সৃষ্টিগতভাবে প্রতিটি মানুষের ইজ্জত এবং মর্যাদা নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কারণ মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সম্মানিত করে। তাই আমরা আমাদের বর্তমান দুনিয়াকে পরিবর্তন করে এমন একটা নতুন দুনিয়া বিনির্মাণ করতে চাই, যে দুনিয়ায় মানুষ ইজ্জতের সাথে বসবাস করতে সক্ষম হবে। মহান আল্লাহ মুসলিম হিসেবে আমাদেরকেই এ দায়িত্ব দিয়েছেন, একই সাথে যুবক বা তরুন হিসেবে আগামী দিনের মুসলিম উম্মাহর কর্ণধার আমরা। এজন্য আমাদের জন্য নতুন দুনিয়া বিনির্মানের এ দায়িত্ব পালন এক অর্থে ফরজ। আমরা যদি এই দুনিয়াকে পরিবর্তন করতে চাই তাহলে প্রথমে আমাদেরকে বর্তমান দুনিয়া সম্পর্কে জানতে হবে। বলা হয়, বর্তমানে আমরা পোস্ট কলোনিয়াল যুগে বসবাস করছি। সত্যি কি আমরা পোস্ট কলোনিয়াল যুগে বসবাস করছি নাকি আমরা যে শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদের যাঁতাকলে ছিলাম সেখানেই এখনও আমরা পড়ে আছি? এ বিষয়টি আগে আমাদেরকে খুব ভালোভাবে জানতে হবে।
প্রথম কথা হচ্ছে এই শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদ এ বিষয়টি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এ বিষয়টি কেন আমাদেরকে খুব ভালোভাবে বুঝা উচিত? আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, মুসলিম উম্মাহ তিনবার সবচেয়ে বড় হুমকির সম্মুখীন হয় এবং দখলে নিপতিত হয়।
প্রথমবার হল; ক্রুসেডারদের আক্রমন। যে আক্রমণের ফলে বায়তুল মাকদিস বা সমগ্র আকসা সাম্রাজ্যবাদী অর্থাৎ ক্রুসেডারদের বা ইউরোপিয়ানদের দখলে চলে যায়।
দ্বিতীয়বার হল; মোঙ্গলদের আক্রমণ। যে আক্রমণের মাধ্যমে আমাদের আব্বাসি খেলাফতের আনুষ্ঠানিকভাবে পতন ঘটে অর্থাৎ বাগদাদের পতনের মধ্য দিয়ে। যদিও মোঙ্গলরা মামলুকীদের কাছে আইন জালুতের যুদ্ধে পরাজয় বরণ করার পর ধীরে ধীরে তাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম ইসলাম গ্রহণ করে। তারা পরবর্তীতে ইসলামের সেবক হয়ে যায়।
তৃতীয় আক্রমণটি হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী কলোনিয়ালিস্ট বা এই শোষকদের আক্রমণ। আর এই আক্রমণের ফলে মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত,নিপীড়িত এবং নির্যাতিত হয়েছি আমরা অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা। বিশেষভাবে বাংলা অঞ্চলের মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত-নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে এবং আজ অবধি আমরা তাদের সেই শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত। এখন প্রশ্ন থাকতে পারে ব্রিটিশরা তো চলে গেছে সেই ৪৭ এ। তাহলে আমরা এখনো কিভাবে তাদের কলোনি? এজন্যই প্রবন্ধের নামকরণ করা হয়েছে শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদ অনতিবাহিত এক অতীত। আমরা একে আজ অতীত হিসেবে আখ্যায়িত করলাম এটা মোটেও আমাদের জন্য অতীত নয় আজকের আলোচনা থেকে আশা করি এটি আমাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে প্রতিপাদন হবে।
সূরা আনফালের ৪২ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন;
وَلَٰكِن لِّيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا لِّيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَن بَيِّنَةٍ وَيَحْيَىٰ مَنْ حَيَّ عَن بَيِّنَةٍ ۗ وَإِنَّ اللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ
এটি বদরের যুদ্ধ সংক্রান্ত একটি আয়াত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা আগেই নিয়েছিলেন অর্থাৎ যারা টিকে থাকবে যারা বেঁচে থাকবে যাতে সুস্পষ্ট দলিল এবং প্রমাণ এর ভিত্তিতে বেঁচে থাকে। আবার যারা ধ্বংস হবে তারাও যাতে সুস্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে ধ্বংস হয়। এজন্য আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে, আমরা আসলে কিসের উপর ভিত্তি করে আমাদের জীবনকে পরিচালনা করব আমাদের আন্দোলনকে পরিচালনা করব?
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর উত্তরসূরী হিসেবে, হযরত মুসা এবং হারুন আলাইহি সালামের উত্তরসূরী হিসেবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু, আলী (রা), ফাতেমা, আসিয়া, সুলতান ফাতিহ, ইকবালের উত্তরসূরী হিসেবে আমরা আসলে কিসের উপর ভিত্তি করে আমাদের চিন্তা এবং দর্শনকে এবং আমাদের জীবনকে পরিচালনা করব, এমনকি এর ভিত্তিতে একটি নতুন দুনিয়া গড়বো?
আমরা যদি শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, এই শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদ ষোড়শ শতাব্দী থেকে অর্থাৎ ১৫০০ সাল থেকে নিয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীর বা মানব সভ্যতার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাৎ এটাকে আমরা গত ৫০০ বছর ধরে সমগ্র পৃথিবীর ভাগ্যাকাশে একটা কালো মেঘ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। একইভাবে এটাকে আমরা দুনিয়ার ইতিহাসের একটি নতুন মাত্রা বলতে পারি।
ইতিপূর্বে বলেছি আমরা মুসলমানরা তিনবার সবচেয়ে বড় আক্রমণের শিকার হয়েছি, কিন্তু এর কোনটি সাম্রাজ্যবাদীদের মত এত সর্বগ্রাসী, সর্বব্যাপী ছিল না এবং এত স্থায়ী ছিল না। এ আক্রমণ আমাদের উপর যেভাবে এসেছে। তবে এ ৫০০ বছরের পুরো সময়ে এক না। অর্থাৎ এই ৫০০ বছরকে আমরা সমান্তরালভাবে বিচার করতে পারি না। শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদ হল, দুনিয়ার ইতিহাসের সর্বশেষ পাঁচশত বছরের ভাগ্যকে নিরূপণকারী একটি পর্যায়। অর্থাৎ দুনিয়ার ইতিহাসের একটি মাত্রা। তবে এর রূপ এক এক শতাব্দীতে এক এক রকম। একেক অঞ্চলে এর রঙ একেক রকম। যেমন মধ্য এশিয়াতে একরকম, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকাতে একরকম, উপমহাদেশে এক রকম। একই ভাবে উত্তর ও দক্ষিন অ্যামেরিকার ক্ষেত্রেও ভিন্ন।
আমরা যদি সাম্রাজ্যবাদকে বুঝতে চাই তাহলে আমাদেরকে এই ৫০০ বছর অর্থাৎ কলম্বাসের তথাকথিত আমেরিকার আবিষ্কার দিয়ে শুরু হওয়া যে শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদ এটাকে অঞ্চলভিত্তিক, সময় ভিত্তিক, এমনকি ব্যক্তি ভিত্তিক বিভাজিত করে পড়তে হবে।
যেমন এটা মধ্য এশিয়াতে একরকম অর্থাৎ রাশিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত যে সাম্রাজ্যবাদ সেটা একরকম। আবার উত্তর আফ্রিকা এবং মিশরে ফ্রান্সের মাধ্যমে পরিচালিত সেটা একরকম। ভারতের হিন্দুস্তান তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এক রকম আবার উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার ক্ষেত্রে এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই এই ভিন্নতাকে আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে।
তবে এদের একটি অভিন্ন বিষয় আছে। এদের মধ্যে অভিন্ন বিষয় হল, এর মাধ্যমে যদি আমরা সাম্রাজ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে চাই তবে তা হলো, “বৈদেশিক সংখ্যালঘু কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছা ও অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাঁদের যা কিছু আছে সেগুলোকে নিজেদেরকে স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা এবং এই সিস্টেম বা ব্যবস্থার মাধ্যমে তাঁদের সম্পদকে- সে দেশের সকল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (যেমন: সে দেশের বিভিন্ন মিলসগুলো) লুণ্ঠন করে, সে দেশের সকল সম্পদকে কুক্ষিগত করে তাঁদের কেন্দ্রীয় দেশে (যেমন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেন্দ্র ছিল লন্ডন, একইভাবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেন্দ্র ছিল নেদারল্যান্ডস) প্রেরন করা।”
একই সাথে ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী একদল মানুষকে তারা এ শোষণের অংশীদার বানাত। শুধু তাই নয় এই গোষ্ঠীকে তারা একটা নাম দিত। এটা অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হতো যাকে আমরা এলিট গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। আমাদের ক্ষেত্রে এটা ছিল আমাদের আমাদের দেশের জমিদাররা। এ গোষ্ঠীকে এলিট গোষ্ঠী নামে নামকরণ করে তাঁদেরকে স্বেচ্ছাসেবী বানানো। যারা একটা স্বার্থের জন্য শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষ হয়ে কাজ করতো। তাদের (শোষক) সাথে মিলে তাদের নিজেদের দেশকে মানুষকে শোষণের জন্য শোষকদের পক্ষ নিয়ে কাজ করতো। এভাবে আমরা শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদ কে সংজ্ঞায়িত করতে পারি।
শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদ যেন স্তিমিত হয়ে না যায় এক্ষেত্রে তারা এক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করে। যার মাধ্যমে এমন একটা শ্রেণি বা এমন একটা গোষ্ঠী তারা তৈরি করে যাতে করে এর মাধ্যমে যে শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে উঠবে তারা তাদের সেবক হিসেবে কাজ করতে পারে। তাদের মেকানিজমের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তাদের পরিচালিত, তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা- যা এখনো আমাদের দেশসহ আমাদের সকল অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত আছে। মূলত এটি তাদের কমন (অভিন্ন) একটি বৈশিষ্ট্য।
আমরা যদি শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা না করি তাহলে এটা বলতে কী বুঝায় এই বিষয়টাকে সঠিকভাবে মোটেই বোঝা সম্ভব হবে না।
এটা আমাদের পূর্ববর্তী যেসব আক্রমণকারী; ক্রুসেডার এবং মোঙ্গলদের আক্রমণের চাইতে সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোঙ্গলদের আক্রমণের সময় আমরা দেখেছি তারা এসেছে, বাগদাদকে আক্রমণ করেছে বাগদাদের সকল লাইব্রেরীগুলোকে পুড়িয়ে দিয়েছে গণহত্যা চালিয়েছে এবং হয় তারা চলে গেছে না হয় সেখানের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা কর্তৃক ওখানের প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির মধ্যে নিজেরা বিলীন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শোষকদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা হয়নি। এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই, স্থায়ীভাবে ও পদ্ধতিগতভাবে একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তৈরি করে সেটার আলোকে তাদের সমগ্র কালকে পরিচালিত করে যা এখনো জারি রয়েছে। যেমন এখন আমাদের যে ওয়ার্ল্ড ভিউ এটা ব্রিটেনের দেওয়া। আমাদের জাস্টিস বা বিচার ব্যবস্থা হল ব্রিটিশদের বিচার ব্যবস্থা। আমাদের অর্থনীতি সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তাহলে কিভাবে আমরা এই শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি পাবো?
শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম তা হলো, স্থায়ী ও পদ্ধতিগতভাবে একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে সেটার আলোকে তারা যেসকল অঞ্চলকে শোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্র ভূমিতে পরিণত করেছিল সেটাকে তারা পরিচালনা করেছে। এর আবার ভিন্ন ভিন্ন পন্থাও আছে। যেমন উত্তর অ্যামেরিকা। সেখানে পশ্চিম ইউরোপীয়রা যাওয়ার পরে সেখানে বসবাসকারি প্রায় সকলকেই হত্যা করে। তারা কেন সেখানে তাঁদেরকে হত্যা করে? এর অন্যতম কারন হল সেখানের অধিবাসীরা যাযাবর হিসেবে বসবাস করত। অর্থাৎ মাটির সাথে তাঁদের মালিকানার সম্পর্ক ছিল না। মালিকানা সত্তকে গ্রহণ না করে যাযাবর একটা জীবন তারা যাপন করত। ইউরোপীয়রা দেখল, এদেরকে আমরা গোলাম বানাতে পারবো না। যার ফলে তাঁদেরকে গোলাম বানিয়ে হালচাষ করাতে পারত না। এই কারণে তাঁদের সামনে একটি মাত্র পথই খোলা ছিল সেটা হল হত্যা করে তাঁদেরকে শেষ করে দেওয়া। সকল রেড ইন্ডিয়ানকে তারা হত্যা করে। আবার ওই অঞ্চলকে আবাদ করার জন্য নিজেদের শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার জন্য আফ্রিকা থেকে মানুষদেরকে ধরে নিয়ে এসে দাস বানিয়েছে। তাই বলা হয়েছিল তাদের চিত্র এবং ৪০০ বছরের যে সাম্রাজ্যবাদ এর মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। এটা অঞ্চল ভেদে, দেশ ভেদে, সময় ভেদে।
আবার আলজেরিয়াতে ফরাসিরা আসার সাথে সাথে দেখতে পায় এখানে একটি শক্তিশালী সভ্যতা সংস্কৃতি আছে এখানে তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে এখানে তাদের ভাষা কে বদলে দেয়ার চেষ্টা করেছে তাদের জীবনধারাকে বদলে দেয়ার চেষ্টা করেছে আর অন্যান্য অনেক পন্থাই এখানে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।এটা কেননা সেখানে বসবাসকারি মানুষের স্থায়ী একটি জীবন ধারা ছিল। এই কারণে সেখানে ভিন্ন পন্থা অবলম্ববন করে।
আমার আলোচনার যে বিষয়বস্তু , সেটাকে আমরা উপনিবেশবাদ বলতে পারতাম। এটা না বলে আমরা কেন সাম্রাজ্যবাদ বলে আখ্যায়িত করলাম? শোষকদের কে ইংরেজিতে বলা হয় exploiters. কিন্তু কোথাও ব্রিটিশদেরকে এক্সপ্লোয়েটের হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়নি। আখ্যায়িত করা হয়েছে কলোনাইজার হিসেবে।
আমাদের বই পুস্তকে বা তারা উপনিবেশবাদ বলতে যেটা বুঝায় –
উপনিবেশবাদ বা কলোনাইজেশনের সাথে কলোনি বা উপনিবেশ বানানোর একটি সম্পর্ক রয়েছে।
কলোনি বা উপনিবেশ বানানোর অর্থ হল, সাধারণ কোন একটি জনগোষ্ঠী কর্তৃক বসবাসকৃত একটি অঞ্চল থেকে অন্য একটি অঞ্চলে সেখানে বসতি স্থাপন করা। এবং সেখানে অবস্থা বুঝে তাদের নিজেদের কল্যাণে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা। এটা হল উপনিবেশবাদের মূল অর্থ। এই দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে কলোনাইজেশন বা উপনিবেশবাদ খুব বেশী নেতিবাচক কোন কিছু নয়। যেমন তোরা নিজেদের স্বার্থে ইন্ডিয়াতে এসেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বানিয়েছে এবং ব্যবসা বাণিজ্য করেছে। কিন্তু কেন আমরা তাদেরকে শোষক বলছি? আমরা কেন তাদেরকে সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করছি? এটা মূলত কলোনাইজার বা উপনিবেশের এটা মৌলিক সংজ্ঞা।
তারা আমাদের সাথে সবসময় খেলতে আসে ভাষা এবং পরিভাষা দিয়ে। আমরা মুসলমানরা খুব কম তাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছি। আমরা যেখানে সবচেয়ে বেশি পরাজিত , সেটা হচ্ছে কুটনীতির টেবিলে। যার কারণে কলোনাইজেশন এর মত গণহত্যার ইতিহাসকে খুব স্বাভাবিকভাবে তারা সংজ্ঞায়িত করতে পেরেছে। আমাদের জিহাদ আমাদের শরীয়তকে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে।
এই দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদ হল উপনিবেশবাদের নামে পশ্চিম ইউরোপের সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়। এই কারণে পূর্বের যে কোন কলোনাইজেশনের চেয়ে এটা ভিন্ন। কলোনাইজেশন কিন্তু অতীতেও হয়েছে কিন্তু এটা একেবারেই ভিন্ন। যেমন ইতিপূর্বেও রোম অনেক দেশে দখল করেছে এবং শাসন করেছে। ফনেশিয়া ও গ্রীকদের অনেক কলোনি ছিল। কিন্তু বর্তমান যে কলোনাইজেশন এটা অতীতের রোম, ফনেসিয়া বা গ্রীকদের Colonization এর চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়। এটা পূর্বের এই সকল কলোনির চেয়ে ভিন্ন।
এই ভিন্নতা বুঝার জন্য আমাদেরকে বুঝতে হবে মডার্ন ইউরোপের মূলে কি রয়েছে? মডার্ন ইউরোপীয়দের সৃষ্টিজগতের সাথে সম্পর্ক, এবং আশেপাশের অন্যান্য মানুষের সাথে তাঁদের তৈরিকৃত সম্পর্ক ও মহাবিশ্বের সাথে তাদের সম্পর্ক, এই সম্পর্কের স্বরূপ সম্পর্কে জানতে হবে।
এখন এই মডার্ন ইউরোপের মূলে কি রয়েছে?
যারা সমগ্র পৃথিবীকে নির্যাতন, লুণ্ঠন, শোষণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করছে না এদের মূল বিষয়টা কি? বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিচে’ এই বিষয়কে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায়, মডার্নিটির মূল হল Will to Power অর্থাৎ তাহাক্কুমের ইরাদা। প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তারের ইচ্ছাকে মর্ডান ইউরোপের ভাষায় বলা হয়, উইল টু পাওয়ার।
এর মূল কথা হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের মূল কারন হল শক্তি সঞ্চয় করা এবং সঞ্চয়কৃত শক্তির মাধ্যমে তাঁর আশে পাশে যা কিছু আছে সেগুলোর উপর তাহাক্কুম বা আধিপত্য কায়েম করা, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা ও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা। এজন্য বর্তমানে তাদের যে ফিজিক্সের ধারণা, তা হলো- প্রকৃতপক্ষে আমি কিভাবে আমার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে উপকৃত হতে পারি বা নিজের স্বার্থকে হাসিল করতে পারব। এর ব্যাকগ্রাউন্ডে যদি আমরা এক ধাপ পেছনে যাই তাহলে দেখতে পাই, দেকার্তের কার্টেসিয়ান থট সেখানে আছে Cogito Ergusum বা I am there, because I am thinking- আমি চিন্তা করি বলেই আমি আছি এ কথার পেছনেও will to power এই বিষয়টি লুকায়িত।
আমরা যদি আরও এক ধাপ পেছনে যাই খ্রিস্টান যে ধর্মতত্ত্ব এর মধ্যেও এ বিষয়টি আমরা খুঁজে পাই। সেটা হল খ্রিস্টান ধর্মের ইতিহাসে দেখতে পাব যে, হযরত ঈসার পরে খ্রিস্টান ধর্ম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো পাউলস। খ্রিষ্টান ধর্মে হযরত ঈসার পরে পাউলস কর্তৃক তৈরিকৃত পরিভাষার মধ্যে একটি হল “অন্যরা”। এই অন্যরা বা আদার্স হল ইয়াহুদীরা। খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্বে এমন একটি চিন্তা আছে, যা পাউলসের চিন্তাকে সামারাইজ করে পাই; হযরত ঈসা যখন ফিরে আসবে তখন যারা তাঁকে স্রষ্টা হিসেবে গ্রহন করবে তারা চিরস্থায়ী জীবন পাবে আর যারা গ্রহণ করবে না তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
এর অর্থ কী?
এর অর্থ হল যারা খ্রিষ্টান না তাঁদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। যার ফলে বেঁচে থাকার পূর্ব শর্ত হল, চার্চের অনুগত হওয়া।
পরবর্তীতে আসে পঞ্চম শতাব্দীতে Augustine এর চিন্তা-ধারা, তিনিও খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিকদের একজন। তিনি এই চিন্তা বা আদার্স বিষয়টাকে এমন ভিত্তির উপর দাঁড় করান যা পরবর্তীতে Inquisition ও ক্রুসেডের জন্ম দেয়। মর্ডান ইউরোপীয় যে স্টেট, এর রূহের মধ্যে কিভাবে সাম্রাজ্য এবং শোষণ গেঁথে আছে এটাকে যদি বুঝতে চাই তাহলে আমাদেরকে এক ধাপ পেছনে, রেনে দেকার্তের কার্তেসিয়ান থট বুঝতে হবে। এরপর এক ধাপ পেছনে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের কাছে যেতে হবে। তাহলে কেন সাম্রাজ্যবাদ হত্যাযজ্ঞ চালাবে, সবাইকে তার নিজের কাজে ব্যবহার করবে- এর কারণও আমরা খুঁজে পাই। পরবর্তীতে এই চিন্তা ক্যাথলিক চার্চের মূল দর্শন হিসেবে জারি থাকে।
এখন খ্রিস্টানদের আদার্স হিসেবে পরিবর্তিত হয়েছে ইহুদীদের পরিবর্তে মুসলমানরা। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের ক্রুসেডগুলো বারবার মুসলমানদের জিহাদি প্রেরণা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শক্তি এবং আকলের শক্তির কাছে পরাজিত হয়। ফলে একপর্যায়ে তারা হতাশ হয়ে যায়। কিন্তু তারা একটা জায়গায় আশা পায় তা হল আন্দালুসিয়ার গ্রানাডা পতনের মাধ্যমে। অর্থাৎ ১৪৯২ সালে তারা নতুন করে আশা খুঁজে পায় এবং তারা বলতে শুরু করে যে আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে যেহেতু তাড়াতে পেরেছি তাহলে মুসলমানদেরকে সমগ্র পৃথিবী থেকেও তাড়িয়ে দিতে পারব।
এই মন্ত্র সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর প্রথম পদক্ষেপ হলো ক্রিস্টোফার কলম্বাস। সে মূলত আমেরিকা আবিষ্কার করতে যায় নাই। কারণ আমেরিকার সাথে দুনিয়ার সীমা আছে। মূলত ক্রিস্টফার কলম্বাস যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অর্থনৈতিক শক্তি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেনাবাহিনী আনার জন্য। এই লক্ষ্যেই মূলত কলম্বাস সহ অন্যরা অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সৈন্য সংগ্রহের জন্য। এ উদ্দেশ্যে সে তথাকথিত আবিষ্কারের নেশায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই তথাকথিত আবিষ্কারের নামে তারা যেখানেই গিয়েছে সেখানেই মানুষকে খ্রিষ্টান বানিয়েছে ও তাঁদের সম্পদকে লুণ্ঠন করেছে আর না হয় তাঁদেরকে হত্যা করেছে।
এই কারণে খ্রিষ্টান ধর্মের মূলতত্ত্ব ও কার্টেসিয়ান চিন্তার মাধ্যমে সামগ্রিকতা লাভকারী এই চিন্তাকে বিবেচনা করা ছাড়া এবং এই অর্থে সেক্যুলার চিন্তাকে উপলব্ধি করা ছাড়া পশ্চিম ইউরোপীয়রা কিভাবে মানবতার ইতিহাসে শুধুমাত্র নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র একটি তাহাক্কুমের ফরম বা নিপীড়ন মূলক ব্যবস্থা হিসেবে শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদকে গঠন করেছে সেটাকে বুঝতে পারব না।
সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে ‘অন্যরা’ অর্থাৎ যারা খ্রিষ্টান নয় তাঁদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। এই চিন্তাকে খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ব থেকে বের করে এনে সেক্যুলারাইজডকারী এবং বিশেষ করে থমাস হবের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রের আদর্শে পরনিতকারী এবং সেই রাষ্ট্রের জন্য সকল প্রকার পন্থাকে গ্রহণ করাকে বৈধতা দানকারী একটি চিন্তা হিসেবে বুঝলে তাঁদের শোষণ ও সাম্রাজ্যের মূলমন্ত্রকে বুঝতে পারব।
সাম্রাজ্যবাদীরা এসব অঞ্চল বা দেশসমূহ কে লুণ্ঠন করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। এখানে আমরা বলেছি যে, সাম্রাজ্যবাদী ও শোষকরা বা এই সকল দেশ সমূহ একেক সময় একেক পন্থাকে গ্রহণ করে। কখনোবা মিশনারী কার্যক্রম, কখনো ব্যবসা আবার কখনোবা শিক্ষাকে ব্যবহার করে থাকে। কখনো সেনাবাহিনী, আবার কখনোবা বিভিন্ন চুক্তিকে ব্যবহার করে থাকে। এর জন্য এর বিভিন্ন পন্থা রয়েছে। কখন কোনটা ব্যবহার করবে সেটা তারা অবস্থা বুঝে সিন্ধান্ত নিয়ে থাকে।
যেমন থমাস ম্যালথুস, যিনি ছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ। An Essay on the Principle of Population নামক বইয়ে তিনি বলেছেন, জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে, সম্পদ বা খাদ্য বাড়ে গাণিতিক হারে। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির অন্যতম একজন কর্মকর্তা। তিনি কেবল কর্মকর্তা ছিলেন না তিনি সেই সময় ইন্ডিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছিলেন। যেমন জন স্টুয়ার্ট মিল তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম একজন শেয়ার হোল্ডার ছিলেন।
থমাস হবস এর রাষ্ট্রের যে মূল আদর্শ তার মৌলিক পরিভাষা হচ্ছে পার্সোনালিটি। পার্সোনালিটি শব্দটি দিয়ে আমরা কর্মক্ষম ও যোগ্য, ব্যক্তিত্ত্ববান একজন মানুষকে জানি, কিন্তু তিনি এটাকে আরও বিস্তৃত করেন। তিনি বলেন, একটি জনগোষ্ঠীও যদি একসাথে কাজ করার চুক্তি করে ও সমবায়ের ভিত্তিতে কাজ করে তাহলে তারাও একটি ফা’য়িল (কর্মক্ষম) হিসেবে গৃহীত হবে। তারাও কোন স্বার্থকে সামনে রেখে এক সাথে কাজের মাধ্যমে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। তার এই পার্সোনালিটি আর ইসলামী সভ্যতায় মুরুয়াত বা ব্যক্তিত্ব এর মাঝে সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে।
এটা বিস্তারিত জানতে হলে ইমাম মাওয়ারদির আদাবুদ্দিন ওয়াদ দুনিয়া গ্রন্থে মুরুয়াত নামে একটি অধ্যায় আছে, সেটি পড়তে হবে। এক হাকিমকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে ‘আকল’ এবং ‘মুরুয়াতে’র মধ্যে পার্থক্য কী? তখন তিনি জবাব দিয়েছেন, আকল হচ্ছে সবচেয়ে উপকারী যে কাজ সে কাজটা করা, আর মুরুয়াত হচ্ছে কোন কাজকে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে করা।
আমরা সবচেয়ে বেশি লুন্ঠিত নির্যাতিত হয়েছি যাদের মাধ্যমে, তাদের ক্ষেত্রে যদি দেখি, তারা হচ্ছে ব্রিটিশ aristrocat। ইংল্যান্ডের দুইটি পার্লামেন্ট রয়েছে। একটি হচ্ছে সাধারণ পার্লামেন্ট আরেকটা হচ্ছে হাউজ অফ লর্ডস অফ দা ইউনাইটেড কিংডম যা এরিস্টোক্র্যাটের। আর এটাই হল মূল পার্লামেন্ট। হাউজ অব লর্ডসের সদস্যসংখ্যা ৭০০ জন এবং হাউজ অফ কমন্সের ৬০০ জন। হাউস অফ লর্ডস হলো মূলত এরিস্টোক্র্যাটদের জন্য।
এটাকে যদি আমরা ব্রিটিশ এরিসটোক্র্যাট গ্রুপকে বিবেচনায় নিয়ে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই যে এরিস্টোক্রাটরা; যাদেরকে আমরা House of Lords of the United Kingdom হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি তারা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে ও সমবায়ের ভিত্তিতে একজন ব্যক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। এবং তাঁদের মধ্যে থেকে একজনকে Peerage নির্বাচিত করে একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে পারে। এই প্রেসিডেন্ট কে তারা তাদের প্রতিনিধি বানায় এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যখন যা লাগে সেটার আলোকে তাদের পরিকল্পনা এবং কর্ম গ্রহণ করে থাকে।এবং নিজেদের স্বার্থে কাজ করে থাকে। যেমন ওসমানীদের সাথে তারা কখনো লড়াইয়ে যায়নি কেননা যখনই লড়াই গিয়েছে সেখানেই হেরেছে। এজন্য তারা ওসমানীদের সাথে সবসময় চুক্তি করত। কারণ তারা জানতো এখানে পারা যাবে না। কোথাও চুক্তি (উসমানী), কোথাও যুদ্ধ, কোথাও গনহত্যা, কোথাও ব্যবসার (হিন্দুস্তান) নামে সকল কিছুকে দখল করে ফেলেছে।
তাদের এই পরিকল্পনাগুলো গ্রহণ করে হাউজ অব লর্ড স এর সদস্যরা।
- এই সকল বিষয়কে বিবেচনায় নিলে আমরা এই কথা বলতে পারি যে, মূলগতভাবে খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ব দ্বারা লালিত, ফরম বা গঠনগত দিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধাকে ব্যবহারকারী আবার একই সাথে বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমেও ধারাবাহিকতা দানকারী এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে সামনে রেখে এটাকে সেক্যুলার এই আদর্শে রুপান্তরিত করে।
- একই সাথে তারা অন্য সমাজ ও দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসেবে দাবী করে।
এই চিন্তাকে তারা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে, তাদের অন্যান্য পন্থার মাধ্যমে এটা আমাদের মন মগজে গেঁথে দিতে দিতে সক্ষম হয়েছে। তারাই সকল মেকানিজম ও চিন্তা তথা খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের চিন্তাভাবনাকে দার্শনিক ফর্ম দিয়ে, আধুনিক মডার্ন স্টেট এর আদর্শে পরিণত করেছে এবং এই আদর্শকে পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে যেমন ইংল্যান্ডের হাউস অফ লর্ডসের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে এটা প্রয়োগ করেছে। এটা হচ্ছে মূলত তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড। এখানে মূল হলো ধর্ম দর্শন, এমনকি তাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও অন্যান্য চিন্তাগুলো এক্ষেত্রে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
তারা এটা আমাদের উপর কীভাবে প্রয়োগ করেছে? আমাদের উপমহাদেশের ক্ষেত্রে তারা ভেবেছে, আমরা যদি তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চাই, তাদেরকে শোষণ করতে চাই, শোষণ করার জন্য সর্বাগ্রে যে বিষয়টি করতে হবে সেটা হল, তাঁদের আত্মবিশ্বাসকে শেষ করে দেওয়া। এই জন্য তারা ইতিহাসবিহীন একটি জাতিতে পরিণত করার জন্য আমাদের সকল কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশে তারা প্রথম এই কাজটি করে। ইসলাম আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলাম ভারতীয় উপমহাদের ১০০০ বছরের ভাগ্য নিয়ত্ত্বা ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে মোহাম্মদ বিন কাসিম এর মধ্য দিয়ে যে বিজয় এবং বাংলা অঞ্চলে আরব বণিকদের মধ্য দিয়ে ইসলামের যে প্রচার এবং প্রসার যা ভারতীয় উপমহাদেশের এক হাজার বছরের ভাগ্যনিয়ত্তা ছিল। এককথায় ইসলামই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ।
এমন একটা জায়গায় এসে তারা সর্বপ্রথম আক্রমণ চালায় ওই সময়ের ভাষা এবং ধর্মের উপরে। তারা প্রথমে এসে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার যে ভাষা সেটাকে পরিবর্তন করে দেয়। এটা তারা রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে করে।
দ্বিতীয় আঘাতটি করে তারা আমাদের দ্বীনের উপরে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মাযহাব হানাফী মাযহাব। আকিদায় আমরা আশয়ারী-মাতুরিদি। ব্রিটিশরা আসার পর তারা ব্রিটিশ সালাফিজমের পথকে উন্মোচিত করেছে। অর্থাৎ তারা দ্বীনকে এমন অবস্থায় নিয়েছে যাতে আমরা সেই দ্বীনকে পালন করতে না পারি। এই দ্বীন যেন আমাদের ভিতরে ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য জন্ম দেয়। এজন্য ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ফরমেট বা সমস্যার সৃষ্টি হয় সালাফিজমের মাধ্যমে। মাত্র ৫০ থেকে ৬০ বছরের পরেই আহলে কোরআন, আহলে হাদিস এর জন্ম হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন সময়ে ২২ হাজার পাউন্ড দিয়েছে মিশকাতুল মাসাবিহ কে অনুবাদ করার জন্য। কারণ মিশকাতুল মাসাবিহকে বলা যায়, আমাদের মুসলমানদের হ্যান্ডবুক। এটাকে তারা আগে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করার চেষ্টা চালায় এবং এক্ষেত্রে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফান্ডিং করে।
এ কারণে ভাষা যদি শক্তিশালী না হয় তাহলে দ্বীনও শক্তিশালী হবে না। এজন্য ভাষাকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। আমাদের দেশের মানুষের ভাষা বাংলা। কিন্তু আমাদের শিক্ষার ভাষা কি বাংলা? আজকে আমরা বাংলা ভাষায় ইসলামকে সঠিকভাবে তুলে ধরার মতো কোন কিছু কি করতে পেরেছি?
তারা তো তাদের কাজ করেছে তারা এসে আমাদের ভাষার উপর আক্রমণ চালিয়েছে, আমাদের পরিভাষার উপর আক্রমণ চালিয়েছে। এটা করে তারা বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এবং বাংলা ভাষার সাথে মুসলমানরা যাতে দূরত্ব বজায় রাখে এজন্য সব সকল ধরনের পন্থা অবলম্বন করেছে। পরবর্তীতে মুসলমানরাও বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা হিসেবে দূরে সরিয়ে দিয়ে রেখেছে। অথচ যে কোন চিন্তাধারার ক্ষেত্রে মানুষ যদি তার মাতৃভাষাকে ভালোভাবে না জানে অন্য ভাষাও ভালোভাবে শিখতে পারবে না ভালোভাবে চিন্তা করতে পারবে না। একারণে তারা প্রথমে আক্রমণ চালায় আমাদের দ্বীনের উপরে আর সেটা করে আমাদের আলেমদেরকে হত্যা করার মাধ্যমে, তারা আমাদের দারস বাড়িগুলো ধ্বংস করে দেয়। ওদের যত প্রতিষ্ঠান ছিল তা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় এবং আমাদের দ্বীন যাতে একটি অনুসৃত দ্বীন না হয়, ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্য সৃষ্টি হবে বহুধা অথবা বিভক্ত হবে এটার জন্য সকল ধরনের কার্যক্রম তারা চালায়।
আজকে যদি আমরা শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই এজন্য আমাদেরকে আমাদের দ্বীনকে ভালোভাবে বুঝতে হবে দ্বীনুল মুত্তাবা’ অর্থাৎ অনুসরণযোগ্য যে দ্বীন। আর এক্ষেত্রে আমরা ইসলামের ইতিহাসে হেরা থেকে শুরু করে প্রবাহমান নদীগুলোর দিকে যদি আমরা দেখি সবচেয়ে প্রশস্ত এবং প্রবাহমান নদী হল উসুলবিদ বা আহলে রায়ের ধারা। এটা সবচেয়ে বড় ধারা। কারন এর প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা এবং এর বীজ বপন করেছেন হযরত ওমর (রা)। আব্বাস খিলাফতের রাষ্ট্র, ওসমানী, মুঘলসহ আন্দলুসিয়ার যে খেলাফত দেখি- এই ফিকহের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হয়েছে। আমরা যদি আমাদের দ্বীনকে একটি অনুসরণযোগ্য একটি দ্বীনে পরিণত করতে চাই তাহলে আমাদেরকে পুনরায় এই উসুলি ধারা যার প্রতিনিধিত্ব শুধুমাত্র হানাফীরাই করে না যার শুরু হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, ইমাম আবু হানিফা থেকে ইমাম গাজ্জালী। অথচ ইমাম গাজ্জালী কে দেখানো হয়, তার সময় এসে জ্ঞান মরে গেছে অথচ তিনি তার পূর্বের ৪০০ বছরের জ্ঞান কে সামারাইজ করেছেন এবং তারপর ৬০০ বছর এর জ্ঞানকে ডাইমেনশন দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তি হলো ইমাম শাতেবী। তিনি যখন দেখলেন আমাদের হানাফী উসুল বা আমাদের ক্লাসিক উসুল দিয়ে ইসলামকে যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য একটি বিশ্বজনীন দ্বীন হিসেবে পরিচালনা করতে পারব না, তখন তিনি মুয়াফাকাত লিখে মাকাসিদের আলোকে এই দ্বীনকে নতুন করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এরপর ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি এর চিন্তা দেখলে, সেই সময় ইউরোপে এনলাইটেনমেন্ট হচ্ছে, তারা আমাদের বাংলা অঞ্চলে চলে আসছে। বিভিন্ন অঞ্চলকে তারা সাম্রাজ্যবাদের অধীনে নিয়েছে৷ তখন তিনি নতুন করে উসুল প্রণয়ন করেন, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা। তারপর আসেন আল্লামা ইকবাল। তিনি ঐসময়ের দুনিয়াকে নতুনভাবে রিড করেন। রিড করে ইসলামের গতিশীলতা কীভাবে আসতে পারে, আগামী দিনের সভ্যতা হিসেবে ইসলামী সভ্যতা কীভাবে গতিশীল হবে, পুনরুজ্জীবিত হতে পারে, মুসলমানগণ কীভাবে জ্ঞান এবং সভ্যতায় নতুন ভাবে নিজেদের জায়গা গ্রহণ করতে পারে এজন্য তিনি কবিতার মাধ্যমে, লেখনির মাধ্যমে, রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের সামনে বিশাল এক মেনিফেস্টো তুলে ধরেন। এজন্য আমরা সাম্রাজ্যবাদ এবং শাসকদের চিন্তাধারা থেকে যদি মুক্তি পেতে চাই তাহলে আমাদেরকে খুব ভালোভাবে এই ধারাকে অনুসরণ করতে হবে খুব ভালোভাবে রিড করতে হবে এমনকি আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া যে জ্ঞান তাকে নবায়ন করে আমাদের যুগের আলোকে নতুনভাবে তুলে ধরতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই ভাষার উপর জোর দিতে হবে। এজন্য আমাদের মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি আরবি ভাষাকে মাতৃভাষার মত রপ্ত করতে হবে। অন্যথায় আমাদের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদী শোষকদের কাছ থেকে কখনো মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের তথাকথিত যারা এলিট তারা কথা বলার সময় অর্ধেক বাংলা, অর্ধেক ইংরেজি বলে, এমনকি আরবির শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে লেকচার দেয়। দৈন্যতা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে মানুষের এসকল আচরণ করতে পারে! এখন আমাদের প্রয়োজন আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করা কারণ আমাদের ভাষা ইংরেজি ভাষার চেয়ে কোন অংশে কম না। শেক্সপিয়ারের চাইতে আলাউল ছোট কবি না। আমাদেরকে এগুলো নতুন ভাবে জাগ্রত করতে হবে এবং নতুনভাবে সামনে তুলে ধরতে হবে।
তারপর তারা যে কাজটা করে যে আমাদের অতীত বলতে কিছু নাই। এটা হচ্ছে আমাদের উপর উনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যের চিন্তার প্রভাব এর সবচেয়ে বড় প্রভাব হচ্ছে আমাদের অতীত বলতে কিছু নেই এটা তারা কেন বলতো এটা করার মূল কারণ হচ্ছে তারা যে অঞ্চলে গিয়েছে সে অঞ্চলের মানুষদেরকে তারা অসভ্য বর্বর এমনকি সভ্যতাহীন একটি জাতি হিসেবে দেখতো তাদের কাছে মানুষ হচ্ছে দুই পা ওয়ালা প্রাণী যেমন ছাগলের পা গরুর চারপা এরকম মানুষও দুই পা ওয়ালা প্রাণী ছাড়া আর কিছু না। যখন ইচ্ছা হাত কেটে ফেলতো, যখন ইচ্ছা ফাঁসিতে ঝুলাতো, যখন ইচ্ছা পিটাতো যখন ইচ্ছা আগুনে ফেলত, যখন ইচ্ছে কৃত্রিমভাবে খরা সৃষ্টি করে হত্যা করত এটা হচ্ছে তাদের অসভ্য বা বর্বর জাতির সাথে আচরণ। কারণ তারা মনে করত তারাই একমাত্র মানুষ অন্যরা মানুষ নয়। তাদের মতে তাদের যে বিবর্তনবাদের ধাপ তা ইউরোপিয়ানরা ছাড়া অন্য কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। এজন্য তারা যে অঞ্চলে গেছে সে অঞ্চলের মানুষদেরকে হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করত না।
এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাই পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় দার্শনিক হেগেল তার দ্য হিস্ট্রি অফ ফিলোসফি বইয়ে। সেখানে একটা ক্যাটাগরি আছে- তা হলো ইতিহাসবিহীন জাতি। ইতিহাসবিহীন জাতি কারা? তাদের কথা হচ্ছে যারা বর্তমানে ক্ষমতাবান নয় তাদের ইতিহাসে কোন জায়গা নেই। এ কারণে মানব সভ্যতার ইতিহাসে বাঙালি জাতির গৌরব, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের অবদান আমরা খুঁজে পাই না। এগুলো কোথাও পড়ানো হয় না কারণ আমাদের বর্তমানে কোন অস্তিত্ব নাই। এটা শুধুমাত্র হেগেল না, এটা পাশ্চাত্য দার্শনিকদের ফিলোসফি বা হিস্ট্রির মূল কথা। তারা আমাদেরকে ইতিহাসবিহীন জাতি হিসেবে গ্রহণ করে। এটি আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ইতিহাস পড়ি তখন আমাদের নিজেদের ইতিহাসের প্রতি আমাদের ঘৃণা সৃষ্টি হয়। আমাদের সমাজবিজ্ঞান বলতে কিছু নাই অর্থনীতি বলতে কিছু নাই কেন এই প্রবণতার কারণে আমাদের অস্তিত্বই নাই। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য মনে করা হয়। কিন্তু এটা ইসলামিক স্টাডিজ এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ হাদিসের ইতিহাস আমরা কতটুকু জানি? ইতিহাস আমরা জানি ইমাম গাজ্জালী পর্যন্ত অর্থাৎ পঞ্চম হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত। তাদের কথা হলো জ্ঞান গাজ্জালীর মাধ্যমে মরে গেছে। অথচ ইসলামের ইতিহাসে ইমাম গাজ্জলীর পর ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বড় দার্শনিক জন্ম নিয়েছে। যেমন ফখরুদ্দিন রাজি তিনি এত বড় চিন্তাবিদ, মুয়াফাকাতের লেখক ইমাম শাতিবীসহ আরও অনেক চিন্তাবিদ।
তাদের সত্যায়িত করার জন্য এটা আমার গোগ্রাসে গিলে নিয়েছি। বাংলাদেশের কোন মাদ্রাসায় দেখবেন না যে উসুলের ইতিহাস আছে, হাদিসের ইতিহাস আছে, দর্শনের ইতিহাস আছে, আখলাকের ইতিহাস আছে- এটা পঞ্চম হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। আমাদেরকে শুধু সোশাল সায়েন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাবজেক্ট গুলোকে মুক্ত করলে হবে না আমাদেরকে মুক্ত করতে হবে তাফসীর এবং হাদিসকে। কারণ আমরা তাফসীরের ইতিহাস জানি না, হাদিসের ইতিহাস জানি না। আর জানলেও তা আংশিক।
আমরা তাদের এই বয়ানকে গ্রহণ করে তাদের কথাকে স্বীকৃতি দিয়েছি যে ঠিকই আছে আমরা ইতিহাসবিহীন জাতি, গাজ্জালীর পরে আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের চিন্তা ও দর্শন নামে কোন দিন কোন লেকচার শোনা হয় না। আমরা যে ইতিহাসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি মর্যাদা পূর্ণ জাতি এটা আমাদেরকে নতুন করে আবিষ্কার করে আবার আমাদের আত্মবিশ্বাসকে জাগ্রত করতে হবে। আমরা ইতিহাসবিহীন জাতি নই, ইতিহাসবিহীন জাতি ইউরোপ নিজে কারণ তার কোন ইতিহাস নেই, তার ইতিহাস সম্পূর্ণ ফিকশন।
আমাদের ইতিহাসবিহীনতার আরেকটি বড় প্রমাণ হচ্ছে আমাদের শহরগুলো। এগুলো কে কি শহর বলা হয়? এগুলোকে বস্তি বলতেও লজ্জা লাগে। ঢাকা কি আজকে আমাদের হাতের কামাই নয়? আমাদের শহরগুলো, বাসা বাড়ি গুলো একজনের বেডরুম থেকে আরেকজনের বেডরুম দেখা যায়, এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? একটা মুসলিম দেশে অথচ তথাকথিত ইসলামের নাম দিয়ে দিয়ে তারা এগুলোকে ইসলামী বানিয়েছে। কোন কিছু নাম দিয়ে ইসলামী হয় না, এর মধ্যে ইসলামের রুহ থাকতে হয়।
যে ইয়াসরিবকে আল্লাহর রাসূল মদিনায় রূপান্তর করেছিলেন সেটা ইসলামী মূল্যবোধের মাধ্যমে, যদি সেই সকল মূল্যবোধ একটি শহরের মধ্যে না পাওয়া যায় তাহলে ওটা কোনক্রমে ইসলামী শহর না।
জিওগ্রাফির ক্ষেত্রে যদি আমরা দেখি গ্রিনিচ হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র। এটা কিভাবে পৃথিবীর কেন্দ্র হতে পারে? সেটাতো পৃথিবীর এক প্রান্তে। যদি পৃথিবীর কেন্দ্র হয় সেটা মক্কা হবে।
গ্রিনিচকে পৃথিবীর কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করার কারণে আমরা আমেরিকার কাছে সাউথ ইস্ট এশিয়া। মধ্যপ্রাচ্য তার কাছে মিডিল ইস্ট। সৌদি আরবের কাছে কিভাবে তা মধ্যপ্রাচ্য হয়? যদি আমরা এভাবে চিন্তা করি তাহলে আমাদের ধারনার পরিবর্তন হবে এবং আমরা নতুন করে কিছু একটা কিছু করতে পারবো। এই সাম্রাজ্যবাদ এবং শোষণ এখনো অতিবাহিত হয়নি। আমরা এখনো সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের যাতাকলে।
******