Genetically Modified Organism (GMO) বর্তমান বিশ্বে কৃষি ও খাদ্য খাতে বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। কোথাও বলা হচ্ছে হাইব্রিড খাদ্য গ্রহণ করে আমরা ধীরে ধীরে আমাদের মানবীয় বৈশিষ্ট্য ও সক্ষমতাগুলো হারাচ্ছি, দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি; কোথাও আবার বলা হচ্ছে পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে খাদ্য উৎপাদনের সুযোগ বৃদ্ধি না হওয়ায় GMO এর বিকল্প নেই ! বিগত এক দশক আগের সাথে বর্তমান সময়ে মানুষের অসুস্থতা বৃদ্ধির হার দেখলে মূলত প্রথম কথাটাকে ফেলে দেওয়া যাবে না, আবার পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখলে মনে হবে আসলেই কি তাহলে আমরা GMO ছাড়া অন্য কোন পথ খুঁজে পাব না ?
Genetically Modified Organism (GMO) নামটি শুনলেই বোঝা যায় জিনের কোন পরিবর্তন বা রূপান্তর করা হয়েছে। আসলেই তাই, এখানে জিনকে রূপান্তরিত করেই শঙ্কর জাতের নতুন জিনের আবিষ্কার করা হয়। আধুনিক বায়োটেকনোলজি পদ্ধতির মাধ্যমে একটি জিন থেকে নির্দিষ্ট বাছাইকৃত অংশ নিয়ে অন্য কোন জিনের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে নতুন একটি জিনের উদ্ভাবনের মাধ্যমেই রিকম্বিনেশন (সমন্বয়) এর কাজটি সম্পন্ন করা হয়। একটি সহজ উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হবে, আমরা যে টমেটো খাই তার আদি রূপ সবুজাভ লাল এবং অনেক ছোট । কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক অথবা কৃষিবিদদের নানাবিধ হাইব্রিড কার্যক্রমের ফলে আজ সেটি আরও বড় ও লালে পরিণত হয়েছে। জেনেটিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, বর্তমানে বাজারে পাওয়া টমেটো ও আদি টমেটো এর জেনেটিক কোডিং এ বিশাল তফাৎ! এখন একজন জিন প্রকৌশলী চাইলেন যে টমেটো আরও বেশি চকচকে করতে হবে এবং এজন্যে তিনি মাছ কে বেছে নিলেন।
তিনি গবেষণাগারে মাছের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য ধারক জিনকে কেটে (এনজাইম দিয়ে বিভক্ত করা হয় ) এনে টমেটো এর জিনে যদি রিকম্বিনেশন করতে পারেন, তবে ঐ টমেটো থেকে আসা পরবর্তী জাতগুলো আগের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল দেখাবে। এই যে মাছ থেকে সরাসরি ঐ জিন এনে টমেটো এর জিনে ঢুকিয়ে দেওয়া, এটিই জিন রিকম্বিনেশন আর এই জিন রিকম্বিনেশন-ই GMO এর একটি প্রক্রিয়া। বাহ্যিকভাবে এটি খুবই আকর্ষণীয় একটি বিষয়। এ কাজটিই বর্তমান প্রযুক্তির মাধ্যমে করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। আজ এই রিকম্বিনেশন-এর প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল হলেও সম্ভব, একটা সময় আসবে এর খরচ কমবে এবং সবাই অহরহ এই কাজটি করতে সক্ষম হবে। তবে এই বিষয়টি কেন এত ঘোলাটে ? কেনই বা কিছু মানুষ এর পক্ষে আর অধিকাংশ মানুষ এর বিপক্ষে? কেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এত আন্দোলন চলছে এটি নিয়ে ? এবার তাহলে এ বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।
প্রথমত, GMO এর পক্ষে যারা বলছেন তাদের বড় একটি যুক্তি হচ্ছে, পৃথিবীর জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে কিন্তু আবাদি জমির পরিমাণ সেই অনুপাতে বাড়ছে না, বরং অধিক মানুষের বসবাসের জন্যে তা আরও কমে আসছে। এজন্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। প্রাচীন প্রজনন পদ্ধতিগুলো ব্যবহারের কারণে স্বল্প জমিতে অধিক ফলন পাওয়া অসম্ভব প্রায়। কিন্তু আধুনিক চাষাবাদের পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে অল্প জমিতে/ জমি ছাড়াই ফসল ফলানো সম্ভব। এছাড়া চাহিদামতো ফলনের জন্যে আধুনিক প্রজনন পদ্ধতির বিকল্প নেই। এ কারণে তারা আধুনিক প্রজনন পদ্ধতিগুলোর মধ্যে GMO এর প্রচলন ঘটানোর চেষ্টায় ব্রত রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে বিষয়টি আসলেই যৌক্তিক এবং একজন কৃষিবিদের জন্যে এটি খুবই বাস্তবসম্মত একটি চিন্তা বলে মনে হবে।
উচ্চফলনে সহায়ক জিনগুলো যদি সকল ফসলের ভিতরেই ঢুকিয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায় আর সেই সাথে জিনগুলোতে যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকে, তাহলে তো কোন কথাই থাকে না। কিন্তু হ্যাঁ, এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যে থাকবে না, এই নিশ্চয়তা কি কেউ দিতে পারবে? জিন প্রতিস্থাপনের পদ্ধতিগুলো কৃষিক্ষেত্রে খুব একটা পুরনো নয়। খুব একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় পদ্ধতিগুলো ব্যাবহারের মাঝে ১০০% সফলতা পাওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। সেই সাথে যদি জিন রিকম্বিনেশনের সময় অনিচ্ছাকৃত জিনগুলো ডিএনএ তে ঢুকে যায় আর সেগুলো যদি মানব/পশু শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, তাহলে? পশুর শরীরে গেলে সে পশুর গোশত ভক্ষনের মাধ্যমে সেই ক্ষতিকর প্রভাব মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, ঠিক যে কারণে আমরা হরমোন দিয়ে ফুলানো গরু/মুরগি খেতে চাই না। যদি জিন রিকম্বিনেশনের সময় নিশ্চয়তা দেওয়া যায় যে যেটুকু জিন কেটে অন্য ডিএনএ তে দেওয়া হবে সেটুকুর বাইরে অন্য কোন জিন ঢুকতে পারবে না, তাহলে বলা যাবে যে বিষয়টি নির্ভরযোগ্য।
এখন এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন আমাদের মাথায় কাজ করতে পারে, এই যে বায়োটেকনোলজির কাজগুলো করে এই সফল জিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হবে, এটি কারা করবে? মূলত যত বিরোধিতা সবকিছুর শুরু এখানেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে যত GMO বিরোধী আন্দোলন ঘটছে তার মূল কারণ হল এই কাজগুলো কারা করছে তার উপর। আমরা জানি যে, বিশ্বের খাদ্য ও ঔষধ সেক্টর মূলত একই কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থাৎ যেসকল কোম্পানিগুলো ঔষধ উৎপাদন করে, তারাই আবার বীজ উৎপাদন করে বিশ্বে বিক্রি করে বেড়াচ্ছে। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, এ দুটির মাঝে যোগসূত্র কি! বিষয়টি একটু পরেই আরও পরিস্কারভাবে বোঝা যাবে।
প্রথমত ভাবার বিষয় যেটি, আসলেই কি মানুষ বাড়ার সাথে সাথে কৃষিজমির পরিমাণ কমে আসছে? শুধু খাদ্য উৎপাদনের অভাবেই কি পৃথিবীতে এত এত মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে? নাকি পৃথিবীর সকলের জন্যে প্রয়োজনীয় খাবারের উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মানুষের কাছে আরও বেশি নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো হচ্ছে ? জাতিসংঘ কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এর মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৯৯০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের খাবার কোন না কোন ভাবে নষ্ট হচ্ছে, যা দিয়ে কিনা মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশকে খাওয়ানো সম্ভব। এর শতকরা ৬৮ শতাংশ শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকেই হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, খাদ্যের যদি সুষম বণ্টন থাকত, তাহলে এই কৃত্রিম সংকট কোনভাবেই হালে পানি পেত না। একদিকে খাদ্যের সুষম বণ্টনের অভাব, আরেকদিকে কৃত্রিম সংকট; এদুটি বিষয় সমন্বয় করেই মূলত জায়নবাদী গোষ্ঠী তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
আরেকটি বিষয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বিশ্বে বীজ নিয়ে যারা কাজ করছে সেগুলো সবই জায়নবাদী কোম্পানি। বীজ নিয়ে বড় গবেষণা করার জন্যে যে পরিমাণ মূলধন/ক্ষেত্র দরকার সেগুলো সাধারণ কোন কোম্পানিগুলোর পক্ষে থাকা সম্ভব না। বড় জায়নবাদী কোম্পানিগুলো নিজস্ব ল্যাবরেটরিতে এসব নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পায় আর তারা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুরো বিশ্ব নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তাদের অনুমতি ছাড়া কোন দেশ/বিশ্ববিদ্যালয়/প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নিজে থেকে কিছু করা অসম্ভব। এসব কোম্পানি নিজেরা অধিক উৎপাদনশীল বীজ বের করছে কিন্তু কিভাবে তা করছে সেগুলো কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তারা এমন বীজ বের করছে যেগুলো থেকে প্রাপ্ত ফল মানুষের জন্যে ক্ষতিকর হবে, নানা রোগ সৃষ্টি করবে। আবার সেসব রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ যখন ঔষধ খুঁজবে তখন তারা নিজেদের তৈরি ঔষধ বিক্রি করবে। বিষয়টি অনেকটা ‘সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়া’।
তারা বীজ বিক্রি করে লাভ করবে আবার এদিকে ঔষধ বিক্রি করেও লাভ করবে। এদিকে ক্রমাগত মানববিধ্বংসী GMO এর মাধ্যমে উৎপাদিত খাবার খেয়ে মানুষ তার নিজস্ব স্বকীয়তাও ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলবে। পৃথিবীতে বিকলাঙ্গ মানুষের হার বৃদ্ধির অন্যতম একটি উদাহরণ এটি। মূলত এসব কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে GMO এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে পরিবেশ সচেতন গোষ্ঠীরা। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২৬ টি দেশে GMO সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে । কিছু দেশে উৎপাদন নিষিদ্ধ করলেও আমদানি বহাল রেখেছে। আমেরিকা, ব্রাজিল, ইন্ডিয়া সহ কৃষিক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখা বেশির ভাগ দেশগুলোতে GMO বহাল রয়েছে।
GMO বলতেই যে খারাপ কিছু, বিষয়টিকে এভাবে ভাবা ঠিক নয়, পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিসই আছে যেগুলো দিয়ে ভালো খারাপ ২ ধরণের কাজ-ই করা যায়। রসায়ন যেমন অনেকের জন্যে মরণব্যাধি রোগ থেকে আরোগ্য লাভের ঔষধের আবিষ্কারক হিসেবে আবশ্যক, তেমনি এই রসায়ন দিয়েই মরণঘাতী বোমা বানানোও সম্ভব। এখানে দেখার বিষয় একটাই যে, রসায়ন কাদের দ্বারা বিকশিত হচ্ছে। তেমনি সময়ের সাথে সাথে কৃষিবিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতা কাদের দ্বারা বিকশিত হচ্ছে এবং তাদের উদ্দেশ্যই বা কি, সেটি না জানলে মানবজাতির ভবিষ্যৎ দিনকে দিন আরও হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তাই সময় হল এখন মানববিধ্বংসী এসব চক্রান্তের ব্যাপারে সচেতন হওয়ার, না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দর একটি পৃথিবীতে রেখে যাওয়া আমাদের পক্ষে আরও কঠিন হয়ে পড়বে।