এক
একালে বসনিয়া ট্র্যাজেডি আমাদেরকে চিনিয়ে দিয়েছে তার সংগ্রামী নেতা আলীয়া আলী ইজ্জেত বেগভিচকে; একই সাথে আমরা দেখেছি ইজ্জেতগভিচের ধীমান নেতৃত্বে একটি জাতির আত্মপরিচয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার এক রক্তাক্ত জনযুদ্ধ। উনিশ শতকের গোড়া থেকেই ক্রমজাগ্রত ইউরোপীয় আন্দোলনের মুখে সেখানে তুর্কী খেলাফতের প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে, যার চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুর্কী খেলাফতের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে। সেই থেকে আমরা প্রায় ভুলেই বসেছিলাম ইউরোপের বলকান অঞ্চলে এক বিপুল মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে, যারা আমাদের বিশ্বাসের ভাই (Brother’s in Faith)।
পুরো বিশ শতক জুড়ে মুসলিম দুনিয়ার নানারকম রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে আটকে আমরা বলকান মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার নীরব আয়োজনকে কখনো যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারিনি। তারপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং দীর্ঘ কমিউনিস্ট শাসন বলকানের মুসলমানদের এক গভীর আত্মপরিচয়ের সংকটে নিপতিত করে। তারা আমাদের বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায়। কেবলমাত্র স্নায়ুযুদ্ধোত্তর পটভূমিতে প্রাক্তন যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশনের দুর্বল ও নড়বড়ে অবস্থানের কারণে সেখানকার মুসলমানরা আবার খবরের শিরোনাম হয়। যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশনের সব সদস্য দেশ যখন একে একে স্বাধীনতার পথে এগুতে থাকে, তখন মুসলিম অধ্যুষিত বসনিয়াও একই পথ গ্রহণ করে। সেখানকার মুসলমানদের এই আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই হয় কাল। অন্যদের ক্ষেত্রে এক রকম নীতি গ্রহণ করা হলেও মুসলিম বসনিয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি প্রযুক্ত হয়, যাকে বলে একই যাত্রায় দুই ফল। মুসলমানদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে নির্মমভাবে দমন করার জন্য প্রতিবেশি সার্বিয়া ও কতকাংশে ক্রোয়েশিয়া তাদের উন্নত সামরিক শক্তি নিয়ে নিরস্ত্র বসনিয়ার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তার পরবর্তী ইতিহাস কমবেশি সকলেরই জানা।
বসনিয়ার প্রায় ৭০ ভাগ ভূমি আগ্রাসীরা অবরুদ্ধ করে ফেলে; পুরো দেশটাই হয়ে ওঠে একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এতে প্রায় নিরীহ ২ লাখ বসনীয় হত্যার শিকার হয়, অসংখ্য নারী হয় ধর্ষিত আর বিপুল সংখ্যক বসনীয় হয় দেশ ছাড়া। এ কালে ইউরোপে এ রকম গণহত্যার নজির নেই। সেকুলার ইউরোপের উদরের মধ্যে দীর্ঘ চার বছর ধরে এই জাতিগত ও ধর্মীয় নির্মলীকরণের অভিযান চললো কিন্তু পাশ্চাত্যের বিবেকবান নীতি-নির্ধারক ও সেকুলার রাজনীতিবিদরা প্রকৃতপক্ষে এতে টু শব্দটিও করেননি। শুধু যুদ্ধ বন্ধের শান্তিপূর্ণ বিবৃতি ও আহ্বানের মধ্যে তাদের কর্মকান্ড সীমিত রেখেছেন। এ রকম গণহত্যার কারবালা যদি বসনিয়ার মুসলমানদের ক্ষেত্রে না হয়ে ইউরোপের অন্যত্র খ্রিস্টানদের উপর চলতো তাহলেও কি পাশ্চাত্যের নীতি নির্ধারকরা এমনি চুপ করে বসে থাকতেন। বসনিয়ার ট্রাজেডি নতুন করে পাশ্চাত্যের সাথে ইসলামের সম্পর্কের ধারা তৈরি করে দিয়েছে।
অন্তত এটুকু আজকে বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ আছে পাশ্চাত্য নিজেদের মধ্যে বা অন্যান্যদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতখানি সেকুলার থাকুক না কেন, মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাদের দীর্ঘ ঐতিহাসিক অসূয়া ও ধর্ম চেতনার আবেগ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে পারেনি। আর এ কারণেই বসনিয়ার ট্রাজেডি আসলে সেখানকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ সার্ব ও ক্রোয়াটদের এক ক্রুসেড, যা পুরো পাশ্চাত্যের নীরব অনুমোদনে সম্ভবপর হতে পেরেছে। এ গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল জাতি হিসেবে বসনীয় মুসলমানদের আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করে দেয়া এবং ইউরোপের বুকে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রকে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর সূচনাতেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। যুদ্ধের সময় ইউরোপের নীতি-নির্ধারকদের কাছ থেকে এ রকম একটা ধারণা আমরা পেয়েছি।
বসনীয় মুসলমানদের এই গভীর সংকটের দিনে আমরা তাদের নেতা হিসেবে দেখি আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচকে। তার প্রবল ব্যক্তিত্ব, ক্ষুরধার যুক্তি, অসমসাহসি বসনীয় মুসলমানদের ধ্বংসের কিনার থেকে মুক্তির সম্ভাবনাকে প্রোজ্জ্বল করেছে। বসনীয়দের দুর্দিনে তিনি যেমন তার রাষ্ট্রের অস্তিত্বের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও বৌদ্ধিক প্রচারণা চালিয়েছেন, অন্যদিকে আগ্রাসী সার্বীয়দের বিরুদ্ধে বসনীয়দের প্রতিরোধ যুদ্ধকেও সংগঠিত করেছেন। একটি দুর্বল অবস্থানে থেকে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ কথা নয়। তার উপর পুরো পাশ্চাত্যের উদাসীন অবহেলা ও ভ্রুক্ষেপহীনতার সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিন যুদ্ধ পরিচালনা করা কথার কথা ছিল না।
এমনি অবস্থায় পাশ্চাত্যের নীতি-নির্ধারকরা আবার জাতিসংঘের মাধ্যমে বসনিয়ার উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা (Arms embargo) আরোপ করে তাদের আত্মরক্ষার ন্যূনতম অধিকারটুকুও গলা টিপে মারার চেষ্টা করেছিল। আমরা জানি না ইজ্জেতবেগভিচের মানসিক অবস্থা তখন কেমন ছিল আর সেই মানসিক চাপকে তিনি কিভাবে গভীর ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করেছিলেন। যখন তার দেশের নারীরা ধর্ষিত হচ্ছিল, যখন সারাজেভোর বাজারে এসে ক্ষেপণাস্ত্র পড়ছিল আর নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছিল; যখন সমস্ত শহরগুলোতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও খাদ্যের সরবরাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় পুরো বসনিয়া একটা জাহান্নামে পরিণত হয়েছিল তখন ইজ্জেতবেগভিচ কি করে সেই দিনগুলো পার করেছেন? তাকে আমরা নিরন্তর দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটাছুটি করতে দেখেছি। একদিকে পাশ্চাত্যের নীতি-নির্ধারকদের কাছে সকাতরভাবে দেশের উপর আপতিত আগ্রাসনকে বন্ধ করবার জন্য তিনি বিভিন্ন ফোরামে অনুরোধ জানাচ্ছেন। অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে সাহায্যের জন্য অকাতরে আহ্বান জানাতেও দ্বিধা করছেন না। নিজের কওমের জন্য আত্মত্যাগী এই রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা আবার জানবাজি রেখে শত প্রতিকূলতার মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধের বাতিটি শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে রেখেছেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের একপর্যায়ে তিনি আকস্মিকভাবে সার্বীয় সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন, তার প্রাণনাশের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। সৌভাগ্যক্রমে বিশ্বজনমতের চাপে সার্বীয়রা তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
দার্শনিকের ধৈর্য ও স্থিরতার গুণেই বোধ হয় ইজ্জেতবোভিচ এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। তিনি এ কালের যথার্থ সালাহউদ্দীন। ইজ্জেতবেগভিচ রাজনীতিবিদ হলেও প্রকৃতিগতভাবে তিনি দার্শনিক। সত্তর দশকে ইউরোপের অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন: যেখানে মসজিদ ও টেলিভিশন থেকে বিপরীতধর্মী বাণী প্রচারিত হয় সেখানে কি ভালো আশা করা যায়। দার্শনিকের পর্যবেক্ষণই বটে। তার এই পর্যবেক্ষণের জন্য ইউরোপীয় পণ্ডিতরা তাকে প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদী বলে গাল দেয়। কিন্তু গাল দিয়ে কি কোনো দার্শনিককে স্তব্ধ করা যায়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ব্যর্থতা ও বিশ্বব্যাপী সাম্য সাধনে অসফল পুঁজিবাদের বাইরে তৃতীয় বিকল্প হিসেবে অদূর ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য তিনি ইসলামের মডেলকে হাজির করেছেন। তৃতীয় ধারার বিকল্প হিসেবে ইসলামের পুনরাবির্ভাবের ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছেন জোরালোভাবে । জগত ও জীবনের ক্যানভাসে ধর্মের অবশ্যয়ারিতা যারা নির্মাণ করতে চেয়েছেন আলীয়া তাদেরই একজন। স্থুল বস্তুবাদ আজ পৃথিবীকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে এসেছে। আলীয়া গভীরভাবে দেখেছেন বস্তুবাদের উপজাত হিসেবে আজ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে অসাম্য, অনাচার আর রক্তক্ষরণ। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ধর্মের মৃন্ময়ী জগতে আশ্রয় নেয়া জরুরী। আলীয়া বিশ শতকের পাশ্চাত্যের মননকে নির্মমভাবে বিশ্লেষণ করে আমাদের দেখিয়েছেন ইসলামই হতে পারে আমাদের আগামী দিনের সেই সমাধান সূত্র।
দুই
আলীয়ার জন্ম বিশ শতকের গোড়ার দিকে, ১৯২৫ সালে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যুগোশ্লাভিয়া তখন অস্ট্রিয় সাম্রাজ্যের অধীন। আলীয়া জন্মগতভাবে ইউরোপের সস্তান হলেও তিনি ছিলেন সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য। তার ভাষায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালীন এই সময় ছিল মুসলমানদের জন্য ভয়ানক দুর্দিন। তুর্কী খেলাফত তখন একটা স্মৃতি। আর মুসলিম দুনিয়া নিপতিত হয়েছে ইউরোপীয় বশ্যতার নিগড়ে। তিনি লিখেছেন,
In the early 1940s, the Muslim world was in a very bad way. There were only a few independent Muslim countries. We regarded this as an untenable situation and saw Islam as a living idea that must bring itself up to date while preserving its essence. We were dissatisfied with the way things were in the Muslim world, dominated as it was by foreigners, through the presence of either their militaries or their Capital.
চল্লিশ দশকের প্রথমভাগে মুসলিম দুনিয়ার অবস্থা ছিল খুব খারাপ। মাত্র কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র স্বাধীন হিসেবে টিকে ছিল। আমাদের কাছে মনে হয়েছিল এটা একটা আত্মপ্রত্যয়হীন অবস্থা, যদিও আমরা ইসলামকে একটা জীবন্ত ধারণা হিসেবে লালন করতাম যা তার অন্তর্গত সারাৎসার দিয়েই আধুনিককালের উপযোগিতা অর্জন করবে। বিদেশী ফৌজ অথবা পুঁজির দ্বারা তখনকার মতো নিয়ন্ত্রিত মুসলিম বিশ্বের অবস্থাদৃষ্টে আমরা মোটেই খুশি হতে পারিনি।
আলীয়া আরও লিখেছেন তার পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন বেলগ্রেড থেকে। ১৮৬৮ সালে বেলগ্রেড মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে গেলে সেখানকার কিছু মুসলমান সামাকে চলে আসেন। তুর্কী খলিফা সুলতান আব্দুল আজীজ তাদের সাভা ও বসনা নদীর ধারে কিছু জমি দেন, সেখানে নতুন মুসলিম জনপদ সামাক গড়ে ওঠে। এই সামাকেই আলীয়া ইজেতবেগভিচের জন্ম। তার পিতা ছিলেন সামাকের একজন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় তিনি যথেষ্ট সফলতা দেখাতে পারেননি। আলীয়ার বয়স যখন মাত্র দুই বছর তখন তিনি সারাজেভো চলে আসেন। আলীয়ার ভাষায়: That is why I feel more like a man from Sarajevo than from Samac সামাকের চেয়ে সারাজেভোর লোক হিসেবে পরিচয় দিতেই আমি পছন্দ করি। এই সারাজেভোতেই আলীয়ার শৈশব, যৌবন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার দিনগুলো কাটে, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে এই শহরেই তিনি সফলতা পান আবার এই শহরে বসে তিনি তার জাতির মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন।
আলীয়ার শৈশবের দিনগুলো নানা রকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। সারাজেভোতে তার পিতা একটা বেসরকারি দফতরে কেরানীর কাজ করতেন। মা ছিলেন ধর্মভীরু। আলীয়া জানিয়েছেন তিনি তার ধর্মানুরাগ পেয়েছিলেন এই মায়ের কাছ থেকেই। মা-ই তাকে ফজরের নামাজের আগে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। বসনিয়ার ভাষায় ফজরের নামাজকে বলে সাবাহ। সাবাহ আদায় করতে তিনি কাছের হাজীসরা মসজিদে যেতেন। সেখানে বৃদ্ধ ইমাম মুজেনজিনোতিক কিভাবে সুললিত সূরে নামাজের কেরাতে সূরা আর রহমান পাঠ করতেন আর সাবাহ আদায় শেষে ফেরবার পথে কিভাবে তাকে বসন্তের সৌরভ এসে আমোদিত করতো তার স্মৃতি আলীয়া কখনোই ভুলতে পারেননি। তার বয়স যখন ১৫ তখন তিনি প্রথমবারের মতো কমিউনিষ্ট মতবাদের সাথে পরিচিত হন। আলীয়া লিখেছেন সে এক দোদুল্যমানতার যুগ। কমিউনিস্ট আদর্শ তখন যুগোশ্লাভিয়ায় হু হু করে ঢুকে পড়ছে, আর কমিউনিষ্ট কর্মীরা দেশজুড়ে যেমন সক্রিয় তেমনি প্রবল হয়ে উঠছে। আসলে যুগোশ্লাভিয়ায় কমিউনিস্টদের অভ্যুত্থান ঘটেছিল ইউরোপ জুড়ে তখনকার ফ্যাসিজমের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। আলীয়ার ভাষায় : Red totalitarianism arose to confornt black totalitarianism.
লাল স্বৈরাচার কমিউনিজম এলো কৃষ্ণ স্বৈরাচার নাজীজম ঠেকাতে। আলীয়ার স্কুলেও কমিউনিস্ট আদর্শ ঢুকে পড়েছিল। স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক রীতিমত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন। এদের মাধ্যমেই আলীয়া কমিউনিস্টদের প্রচার পত্র, বই পুস্তক পড়েন। আলীয়া মনে করেন কমিউনিষ্টরা আসলে সামাজিক অসাম্যের কথা বলে এবং তারা এও বিশ্বাস করে খোদা এই অসাম্যের পক্ষে। ধর্ম হচ্ছে এই অসাম্যকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার এবং এটি দুর্বলদের তাদের অবস্থান পরিবর্তনে বাধা দেয়। আলীয়া এসব কথার সাথে একমত হতে পারেননি। তিনি লিখেছেন :
I did not accept it, however, it seemed to me, if not always quite clearly, that the chief message of religion is responsibility. Its message is the same even to kings and emperors; that they should be responsible. Even if they have no fear of the police on this earth, as the police are in their hands, religion tells them that they will have to answer for the violence they commit, and that there is no escaping accountability. A universe without God seemed to me to be a universe without meaning.
আমি এটা মেনে নেইনি। যদি আমি পারি এতদসত্ত্বেও আমার কাছে মনে হয়েছিল ধর্মের প্রধান কথা হচ্ছে দায়িত্ব। বাদশাহ ও সম্রাটের কাছেও এর দাবি এক রকম। যদিও এই পৃথিবীতে তাদের পুলিশের মনে কোনো ভয় নেই, কেননা পুলিশ তাদেরই হাতের মুঠোয়, এতদসত্ত্বেও ধর্মের সুস্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে তাদেরকে তাদের কৃত অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এই বিশ্ব আমার কাছে নিতান্ত তাৎপর্যহীন মনে হয়।
আলীয়ার এই দোদুল্যমানতা ও অনিশ্চয়তা এক থেকে দুবছর চলেছিল। তারপর তিনি নিজের বিশ্বাসে স্থির হন এবং আর পিছনে ফিরে তাকাননি। স্কুলের লেখাপড়ায় তার যত না মন ছিল তার চেয়ে তিনি বেশি সময় দিয়েছেন বাইরের পড়াশুনায়। আঠারো কি উনিশের মধ্যেই তিনি ইউরোপীয় দর্শনের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য বই পড়ে ফেলেছিলেন এ জন্য তাকে স্কুলে মূল্য দিতে হয়েছিল একবার তিনি ইতিহাস বিষয়ে ফেল করেন, যদিও তার ভাষায় ইতিহাস তিনি অনেক বেশি জানতেন। এ জন্য তিনি তার ইতিহাসের সার্বীয় শিক্ষককে দায়ী করেন; এর পিছনেও যুক্তি ছিল। সার্বীয়রা মুসলমানদের পছন্দ করতো না। পুরো বসনিয়া জুড়েই সার্বরা আধিপত্যের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল যা পরবর্তীকালের কমিউনিস্ট শাসনের সময় আরো বৃদ্ধি পায়। বসনীয় যুদ্ধের সময় এর চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে আলীয়া তার স্নাতক ডিগ্রী নেন। যদিও তখন স্ট্যালিনগ্রাড ও এল আলামীনের ভয়ংকর যুদ্ধ পর্ব শেষ হয়ে গেছে। নাজীদের হাতে মুগোশ্লাভিয়া পতনের কয়েক মাস আগে আলীয়া ইয়ং মুসলিমস এসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠনের সাথে পরিচিত হন যা তার জীবনের পরবর্তী গতিধারাই পাল্টে দেয়। এ সংগঠনটি মূলত জাগরেব ও বেলগেড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ ও উদ্যমী মুসলমান ছাত্রের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইউরোপীয় সংস্কৃতির কবল থেকে বসনিয়ার তরুণ মুসলমানদের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে এটি যাত্রা শুরু করে। এই সংগঠনের লক্ষ্য ও কর্মসূচী আলীয়াকে প্রাণিত করে, কারণ এর চিন্তাভাবনার ধরন অন্যদের থেকে ভিন্ন রকম ছিল। আলীয়ার ভাষায় :
It was all very different from what we had learned in the maktabs, the religious instruction we had had at school, the lectures we had attended, the articles we read in the journals of the day. I see it as a matter of the relationship between essence and form-the hojjas (Islamic religious teachers or priests) were, in our view, more inclined to interpret the rituals or external forms of Islam, while neglecting the essence.
আমরা মক্তব, ধর্মীয় অনুজ্ঞা, স্কুল, বক্তৃতা ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে যা শিখেছিলাম তার থেকে এটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার কাছে এটি মনে হয়েছিল কোনো জিনিসের নির্যাস ও অবয়বের মধ্যে বিরাজিত সম্পর্কের মতো একটি বিষয়। ধর্মগুরুরা, আমাদের মতে ইসলামের বাহ্যিক আচারগুলোর ব্যাখ্যা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, অন্যদিকে এর নির্যাসকে উপেক্ষা করতেন।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইয়ং মুসলিমস এসোসিয়েশন জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বসনিয়ার প্রত্যেকটি শহরে এর শাখা বিস্তৃত হয়।১৯৪৫ সালে কমিউনিস্টরা সারাজেভোতে প্রবেশ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যাহতির পর মার্শাল টিটোর এই সাম্যবাদী সরকারের সূচনার মধ্য দিয়ে বসনিয়ার মুসলমানরা আর এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তার যুগে পা দেয়। টিটোর সরকার ধর্ম চর্চা নিষিদ্ধ করে এবং অনুমাত্র ভিন্নমতালম্বী হওয়ার কারণে অসংখ্য নিরীহ মানুষের উপর জুলুম-পীড়ন-নির্যাতন নেমে আসে।
ইয়ং মুসলিমস এসোসিয়েশন টিটোর সরকারের অন্যায় কার্যকলাপের প্রতিবাদ করে। ফল যা হবার তাই হয় । এই নবীন সংগঠনের অসংখ্য তরুণ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরকে পাঠানো হয় কষ্টসাধ্য লেবার ক্যাম্প ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে। নেতৃপদের অনেককেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এইভাবে জেল-জুলুম-হুলিয়া মৃত্যু দিয়ে ইয়ং মুসলিমস এসোসিয়েশনকে কার্যত নিঃশেষ করে দেয়া হয়। কমিউনিস্ট সরকার আলীয়াকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। এ সময় তাকে রাজমিস্ত্রির সহকারী এবং কাঠুরের কাজ করতে হয়। আলীয়া জানিয়েছেন এইভাবে ১৯৪৮-৪৯ এর পুরো শীতটাই তাকে কাঠ কাটতে হয়েছে। মুক্তির পর তিনি আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৬ সালে আইনের উপর তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আইনজীবী হওয়ার পরও তিনি দীর্ঘ দশ বছর একটা নির্মাণ কোম্পানীর সাথে যুক্ত ছিলেন এবং এভাবেই তখনকার মতো তার জীবিকা নির্বাহ হত।
নির্মাণ ও আইন ব্যবসায় নিয়োজিত থাকার পর এবং যুগোশ্লাভিয়ার প্রতিকূল রাজনৈতিক আবহাওয়ায়ও আলীয়া তার জীবনের মৌলিক লক্ষ্য থেকে এক বিন্দু সরে আসেননি। তখনকার পরিস্থিতিতে সক্রিয় রাজনীতি সম্ভব না হলেও ইসলাম, দর্শন ও অন্যান্য বিষয়ে তিনি বিস্তর লেখালেখি করেন। তার এ সময়ের বিখ্যাত কাজ হচ্ছে Islamic Declaration। ১৯৬৯ সালে ৪০ পৃষ্ঠার এ ছোট বইটি তিনি লেখেন, যা ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়। এ বইতে তিনি সে সময় যে সব কথা বলেন তা সম্ভবত তার সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ছিল, যখন এসব নিয়ে কেউ ভাবতেই পারতো না। মূলত মুসলিম দুনিয়াকে সামনে রেখেই Islamic Declaration লেখা হয়েছিল, যুগোশ্লাভিয়ার কথা এখানে আদৌ উল্লিখিত হয়নি।
Islamic Declaration এ আলীয়া যা বলতে চেয়েছিলেন তার মূল প্রতিপাদ্য হলো একমাত্র ইসলামই মুসলিম জনগণকে উজ্জীবিত করতে পারে, তাদের কল্পলোককে নাড়া দিতে সক্ষম, এবং তাদের ভবিষ্যৎ ইতিহাস নির্মাণের সক্রিয় সংগঠক হিসেবে ইসলাম রাখতে পারে ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তাধারা দিয়ে মুসলমানের ভাগ্য বদলানো যাবে না। সঙ্গত কারণেই আলীয়া মুসলিম জনতাকে ইসলামের মৌলিক নীতি ও বিশ্বাসের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে আহবান জানান। একই সঙ্গে এ বইতে তিনি মুসলিম দুনিয়ায় বিদ্যমান স্বৈরাচারী ব্যবস্থার নিন্দা জানান, শিক্ষার হার বাড়ানোর কথা বলেন, নারীর অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেন, সন্ত্রাস-দুর্নীতি পরিহার ও সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠার উপরও জোর দেন। বইটি আলীয়া সম্ভবত কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর আদলে লিখতে চেয়েছিলেন।
মেনিফেস্টোকে কমিউনিস্টরা যেমন মুক্তির দলিল হিসেবে বিবেচনা করে, আলীয়ার মনেও হয়তো একই ধারণা কাজ করে থাকবে, তার Islamic Declaration হবে সব মুসলমানের মুক্তিমন্ত্র। এ বইয়ের প্রতিক্রিয়া হয় খুব দ্রুত, একে প্রতিক্রিয়াশীল ও মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং পরবর্তীতে এ বইকে ভিত্তি করেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে দোষী সাব্যাস্ত করা হয়। এমনকি পাশ্চাত্যেও এ বই সম্পর্কে শীতল মনোভাব প্রকাশ করা হয়, কেননা তারা হয়তো বইয়ের প্রতিপাদ্য বিষয়টি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না যেখানে ইসলামকে সমস্যা সমাধানের প্রধান সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সময়েই আলীয়া তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটি করেন। তার বিখ্যাত বই Islam Between East and West তিনি এ সময়েই লেখেন, যার বসনিয়াক ভাষায় নাম ছিল। ইসলাম ইজমেনু ইসতোকা-ই-জাপাদা”। এটি একটি দর্শনমূলক গ্রন্থ, দার্শনিকের ভাবনা ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে সমকালীন পৃথিবীতে ইসলামের অবস্থানকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। মূলত আলীয়া বইটি লিখেছিলেন ১৯৪৬ সালের কারাবাসের আগে। এরপর ২০ বছর বইয়ের পাণ্ডুলিপি কমিউনিষ্ট প্রশাসনের ভয়ে লুকিয়ে রাখতে হয়। জানীয়ার কারাবাসের সময় বোন আজরা পাণ্ডুলিপিটি বাড়ির পাটাতনের উপর রেখে দেন। তারপর পাণ্ডুলিপিটি যখন তিনি ফেরত পান তখন এটি ছিল তার ভাষায় Bundle of half decayed paper.
এই জরাজীর্ণ পাণ্ডুলিপিটি আলীয়া নতুন করে লেখেন এবং গোপনে কানাডায় এক বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেন। পরে ১৯৮৪ সালে আমেরিকায় এটি প্রকাশিত হয়, যখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করছেন। এ বইতে আলীয়া ইসলামকে পূর্বীয় ও পশ্চিমী চিন্তার মাঝামাঝি একটা অবস্থানে দেখাতে চেষ্টা করেছেন, যেমন নাকি ভৌগোলিকভাবেও মুসলিম দুনিয়া পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝামাঝি অবস্থান করছে। একই সাথে তিনি এটাও বলতে চেষ্টা করেছেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার কতকগুলো সাধারণ মূল্যবোধ ও ধারণা কাজ করে থাকে। তার মতে বিশ্বধারণার (World-view) তিনটি ধারা রয়েছে ধর্মীয়, বস্তুবাদী ও ইসলামিক। কুরআন আমাদের শিখিয়েছে প্রত্যেকটি জিনিসই যুগল হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষও তেমনি শরীর ও আত্মা এই দ্বৈত সত্তার অস্তিত্ব। শরীর হচ্ছে আত্মার বাহক (Carrier)। এই বাহকের উত্থান ঘটে। তার মানে এর একটা ইতিহাস থাকে। কিন্তু আত্মার কোনো ইতিহাস থাকে না। ঐশীস্পর্শে এর বিকাশ। এই মানুষের প্রথম অংশ হচ্ছে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় অংশ ধর্ম, কলা ও নৈতিকতার প্রতিপাদ্য বিষয়। এই ভাবে মানব জীবনে দুটি সত্য ও দুটি ঘটনা পাশাপাশি বিরাজ করে। পশ্চিমা বিশ্বে এই দ্বৈত সত্ত্বা ডারউইন ও মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর মধ্যে প্রতিভূত (Represented) হয়। ডারউইনের মানুষের সাথে মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর মানুষের কোনো মিল নেই। তাদের সত্য দুরকম ও পৃথক কিন্তু একই সাথে পরস্পরের বসবাস। এটিই সময়ের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হচ্ছে সভ্যতার বিবেচ্য, ধর্ম ও কলা হচ্ছে সংস্কৃতির আলোচ্য বিষয়। প্রথমটি হচ্ছে মানুষের প্রয়োজনের প্রকাশ (How do I live), দ্বিতীয়টি মানুষের আকাঙ্ক্ষার ধন ( Why do I live ) । এখানেই ড্রামা ও ইউটোপিয়ার দ্বন্দ্ব। ইউটোপিয়া ব্যক্তিকে স্বীকার করে না, ড্রামা নৈতিকতাকে অস্বীকার করে। এইভাবে অধ্যয়ন (Study) ও Meditation হচ্ছে দুটি বিপরীতধর্মী আধ্যাত্মিক কাজ, প্রথমটি বহির্মুখী, যার দৃষ্টি জড়ের দিকে। প্রতিটি কলা ধর্মের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। যদি আল্লাহ না থাকে তাহলে মানুষের অস্তিত্বও থাকে না। আবার মানুষ না থাকলে মানবতা, মানব মর্যাদা, মানবাধিকার প্রভৃতি অশব্দবন্ধ, মূল্যহীন। সভ্যতা কর্মের ধারলে সম্পর্কে অজ্ঞাত, অন্যদিকে সংস্কৃতি হচ্ছে আক্রান্তের আশ্রয়। সভ্যতার Earthly empire. ঐহিক সাম্রাজ্য যার লক্ষ্য Utopian equality কল্পলোকের সমতা, অন্যদিকে ধর্ম হচ্ছে Kingdom of heaven- স্বর্গের রাজ্য।
আলীয়া মনে করেন আল্লাহ ছাড়া কোনো নৈতিক অনুশাসন সম্ভব নয়। নৈতিকতা হচ্ছে ধর্মেরই ভিন্নতর অবস্থা (another physical condition)। সভ্যতা যেহেতু কলার প্রকৃত অর্থে কোনো বিকাশ, প্রতিটি ধর্মই উদ্ভবের কাল থেকে পবিত্র, সময়ের ধারায় এটি দূষিত হয়েছে, একই কথা সত্য কলা ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে। এভাবেই যীশু ও চার্চের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। প্রতিটি আইনই দ্বিপ্রান্তিক (Dual) এবং মেডিসিন চিকিৎসা আদতে কোনো প্রকৃত বিজ্ঞান (True science) নয় । প্রাচীন গুহা মানবের আঁকা চিত্র অথবা পলিনেশিয়ার উপজাতীয় মুখোশ হচ্ছে কার্যত শিল্পকলার নির্যাস (Essence) যা আধুনিক কোনো সৃষ্টির চেয়ে কম উত্তেজক নয়।
এইভাবে মানব জীবন দ্বিপ্রান্তিকতার ধারণা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং এর নিদর্শন- Sign মানুষের প্রত্যেকটি ঘটনার সাথে যুক্ত। একইভাবে ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের মৌল ভাবনা ও নির্যাসের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, যেমন রয়েছে মুসা ও ঈসার মধ্যে। একজন জনতার নেতা, অন্যজন নৈতিকতার প্রচারক। এবং এখানেও ভিন্ন ভিন্ন বিচার ও লক্ষ্য। একজনের Promised land, অন্যজনের Kingdom of heaven. আলীয়া বলতে চান এই দুটো বিপরীত সত্যকে সমন্বয় করা হয়েছে ইসলামে। ইসলাম হচ্ছে একটা সমন্বয়, এই দুই মেরুর মধ্যে তৃতীয় বিকল্প যা কিনা একটা মানুষের মধ্যে কার্যত প্রতিবিম্বিত হয়।
জগত ও জীবনের প্রত্যেকটি চিন্তাভাবনা, মতামত এই দুটি ধারা হয় বস্তুবাদ, নয়তো আধ্যাত্মবাদ আশ্রয় করে পল্লবিত হয়েছে। পৃথক পৃথকভাবে বস্তুবাদ ও আধ্যাত্মবাদের খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মানব জীবনকে বিশ্লেষণ করতে যাওয়ার কারণে দুটির কোনটিই মানুষের জন্য সমাধান সূত্র নির্মাণ করতে পারেনি; কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আত্মা ও বস্তুকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ব্যবস্থা ও চিন্তার মধ্যে আলীয়া একটা দার্শনিক সমন্বয় খুঁজেছেন এবং তার এই সমন্বয় ভাবনা মানুষকে সংশ্লিষ্ট করে দেখাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন মানুষের মধ্যে যে এই প্রাথমিক দ্বৈতবাদ কাজ করছে তা কেবল ইসলামই যথার্থ অর্থে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ কারণেই তিনি মনে করেন মানব প্রকৃতি ও ইসলাম অভিন্ন। এখানে ইসলামকে তিনি একটি বিশ্বজাগতিক স্বতঃসিদ্ধতা হিসেবে নিয়েছেন এবং মানব মুক্তির একক বিকল্প ধারা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বইটি লেখা হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের কালে। সেই কালেই তিনি পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক বিচ্যুতিগুলো দার্শনিক প্রজ্ঞার সাথে চিহ্নিত করেছেন এবং একই প্রজ্ঞার জোরে তিনি এ দুটো মতবাদের অক্ষমতা ও ব্যর্থতাকে অকপটে তুলে ধরেছেন। সমাজতন্ত্রের পতন ও পুঁজিবাদের অক্ষমতার প্রেক্ষাপটে তিনি Islam Between East and West ইসলামের ফিরে আসার আগাম ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। আজকের পরিবর্তিত বিশ্বে ইসলামের ভূমিকা তারই সাক্ষ্য দেয়। সেদিক দিয়ে এ বইটি এ কালে ইসলামী পুনর্জাগরণের দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বসনিয়ায় আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচের জীবন কখনোই পুরোপুরি সুস্থতার মধ্যে কাটেনি। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে শুরু করে মিডিয়ার অপপ্রচার ও কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র অহর্নিশ ছায়ার মতো তার পিছু নিয়েছে। বসনিয়ার ক্রমাবনত মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন সদস্য হিসেবেও তাকে পোহাতে হয়েছে নানারকম দুর্যোগ। বসনিয়ার প্রধান সমস্যা ছিল গণতন্ত্রের। গত শতকের প্রথম অংশে বসনিয়ায় ছিল রাজতন্ত্র, দ্বিতীয় ভাগে এসে কমিউনিস্টদের একনায়কত্ব। চরিত্রের দিক দিয়ে দুটিই ছিল স্বৈরাচার। এমনি প্রতিকূল পরিবেশে এই দার্শনিককে তার মননচর্চা অব্যাহত রাখতে হয়েছে, যদিও তা কখনো মসৃণ ধারায় এগুতে পারেনি। মার্শাল টিটোর তথাকথিত সাম্যবাদী শাসনের সময় বসনিয়ার মুসলমানদের উপর নেমে আসে জুলুমের স্টীম রোলার। বহির্বিশ্বে টিটোর যতই উদার ও প্রাজ্ঞ নেতা হিসেবে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি থাকুক না কেন নিজের দেশের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন এক আতঙ্ক বিশেষ করে মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন এক দুঃস্বপ্ন। টিটোর সময়ই সার্বীয়দের মুসলিম বিরোধিতা তীব্র আকার নেয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় পণ্ডিতদের পরামর্শ অনুসারে যুগোশ্লাভীয় সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের আনুগত্য পরীক্ষা করার জন্য শূকরের গোশত ভক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো মুসলমানকে ইসলাম ছাড়তে হতো, নয়তবা সেনাবাহিনী ছাড়তে হতো।
এই সার্বীয় পণ্ডিতরাই বসনীয় যুদ্ধের সময় মুসলমানদের হত্যাকে বৈধতা দেবার জন্য ইসলামকে স্বৈরতান্ত্রিক, অদ্ভুত, রক্তপিপাসু, পশ্চিমা সভ্যতায় অবাঞ্চিত ও ক্ষেত্রবিশেষে ‘ ‘Abnormal’ ধর্ম হিসেবে আক্রমণ করে। বসনীয় মুসলমানদের ইউরোপীয় হওয়ার দাবিকে এই সব সাম্প্রদায়িক পণ্ডিতরা ‘A notorious absurdity’ বলে উড়িয়ে দেয়। আশির দশকে টিটো বসনিয়ার মুসলমানদের শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেন। এ সময়ই কমিউনিস্টরা আলীয়ার বন্ধু বসনিয়ার সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেম হোসেন দোজোকে গ্রেফতার করে। দোজো ‘তাকভীম’ নামে একটি পত্রিকা চালাতেন। এ পত্রিকায় আলীয়া বেনামীতে ইসলামী আন্দোলনের সমস্যা ও কৌশল নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। এগুলো পরবর্তীকালে আলীয়ার বিখ্যাত বই ‘Problems of the Islamic Renaissance’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সালে টিটোর মৃত্যুর পর বসনিয়ার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। মুসলমানদের উপর নির্যাতন, হয়রানি এক নাগাড়ে চলতে থাকে বিশেষ করে কসোভোর আলবেনীয় বংশোদ্ভূত মুসলমানদের দুর্দশার সীমা থাকে না।
১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে এই দার্শনিককে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করা হয় এবং আনুষ্ঠনিক বিচারের আগে দীর্ঘ ১০০ দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তার উপর মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এ যাত্রায় আলীয়াসহ মোট ১১ জন মুসলিম বুদ্ধিজীবিকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে একজন মহিলাও ছিলেন। এদের সকলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হয়। এবারে আলীয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করবার জন্য প্রমাণস্বরূপ তার লেখা Islamic Declaration কে উপস্থিত করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের উকিল ইসলামী পুনর্জাগরণ চিন্তার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। Islamic Declaration বইয়ের নিম্নোক্ত কয়েকটি অংশ তুলে ধরা হয় রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগের সমর্থনে:
There is no known instance in history of a genuine Islamic movement that was not at the same time a political movement. This is because Islam is a religion, but also at the same time a philosophy, a morality, an atmosphere, in a word an integral way of life….. The presence of a great many laws and of a complex legislature is, as a rule, a reliable indicator that there is something rotten in that society, which needs to stop passing laws and begin to educate its people on how to behave The Islamic movement is a coherent unity of religion and politics ……. Muslims are brothers. The Islamic movement should and can begin to take power as soon as it is morally and numerically strong enough not merely to replace existing un-Islamic governments, but to create a new Islamic government.
ইতিহাসে এমন কোন নজির নেই, প্রকৃত অর্থেই একটি ইসলামী আন্দোলন একই সাথে রাজনৈতিক আন্দোলন হয়ে ওঠেনি। এর কারণ ইসলাম যেমন একটি ধর্ম, একই সাথে এটি একটি দর্শন, একটি নৈতিক ধারণা, একটি পরিবেশ, এক কথায় জীবনের একটি সংহত রূপ। বহু রকমের আইন-কানুন ও জটিল আইন-প্রণয়ন পদ্ধতি হচ্ছে কার্যত একটি নির্ভরযোগ্য নির্দেশক, যা প্রমাণ করে সমাজের কোথাও কিছুর পচন ধরেছে এবং এর জন্য দরকার আইনি প্রণয়ন বন্ধ রেখে জনগণকে প্রকৃত ব্যবহার সম্বন্ধে শিক্ষিত করে তোলা ……… ইসলামী আন্দোলন হচ্ছে ধর্ম ও রাজনীতির সমন্বয় মুসলমানরা পরস্পরের ভাই………….. নৈতিক ও সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে যথেষ্ট শক্তি সম্পন্ন হওয়া মাত্র ইসলামী আন্দোলনের উচিত হবে ক্ষমতা অর্জনের দিকে অগ্রসর হওয়া যাতে শুধু প্রচলিত অনৈসলামিক সরকারকে অপসারণ নয়, তার পরিবর্তে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়।
আলীয়ার ভাষায় এই মামলার বিচারক ছিলেন অনেকটা Contractor এর মতো, যাকে একটা পারিতোষিকের বিনিময়ে কাজ করবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত অন্যান্য সরকারি লোকজন প্রকৃত সত্য ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। তাদের কাজ ছিল অভিযুক্ত ১১ জনকে যেভাবে হোক অপরাধী প্রমাণিত করা। তাদের কৌশল ছিল কারাবাসের ভয় দেখিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য আদায় করা। যে কেউ তাদের ইচ্ছামতো সাক্ষী দিতে রাজি হতো না, তাকেই আসামী বানানোর অভিযোগে ভয় দেখানো হতো। সরকারি উকিল আদালতের কাছে আলীয়ার শাস্তির দাবি জানিয়ে তার বিরুদ্ধে দেয়া অভিযোগ সম্বন্ধে আরো বলেন:
The Islamic Declaration is an attack upon the values of our social order. In it their lice abstract danger, written and verbal delict, the consciousness of counter-revolutionary activities. These latter actions have some similarities to enemy propaganda. But this is a case of incessant activities and intense propaganda, which shade into counter-revolutionary activities.
ইসলামী ঘোষণাপত্র হচ্ছে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের উপর বড় ধরনের আঘাত। লিখিত ও মৌখিক উভয় অর্থে এর মধ্যে এক অদৃশ্য বিপদ উকি দিচ্ছে, এতে এক প্রতিবিপ্লবী ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষ করে পরবর্তী কার্যক্রমের সাথে শত্রুর প্রচারণার সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এটি হচ্ছে একটি অবিরত কার্যক্রম ও ভয়ানক প্রচারণার অংশ যা কার্যতা প্রতিবিপ্লবী কর্মকান্ডের মধ্যেই পড়ে।
আলীয়া জানতেন তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সত্যিকার মূল্য এখানে নেই। তবু তিনি যে জবানবন্দী দেন তা স্রেফ কোনো আসামীর জবানবন্দী বলে মনে হয় না। এর মধ্যে বিবৃত হয়েছে একজন স্বাধীনচেতা মুসলিম দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীর জীবনের কষ্টি পাথরে যাচাই করা উপলব্ধির নির্যাস :
I love Yugoslavia, but not its government…… | bestow all my love on freedom, and there is nothing left over for the authorities. I am not being tried for having violated the laws of this land, for I have not done so. I am being tried for having transgressed some unwritten rules by which individual power holders in our midst impose their own standards of the prohibited and the permissible, without regard for the constitution and the law. By all appearances, I have gravely transgressed those unwritten rules.
I, therefore, state: I am a Muslim and so shall I remain. I consider myself to be a fighter for the cause of Islam in the world, and shall so feel to the end of my days. For Islam for me has been another name for all that is fine and noble, a name for the promise or hope of a better future for the Muslim peoples of the world. for their life in dignity and freedom, in a word for everything that in my belief is worth living for.
আমি যুগোশ্লাভিয়াকে ভালোবাসি, কিন্তু এর সরকারকে নয় …………… স্বাধীনতার জন্য আমার সমস্ত ভালোবাসা নিবেদন করছি, এবং কিছুই কর্তৃপক্ষের জন্য অবশিষ্ট রাখিনি। এই ভূখণ্ডের আইনি অবমাননার জন্য আমার বিচার হচ্ছে না, কারণ আমি এরকম কিছু করিনি। আমার বিচার হচ্ছে কিছু অলিখিত বিধান লঙ্ঘনের জন্য কেননা আমাদের মধ্যকার কিছু কায়েমী স্বার্থের ধ্বজাধারী লোকজন সংবিধান ও আইনের তোয়াক্কা না করে তাদের নিজেদের মতো করে নিষিদ্ধ ও পালনীয় বস্তুর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। সব দিক দিয়েই আমি ঐসব অলিখিত আইন ভঙ্গ করেছি।
সুতরাং আমি বলতে চাই, আমি একজন মুসলিম এবং মুসলিম হিসেবেই আমি থাকব। ইসলামের পক্ষে এই পৃথিবীতে আমি নিজেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে মনে করি এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার এই বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ থাকবে। আমার কাছে ইসলাম যা কিছু সুন্দর ও মহৎ তার অন্য নাম, বিশ্বের তাবৎ মুসলমান জনগণের আশার নাম, তাদের জীবনের মর্যাদা ও স্বাধীনতার নাম, আমার বিশ্বাস এ মঙ্গলকর জীবনের নাম।
এই সাজানো মামলায় আলীয়ার ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এটিই সারাজে জোয়ান হিসেবে পরিচিতি পায়। দেশ-বিদেশের মানবাধিকার কর্মী ও বুদ্ধিজীবী কমিউনিস্ট সরকারের এই অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন ও যুগো সরকারকে এই মামলার আসামীদের বেসুর খালাসের আহবান কমিউনিস্ট সরকার তাতে কর্ণপাত করার আদৌ প্রয়োজন বোধ করেনি।
কারাবাসের দিনগুলো যুদ্ধ দার্শনিকের জন্য মোটেই সুখকর ছিল না, বিশেষ করে এই বয়সে তাকে দিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করানো হতো যা যুগপৎ তার শারীরিক ও মানসিক নির্ধারনের কারণ হয়ে দাড়ায়। কিন্তু দার্শনিকের অনুভব দিয়ে এই জীবনের এই সব বাধ্য ও অস্বস্তিকে তিনি বোধ হয় সহজ করে নিতে পেরেছিলেন। নতুন এই জীবনেও আলীয়া মোটেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যাননি। তিনি প্রতিদিনের ঘটনাকে দার্শনিক তাৎপর্যে লিখে রাখতেন। তার ভাষায়,
I began to make notes; reflections on life and destiny, religion and politics, on the books I had read and their authors, and all the things that come to a prisoner’s mind during more than two thousand long days and nights.
আমি নোট রাখতে শুরু করি; জীবনের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্ম ও রাজনীতি, যে সব বই আমি পড়েছি এবং তাদের লেখক সম্বন্ধে, এবং দুই হাজার দিন ও রাত নিয়ে বিস্তৃত সময়ে যা কিছু একজন বন্দীর মনে উকি দেয়, সে সব কথা।
প্রতিদিনের এই নোটই অবশেষে ১৩ খন্ডে পরিণত হয় যা তিনি গোপনে জেলের বাইরে পাচার করেন। এসবই ১৯৯০ সালে My Escape to Freedom নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালে যখন তার কারাবাসের প্রায় অর্ধেক সমাপ্ত হয়, তখন তার সন্তানরা একদিন একটি গোপন খবর নিয়ে তার কাছে আসে। তাকে জানানো হয় যদি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা স্বীকার করে তিনি একটি দরখাস্ত দেন তবে তাকে মুক্ত করে দেয়া হবে। তার মেয়েরা এই মর্মে একটি দরখাস্ত লিখেও নিয়ে এসেছিল যাতে তাদের পিতা দরখাস্তে একটা স্বাক্ষর নিয়ে দেয়। আলীয়া দরখাণ্ডটি পড়েন, কিন্তু স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করেন। আলীয়া লিখেছেন :
My prison sentence continued: I had another five years yet to serve.
আমার বন্দী জীবন গড়িয়ে যাচ্ছে- এমনি করে আরো পাঁচ বছর আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
বিশ্বাসের জোর ছাড়া এটি কখনোই সম্ভব নয়। ঘটনা খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। তাকে আর বেশিদিন আটকে রাখা হয়নি। তিনি আর অতিরিক্ত চার মাস কারাভোগ করেন। পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পতনের লগ্নে এবং সেখানে গণতন্ত্রায়নের প্রেক্ষাপটে ১৯৮৮ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
তিন
কারামুক্তির পর আলীয়ার জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। তার ভাষায় ছয় বছর একাধারে কারাবাসের পর তিনি মাঝে এক বছর বিশ্রাম পান, তারপর এক নাগাড়ে দশ বছর বসনিয়া ও হারজেগোভিনা প্রেসিডেন্সির সদস্য হিসেবে কাজ করতে হয়। দীর্ঘদিনের কমিউনিষ্ট শাসনে বসনিয়া-হারজেগোভিনা তথা যুগোশ্লাভিয়া কাকরা হয়ে গিয়েছিল। আলীয়ার মতে দুর্বল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সার্বীয় আধিপত্য যুগোশ্লাভিয়ার পতনকে ত্বরান্বিত করে। এর উপর আলীয়া মনে করতেন কমিউনিজম আদর্শ হিসেবে খুব অনমনীয় প্রকৃতির যা কোনো রকমের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় না। কমিউনিজম হচ্ছে একটা All or nothing ব্যবস্থা। স্বাধীনতা ও কমিউনিজম এক সাথে চলতে পারে না। অন্যদিকে কমিউনিষ্ট শাসনে বসনিয়ার মুসলমানদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, তারা একটা প্রান্তিক অবস্থানে চলে আসে, তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। বসনিয়ার মুসলমানদের এমনি ক্রান্তিকালে তিনি Party of Democratic Action প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দেন, যার প্রতি বসনিয়ার মুসলমানদের সমর্থন প্রায় একচেটিয়া হয়ে দাঁড়ায়। বসনিয়ার স্বার্থ দেখবার জন্য আলীয়াকে তখন এক বৃহত্তর ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হয়।
আলীয়া তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি দলের কার্যনির্বাহী সভার বৈঠকে বিসমিল্লাহ বলে বক্তৃতা শুরু করেন, যা এতকালের কমিউনিস্ট শাসনে ছিল অকল্পনীয়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন:
I did so for two reasons: first I was quite sincerely appealing to the Almighty for help, and second, it was a mark of religious freedom and a clear signal of disobedience to the regime.
দুটি কারণে আমি এরকম করার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথমত আমি আন্তরিকভাবেই সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলাম। দ্বিতীয়টি এটা ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতীক এবং প্রশাসনকে অবজ্ঞা করার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
এ ঘটনাকে তিনি বসনিয়ার মুসলমানদের জন্য ফরাসী বিপ্লবের মতো তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। একই অনুষ্ঠানে তিনি কমিউনিজমকে বিদায় জানান এই ভাবে:
The giant attempt to create ‘heaven on earth’ without God and man, indeed even against God and man, has ended in total failure.
প্রভু ও মানুষ ব্যতিরেকে পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির মহাপরিকল্পনা, কার্যত প্রভু ও মানুষের বিরুদ্ধে চালিত পরিকল্পনা সর্বাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৯০ সালে তিনি বিপুল ভোটে বসনিয়া-হারজেগোভিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে বসনিয়া-হারজেগোভিনার জনগণের ইচ্ছায় বসনিয়া হারজেগোভিনাকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। আর এভাবেই আলীয়াকে নিয়তির অমোঘলীলায় তার জাতির জীবনের সবচেয়ে দুঃসময়ে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। বিশেষ করে আগ্রাসনের হাত থেকে বসনিয়ার স্বাধীনতা রক্ষা, বসনিয়ার খণ্ডীকরণে সার্বীয় চক্রান্ত রোধ এবং নিরীহ বসনীয়দের হত্যা ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা এখন থেকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
একালে বসনীয় যুদ্ধের নির্মমতা, পৈশাচিকতা ও ভয়াবহতার একটা ছবি বসনীয় লেখক কাসিম বেজিকের লেখায় উঠে এসেছে। আমি তার উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
History stepped up the pace in this part of the world. It was a time when hours were compressed into minutes, days into hours, months and years into days, is absolutely certain that never in recent history have so many unavoidable questions and quandaries about the world we live in been as concentrated as here in Bosnia.
পৃথিবীর এই প্রান্তে এসে ইতিহাসের গতি নিথর হয়ে গেছে। এটা এমন একটা সময় ঘন্টাগুলো সংকুচিত হয়ে মিনিটে দিনগুলো ঘন্টায়, মাস এবং বছরগুলো দিনে রূপান্তরিত হয়েছে। সমকালীন ইতিহাসে নজির নেই আমাদের পৃথিবীর এত সব প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার মতো নয় এবং সংশয়, এখানে বসনিয়ায় এসে স্তূপীকৃত হয়েছে।
এই ভয়াবহতার নির্মম সাক্ষী আলীয়া আলী ইজ্জেতবেগভিচ। বসনিয়ার যুদ্ধের কথা উঠলেই মনে পড়ে যাবে আলীয়ার কথা। এ যুদ্ধের প্রতিটি ঘটনার সাথে আলীয়া একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের তারবে প্রতিটি জনপদের মানুষের দুর্দশার সাথে আলীয়া যেন মিশে গিয়েছিলেন। আলীয়া ছাড়া বসনীয় যুদ্ধের কথা চিন্তাই করা যায় না। বসনীয় মানুষের প্রতিরোধ যুদ্ধের যে অপরাজেয় কাহিনী তার নির্মাণ আলীয়ার হাতেই সম্ভব হয়েছে। আলীয়ার নেতৃত্ব ছাড়া এ প্রতিরোধ যুদ্ধের কাহিনী হয়তো অন্যভাবে দেখা হতো। আলীয়ার কারণেই বসনিয়ায় আর একবার স্পেনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়নি।
১৯৯২ সালে এ যুদ্ধের শুরু। বসনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে সার্বীয় সেনা বসনিয়ার ভূখন্ডে প্রবেশ করতে শুরু করে। সার্বিয়ার সেনাবাহিনী ছিল মূলত প্রাক্তন যুগোশ্লাভ সেনাবাহিনীর অংশ যা কিনা স্নায়ুযুদ্ধ কালে ইউরোপের চতুর্থ সেনাবাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল। এই রকম একটি বাহিনী পূর্ণ শক্তি নিয়ে বসনিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যখন কিনা স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় বসনিয়ার সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই ছিল না। এভাবেই একটি নিরস্ত্র জাতির উপর সশস্ত্র অভিযান শুরু হলো। শুরু থেকেই সার্বিয়া বসনিয়ার স্বাধীনতার অস্বীকার করে আসছিল। তারা চাইছিল Greater Serbia। এই সশস্ত্র অভিযানের মাধ্যমে বসনিয়াকে সার্বিয়ার সাথে একীভূত করে ফেলাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু সার্বীয় পরিকল্পনার প্রধান বাধা হয়ে উঠল বসনিয়ার প্রতিরোধকামী জনতা, যারা আলীয়ার নেতৃত্বে রীতিমত জনযুদ্ধ শুরু করল। বলা চলে শূন্য থেকে আলীয়া অসীম ধৈর্য ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বসনিয়ার সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। অস্ত্র আমদানির উপর জাতিসংঘের অন্যায় নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তিনি তার দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নিরলস নেতৃত্ব দিয়ে যান। তার ভাষায়,
The arming of the Bosnian army is a moving story of human courage, determination and resourcefulness on an invisible battlefront for the survival of Bosnia.
বসনীয় সেনাদলের সশস্ত্রীকরণ মানবীয় সাহস, প্রতিজ্ঞা ও সামর্থ্যের এক সজল কাহিনী। যা এক অদৃশ্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে বসনীয়দের বাঁচার লড়াই হয়ে উঠেছিল।
পুরো যুদ্ধের সময় বসনিয়া হয়ে ওঠে একটা মৃত্যুপুরী। যুদ্ধাবস্থায় বসনিয়ার অবস্থা আলীয়া নিজেই বর্ণনা করেছেন একটি বক্তৃতায় যা তিনি হেলসিঙ্কির একটি সম্মেলনে দিয়েছিলেন:
Bosnia has become the battleground of genocide. She is now a country of concentration camps. Schools and sports stadiums have become torture chambers and sites of mass murders Not a single international humanitarian organization or reporter has been allowed to visit the occupied areas where, according to the deeply disturbing and moving accounts of surviving refugees, mass expulsions and murders are being carried out.
বসনিয়া কার্যত বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। এটিকে এখন একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের দেশ বলা যায়। স্কুল ও খেলার মাঠগুলো নির্যাতন ও গণহত্যার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অধিকৃত এলাকায় যেখানে সবচেয়ে গণউচ্ছেদ, হত্যা ও নির্মমতার ঘটনা ঘটেছে সেখানে কোনো আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা বা সাংবাদিককে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়নি।
এই পৈশাচিকতা ও নরমেধযজ্ঞের মধ্যে অবরুদ্ধ বসনিয়ার খাবার পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যন্ত ব্যাহত হয়। জাতিসংঘের পাঠানো মানবিক সাহায্য ও ত্রাণ পর্যন্ত সার্বীয়রা অবরুদ্ধ করে রাখা শহরগুলোতে পৌছাতে দেয়নি। বসনিয়ায় নিয়োগকৃত জাতিসংঘের বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে নরমেধযজ্ঞে সার্বীয়দের সহযোগিতা করেছে বলে শোনা গেছে। যুদ্ধাবস্থায় বসনিয়ার যে সব এলাকা জাতিসংঘ বাহিনী রক্ষা করবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, প্রয়োজনের সময় তা তারা করেনি। অনেক ক্ষেত্রে জাতিসংঘের বাহিনী নিরাপত্তা দেবে এই অজুহাতে বসনিয়ার কোন কোন অঞ্চলকে de militarize করা হয়েছে, অথচ সার্বীয় বাহিনী যখন সেই শহরের দিকে ছুটে এসেছে, জাতিসংঘ বাহিনী কোন টু শব্দটি করেনি। সেক্ষেত্রে নিরস্র বসনীয়রা কোন প্রতিরোধ ছাড়াই সার্বীয় পৈশাচিকতার শিকার হয়েছে। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে সেব্রেনিকায় জাতিসংঘ বাহিনী যা করেছে তা প্রকারান্তরে সার্বীয়দের পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকাই বলা যায়। প্যারিস ও লন্ডনের ভূমিকা ছিল রহস্যময়। পুরো যুদ্ধের সময় তারা সার্বীয়দের পক্ষ নিয়েছে, বসনিয়ার পক্ষে নিরাপত্তা পরিমন ও ন্যাটোর সিদ্ধান্তগুলো রুদ্ধ করে দিয়েছে তারাই। আর রাশিয়া সার্বীয়দের পক্ষে প্রকাশ্য রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা দিয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ধরি মাছ না ছুই পানির মতো। প্রথম দিকে তারা টু শব্দটি করেনি। ভাবটা এমন সার্বীয়রা যদি বসনিয়া দখল করে নিতে পারে তাতে তাদের আপত্তি নেই। মোট কথা পুরো পাশ্চাত্য জগত তখন বসনিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যাতে এটি কোনভাবেই টিকতে না পারে। তাতে যত প্রাণনাশই ঘটুক। কিন্তু পাশ্চাত্য যেভাবে চেয়েছিল বসনীয়রা ঠিক সেভাবে হতে দেয়নি। বসনীয়দের অপরিসীম প্রতিরোধ ক্ষমতা, অসীম আত্মত্যাগ ও উঁচু নৈতিক মনোবল পুরো পাশ্চাত্যের নীরব সমর্থনপুষ্ট সার্ব ও কতকাংশে ক্রোয়াট বাহিনীকে অবশেষে ঠেকিয়ে দিয়েছে। সার্বদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তির সামনেও বসনীয় বাহিনী দিনে দিনে শক্তিশালী হয়েছে । হ্যাঁ, এটা সত্য এই অসম যুদ্ধে বসনীয়দের চরম মূল্য দিতে হয়েছে, কিন্তু তাদেরকে পরাজিত করা যায়নি। বসনিয়া যেমন করে দুঃখ-দুর্দশার প্রতীকে পরিণত হয়েছে তেমনি প্রতিরোধের অজেয় চূড়া হিসেবেও প্রমাণিত হয়েছে। বসনিয়ার সারাজেতো হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিরোধের আর এক স্ট্যালিনার্ড। Juan Goytisolo লিখেছেন:
The tragedy of Bosnia is an unparalleled source of knowledge of the potential of the human species, the worst and the best alike.
বসনিয়ার বিয়োগান্তক ঘটনা মানুষের শক্তি ও সামর্থ্য, ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় অর্থে, বিবেচনার এক অতুলনীয় উৎস।
এমনি যখন অবস্থা তখন পাশ্চাত্য কি করছে? দিনের পর দিন বসনিয়া নিয়ে আলোচনা ও সম্মেলন করে দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে যাতে সার্বরা বসনিয়ার উপর পুরো দখল প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অন্যদিকে আগ্রাসন বন্ধ করার আদৌ কোনো চেষ্টা না করে বসনিয়ার জনগণ বিশেষ করে আলীয়ার উপর চাপ দেয়া হয়েছে সার্বদের সাথে আপোস করার জন্য। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নেমে পাশ্চাত্য এমনিভাবে বসনিয়ার নিরীহ ও আক্রান্ত মানুষকে নিয়ে কৌতুক ও তামাশা করেছে। আলীয়া লিখেছেন:
Now we are being asked to negotiate, as though nothing had happened. As though no cities had been ravaged, no one killed or expelled, no mistrust and hatred had been sown.
এখন আমাদেরকে আপোস করার কথা বলা হচ্ছে, যেন কোন কিছুই ঘটেনি। যেন কোন নগর বিধ্বস্ত হয়নি, কেউ মারা যায়নি বা উৎখাত হয়নি; কোন অবিশ্বাস বা ঘৃণার বীজ বপন করা হয়নি।
এরপর পাশ্চাত্য যখন দেখল বসনিয়ার মানুষকে কোনভাবেই কাবু করা যাচ্ছে না তখন তারা নিয়ে আসে নানারকম শাস্তি চুক্তির ফর্মুলা। এসব চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বসনিয়াকে ভাগ করে একটা আপাত স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা। এর মধ্যে ভাল-ওয়েন চুক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯১ সালের শুমারী অনুযায়ী বসনিয়া-হারজেগোভিনার মুসলিম জনসংখ্যা ৪৩.৪৭%, অথচ চুক্তিতে সারাজেভো ব্যতীত বসনীয়দের দেয়া হলো পুরো ভূখণ্ডের ২৬.৩৬% অংশ।
আলীয়ার ভাষায় :
It was an attempt to buy peace with this unprincipled compromise at the expense of the weaker.
এটা ছিল দুর্বলকে জিম্মি রেখে, এক নীতিহীন আপোসের পথে শান্তি ক্রয়ের চেষ্টা।
বসনীয় মুসলমানদের তখনকার প্রকৃত অবস্থাটা আরো ভালো করে বলেছেন Carl Bildt,
To put it simply, (the Muslims) could choose between having 30 percent authority over 100 percent of Bosnia or 100 percent influence over 30 percent of Bosnia…………… The alternative of 100 percent control over 100 percent of the territory of Bosnia did not and could not exist (Peace Journey The struggle for peace in Bosnia).
সহজ কথা হচ্ছে মুসলমানরা দুটির একটিই গ্রহণ করতে পারতো। ১০০ ভাগ বসনিয়ার উপর ৩০ ভাগ কর্তৃত্ব অথবা ৩০ ভাগ বসনিয়ার উপর ১০০ ভাগ প্রভাব। এর বিকল্প হিসেবে ১০০ ভাগ বসনিয়ার ভূখণ্ডের উপর ১০০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ মুসলমানদের কখনোই দেয়া হতো না।
এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক কেন বসনীয় মুসলমানরা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও বসনিয়ার মাত্র ৩০% ভূখণ্ডে পাবে। আলীয়ার ভাষায় :
This was European justice for the Bosnian Muslims.
বসনিয়ার মুসলমানদের জন্য এই ছিল ইউরোপীয় ন্যায়ের নমুনা।
জনগণের অসীম দুর্দশার কথা ভেবে আলীয়া ভাগ-ওয়েন চুক্তি যা কিনা মুসলমানদের প্রতি সীমাহীন বেইনসাফী করেছিল, তাও মেনে নিতে সম্মত হন। কিন্তু সার্বীয়দের একগুঁয়েমীতে সেটিও ভেস্তে যায়। যুদ্ধ যতই দীর্ঘ হতে চলছিল, বসনীয়রা ততই শক্তিশালী হচ্ছিল। একই সাথে তাদের প্রতিরোধের শক্তিও বাড়ছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা সার্বীয়দের হাত থেকে তাদের হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করার সফলতাও দেখিয়েছিল। এমনি সময় পাশ্চাত্য ন্যাটো হামলার প্রস্তুতি নেয় এবং ডেটন চুক্তির দিকে অগ্রসর হয়।
গুণগত দিক দিয়ে ডেটন চুক্তি ভাগ ওয়েন চুক্তির তুলনায় কিছুটা ভালো হলেও এখানেও বসনীয় মুসলমানদের উপর বেইনসাফী করা হয়েছিল। বসনীয় ভূখণ্ডের বিরাট অংশ সার্বীয়দের হাতে তুলে দেয়া হয়। ডেটন চুক্তির সময় যদিও আলীয়া ও তার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বসনীয় স্বার্থরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, বিশেষ করে আলীয়া এই বৃদ্ধ বয়সেও তার অনমনীয়তা ও দৃঢ়চিত্ততার যে নজির রাখেন তা পাশ্চাত্যের মধ্যস্থতাকারীদেরও কপালে ভাঁজ ফেলে দেয়। যদিও ডেটন চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আলীয়ার উপর পরাশক্তিগুলো প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল, তথাপি তিনি নিজের দাবি আদায়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। এটা সত্য আলীয়া ডেটন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু এটা না করে তখনকার মতো তার অন্য কোন বিকল্প ছিল কি? কোনো সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া একটা দুর্বল অবস্থানে থেকে পাশ্চাত্যের বৈরিতার মুখে তিনি আর কতকাল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতেন। যখন তাকে অবিরত হুমকি দেয়া হচ্ছিল ডেটন চুক্তি স্বাক্ষর না করলে জাতিসংঘ বাহিনী বসনিয়া থেকে ফিরিয়ে আনা হবে এবং কোন কিছুর জন্য আর পাশ্চাত্য দায়ী থাকবে না।
এটা অবশ্যই দুঃখজনক গত বিশ শতকে মুসলমানদের সংকটের দিনগুলোতে অধিকাংশ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় পাশ্চাত্যকে দেখা গেছে এবং মুসলিম দুনিয়া নিজের সমস্যা নিজে সমাধানে আদৌ সফল হয়নি। পাশ্চাত্য মধ্যস্থতাকারীরা উপর থেকে যা চাপিয়ে দিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম নেতৃত্ব তাই হজম করতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য মুসলিম দুনিয়ার অনৈক্য ও অনগ্রসরতার বাস্তব পটভূমিতে তারা কোন কোন ক্ষেত্রে এসব চাপিয়ে দেয়া ফর্মুলা মেনে নিতে সম্মত হয়েছেন। যেই এ ধরনের চাপিয়ে দেয়া ফর্মুলা মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন অথবা নিজের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন কিংবা পাশ্চাত্যের বাইরে নিজের সিদ্ধান্ত এগিয়ে নিতে অগ্রসর হয়েছেন তখনই তাকে বলা হয়েছে Incorrigible, incorrectable, কখনো কখনো Difficult person হিসেবে। আর এখনতো রাখ ঢাক না রেখেই বলা হচ্ছে Terrorist । আলীয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী হলব্রুকও একই কথা লিখেছেন। এখানে তিনি আলীয়ার প্রশংসা করেননি কিন্তু যা লিখেছেন তা আলীয়ার অনমনীয়তা ও দৃঢ়চিত্ততার ইঙ্গিত দেয়। পাশ্চাত্য যখন কাউকে প্রশংসা করতে পারে না, তখন ধরে নেয়া যেতে পারে তিনি মুসলিম বিশ্বের স্বার্থই রক্ষা করছেন। হলব্রুকের ভাষ্য:
At the centre of this tangle was the remarkable figure of Alija Izetbegovic. He had kept the idea of Bosnia alive under the most difficult circumstance At the age of seventy, after surviving eight years in Tito’s jails and four years of serb attacks, he saw politics as perpetual struggle, His eyes had a cold and distant gaze, after so much suffering, they seemed dead to anyone else’s pain. He reminded me a little of Mao Zadong and other radical chinese communist leaders good at revolution, poor at governance,
আট বছর এই ত্রিভুজের কেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ। খুব কঠিন সময়ের মধ্যেও তিনি বসনিয়ার ধারণা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তার চোখে টিটোর কারাভোগ এবং চার বছর ধরে সার্ব আক্রমণের পর সত্তর বছর বয়সেও তিনি রাজনীতিকে এক অবিরত সংগ্রাম হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। তার ছিল শীতল অথচ দূরবর্তী দৃষ্টি, অনেক কষ্ট ভোগের পর এগুলোকে মনে হতো অন্যের ব্যাথার ব্যাপারে উদাসীন। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে মাওসেতুং ও অন্যান্য চীনা বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতাদের প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন- বিপ্লবের জন্য তারা উপকারী হলেও, সরকার পরিচালনায় ছিলেন অদক্ষ।
একই রকম কথা বলেছিলেন মাউন্টব্যাটেন আমাদের উপমহাদেশের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে। এখানে মাউন্টব্যাটেন, ওখানে হলব্রুক। একই ছবি। একই চিত্র। একই রকম ঘটনা ঘটছে আজ ফিলিস্তিনে, ইরাকে, আফগানিস্তানে। যারাই মুসলমানদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলছে অথবা তাদের দাবির ব্যাপারে দৃঢ়চিত্ততা দেখাচ্ছে, তাদেরকেই ছাপ মেরে দেয়া হচ্ছে। পাশ্চাত্যের এই অপকৌশল আর কতকাল মুসলিম দুনিয়া নীরবে হজম করবে।
পাশ্চাত্য দুনিয়ার এই মোনাফেকী ও ভন্ডামিকে (তাদের ভাষায় এটি রাজনীতি) আলীয়া বলেছেন Inescapable Question, পাশ্চাত্য যে প্রশ্নের উত্তর আজও দেয়নি। এই নামে আলীয়া নিজের আত্মজীবনীও লিখেছেন যেখানে তিনি জীবনের কষ্টি পাথরে যাচাই করে পাশ্চাত্যের এই ছবি আমাদের সামনে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন, যা আমাদের দৃষ্টি খুলতে সাহায্য করতে পারে।
একালে বসনিয়ার যুদ্ধ কি আমাদের জন্য কোন শিক্ষা রেখে গেছে? যদি মুসলিম দুনিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয় তবে এটি তাদের অসীম ব্যর্থতার দলিল। শুধু মুখের কথা ছাড়া গভীর অর্থে মুসলিম দুনিয়া বসনিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছুই করতে পারেনি। আর যদি বসনিয়ার মুসলমানদের প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্লেষণ করা হয় তবে এটি সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধিতার গৌরবোজ্জ্বল নমুনা হয়ে থাকবে। বসনিয়ার বীর আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে শূন্য থেকে শুরু করে পরাক্রান্ত শত্রুকেও মোকাবিলা করা যায়। আজকে মুসলিম নেতৃত্ব পাশ্চাত্যের সামরিক আধিপত্যের সামনে রীতিমতো নতজানু ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন এবং মুসলিম দুনিয়ার উপর আপতিত সাম্রাজ্যবাদী হামলা ও চক্রান্ত মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা একেবারে নেই বললে চলে। আলীয়ার নেতৃত্ব আমাদের দেখিয়েছে আজকের দিনে সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলার রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল এবং এটিকে একালের মুসলিম নেতৃত্ব তাদের মডেল হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
জানীয়ার দুর্ভাগ্য তিনি চার্চিল হতে পারেননি। এমনকি স্নায়ুযুদ্ধকালে বরিস পাস্তেরনাক, আলেক্সান্ডার সোলজেনিৎসিন ও আদ্রে শাখারভরা যে রকম পশ্চিমা মিডিয়ার নজর কেড়েছিলেন তাও তার ভাগ্যে জোটেনি। কারণ তিনি জন্মগতভাবে ইউরাপের হলেও বিশ্বাসের দিক দিয়ে ছিলেন ইসলামের অনুসারী। তাই অমুসলিম নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এই দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীকে সঠিকভাবে তুলে ধরেনি। তার বুদ্ধিজীবিতা ও উচ্চমানসম্পন্ন রচনাবলীর সঠিক স্বীকৃতি দিতেও পাশ্চাত্য তার সাম্প্রদায়িক ভেদ-জ্ঞান অতিক্রম করতে পারেনি। আলীয়া যদি ঘটনাক্রমে ইউরোপীয় খ্রিস্টান কিংবা ইহুদী হতেন তবে এতদিন তার ভাগ্যে কয়েক ডজন আন্তর্জাতিক পুরস্কার মিলে যেত, তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে আমরাও তাকে যথার্থ অর্থে তুলে ধরতে পারিনি।
আলীয়ার দিক থেকে আর একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি জন্মেছিলেন ইউরোপের এক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে। জীবদ্দশায় তাকে অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়েছে স্বীয় সমাজের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। তার মেধা, মনন ও উচ্চমানসম্পন্ন বুদ্ধিজীবিতা যদি পুরো মুসলিম দুনিয়ার সমস্যা সমাধানের কাজে ব্যবহৃত হতো তবে মুসলমানরা আরো বেশি লাভবান হতে পারতো। তারপরে শত প্রতিকূলতার মুখেও ইসলাম ভাবনাই ছিল তার চিন্তাভাবনার কেন্দ্রস্থলে। তিনি মুসলিম দুনিয়ার সমস্যা নিয়েও ভেবেছেন, এবং তার সমাধানের কৌশল নিয়েও নাড়াচাড়া করেছেন। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে তেহরানে অনুষ্ঠিত ওআইসি কনফারেন্সে তিনি যে ভাষণ দেন তা এসব ভাবনারই প্রতিফলন। এ শুধু নিছক প্রতিনিধি দলের নেতার ভাষণ নয়, এ তার মনের গভীর প্রার্থনাও বটে। আমি এর কিয়দংশ উদ্ধৃত করছি :
Islam is the best, this is the truth-but we are not the best. Those two are different things and we always switch them, Instead of hating the West, we should compete with it. Did not the Qur’an order us to do just that: “Strive to achieve the virtue of deeds with the help of religion and science”, we can create the power that we need. It is a long and hard road, it is the Qur’an talks about, but there is no other way.
ইসলাম শ্রেষ্ঠ, এ কথা সত্য। কিন্তু আমরা শ্রেষ্ঠ হতে পারিনি। দুটি পুরোপুরি ভিন্ন জিনিস অথচ এটিকে আমরা গুলিয়ে ফেলি। পাশ্চাত্যকে ঘৃণা নয়, এর সাথে আমাদের প্রতিযোগিতায় আসা উচিত। কুরআন কি আমাদের সেটা করতেই বলেনি যে ভালো কাজের জন্য তোমরা প্রতিযোগিতা করো। এটা একটা দীর্ঘ এবং শক্ত রাস্তা, যার কথা কুরআন বলেছে, কিন্তু এর কোন বিকল্প নেই।
আলীয়া ইন্তেকাল করেছেন (১৯ অক্টোবর, ২০০০)। কিন্তু তিনি একটি মডেল রেখে গেছেন। এ মডেল কর্মের, অর্জনের, সংগ্রামের এবং যোগ্যতার। আলীয়া নিজেই একবার বলেছেন, কাজ ছাড়া আমি বেঁচে থাকার প্রয়োজন বোধ করি না। ইসলামী দুনিয়া যদি কার্যকরভাবেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চায় তবে আলীয়ার এ মডেল গভীর অর্থেই অনুসরণ করা যেতে পারে। শতাব্দীর আবর্জনা মুক্ত হয়ে ইসলাম আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছেছে। পতনের পথ পরিক্রমণ শেষে ইসলামের এই প্রত্যাবর্তনের লগ্নে আলীয়ার কণ্ঠস্বর আরো জোরে শুনতে পাচ্ছি।
তথ্যসূত্রঃ
- Alija Izetbegovic, Islamic Declaration. Quoted in Alija Izetbegovic, Inescapable Questions: Autobiographical Notes.
- আলীয়া আলী ইজ্জেততবেগভিচ, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও ইসলাম। তরজমা: ইফতেখার ইকবাল। ঢাকা : আমান পাবলিশার্স, ১৯৯৬।
- Alija Izetbegovic, Inescapable Questions Autobiographical Notes. Leicester The Islamic Foundation, 2003.
- Juan Goytisolo Sarajevo Note books. Quoted in Alija Izetbegovic, Inescapable Questions: Autobiographical Notes.