ইসলামী ব্যবস্থা একই সাথে বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমন্বয়। তাহলে ইসলামী ব্যবস্থায় কিভাবে উপনীত হব? ধর্মীয় নবায়নের মাধ্যমে নাকি রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে?
এই প্রশ্নের জবাব হল, ধর্মীয় চিন্তার নবায়ন ছাড়া ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হবে না, তবে রাজনৈতিক বিপ্লব ছাড়াও এটা সফলতার সাথে পূর্ণতায় পৌঁছাবে না। এই জবাব, ইসলামী পুনর্জাগরণকে দ্বিমুখী একটি বিপ্লব হিসেবে সঙ্গায়িত করে। একটি হল, আখলাকী বিপ্লব, অপরটি হল সামাজিক বিপ্লব। এই জবাবের মধ্যে ধর্মীয় চিন্তার নবায়নের প্রতি বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে। এর প্রতি জোর দেওয়ার কারণ হল, ইসলামের প্রকৃতি ও মূলনীতি সমূহের পাশাপাশি মুসলিম দুনিয়ার কিছু অবশ্যস্বীকার্য বাস্তবতা।
আজকে যদি আমরা মুসলিম দেশ সমূহের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, মুসলমানদের মধ্যে আজ আখলাকহীনতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অলসতা, দ্বিমুখীতা, অনৈসলামী কৃষ্টি-কালচার এবং চরম বস্তুবাদীতা ব্যপকভাবে দানা বেঁধে উঠেছে। শুধু তাই নয় এর সাথে যুক্ত হয়েছে উদ্যোগ ও স্বপ্নের নির্মম অনুপস্থিতি। অবস্থা যখন এমন তখন কি কোন ধরণের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার অনতিবিলম্বে শুরু করা সম্ভব?
ইতিহাসের মঞ্চে যথাযথ ভূমিকা পালন করার পূর্বে প্রত্যেক জাতিকেই একটি অভ্যন্তরীণ আত্মশুদ্ধির পথ পাড়ি দিতে হয় এবং কিছু কিছু মৌলিক আখলাকী মূল্যবোধকে সত্যিকার ভাবে হৃদয় দিয়ে ধারণ করতে হয়। দুনিয়ার মঞ্চে আত্মপ্রকাশকারী প্রতিটি শক্তিই, বলিষ্ঠ আখলাকের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়। আর প্রতিটি পরাজয়ই শুরু হয় আখলাকী অধঃপতনের মধ্য দিয়ে। যা কিছুই করতে চাওয়া হোক না কেন সর্বাগ্রে সেটা মানুষের রূহের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা রূহের জাগরণ ছাড়া কোন জাগরণই সম্ভবপর নয়।
ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত হিসেবে ইসলামী চিন্তার নবায়ন বলতে কি বুঝানো হয় ?
সর্বাগ্রে এটা দুইটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেঃ নতুন এক জজবা ও নতুন এক ইচ্ছাশক্তি (ইরাদা)
ধর্মীয় চিন্তার নবায়ন করার অর্থ হল, জীবনের মূল উদ্দেশ্য কি, কেন ও কিসের জন্য বেঁচে আছি এবং কিভাবে বেঁচে থাকা প্রয়োজন , এই সকল বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটি জজবার অধিকারী হওয়া। এই উদ্দেশ্য কি ব্যক্তিগত কিংবা অভিন্ন কিছু মানে উন্নীত হওয়া , নিজ দেশ ও জাতির জন্য মান-মর্যাদা বইয়ে নিয়ে আসা, নিজেকে সত্যায়িত করা, নাকি আল্লাহর বিধানকে দুনিয়াতে বিজয়ী করা? আমাদের অবস্থান থেকে ধর্মীয় চিন্তার নবায়ন করার অর্থ হল, নিজেকে মুসলমান বলে দাবিকারী কিংবা তাঁদেরকে এই নামে অভিহিত করার ব্যক্তিদেরকে ইসলামীকরণ করা। এই ইসলামীকরণের সূচনাবিন্দু হল, আল্লাহর প্রতি অটল ও অবিচল ঈমান এবং ইসলামের যে আখলাকী মূল্যবোধ রয়েছে সেই সকল মূল্যবোধকে যথাযথ আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়ন।
ধর্মীয় চিন্তার নবায়নের দ্বিতীয় মৌলিক ধাপ হল, মূল উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কিত জজবার যে দাবী সে দাবীকে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রস্তুত থাকা। এই কারণে ধর্মীয় চিন্তার নবায়নের অর্থ হল মানসম্পন্ন একটি উচ্চ আখলাক ও উৎসাহ-উদ্দীপনাকে হৃদয়ে লালন করা এবং বস্তুর উপর রূহের প্রভাব যে অপরিসীম এটার উপর বিশ্বাস করা। শুধু তাই নয়, এমন একটি আদর্শ লালন করা যে আদর্শ সাক্ষ্য দেয় সাধারণ মানুষ অসীম সাহসী হয়ে থাকে এবং তাঁরা আত্মত্যাগের জন্যও সদা প্রস্তুত থাকে। বিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তির (ইরাদা) দিক থেকেও এটা অনেকটা নতুন ধরণের বিশ্বাস ও উদ্যোগ যার ভিত্তিতে সবাই তাঁদের আদর্শের জন্য চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করতে উজ্জীবিত হবে।
এই নব চেতনা ও রূহে উপনীত হওয়া ছাড়া বর্তমান মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সত্যিকারের কোন পরিবর্তন আসা সম্ভবপর নয়।
এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সময় অনেক সময় দেখতে পাই যে, অনেকেই সংক্ষিপ্ত পন্থায় ক্ষমতা দখল করে ইসলামী ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করার কথা চিন্তা করে থাকেন। তাঁরা বলে থাকেন যে এই ভাবে ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরা যথাযথ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ধারাবাহিকভাবে জনগণকে ধর্মীয়, আখলাকী ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিয়ে ইসলামী ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন।
এই ধরণের চিন্তা প্রলোভন ছাড়া অন্য কিছু নয়। ইতিহাসের পাতায় এমন কোন সত্যিকারের বিপ্লব পাওয়া যায় না, যা ক্ষমতার বিন্দু থেকে শুরু হয়েছে। সত্যিকারের বিপ্লব শিক্ষার মাধ্যমে শুরু হয়েছে এবং সেই শিক্ষা ব্যবস্থা তাঁর মূলে আখলাকী একটি আহ্বানকে ধারণ করেছে।
অপর দিক থেকে যারা ইসলামী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাকে ক্ষমতা ও বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করতে চান, তাঁদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় এমন ধরণের সরকার ও প্রতিষ্ঠান কোথা থেকে আসবে? তখন তাঁরা এই প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারেন না। এই ধরণের সরকার কে প্রতিষ্ঠা করবে? কে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে এবং এই সরকার ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ কোথা থেকে আসবে? সর্বশেষে, এই সরকারের কর্মকাণ্ড সমূহকে কে পর্যবেক্ষণ করবে এবং যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাকে বাদ দিয়ে যে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা শুরু করবে না এর নিশ্চয়তা কে দিবে?
ক্ষমতায় যারা থাকে তাঁদেরকে এক গ্রুপকে দিয়ে অন্য গ্রুপকে পরিবর্তন করা যায়, এটা নিত্তনৈমিত্তিক একটি ব্যাপার। একজনের জুলুম ও স্বৈরতন্ত্র অপরের মাধ্যমে পরিবর্তন করা কিংবা দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির সম্পদও অপরের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব। নাম, পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত এবং স্লোগান সমূহকে পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু এসব কিছুর মাধ্যমে পৃথিবীর এক নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে ইসলামী ব্যবস্থার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব নয়, যার মাধ্যমে মানুষের সাথে নিজের, অন্যের এবং তাবৎ জগতের এক নতুন সম্পর্কের গতিপথ রচিত হয়।
শক্তি অর্জন কিংবা ক্ষমতা দখলের ভাবনার মধ্যে আছে মানুষের একটি সহজাত প্রবণতা, নিজের প্রবৃত্তির মোকাবেলায় যে জিহাদ তার প্রাথমিক ও কষ্টদায়ক পথটা পরিহার করা। মানুষকে তৈরি করে তাঁকে পরিচালনা করা কঠিন কিন্তু তাঁর চেয়েও কঠিন হল নিজেকে তৈরি করে সঠিক পথে পরিচালিত করা।
ধর্মীয় পুনর্জাগরণের সূচনাই হয় নিজেকে দিয়ে এবং নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে। অপর দিকে শক্তি প্রয়োগ ও জবরদস্তির ঘটনা ঘটে অন্যকে দিয়ে। আর এ কারণেই এই চিন্তাটা এত বেশী চিত্তাকর্ষক।
এই কারণে যে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হল ইসলামী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, সর্বাগ্রে সেই আন্দোলনকে একটি আখলাকী আন্দোলন হতে হবে। আর এই ধরণের আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল মানুষকে আখলাকী দৃষ্টিকোণ থেকে উজ্জীবিত ও উচ্চ মর্যাদায় আসীন করা যাবে । মানুষ যেন আরও ভালো মানুষে পরিণত হতে পারে এই জন্য আন্দোলনের মধ্যে আখলাকী কর্মকাণ্ডের ধারাকে ব্যাপকভাবে জারী রাখতে হবে। ইসলামী আন্দোলন ও সাধারণ রাজনৈতিক দলের মধ্যে এটাই হল মৌলিক পার্থক্য। কেননা সাধারণ রাজনৈতিক দলসমূহ একই চিন্তা ও অভিন্ন স্বার্থে একত্রিত হওয়ার পরে তাঁদের মধ্যে আখলাকী কোন মূল্যবোধ কিংবা আখলাকী কোন দায়িত্ত্ববোধ নেই।
ধর্মীয় চিন্তার নবায়নকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি অন্যান্য উৎসের পাশাপাশি ইসলামের মূল উৎস সমূহের মধ্যেও সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়।
প্রথমত, কোরআনে কারীম উল্লেখ করেছে যে অভ্যন্তরীণ পুনর্জাগরণ হল জনগণের অবস্থার পরিবর্তন বা উন্নতির পূর্বশর্ত।
দ্বিতিয়ত, এই অমোঘ বিধানটি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে এবং প্রথম যুগে ইসলামকে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় সত্যায়িত হয়ে আছে। প্রথম তের বছর ধরে কোরআনে কারীমের শুধুমাত্র ঈমানী ও দায়িত্ত্বশীলতা সংক্রান্ত বিষয়ে জোর প্রদানের বিষয়টিও এই বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে। এই ১৩ বছর ধরে কোরআনে কারীম কোন ক্রমেই রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার বিষয়ে কোন ধরণের মতামত পেশ করেনি এবং সামাজিক সমস্যা সংক্রান্ত ইসলামী কোন সমাধানও তুলে ধরেনি।
ধর্মীয় চিন্তার নবায়নের পূর্বে তিনটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় চাই;
১। কোরআনে কারীমের আদেশ সমূহের, বিশেষ করে শিকড় সমূহ গভীরে প্রোথিত এমন সামাজিক সমস্যা সমূহ সংক্রান্ত বিষয়াদি কিংবা ক্ষমতাসীন অথবা সম্পদশালীদেরকে বিরক্ত করে এমন আদেশ সমূহের মধ্যে কোন ধরণের পরিবর্তন না ঘটিয়ে এবং কোন প্রকার আপোষ না করে সেই আদেশ সমূহকে বাস্তবায়ন করার জন্য যে দৃঢ়তা প্রয়োজন সেটা কেবলমাত্র ধর্মীয় চিন্তার নবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। ধর্মীয় চিন্তার নবায়নের মাধ্যমে কোন প্রকারের শক্তি প্রয়োগ না করেই এবং ঘৃণাবোধকে জাগিয়ে না তুলেই করা সম্ভব। কেননা তখন সকলেই কিংবা নতুনভাবে জাগ্রত সমাজের অধিকাংশই মনে করবে যে এটাই হচ্ছে স্রষ্টার নির্দেশ এবং আদালতের মানদণ্ড, যা আমাদের সকলের মেনে চলতে হবে।
২। ইসলামী পুনর্জাগরণ, এমন মানুষ ছাড়া কল্পনাও করা যাবে না যারা এই ধর্মীয় পুনর্জাগরণের জন্য বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিকভাবে সকল কিছুকেই ত্যাগ করতে প্রস্তুত। অনুরূপভাবে পারস্পারিক আস্থা ও সহযোগিতা ছাড়াও এই জাগরণের কথা চিন্তাও করা যায় না। আবার এই বৃহৎ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কুরবানীর ফলাফল যে নিজের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা ও অন্যকে অধীনস্ত করে রাখার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হবে না এর নিশ্চয়তা কে দেবে? কোন ব্যবস্থা একটি নৈতিক ব্যর্থতার ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারবে যার উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসে সুপ্রচুর। ইসলামী ব্যবস্থাসহ প্রতিটি ব্যবস্থাই শেষ পর্যন্ত ঘোষিত নীতির চেয়ে সেই সব মানুষকে প্রতিফলিত করে যারা এর প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত।
৩। মুসলিম উম্মাহ আজ ঘোরতর পশ্চাদপদতার মধ্যে নিপতিত। এই অবস্থা থেকে মুসলিম উম্মাহকে উদ্ধার করতে হলে শিক্ষা ও শিল্পায়নের দিকে জোর দিতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব এই ক্ষেত্রে গৃহীত পরিকল্পনাসমূহকে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে পাশ্চাত্যের হুবুহু অনুকরণ করতে গিয়ে যদি যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া যদি উন্নয়নের দিকে যাওয়া হয় সেই অতি উন্নয়ন স্বৈরাচার, দুর্নীতি, পারিবারিক ব্যবস্থার অবক্ষয়, দ্রুত ও বৈষম্যমূলকভাবে সম্পদ বৃদ্ধি, নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অবিবেচক ও সম্পদশীল লোকদের উত্থান, ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে গিয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ন, সমাজের ভাঙ্গন ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিক্ততা বৃদ্ধি, মাদকাসক্তি ও গণিকাবৃত্তির প্রসারের মত আরও অনেক সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এই অপসংস্কৃতি ও আদিমতার তুফানকে মোকাবেলা করার জন্য অনুপম পন্থা হল, আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং ধর্মীয় অনুশাসনকে সমাজের সকলে বাস্তবায়ন। এই ক্ষেত্রে ধর্মই পারে সংস্কৃতিকে ধর্মহীন সভ্যতা থেকে রক্ষা করতে। নিছক বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আদিমতার প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারে। যার অহরহ নজির আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।
উৎসঃ ইসলামী ডেক্লারেশন
অনুবাদক: বুরহান উদ্দিন আজাদ