আমরা এই কথা বলি যে, আজকের দিনে ইসলামী ব্যবস্থার পক্ষে একটা অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য হলো দুনিয়ার সকল মুসলমান ও সকল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে একটি ইউনিয়ন তৈরি করা। বর্তমান পরিস্থিতির যে দাবী সেই দাবীর কারণেই মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া, উষ্ণমণ্ডলীয় আফ্রিকা থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বিশাল ইসলামী ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করা।

আমরা যখন এই ভিশনের কথা বলি তখন আমাদের মধ্যকার অনেকেই যারা নিজেদেরকে বাস্তববাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেন তাঁরা যে কি পরিমাণ অস্বস্তিবোধ করেন সেটা ভালোভাবেই জানা আছে। আর এই কারণে আমরা আমাদের এই ভিশনকে আরও সুস্পষ্টভাবে ও উচ্চস্বরে তুলে ধরি যেন তাঁদের অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়। মুসলিম জনগণকে নিম্নমানের একটি জীবনধারা গ্রহণে বাধ্যকারী এবং কোন ধরণের উদ্যোগ ও উদ্দীপনার ক্ষেত্রে কোন স্থানদানে অস্বীকারী এই রিয়ালিজম তথা বাস্তবতাকে  প্রত্যাখ্যান করছি।

রূহবিহীনতা ও দুনিয়াকে শাসনকারী শক্তিবর্গকে তোয়াজ করার ফলে সৃষ্ট এই রিয়ালিজম হল এমন এক চিন্তা যা রাজাদেরকে রাজা ও প্রজাদেরকে আজীবন প্রজা হিসেবেই থাকার দীক্ষা দিয়ে থাকে। ইতিহাস শুধুমাত্র ধারাবাহিক পরিবর্তনের নামই নয়,  একই সাথে তা অসম্ভব ও অপ্রত্যাশিতের বাস্তবায়ন হওয়ারও এক উপাখ্যানের নাম। এছাড়াও আমাদের সময়ে আজকে যা বাস্তবতা পঞ্চাশ বছর পূর্বেও এর প্রায় সবকিছুকেই অসম্ভব বলে মনে হত।

অবশ্য দুই ধরণের বাস্তববাদিতা দৃশ্যমানঃ একটি হল আমাদের অপরটি হল কাপুরুষ ও রূহহীন মানুষদের।

আমাদের মতে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হল, মুসলমানগণ তাঁদের অভিন্ন সমস্যাকে সমাধান করার জন্য এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে একত্রে ও সমন্বয় করে চলার জন্য কিছু আধি-রাষ্ট্রিক (অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক) ফোরামকে গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে।

আমাদের তথাকথিত বাস্তববাদীদের (কাপুরুষ ও রূহহীন) কাছে এগুলো অবাস্তব। তারা বর্তমান অবস্থাকেই বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। যা আমাদের বাস্তববাদিতার কাছে সামঞ্জস্যহীন ও হাস্যকর। আজকের এই সংযোগ ও কেন্দ্রিকতার যুগেও আরব জাতির তেরটি ভিন্ন জাতি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়া, অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়েও মুসলিম দেশ  সমূহের বিপরীতমুখী অবস্থান নেওয়া,  ইথোপিয়া কিংবা কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য হৃদয় বিগলিত না হওয়া, আরব রাষ্ট্রসমূহ ও ইসরাইলের মধ্যকার দ্বন্দ যখন চরম পর্যায়ে সেই সময়েও শত্রুভাবাপন্ন দেশের সাথে ইরানের মত মুসলিম দেশের বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলাসহ আর অনেক বিষয়কে কোন ভাবে গ্রহণ করা যায় না। এখানে যদি অবাস্তব কিছু থেকে তাহল, তবে তা মুসলমানদের ঐক্য নয়, বরং তার অনুপস্থিতি – বিভাজন ও বিভেদাবস্থা। যা আজ আমরা বাস্তবে দেখতে পাই।

প্রকৃতি ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা সমূহের সাথে যতক্ষণ পর্যন্ত সাংঘর্ষিক না হওয়া পর্যন্ত এমন কোন উদ্দেশ্য নেই যা মানুষের অভিন্ন ইচ্ছা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার দ্বারা বাস্তবায়িত হয় না। আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন এবং তাঁর জন্য শ্রম ব্যয় করা হয়েছে এমন যে কোন ইউটোপিয়া, আর ইউটোপিয়া থাকে না। কিন্তু যারা এটাকে বিশ্বাস করে না এবং এর জন্য পরিশ্রম করতে চায় না তাঁদের দুর্বলতাকে তাঁদের লজ্জাজনক ‘রিয়ালিজম’ এর মধ্যে খুঁজে ফেরা দরকার। মুসলমানদের ঐক্যকে যারা অবাস্তব ও অলীক স্বপ্ন বলে থাকে তাঁরা মূলত তাঁদের অনুভূত দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। এই অসম্ভাব্যতা আসলে বাস্তবের নয় তাঁদের হৃদয়ের। ইসলামী ঐক্যের ধারণা কারো আবিষ্কার নয় অথবা কোনো আদর্শবাদী বা সংস্কারকের নিছক স্বপ্ন বিলাস নয়। ইসলামী ঐক্যের চিন্তা বিধৃত আছে কোরআনের এই বাণীর মধ্যে-  মু’মিনগণ হলো পরস্পরের ভাই। এক সাথে রোজা পালন, একটি আধ্যাত্মিক ঐক্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাবা এবং মক্কায় পালিত হওয়া হজ্জের মত বিষয় সমূহ অবিরতভাবে এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমাদের জজবা ও চেতনাকে জাগ্রত রাখে। আর এই কারণেই সমগ্র উম্মাহর মধ্যে সর্বদায় একটি সমজাতীয় সত্ত্বা ও ঐক্যের চেতনাকে জাগ্রত করে রেখেছে। দূরের যে কোন একটি মুসলিম দেশে কোন একটি বিপর্যয় নেমে আসার পর আমরা যদি মুসলিম সমাজকে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে তাঁদের সৌহার্দ ও সহমর্মতা দেখেই আমরা আঁচ করতে পারি যে এই ঐক্যের চেতনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কতটুকু জাগ্রত।

আচ্ছা মুসলিম জনগণের মধ্যকার যে চেতনা এই ইসলামী ঐক্যের চেতনা কেন বাস্তব জীবনধারা ও মুসলমানদের রাজনীতির মধ্যে বড় কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না?

কেননা এটা শুধুমাত্র একটি আবেগ-অনুভূতি হিসেবেই রয়ে যায় এবং অভিন্ন তাকদীর ও স্বার্থের জন্য যে অবস্থান তৈরি হওয়া দরকার সেই অবস্থায় উপনীত হয় না! ফিলিস্তিন, ক্রাইমিয়া, পূর্ব-তুর্কিস্তান, কাশ্মীর কিংবা ইথিওপিয়াসহ দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদের উপর যে জুলুম নির্যাতন চলছে এটা নিয়ে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সমানভাবে ব্যথিত হলেও তাঁদের সে ব্যথা ও নিন্দা কেন কখনোই একটি একশন (কর্মে) পরিণত হয় না? হলেও কেনই বা তা এমন একটি কর্মসূচীতে পরিণত হয় না যেটার মাধ্যমে তাঁদের উপর জুলুম-নির্যাতনের অপসারণ হতে পারে?

 

এই প্রশ্নের জবাব হল, পাশ্চাত্যে প্রশিক্ষিত কিংবা পাশ্চাত্য চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত শাসকগোষ্ঠীর সাথে সাধারণ মানুষের চিন্তাধারার তফাৎ। যার কারণে এরা ইসলামী ঐক্যের চেতনা নিয়ে নয় বরং জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোন থেকেই আচরণ করে থাকে। ফলশ্রুতিতে মুসলিম জনগণের জজবা ও ভাবনার জগত বিভক্ত ও বিপরীতমুখী হয়ে পড়েছে। আর অবস্থা এমন হওয়ায় কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং নেতৃত্বের জায়গায় ইসলামী ঐক্যের চেতনাকে যারা লালক করেন এমন নেতৃত্ব না আসলে অবস্থা কোন দিনও পরিবর্তন হবে না।

আর এই কারণে সমকালীন ইসলামী ঐক্যের চিন্তা আমাদের সচেতনতা ও অনুভূতিকে একই সুরে মেলানোর একটি প্রচেষ্টা যা পাশাপাশি দেখিয়ে দেয় আমরা বাস্তবে কি চাই আর কোন বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করি।

এই অবস্থা, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও তাঁদের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

দুনিয়ার সকল স্থানেই জাতীয়তাবাদ জনগণের প্রভাবশালী একটি চরিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কেননা  জনগণের এটা জনগণের চাওয়াকে (ভাষা, লোকগাথা,সঙ্গীত ইত্যাদি)  সমর্থনকারী একটি আন্দোলন হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। অপরদিকে মুসলিম দেশসমূহে এই বিষয়টি বিকাশটি ব্যহত হওয়ায় অজাতীয়-জাতীয়তাবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয় এটা এমন একটি জাতীয়তাবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ  করেছে যা জাতীয়তাবাদী কিংবা জনবান্ধব নয়। এর কারণ হল, একদিক থেকে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উপর প্যান ইসলামী চিন্তার প্রাধান্য লাভ করা এবং অপর দিক থেকে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারাকে ইসলামের একটি বিকল্প হিসেবে দেখানোর কারণে জনগণ শুরুতেই এটাকে অনৈসলামী একটি চিন্তা হিসেবে অভিহিত করেছে। জনগণের অতীত ও ঐতিহ্যের সাথে ( এই ঐতিহ্যে সব সময়েই ইসলামী) এই সকল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বাভাবিক একটি বিরোধ থাকার কারণে অনেক মুসলিম দেশেই এই সকল জাতীয়তাবাদীরা সাম্রাজ্যবাদীদের পদাঙ্ককেই অনুসরণ করেছে এবং তাঁরা এমন একটি পন্থা অবলম্বন করেছে যা সমাজের রীতি ও প্রথা বিরোধী। যেমন কিছু কিছু আরব দেশে আরবী ভাষার মর্যাদা ও অবস্থান সেই সকল দেশের শাসকদের কাছে ইংরেজী ও ফ্রেঞ্চের চেয়ে বেশী মর্যাদাবান নয়। অর্থাৎ এখনো তাঁরা সাম্রাজ্যবাদীদের পদাঙ্ককেই অনুসরণ করে চলছে। এই ব্যাপারে যদি তাঁরা কিছু করার চেষ্টাও চালায় তবু তাঁরা সফল হতে পারবে না কেননা এই বিষয়ে তাঁরা আন্তরিক নয়। তবে ভবিষ্যতে কেউ হয়ত ভাষার হৃত মর্যাদা ও গৌরবকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে। (একটি উপমাঃ ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনকে দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পর ইবরানী ভাষাকে পুনুরুজ্জীবিত করেছে। যদিও এর ইতিপূর্বে এই ভাষা প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল)।

 

আরবী ভাষাকে ভুলিয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা এর কারণ খুব সহজেই অনুমেয়। কোরআনে কারীম ও ইসলামী সভ্যতার ভাষা হিসেবে পরিচিত এই ভাষা, আরব কিংবা আরবদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার একটি উপাদানের চেয়ে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বড় একটি উপাদান।

জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বদানকারী এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকার কারণে তাঁদের মধ্যে থেকেই সৃষ্ট নেতা কিংবা প্রশাসকরা তাদের ভাষায় কথা বলাকে পছন্দ করে এক কালে যারা তাঁদেরকে শোষণ ও নির্যাতন করেছে। প্রকৃত কথা হল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ইসলাম ছাড়া দেশপ্রেম হতে পারে না। এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমূহের জন্ম অনৈসলামিকতার গর্ভে।এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল মধ্যপ্রাচ্য! এই অঞ্চলে জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে সিরিয়া ও লেবাননের খ্রিষ্টান বুদ্ধিজীবীরা। এরা আমেরিকান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করেছে ( সিরিয়ার প্রোটেস্টান কলেজ ও বৈরুতের St. George University)। তুরস্কে মুস্তাফা কামালের আন্দোলন ও ইন্দোনেশিয়াতে সুকারনোর পঞ্চশীলা আন্দোলন, কিছু কিছু আরব দেশে বাস পার্টি এবং মুসলিম দেশ সমূহের জাতীয়তাবাদীদের ঐতিহাসিক মূলকে যদি অনুসন্ধান করা হয় তাহলে এই একই বিষয় দেখতে পাব। ইসলামী ঐক্যে যে চিন্তা এটা সব সময় মুসলমানদের হৃদয়ের স্পন্দন হিসেবে মুসলিম জনগণের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে আর জাতীয়তাবাদী চিন্তা সর্বদায় ভিনদেশী চিন্তা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

অর্থাৎ মুসলিম জনগণ জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে গ্রহণ করতে ‘যোগ্য’ নয়। এখন এই বাস্তবতাকে কি অস্বীকার করার উপায় আছে?

ধর্মীয় সমাজের চিন্তা যে জাতীয়তাবাদী চিন্তার ঊর্ধ্বে এই বিষয়টিকে যদি কিছুক্ষণের জন্যও উপেক্ষা করি তাহলেও এই লেখাটি লেখার সময়টিকে যদি বিবেচনায় নেই তাহলে আমার উচিত ছিল আমাদের জনগণকে এই বলে সতর্ক  করা যে, ‘ এই যোগ্যতা তথা জাতীয়তাবাদী হওয়ার চিন্তাকে বাদ দিন’। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরেও জাতীয়তাবাদী সমাজে বসবাসকারীরাও ধাপে ধাপে বিস্তৃত একটি ভিত্তির উপর একত্রিত হওয়া সম্ভব এমন একটি অভিন্ন জীবন ধারার দিকে এগিয়ে যাবে। বর্তমান সময়েও ফ্রান্স ও জার্মানির দূরদর্শী ব্যক্তিরা তাঁদের নিজেদের জনগণকে কমমাত্রায় জার্মান ও ফরাসী এবং বেশী মাত্রায় ইউরোপীয় হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এই পরামর্শ শুরুতেও একটু অবাস্তব মনে হলেও ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিষ্ঠা, বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে গঠনমূলক একটি ঘটনা। সকল প্রকার জাতীয়তাবাদের উর্দ্ধে উঠে গঠিত এই ফোরাম জাতীয়তাবাদের উপর ইউরোপীয় জনগণের প্রথম প্রকৃত বিজয়। জাতীয়তাবাদ; ছোট এমনকি মাঝারি ধরণের রাষ্ট্রের জন্যও অনেক ব্যয়বহুল হওয়ার পাশাপাশি বিলাসীতায় পরিণত হয়েছে।

আধুনিক দুনিয়া এই বিষয়ে এমন কিছু চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে যার উপমা ইতিহাসে আর পাওয়া দুষ্কর।  শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা, প্রতিরক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় অবিশ্বাস্য রকমভাবে বেড়ে গিয়েছে। ফলশ্রুতিতে এই সকল বিষয়কে বাস্তবায়ন করার জন্য এতবেশী মানব সম্পদ ও উপাদানের প্রয়োজন যে যা ইতিপূর্বে আর কক্ষনো দেখা যায়নি। আর শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা, প্রতিরক্ষা এর বিষয় সমূহ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় এটা শুধুমাত্র বড় বড় জাতি কিংবা বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত জোট ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে এই সকল বিষয়কে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমান সময়ে সমগ্র দুনিয়াকে দুইটি বড় বড় জোট শাসন করছে। একটি হল অ্যামেরিকা অপরটি হল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এদের মধ্যে তৃতীয়টি হল ইউরোপ যা আস্তে আস্তে সামনে অগ্রসর হচ্ছে ও নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। যে সমাজ তাঁর দুইশত মিলিয়ন জনসংখ্যাকে একত্রিত করতে পারে না এবং জিডিপিতে দুইশত বিলিয়ন ডলার উপার্জন করতে পারে না (এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান)  এমন একটি সমাজ প্রবাহমান গতিধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না এবং তাঁকে তাঁর জন্য পূর্ব নির্ধারিত নিকৃষ্ট অবস্থানেই থাকতে হবে। এই ধরণের সমাজ অন্যকে পরিচালনা করা তো দূরে থাকুক নিজেকেই পরিচালনা করতেই সক্ষম নয়। উন্নয়নের হার আর এই সকল ডাটার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে। চীন উন্নতি ও অগ্রগতির দিক থেকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের চেয়ে অনেক পেছনে থাকলেও তাঁর বিশাল মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের বদৌলতে আজ তাঁদের সাথে যে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত সেই প্রতিযোগীতায় চীন নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে। এই অবস্থা মুসলিম উম্মাহর উম্মাহর জন্যও একটি বিরাট সুযোগ। কেননা মুসলিম উম্মাহও মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদে অনেক এগিয়ে কিন্তু সে তাঁর এই সকল সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়ায় উন্নতি ও অগ্রগতিতে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এই বিষয়টি মুসলিম দেশ সমূহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও পারস্পারিক সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে।

দ্রুতগতিতে জনসংখ্যার বৃদ্ধি মুসলিম দেশ সমূহের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে দুনিয়াতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশী হল মিশর ও পাকিস্তানে। আনুমানিক দুইকোটি মুসলমান প্রতি বছর দুনিয়াতে আসছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার যদি মুসলিম দেশ সমূহে চলতে থাকে তাহলে এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ মুসলিম দেশ সমূহের জনসংখ্যা হবে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুন। অনাগত এমন কোটি কোটি মুসলমানকে সাদরে গ্রহন করে, তাঁদেরকে সঠিকভাবে লালন পালন করে গড়ে তুলে সম্মানজন একটি জীবিকার ব্যবস্থা কি আমরা করতে পারব? জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটার সাথে সমান্তরালভাবে যদি আমাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি না ঘটে তাহলে আমাদেরকে অনেক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। বিগত বিশ বছরে জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক কম হওয়ায় অধিকাংশ মুসলিম দেশের মাথাপিছু আয় আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। মুসলিম জনসংখ্যার এই বৃদ্ধি যখন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী একটি মুসলিম উম্মাহ গঠনের পেছনে সবচেয়ে বড় একটি শক্তি হওয়ার কথা ছিল, তা না হয়ে আমাদের অব্যবস্থাপনার কারণে আজ তা একটি সংকট ও অসহায়ত্ত্বে পরিণত হয়েছে।

একথা দিনের আলোর মত সুস্পষ্ট যে মুসলিম দেশ সমূহ একক ভাবে এই সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এই অবস্থা থেকে মুসলমানদেরকে যে বিষয়টি উদ্ধার করতে পারে সেটা হল ‘ ইসলামী ঐক্য’। এই ইসলামী ঐক্যই পারে মুসলমানদেরকে পশ্চাৎপদতা ও স্থবিরতা থেকে মুক্ত করে নতুন একটি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার দ্বারকে উম্মোচন করতে। যেই সমস্যাকে আরবগণ, তুর্কীগণ, পার্সিয়ানদের পক্ষে এককভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়, সেই সমস্যাকে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।

প্রতিটি মুসলিম দেশ কেবলমাত্র তখনই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে ও উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছাতে পারবে যখন সমগ্র মুসলিম উম্মাহ-ই প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে ও উন্নতি করতে পারবে। কুয়েত ও লিবিয়ার মত ধনী দেশ সমূহ দারিদ্রতা ও দুর্দশার সাগরে সমৃদ্ধির দ্বীপ হয়ে টিকে থাকতে পারবে না। যদি ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সাহায্য সহযোগীতাকে যদি বৃদ্ধি না করে এবং তাঁদের পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশ সমূহের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয় এবং স্বার্থপরের মত আচরণ করে তাহলে এটা কি অন্য দেশ গুলোকেও একই আচরণের দিকে ধাবিত করবে না? আর এটা এমন এক বিশৃঙ্খলা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি করবে যা আমাদের দুশমনরা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। ধনী মুসলিম দেশ সমূহ, ইসলাম কর্তৃক তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ত্বকে যদি পালন করে তাহলে তাঁরাও তাঁদের স্বার্থকে রক্ষা করতে সমর্থ হবে।

প্রতিটি মুসলিম দেশের সামনে যে বিকল্প রয়েছে এই বিষয়টি একেবারেই সুস্পষ্টঃ হয় অন্য মুসলিম দেশের সাথে পারস্পারিক সাহায্য ও সহযোগিতাকে বৃদ্ধি করে অগ্রগতি ও উন্নতির পথকে নিশ্চিত করে সকল ধরণের সমস্যাকে সমাধান করার চেষ্টা চালাবে আর না হয় প্রতিনিয়ত আরও বেশী পিছিয়ে পড়ে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা শোষিত হবে। আমরা যে আজ ঐতিহাসিক একটি প্রেক্ষাপটে অবস্থান করছি যদি এই সময়ে আমরা ইসলামী ঐক্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তাহলে মুসলিম উম্মাহ নতুন একটি মাত্রা পাবে। এই ঐক্যের বানী শুধুমাত্র আদর্শনবাদী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিদের একটি আকাঙ্ক্ষাই নয়। বর্তমান উম্মাহর জন্য আজ এটি সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সমূহের একটি। মুসলিম উম্মাহ যদি আজকের অবস্থার পরিবর্তন চায় এবং সম্মান ও মর্যাদার সাথে বিশ্বদরবারে নিজের প্রাপ্য স্থানকে অধিকার করে নিতে চায় তাহলে এই ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। যে উদ্দেশ্যে কিংবা যে কারণেই হোক না কেন আজকে যারা মুসলিম উম্মাহর এই বিভাজনকে সমর্থন করে তারা বাস্তবিকই অর্থেই মুসলমানদেরকে শত্রুদের পক্ষাবলম্বন করছে। যখন যেভাবেই সুযোগ পাওয়া যাবে সেখানেই ইসলামী ঐক্যের ধারণাকে তুলে ধরতে হবে।

মুসলিম জনগণের মধ্যে ইসলামী ঐক্যের যে সুপ্তবাসনা, সেটা যেন ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক সম্মলিন। যা তাঁকে তাঁর পূর্বপুরুষদের সাথে এক মোহনায় মিলিত করেছে। জাতীয়তাবাদের প্রভাবে যারা প্রভাবান্বিত তাঁরা যদিও এই বিষয়টিকে দেখতে পাবে না। কেননা এই ব্যাপারে তাঁরা ছিন্নমূল।।

অনুবাদক: বুরহান উদ্দিন আজাদ

 

১৪৯৬ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ হলেন গোটা দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের একজন মহান পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে জন্ম লাভ করা এই মহাপুরুষ দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করেছেন বিরল অনেক দৃষ্টান্ত। তিনি বসনিয়া হেরসেকের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, যার হাত ধরেই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মুক্তি পেয়েছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অসম যুদ্ধে জয়ী হয়ে শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছিলেন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে।

জন্ম ও শৈশবকাল:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ১৯২৫ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বস্নাকা ক্রুপা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিলো ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি পরিবার। কিন্তু আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলাম বিরোধী একটি বৈরী পরিবেশ ও ইউরোপিয়ানদের দারা দখলকৃত একটি ভূমিতে বেড়ে উঠেন। সারায়েভোর একটি জার্মান স্কুলে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। একজন মেধাবী ও সুশৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে সবার কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। তিনি তার স্কুল জীবনেই পাশ্চাত্য ও ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য তার সহপাঠীদের কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। সে সময়েই তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে গড়ে তুলেন মেলাদি মুসলমানি (মুসলিম যুবসংঘ) নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠন কায়েমকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু তার জ্ঞান এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে সবার কাছেই ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ। আর এই কারণেই তার প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্লাব না হয়ে পরিণত হয় সক্রিয় একটি সংগঠনে। যার ফলে এটি হয়ে ওঠে ছাত্রদের ক্যারিয়ার গঠন ও গঠনমূলক কাজের অন্যতম সূতিকাগার। অপরদিকে মেয়েদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠনটি দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ এর প্রতিষ্ঠিত এই মুসলিম যুবসংঘটি যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার এই যুগান্তকারী ভূমিকা তাকে ও তার সংগঠনকে সবার সামনে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী বসনিয়াতে ১ লাখেরও বেশি মুসলমান হত্যা করে।

কম্যুনিস্ট শাসনের জুলুম-নির্যাতন:
১৯৪৬ সালের ১৩ জানুয়ারি বসনিয়া পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। কিন্তু এই সংগ্রামে বামপন্থি নেতাদের আধিপত্য থাকায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বামপন্থিরা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। বসনিয়া একটি স্বায়ত্ত শাসিত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এক চুক্তি অনুযায়ী যুগোশ্লাভিয়ার সাথে আরও ৬টি দেশ মিলে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে। বসনিয়া হয় এই ৬টি দেশের একটি।
কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলামী আন্দোলনের নেতা হওয়ায় এবং নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকার কারণে কম্যুনিস্টদের টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৪৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। এবং তিনি একাধারে ৫ বছর বন্দি জীবন যাপন করেন।
১৯৫৩ সালে টিটু (Titu) ক্ষমতায় আসার পর আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের উপর জুলুম-নির্যাতন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি এ সকল জুলুম- নির্যাতনের পরেও তার বিপ্লবী ভূমিকা অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কাজকে অব্যাহত রাখেন, চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটানোর কাজে রত থাকেন। এ সময়ে তিনি অন্য একটি ইসলামী দলের নেতা হাসান দুজুর সাথে মিলে তার কাজের গতি বৃদ্ধি করেন।
১৯৭৪ সালে টিটুর নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসা নতুন করে উন্মুক্ত হয়। ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম-নির্যাতন কমে আসায় অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলোর উপর পরিমাণে স্বল্প হলেও জুলুম-নির্যাতন কমে আসে। ইসলামী সংগনগুলোর কাজের ফলে জনগণের মধ্যে ইসলামের একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়।

টিটুর মৃত্যু ও আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ইসলামী মেনিফেস্টো (Islamic Menifesto):
১৯৮০ সালে টিটুর মৃত্যুর পর ফেডারেশন প্রেসিডেন্টের বিষয়ে একটি চুক্তি প্রস্তাবিত হয়। আর এটি হলো ৬টি স্বায়ত্ত শাসিত দেশের প্রেসিডেন্টগণ সবাই এক বছর করে ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই চুক্তির কারণে স্বল্প পরিসরে হলেও গণতন্ত্র ফিরে আসে। চুক্তির আলোকে সকলেই কাজ করার সুযোগ পায়। আর এ সময়েই আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ছেলে তার পিতার বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধসমূহকে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে বই আকারে প্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে Islamic Declartion নামে একটি বই প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে এই বই প্রকাশিত হওয়ায় আলীয়া ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রে রেডিকেল ইসলামের প্রবর্তন করতে চাচ্ছেন, এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচকে আদালতে নেওয়া হলে তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বসনিয়া হেরসেককে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপর তারা তাকে এক অন্যায় আদেশের মাধ্যমে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এবং তার বইকেও নিষিদ্ধ করে। এতে করে এই বই এর প্রচার ও প্রকাশনা গোপনে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এবং এই বই (ডেক্লারেশন) লেখার কারণেই লেখক আজ কারাগারে এই বিষয়টি পাঠকের মনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে।

জেল জীবন:
উচ্চ আদালত তার ১৪ বছরের সাজা কমিয়ে ১১ বছরে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এক ক্ষমার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দান করে। ৫ বছরের জেল জীবনে আলীয়া তার চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটান। তার আগের চিন্তাগুলোকে সংশোধন করে মজবুত যুক্তির উপর দাঁড় করান। তার যুক্তিভিত্তিক যে লেখনীর কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তিনি তার সেই যুক্তিকে শাণিত করে কারাগারে বসেই লিখেন তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ Islam between East and West। তার এক বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সব জায়গায় তার এই বইটিকে ছড়িয়ে দেন। আর তিনি আলীয়ার এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষিত মুসলিমদেরকে আলীয়ার দলে ভিড়াতে থাকেন। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে তার এই জেল জীবন তাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলে এবং তিনি সকলের মাঝে একজন স্কলার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর জনগণ তাকে একজন মহান নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বসনিয়া হেরসেক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেগবান করেন।

রাজনৈতিক জীবন:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ যখন জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘণ্টা বেজে গিয়েছিলো। যুগোস্লাভিয়াতে স্বাধীনতা সংগ্রাম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। অপরদিকে ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোও একে একে স্বাধীনতার দিকে আগাতে থাকে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাতে তার নেতৃত্বে Democratic Action Party (SDA) নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে এবং আলীয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথম বার নির্বাচন করেই তার দল সরকার গঠন করে এবং পার্লামেন্টে ৮৬টি আসন লাভ করে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম:
১৯৯০ দশকের দিকে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশন স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফেডারেশন এর ৬টি দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ১ মার্চ ১৯৯২ সালের এক রেফারেনডামের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কারণ শতকরা ৬২% জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সার্বিয়া বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা করে মুসলিম নিধনের নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একই ফেডারেশনের দেশ ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাধুবাদ জানালেও মুসলিমদের দেশ বসনিয়া হেরসেক- এর উপর সার্বিয়ার হামলাকে সাধুবাদ জানায়। বসনিয়া হেরসেক-এর দুর্দশায় নতুন মাত্রা যোগ করে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী দেশ যুগোস্লাভিয়া। তারা সার্বিয়ার এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানিয়ে তাদেরকে সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি ছাড়া এ সময় কোনো মুসলিম দেশ নির্যাতিত বসনিয়ান মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহর শত্রুপক্ষ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসনে তারা লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে তারা ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত বিভিন্ন স্থাপনা ও মসজিদসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতা খুব একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। কারণ একথা সত্য যে, বাতিলরা কখনো মুখের কথায় তাদের জুলুম বন্ধ করে না। তাদের জুলুমকে বন্ধ করার জন্য তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং তারা কেবলমাত্র শক্তিকেই ভয় করে। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজারে। সব মিলিয়ে ১ মিলিয়ন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময়ে বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ। এই ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি তার নেতৃত্বের অসীম গুণাবলী দ্বারা ও সাহসিকতার সাথে তার দেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তার জাতিকে একত্রিত করে সার্বিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

ডেটন চুক্তি:
বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলিমদের এই সংগ্রামে বিশ্বের মুসলিমগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুবকগণ বসনিয়ার মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সংগ্রাম ও জিহাদের পাশাপাশি বসনিয়ান মুসলিমদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। তিনি তুরস্ক থেকে হাজার হাজার যুবক পাঠান বসনিয় মুসলিম ভাইদের সাহায্য করার জন্য। তার সম্পদের বিশাল এক অংশ দিয়ে বসনিয়ায় গড়ে তুলেন অস্ত্রাগার। OIC-ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে বসনিয় মুসলিমদের সাহায্যার্থে ভঙ্গ করেন জাতিসংঘের সকল চুক্তিকে। ইরানকে সাথে নিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের। এরবাকান তৎকালীন তুরস্ক সরকারকে বাধ্য করেন বসনিয় মুসলিমদের সাহায্য করতে। আর এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্বিয়াকে তাদের এক তরফা সমর্থন দিতে থাকে। তারা সার্বিয়ার সাথে চুক্তি করার জন্য বসনিয়াকে চাপ দিতে থাকে। পরবর্তীতে আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কারণ তিনি তাতে রাজি না হলে এই অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র বসনিয়ানরা আরও হত্যার শিকার হতো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তিতে বসনিয়া পায় ৫১% ভূমি আর ক্রোয়েশিয়াকে দেওয়া হয় ৪৯% ভূমি। এবং বিভিন্ন অসম চুক্তিতে বসনিয়াকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।

মৃত্যু:
এই মহান মানুষটি ১৯ অক্টোবর ২০০৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান মহান মনিবের দরবারে।
Picture of আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ হলেন গোটা দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের একজন মহান পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে জন্ম লাভ করা এই মহাপুরুষ দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করেছেন বিরল অনেক দৃষ্টান্ত। তিনি বসনিয়া হেরসেকের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, যার হাত ধরেই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মুক্তি পেয়েছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অসম যুদ্ধে জয়ী হয়ে শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছিলেন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে।

জন্ম ও শৈশবকাল:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ১৯২৫ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বস্নাকা ক্রুপা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিলো ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি পরিবার। কিন্তু আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলাম বিরোধী একটি বৈরী পরিবেশ ও ইউরোপিয়ানদের দারা দখলকৃত একটি ভূমিতে বেড়ে উঠেন। সারায়েভোর একটি জার্মান স্কুলে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। একজন মেধাবী ও সুশৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে সবার কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। তিনি তার স্কুল জীবনেই পাশ্চাত্য ও ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য তার সহপাঠীদের কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। সে সময়েই তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে গড়ে তুলেন মেলাদি মুসলমানি (মুসলিম যুবসংঘ) নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠন কায়েমকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু তার জ্ঞান এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে সবার কাছেই ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ। আর এই কারণেই তার প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্লাব না হয়ে পরিণত হয় সক্রিয় একটি সংগঠনে। যার ফলে এটি হয়ে ওঠে ছাত্রদের ক্যারিয়ার গঠন ও গঠনমূলক কাজের অন্যতম সূতিকাগার। অপরদিকে মেয়েদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠনটি দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ এর প্রতিষ্ঠিত এই মুসলিম যুবসংঘটি যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার এই যুগান্তকারী ভূমিকা তাকে ও তার সংগঠনকে সবার সামনে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী বসনিয়াতে ১ লাখেরও বেশি মুসলমান হত্যা করে।

কম্যুনিস্ট শাসনের জুলুম-নির্যাতন:
১৯৪৬ সালের ১৩ জানুয়ারি বসনিয়া পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। কিন্তু এই সংগ্রামে বামপন্থি নেতাদের আধিপত্য থাকায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বামপন্থিরা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। বসনিয়া একটি স্বায়ত্ত শাসিত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এক চুক্তি অনুযায়ী যুগোশ্লাভিয়ার সাথে আরও ৬টি দেশ মিলে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে। বসনিয়া হয় এই ৬টি দেশের একটি।
কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলামী আন্দোলনের নেতা হওয়ায় এবং নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকার কারণে কম্যুনিস্টদের টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৪৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। এবং তিনি একাধারে ৫ বছর বন্দি জীবন যাপন করেন।
১৯৫৩ সালে টিটু (Titu) ক্ষমতায় আসার পর আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের উপর জুলুম-নির্যাতন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি এ সকল জুলুম- নির্যাতনের পরেও তার বিপ্লবী ভূমিকা অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কাজকে অব্যাহত রাখেন, চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটানোর কাজে রত থাকেন। এ সময়ে তিনি অন্য একটি ইসলামী দলের নেতা হাসান দুজুর সাথে মিলে তার কাজের গতি বৃদ্ধি করেন।
১৯৭৪ সালে টিটুর নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসা নতুন করে উন্মুক্ত হয়। ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম-নির্যাতন কমে আসায় অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলোর উপর পরিমাণে স্বল্প হলেও জুলুম-নির্যাতন কমে আসে। ইসলামী সংগনগুলোর কাজের ফলে জনগণের মধ্যে ইসলামের একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়।

টিটুর মৃত্যু ও আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ইসলামী মেনিফেস্টো (Islamic Menifesto):
১৯৮০ সালে টিটুর মৃত্যুর পর ফেডারেশন প্রেসিডেন্টের বিষয়ে একটি চুক্তি প্রস্তাবিত হয়। আর এটি হলো ৬টি স্বায়ত্ত শাসিত দেশের প্রেসিডেন্টগণ সবাই এক বছর করে ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই চুক্তির কারণে স্বল্প পরিসরে হলেও গণতন্ত্র ফিরে আসে। চুক্তির আলোকে সকলেই কাজ করার সুযোগ পায়। আর এ সময়েই আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ছেলে তার পিতার বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধসমূহকে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে বই আকারে প্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে Islamic Declartion নামে একটি বই প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে এই বই প্রকাশিত হওয়ায় আলীয়া ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রে রেডিকেল ইসলামের প্রবর্তন করতে চাচ্ছেন, এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচকে আদালতে নেওয়া হলে তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বসনিয়া হেরসেককে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপর তারা তাকে এক অন্যায় আদেশের মাধ্যমে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এবং তার বইকেও নিষিদ্ধ করে। এতে করে এই বই এর প্রচার ও প্রকাশনা গোপনে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এবং এই বই (ডেক্লারেশন) লেখার কারণেই লেখক আজ কারাগারে এই বিষয়টি পাঠকের মনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে।

জেল জীবন:
উচ্চ আদালত তার ১৪ বছরের সাজা কমিয়ে ১১ বছরে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এক ক্ষমার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দান করে। ৫ বছরের জেল জীবনে আলীয়া তার চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটান। তার আগের চিন্তাগুলোকে সংশোধন করে মজবুত যুক্তির উপর দাঁড় করান। তার যুক্তিভিত্তিক যে লেখনীর কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তিনি তার সেই যুক্তিকে শাণিত করে কারাগারে বসেই লিখেন তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ Islam between East and West। তার এক বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সব জায়গায় তার এই বইটিকে ছড়িয়ে দেন। আর তিনি আলীয়ার এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষিত মুসলিমদেরকে আলীয়ার দলে ভিড়াতে থাকেন। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে তার এই জেল জীবন তাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলে এবং তিনি সকলের মাঝে একজন স্কলার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর জনগণ তাকে একজন মহান নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বসনিয়া হেরসেক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেগবান করেন।

রাজনৈতিক জীবন:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ যখন জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘণ্টা বেজে গিয়েছিলো। যুগোস্লাভিয়াতে স্বাধীনতা সংগ্রাম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। অপরদিকে ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোও একে একে স্বাধীনতার দিকে আগাতে থাকে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাতে তার নেতৃত্বে Democratic Action Party (SDA) নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে এবং আলীয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথম বার নির্বাচন করেই তার দল সরকার গঠন করে এবং পার্লামেন্টে ৮৬টি আসন লাভ করে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম:
১৯৯০ দশকের দিকে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশন স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফেডারেশন এর ৬টি দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ১ মার্চ ১৯৯২ সালের এক রেফারেনডামের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কারণ শতকরা ৬২% জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সার্বিয়া বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা করে মুসলিম নিধনের নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একই ফেডারেশনের দেশ ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাধুবাদ জানালেও মুসলিমদের দেশ বসনিয়া হেরসেক- এর উপর সার্বিয়ার হামলাকে সাধুবাদ জানায়। বসনিয়া হেরসেক-এর দুর্দশায় নতুন মাত্রা যোগ করে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী দেশ যুগোস্লাভিয়া। তারা সার্বিয়ার এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানিয়ে তাদেরকে সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি ছাড়া এ সময় কোনো মুসলিম দেশ নির্যাতিত বসনিয়ান মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহর শত্রুপক্ষ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসনে তারা লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে তারা ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত বিভিন্ন স্থাপনা ও মসজিদসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতা খুব একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। কারণ একথা সত্য যে, বাতিলরা কখনো মুখের কথায় তাদের জুলুম বন্ধ করে না। তাদের জুলুমকে বন্ধ করার জন্য তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং তারা কেবলমাত্র শক্তিকেই ভয় করে। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজারে। সব মিলিয়ে ১ মিলিয়ন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময়ে বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ। এই ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি তার নেতৃত্বের অসীম গুণাবলী দ্বারা ও সাহসিকতার সাথে তার দেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তার জাতিকে একত্রিত করে সার্বিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

ডেটন চুক্তি:
বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলিমদের এই সংগ্রামে বিশ্বের মুসলিমগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুবকগণ বসনিয়ার মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সংগ্রাম ও জিহাদের পাশাপাশি বসনিয়ান মুসলিমদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। তিনি তুরস্ক থেকে হাজার হাজার যুবক পাঠান বসনিয় মুসলিম ভাইদের সাহায্য করার জন্য। তার সম্পদের বিশাল এক অংশ দিয়ে বসনিয়ায় গড়ে তুলেন অস্ত্রাগার। OIC-ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে বসনিয় মুসলিমদের সাহায্যার্থে ভঙ্গ করেন জাতিসংঘের সকল চুক্তিকে। ইরানকে সাথে নিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের। এরবাকান তৎকালীন তুরস্ক সরকারকে বাধ্য করেন বসনিয় মুসলিমদের সাহায্য করতে। আর এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্বিয়াকে তাদের এক তরফা সমর্থন দিতে থাকে। তারা সার্বিয়ার সাথে চুক্তি করার জন্য বসনিয়াকে চাপ দিতে থাকে। পরবর্তীতে আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কারণ তিনি তাতে রাজি না হলে এই অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র বসনিয়ানরা আরও হত্যার শিকার হতো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তিতে বসনিয়া পায় ৫১% ভূমি আর ক্রোয়েশিয়াকে দেওয়া হয় ৪৯% ভূমি। এবং বিভিন্ন অসম চুক্তিতে বসনিয়াকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।

মৃত্যু:
এই মহান মানুষটি ১৯ অক্টোবর ২০০৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান মহান মনিবের দরবারে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top