গত সপ্তাহে এই স্তম্ভে আমি মুসলিম জাতির বিশেষ করে বাংলাদেশের মুসলমানদের চতুর্মুখী সংকটের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম। আমি দেখিয়েছিলাম যে, এই দেশে এখন স্বাধীনভাবে খৃস্টানরা ধর্ম চর্চা ও তাদের মিশনারী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দুরা তাদের পূজা অর্চনা করছে এবং ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর সৌজন্যে তাদের মন্দির ও উপাসনালয়গুলো মুসলমানদের শয়ন কক্ষে পৌঁছে গেছে। ফলে মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েরা হিন্দু ও খৃস্টানদের শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হচ্ছে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তাদের ধর্মীয় অনুশাসনসমূহ শিখছে এবং অনুকরণ করছে। পক্ষান্তরে ৯০ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতিকে শুধু অবজ্ঞাই করা হচ্ছে না-উপহাস করা হচ্ছে। ইসলামী অনুশাসনের অনুসরণ অনেকের দৃষ্টিতেই একটি অপরাধ। ইসলামের ষষ্ঠ জিহাদকে ‘জঙ্গিবাদ’ এবং ইসলামী বই পুস্তককে ‘জঙ্গি সাহিত্য’ হিসাবে আখ্যায়িত করে পুলিশ ও আইন- শৃঙ্খলা বাহিনী বাজেয়াপ্ত করছে। কুরআন ক্লাস থেকে দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ মেয়েরা গ্রেফতার হচ্ছে। কুরআন ও তার তাফসীর চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এই দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দারুল ইসলামের পরিবর্তে দারুল হরব বলে পরিগণিত হচ্ছে। এই অবস্থা আমাদের ঈমান-আকিদার জন্য ক্ষতিকর। এ থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় হচ্ছে ইসলামী দলগুলো এবং ওলামায়ে কেরামের ঐক্য।
এই ঐক্যের কথা বহুল আলোচিত হলেও মুসলমানদের মধ্যে যাতে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ঐ প্রচেষ্টার অভাব নেই। তথাপিও অনেকেই ঐক্যের কথা বলছেন। কিছুকাল আগে মসজিদ মিশনের ইমাম সম্মেলনের তরফ থেকে ঐক্যের ডাক দেয়া হয়েছিল। চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম সাহেব এক আলোচনা সভায় বলেছেন যে, বাংলাদেশে এখন ইসলামী মূল্যবোধের উপর চূড়ান্ত আঘাতের আয়োজন চলছে, ইসলামপন্থীদের ঘায়েলের চেষ্টা চলছে। ইসলামী মূল্যবোধ ও দেশ রক্ষায় সব ভেদাভেদ ভুলে কালেমায় বিশ্বাসী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। কুরআন রক্ষা ও কুরআন চর্চার স্বাধীনতার জন্য ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কোনো পথ আছে বলে আমি মনে করি না।
বলাবাহুল্য, এই কুরআনের বদৌলতেই আমরা কেউ পীর-মাশায়েখ, আলেম-উলামা এবং কেউ সাধারণ ঈমানদার মুসলমান হিসেবে বেঁচে আছি। একসময় এই কুরআনকে অনুসরণ করে আমাদের পূর্বপুরুষরা সারাবিশ্বে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি, আবিষ্কার উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সারা দুনিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কুরআনের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে আমরা কয়েক শতাব্দী ধরে অধঃপতিত অবস্থায় রয়েছি এবং সারা দুনিয়ার মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও সর্বত্র নিগৃহীত নির্যাতিত জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছি। অবশ্য এই অবস্থা থেকে উত্তরণের আন্দোলন থেমে নেই। গত শতাব্দী থেকেই এই আন্দোলন সারাবিশ্বে ধীরে ধীরে বেগবান হচ্ছে এবং বর্তমান শতাব্দীর এই দশকে এসে তা বিরোধী শক্তির ভিতকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে ইসলামী শক্তির পুনরুজ্জীবন এ দেশের বাম ও রামপন্থী এবং প্রতিবেশী মুশরেক ও ইহুদীবাদীদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো থেকেই শুধু কুরআনের শিক্ষা ও ইসলামী মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় না বরং আমাদের ভবিষৎ বংশধররাও যাতে ইসলামের জন্য বৈরী একটি শক্তি হিসেবে গড়ে উঠে তা নিশ্চিত করতেও উঠে-পড়ে লেগেছে। বিডিআর ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের প্রচেষ্টা, শিক্ষানীতি থেকে ইসলামী জীবনাদর্শ ও মূল্যবোধের নির্বাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদরাসার ছাত্রদের প্রবেশ নিষিদ্ধকরণ, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পুনঃপ্রবর্তন, ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগে বরেণ্য আলেম-উলামাদের গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, মাদরাসাসমূহকে জঙ্গিপ্রজনন কেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িতকরণ প্রভৃতি হচ্ছে এসব অপপ্রয়াসের অংশ। আলেমদের অনৈক্য এবং ঈমান-আকিদা ও জাতিসত্তা রক্ষায় সাধারণ মানুষের অনীহা তাদের জন্য মূলধন হিসেবে কাজ করেছে।
আলেমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হন এবং কুরআনের শিক্ষা, ইসলামী মূল্যবোধ ও ভ্রাতৃত্বে মুসলমানদের উজ্জীবিত করেন তা হলে এই অপশক্তিকে পরাভূত করা কঠিন কোনো কাজ নয়। দেশে প্রায় তিন লাখ মসজিদ আছে এবং এই মসজিদগুলোতে স্থায়ীভাবে প্রায় ৩ লাখ ইমাম ও ৩ লাখ মুয়াজ্জিন রয়েছেন। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাযের আগে তারা খুতবা পাঠ করেন। মূল খুতবা আরবীতে হলেও তার আগে মসজিদসমূহে ইমাম সাহেবরা অন্তত ১৫ মিনিট করে বাংলায় ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন। তাদের এই ওয়াজ-নসিহত ও আলোচনার যে মেয়াদ তা নির্ণয় করতে গেলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের তিন লাখ মসজিদের তিন লাখ ইমাম সপ্তাহে সম্মিলিতভাবে ৭৫০০০ কর্মঘণ্টা ওয়াজ- নসিহত করেন। প্রতি মাসে এই সময়ের পরিমাণ অনূন্য ৩ লাখ কর্মঘণ্টা এবং বছরে ৩৬ লাখ কর্মঘন্টা বা ১০,০০০ কর্ম বছর। এর জন্য আলাদা কোনো সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ব্যবস্থা করতে হয় না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই প্রতি শুক্রবার জুমার জামায়াতে শরীক হওয়া মুসল্লিরা এর শ্রোতা। আলেমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হন, ইমামরা যদি অকুতোভয় হন তাহলে ইসলামী মূল্যবোধে মানুষকে উজ্জীবিত করা এবং ইসলামবিরোধী শক্তির মুখোশ উন্মোচনের জন্য জুমার নামাযের প্লাটফর্মেও চেয়ে শক্তিশালী কোনো প্লাটফর্ম আছে বলে আমি মনে করি না। ইসলামের ব্যাখ্যা দেবেন হক্কানী আলেম-উলামা, কুরআন এবং সুন্নাহ হচ্ছে তাদের ইলমের উৎস। এই ব্যাখ্যা যদি আসে মুরতাদ ও মুশরিকদের কাছ থেকে তা হলে আলেমরা বসে থাকতে পারেন না। বাংলাদেশে তাই হচ্ছে। যে আল্লাহর ওপর তারা ঈমান এনেছেন সেই আল্লাহর ওপর জীবন ও রিযিকের ভার ছেড়ে দিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাদের মধ্যে যদি বিভেদ থাকে অথবা কুফরী শক্তির প্ররোচনা কিংবা নগদ অর্থবিত্তের মোহে যদি তারা বিভেদ বিচ্ছেদে জড়িয়ে পড়েন তা হলে মুসলিম মিল্লাতকে যেমন বাঁচানো যাবে না তেমনি ইসলামী মূল্যবোধ আকিদা, বিশ্বাস ও এদেশ থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। এ প্রেক্ষিতে চরমোনাই পীর মোহতারাম মুফতি রেজাউল করিম কালেমার দাবি নিয়ে যে ঐক্যের এবং ঐক্যবদ্ধ কর্মপন্থার ডাক দিয়েছেন তাকে আমি অভিনন্দনযোগ্য বলে মনে করি। আমি ইতিঃপূর্বে এই কলামে একাধিকবার বলেছি যে, ভিন্নমত পোষণ করা ইসলামে হারাম নয়। এ প্রেক্ষিতে আলেম-উলামাদের মধ্যে মতভেদ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে কিভাবে ভিন্নমত পোষণ করতে হয় সে সম্পর্কে আমরা অনেকেই পরিপূর্ণভাবে অবহিত নই।
মু’মিনদের মধ্যে পারস্পরিক সমালোচনা কিংবা মতভেদের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে তারা যখন স্ব স্ব মত প্রকাশ করবেন তখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, দরূদ ও অনুকম্পা এবং সহনশীলতার চেতনা জাগ্রত থাকবে। একজন মানুষ যখন বুঝতে পারবেন যে, শরীয়া এমন একটি বিষয় যা মানুষের সামগ্রিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য ও পরিব্যাপ্ত এবং তা বিস্ময়করভাবে নমনীয় তখনি তিনি এ ধরনের প্রসারিত অন্তরের অধিকারী হতে পারেন। কোনো কিছু জানা বা হৃদয়াঙ্গম করা একটি মানবিক গুণ এবং যেহেতু প্রত্যেকটি মানুষ একেকটি স্বতন্ত্র সত্তা সেহেতু এই অভিজ্ঞান বিভিন্ন মতের জন্ম দেয়া অস্বাভাবিক নয়। ইসলামী শরীয়ার মূলনীতি ও মৌলিক চেতনাকে যতক্ষণ পর্যন্ত এই ভিন্নমত আঘাত না করবে তক্ষণ পর্যন্ত এতে দোষের কিছু নেই। ফিকাহ শাস্ত্রে ইলম আল খিলাপ নামে কটি শাখা আছে। এতে শরীয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভিন্নমতের ক্ষেত্র এবং সীমা-পরিসীমা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এতে খিলাফ ও ইখতিলাফের বৈশিষ্ট্য এবং এই সুযোগ ব্যবহারকারীর যোগ্যতা সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা রয়েছে। খিলাফ বা ইখতিলাফ যদি নিঃস্বার্থ এবং আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) নির্দেশিত পন্থার অনুসরণে হয় তাহলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের জন্য তা কল্যাণকর। আমাদের সম্মানিত আলেম সমাজ নিশ্চয়ই অবহিত আছেন যে, ইখতিলাফ যদি শরীয়া বহির্ভূত ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে হয় তাহলে তা অবশ্যই হারাম, ইসলামে ইখতিলাফ বা ভিন্নমত পোষণের অনুমতি আছে বলেই বিভিন্ন ইমামের নেতৃত্বে বিভিন্ন মাজহাবের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মতবাদের ইমামগণ শরীয়া অনুশীলনের পদ্ধতির ব্যাপারে পারস্পরিক ভিন্নমত প্রকাশ করলেও তারা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং কেউ কাউকে কখনো ইসলাম বিচ্যুত মনে করতেন না এবং তাদের অনুসারী হক্কানী আলেম সমাজও তা মনে করেন না। ইখতিলাফ সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা অপরিহার্য। ইখতিলাফ বা ভিন্নমত বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি বা বিবাদে রূপান্তরিত হলে চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি করে যা দ্বীনি সম্পর্ক নষ্ট কওে দেয়। এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না, পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফে দ্ব্যর্থহীনভাবে মুসলমানদের ঐক্য, সংহতি ও অঙ্গীকারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,
إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلَّذِينَ يُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِهِۦ صَفّٗا كَأَنَّهُم بُنۡيَٰنٞ مَّرۡصُوصٞ
অর্থাৎ, আল্লাহ্ ভালোবাসেন সেই লোকদের যারা এমনভাবে কাতারবন্দি হয়ে লড়াই করে যেন তারা সীসাঢালা প্রাচীর। (সূরা ছফ: ৪)
ঈমানদারদের কাছে আল্লাহর দাবি হচ্ছে এই সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্য। এই ঐক্য বিনাসী ইখতিলাফ ঈমানের দাবিদার কারোরই কাম্য হতে পারে না। কুরআন মাজীদে আরো বলা হয়েছে,
وَٱعْتَصِمُوا۟ بِحَبْلِ ٱللَّهِ جَمِيعًۭا وَلَا تَفَرَّقُوا۟ ۚ وَٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتَ ٱللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَآءًۭ فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِۦٓ إِخْوَٰنًۭا
অর্থাৎ তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আল্লাহর সেই অনুগ্রহকে স্মরণ কর যা তিনি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন। তোমরা পরস্পর দুশমন ছিলে তিনি তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ফলে তোমরা তারই অনুগ্রহে পরস্পর ভাই হয়ে গেলে (আলে ইমরান- ১০৩)।
আল্লাহ্ আরো বলেছেন,
وَمَن يَعْتَصِم بِٱللَّهِ فَقَدْ هُدِىَ إِلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ
অর্থাৎ আর যে ব্যক্তি আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে সে নিশ্চয়ই সত্য ও সঠিক পথের সন্ধান পাবে। (আলে ইমরান- ১০১)
অনুরূপভাবে আল্লাহ কলহ বিবাদ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদকেও নিষিদ্ধ করেছেন। কলহের সৃষ্টি করতে পারে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করাও ইসলামের দৃষ্টিতে দূষণীয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَقُل لِّعِبَادِى يَقُولُوا۟ ٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ ۚ إِنَّ ٱلشَّيْطَـٰنَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ ۚ إِنَّ ٱلشَّيْطَـٰنَ كَانَ لِلْإِنسَـٰنِ عَدُوًّۭا مُّبِينًۭا
অর্থাৎ আর হে মোহাম্মদ আমার মুমিন বান্দাদের বল তারা যেন মুখ থেকে সেসব কথাই বের করে যা অতি উত্তম। আসলে শয়তানই মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে থাকে, প্রকৃত কথা হচ্ছে শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৫৩)
আল্লাহর রাসুল (সা.) বিভিন্ন হাদিসে দলাদলি ও বিভক্তির ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়ো না। তোমাদের পূর্বে যারা দলাদলি ও বিভক্তিতে লিপ্ত হয়েছে তারা। ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।” ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে শরীয়ার বিধি বিধানের বিরোধিতা করা, তার পথ ও পন্থা থেকে বিচ্যুত করার লক্ষ্যে পরিচালিত খিলাফ ও ইখতিলাফ পরিষ্কারভাবে কুফরের বৈশিষ্ট্য বহন করে এবং এ ধরনের ভিন্নমত পোষণকে ঈমানদারদের জন্য হারাম করা হয়েছে। অনুরূপভাবে শরীয়ার বিধিবিধান প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত কোনো সংস্থা বা দলকে হেয় করাও বিধিসম্মত নয়।
এখানে তিনটি বিবেচ্য বিষয় আছে :
(১) মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক, যদি এই মতপার্থক্য ধ্বংসাত্মক বিভেদের রূপ নেয় তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
(২) বিভেদাত্মক মতপার্থক্য পরিহার করার জন্য সতর্কতা অবলম্বনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
(৩) যে মতপার্থক্য মিল্লাতকে দলাদলিতে লিপ্ত করে তা হারাম। যারা এই দলাদলিতে ইন্ধন যোগায় আখিরাতে তাদের জন্য বিরাট শান্তি অপেক্ষা করছে।
আল্লাহ্ কালামে পাকে পরিষ্কার বলেছেন, যারা বিভক্ত হয়ে যায় এবং পরিস্কার হেদায়েত আসার পরও দলাদলিতে লিপ্ত হয় তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। ইখতিলাফ সম্পর্কে এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। এক. ইসলামী শরীয়ায় মতপার্থক্য কি প্রয়োজন না একটি সম্ভাবনা মাত্র? দুই, এই মতপার্থক্যের পরিধি কি? মতপার্থক্যের সবটাই কি দূষণীয়, না এর অংশ বিশেষ প্রশংসার যোগ্য? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ্ রাববুল আলামীন তার সৃষ্টি বৈচিত্র্য অনুধাবন করার জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষকে তিনি বিভিন্ন জাতি, গোত্র ও বর্ণে বিভক্ত করেছেন পরিচিতির জন্য। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা আমাদের কাজ এবং এই ঐক্য চেতনার পরিপন্থী সকল প্রকার বিভেদাত্মক
পথ-পন্থাই পরিত্যাজ্য। বিভক্তি মুসলিম মিল্লাতের কাম্য নয়, ঐক্যই তার চরম লক্ষ্য। বিভক্তির বিরুদ্ধে রাসূল (সা.)-এর একটি বড় সতর্কবাণী রয়েছে। তিনি বলেছেন, ইহুদী জাতি ৭১টি ফেরকায় বিভক্ত হয়েছিল, খৃস্টানরা ৭২টি এবং আমার উম্মতরা ৭৩টি উপদলে বিভক্ত হবে, এর মধ্যে একটি ছাড়া আর সবগুলো দলই জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। এই হাদিসটি আমাদের আলেম ওলামা এবং নেতৃবৃন্দসহ গোটা মিল্লাতের প্রতি একটি হুঁশিয়ারি যাতে করে তারা এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না করেন যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আমাদের বিজ্ঞ আলেম ওলামারা কুরআন, হাদিস ও ফিকাহ শাস্ত্রসহ ইসলামী শরিয়া সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান রাখেন বলে আমি বিশ্বাস করি। বাংলাদেশসহ সমসাময়িক বিশ্বে মুসলমানদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কেও তারা নিশ্চয়ই অবহিত আছেন। ইহুদী, খৃস্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি একজোট হয়ে সারা দুনিয়া থেকে মুসলমানদের উৎখাত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলছে।
আফগানিস্তান ও ইরাককে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যে মানব বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব ইরাককে ধ্বংস করলো সে অস্ত্রের সন্ধান ইরাকে পাওয়া যায়নি। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের সাথে বিন লাদেন ও তালেবানদের সম্পৃক্তিকে প্রধান অভিযোগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এই অভিযোগ অদ্যাবধি যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারেনি। এর মধ্যে দু’টি মুসলিম জনপদের লাখ লাখ লোক হত্যার শিকার হয়েছে, যারা বেঁচে আছে তারা তাদের সহায় সম্পদ হারিয়েছে, কেউ পঙ্গুত্ব হয়েছে আবার কেউ পথের কাঙ্গাল। এখন পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মুসলিম শক্তির উত্থানকে রোধ করার জন্যই ইসলাম বিরোধী শক্তি একের পর এক মুসলিম দেশগুলোকে টার্গেট করে নিয়েছে। চেচনিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মীরসহ বিশ্বের বহু দেশে মুসলমানরা পাইকারী নির্যাতনের শিকার। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের জন্য তাদের এককভাবে দায়ী করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য এদেশেরই একটি অপশক্তি দেশে বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন মুসলিম জাতিসত্তাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন থেকে ইসলামকে নির্বাসিত করার জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে জোরদার করা হয়েছে। বরেণ্য আলেম ওলামা ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম, নির্যাতন, গ্রেফতারী রিমান্ডের স্টীমরোলার চলছে। যারাই ইসলামের কথা বলছেন, ইসলামী অনুশাসন মেনে চলছেন এবং অন্যদের মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা জঙ্গি-মৌলবাদী হিসেবে শুধু অভিহিতই হচ্ছেন না বরং তাদের কণ্ঠ স্তব্ধও করে দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে আলেম হয়ে যাতে কেউ ভালো দ্বীনি ইলম নিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারে তার জন্য মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকেও নাস্তিক মুশরেকদের অভিসন্ধি অনুযায়ী ঢেলে সাজানো হয়েছে। জিহাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে এবং জঙ্গিবাদের উৎস হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইসলামী বই পুস্তককে জিহাদী বই আখ্যা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে এবং সরকারিভাবে পরিপত্র জারি করে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরাকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। মানুষের ঈমান আকিদার ওপর এ ধরনের আঘাত ইত:পূর্বে আর কখনো আসেনি এই অবস্থায় হক্কানী আলেম ওলামা, পীর মাশায়েখরা যদি ঐক্যবদ্ধ না হোন তাহলে ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্তাকে এদেশে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আধিপত্যবাদী শক্তি ও তাদের দোসররা তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের কাজকে সহজতর করার জন্য একশ্রেণির আলেম ওলামাকে বিভিন্ন প্ররোচনায় প্রভাবিত করার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে।
এই অবস্থায় এদেশের সকল শ্রেণির আলেমদের আতাতুর্কের তুরস্ক এবং সাদ্দামের ইরাক থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরী বলে আমি মনে করি। কয়েক শতাব্দি ধরে খেলাফতের কেন্দ্রভূমি হিসেবে পরিচিত শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশ তুরস্ক থেকে খেলাফতের উৎখাত এবং সে দেশে ধর্মহীন সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। কামাল আতাতুর্ক আমাদের শাসকদের ন্যায় পরিকল্পিত কৌশলই অবলম্বন করেছিলেন। ১৯২৪ সালে মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুরস্কে খেলাফত উৎখাত করে নতুন তুর্কী প্রজাতন্ত্র যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এই প্রজাতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। না। প্রতিষ্ঠিত হবার পর দীর্ঘ তের বছর পর্যন্ত এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ছিল, যদিও মোস্তফা কামাল রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলামী মূল্যবোধকে ধ্বংস করে পাশ্চাত্যের সেক্যুলার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই কাজে তিনি একশ্রেণির আলেমদের ব্যবহার করেছিলেন, তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং মোস্তফা কামালকে তার সকল অপকর্মে সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের সহযোগিতায় তিনি হক্কানী আলেম এবং ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নির্মূল করে মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৩৭ সালে শাসনতান্ত্রিক নীতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। যে আলেমরা তাকে সহযোগিতা করেছিলেন মৃত্যুর আগে তিনি তাদেরও ধ্বংস করেছিলেন। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনও ইরাকের সমাজজীবন থেকে ইসলামের উৎখাত এবং নাস্তিক্যবাদী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে একশ্রেণির আলেমকে তার সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই আলেমরাই তার হাতে চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন। ইতিহাসের নির্মমতায় আজ সেই আলেমরাও নেই, সাদ্দাম হোসেনও নেই। রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে ইসলামকে নির্বাসিত করে।
তারই এককালের বন্ধুদের কাছে তিনিও চরম মূল্য দিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে কালেমা পড়ে তার পাপ মোচন হয়েছে বলে কেউ মনে করেন না। আমাদের আলেম-ওলামারা ইতিহাস থেকে যত দ্রুত শিক্ষা নেবেন ততই মঙ্গল। শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বর্তমানে মুসলিম মিল্লাতের অনুকূল নয়। ঘরের শত্রুরা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি তৎপর। ঘরে-বাইরে উভয় ফ্রন্টের যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য নায়েবে রাসূলদের এখনি এগিয়ে আসার সময়। আমাদের মধ্যে শরিয়া প্রয়োগের পন্থা নিয়ে অতীতে ভিন্নমত ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
কিন্তু আমরা যারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তৌহিদে বিশ্বাস করি, রিসালাত, খেলাফত ও আখেরাতের ওপর আস্থা রাখি এবং ইসলামকে জীবন বিধান হিসেবে স্বীকার করি, সামান্য ইখতিলাফ সত্ত্বেও তারা কি সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না? মিল্লাতের এই দুর্দিনে এই ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ওলামায়ে কেরামের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি বলে আমি মনে করি। ছোটখাট বিভেদ ভুলে গিয়ে যুগের চেতনাকে সামনে রেখে তারা তাদের এই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবেন এটাই জাতির প্রত্যাশা ।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ঐক্যের পাশাপাশি আদর্শিক ঐক্য প্রতিষ্ঠাকেও বিশ্লেষকরা অপরিহার্য বলে মনে করছেন। এই আদর্শিক ঐক্যে ইসলামী দল এবং আলেম সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করলে আলেমদের ঐক্যের বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য, এক সময় এই দেশের আলেমদের একটা বৃহৎ অংশ রাজনীতিকে হারাম বলে মনে করতেন। সত্তরের দশক পর্যন্ত এই অবস্থা ছিল। কিন্তু পরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং মরহুম হাফেজজী হুজুরের মতো জাঁদরেল আলেমও রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাকে অনুসরণ করেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, ফজলুল হক আমিনী প্রমুখ।
১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর হাফেজজী হুজুরের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা ফজলুল হক আমিনী, আল্লামা আজিজুল হক, মাওলানা বোরহান উদ্দিন, মাওলানা ফজলুল করিম চরমোনাই প্রমুখ এই আন্দোলনে ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ৩ মার্চ চরমোনাই পীর, মাওলানা ফজলুল করিম ও আরো ৫ জন আলেম একটি শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করেন এবং ওই দিনই ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন গঠন করেন। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে খেলাফত আন্দোলন দুই ভাগ হয়ে যায়, একভাগের নেতৃত্ব দেন মাওলানা শাহ আহমদ উল্লাহ আশরাফ আরেক ভাগের নেতৃত্ব দেন মাওলানা মমিনুল্লাহ। বলাবাহুল্য, এর আগে ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর খেলাফত আন্দোলনের অংশ বিশেষ এবং যুব শিবিরের অংশ বিশেষ নিয়ে খেলাফত মজলিস গঠিত হয়।
২০০৫ সালের ২২ মে আবার শায়খুল হাদিস ও মাওলানা ইসহাকের নেতৃত্বে দুই ভাগ হয়ে যায়। উপরোক্ত দলগুলোর অস্তিত্ব এখনো আছে। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে জাকের পার্টি গঠিত হয়। ১৯৯০ সালের ১০ মার্চ বাংলাদেশ মুসলিম পার্টি নামে একটি দল গঠিত হয়। ১৯৯৩ সালের নভেম্বর মুসলিম মিল্লাত পার্টি নামে আরেকটি দল গঠিত হয়। ১৯৯২ সালে মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা তৈয়বের নেতৃত্বে উলেমা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে উলেমা কমিটি গঠন করা হয়। এর অব্যবহিত পরেই মাওলানা মহিউদ্দিন খান ও মাওলানা ফজলুল হক আমিনী ইসলামী মোর্চা নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ফটিকছটির মাইজভান্ডার কেন্দ্রিক আরেকটি ইসলামী দলও আছে। তার নাম তরিকত ফেডারেশন ।
১৯৯৫ সালের ১৫ জানুয়ারি মাওলানা আতাউর রহমান আরেফী ও মাওলানা মাহমুদুল হাসান শরিয়তপুরীর নেতৃত্বে ইত্তেহাদ মুসলিম উম্মাহ নামে একটি দল গঠিত হয়। ১৯৯৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারী ইসলামী সংগ্রাম পরিষদ নামে আরেকটি সংস্থা গঠন করা হয়। ২০০৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ঐক্যজোট নামে একটি দল জন্ম নেয়।
১৯৯৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আল্লাহ্র দল নামে একটি পার্টি গঠন করা হয়। ২০০০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেয় জমিয়তে উলেমা মঞ্চ। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে জাগ্রত জনতা, আগস্ট মাসে ইসলামী হুকুমত আন্দোলন এবং প্রায় একই সময়ে তাহফিজে হারামাইন পরিষদ গঠিত হয়। ২০০১ সালের ডিসেম্বর। মাসে ইসলামিক ফোরাম এবং একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক মহিউদ্দিনের উদ্যোগে হিজবুত তাহরির নামে একটি দল গঠিত হয়। এই দলগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি এখনো সক্রিয় আছে, তবে অনেকগুলোরই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই দলগুলোর একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ক কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওহি-নকুলের, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুবই শীতল। এক দল আরেক দলকে চেনে না। এমন অবস্থাও প্রচুর। আবার ১৯৪১ সাল থেকে সক্রিয় দেশের বৃহত্তম আন্দোলন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে সিংহভাগ দলেরই কোনো সম্পর্ক নেই। তারা একে অপরের ইসলামী দাওয়াহ ও তরবিয়াহ তৎপরতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদল অন্য দলকে গোমরাহ বলে মনে করে। অথচ ইসলামী দল হিসেবে তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতার মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। আল্লাহ্ জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা, শিরকের উৎখাত, দেশী-বিদেশী ইসলাম বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় তাদের মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভাব থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছা কখনো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পরিবেশকে ইসলামের অনুকূলে নিতে হলে সমাজ-রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। গণতন্ত্র ছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করা যায় না। মানুষের চরিত্রকে ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে ঢালাই করতে হলে যুগের চাহিদা অনুযায়ী দাওয়াহ ও তরবিয়াহর প্রয়োজন। এটি একটি বিশাল কাজ। এককভাবে কোনো দলের পক্ষে এই কাজ সম্পাদন সম্ভব নয়। আবার এই কাজ করতে গেলে যে ঝুঁকি তা মোকাবেলা করাও কঠিন। আদর্শিক ঐক্য থাকলে কোনো শক্তিই এদের গায়ে হাত দিতে যেমন সাহস করবে না। তেমনি তাদের পক্ষেও বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছা সহজতর হয়। মুসলিম উম্মাহকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হয়। ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নেয় না। তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়েই নিক্ষিপ্ত হয়। ইসলাম একটি বিজয়ী জীবনাদর্শ বিজিত নয়। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের ওলামায়ে কেরামদের ঐক্য অপরিহার্য। তাদের মধ্যে ঐক্য থাকলে সাধারণ মানুষ তথা সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে স্বাভাবিকভাব ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে হিমালয়ের চূড়ায় আরোহণ সহজ কিন্তু আমাদের দেশের আলেমদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সহজ নয়। কথাটা হয়তো সত্য হয়তো সত্য নয়। বৃটিশ আমল থেকেই আলেমদের বিভক্ত রেখে আমাদের উপর ছড়ি ঘুরানোর অপচেষ্টা চলে আসছে। আমাদের মধ্যে দেওবন্দি-নন দেওবন্দি, কওমী- নন কওমী এবং আলিয়া-নন আলিয়া বিভেদ বিভক্তি কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। আবার ওহাবী-ননওহাবী ভাবধারাও কারোর কারোর মাঝে প্রবল অহংরোধ এখানে প্রকট। শোনা কথায় বিশ্বাস করে, খানা তল্লাশি ছাড়াই ছহিহ ছিলছিলার অনেক আলেম বুজুর্গের চরিত্র হননে আমরা দ্বিধা করি না। আগেই বলেছি, ইখতিলাফ সবসময় ছিল, থাকবে। ঐক্যের পথে এটি বাঁধা হতে
পারে না। আমরা আমাদের সামনে যে হুমকিগুলো (threats) আছে (১) সেগুলো যদি উপলব্ধি করি এবং সেগুলো দূর করে এগিয়ে যেতে চাই তাহলে ঐক্য কঠিন কিছু নয়। এই দেশ থেকে ইসলামকে মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আলেম- উলামাদের উপর নির্যাতন চলছে। মাদরাসা শিক্ষাকে এমনভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে যে মাদরাসার সংখ্যা বাড়বে, ছাত্র বাড়বে কিন্তু আলেম সৃষ্টি হবে না। বরেণ্য আলেমদের উপর জেল-জুলুম ফাঁসির দন্ড প্রভৃতির ন্যায় অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে যে বেইজ্জতি করা হচ্ছে তার নজির দুনিয়ায় নেই। ইসলামের অনুসরণ ও অনুশাসনের অনুশীলন, টুপি পরা ও দাড়ি রাখা অপরাধ হিসাবে গণ্য হওয়া শুরু হয়েছে। ইসলামী তাহজিব তমদ্দুন ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। মেয়েদের হিজাব। পরা অপরাধে পরিণত হয়ে পড়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যভিচারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এগুলো আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। এই হুমকির মোকাবেলা এবং বিজয়ী শক্তি হিসাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য আলেমদের ঐক্যের বিকল্প নেই।
ভারতে দেওবন্দি নন দেওবন্দি দ্বন্ধ আলেমদের ঐক্যে বিরাট বাঁধা ছিল। বাবরি মসজিদ সংকট তাদের সামনে যে হুমকি সৃষ্টি করেছিল তা তাদের ঐক্যের পথ প্রশস্ত করে দেয়। এখন সেখানে আলেমরা অনেক অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। আলেমরাও আগের তুলনায় ঐক্যের পথে অনেক বেশি এগিয়ে গেছেন। আমরা বাঁধাগুলো দূর করতে পারিনি। দুঃখের বিষয় বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সংগঠন তাবলীগ জামাতও আমাদের হাতে সম্প্রতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। আদর্শিক ঐক্য ছাড়া শুধু রাজনৈতিক ঐক্য কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না। আদর্শিক ঐক্যের ভিত্তি আল্লাহ্র উপর আস্থা ও বিশ্বাস এবং তার রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ। আলেম সমাজের ঐক্য বিষয়ে উপমহাদেশের দেশগুলো ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্কের অবস্থা অধ্যয়ন করার আমি সুযোগ পেয়েছি। এই উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর শীর্ষস্থানীয় বেশ কিছু আলেমের মতামত আমি সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে ঐক্যের জন্য তুরস্কের আলেমরা ভিত্তি হিসাবে যে মূলনীতি প্রণয়ন করেছেন সেগুলোই আমার কাছে খুব যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে। মূলনীতিগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ:
- তৌহিদের দৃষ্টিকোন থেকেই সব কিছু দেখতে হবে।
- সর্বাবস্থায় হকের পাশে থাকতে হবে শক্তির পাশে নয়।
- সুন্নাহকে প্রাধান্য দিতে হবে। সুন্নাহ না জানলে কুরআন শেখা যাবে না।
- চিন্তা ও কাজে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
- বিদাত থেকে দূরে থাকতে হবে। দ্বীনের পরিপন্থী কোনো কিছুই গ্রহণ করা যাবে না।
- কোনো মুসলমানকে কাফের বলা যাবে না। এজন্য সুস্পষ্ট দলিল থাকতে হবে।
- মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
- সাহাবায়ে কেরাম আমাদের পথ প্রদর্শক তাদের বিরুদ্ধে কটু কথা বলা যাবে না।
- গুনাহগার হলেও মুসলমানদের ঘৃণা করা যাবে না, তার প্রতি দরদ নিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে।
- ইসলামের চেয়ে আর কোনো কিছুকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা যাবে না।
- পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই থাকি না কেন সবসময় ইসলামী ঐক্যের জন্য কাজ করবো।
- সজাগ ও অনুভূতিসম্পন্ন একজন মুসলমানের সামনে ৫টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে :
- শয়তান
- নফস
- কাফের, মুশরিক
- মুনাফেক, (বিশ্বাস ও আকিদায়)
- জালেম
এই ৫ জনের বাইরে কারোর সাথে মুসলমানদের দুশমনি নেই ।
উপরোক্ত ১২টি ভিত্তি বা মূলনীতিকে সামনে রেখে আলেম সমাজ এবং আমাদের ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন বলে আমি মনে করি।
প্রকাশিত: মঙ্গলবার ২৯ জানুয়ারি ২০১৯