আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে আকীদার তিনটি ধারা রয়েছে। একটি হল সালাফিয়্যা, অপরটি হল আশয়ারী আর তৃতীয়টি হল মাতুরিদি। ইমাম মাতুরিদি এই ধারার ইমাম।
আবু মানসুর মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ মাতুরিদি সমরকান্দে ২৩৮ হিজরিতে সমরকন্দে জন্ম গ্রহন করেন এবং ৩৩৮ হিজরিতে মৃত্যু বরণ করেন সেই হিসেবে তিনি ১০০ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। তিনি যে স্থানে জন্মগ্রহন করেছেন সেই স্থানের সাথে সম্পর্কিত রেখে তাকে মাতুরিদি নামে ডাকা হয়ে থাকে। মাতুরিদি মাযহাবের অনুসারিগণ তাকে ‘ইমামূল হুদা’, আলামূল হুদা, ইমামূল মুতাকাল্লিমুন, রাইসু আহলুস সুন্নাহ উপাধিতে অভিহিত করে থাকেন।
ইমাম মাতুরিদি আমাদের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণঃ
চিন্তার ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা ইমাম মাতুরিদির গুরুত্ত্বকে অনুধাবন করতে পারি। আমরা যদি ইমাম মাতুরিদির পূর্বে রচিত কালামের গ্রন্থ সমূহের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, সেই সকল গ্রন্থে অনেক বিষয়কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হলেও একটি বিষয়কে কিভাবে জানব, আমরা যা জানি সেই বিষয়ে কিভাবে নিশ্চিত হতে পারি এই সকল বিষয় ছিল না। কিন্তু ইমাম মাতুরিদি ইলমূল কালামের শুরুতে এই বিষয়কে নিয়ে আসেন অর্থাৎ সর্বপ্রথম তিনি এপিসটোমলজিকে সিস্টেম্যাটিক ভাবে দাঁড় করান এবং ইলমূল কালামের শুরুতে স্থাপন করেন।
আকলী ও নাকলী উভয় জ্ঞানে গভীর জ্ঞান অর্জনকারী ইমাম মাতুরিদি; ফিকহ, তাফসীর এবং ইলমূল কালামে অনেক গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হোন এবং সকল বিষয়ে তিনি গুরুত্ত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। বিশেষ করে ইলমূল কালাম সম্পর্কে তার লিখিত গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এবং তাফসীরের ক্ষেত্রে তার লিখিত ‘তা’বিলাতু আহলু’স সুন্নাহ’ তার সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
ইমাম মাতুরিদি লিখিত গ্রন্থ সমূহঃ
ইমাম মাতুরিদি আকল এবং নাকল উভয়টিকেই দ্বীনকে শিক্ষার ক্ষেত্রে মৌলিকতাকে গঠনকারী দুইটি মৌলিক উৎস হিসেবে গ্রহন করেন। এবং এই চিন্তার মাধ্যমে তার সৃষ্ট কালামী মেথড সম্পর্কে তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন। তার মতে আকলকে কক্ষনোই অবহেলা করা যাবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা নিজে আকলী তাফাক্কুর এবং গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। এছাড়াও তিনি তাকলিদকে পরিহার করে দ্বীনকে দলীলের উপর ভিত্তি করে শেখার জন্য গুরুত্ত্বারোপ করেছেন।
কিতাবুত তাওহীদঃ
আমরা যদি কিতাবুত তাওহীদের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, এই গ্রন্থটি অধ্যায়ে বিভক্ত নয়। মূল বইয়ের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে এখানে তিনি ‘মাসাইল’ শিরোনামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আর মাসাইলসমূহের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে, এই গ্রন্থে ৩৫ টি মাসাইল রয়েছে এবং সাধারণত এগুলো গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়ের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে।
মাসাইল সমূহের পাশাপাশি এই বইকে যদি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাই যে, এই গ্রন্থটিকে মুকাদ্দিমা বা ভূমিকা ছাড়া পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত করা সম্ভব।
দ্বীনী বিষয় সমূহকে কেন আকলী ও নাকলী দলীলের ভিত্তিতে নির্ণয় করে শিক্ষা করা করা দরকার এর উপর জোর দেওয়ার পর মুকাদ্দিমাতে তিনি বাশারি (মানবিক) প্রয়োজনের জন্য জরুরী বিষয় এবং মূল্যবোধ ভিত্তিক হুকুমকে বহনকারী জ্ঞানকে অর্জন করার পন্থা নিয়ে আলোচনা করেন।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে তিনি আল্লাহর অস্তিত্ব, আল্লাহর একত্ব, তাঁর সিফাত ও ফি’ল সমূহ এবং বিশেষ করে আল্লাহর কালাম সিফাত এবং রুইয়াতুল্লাহ নিয়ে আলোচনা করেন। এই সকল বিষয়কে নিয়ে আলোচনা করার পর তিনি এই অধ্যায়ে তাওহীদের মূলনীতিকে আঘাতকারী এবং তাওহীদ বীরোধী চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে সমালোচনা করেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেন নবুয়ত নিয়ে। এখানে তিনি আকাইদের মধ্যে নবুয়তের অবস্থান, দুনিয়া ও আখেরাতে সা’দাত বা সফলতার জন্য নবুয়তের প্রয়োজনীয়তা। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর নবুয়তের প্রমান্যতা, নবুয়তের যারা বিরোধী তাঁদের বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার পাশাপাশি খ্রিষ্টানরা যে হযরত ঈসাকে ইলাহ মনে করে সেই চিন্তার অসারতা প্রমাণ করেছেন।
কিতাবুত তাওহীদের তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি, কাযা ও কাদার নিয়ে আলোচনা করেন।
কাযা হল, আল্লাহর চিরন্তননীতি। অর্থাৎ এই সৃষ্টিজগতে যা কিছু ঘটে তার সকল কিছুই লাউহে মাহফুজে রয়েছে।
আর কাদার হল সকল বিষয় ও ঘটনাকে কাযার সাথে সঙ্গতি রেখে সৃষ্টি করা বহিঃজগতে বাস্তবে পরিণত হওয়া। হিকমত ও এর বিপরীত শব্দ সাফাহ এবং আদলুন এর বিপরীত জুলুম এর মত পরিভাষা সমূহকে তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে স্থাপন করে মাতুরিদি এই অধ্যায়ে তাকদীরের বিষয়টিকে আকলী ও নাকলী দলিলের আলোকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। এবং তাকদির নিয়ে আলোচনা করার সময় তিনি কাবী সহ মুতাযিলাদের কাদরিয়া ও অন্যদের জাবরিয়া মতের যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করেন।
কিতাবুত তাওহীদের চতুর্থ অধ্যায়ে ইমাম মাতুরিদি মুরতাকিবে কাবিরা বা কবিরা গুনাহ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ে তিনি প্রথমেই গুনাহ করার ফলে মানুষের জীবনের উপর যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি এই বিষয়ে অন্যান্য মাজহাবের ইমামগণ কি বলেছেন সেগুলোকেই উল্লেখ করেন। এই অধ্যায়ে তিনি গুনার ক্ষতিকর প্রভাবের আলোচনায় তিনি প্রচুর পরিমাণে আয়াত উল্লেখ করেন এবং সেগুলোকে ব্যাখ্যা করেন।
এই ক্ষেত্রে ইমাম মাতুরিদি, কবিরা গুনাহকারী একজন মু’মিনের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে বিশ্লেষণ করে তাঁর মধ্যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পয়গাম্বরের প্রতি ও মুসলিম সমাজের প্রতি গভীর ভালোবাসাকে তুলে ধরেন। কবিরা গুনাহকারী একজন মু’মিনকেও না হারানোর জন্য এবং তাঁকে উদ্ধারের লক্ষ্যে মানুষকে কেন্দ্র করে তাঁর রহমত ভিত্তিক দালিলিক পন্থা সকল চিন্তাবিদগনেরই নজর কেড়ে থাকে।
এই ক্ষেত্রে তিনি মানুষ ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ককে হিকমতের উপর ভিত্তি করে দাঁড় করান যা উসুলুদ্দিনের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাত্রা নিয়ে আসে।
এই অধ্যায়ে তিনি শাফায়াত নিয়েও আলোচনা করেন এবং কবিরা গুনাহকারীরাও শাফায়াতের অন্তর্ভূত হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
কিতাবুত তাওহীদের পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি ঈমান ও ইসলাম নিয়ে আলোচনা করেন। ঈমানের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তাসদিক, ইকরার ও আমল এই তিনটি বিষয়কেই গুরুত্ত্বপূর্ণ বলে গন্য করেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির জন্য এই তিনটি উপাদানেরই প্রভাব রয়েছে বলে আলোচনা করেন।
কিতাবুত তাওহীদ শুধুমাত্র নাকল নয় আকলের প্রতিও গুরুত্ত্ব প্রদানকারী কালামী ধারার এবং কালামের মৌলিক বিষয়ের ব্যাপারে প্রথম গ্রন্থ সমূহের একটি।
এই গ্রন্থের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট হল, একটি বিষয়কে আলোচনা করার সময় সেই বিষয়ে নসের উল্লেখ করে সেই নসকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করা এবং এই ক্ষেত্রে মৌলিক দলীল পেশ করা।।