বর্তমানে মানবতার এমন একটি নতুন সভ্যতা খুব বেশি প্রয়োজন, যে সভ্যতার পাশ্চ্যত্য সভ্যতার থেকে ভিন্ন দর্শন এবং বার্তা রয়েছে। পাশ্চ্যত্য সভ্যতার বলতে আমরা এ সভ্যতার কমিউনিস্ট এবং বস্তুবাদী দিক উভয়টিকেই বুঝাচ্ছি। উভয়টিই কোরআন, তাওরাত এবং যাবুরে বর্ণিত সেই অভিশপ্ত গাছের দুটি শাখা। আর গাছটি হলো বস্তুবাদ।
মানবতার এমন একটি সভ্যতা প্রয়োজন, যে সভ্যতা আল্লাহ, কোরআন, হাশর, মিজানে বিশ্বাসী; সেইসাথে মানুষের মহৎ মূল্যবোধে বিশ্বাসী। যা ছাড়া মানুষ তার মানবিকতাবোধ হারায় এবং জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলে।
মানবতার এমন একটি সভ্যতা প্রয়োজন, যে সভ্যতা ধর্ম, বিজ্ঞান, বিশ্বাস, আকল, চেতনাসহ মানুষের আকাঙ্ক্ষিত সবকিছুকে বেষ্টন করে রাখে। এ সভ্যতা যেমন পরকালে মানুষের জান্নাত প্রাপ্তির পথকে সুগম করতে পারে, তেমনি ইহকালে মানুষের জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ্য করে তুলতে পারে। এটি মানুষকে সত্য, শক্তি, নীতি-নৈতিকতা এবং স্বাধীনতার সন্ধান দেয়।
মানুষের এমন একটি সভ্যতা প্রয়োজন, যা পৃথিবী ও জান্নাতের মাঝে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। এ সভ্যতায় বিশ্বাসী হৃদয়ের সাথে যুক্তিরও ওতপ্রোত সম্পর্ক থাকে। এ সভ্যতায় মানুষ হাকীকত এবং আকলের দ্বারা পরিচালিত হয়, যা তার উপর আল্লাহর দয়া এবং অনুগ্রহের প্রমাণ।
আমরা এতক্ষণ যে সভ্যতার কথা ভাবছি, তা মূলত ইসলাম ছাড়া অন্য কোনোটিই নয় এবং সেই প্রভু হলেন আল্লাহ, যিনি সর্বজ্ঞ এবং সর্বজ্ঞানী, যিনি সবকিছু জানেন। জান্নাত ও পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো কিছুই তার জানার বাইরে নয় এবং তিনি ভারসাম্য ও সুসমন্বয়ের অবিশ্বাস্য ও বাস্তবসম্মত উদাহরণ তৈরি করতে সক্ষম।
ভারসাম্য এবং সমন্বয়ের সভ্যতা :
ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা মানবতাকে একটি পূর্ণাঙ্গ ভারসাম্যপূর্ণ এবং সুসমন্বিত ব্যবস্থা উপহার দেয়।
ভারসাম্য বলতে আমরা বুঝি মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা, অর্থাৎ দুটি প্রান্তিকতার মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করাকে। মানব রচিত কোনো ব্যবস্থা অথবা মানুষের দ্বারা পরিবর্তিত কোনো ধর্মীয় ব্যবস্থাই চরমপন্থা বা প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত নয়। একমাত্র ইসলামেই এটি উপস্থিত।
আল কোরআনের মধ্যমপন্থাকে সরল-সঠিক পথ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কোরআন যে সূরা দিয়ে শুরু হয়েছে, সে সূরা ফাতিহার একটি আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে। একজন মুসলমান প্রতিদিনের নামাজে কমপক্ষে সতেরো বার আল্লাহর কাছে এ আর্জি জানায়,
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত করো।” (সূরা ফাতিহা : ০৬)
এ সরল-সঠিক পথ আল্লাহর আযাবের ফলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জাতিগুলোর পথের সম্পূর্ণ বিপরীত। মধ্যম পন্থাকে ‘মিজান’ বা দাঁড়িপাল্লা হিসেবেও অভিহিত করা হয় যা, যা সীমালঙ্ঘন না করা এবং ওজনে কম না দেওয়া বোঝায়। আল্লাহ বলেন,
“আসমানকে তিনিই সুউচ্চ করেছেন এবং মিজান কায়েম করেছেন। এর দাবি হলো, তোমরা মিজানে সীমালঙ্ঘন করো না। ইনসাফের সাথে সঠিকভাবে ওজন করো এবং ওজনে কম দিও না।” (সূরা আর রাহমান : ৬-৯)
এখানে সীমালঙ্ঘন করা বলতে চরমপন্থা বা প্রান্তিকতা অবলম্বনের প্রবণতা এবং ওজনে কম দেওয়া বলতে সঠিকভাবে ওজন করার ক্ষেত্রে গাফিলতির প্রবণতাকে বোঝায়। আর উভয়টিই নিন্দনীয়।
ইসলামের ভারসাম্যের এই চমৎকার ব্যবস্থা এমন সব পরস্পর বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করেছে, যাদের পারস্পরিক সমঝোতাকে মানুষ কার্যত অসম্ভব মনে করতো। আর এ সমঝোতা এতটাই সুন্দর যে, উভয় পক্ষ কোনো ধরনের সীমালঙ্ঘন ও পারস্পরিক সংঘর্ষ ছাড়াই নিজেদের সীমার মধ্যে অবস্থান নিয়েছে।
আল্লাহ ইলাহী ও মানবিক বিষয়াবলি, ওহী ও আকল, আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত বিষয়, পরকাল ও ইহকাল, একক ব্যক্তি ও ব্যক্তিসমষ্টি, ধারণাগত ও বাস্তববাদী বিষয়, অতীত ও ভবিষ্যত এবং দায়িত্ববোধ ও স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্যের মানদণ্ড স্থাপন করেছেন। এ ভারসাম্য সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি ও নতুন আবিষ্কার, দায়িত্ব ও অধিকার, স্থিতিশীলতা ও পরিবর্তন, প্রতিশ্রুতি ও ধৈর্যের মাঝে পুনর্মিলন ঘটায়।
এসবের কারণে মুসলিম উম্মাহ অন্য সব জাতির তুলনায় বিশিষ্ট নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,
“আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি ‘মধ্যমপন্থী’ উম্মতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা দুনিয়াবাসীদের উপর সাক্ষী হতে পারো এবং রাসূল হতে পারেন তোমাদের উপর সাক্ষী।” (সূরা আল-বাকারা : ১৪৩)
আর সমন্বয় বলতে বোঝায় দুটি ধারণা বা মতাদর্শকে এমনভাবে মিলিত করা, যেন একটি অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায় এবং একটি অন্যটিকে ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। এটি মানুষের জমিনে বিনির্মাণ, পৃথিবীতে খেলাফতের দায়িত্ব পালন এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইবাদাত করার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। ইসলাম বিজ্ঞান ও বিশ্বাস, সত্য ও শক্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ক্রিয়াকলাপ, ধর্ম ও রাষ্ট্র, নির্দেশনা ও আইন, ধর্মীয় বিড়ম্বনা ও শাসকদের দায়িত্ব, বস্তুগত সৃজনশীলতা ও নৈতিক উন্নতি এবং সামরিক শক্তি ও মনোবল এর মাঝে সমন্বয় সাধন করে।
ইসলাম এবং বাস্তবতা অনুসারে, বিজ্ঞান বিশ্বাসের সাথে এবং ক্ষমতা সত্যের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তারা একে অপরের সাথে সেভাবে সমন্বিত, যেভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস ক্রিয়াকলাপ বা কার্যাবলির সাথে এবং নির্দেশনাসমূহ আইনের সাথে সমন্বিত। ইসলাম যে জীবনের কথা বলে তা মূলত এ সমন্বয়ের উপর ভিত্তি করে গঠিত।
মানবরচিত ব্যবস্থা কিছু মূল্যবোধ এবং বিষয়ের উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করে এবং অন্য বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয় না। যার ফলে এটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এসব ব্যবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের চেয়ে উদরপূর্তিকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয় যা মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। এ ব্যবস্থাগুলো বস্তুবাদী বিজ্ঞানকে অত্যাধিক গুরুত্ব দেয়, কিন্তু বিশ্বাসের গুরুত্বকে উপেক্ষা করে। এ ব্যবস্থাগুলো যোগাযোগের সুবিধার প্রতি আগ্রহ দেখায়, কিন্তু জনগণের মধ্যে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ গড়ে তোলার গুরুত্বকে উপেক্ষা করে।
আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থা ‘ইসলাম’ মানুষকে তার প্রয়োজনীয় সব কিছুই দেয়। এটি মানুষের শরীর, মন এবং আত্মার ভারসাম্য বিধান করে। এটি মানুষকে ব্যক্তি হিসেবে যেমন গুরুত্ব প্রদান করে, তেমনি গুরুত্ব প্রদান করে একটি পরিবার এবং একটি সমাজের সদস্য হিসেবেও। এটি মানুষকে তার জীবনের বিভিন্ন ধাপের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলি সম্বলিত আইনসমূহ সরবরাহ করে। এটি শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, শাসক এবং শাসিতদের সকল চাহিদা পূরণ করে। এটি শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, ধনী-দরিদ্র, আকাশচুম্বী ভবনে বসবাসকারী-গভীর জঙ্গলে বসবাসকারী নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতিকে গুরুত্ব প্রদান করে।
ইসলামে বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের সমন্বয় :
বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের মধ্যকার সমন্বয় সুসমন্বিত ইসলামী ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। অন্যান্য ব্যবস্থায় এটি অনুপস্থিত, উপরন্তু অন্যান্য ব্যবস্থায় সর্বদা বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। ইসলামী ব্যবস্থায় বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানকে এমনভাবে সমন্বিত করা হয়েছে যে, উভয়েই সমান তালে দাঁড়িয়ে থাকে।
মধ্যযুগের ইউরোপ অবিচার এবং হাজার হাজার নিরীহ বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, পণ্ডিত ও তাদের সমর্থকদের উপর পরিচালিত রক্তাক্ত গণহত্যার ইতিহাসে পূর্ণ। ÒIslam and Christianity: Side by Side With Science and UrbanismÓ বইয়ে মুহাম্মদ আবদুহু এ রোমহর্ষক ঘটনাগুলোর কিছু বর্ণনা করেছেন।
আমাদের বোঝা উচিত, মুসলমান হওয়ার কারণে আমরা কতটা ভাগ্যবান, কারণ ইসলাম কখনোই বিজ্ঞান ও উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। যারা বলে যে, ইসলাম বিজ্ঞান ও উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টিকারী, তারা মূলত ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ এবং তারা চায় ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো পরিণতি বরণ করুক।
আমরা বৈজ্ঞানিক উন্নতিকে (প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে, যা মানুষের কাজকে সহজ করে তোলে এবং তার সময় ও শ্রম বাঁচায়) একজন মুসলমানের ইবাদত হিসেবেই মানি। বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে তার অংশগ্রহণ এবং উৎকর্ষ সাধন তাকে তার নামাজ-রোজার মতো করেই আল্লাহর নিকটবর্তী করে তোলে। বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ একটি সমষ্টিগত ইবাদত, যা অবশ্যই পালন করতে হবে। বেসামরিক ও সামরিক পর্যায়ে এটির দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার জন্য সমগ্র মুসলিম সমাজকেই দায়বদ্ধ থাকত হবে।
বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এবং চিন্তার প্রতি উৎসাহ প্রদানের কারণে ইসলাম অন্যান্য ধর্ম থেকে আলাদা। ইসলাম মানুষকে জ্ঞানার্জনের জন্য আহ্বান জানায়, আল কোরআনের প্রথম সাতটি আয়াত যার সাক্ষ্য প্রদান করে। ইসলাম বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের প্রশংসা করে এবং পশ্চাদপদতা ও অজ্ঞতার নিরলস বিরোধিতা করে।
অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম কখনো এ ধরনের মিথ্যাচার করেনি যে, “আপনাকে প্রথমে বিশ্বাস করতে হবে এবং তারপর জানতে হবে আপনি কী বিশ্বাস করেছেন! আপনাকে অবশ্যই অন্ধ আনুগত্যের মাধ্যমে আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে! এই না জেনে অনুসরণ করাই তাকওয়ার উৎস!” এসব বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের বিপরীতে বিশিষ্ট মুসলিম আলেমরা বলেছেন, “আল্লাহ সেসব বিশ্বাসীর আমল কবুল করবেন না, যারা না জেনে, না বুঝে অন্ধ আনুগত্য করে।” তারা বলেন, ওহীতে বিশ্বাসের মূল ভিত্তিই হলো আকল। আকল প্রমাণ করে যে, আল্লাহ আছেন এবং নবুয়তও সংঘটিত হয়েছে। নবুয়তের সীলমোহর এবং কোরআনের মুজিযাগুলোতে অবিশ্বাসীদেরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আল্লাহ বলেন,
“তাদেরকে বলে দাও, তোমাদের প্রমাণ আনো, যদি নিজেদের দাবির ব্যাপারে তোমরা সত্যবাদী হও।” (সূরা আল-বাকারা : ১১১)
“আসলে তাদের বেশিরভাগ লোকই নিছক আন্দাজ-অনুমানের পেছনে চলছে। অথচ আন্দাজ-অনুমান দ্বারা সত্যের প্রয়োজন কিছুমাত্র মেটে না। তারা যা কিছু করছে তা আল্লাহ ভালোভাবেই জানেন।” (সূরা ইউনুস : ৩৬)
মধ্যযুগের মানুষেরা পশ্চিমা গির্জাগুলোর প্রচারিত শিক্ষা এই মর্মে ধারণ করতো যে, আকল, যুক্তি, বিজ্ঞান, চিন্তা এবং আইন ওহী বা আসমানী কিতাব, ধর্ম, বিশ্বাস এবং প্রজ্ঞার চরম শত্রু। ইসলামে এই সমস্যা নেই, কারণ এটি আকল এবং ওহী উভয়টিকেই আল্লাহর কুদরতের দুটি চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করে। উভয়টিই সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সমজাতীয়, উপরন্তু ওহী আকলকে সমর্থন করে এবং মুসলমানদেরকে আকল বোঝা এবং আকলের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য আহ্বান জানায়। মুসলিম আলেমদের মতে, প্রকাশ্য (যাহের) এবং ব্যখ্যাযোগ্য (মুফাসসার) এর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। যদি কেউ এর বিপরীত দাবি করে, তবে তা প্রকাশ্য এবং আকল সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলির ব্যাপারে যথাসম্ভব চরম অবিচার এবং অপব্যাখ্যার ফলাফল।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় হলো,
১. চৌদ্দ শতাব্দী আগে কোরআন নাযিল হওয়ার পরবর্তী সময়ে অনেক মতাদর্শ এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রের উদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোরআনের কোনো আয়াতকেই বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল প্রমাণিত করা সম্ভব হয়নি। এটি কোরআনের অশেষ মুজিযার প্রমাণ।
২. কোরআনকে যদিও শুধুমাত্র বিজ্ঞানের গ্রন্থ বলা হয় না, কিন্তু কোরআন প্রায় সময়ই এমন সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়, যা কোরআন নাযিলের পূর্বে ভাবাই যেতো না বা কোরআন নাযিলের বহু শতাব্দী পরেও শোনা যায়নি। বৈজ্ঞানিক বিস্ময় হিসেবে পরিচিত কোরআনের তথ্যের উপর ভিত্তি করে অনেক বৈজ্ঞানিক বই লেখা হয়েছে, একে কেন্দ্র করে অনেক দেশে অনেক সভা-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মক্কার Muslim World League-এর সাথে সম্পৃক্ত একটি স্বতন্ত্র সংস্থা রয়েছে, যা শুধু এ বিষয়টি নিয়েই কাজ করে।
৩. কোরআনের শিক্ষা অবশ্যই সর্বোত্তম আখলাক ও উন্নত চরিত্র গঠনকারী। এ শিক্ষা মানুষের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা সৃষ্টি করে যা কুসংস্কার, অনুমান এবং লালসাকে প্রত্যাখ্যান করে। এটি অন্ধ অনুকরণ এবং নির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী নয়, বরং এটি বৈজ্ঞানিক এবং পরীক্ষামূলক প্রমাণে বিশ্বাসী। এটি কোরআন, হাদীস এবং রাসূল (স.)-এর সীরাতে বিশ্বাসী। এটি বিশ্বাস করে যে মানুষের মন তার জন্য একটি নেয়ামত, যার মাধ্যমে সে সৃষ্টিজগতে যা কিছু আছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহারের সর্বোত্তম উপায়গুলো প্রতিফলিত করতে পারে। এর মাধ্যমে সে ইতিহাসের ধারণারও বিকাশ ঘটাতে পারে এবং কীভাবে অতীতকে ব্যবহার করতে হয় তা শিখতে পারে, যে অতীত রবের হুকুমের অপরিবর্তনীয়তার সাক্ষ্য দেয়। নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে উল্লিখিত উপমাগুলো এ আহ্বানেরই পরিচায়ক।
“…যাদের বুদ্ধি ও বিবেক রয়েছে।” (সূরা আল-বাকারা : ১৬৪)
“…যারা চিন্তা-ভাবনা করে।” (সূরা ইউনুস : ২৪)
“…তাদের জন্য, যাদের জ্ঞান আছে।” (সূরা আল-বাকারা : ২৩)
“…তাদের জন্য, যারা বোধসম্পন্ন।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)
“তাদের জন্য যারা আকলসম্পন্ন।” (সূরা ত্বাহা : ৫৪)
৪. আল কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে আলেমদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?” (সূরা আয যুমার : ০৯)
“তুমি কি দেখো না আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তারপর তার মাধ্যমে আমি নানা ধরনের বিচিত্র বর্ণের ফল বের করে আনি? পাহাড়ের মধ্যেও রয়েছে বিচিত্র বর্ণের সাদা, লাল ও নিকষকালো রেখা। আর এভাবে মানুষ, জীব-জনোয়ার ও গৃহপালিত জন্তুও বিভিন্ন বর্ণের রয়েছে। আসল ব্যাপার হলো আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞান সম্পন্নরাই তাঁকে ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ পরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল।” (সূরা ফাতির : ২৮)
এখানে উল্লেখ্য যে, আল্লাহ আকাশ, বৃক্ষ, জীবজন্তু এবং মানব জাতির পরেই আলেমদের কথা বলেছেন, যা নির্দেশ করে যে আলেমরাই তারা, যারা মহাজাগতিক এবং জীববৈজ্ঞানিক বিষয়াবলি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে, গভীর জ্ঞান রাখে। তাদের জ্ঞানই তাদেরকে মহান আল্লাহর পরম শক্তি, দয়া, রহমত, ক্ষমা এবং জ্ঞান অনুভব করায়।
৫. নবী-রাসূলগণ এবং সৎকর্মশীলগণের সীরাত আমাদেরকে জ্ঞানের মূল্য এবং গুরুত্ব শিক্ষা দেয় যেন আমরা পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহর খলিফা হিসেবে তার দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো পূরণে সহায়তা করতে পারি। এ জ্ঞানের কারণেই হযরত আদম (আ.) ফেরেশতাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন, এ জ্ঞান হযরত ইউসুফ (আ.)-কে মিশরকে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে উদ্ধার করতে সাহায্য করেছিলো, এ জ্ঞানের মাধ্যমে হযরত সোলায়মান (আ.) চোখের পলকে রানী বিলকিসের সিংহাসন ইয়েমেন থেকে ফিলিস্তিনে নিয়ে এসেছিলেন, অন্যান্য নবী এবং বিশ্বাসীগণও এ জ্ঞানের মাধ্যমেই সফলতা লাভ করেছিলেন। এটিই জ্ঞানের উপযোগিতা। ইসলামী সভ্যতার সেরা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এসব মূল্যবোধ ও নীতির বাস্তব প্রয়োগের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিলো।
মুসলমানগণ অনুবাদেও ছিলেন সর্বোচ্চ অবস্থানে, ইতিহাস তাদের অনুবাদ প্রতিভার এ উৎকর্ষের সাক্ষী। তারা প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সকলের আগেই এ উৎকর্ষ অর্জন করেছিলেন। তারা বিজ্ঞান, গণিত, মেটাফিজিক্সসহ জ্ঞানের সকল শাখায় সংশোধন, বিস্তৃতকরণ, গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে জ্ঞান ভাণ্ডারের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। তারা বীজগণিতের মতো জ্ঞানের নতুন ক্ষেত্র উদ্ভব করেছেন। তারা যৌক্তিক এবং পরীক্ষামূলক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন যা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে পশ্চিমারা তা গ্রহণ করে নেয় এবং আধুনিক পশ্চিমা রেনেসাঁর ভিত্তি নির্মাণে তা ব্যবহার করে। নিরপেক্ষ মানসিকতার পশ্চিমারা এ ইতিহাসের সাক্ষী। নিঃসন্দেহে ইসলামী সভ্যতা বহু শতাব্দী ধরেই পৃথিবীর সকল সভ্যতার পথিকৃৎ ছিলো, আর তখন ইউরোপ অজ্ঞতা, অনগ্রসরতা বা পশ্চাৎপদতায় আবৃত ছিলো। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুসলিম অঞ্চলগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যেমন: বাগদাদ, কায়রো, দামেস্ক, কর্ডোভা, আন্দালুসিয়া এবং অন্যান্য মুসলিম দেশ। সারা বিশ্বের ছাত্ররা সঠিক শিক্ষা গ্রহণ এবং নিজেদের দেশকে উন্নয়নের পদ্ধতি শেখার জন্য এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতো।
চিকিৎসা, ফার্মাকোলজি, জ্যোতিষশাস্ত্র, অপটিকস, রসায়ন, গণিত, ভূগোল এবং জ্ঞানের অন্যান্য শাখার ক্ষেত্রে ইসলামী তথ্যসূত্রগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ছিলো। ইসলামী এবং আরব তথ্যসূত্রগুলো বহু শতাব্দী ধরেই চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রধান তথ্যসূত্র ছিলো। আল রাজীর “আল-হাওয়ি”, ইবনে সিনার “আল-কানুন”, ইবনে রুশদের “আল-কুলিয়াত”, আল জাহরাওয়ীর “আল-তাসরিফ লিমান আগাজ আন আল-তালিফ” এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এগুলো ইসলামী সভ্যতার জ্ঞানের রত্ন ভাণ্ডারের অংশ ছিলো। সে সময়ে মুসলিম পণ্ডিত বা আলেমরা ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতের তারকা; আল-খাওয়ারিজমি, আল-বেরুনি, ইবনে আল-হাইশাম, ইবনে নাফিস, ইবনে আল-বিত্তার এবং আরও অনেকেই যার উদাহরণ। মানবিকের ক্ষেত্রে আল-ফারাবি, আল-গাজ্জালী, ইবনে তোফায়েল, ইবনে তাইমিয়া, ইবনে খালদুন এবং আরও অনেকেই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন।
তখন আরবী ছিলো বিশ্বের প্রধান ভাষা, কারণ এটি জ্ঞানের অনূদিত এবং মূল শাখা উভয়টিকেই মূলধারার ইসলামী সভ্যতার সাথে একীভূত করেছিলো। আরবী ভাষার এ ক্ষমতা ও নিপুণতা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং সমাদৃত হয়েছিলো।
মুসলমানদের এই দুর্দান্ত উত্থান সে সময় মুসলিম শহরগুলোর মসজিদ, স্কুল, ঘরবাড়ি, হাসপাতাল এবং জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে ছাপ রেখে গিয়েছিলো। এটি মুসলমানদের আধ্যাত্মিক জীবনে একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছিলো, যে প্রভাব আল্লাহর সাথে তাদের অনন্য সম্পর্ক, তাদের নামাজ, রোজা, যাকাত, সাদকা এবং দাতব্য কাজগুলোতে ফুটে উঠেছিলো। গুস্তাভ লে বন মুসলমানদের এ স্বকীয়, মানবিক ও বিবেকপূর্ণ আচরণ, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রেও তাদের ভালো আচরণে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “আরবদের (মুসলমান) মতো এত বেশি ন্যায়পরায়ণ (আদিল) এবং দয়ালু বিজেতার উদাহরণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে নেই।”
প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, তার কাছে আত্মসমর্পণ, তার ইবাদত এবং তার স্মরণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিলো এ সভ্যতা। এ সভ্যতার মুসলমানগণ বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। নিশ্চিতভাবেই এটি ছিলো একটি আদিল (ন্যায়ভিত্তিক) সভ্যতা, যেখানে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং যুদ্ধ একে অপরের সাথে মিলেমিশে ছিলো।
বিজ্ঞান এবং বিশ্বাস : অবিচ্ছেদ্য
আমরা জ্ঞান এবং যুক্তির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাসী, তবে আমরা এটিও বিশ্বাস করি যে, শুধুমাত্র জ্ঞান এবং যুক্তি মানুষের সকল চাহিদাই পূরণ করতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ জ্ঞান এবং যুক্তিরও সীমাবদ্ধতা আছে। এগুলো আমাদের কিছু চাহিদা পূরণ করে, আবার কিছু চাহিদা পূরণ করতে পারে না। নিজেদের ক্ষমতার বাইরের বিষয়গুলোর সামনে উভয়েই অসহায়। উভয়েই অস্তিত্ব, জীবন, মহাবিশ্ব, মৃত্যু এবং অন্যান্য সকল প্রাসঙ্গিক বিষয়ের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম নয়। উভয়ের ক্ষমতাই বস্তুবাদী এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। সুতরাং বোঝা যায়, জ্ঞানের অন্য একটি উৎস অবশ্যই থাকতে হবে যা মানুষকে তার দায়িত্ব-কর্তব্য, পৃথিবীতে তার ভূমিকা এবং সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কিত অন্তহীন প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এক্ষেত্রে ওহী-ই একমাত্র উৎস যা মানুষের সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদানের সক্ষমতা রাখে, আর বিশ্বাসই এটির মূল চাবিকাঠি। চিন্তাবিদরা জ্ঞান এবং যুক্তির মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্বের রহস্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উল্টো পরস্পরবিরোধী এবং অযৌক্তিক ফলাফলের কারণে তারা গভীর বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছেন। তাই কোরআনের অকাট্য আয়াত দ্বারা পরিচালিত বিশ্বাসই একমাত্র সমাধান।
ইসলামের মতে মানুষকে বিভ্রান্তকারী প্রধান সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ঈমান বা বিশ্বাসের রয়েছে, যেমন, মানুষের অস্তিত্ব এবং তার মৃত্যু পরবর্তী অনন্তকালের জীবন। তাছাড়াও বিশ্বাস মানুষকে তার জীবনের অর্থ বুঝতে এবং জীবনের লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম করে তোলে। সেইসাথে জ্ঞান অর্জনের নামে সীমালঙ্ঘন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লাগাম টানতেও এ শক্তি ব্যবহৃত হয়। আমাদের কাছে এ নিয়ন্ত্রণের অনেক উদাহরণ রয়েছে। চোখের পলকে রানী বিলকিসের সিংহাসন ইয়েমেন থেকে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসার পর আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা ও জ্ঞানের অধিকারী হযরত সুলায়মান (আ.) বলেছিলেন,
“এ আমার রবের অনুগ্রহ, আমি শোকরগুযারী করি না নাশোকরী করি, তা তিনি পরীক্ষা করতে চান। আর যে ব্যক্তি শোকরগুযারী করে, তার শোকর তার নিজের জন্যই উপকারী। অন্যথায় কেউ অকৃতজ্ঞ হলে, আমার রব কারো ধার ধারেন না এবং আপন সত্তায় আপনি মহীয়ান।” (সূরা নামল : ৪০)
সুলায়মান যখন তার সামনে রানী বিলকিসের সিংহাসন পড়ে থাকতে দেখেন, তখন তিনি আনন্দ বা অহংকারে মত্ত হয়ে একটা মুহূর্তও নষ্ট করেননি, বরং আল্লাহর প্রশংসা করেন।
প্রাচীর নির্মাণ শেষে যুলকারনাইন (আ.) বিনীতভাবে বলেছিলেন,
“এ আমার রবের অনুগ্রহ। কিন্তু যখন আমার রবের প্রতিশ্রুতির নির্দিষ্ট সময় আসবে, তখন তিনি একে ধূলিস্মাৎ করে দেবেন, আর আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য।” (সূরা কাহফ: ৯৮)
যদি আমরা ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণালী দিনগুলোতে ফিরে যাই, তাহলে আমরা বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত জ্ঞান কীভাবে গঠনমূলকভাবে মানুষের সেবা, উপকার এবং সুখে থাকার কাজে আসে তার অনেক উদাহরণ দেখতে পাবো। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে আমরা পশ্চিমাদের উদাহরণগুলো খুঁজে নেই, যারা জ্ঞানকে কলুষিত করেছে, আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে, গণবিধ্বংসী অস্ত্র আবিষ্কার করে এটির অপব্যবহার করেছে, যা আমাদের জীবনকে একটি জীবন্ত দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে।