা প্রগতিকে এবং equality এর ক্ষেত্রে meritocracy কে প্রাধান্য দিয়েছে। Consent এর ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, চুক্তির ভিত্তিতে সমতা থাকতে হবে। সাদা চোখে এ ধরনের বই পড়লে কেউ লিবারেলিজমের বিরোধিতা করবে না, কিন্তু এর পেছনের দর্শন জানলে যে কেউ আশ্চর্য হয়ে যাবে। তারা আমাদের সবাইকে প্রতারিত করে, পূর্বে যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, এনেস্থিসিয়া দিয়ে অচেতন করে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়া হচ্ছে, অথচ আমরা টেরই পাচ্ছি না। কিন্তু যখন এনেস্থিসিয়ার প্রভাব ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে, তখন আমরা দেখছি আমাদের কারো চোখ নেই, কারো হাত নেই, কারো পা নেই! এহেন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় হলো আমাদের ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে হবে যে, তারা কীভাবে আমাদের প্রতারিত করছে। আর এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে জানতে হবে লিবারেলিজম কী, লিবারেলিস্টরা কেমন স্বপ্ন নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছিল এবং তাদের মূল ওয়াদা বা ভবিষ্যৎ দর্শন কী। মূলত লিবারেলিস্টদের ওয়াদা বা ভবিষ্যৎ দর্শন হলো তারা দুনিয়াকে জান্নাতে পরিণত করবে। কিন্তু তারা কেমন জান্নাতের স্বপ্ন দেখে? লিবারেলিজমের পেছনে কার্যকরী সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। মূলত ব্রিটিশ সম্প্রসারণবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক যে বিকাশ, এ চিন্তার পেছনের মূল চিন্তা হলো লিবারেলিজম। অর্থাৎ ব্রিটিশ পুঁজিবাদের সম্প্রসারণই হলো লিবারেলিজমের মূল লক্ষ্য।
লিবারেলিস্ট অর্থনীতিবিদ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার “The End of History and The Last Man” বইয়ের মূল কথা হলো- “অর্থনীতির ক্ষেত্রে লিবারেলিজম এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে ডেমোক্রেসি। এ দুটি ছাড়া মানুষের আর কোনো গন্তব্য নেই। আর এ গন্তব্যে পৌঁছানোর মানে হলো আর কোনো কিছু অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই।”
Bernard Mandeville এর বিখ্যাত বই “The Fable of the Bees”, তাঁর সবচেয়ে বড় সফলতা হলো এ বইয়ে তিনি আখলাক এবং অর্থনীতিকে পরস্পর থেকে আলাদা করছেন। তবে এ আখলাক হলো খ্রিস্টান ধর্মের আখলাক। তার মতে অর্থনীতির মূলভিত্তি হলো সুদভিত্তিক পুঁজিবাদ। এ বইটি মূলত একটি উপন্যাস, যেখানে মৌমাছিদের ঠিকভাবে কাজ না করা, অলস বসে থাকার পেছনে ধর্মীয় (খ্রিস্টান ধর্ম) বৈরাগ্যবাদকে তুলে ধরা হয়েছে। যখন দ্বীন থেকে আখলাককে সরিয়ে নেওয়া হলো, তখন মৌমাছিদের উৎপাদন ব্যপকভাবে বেড়ে যায় এবং তারা সমৃদ্ধি লাভ করে। মৌমাছিরা ঠিকভাবে কাজ না করার কারণ হলো বৈরাগ্যবাদ, আর এ বৈরাগ্যবাদ খ্রিস্টানদের রূহানিয়াত। ম্যান্ডেভিলের ভাষ্যে, “যদি আমরা উন্নতি এবং অগ্রগতি চাই, তাহলে আমাদের আখলাক ও দ্বীন থেকে দূরে থাকতে হবে। অন্যথায় আমরা উন্নতি করতে পারবো না।” এ বইয়ের উপর ভিত্তি করে অর্থনীতির জনক হিসেবে পরিচিত এডাম স্মিথ তার “The Wealth of Nations” বই লিখেন, যে বইকে অর্থনীতির বাইবেল বলা হয়। এ বই আখলাক এবং অর্থনীতিকে আলাদা করাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। পরবর্তীতে এ বইয়ের উপর ভিত্তি করেই মার্কেন্টালিজম বা ব্রিটেনের অর্থনীতি দাঁড়ায়। এখানেই লিবারেলিস্ট অর্থনীতির বীজ গ্রোথিত।
উপরোক্ত বিষয়গুলোকে ভালোভাবে না বুঝলে শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ বণিক সভ্যতাকে, বর্তমান অর্থনীতির মূল ভিত্তিকে বুঝা সম্ভব নয়। আমরা ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি, ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আমরা জানি না যে টাকার সংজ্ঞা কী! মার্কেন্টালিজম বুঝা ছাড়া কারো পক্ষে বর্তমান অর্থনীতি নিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। অর্থনীতি এবং আখলাকের মধ্যকার বিভাজনকে না বুঝে কারো পক্ষে অর্থনীতি নিয়ে কল্যাণমূলক কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। সাম্রাজ্যবাদীদের বিখ্যাত ঐতিহাসিক বাকল (Henry Thomas Buckle) বলেন, “যারা মেধাবী ও গতিশীল, তাদের আখলাককে নয়, বরং মেধাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ মেধা অগ্রসর হয়, শানিত হয়, কিন্তু আখলাক এক ধরণের প্রতিবন্ধকতা, যার জন্য যা ইচ্ছা তাই করা যায় না।” অর্থাৎ, তাদের মতে তাদের প্রগতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো দ্বীন ও আখলাক। এক্ষেত্রে এ দ্বীন ও আখলাক হলো খ্রিস্টান ধর্ম ও খ্রিস্টানদের আখলাক। একইভাবে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বা সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো অধ্যয়ন করি, তখন দেখতে পাই, দ্বীন ও আখলাক বাদ দিয়ে এমন এক ধরনের অর্থনৈতিক দর্শন ও সমাজদর্শন দাঁড় করানো হচ্ছে, যার সাথে আমাদের সমাজের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। তাহলে কেন আমরা তাদের বর্জনকৃত দ্বীন ও আখলাকের সাথে আমাদের দ্বীন (ইসলাম) ও আখলাককে মিলিয়ে ফেলছি?
আমরা মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, “আমরা দুনিয়া ও আবিরাত উভয় জগতে কণ্যান চাই” এবং আল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ায় তোমাকে যে অংশ দেওয়া হয়েছে, সেটি তুমি ভুলে যেও না। আমাদের মূল সমস্যা হলো আমরা স্বীন ও দুনিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নিত্তপণ করতে পারছি না, সমন্বয় করতে পারছি না। সমন্বয় করতে না পারার মূল কারণ হলো দ্বীনের ব্যাপারে প্রান্তিক ধারণা। ইসলামে দ্বীন ও দুনিয়ার স্বরূপ তেমন তা সঠিকভাবে না জানার কারণে কেউ শুধু দ্বীনের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে, আবার কেউ শুধু দুনিয়ার পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। অথচ দুটোই ইসলামের আদালতকে খারিজ করে দিচ্ছে। এ বিষয়টি আমাদের বুঝা প্রয়োজন, সেই সাথে আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, বর্তমান ব্যবস্থায় দ্বীন বলতে যে খ্রিস্টানদের ধর্ম এবং আখলাক বলতে যে খ্রিস্টানদের আখলাককে বুঝানো হয়, এর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সমাজতান্ত্রিক প্রগতিবাদ এবং লিবারেল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদ উভয়টিই দ্বীন ও আখলাককে প্রধান শত্রু মনে করে, এক্ষেত্রে তারা এক। তাদের পার্থক্য হলো মালিকানা নিয়ে ধারণার ক্ষেত্রে। লিবারেল পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদ মালিকানা রক্ষার চেষ্টা করে, আর সমাজতান্ত্রিক প্রগতিবাদ মালিকানা উৎখাতের চেষ্টা করে, অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকানা বলতে কিছু থাকবে না।
বর্তমান বিশ্ব-অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষ সম্পদের মালিক নয়, মালিক হলো এরিস্ট্রোক্রেটরা। স্পেন ছাড়া সমগ্র ইউরোপে দশ হাজার এরিস্ট্রোক্রেট আছে, যাদেরকে Land Lord বলা হয়। মূলত তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করার জন্য প্রণিত ব্যবস্থাই হলো লিবারেলিজম। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটেনের কথা বলা যায়, ব্রিটেনের অর্থনীতি ভূমি মালিকানার সাথে সম্পর্কিত। যেমন- ব্রিটেনের পার্লামেন্টে দুইটি হাউজ রয়েছে, হাউজ অব কমন্স এবং হাউজ অব লর্ডস। হাউজ অব কমন্সের সদস্য সংখ্যা ৬৫০ জন এবং হাউজ অব লর্ডসের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৮০০ জন। প্রকাশ্যে হাউজ অব কমন্স এর বির্তক প্রচারিত হয়, কিন্তু কোনো নীতিই হাউজ অব কমন্সে পাস হয় না। অর্থাৎ এটি একটি কমিটি ছাড়া কিছুই নয়। সেই সাথে হাউজ অব কমন্সে যারা নির্বাচিত হয়, তাদেরকে এরিস্ট্রোক্রেটরা প্রোপাগান্ডার জন্য টাকা, ঘুষ প্রদান করে। অন্যদিকে আমেরিকার ধর্ম হলো Civil Religion। এই Civil Religion-ই তাদের প্রথম মূলনীতি। তাদের দ্বিতীয় মূলনীতি হলো, ব্যক্তিগত সম্পদে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করা যাবে না। মূলত এরিস্ট্রোক্রেটদের মালিকানা সু-সংহত করবে, তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করবে এ ধরনের পদ্ধতিই লিবারেলিজম।
এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো ব্রিটিশদের সবচেয়ে বড় দার্শনিক, লিবারেলিজম চিন্তাধারার বড় অগ্রপথিক জন লক এর বিখ্যাত বাণী, “প্রথম মালিকানা কীভাবে অর্জিত হলো তা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই, মালিকানা অর্জিত হওয়ার পর তা রক্ষা করাই হলো মূল বিষয়।” এ অনুসারে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বাংলা অঞ্চলসহ গোটা পৃথিবী থেকে যত কিছু লুট করে নিয়ে সংরক্ষণে রাখা হয়েছে, এগুলোর জন্য কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে তারা রাজি নয়, বরং তাদের চিন্তার বিষয় হলো কীভাবে এসব সম্পদ তারা রক্ষা করবে। আমাদের দেশে যদি কেউ ব্যাংকে মোটা অংকের টাকা জমা দিতে যায়, প্রশাসন প্রথমেই তারা টাকার উৎস অনুসন্ধান করবে। অন্যদিকে আমেরিকাতে প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে দুই ট্রিলিয়নের বেশি টাকা পাচার হয়। টাকা পাচারকারীদের জান্নাত হলো আমেরিকা এবং কানাডা। অথচ এসব দেশে এ টাকার উৎস নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসাবাদের ব্যবস্থাই নেই। একইভাবে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জন লক বলেছিলেন, “রাষ্ট্র হলো মালিকানা রক্ষা করার জন্য গঠিত একটি ব্যবস্থা। মালিকানা রক্ষার স্বার্থে রাষ্ট্র মানুষকে মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারে।”
ব্রিটেন এরিস্ট্রোক্রেটদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র, যেখানে তারাই সম্পদের মালিক। সম্পদের মালিকানা রক্ষায় তাদের নীতি হলো “যে মালিকানার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।” অর্থাৎ রাষ্ট্র হলো এরিস্ট্রোকেটদের ভূমির মালিকানা রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা। মার্কস তার “Das Capital” বইয়ে তৎকালীন লন্ডনের অবস্থা তুলে ধরেছেন। এ বইয়ে তিনি শ্রমিকদের উপর কৃত অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। লন্ডনের ফ্যাক্টরিগুলোতে বিভিন্ন শর্তের আলোকে মানুষকে কাজ করানো হতো। সে শর্তগুলো এতটাই কঠিন ছিল যে, তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুবকরা তাদের যৌবনের উৎসাহ, উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলতো, শিশুরা হারিয়ে ফেলতো শৈশবের কোমলতা। তার এ বই মূলত ক্যাপিটালজমের নির্মম জুলুম-নির্যাতনের বর্ণনা, যেখানে তিনি লন্ডনকে এ জুলুম-নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে, এ জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছিলো এরিস্ট্রোক্রেটরা। তাদের সম্পদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, অন্যদিকে প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণি দিন দিন দরিদ্র হচ্ছিলো, নির্যাতিত, নিপিড়ীত হচ্ছিলো।
তারা তাদের শিল্পের বিকাশের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশকে শেষ করে দিয়েছে, বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন অঞ্চলকে শোষণ করেছে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, সে সময়ে জন লক, জন স্টুয়ার্ট মিল, থমাস ম্যালথাস-সহ বড় বড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীদের ভূমিকা কী ছিল? তিক্ত হলেও সত্য, তারা জুলুমকে গ্রহণযোগ্য বানানোর জন্য এবং সমগ্র পৃথিবীতে একমাত্র বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার জন্য তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। যেমন- জন লকের তত্ত্ব। এর উদাহরণ আমরা এডাম স্মিথের পুঁজি সম্পর্কিত বইগুলোতেও দেখতে পাই। তার মতে প্রাকৃতিক সম্পদ বা নগদ টাকা পুঁজি নয়, পুঁজি হলো শ্রম। তাদের চিন্তাধারা, ব্যবস্থাকে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই মূলত তারা এ ধরনের তত্ত্ব আবিষ্কার করতো। সামগ্রিকভাবে তাদের লক্ষ্য ছিল মালিকানার উপর ভিত্তি করে একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যে ব্যবস্থা মালিকানা বৃদ্ধি করবে, ধনীদেরকে আরও ধনী বানাবে। সেই সাথে অন্য মানুষের উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা তারা তৈরি করবে, যেটি বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করবে।
সে সময়ে এত বিস্তৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল না। ইউরোপের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস শিল্পায়নের সাথে জড়িত। শোষিতরা যেন তাদের ফ্যাক্টরিতে তাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলতে পারে, সেই মানে তাদেরকে উন্নীত করার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। এটিই শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ইতিহাস। আর তালের ব্যবস্থার অধীনে মানুষকে কাজ করতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে নিয়ে আসা হয় ব্যক্তিস্বার্থকে। মানুষের মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া হয় যে, তুমি যদি কাজ করো, তাহলে তুমি ধনী হতে পারবে, যাকে বলা হয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। এখানে আখলাক এবং দ্বীনের কোনো স্থান নেই। ডেভিড হিউম বলেছিলেন, “যদি আমরা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তবে তাদেরকে ব্যক্তিস্বার্থের পেছনে ধাবিত করতে হবে। কেননা ব্যক্তিস্বার্থ এমন একটি বিষয়, যা তাকে ব্যবস্থা (System) থেকেই অর্জন করতে হবে, যার কারণে তাকে অবশ্যই ব্যবস্থার অধীনে আসতে হবে।” ব্যক্তিস্বার্থের পেছনে ছুঁটে চলা মানুষের চিন্তায় থাকে সে কীভাবে কর্পোরেট, ব্যবস্থার (System) একজন ভালো শ্রমিক হবে। ব্যক্তিস্বার্থকে ব্যবহার করে মানুষকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি আমরা ফেরাউনের শাসনব্যবস্থায়ও দেখতে পাই। ফেরাউন তার জাতির উপর সবচেয়ে বেশি জুলুম করতো, তাদেরকে নিগৃহীত করতো, নিপীড়িত করতো, অসম্মানিত করতো, তবুও তারা ফেরাউনের আনুগত্য করতো, কারণ তারা ছিল ফাসেক জাতি। আর ফাসেক হলো তারা, যারা আল্লাহ এবং রাসূলের (স.) চেয়ে, আল্লাহর জন্য সংগ্রামের চেয়ে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ, সম্পদ, পরিবারকে বেশি গুরুত্ব বা প্রাধান্য দেয়। এমনকি কেউ যদি ব্যক্তিস্বার্থের পেছনে ছুটে বেড়ায়, শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন গঠন করে, তাহলে সে সারাদিন আল্লাহকে স্মরণ করলেও, নামাজ পড়লেও সে ফাসেক জাতিরই অন্তর্ভুক্ত হবে। আর এটি করতে পারলেই তারা সফল। এ লক্ষ্যেই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সকল ব্যবস্থা তাদের চিন্তার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। একজন মুসলমানের উচিত এ ব্যপারে সজাগ থাকা। কারণ যে ব্যক্তিস্বার্থের পেছনে না ছুটে মানুষের কল্যাণের পেছনে ছুটে বেড়ায়, তাকে পৃথিবীর কোনো শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আর এ বিষয়টি আল্লামা ইকবাল তার “আসরারে খুদী ও রমুজে বেখুদী”তে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। এজন্য আমাদের খুদীকে বিকশিত করতে হবে, ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করতে হবে। একইসাথে এর মাধ্যমে যেন সমাজের মানুষ উপকৃত হয়, সমগ্র পৃথিবীর মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে বেঁচে থাকার সুযোগ পায়, তারা যেন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্রীড়নকে পরিণত না হয়, সে আলোকে কাজ করা আমাদের আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। শুধুমাত্র অর্থের পেছনে ছুটে বেড়ালে আমাদের জীবন হবে লাঞ্চিত, নিপীড়িত।
দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম একজন শেয়ার হোল্ডার। তিনি নিজেও একজন লর্ড ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, By the natural growth of civilization, power passes individual to masses. And the worth and importances of an individual as compared with the mass sink into grater and grater insignificance! অর্থাৎ, “সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে প্রাকৃতিক গতিধারা, তা ক্ষমতাকে ব্যক্তির হাত থেকে একটি গোষ্ঠীর হাতে নিয়ে যায় (এখানে গোষ্ঠী বলতে সাধারণ মানুষ নয়, বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি) এবং যখন ব্যক্তির মূল্য বা গুরুত্বকে এ গোষ্ঠীর সাথে তুলনা করা হয়, তখন ব্যক্তি মূল্যহীন হয়ে পড়ে।” ব্যক্তি যদি মূল্যহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সে কাজ করবে কেন? মূলত এটিই হলো লিবারেলিজম। তাদের ভাষ্যে, “সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে গোষ্ঠীসমূহের শক্তি আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। এখানে মূল বিষয় হলো বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ, এখানে ব্যক্তির ভূমিকা অর্থহীন। এখানে ব্যক্তি উৎপাদনের একটি উপাদান মাত্র।”
জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, “আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে, যে শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে মানুষ বসবাস করবে এবং এ শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি উপ-শাখা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।” অর্থাৎ তারা মনে-প্রাণে এটিই বিশ্বাস করাবে যে, আমাদের সুন্দর একটি ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে পারে হয় ইউরোপ, না হয় আমেরিকা। মূলত এসব কারণেই আমাদের ফিকহ ভিত্তি হারিয়েছে, মুসলমানরা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, মাদরাসাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে, তার স্থলে বর্তমান ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে। তারা শুধুমাত্র এ শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই সাথে এমন একটি বিশ্বাস তৈরি করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে যে, এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা হয় না। আর তাদের এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তাদের দুটি পন্থা রয়েছে-
১. অর্থনৈতিক শক্তি।
২. মনস্তাত্ত্বিক শক্তি।
পূর্বে লিবারেলিস্টদের অর্থনৈতিক শক্তি আলোচিত হয়েছে। এবারের আলোচ্য বিষয় তাদের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি। মানুষের মনস্তত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তৎকালীন সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল উপন্যাস (যেমন- ড্যানিয়েল ডিফোর “রবিনসন ক্রুসো”), আর বর্তমানে সিনেমা। অর্থনীতি আর মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা বুঝানোর চেষ্টা করে যে, এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কিছু হতে পারে না। তারা বলে, তারা প্রতিটি ব্যক্তিকে শক্তিশালী বানায়, তাকে Freedom বা মুক্তি নেয়, Reason বা মুক্তচিন্তা দেয়, Equality বা সমতা দেয়, Toleration বা ধৈর্য্য শেখায়, Consent বা একতা শেখায়, Constitutionalism শেখায়। আদতে তারা শক্তিশালী করার নামে মানুষকে নফসের দাস হিসেবে গড়ে তুলে, মানুষের নফসের চাহিদা, আবেগ, যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা পূরণ করাকেই মানুষের স্বপ্নে পরিণত করে, এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যতটুকু স্বাধীনতা দরকার, ততটুকু স্বাধীনতার ব্যবস্থাই তারা করে। মূলত পুঁজিবাদ কোনো পণ্য বানানোর পূর্বে তার ক্রেতা বানায়। তাদের প্রদত্ত স্বাধীনতা হলো মানুষের জৈবিক চাহিদা বা নফসের চাহিদা পূরণ করার স্বাধীনতা, সেই সাথে যতদিন কেউ পুঁজিবাদের সেবা করবে, ততদিন সে স্বাধীন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ‘American Dream’।
American Dream হলো একজন সঙ্গী, একটি কুকুর, দুইটি সন্তান, খাবার ভর্তি একটি ফ্রিজ, একটি ভালো গাড়ি। আর এটি কিন্তু বর্তমানে Dream of the World, যুব সমাজের স্বপ্ন! ইসলাম মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। কিন্তু একইসাথে ইসলাম মানুষকে শেখায় মানুষের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী? মানুষের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকে, মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে শুধুমাত্র কয়েকটি বৈষয়িক বিষয়ের মধ্যে নামিয়ে আনা মানবতার প্রতি অপমান, কারণ মানুষ হলো খলিফাতুল্লাহ। এজন্য আমাদের জীবনে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। কাদেসিয়ার যুদ্ধের আগে পারস্যের সেনাপতি রুস্তমের সামনে রিবঈ (রা.) এর ভাষণ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তিনি দৃপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন, “আল্লাহ আমাদরকে পাঠিয়েছেন মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করে আল্লাহর গোলাম বানানোর জন্য, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে আখিরাতের বিশালতার দিকে ধাবিত করার জন্য। আমরা বিভিন্ন ধর্ম কর্তৃক সৃষ্ট মানুষের গোলামী থেকে মানুষকে মুক্ত করে ইসলামের আদালতের দিকে নিয়ে যেতে চাই।” অথচ আমরা গোলামী করি কোম্পানির! আমাদের জীবনের স্বপ্ন একটা কোম্পানির কর্পোরেট অফিসার হওয়া। আমরা আমাদের জীবনকে American Dream এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি, অথচ আমাদের জন্য সমগ্র পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছে, সমগ্র মহাকাশ, মহাজগৎ সৃষ্টি করা হয়েছে! আমরা যদি শুধুমাত্র আমাদের জীবনকে, জীবনের লক্ষ্যকে কয়েকটি বস্তুগত চাহিদার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখি, সেটি হবে আমাদের নিজেদের প্রতিই অপমান। কারণ, আমরা হিবাতুল্লাহ (আল্লাহর দেওয়া উপহার)। আমাদের ভেতরে আল্লাহর ফুঁকে দেওয়া রূহ রয়েছে। এজন্য আমাদের সর্বপ্রথম আমাদের মানবিক মর্যাদা বা খুদীকে আবিষ্কার করতে হবে।
লিবারেলিজমের দর্শনকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, লিবারেলিজম নামে যা দেখানো হয়, তা Irony ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে ইউরোপের অনেক ভালো ভালো চিন্তাবিদও রয়েছেন, যাদেরকে ভালোভাবে পড়া উচিৎ। কেউ যদি পুঁজিবাদকে ভালোভাবে খণ্ডন করতে চায়, তাহলে তার জন্য মার্কস এর “Das Capital” পড়াই যথেষ্ট। কেউ যদি ড্যানিয়েল ডিফোর “রবিনসন ক্রুসো” কে খন্ডন করতে চায়, তাহলে তার উচিত Michel Tournier রচিত ‘Friday’ নামক গ্রন্থটি পড়া। কেউ যদি লিবারেলিজমকে খণ্ডন করতে চায়, তাহলে তার জন্য বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক কার্ল স্কিমিদ এর বইগুলো পড়াই যথেষ্ট। তার একটি বিখ্যাত বই হলো “Political Theology: Four New Chapters on the Concept of Sovereignty”। কার্ল স্কিমিদের মতে, “সত্যিকারের লিবারেলিজম আমাদের সামনে উপস্থাপিত লিবারেলিজমের সম্পূর্ণ বিপরীত।” এটিই মূলত লিবারেলিজমের সার-নির্যাস।
এবারের আলোচ্য বিষয় এ লিবারেলিস্টরা কেমন দুনিয়া চায় বা তাদের ওয়াদাকৃত জান্নাতের স্বরূপ কেমন। লিবারেলিস্টদের লক্ষ্য হলো World State বা বিশ্বরাষ্ট্র। তাদের মতে বিশ্বরাষ্ট্রই হলো ইতিহাসের সর্বশেষ পর্যায়, তারপর আর কিছু নেই। বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, আর এটি তারা প্রতিষ্ঠা করবে, যারা এ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী, অর্থাৎ এরিস্ট্রোক্রেট, ডেমোক্রেটিক, ক্যাপিটালিস্ট চিন্তাধারায় বিশ্বাসীরা। অন্যদের দ্বারা এটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এ বিশ্বরাষ্ট্র ব্যবস্থা কেমন হবে তা সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরেছেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক, ব্রিটেনের ইতিহাসে এংলো স্যাক্সন ওয়ার্ল্ডের প্রতিনিধিত্বকারী সবচেয়ে বড় দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। তিনি একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব, এ কথা অনস্বীকার্য। বর্তমান প্রযুক্তি দুনিয়ার অনেক কিছুই তার “Principia Mathematica” এর উপর নির্ভরশীল। Logic and Linguistic এ তার ভূমিকা অনন্য, এক্ষেত্রে তার বিকল্প নেই। বার্ট্রান্ড রাসেলেরই স্বপ্ন ছিল বিশ্বরাষ্ট্র। লিবারেলিস্টদের ওয়াদাকৃত এ জান্নাতের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি তিনি। তার রচিত “Scientific Outlook” বইটি লিবারেলিস্টদের ওয়াদাকৃত জান্নাতের রূপরেখা।
তিনি বিশ্বরাষ্ট্রকে তুলে ধরছেন এভাবে, “লিবারেলিজমের উপর ভিত্তি করে যে আধুনিক সমাজ তৈরি হবে, সেটি হবে প্রোপাগান্ডার উপর ভিত্তি করে। আর এ প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তারা মানুষকে বুঝাবে। এ পদ্ধতিতে তৈরিকৃত প্রোপাগান্ডাই হবে আধুনিক সমাজের মূলভিত্তি অর্থাৎ Advertisement”। রাসেলের এ কল্পিত দুনিয়ায় গণতন্ত্র বলে কিছু থাকবে না, কারণ গণতন্ত্র থাকলে বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। Oligarchy এর উপর ভিত্তি করে বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, আর এ Oligarchy ভূমির উপর ভিত্তিশীল হবে না, এটি হবে বিজ্ঞানীদের একটি সমাজ অর্থাৎ Scientific Oligarchy, যেখানে বিজ্ঞানীগণ হবেন মূল স্তম্ভ। তিনি তার বইয়ে বলছেন, উদাহরণ স্বরূপ রাশিয়ার কথাই ধরা যাক, আজকের গতিশীল ও মেধাবীরা একবার ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার পর প্রথম দিকে অধিকাংশ মানুষের বিরোধীতার সম্মুখীন হলেও তাঁরা তাঁদেরকে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখতে সক্ষম হবে। দিন যত অতিবাহিত হবে ক্ষমতা ততই বংশগত অলিগার্কদের হাত থেকে বুদ্ধিজীবী অলিগার্কদের হাতে চলে যাবে। যে সকল দেশ দীর্ঘদিন যাবত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে সেই সকল দেশে এই অলিগার্কদের একচ্ছত্র আধিপত্য অগাস্টাসের রোমের মত ডেমোক্রেসির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে পারবে। তবে অন্যান্য স্থানে এই অলিগার্কদের মুখোশ খুব দ্রুতই খসে পড়তে পারে। যদি নতুন ধরণের একটি সমাজকে তৈরি করতে হয় তাহলে সেখানে চিন্তাগত Oligarchy অবশ্যম্ভাবী। এখানে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, নতুন এক ধরণের অলিগার্ক গড়ে উঠবে আর এই অলিগারশিক গ্রুপ (মানুষের মধ্যে ছোট্ট একটি গোষ্ঠী) রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাকে ব্যবহার করবে এবং তাঁদের শাসন ব্যবস্থা যেন মানুষের সামনে গ্রহণযোগ্যতা পায় এই ভাবে তাঁরা মানুষকে কনভিন্স করার চেষ্টা করবে। আর এই ক্ষেত্রে প্রপাগাণ্ডা হবে তাঁদের মূল হাতিয়ার।
এরপর তিনি আরও বলেন, সে অলিগার্কদের মধ্যে মাঝেমধ্যে সমস্যা হলেও, দিনশেষে অলিগার্কদেরই একটি শ্রেণি সমগ্র পৃথিবীর ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারবে এবং একটি বিশ্বব্যপী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে; এক্ষেত্রে রাশিয়া একটি উদাহরণ। তাদের এ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বরাষ্ট্র খারাপও হতে পারে, আবার ভালোও হতে পারে। অর্থাৎ ছোট একটি গোষ্ঠী সমগ্র দুনিয়াকে শাসন করার জন্য একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে এবং এবং সমগ্র দুনিয়াকে তাঁরা সেই ব্যবস্থার মাধ্যমে শাসন করবে! সমগ্র মানবতার ভবিষ্যতের জন্য লিবারেলিস্টদের এটাই হলো ওয়াদা! এমন একটি সমাজই সবচেয়ে অগ্রসর সমাজ বলে বিবেচিত হবে! রাসেলের ভাষায়, তাদের এ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বরাষ্ট্র খারাপও হতে পারে, আবার ভালোও হতে পারে। এই উভয় অবস্থায় একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ আর সেটা হলো; যেকোনো অবস্থায় তাদের বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিকে ধারণ করতে হবে। অন্যথায় তাঁদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভবপর হবে না। বৈজ্ঞানিক পন্থা সর্বদায় সংগঠন (Organization) চায়, আর বিজ্ঞান যত বেশী অগ্রসর হবে তাঁর কাঙ্ক্ষিত সংস্থাও ততবেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে! তাঁরা কেমন একটি সংগঠন (Organization) চাচ্ছে? এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ! কেননা যে ব্যক্তি এই কথা বলছেন তিনি মার্ক্সিস্ট কিংবা সোশ্যালিস্ট কোনো ব্যক্তি নন। এই ব্যক্তি একজন ব্রিটিশ লর্ড। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দার্শনিকদের একজন। এই ব্যক্তি এই সব কথা বলছে। এই ব্যক্তি মানবতার জন্য এমন একটি বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, এখানে যুদ্ধকে এক পাশে রেখে চিন্তা করলে আন্তর্জাতিক একটি ব্যাংকিং, ফাইন্যান্স এবং ট্রেড সিস্টেমের দরকার, যার মাধ্যমে শুধু কিছু দেশ নয়, সকল দেশের উন্নতি এবং অগ্রগতি নিশ্চিত হবে। এর মানে কী? International Organization of Credit and Banking এর মানে কী? এর অর্থ হলো সকল অর্থনৈতিক লেনদেন একটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হবে। কাকে কত ঋণ দেওয়া হবে, কোন খাতে দেওয়া হবে, কোন খাতে দেওয়া যাবে না, এই সকল বিষয়ই একটি মাত্র কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হবে। রাসেলের মতে, এ ধরণের বিশ্বরাষ্ট্রের সুবিধাসমূহ হবে অনেক বেশি। প্রথমত যুদ্ধের কোনো ভয় থাকবে না। তবে অস্ত্র তৈরি করার জন্য যে প্রতিযোগিতা করা হচ্ছে নিঃসন্দেহে সেটা বৃথা যাবে না। বিশেষ করে যুদ্ধবিমান ও রাসায়নিক অস্ত্র থেকে উপকৃত হতে হবে যেন কেউ শক্তির সামনে দাঁড়াতে না পারে। কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা কখনো কখনো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরিবর্তিত হলেও হতে পারে। কিন্তু এটি শুধুমাত্র ব্যক্তি পরিবর্তন করবে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু পরিবর্তন করতে পারবে না। এটি তার স্বকীয়তা রক্ষা করার জন্য যে কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা চালাতে পারবে। যদি এ রকম একটি বিশ্বরাষ্ট্রকে কোনো প্রজন্ম একবার ধরে রাখতে পারে, তাহলেই এটি স্থিতিশীল হবে। কীভাবে স্থিতিশীল হবে? এর জবাবে রাসেল বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক সুবিধা অর্জিত হবে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার কারণে অপচয় বলতে কোনো কিছু থাকবে না, পেশাগত জীবনে কোনো ধরণের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকবে না, দরিদ্রতা থাকবে না, খারাপ ও ভালো দিন চক্রাকারে আবর্তিত হবে না, যারা কাজ করবে তাঁরা আরাম আয়েশে জীবন যাপন করবে। আর যারা কাজ করতে অনাগ্রহ দেখাবে তাঁদের স্থান হবে জেলখানা। অর্থনীতিকে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজে লাগানো হবে। (অর্থাৎ কতজন মানুষ জন্ম নিবে এটা নির্ভর করবে অর্থনৈতিক সামর্থ্যের উপর)। হয়তোবা সকল মানুষকে শুধুমাত্র একটি স্থলভূমিতে রাখা হবে। মানুষের জীবনকে হুমকিতে ফেলে দিতে পারে এমন ধরনের সকল বিষয়কে উৎখাত করা হবে এবং অকাল মৃত্যুর হার কমে আসবে।
বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর এই চিত্রিত বিশ্বরাষ্ট্রকেই জান্নাত হিসেবে অভিহিত করেন! এমন একটি রাষ্ট্রই হলো লিবারেলিস্টদের ওয়াদাকৃত জান্নাত। আর তাঁদের এই জান্নাতে মানুষের অবস্থা কেমন হবে এটা রাসেলের মুখেই শুনা যাক, “আর এ ওয়াদাকৃত জান্নাতে মানুষ সুখী হবে কি হবে না সেটা আমি জানি না। বসবাস করার জন্য সকল কিছুকে অর্জন করার পর মানুষ সুখী হবে কি হবে না সেটার জন্য কি করা প্রয়োজন সেই শিক্ষা হয়তোবা জৈব রসায়ন (Biochemistry) দিবে।” এখানে রাসেল বায়োকেমেস্ট্রির কথা কেন আনলেন? এর অর্থ হলো মানুষকে সুখে রাখার জন্য ঔষধ তৈরি করা হবে। মনে করেন আজকে আপনার মন খারাপ, একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিবেন যা আপনাকে খুশিতে রাখবে। এরপর সে প্রশান্তি অনুভব করবে। লিবারেলিস্টদের চিন্তাধারায় সুখ বলতে এতটুকুই। এখন কথা হলো নেশা করার সাথে সুখ পাওয়ার জন্য ঔষধ খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য কি? মানুষকি তাঁর ব্যথা কিংবা দুঃখকে ভুলে থাকার জন্য নেশা করে না? একবার চিন্তা করুন মানুষকে জৈব রসায়ন (Biochemistry) এর মাধ্যমে সুখী করার চিন্তা কেমন একটি চিন্তাধারা!!
শুধু তাই নয় দেখুন লিবারেলিস্টরা তাঁদের জান্নাতে মানুষ সুখে রাখার জন্য কোন ধরণের প্রস্তাবনা পেশ করে। রাসেলের ভাষায়, কেউ কেউ মানসিক অশান্তির কারণে অরাজকতা সৃষ্টিকারী হতে পারে বলে তাঁদেরকে দমিয়ে রাখার জন্য বিপজ্জনক কিছু খেলাধুলার আবিষ্কার করা যেতে পারে। জুলুমকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে খেলাধুলাতে স্থানান্তর করা হবে। প্রস্তাবিত সমাধানের দিকে খেয়াল করুন। আর খেলাধুলার ক্ষেত্রে কী এখন এগুলোই হচ্ছে না? বর্তমানে ক্রীড়াজগতে আমরা তাকালে দেখতে পাই যে বিভিন্ন ধরনের খেলা রয়েছে এবং সেগুলোকে বৈজ্ঞানিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যদি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কমিয়ে আনা ও তাঁদেরকে নিয়ন্ত্রিত একটি স্রোতের দিকে ধাবিত করা। তিনি আরও বলেন, ফুটবলের পরিবর্তে আকাশ থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করার প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা যেতে পারে। এক দিক থেকে দেখলে রাসেলের এই প্রস্তাবনা হলো, রোমানদের গ্লাডিয়েটরের আধুনিক রূপ! তদের প্রস্তাবিত জান্নাতে মানুষকে গ্লাডিয়েটর হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। তাঁদের চিন্তার সীমানা এতটুকুই।
তিনি আরও বলেন, মৃত্যু যখন মানুষের হাতের মুঠোয় থাকবে, বিজয়ের নেশায় মৃত্যুর দিকেও ধাবিত হওয়া থেকে দ্বিধা করবে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে উপর থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষকে বিনোদন দেওয়া ছাড়া হয়তো অন্য কিছু হবে না, হয়তো এমন দিনও আসবে যখন তাঁকে বীরের মর্যাদা দেওয়া হবে। অর্থাৎ এমনভাবে প্রোপাগান্ডা চালানো হবে যে, অমুক ব্যক্তি এত হাজার ফিট উপর থেকে গড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। সে সকলের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ইত্যাদি বলে মানুষের নিকটে এই ধরনের খেলাকে গ্রহণযোগ্য করা হবে। রাসেলের ভাষায়, এ ধরণের আরো অনেক পন্থা অবলম্বন করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সুনিয়ন্ত্রিত একটি শিক্ষাব্যবস্থা ও খাদ্যব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের মধ্যকার অরাজকতার চিন্তা ও অন্যান্য অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
আর মানুষের জীবন ধারাকেও একটি সানডে স্কুলের কোচিং সেন্টারের মত নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। অবশ্যই সেখানে একটি বিশ্বজনীন ভাষা তৈরি করা হবে। আর এই বিশ্বজনীন ভাষাটি কেমন হবে? এই ক্ষেত্রে রাসেলের প্রস্তাবনা হলো, এই ভাষা হবে হয় এসপেরান্টো (Esperanto), আর না হয় পিডগিন ইংলিশ (Pidgin English)। আর অতীতের অনেক কিছুকেই এই ভাষায় অনুবাদ করা হবে না। কেননা ঐ সকল চিন্তা এই ভাষার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা ও অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না। যারা ইতিহাস নিয়ে কাজ করবে তাঁরা ‘হ্যামলেট’ এবং ‘অথেলোর’ মত গ্রন্থসমূহকে ব্যাখ্যা করার জন্য সরকার থেকে অনুমতি নিতে পারবে তবে এগুলা জনসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ করা হবে। শিশুদেরকে রেড ইন্ডিয়ান ও অন্য কোনো জাতির ইতিহাস পড়ার সুযোগ দেওয়া হবে না!
এটিই লিবারেলিজমের ওয়াদাকৃত জান্নাত। এখানে আমরা হয় তাদের ব্যবস্থার গোলাম হবো, অন্যথায় আমাদের জায়গা হবে কারাগারে। এ জান্নাতে মানুষের সুখ মূখ্য নয়, বরং তারা মানুষকে কল্পিত সুখে ডুবিয়ে রাখবে মাদক ও ভোগ-বিলাসের মাধ্যমে। আর তাদের ভাষা হিসেবে পিডগিন ইংরেজিকে বেছে নেওয়ার কারণ হলো এ ভাষায় ব্যাকরণ মুখ্য নয়, শুধুমাত্র ভাব প্রকাশই মুখ্য। ভাষা হলো চিন্তা ও ধারণা প্রকাশের বড় একটি মাধ্যম। প্রতিটি ভাষাতেই মূল্যবোধের কথা উল্লেখিত আছে, স্রষ্টার কথা উল্লেখিত আছে। প্রতিটি ভাষাতেই ভালোর কথা বলা হয়েছে, খারাপের কথা বলা হয়েছে, জাতির বীরত্বের গৌরবের কথা বলা হয়েছে। আর এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে এমন দুনিয়ার জন্য তারা সবচেয়ে উপযুক্ত ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছে পিডগিন ইংরেজিকে (Pidgin English)। আর পূর্বের বইগুলো এ পিডগিন ইংরেজিতে অনূদিত না হওয়ার কারণ হলো এর ফলে উদ্ভূত আবেগকে তারা অর্থনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে সমর্থ হবে না। সেই সাথে তারা সকলকে অতীত ভুলিয়ে দিয়ে অতীত ইতিহাসের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কবিহীন এক জাতিতে রূপান্তরিত করতে চায়। আর সত্যিকার ভালোবাসার ধারণা মুছে দিয়ে এর পরিবর্তে তাৎক্ষণিক বিনোদনের ব্যপারগুলোকে তুলে ধরতে চায়, যা তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সহায়ক। এখন যদি আমরা বর্তমান দুনিয়ার সাথে তাদের ওয়াদাকৃত জান্নাতকে মিলিয়ে দেখি, তবে কী দেখবো? আমেরিকার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, তাহলে আমেরিকা চীনের সাথে সংঘর্ষে না গিয়ে রাশিয়ার সাথে কেন সংঘর্ষে গেলো? কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য বিশ্বরাষ্ট্র একটু হলেও ধাক্কা খেয়েছে। ট্রাম্প চীনের দিকে নজর দিতে গিয়ে রাশিয়ার দিকে নজর দিতে পারেনি, যে কারণে ন্যাটো দুর্বল হয়ে গিয়েছে। যায়নবাদী সভ্যতা ন্যাটোর মাধ্যমেই ইউরোপে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। আর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কিন্তু মানুষ মারা গেলেও তাদের কিছু যায়-আসে না, কিন্তু যেকোনো মূল্যে আধিপত্য বজায় রাখতে হবে, ন্যাটোর অবস্থান ঠিক রাখতে হবে। এটিই হচ্ছে মূল ব্যপার।
এ বিষয়গুলোকে আমাদের সামগ্রিকভাবে পড়তে ও উপলব্ধি করতে হবে। নিজে উপলব্ধি করে অপরকে উপলব্ধি করানো, মানুষের সামনে তুলে ধরা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। আমাদেরকে মুসলমানদের মধ্যকার সাহায্য ও সম্প্রীতির জাগরণ ঘটাতে হবে, ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র পৃথিবীতে তা ছড়িয়ে দিতে হবে, সেই সাথে এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ডি-৮ এর কার্যক্রম শুরু হওয়ার মাধ্যমে এ উদ্যোগ আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলো, কিন্তু পরবর্তীতে আর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অথচ এই ডি-৮ ছিল একবিংশ শতাব্দীর যুবকদের জন্য সবচেয়ে বড় আশার বাতিঘর। ইউরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রায় পরিণত হয় ১৯৯৭ সালে, অন্যদিকে আমাদের অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা ইসলামিক দিনারের ধারণা সৃষ্টি হয় ১৯৭৪ সালে। আমাদেরকে লিবারেলিস্টদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমাদের নিজস্ব অর্থনেতিক ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে এ মুহূর্তে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন সবচেয়ে বেশি জরুরী। আমাদেরকে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
লিবারেলিস্টদের বৈজ্ঞানিক রূপরেখার জবাব আল্লামা ইকবাল ১৯৩২ সালেই দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমাদের বড় বড় আলেমগণ আমাদের সতর্ক করেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তারা কাজ করেছেন। আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ এক অর্থে তাদের বিরুদ্ধে একটি জোরালো সতর্কবার্তা। কিন্তু আমরা এখনো নিজেদেরকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে পারি না, যার ফলে তাদের কৌশল গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের। যদি আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা না করি, তাহলে আমরা ধাপে ধাপে বিশ্বরাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ শিকারে পরিণত হবো। কিন্তু আমরা যদি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, কাজ করি, তাহলে সফলতা অবশ্যই আসবে, এটি আল্লাহর ওয়াদা। এ লক্ষ্যে যদি আমরা ২০ কোটি মানুষের বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারি, তবে তা বিশ্বের ১৯০ কোটি মুসলমানের আশার আলো হবেই। জুলুম কখনোই চিরস্থায়ী হয় না, আজ হোক বা কাল, জুলুমের পতন ঘটবেই। কিন্তু এ পতন কতটুকু ত্বরান্বিত হবে তা নির্ভর করে আমাদের চেষ্টা ও কাজের উপর। ফেরাউনী সাম্রাজ্যের যদি পতন হতে পারে, রোম সাম্রাজ্যের যদি পতন হতে পারে, সাসানীদের যদি পতন হতে পারে, এই যায়নবাদী সভ্যতারও পতন অবশ্যই হবে এবং তা হবে আমাদের হাত ধরেই, ইনশাআল্লাহ।


