বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
[ইমাম আবু হানীফা তাঁর একজন ছাত্র ‘ইউসুফ বিন খালিদ আস-সামতি’ কে বসরায় পাঠানোর সময় এই উপদেশ প্রদান করেন]
সামতি, জেনে রাখো, তুমি যখন মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, ভালো সম্পর্ক না রাখবে, তখন তারা শত্রুতে রুপান্তরিত হবে। তারা তোমার বাবা মা হলেও। আর যদি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করো, তাহলে তারা তোমার আত্মীয়তে পরিণত হবে, তোমার আত্মীয় না হলেও।
ধরে নিচ্ছি, তুমি বসরায় গিয়েছো। এবং সেখানকার মানুষের সাথে বিরুদ্ধাচারণ শুরু করেছো। তারা যেসব চিন্তা করে, তার বিরুদ্ধে তুমি বলা শুরু করেছো। তুমি তাদের উপর তোমার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরা শুরু করেছো। এবং তুমি তোমার জ্ঞান দিয়ে তাদেরকে পরাভূত করার চেষ্টা করতেছো। যদি এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়,
- তাহলে তুমি তাদেরকে যতটুকু দূরে ঠেলে দিবে, তারাও তোমার থেকে ততটুকুই দূরত্ব বজায় রেখে চলবে।
- যদি তুমি তাদের নিন্দা করো, তারাও তোমার নিন্দা করবে।
- যদি তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলো, তারাও তোমাকে অনুরুপ অভিযোগ আরোপ করবে।
- তাদেরকে বিদয়াতী বললে তারাও তোমাকে বিদয়াতী বলবে।
- যদি তুমি এরকম করতে থাকো, তাহলে এটা আমাদের জন্য এবং তোমার জন্য একটা দুঃখের বিষয়।
আমি চাইনা পরবর্তীতে তাদের থেকে তুমি পালিয়ে চলে আসো। এটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ না যে, তুমি তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে পারছো না। এই অবস্থায় যদি আল্লাহ তোমার জন্য কোনো পথ উন্মুক্ত করে না দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি সমস্যায় পড়ে থাকবে।
এসব শুনে সামতি চিন্তায় পড়ে গেলেন এবং করণীয় সম্পর্কে ভাবতে লাগলেন।
তারপর আবু হানিফা তাকে বলেন, যখন তুমি বসরাতে যাবে, লোকেরা তোমাকে স্বাগত জানাবে, তোমার সাথে সাক্ষাত করতে আসবে, যখন তাদের মর্যাদা বুঝতে পারবে, তখন তাদের প্রত্যেকের অবস্থান অনুযায়ী তাদেরকে সম্মান করবে।
- সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান প্রদর্শন করো।
- যারা জ্ঞানের অধিকারী, তাদের প্রশংসা করো।
- আর যারা বয়সে বড়, তাদেরকে সম্মান করো।
- যারা যুবক, তাদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করো, তাদেরকে হাসাও।
- সাধারণ মানুষের সাথে মেশার চেষ্টা করো, তাদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করো।
- যারা পাপী, তাদের থেকে দূরে থাকো।
- ভালো মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করো।
- যেখানে যাবে, সেখানের সুলতানকে অবহেলা করো না, তাকেও বিবেচনায় নিও।
- কাউকেই ইচ্ছাকৃতভাবে নিচু মনে করো না।
- মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে কখনোই কার্পণ্য করো না।
- কারো কাছে নিজের গোপন বিষয় প্রকাশ করো না।
- কাউকে যাচাই বাছাই না করে গভীর বন্ধুত্ব করতে যেও না। নিম্নশ্রেণীর মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করো না। তাদের কারো সাথে এমনভাবে কথা বলো না, যার ফলে তারা সরাসরি তোমার বিরোধিতা করতে আসে৷
সাবধান! মুর্খদের সাথে উঠাবসা করবে না। এদের দাওয়াত গ্রহণ করো না, হাদিয়া গ্রহণ করো না, তুমি এমতাবস্থায় ধৈর্য্য ধারণ করবে। উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করবে এবং তোমার বক্ষকে উন্মুক্ত রাখবে। সুন্দর পরিস্কার ও নতুন কাপড় পরিধান করবে, বেশি বেশি সুগন্ধি ব্যবহার করবে, এবং এটার প্রসার ঘটাবে।
- তোমার মজলিসকে গুরুত্ব দিও, যাতে সবাই দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে, সহজেই তোমার কাছে আসতে পারে।
- নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করো, যাতে সবাই তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য তোমার কাছে আসে।
- মানুষের খোজ খবর নিও।
- নামাজের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।
- প্রচুর পরিমাণ খাবার খাওয়াবে। কারণ কৃপন ব্যক্তি কখনো মানুষের নেতৃত্ব দিতে পারে না।
এমন কিছু মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখো, যাদের মাধ্যমে সব ধরনের খবর নিতে পারো। যদি কোথাও ফাসাদ বা পাপাচার দেখতে পাও, সেটাকে বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করবে। কোথাও সংশোধনমূলক কাজ দেখলে সেখানে ভূমিকা রাখবে। যারা তোমার কাছে আসে, আর যারা আসে না, সবার কাছেই সফর করো। যারা ভালো ব্যবহার করে আর যারা করেনা, সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করো। ক্ষমা এবং সৎকাজের আদেশ দাও, অর্থাৎ নিজের আমল দিয়ে সৎকাজের প্রসার ঘটাও। যেসব বিষয় তোমার সাথে সম্পৃক্ত নয়, সেসব থেকে দূরে থাকো। যা তোমাকে কষ্ট দেয়, তা থেকে দূরে থাকো। তোমার উপর অর্পিত দায়িত্বকে সঠিকভাবে পালন করার চেষ্টা করো।
- যদি তোমার বন্ধুদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়, তাহলে তুমি নিজে তাদের খোজ নাও।
- যদি যেতে না পারো, তাহলে অন্তত তাদের কাছে তোমার বার্তা প্রেরণ করো।
- কেউ হারিয়ে গেলে তার খোজ নেওয়ার চেষ্টা করো।
- মানুষ যতক্ষণ তোমার কাছে আসতে চায়, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি সেখান থেকে চলে যেও না।
প্রতিবেশির সাথে ভালো সম্পর্ক রাখো। যারা তোমার কাছে আসে, তাদের সম্মান করো। যারা কষ্ট দেয়, তাদেরকে ক্ষমা করো। কেউ তোমার সাথে মন্দ ভাষায় কথা বললে, তুমি তাদের সাথে উত্তম ভাষায় জবাব দাও। সে মৃত্যুবরণ করলে তার অধিকার পূরণ করো। বেশি বেশি সালাম দাও, সে যেকোনো নিম্ন শ্রেণীর হলেও। কোনো মজলিসে বা আলোচনায় কেউ তোমার সাথে দ্বিমত করলে তুমি সাথেসাথেই তাদের বিরুদ্ধে বলতে যেও না। তারা প্রশ্ন করলে তাদের লেভেল অনুযায়ী জবাব দাও। তবে আরেকটি বিষয় এখানে খেয়াল রেখো, সেটা হচ্ছে,
- জবাব দিতে গিয়ে এটাও বলবে যে, এ বিষয়ে মতামত আছে এবং সেটার দলিল হচ্ছে এই। তাহলে তারা তোমার অবস্থান, তোমার কতটুকু যোগ্যতা, এটাও বুঝতে পারবে। এটা শুনে যদি তারা জিজ্ঞেস করে, এটা কার কথা, তাহলে তাদেরকে বলো কতিপয় ফকিহদের মতামত। (নিজেকে প্রকাশ করতে যেও না।) তাহলে তারা তোমার অবস্থান বুঝতে পারবে, তোমাকে মর্যাদা দিবে।
- যাদের সাথেই তর্কবিতর্ক বা আলোচনা করো, তাদেরকেই তোমার জ্ঞান থেকে একটু দেওয়ার চেষ্টা করো, যাতে তারা তোমার জ্ঞানের গভীরতা বুঝতে পারে। আর এটা এমনভাবে উপস্থাপন করো, যাতে তারা একটু হলেও গ্রহণ করতে পারে।
- কেবল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলোই তাদেরকে উপস্থাপন করবে, অপ্রয়োজনীয় জিনিস সামনে আনবে না। তাদের কাছে যাও, মাঝেমধ্যে ঠাট্টা মস্করা করো, খোশগল্প করো। এটা ভালোবাসার সৃষ্টি করে। এটা জ্ঞানের সম্পর্ককে ধারাবাহিকতাকে দান করে।
- মাঝেমধ্যে তাদেরকে খাবার খাওয়াও। তাদের প্রয়োজন পূরণ করো। তাদের অবস্থা জানার চেষ্টা করো।
- তাদের যেকোনো গোপন বিষয় উপেক্ষা করো, জানার চেষ্টা করো না। তাদেরকে কাছে টানার চেষ্টা করো, এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দাও।
নিজেকে কখনোই সংকীর্ণ মানসিকতা ও ক্লান্ত হিসেবে উপস্থাপন করো না। সবসময় নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করো, যাতে মানুষ মনে করে তুমি তাদেরই একজন। মানুষ তাকেই নেতা হিসেবে গ্রহণ করে, যে তাদের মতো। - তাদের উপর এমন কোনো বোঝা চাপিয়ে দিও না, যা তারা করতে সক্ষম নয়।
- তুমি যা পছন্দ করো, তাদের জন্য তাই পছন্দ করো। সবসময় ভালো ধারণা করো। সততার পথ অবলম্বন করো। তাকওয়াকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরো।
- যদি কেউ পরামর্শ করার মতো থাকে, তাহলে তার সাথে পরামর্শ করো।
তুমি যদি এই উপদেশ মেনে চলতে পারো, তাহলে আবার আমার কাছে ফিরে আসতে পারবে। এমনকি তুমি সেখানে ভালোভাবেই নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারবে।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ।