আজ মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে প্রান্তরে ইসলামী জাগরণ দেখা দিয়েছে। প্রতিটি মুসলিম দেশেই মুসলিমরা তাদের হৃত গৌরব পুনঃরোদ্ধারে আজ বদ্ধপরিকর। যখন কোন কিছু আন্দোলিত হওয়া শুরু করে তখন সেই আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার শক্তি আর কারো নেই। আজ পর্যন্ত মুসলিম দেশ সমূহে যা হয়েছে তা হয়ত আগামী দিনের বিপ্লবের জন্য যথেষ্ট নয়, কিন্তু আগামী দিনে যে সফল একটি বিপ্লব হবে এর বারতা নিয়ে এসেছে এই নবজাগরণ।
অন্যান্য অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের মত আলিয়া ইজ্জেত বেগভিচও “মুসলিম দুনিয়া কেন পেছনে পড়ে আছে?” এবং “এর থেকে উত্তরণের উপায় কি?” এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মুসলিম বিশ্বকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি মেনিফেস্টোও দাড় করিয়েছেন।
আলিয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ১৯১৮ সালকে মুসলিম বিশ্বের জন্য পতনের সর্বশেষ বিন্দু হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। কেননা সেই সময়ে পৃথিবীতে কোন একটি স্বাধীন মুসলিম দেশ ছিল না। এই সময়কে বিবেচনায় নিয়ে আলিয়া ইজ্জেতবেগভিচ মুসলিম উম্মাহর পশ্চাদপদতার “অভ্যন্তরীণ” এবং “বাহিরের” কারণ সমূহকেও চিহ্নত করেন। বাহিরের কারণ সমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ কারণ সমূহের একটি হল; মঙ্গোলদের আক্রমন। কেননা এই মঙ্গোলরা মুসলিম বিশ্বের বুদ্ধিগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক সকল অভিজ্ঞতাকে ভয়াবহ ভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আর পশ্চাৎপদতার অভ্যন্তরীণ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ইসলামকে কেবলমাত্র একটি ধর্ম হিসাবে এবং ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টি কোন থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আলিয়া ইজ্জেতবেগভিচ বিশেষ করে দ্বিতীয় কারণটির উপরে অনেক বেশী গুরুত্ত্বারোপ করেছেন এবং এই বিষয়ে বেশী বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি পাশ্চাত্যের চোখে ইসলামকে কেবলমাত্র যারা একটি ধর্ম (Religion) হিসেবে দেখে থাকেন তাদেরকে তিনি সমালোচনা করেন কঠিনভাবে।
আলিয়া ইজ্জেতবেগভিচের মতে মানুষ রূহ এবং শরীরের সমন্বয়ে গঠিত একটি জীব। এই ‘রূহ এবং শরীর’ উভয়ের প্রয়োজনকে পূর্ণ করার জন্য ইসলাম প্রয়োজন। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে নিয়ে থাকলে তা কক্ষনই পরিপূর্ণতা লাভ করবে না।
আলিয়া ইজ্জেত বেগভিচ তার ইসলামী ডেক্লারেশন নামক গ্রন্থে বলেন; “ইবাদত, আত্মত্যাগ, তওবা, জুহুদ, উত্তম কাজ এবং ভালোবাসা, কেবলমাত্র এই সকল পরিভাষাকে ব্যবহার করে ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে বুঝা সম্ভবপর নয়। ইসলামকে পরিপূর্ণ ভাবে বুঝার জন্য শরীর, ক্ষমতা, সংগ্রাম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, আদালত, স্বাস্থ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, পুরস্কার, পরিবেশ এবং শক্তি এই সকল পরিভাষাকেও খুব ভালভাবে জানতে হবে।
“ তার মতে মুসলমানগণ যখন ইসলামকে বহুমাত্রিক দিক থেকে বিবেচনা করা পরিহার করেছে তখন থেকেই মূলত মুসলমানদের পতন শুরু হয়েছে। তিনি অন্য স্থানে বলেন, ইসলামকে রাজনীতি বিমুখ করে কেবলমাত্র রাজনীতি বিহীন একটি ইবাদতের মধ্যে ফ্রেমবন্দী করে ফেলার ফলে মুসলমানগণ বিশ্ববিজয়ের নেশা এবং দুনিয়াকে পরিবর্তন করার প্রবল বাসনা থেকে ফিরে আসে। মুসলমানদের এই ফিরে আসাটা মঙ্গোলদের আক্রমণের চেয়ে বেশী ক্ষতি করেছে।
মুসলমানগণ অরাজনৈতিক এবং দুনিয়াকে পরিবর্তনের নেশা থেকে ফিরে আসার ফলে তাদের মধ্যে আস্তে আস্তে ভীতির সঞ্চার হতে থাকে। এই ভীতি আস্তে আস্তে মুসলমানদের মধ্য থেকে সাহসিকতা, উচ্ছাস, সংগ্রামী চেতনাকে দূরীভূত করে দেয়। ফলশ্রুতিতে মুসলমানগণ নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ার পরিবর্তে, নিজেদের চেয়ে যাদেরকে শক্তিশালী দেখেছে সেই সকল বিদেশী শক্তির পক্ষাবলম্বন করা শুরু করে। পরবর্তীতে তাদের হাতের খেলার পুতুল হয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ সংঘাত এবং একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে!
আলিয়া ইজ্জেতবেগভিচ মুসলিম বিশ্বের পশ্চাদপদতার কারণ সমূহকে তুলে ধরার পাশাপাশি, মুসলিম উম্মাহকে সামনে যেতে হলে কোন ধরণের পথ এবং পন্থাকে অবলম্বন করতে হবে সেই ব্যাপারের উপরেও আলোকপাত করেছেন।
আলিয়া ইজ্জেতবেগভিচের মতে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের উচিত হল দ্বীনী ক্ষেত্রে একটি ‘তাজদীদ’ করা অর্থাৎ ধর্মীয় চিন্তাকে যুগজিজ্ঞাসার আলোকে নতুন করে বিন্যাস করা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ‘ইত্তিহাদি ইসলাম’ (ইসলামী ঐক্য) র ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করার সাথে সাথে নতুন করে বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসা।
আলিয়া ইজ্জেতবেগভিচ, জাতীয় অঙ্গনে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটি ইসলামী সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাধীন মুসলিম দেশসমূহকে নিয়ে একটি বিশাল ফেডারেশন গঠনের জন্য সংগ্রাম করা প্রয়োজন বলে মনে করতেন। এই ফেডারেশন বা ইসলামী ঐক্যকে প্রতিষ্ঠা করা কেবলমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন মুসলমানগণ তাদের রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং অর্থনৈতিক শক্তি সমূহকে এক করতে পারবেন। অর্থ-সম্পদ, জনশক্তি, পেট্রোল, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং এই ধরণের যত সম্ভাবনা আছে সেগুলোকে এক করতে হবে। তাহলেই কেবলমাত্র মুসলমানদের এই ফেডারেশনটি আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে (Global System) একটি সত্যিকারের পার্থক্য তৈরি করতে পারবে।
জ্ঞান সম্রাট ইজ্জেতবেগভিচ, রক্ষনশীলদের (Conservative) পুরানো প্রেসক্রিপশন এবং আধুনিকতাবাদীদের (Modernist) ভিনদেশী সব প্রেস্ক্রিপশনকে সমাধান হিসেবে পেশ করার সমালোচনা করেন। তার মতে মুসলমানদের পশ্চাদপদতার কারণ হচ্ছে ইসলামকে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠা না করা। অর্থাৎ ইসলামের কারণে মুসলমানদের পতন হয়নি বরং ইসলামকে মেনে না চলার কারণে মুসলমানগণ আজ অধঃপতিত এবং নিপীড়িত এক জাতি।
মুসলমানগণ যদি পুনরায় ইসলামকে ধারণ করে নতুন একটি সভ্যতা এবং সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে তাহলে এটা থেকে শুধুমাত্র মুসলমানগণ নয় সমগ্র মানবতা লাভবান হবে বলে তিনি মনে করেন। শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাদ্য মানুষের জন্য যত টুকু প্রয়োজন সংস্কৃতি এবং সভ্যতাও মানুষের জন্য ততটুকুই প্রয়োজন। এই জন্য মুসলমানগণ তাদের বিশ্বাসের আলোকে সংস্কৃতি এবং সভ্যতাকে গড়ে তুলতে বাধ্য!
‘সংস্কৃতি’, মানুষের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতাকে বৃদ্ধি করার একটি পন্থা। ‘সংস্কৃতি’, ‘কেন বসবাস করি’ এই প্রশ্নের জবাব খুজে আর “সভ্যতা” ‘কিভাবে বসবাস করব’, এই প্রশ্নের জবাব খুজে। ইসলামের যেমন একটি নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে তেমনিভাবে ইসলামের নিজস্ব একটি সভ্যতাও রয়েছে। এই জন্য মুসলমানদের উচিত হল, প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয় প্রকৃতিকে ভালো ভাবে বুঝা এবং উপলব্ধি করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
আলিয়া ইজ্জেত বেগভিচের মতে, পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রকৃতিকে নিজের জন্য একটি আমানত নয় বরং নিজের সম্পদ মনে করে। এই দর্শনের উপর ভিত্তি করে তারা যে প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন সাধন করেছে তা মানবতার জন্য কখনো কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। ‘তাওহীদ’ এর শিক্ষা বিহীন এই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ‘অনেক সুবিধার পাশাপাশি অনেক বিপদও বয়ে এনেছে’। এই কথা বলে তিনি আধুনিক প্রযুক্তির ভয়ঙ্কর দিকের দিকে ইশারা করেছেন।