ইসলামে রাষ্ট্রের অবস্থান
ইমাম হাসান আল বান্না ইসলামের ব্যাপকতা বর্ণনায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- “যেমনিভাবে ইসলাম আকিদা ও ইবাদত, তেমনিভাবে ইসলাম হচ্ছে রাষ্ট্র ও ভূখণ্ড।” এই বাস্তবতাটির ঘোষণা এবং এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ ইসলামের প্রথম যুগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইমাম বান্না তাঁর প্রত্যেকটি প্রবন্ধ ও আলোচনায় রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডের ওপর গুরুত্ব দিতেন। আর এই গুরুত্ব দেওয়ার কারণ আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।
মুসলিমদের ভূখণ্ড জবরদখলকারী ঔপনিবেশিকরা অনেক মুসলিমের চিন্তায় এই বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছে যে- ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম; রাষ্ট্র বা রাজনীতির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই’। তাদের চিন্তায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে- ‘ধর্ম মানেই পশ্চিমা চিন্তাধারার ধর্ম। রাষ্ট্রীয় কাজের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রকে মানুষ স্বীয় বিচারবুদ্ধির নিরিখে সদা পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং নিজ নিজ দক্ষতার আলোকে সাজিয়ে নেবে।’
পশ্চিমে খ্রিষ্টবাদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে, প্রাচ্যে ইসলামের সাথে ঔপনিবেশিকরা একই আচরণ করতে চেয়েছে। ঔপনিবেশিকদের মতে- ‘পশ্চিমে ধর্মের শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোনো বিপ্লব পূর্ণতা পায়নি। সুতরাং, প্রাচ্য তথা আরব কিংবা মুসলিম বিশ্বে বিপ্লব করতে চাইলে, অবশ্যই তা ধর্মের বিরুদ্ধেই করতে হবে।’ অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো- পশ্চিমে ধর্ম মানে গির্জা ও পাদ্রির একচ্ছত্র ক্ষমতা; মানুষের অনুভূতি ও হৃদয়ের ওপর পুরোহিতদের স্বেচ্ছাচারিতা। আমাদের দ্বীন ইসলামে এর সুযোগ কোথায়! ইসলামে কোনো পোপ-পাদ্রি বা পুরোহিত নেই। নেই কোনো ধর্মীয় যাজকতন্ত্র। সুযোগ নেই হৃদয়-মনের সাথে কোনো স্বেচ্ছাচারিতারও।
ঔপনিবেশিকরা মুসলিমদের মাঝে এমন একটি পক্ষ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যারা মনে করে- ‘রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে দ্বীনের কোনো ভূমিকা নেই। আর দ্বীন ও রাজনীতি সম্পূর্ণ পৃথক দুটি ব্যাপার।’ তারা বলে- ‘এটি ইসলামের ক্ষেত্রেও সত্য, যেমনি সত্য খ্রিষ্টবাদের ক্ষেত্রেও।’ ঔপনিবেশিকরা একটি প্রবাদের বহুল প্রচলন ঘটিয়েছে। সেই প্রবাদটি হলো- الدين لله والوطن للجميع ‘দ্বীন আল্লাহর, রাষ্ট্র সবার’। কথাটি সত্য বটে, কিন্তু এই কথার প্রচলন ও প্রচারের ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য খারাপ।
ঔপনিবেশিকরা ‘দ্বীন আল্লাহর’ কথাটার মধ্যে দ্বীনের অর্থ করেছে- ‘বান্দার ব্যক্তিসত্তার সাথে আল্লাহর একান্ত সম্পর্ককে’। অর্থাৎ, দ্বীনের অবস্থান কেবল ব্যক্তিগত জীবনে; এর বাইরে রাষ্ট্র বা সমাজের অঙ্গনে দ্বীনের কোনো অবস্থান নেই। এ চিন্তাধারার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো- কামাল আতাতুর্ক সৃষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি রাষ্ট্র। নিপীড়ন, জুলুম, রক্তবন্যা আর অস্ত্রের মুখে তুর্কি মুসলিমদের ওপর এই ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সাথে যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ করে টিকে থাকা ইসলামের সর্বশেষ রাজনৈতিক দুর্গ উসমানী খিলাফত ভেঙে পড়ার পর মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতা আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠালাভ করে। এরপর বেশ কিছু মুসলিম সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধুনিক তুরস্ককে অনুসরণ করতে শুরু করে। তারা ফৌজদারি ও নাগরিক আইন ইত্যাদি থেকে ইসলামকে সরিয়ে দেয়। ইসলামকে সীমাবদ্ধ করা হয় শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনে। আসলে এর মাধ্যমে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিষয়াদি থেকে ইসলামের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি ও রীতিনীতির অনুপ্রবেশের জন্য মুসলিম বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
আরবের বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা আতাতুর্কের কর্মকাণ্ডকে অনুসরণ ও পছন্দ করে। আর পছন্দ করার এই বিষয়টাকে তারা গোপন করার প্রয়োজনও বোধ করে না। এমনকি তৎকালীন মিশরের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক দলের নেতা এবং ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেন- “আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় কামাল আতাতুর্কের পদক্ষেপ আমি পছন্দ করছি।” ইমাম হাসান আল বান্না তার কথার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন।
পশ্চিমাদের আগ্রাসী সাংস্কৃতিক যুদ্ধের সবচেয়ে বড়ো দৃশ্যমান বিজয় হলো- তাদের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা শুধু আধুনিক নাগরিকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, আগাগোড়া ইসলামি ধারায় পড়াশোনা করা কিছু লোকও তাদের চিন্তায় প্রভাবিত হয়েছে। এমনকি আল আযহারের মতো প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের কতিপয় ব্যক্তিও তাদের সাথে একাত্ম হয়েছে! আলী আবদুর রাজ্জাক লিখিত আল ইসলাম ওয়া উসুলুল হুকুম (ইসলাম ও শাসনব্যবস্থা) বইটি তার প্রমাণ।
উল্লেখ্য, আলী আবদুর রাজ্জাকের বইটি প্রকাশের পর জনসাধারণের মাঝে এবং বিশেষ করে আল আযহারের ভেতরে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। আল আযহার শীর্ষ আলিমদের নিয়ে তার জন্য সালিশি বৈঠক ডাকে। সেখানে তাকে আলিমদের অঙ্গন থেকে বহিষ্কৃত ঘোষণা করা হয়। আবদুর রাজ্জাকের বইটির বিরুদ্ধে আল আযহার এবং আল আযহারের বাইরের আলিমরাও মজবুতভাবে কলম ধরেন।
এসব কারণে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক-পৃষ্ঠপোষকদের মোকাবিলায় ইসলামের ব্যাপকতা তুলে ধরা অধিক গুরুত্ববহ হয়ে দাঁড়ায়। ইসলামি শিক্ষা ও বিধিবিধানে ইসলামের জীবন্ত দিকগুলো স্পষ্ট করা জরুরি হয়ে পড়ে। যেমন- রাষ্ট্রগঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি এবং শাসনব্যবস্থার শিষ্টাচার। এই বাস্তবতায় এটি ঘোষণা করা ওয়াজিব হয়ে পড়ল যে- ‘রাষ্ট্র, শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। একে ইসলাম থেকে আলাদা করা যায় না।’
ইসলামি জ্ঞানের উৎস থেকে দলিল
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো কোনো ইসলামি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা নেতাকর্মীদের উদ্ভাবিত কথা নয়। ইসলামি জ্ঞানের মৌলিক উৎসে এর জোরালো বয়ান এসেছে। ইসলামের ইতিহাস এবং যুগে যুগে দাওয়াতি কার্যক্রমে রয়েছে তার অজস্র দলিল-প্রমাণ। ইসলামি জ্ঞানের উৎসের অগণিত দলিল থেকে নিম্নোক্ত দুটি আয়াতই এর জন্য যথেষ্ট।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمْنَتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا ﴿٥٨﴾ يَأَيُّهَا الَّذِينَ امَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُوْلِ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ হকদারদের কাছে পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে বিচার-ফয়সালা করবে, তখন তা ন্যায়পরায়ণতার সাথেই করবে। আল্লাহ তোমাদের সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী। হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো, নির্দেশ মান্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা (শাসন ও বিচারের) দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ো, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ করো…।” সূরা নিসা: (৫৮-৫৯)
প্রথম আয়াতে রাষ্ট্রের প্রশাসক ও বিচারকদের উদ্দেশে বলা হয়েছে- তারা যেন আমানত রক্ষা করে এবং ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করে। আমানত ও ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি উম্মাহকে ধ্বংস করে দেয় এবং দেশকে চরম ক্ষতির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। সহিহ হাদিসে এসেছে-
قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ” فَإِذَا ضُيْعَتِ الأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ “. قَالَ كَيْفَ إِضَاعَتُهَا قَالَ إِذَا وُسِدَ الْأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ”.
“নবি সা. বলেন- ‘যখন আমানতদারীতা উঠে যাবে, তখন কিয়ামতের জন্য অপেক্ষা করবে।’ সাহাবিদের মধ্য থেকে একজন প্রশ্ন করলেন- ‘কীভাবে আমানত হারিয়ে যায়?’ রাসূল সা. বললেন- ‘যখন অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর কোনো দায়িত্ব অর্পণ করা হবে, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো’।” (বুখারি: ৫৯)
দ্বিতীয় আয়াতে সাধারণ মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। তারা যেন দায়িত্বপ্রাপ্তদের আনুগত্য করে। শর্ত হলো- এই দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের মধ্য থেকে হবেন। এই আনুগত্যকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পরে আনা হয়েছে। মতবিরোধকালে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মানদণ্ড ধরতে বলা হয়েছে। এসব কিছুর চূড়ান্ত দাবি হচ্ছে- মুসলিমদের নিজেদের রাষ্ট্র থাকবে। সবাই এই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করবে। যদি রাষ্ট্রই না থাকে, তাহলে ওপরের আদেশগুলো দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক!
এই আয়াত দুটোর বিস্তারিত তাফসির পাওয়া যাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার- السياسة الشرعية في إصلاح الراعي والرعية রাজনীতি) শিরোনামীয় প্রসিদ্ধ গ্রন্থে। পুরো বইটি এই দুই আয়াতের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত।
এরপর সুন্নাহর দলিলের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। রাসূল সা. বলেন-
مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةٌ .
“কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে, অথচ তার গলায় বাইয়াত নেই, সে জাহিলি মৃত্যুবরণ করেছে।”
ইসলামের বিধান লঙ্ঘনকারী কোনো ব্যক্তির হাতে তো একজন মুসলিম কোনোভাবেই বাইয়াত গ্রহণ করতে পারে না। এটা হারাম। যে বাইয়াত আমাদের মুক্তি দেবে তা হলো- আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালাকারীর হাতে বাইয়াত। যতক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের বাইয়াতের পরিবেশ অনুপস্থিত থাকবে, ততক্ষণ প্রত্যেক মুসলিম অবিশ্রান্তভাবে গুনাহর ভাগীদার হতে থাকবে। কাঙ্ক্ষিত বাইয়াত গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত কেবল দুটি কাজই এ গুনাহ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে। যথা:
এক. ইসলামি শরিয়তবিরোধী সকল কায়েমি ব্যবস্থার বিরোধিতা করা- অক্ষমতার ক্ষেত্রে অন্তত মনে মনে হলেও।
দুই. সুদৃঢ়ভাবে ইসলামি জীবনব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বদা সক্রিয় থাকা, যেন এই সম্মিলিত চেষ্টা-প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরে আসে।
খিলাফত, ইমারত, বিচার, ইমাম (শাসক-নেতা), ইমামের গুণাবলি, নাগরিকদের ওপর তার অধিকার, কল্যাণমূলক কাজে সহায়তা, দায়িত্বশীলের জন্য উপদেশ, সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি উভয় অবস্থায় আমীরের আনুগত্য, দায়িত্বশীলদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ, আল্লাহ নির্ধারিত দণ্ডসমূহ বাস্তবায়ন ইত্যাদি বিষয়ে রয়েছে অগণিত দলিল। মানুষের অধিকার সংরক্ষণে শাসকের দায়িত্বসমূহ, বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ, সুস্থ-সবল ও শক্তিমানদের তত্ত্বাবধান, অসুস্থদের সেবা, সালাত প্রতিষ্ঠা, যাকাত আদায়, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, বিচারিক আইন, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিধি সম্পর্কে এসেছে অজস্র হাদিস।
আমরা ইমামত ও খিলাফতসংক্রান্ত বিষয়গুলো ইসলামি আকিদা ও উসুলুদ দ্বীনের কিতাবে দেখতে পাই। ফিকহের কিতাবেও এর বিস্তৃত আলোচনা দেখা যায়। এ ছাড়াও রাষ্ট্রীয় সংবিধান, প্রশাসন, অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে আলাদা আলাদা বিশেষায়িত অসংখ্য কিতাবাদি পাওয়া যায়। যেমন- আল মাওয়ারদির আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, আবু ইয়ালার আহকামুস সুলতানিয়্যাহ, ইমামুল হারাইমাইনের আল গিয়াসি, ইবনে তাইমিয়ার সিয়াসাতুশ শারইয়্যাহ, ইবনে জামায়াহর তাহরিরুল আহকাম, ইমাম আবু ইউসুফের আল-খারাজ, ইয়াহইয়া ইবনে আদমের আল-খারাজ, আবু উবাইদের আল-আমওয়াল, ইবনে যানজুয়াহর আল-আমওয়াল- এরকম আরও অজস্র বইপুস্তক। এর সবগুলোই রচিত হয়েছে প্রশাসক ও বিচারকদের দায়িত্বের ধরন, প্রকৃতি, বিচারিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্ব প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে।
ইসলামের ইতিহাস থেকে দলিল
ইসলামের ইতিহাস জানাচ্ছে- ঐশী হিদায়াতের ধারক এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাসূল সা. তাঁর শক্তি, চিন্তা ও সামর্থ্যের বড়ো অংশ বিনিয়োগ করেছেন, যা হবে দাওয়াতের ভূখণ্ড এবং তাঁর পরিবার ও অনুসারীদের একান্ত জায়গা। যে রাষ্ট্রে শরিয়াহর কর্তৃত্ব ছাড়া অন্য কারও কর্তৃত্ব থাকবে না। এজন্য রাসূল সা. বিভিন্ন গোত্রের কাছে গিয়েছেন। রাসূল সা. চেয়েছেন, তারা ঈমান আনুক এবং তাকে ও তাঁর দাওয়াহকে সুরক্ষা দিক। এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তায়ালা আউস ও খাযরাজদের কবুল করেন। তাদের মাঝে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে।
আউস ও খাযরাজদের ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী হজের মৌসুমে রাসূল সা.-এর কাছে আগমন করেন এবং বাইয়াত গ্রহণ করেন। সেইসাথে তারা অঙ্গীকার করেন- তারা নিজেদের এবং নিজ পরিবার-পরিজন ও সন্তানদের যেভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন, ঠিক তেমনি আল্লাহর রাসূলকেও নিরাপত্তা প্রদান করবেন। এরপর আউস ও খাযরাজ গোত্রের লোকেরা শ্রবণ, আনুগত্য, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধার ওপর বাইয়াত গ্রহণ করলেন।
রাসূল সা.-এর মদিনায় হিজরত একটি অনন্য ইসলামি সমাজ গড়ার প্রয়োজনেই হয়েছিল, যে সমাজের ওপর গড়ে উঠবে একটি অনুপম রাষ্ট্র। মদিনা ছিল একটি দারুল ইসলাম, একটি নতুন ধারার রাষ্ট্রের নমুনা- যার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন স্বয়ং রাসূল সা.। তিনি ছিলেন একাধারে ইমাম ও নেতা, ছিলেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
আল্লাহর রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সেই রাষ্ট্রে যোগদান করা, রাসূল সা.-এর শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে কাজ করা, সে রাষ্ট্রের ছায়ায় জীবনযাপন করা, সে রাষ্ট্রের সেনাপতিদের অধীনে জিহাদ করা- সে সময়ের সব ঈমানদারের ওপর ছিল ফরজ। ইসলামের শত্রুদের ও কুফরের ভূমি থেকে দারুল ইসলামে হিজরত করা, সারা দুনিয়া থেকে মুমিন মুজাহিদদের দলে যোগদান করা এবং তাদের মতো চরিত্রকে ধারণ করা ছাড়া দ্বীনে পূর্ণতা আসত না। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُمْ مِنْ وَلَا يَتِهِمْ مِّنْ شَيْءٍ حَتَّى يُهَاجِرُوا
“যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরত করেনি, হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব তোমাদের (মুসলিমদের) নেই।” (সূরা আনফাল: ৭২)
… فَلَا تَتَّخِذُوا مِنْهُمْ أَوْلِيَاءَ حَتَّى يُهَاجِرُوا فِي سَبِيْلِ اللَّهِ …
“আল্লাহর পথে হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের কাউকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।” (সূরা নিসা: ৮৯)
কিছু মুসলিম স্বেচ্ছায় দারুল হারব ও দারুল কুফরে বসবাস করছিল এবং এর ফলে তারা দ্বীনের নির্দেশনা, একান্ত করণীয় বিষয়াদি এবং আনুষ্ঠানিক ইবাদতগুলো স্বচ্ছন্দে ও যথাযথভাবে পালন করতে পারছিল না। আল্লাহ তায়ালা সেসকল মুসলিমদের কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করে বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّهُمُ الْمَلَئِكَةُ ظَالِينَ أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيْمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِيْنَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةٌ فَتُهَاجِرُوْا فِيْهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَلَهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا ﴿2﴾ إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُوْنَ حِيْلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا ﴿﴾ فَأُولَئِكَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوا غَفُوْرًا (1)
“যারা নিজেদের ওপর জুলুম করে তাদের প্রাণ কবজ করার সময় ফেরেশতাগণ বলেন- তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে- ‘দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম।’ প্রত্যুত্তরে ফেরেশতাগণ বলেন- ‘আল্লাহর জমিন কি এমন প্রশস্ত ছিল না, যেখানে তোমরা হিজরত করতে পারতে?’ এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম, আর তা কত মন্দ আবাস! তবে যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও পায় না আল্লাহ অচিরেই তাদের পাপ মোচন করবেন। কারণ, আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, ক্ষমাশীল।” (সূরা নিসা: ৯৭-৯৯)
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ সা.-এর ওফাতের পর সাহাবায়ে কিরাম সর্বপ্রথম নিজেদের নেতৃত্ব নির্ধারণে ব্যস্ত হয়েছেন। এ কাজটা সাহাবাগণ রাসূল সা.- এর দাফনের পূর্বেই সম্পন্ন করেছিলেন। সাহাবায়ে কিরাম যথাসম্ভব দ্রুত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর হাতে বাইয়াত নেন এবং তাঁর কাছে সকল দায়দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এরপর প্রত্যেক যুগেই একই পরিস্থিতিতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সাহাবি ও তাবেয়িগণের ঐতিহাসিক এই ইজমাকে পরবর্তী আলিমগণ ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতীক এবং ইমামের হাতে বাইয়াত গ্রহণ ওয়াজিব হওয়ার দলিল হিসেবে গণ্য করেছেন।
বর্তমান সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা দৃশ্যপটে আসার পূর্বে মুসলিমরা কখনও নিজেদের দ্বীন ও রাষ্ট্রকে আলাদাভাবে দেখেনি। সাম্প্রতিককালে দ্বীন ও রাষ্ট্রকে আলাদা করার প্রবণতা সম্পর্কে রাসূল সা. পূর্বেই আমাদের সতর্ক করেছেন এবং এই প্রবণতার বিরোধিতা করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন। যেমন, মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. বর্ণিত হাদিস, তিনি বলেন-
سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: ألا إن رحى الإسلام دائرة فدوروا مع الكتاب حيث دار ، ألا إن الكتاب والسلطان سيفترقان فلا تفارقوا الكتاب ألا إنه سيكون عليكم أمراء يقضون لأنفسهم ما لا يقضون لكم إن عصيتموهم قتلوكم وإن أطعتموهم أضلوكم . قالوا : يا رسول الله كيف نصنع؟ قال: كما صنع أصحاب عيسى ابن مريم نشروا بالمناشير وحملوا على الخشب. موت في طاعة الله خير من حياة في معصية الله.
“আমি রাসূল সা.-কে বলতে শুনেছি- ‘সাবধান! ইসলামের চাকা একটি বৃত্তে ঘুরছে। সুতরাং তোমরা ইসলামের সাথে ঘুরতে থাকো। সাবধান! কুরআন ও সুলতান অচিরেই আলাদা হয়ে যাবে (অর্থাৎ, দ্বীন ও রাষ্ট্র)। সুতরাং তোমরা কিতাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। সাবধান! অচিরেই তোমাদের মাঝে কিছু শাসকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা নিজেদের জন্য যা ফয়সালা করবে, তোমাদের জন্য তা করবে না। যদি তোমরা তাদের অবাধ্য হও, তারা তোমাদের হত্যা করবে। আর যদি তাদের আনুগত্য করো, তবে তোমাদের পথভ্রষ্ট করবে।’ সাহাবিগণ প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, তখন আমরা কী করব?’ রাসূল সা. বললেন, ‘ঠিক ঈসা ইবনে মারইয়ামের অনুসারীরা যা করেছে, তোমরা তা-ই করবে। তাদের করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে, শুলে চড়ানো হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্যের মাঝে মৃত্যু, আল্লাহর অবাধ্যতার মাঝে বাঁচার চেয়ে উত্তম’।”
ইসলামের ভাবধারা থেকে দলিল
ইসলাম ও ইসলামের রিসালার প্রকৃতি হলো- এটি সর্বজনীন দ্বীন, সার্বজনীন শরিয়াহ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই শরিয়াহ জীবনের সকল দিকে মনোনিবেশ করে। সুতরাং, রাষ্ট্রীয় দিককে ইসলাম অবহেলা করবে- এ কথা চিন্তাতীত। রাষ্ট্রকে অসৎ, নাস্তিক ও পাপীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া ইসলামের বৈশিষ্ট্যের সাথে মানানসই নয়। এটা তো অকল্পনীয় যে- রাষ্ট্রকে অসৎ লোকেরা চালাবে, আর ইসলামি শরিয়াহ শুধু আকিদা ও ইবাদত নিয়ে নির্দেশনা দেবে।
এই দ্বীন শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার দিকে আহ্বান করে এবং যেকোনো ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা অপছন্দ করে। এমনকি রাসূল সা. আমাদের সালাতের কাতার সোজা করতে এবং অধিক জ্ঞানীকে ইমামতি করার নির্দেশ দিয়েছেন। আরও নির্দেশ দিয়েছেন- সফরের সময়ও কাউকে দায়িত্বশীল বানিয়ে নিতে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া তাঁর السياسة الشرعية গ্রন্থে বলেন-
“এটা জানা জরুরি যে, মানবীয় প্রয়োজন বা জাগতিক বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা দ্বীনের সবচেয়ে বড়ো ওয়াজিব। এটি ছাড়া দ্বীন ও দুনিয়া কোনোটারই অস্তিত্ব নেই। সমাজ ও সামষ্টিকতা ছাড়া আদম সন্তানদের চাহিদাসমূহ পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ, মানুষ একে অপরের মুখাপেক্ষী। আর সমাজ ও সামষ্টিকতার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব অপরিহার্য। সেজন্যই আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন-
إِذَا خَرَجَ ثَلَاثَةٌ فِي سَفَرٍ فَلِيُؤَمِرُوا أَحَدَهُمْ .
“তোমাদের তিনজন যদি সফরে বের হও, তবে একজনকে আমির হিসেবে নিযুক্ত করো।”
ইবনে উমর রা.-এর সূত্রে ইমাম আহমাদের বর্ণনা, নবি সা. বলেছেন-
لا يحل لثلاثة يكونون في فلاة من الأرض إلا أمروا عليهم أحدهم
“তোমাদের তিনজন যদি নির্জন কোনো মেরুতেও থাকো, একজনকে নেতা নিযুক্ত না করা জায়েয হবে না।”
আমরা জানি, নবি সা. সফরের ছোটো কাফেলায়ও নেতৃত্ব বাধ্যতামূলক করেছেন। আসলে রাসূল সা. সকল সামাজিক প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব সম্পর্কে সতর্ক করতে চেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা সৎকাজের আদেশ ও মন্দকাজে বাধাদানকে ওয়াজিব করেছেন। এ কাজ দুটো শক্তি ও নেতৃত্ব ছাড়া যথার্থভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়।
এভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা এমন অনেক কিছু আমাদের ওপর আবশ্যক করেছেন, যা ক্ষমতা ও নেতৃত্ব ছাড়া যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা অসম্ভব; যেমন- জিহাদ, ন্যায়বিচার, হজ, জুমা, ঈদ, মজলুমের সাহায্য, শরয়ি দণ্ড বাস্তবায়ন ইত্যাদি। এ কারণে বলা হয়- ‘সুলতান (শাসনক্ষমতা) পৃথিবীতে আল্লাহর ছায়া।’ এসব বাস্তবতা ও জরুরতের কারণেই সালফে সালেহিনের অনেকে যেমন- ফাদল ইবনে ইয়াজ, আহমাদ ইবনে হাম্বলসহ অনেকে বলতেন- ‘যদি আমাদের ইচ্ছাপূরণের সুযোগ থাকত, তবে আমরা শাসনক্ষমতা চাইতাম।”
ইমামদের এমন আকাঙ্ক্ষার কারণ হলো- শাসনক্ষমতার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বহু সৃষ্টির কল্যাণ সাধন করেন।
একটি জীবনধারা হিসেবে ইসলাম মানবজীবনকে নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সমাজকে শাসন করতে চায় এবং আল্লাহর আদেশের আলোকে মানবচরিত্রকে সাজাতে চায়। বক্তৃতা-বিবৃতি কিংবা সুন্দর সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানবচরিত্রের পূর্ণতা সাধন সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান, নসিহত ও শিক্ষা শুধু মানুষের বিবেকের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। কারণ, বিবেকের অসুস্থতা বা মৃত্যুর সাথে এই সকল বিধানের বাস্তবায়নের অনুভূতি ও শিক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে।
আমিরুল মুমিনীন উসমান ইবনে আফফান রা. বলেন-
إن الله لينع بالسلطان ما لا يزع بالقرآن
“কিছু কাজ আল্লাহ তায়ালা সুলতানের (রাষ্ট্রশক্তি) হাত দিয়ে করান- যা কেবল কুরআনের (উপদেশের) মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয় না।”
কিছু মানুষকে কুরআন ও মিজান সুপথ দেখায়, আর কিছু মানুষকে সুপথে রাখতে পারে কেবল আইন ও লোহা (শাস্তির ভয়)। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَتِ وَاَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتٰبَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ
وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيْهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ
“নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদের প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও মিযান- যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে; আর আমি লৌহ দিয়েছি যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ।” সূরা হাদিদঃ ২৫
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন-
“যে কিতাব থেকে সরে যাবে, তাকে লোহা (শক্তি) প্রয়োগ করে ঠিক করা হবে। আর এ কারণেই দ্বীনের তত্ত্বাবধায়করা কুরআন ও তরবারির সমন্বয়ে কাজ করেছেন।”ইমাম গাযালি রহ. বলেন- “দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। দুনিয়া ছাড়া দ্বীন পূর্ণতা পায় না। রাষ্ট্র ও দ্বীন জমজ ভাই। দ্বীন মৌলিক স্তম্ভ, আর শাসক তার রক্ষক। যার মৌলিকত্ব নেই, তার অস্তিত্বই নেই। আর যার রক্ষক নেই, তার ধ্বংস অনিবার্য। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের পরিচালনা শাসক ছাড়া পূর্ণতা পায় না।”
ইসলামি জ্ঞানের উৎসগুলোতে যদি ইসলামি রাষ্ট্রের আবশ্যকতার কথা নাও আসত, যদি রাসূল সা. ও সাহাবিগণ এর বাস্তবায়ন করে নাও দেখাতেন, তারপরও ইসলামের স্বভাবজাত প্রকৃতি নিজ প্রয়োজনেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বাধ্যতামূলক করে দিত। আর তা হতো ইসলামের বিশ্বাস, প্রতীক, শিক্ষা, বোধ, চারিত্রিক গুণাবলি, নিয়মনীতি ও শরিয়তের মাধ্যমে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
ইসলামের দাবি বাস্তবায়নে প্রতিটি যুগেই রাষ্ট্রের চাহিদা অনস্বীকার্য। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে এর চাহিদা আরও তীব্রতর। কেননা, এখন চিন্তা ও দর্শনভিত্তিক আদর্শিক রাষ্ট্রের প্রবর্তন হয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, আইন, বিচার, অর্থনীতি থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাজনীতি সবই এই আদর্শের মানদণ্ডে চলে। উদাহরণত আমরা সমাজতান্ত্রিক ও কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি।
আধুনিক বিজ্ঞান এখন উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করছে। রাষ্ট্র চাইলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের চিন্তা, বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি, রুচি, চরিত্র ইত্যাদির ওপর কার্যকর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এমন সুযোগ পূর্বের কোনো সময় ছিল না। রাষ্ট্র এখন ওপরে বসে যন্ত্র ব্যবহার করে সমাজের মূল্যবোধ, চিন্তার গণ্ডি ও চরিত্রকে পরিবর্তন করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এ কাজে রাষ্ট্রের শক্তিশালী কোনো প্রতিপক্ষও নেই।
ইসলামি রাষ্ট্র একটি আদর্শিক রাষ্ট্র। এটি একটি বিশ্বাস এবং জীবনধারার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এটি শুধু অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রু থেকে জাতিকে রক্ষার কোনো নিরাপত্তাযন্ত্র নয়; বরং এ রাষ্ট্রের দায়িত্বসীমা অনেক বিস্তৃত ও গভীর। জাতিকে ইসলামের বুনিয়াদ ও শিক্ষার আলোকে শিক্ষিত ও অনুশীলনকারী হিসেবে গড়ে তোলা- এই রাষ্ট্রের আবশ্যিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ইসলামি আকিদা, চিন্তা ও শিক্ষার বিকাশ এবং বাস্তব জীবনে এর অনুশীলনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা হবে প্রত্যেক সত্যনিষ্ঠের জন্য অনুকরণীয় এবং বিপথগামীর বিপক্ষে উদাহরণ।
এজন্যই ইবনে খালদুন খিলাফতের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে-
“শরিয়তপ্রণেতার কাছে দুনিয়ার ব্যবস্থাপনার পুরোটাই আখিরাতের কল্যাণের জন্য বিবেচ্য। সুতরাং, সমগ্র মানবতাকে পরকালীন ও দুনিয়াবি কল্যাণের বিবেচনায় শরয়ি দর্শনের দিকে উদ্বুদ্ধ করা এবং দ্বীন ও তৎসংশ্লিষ্ট দুনিয়ার রাজনীতি রক্ষণাবেক্ষণে শরিয়তপ্রণেতার প্রতিনিধিত্ব করাই খিলাফত।”
আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের প্রশংসায় এমন গুণাবলি বর্ণনা করেছেন, যা রাষ্ট্র ও কর্তৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنْهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلوةَ وَآتَوُا الزَّكُوةَ وَ آمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ
“আমি তাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ হতে বিরত করবে।” সূরা হজ: ৪১
রিবয়ি ইবনে আমির রা. পারসিকদের সেনাপতি রুস্তমকে ইসলামি রাষ্ট্রের নির্দশন নিয়ে বলেছিলেন-
الله ابتعثنا لنخرج من شاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام .
“আল্লাহ তায়ালা আমাদের পাঠিয়েছেন মানুষকে বান্দার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে বের করে আখিরাতের প্রাচুর্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অন্যান্য ধর্মের অত্যাচার-অনাচার থেকে ইসলামের সুবিচারের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।”
ইসলামের আদর্শিক রাষ্ট্র কোনো আঞ্চলিক বা জাতীয়তাবাদী চরিত্রের রাষ্ট্র নয়; বরং এ রাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক বার্তার বাহক। কারণ, আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন- তাদের কাছে থাকা আলো ও হিদায়াতের দিকে গোটা মানবতাকে আহ্বান জানানোর। তাদের দায়িত্ব দিয়েছেন মানবতার ওপর সাক্ষী হওয়ার। পুরো মানবজাতির শিক্ষকতার দায়িত্বও তাদের ওপর অর্পিত।
মুসলিমরা অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর মতো ইতিহাসের গতিধারায় গড়ে উঠা কোনো জাতি নয়। মুসলিমরা নিজ থেকে তৈরি হয়নি এবং নিজেদের জন্যও তৈরি হয়নি। মূলত মানবজাতির কল্যাণের জন্য মুসলিমদের বের করে নিয়ে আসা হয়েছে। আর এজন্য আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের বানিয়েছেন মধ্যপন্থী জাতি। মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের উদ্দেশে বলেছেন-
وَكَذلِكَ جَعَلْتُكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُوْنُوْا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ
“আমি এভাবে তোমাদের মধ্যপন্থী উম্মাহ করেছি, যেন তোমরা মানবতার জন্য সাক্ষী হও।” সূরা বাকারা: ১৪৩
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ
“তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, যাদেরকে মানবতার জন্য বের করা হয়েছে।” সূরা আলে ইমরান: ১১০
আমরা ইতিহাসে পাতা উল্টালে দেখতে পাই, হুদাইবিয়ার সন্ধির পর প্রথম সুযোগেই রাসূল সা. তৎকালীন দুনিয়ার উল্লেখযোগ্য সকল রাজা-বাদশাহ ও আমিরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছেন। তাওহিদের কাছে সমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন- ‘ঈমানের পথ গ্রহণ না করলে নিজেদের ও অধীনস্থদের পাপের ভার বইতে হবে।’ রাসূল সা. এ চিঠিগুলোর সমাপ্তি টানতেন এ আয়াতের মাধ্যমে-
قُلْ يَأَهْلَ الْكِتٰبِ تَعَالَوْا إِلى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ إِلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُوْلُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ )
“আপনি বলে দিন- ‘হে আহলে কিতাব, তোমরা এমন এক কালিমার দিকে এসো, যা তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সমান। আর তা হলো- আমরা আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করব না এবং আল্লাহ ছাড়া আমাদের কেউ অপর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করব না।’ এরপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বলে দিন- ‘তোমরা সাক্ষী থাকো যে, আমরা মুসলিম’।” সূরা আলে ইমরান: ৬৪
ইসলামের ধারক একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান সময়ে ইসলামি দাওয়াহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো, ছোটো পরিসরে হলেও একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই রাষ্ট্রটি তার ধ্যান- ধারণা, সরকারব্যবস্থা, জীবনাচার, সভ্যতা, বস্তুগত দিক ও সাহিত্যে ইসলামের সামগ্রিক ধারণাকে লালন করবে। এই রাষ্ট্রের দরজা খোলা থাকবে জুলুম, বিদআত ও কুফরের দেশ থেকে হিজরতকারী মুমিনদের জন্য। শুধু ইসলামের জন্য নয়, গোটা মানবতার জন্যই এমন একটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন। এই ইসলামি রাষ্ট্রটি মানবতার সামনে দ্বীন ও দুনিয়ার সমন্বয়ের নমুনা পেশ করবে।
উদাহরণ পেশ করবে পার্থিবতা ও আধ্যাত্মিকতার সুষম ভারসাম্যের। এ রাষ্ট্র হবে যুগপৎভাবে সভ্যতার উন্নতির ও চরিত্রের উৎকর্ষতার নজির, হবে বৃহত্তর ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের পথে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। এই ইসলামি রাষ্ট্রই গোটা উম্মাহকে পর্যায়ক্রমে ইসলামি খিলাফতের ছায়ায় একই তোরণের নিচে নিয়ে আসবে।
বাস্তবতা হচ্ছে- সকল বিরোধী শক্তিগুলো একাট্টা হয়ে এমন একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্মুখে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কোনোমতেই এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে দেওয়াকে বরদাশত করবে না। এই রাষ্ট্রকে ঠেকাতে তারা নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করবে- এ রাষ্ট্রটি যত কম দৈর্ঘ্য বা জনসংখ্যারই হোক না কেন। এমনকি পশ্চিমারা মার্কসীয় রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করে। কমিউনিস্টরা গণতন্ত্রীদের সাথে সন্ধি করে। কিন্তু তাদের কেউই ইসলামি রাষ্ট্রকে বরদাশত করতে রাজি নয়।
বিশ্বের কোথাও ইসলামি আন্দোলন দাঁড়িয়ে গেলে পশ্চিমারা একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কুফরি শক্তিগুলো। তারা সুন্দর সুন্দর কথা বলে। ছলনা দেখায়। আবার খাদ্য অবরোধও করে। নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায়। হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। একটার পর একটা হামলা চালাতেই থাকে। তাই ইসলামি আন্দোলনগুলোকে সর্বদা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আশার আলো দেখতে হয়। এক সাগর হতাশা ও আঘাতকে সহ্য করে কাঙ্ক্ষিত উচ্চাশার সোপানের দিকে এগিয়ে চলতে হয়।
আমাদের যদি একটা সরকার থাকত
ইমাম হাসান আল বান্না বলেন-
“আমাদের যদি বিশুদ্ধ ইসলাম, প্রকৃত ঈমান, বিশুদ্ধ চিন্তার ধারক এবং এর বাস্তবায়নকারী একটি সরকার থাকত! যে সরকার তাদের কাছে সঞ্চিত সম্পদ ও জ্ঞানের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার ঐতিহ্য ও মহত্ত্ব সম্পর্কে সমঝদার এবং যারা বিশ্বাস করে- উম্মাহর সকল ব্যাধির সমাধান ও মানবজাতির পথপ্রাপ্তি ইসলামেই রয়েছে। তাহলে আমরা গোটা দুনিয়াকে ইসলামের খুঁটিতে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানাতে পারতাম। অন্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানাতে পারতাম- আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার ওপর গবেষণা আর পর্যবেক্ষণের। তাদের মাঝে নিয়মিত দাওয়াতি কার্যক্রম, সৌহার্দ্য বিনিময় এবং প্রতিনিধি দল প্রেরণের মাধ্যমে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করতে পারতাম। অন্যান্য সরকারের তুলনায় এটা হতো আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক কার্যকারিতার সমন্বয়। এর মাধ্যমে জাতি প্রাণশক্তি নবায়নের এবং গৌরব ও আলোকশক্তি রক্ষার সুযোগ পেত। সেইসাথে নাগরিকদের হৃদয়ে উদ্যম ও কর্মস্পৃহা জাগত এবং তাদের কার্যশক্তি প্রভাবিত হতো।
মজার ব্যাপার হলো, সমাজতন্ত্রীরা নিজেদের মতবাদের গুণকীর্তন প্রচার করে। অর্থ খরচ করে নিজ আদর্শের দিকে ডাকে। নিজেদের পথচলায় তারা জনতাকে পাশে চায়- যেন তাদের পথ উদ্দীপনাময় ও দাপুটে হয়। সমাজতন্ত্রীরা অনুসারীদের উদ্দীপনার খোরাক জোগাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। তারা চায়, সকল রাষ্ট্রব্যবস্থা তাদের সামনে নুয়ে পড়ুক।
সামাজিক ও রাজনৈতিক মতবাদগুলোর কিছু পাগলপ্রাণ সমর্থক থাকে। তারা নিজেদের ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা, লেখনীশক্তি, সম্পদ, প্রচারমাধ্যম সবকিছু এ মতবাদের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার পেছনে ব্যয় করে, যেন এ মতবাদকে কেন্দ্র করেই তাদের বাঁচা-মরা আবর্তিত হচ্ছে।
আমাদের সামনে ইসলামের দিকে আহ্বানকারী এমন কোনো রাষ্ট্রের উপস্থিতি নেই- যে রাষ্ট্রটি ইসলামের সৌন্দর্যসমূহ একত্রিত করে নিষ্কলুষ ও অবিকৃত ইসলামকে একটি আন্তর্জাতিক নীতি হিসেবে উপস্থাপন করবে এবং যার মাধ্যমে মানবতার সকল সমস্যার সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান সম্ভব হবে।
মুসলিমদের ওপর দাওয়াতি কাজ ফরজ। এটা যেমন ব্যক্তিপর্যায়ে ফরজ, ঠিক তেমনি সামষ্টিক পর্যায়েও ফরজ। অর্থাৎ, জাতিগতভাবে মুসলিমদের ওপর দাওয়াতি কাজ ফরজ। কোনো ইসলামি রাষ্ট্র গড়ে উঠার পূর্বেও দাওয়াতি কাজ ফরজ। রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পর এ কাজটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন-
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা চাই, যারা কল্যাণের দিকে মানুষকে ডাকবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। তারাই হবে সফলকাম।” সূরা আলে ইমরান: ১০৪
আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানদের অবস্থা কী? আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রায় সকলেই বিজাতীয় শিক্ষায় বড়ো হয়েছে। তারা আধিপত্যবাদীদের চিন্তার অনুগত এবং তাদের চিন্তার বৃত্তেই ঘূর্ণায়মান। আধিপত্যবাদীদের সন্তুষ্টি ছাড়া আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানরা নিশ্বাসও নিচ্ছে না।
আমরা তাদের বলেছি এবং বলছি- আপনারা স্বাধীনচেতা সিদ্ধান্ত নিন এবং আধিপত্যবাদীদের অনুকরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। এটা আপনাদের অবস্থান দুর্বল করবে না; বরং শক্তিশালী করবে। আফসোস! আমাদের কথাগুলো তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না।
আমরা বড়ো আশা-ভরসা নিয়ে মিশরের শাসকের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য! এই দাওয়াতের কোনো কার্যকর প্রভাব তৎকালীন শাসকের মাঝে পরিলক্ষিত হয়নি। যে জাতি নিজের অস্তিত্ব, বাসস্থান, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলাম খুইয়ে বসেছে, তারা কীভাবে অন্যের কাছে ইসলাম পৌঁছে দেবে? সে জাতি তো অন্যকে ইসলামের দিকে নিয়ে আসার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
প্রিয় ভাইয়েরা! বর্তমানে মুসলিম জাতি দাওয়াতি দায়িত্ব পালন করছে না। আর দাওয়াতি কাজে মনোনিবেশ না করার কারণ কী জানেন? কারণ, বর্তমান প্রজন্মের দাওয়াতি কাজে উৎসাহ ও অক্ষমতা প্রমাণিত। সুতরাং, এ দায়িত্ব নিতে হবে নতুন প্রজন্মকে।
প্রিয় তরুণ ভাইয়েরা! তোমাদের দাওয়াতি তৎপরতায় সৃজনশীলতা আনো। দাওয়াতি কাজে পরিশ্রম করো। মানুষকে নাফস ও কলবের মুক্তি শেখাও। চিন্তা ও বুদ্ধির প্রকৃত স্বাধীনতা বাতলে দাও। জিহাদ ও কর্মে স্বাধীন করে তোল। কুরআন ও ইসলামের প্রাচুর্যে সাধারণ মানুষের দ্বিধাগ্রস্ত মনকে ভরিয়ে দাও। তাদের মুহাম্মদি ফৌজে শামিল করে নাও। অচিরেই দেখবে, তাদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ মুসলিম শাসক হয়ে অবির্ভূত হয়েছে। আর সেই শাসক নিজেও জিহাদ করবে, অন্যদেরও জিহাদে উৎসাহ জোগাবে।”
অনুবাদঃ তারিক মাহমুদ