এক

১৯৭৯ সালে ইরানী জনতার অভ্যুত্থান ও আন্দোলনের মুখে সেখানকার বহু বছরের পুরনো কর্তৃত্ববাদী রেজা শাহ পাহলভীর রাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে। এই বৈপ্লবিক ঘটনার ভিতর দিয়ে যেমন একদিকে স্বৈরাচারী রেজা শাহ পাহলভীর অপসারণ সম্ভব হয় তেমনি সেখানকার মানুষ পাশ্চাত্য ঘেঁষা সরকার পদ্ধতি বাদ দিয়ে ইসলামকে ভিত্তি করে একালে এক ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়ে দেখে পাহলভী জামানার অইসলামীকৃত পরিচয় বদলে ফেলে ইরানের মানুষ ইসলামী পরিচয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে এবং এই পুনঃইসলামীকরণের পিছনে ইরানের শিয়া উলেমাদের এক সম্মোহনী নেতৃত্ব কাজ করেছে। এইসব উলেমারা জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বিপ্লবের মাধ্যমে একটি পূর্ণ পরিণতির দিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ইরানের শিয়া উলেমারা নানা ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে বরাবর এক বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে স্বাধীনভাবে জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে একাত্ম হয়ে তাদের কাজ করতে দেখা গেছে। পাহলভী জামানার ইরানের পশ্চিমনির্ভরতা, এর সংস্কৃতি-অর্থনীতি নিয়ে পশ্চিমের ষড়যন্ত্র, সর্বোপরি ইরানী মুসলমানদের আত্মপরিচয় নিয়ে টানাটানির বিরুদ্ধে এই সব উলেমারা এক সর্বাত্মক লড়াই শুরু করেন। ইরানী সমাজের এই আরোপিত পশ্চিমীকরণকে আলী শরিয়তি বলেছিলেন ঘারবজাদেগী পশ্চিমের সম্মোহন। এই সম্মোহন থেকে ইরানী সমাজকে আত্মরক্ষার জন্য শিয়া উলেমারা জনগণের ইসলামী চেতনাকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে আশুরা, কারবালা ও ইমাম হুসাইনের শাহাদৎ যা ইরানী সমাজে যুগ যুগ ধরে জুলুমের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রতীক হয়ে আছে সেটিকেই তারা রেজা পাহলভীর রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারের অবসানের লক্ষ্যে কাজে লাগান। ১৯৭৮ সালের মোহররম মাসে ইরানী উলেমারা রেজা শাহর স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অবসান ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। একই সাথে তারা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। পরবর্তী মোহররমে এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ইমাম খোমেনী এটিকে বিপ্লবের মহীমায় অভিষিক্ত করেন। এটা সত্য ইরানী বিপ্লবের রাজনৈতিক পরিকল্পনা, নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনার প্রধান স্থপতি ছিলেন ইমাম খোমেনী এবং তারই পরিচালনায় ইরানী উলেমারা এই বিপ্লবের ভিত প্রস্তুত করেন। কিন্তু এর প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি। ইরানী জনগণের অগ্রসর অংশের মানস পরিবর্তনে এবং একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐকমত্য সৃষ্টিতে অনেক চিন্তানায়কের ভূমিকা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। ফরাসী বিপ্লবের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন ভলতেয়র, কাদীদ, রবসপিয়েরের মত চিন্তানায়কেরা। তেমনি ইরানী বিপ্লবের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দেন ড. আলী শরিয়তি, আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহারী, ড. মাহদি বাজারগান প্রমুখ। এরা আধুনিক চিন্তাভাবনার সাথে গভীরভাবে পরিচিত ছিলেন। এই নবচিন্তার সাথে ইসলামী বিশ্বাসের সমন্বয় করে তারা ইসলামের জন্য এক নতুন পরিভাষা তৈরি করেন এবং সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিতজনের কাছে ইসলামকে উপস্থাপন করেন।

ড. আলী শরিয়তি ঠিক প্রথাগত শিয়া বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। অনেক শিয়া আলেমের মত তিনি শিয়াবাদের কথা না বলে ইসলামের কথাই বলেছেন বেশি। বৈশ্বিক ইসলামের পটভূমিতে বিচার করলে বলতে হয় ড. আলী শরিয়তির সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে শিয়া ও সুন্নী উভয়কেই তিনি মুসলমান মনে করতেন, এদের মধ্যে কোনো মৌলিক তফাৎ আছে বলে তিনি স্বীকার করতেন না। ইসলামের সর্বজনীনতা নিয়ে তার কোনো সন্দেহ ছিল না এবং এর আন্তর্জাতিক চরিত্রে তার পূর্ণমাত্রায় আস্থা ছিল। এটা সত্য ইরানী সমাজের ভিতরে কাজ করতে গিয়ে এবং ইরানী জনমানসের উজ্জীবনের জন্য তিনি শিয়াবাদের কথা বলেছেন কিন্তু তার শিয়া ইসলামের ব্যাখ্যা প্রথাগত চিন্তার থেকে সুস্পষ্ট ভাবে স্বাতন্ত্র্য দাবি করতে পারে। তিনি তার চিন্তাভাবনার পুনর্নির্মাণে শুধুমাত্র শিয়া উৎসকে ব্যবহার করেননি। অনেক সুন্নী চিন্তাভাবনাকেও অকৃপণভাবে গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে তিনি কবি ইকবালের চিন্তাভাবনা দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিলেন যিনি বলেছিলেন ইসলামী ব্যবস্থার আজ সংস্কার জরুরি হয়ে উঠেছে। এটিকে মনে রেখেই আলী শরিয়তি ইকবালের ধারণাগুলোকে আরো বিকশিত করার চেষ্টা করেন এবং তার স্বল্পায়ু জীবনে দেশোপযোগীভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করেও যান। তিনি জীবদ্দশায় বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন, এমনকি কিংবদন্তীতে পরিণত হন। তিনি লেখালেখি করেছেন, ইসলামের উপর বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা দিয়েছেন। এসব বক্তৃতা শুনবার জন্য হাজার হাজার মানুষ বিশেষ করে তরুণরা জমায়েত হতো এবং তার বক্তৃতার লক্ষ লক্ষ কপি বিতরণ করা হতো।

আলী শরিয়তি শিয়া ইসলামকে উদারীকরণের চেষ্টা করেন এবং আধুনিক জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করে একে ব্যাখ্যা করেন। ফ্রান্সের সোরবোর্নে পড়া এই বুদ্ধিজীবী এমিল ডারহিম, ম্যাক্স ওয়েবারের মতো সমাজতাত্ত্বিক এবং ফ্রানজ ফ্যানন, চে গুয়েভারার মতো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগঠকদের চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি এদের চিন্তাভাবনাকে প্রয়োজনমত ব্যবহারও করেন। এইভাবে ইরানে শুধু প্রাচীনপন্থী উলেমাদের কাছ থেকেই নয় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের কাছ থেকেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার ধ্বনি শোনা যেতে থাকে।

 

দুই

আলী শরিয়তির পরিবারের আদি নিবাস ছিল ইরানের খোরাসান প্রদেশে এবং পরিবারটির ধর্মীয় ঐতিহ্য, সমাজসেবা ও এলাকার জনগণের নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সুনাম ছিল। আলী শরিয়তির পিতা মোহাম্মদ তকি শরিয়তি ছিলেন আধুনিক ও ধর্মীয় উভয় শিক্ষায় সমৃদ্ধ এবং পেশায় একজন শিক্ষক। খোরাসানের গ্রাম মাজিনান থেকে তিনি মাশাদ শহরে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। শরিয়তির পিতা এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি ইসলামকে নিছক অতীতের এক অন্তর্মুখী চেতনা ও একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস হিসেবে মনে না করে একালের উপযোগী পুরোপুরি সামাজিক ও দার্শনিক প্রত্যয় হিসেবে বিবেচনা করতেন। ১৯৪০ এর দশকে তকি শরিয়তি মাশাদে কানুন-ই-পশর-এ- হাকায়েক-এ-ইসলামী (Centre for the Propagation of Islamic Truths) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটির উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিস্টদের নাস্তিকতার ধ্যান ধারণাকে ঠেকানো এবং এদের দ্বারা প্রভাবিত মুসলমানদের নতুন করে ইসলামী বৃত্তে ফিরিয়ে আনা। ১৯৫০ এর দশকে যখন রেজা শাহ পাহলভীকে স্বল্পকালের জন্য হঠিয়ে ইরানে ড. মোসাদ্দেকের জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এটি মাশাদের মোসাদ্দেকপন্থীদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং মোসাদ্দেককে নিয়ে মার্কিন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এর সদস্যরা সোচ্চার হয়। পিতার প্রেরণায় তরুণ আলী শরিয়তি তখন এটির সাথে যুক্ত হন।

 

আলী শরিয়তির জন্ম মাশাদ শহরে ১৯৩৩ সালের ২৪ নভেম্বর। এই শহরেই তার শৈশব ও যৌবনের দিনগুলো কাটে এবং এখানেই তার লেখাপড়ার হাতে-খড়ি। ১৯৪১ সালে আলী ইবনে ইয়ামিন স্কুলে ভর্তি হন, যেখানে তার পিতা শিক্ষকতা করতেন। স্কুলে তিনি ছিলেন নীরব, একাকী, কিছুটা অসামাজিক কিন্তু জ্ঞানী পিতার সাথে দীর্ঘরাত জেগে পড়াশুনায় তার ক্লান্তি ছিল না। স্কুলের পড়াশুনার চেয়ে তার পাঠ্যবহির্ভূত বই পড়ায় আগ্রহ ছিল বেশি। প্রাথমিক স্কুলে থাকবার সময়ই আলী ফারসীতে অনূদিত লা মিজারেবল পড়ে শেষ করেন এবং এসময় ভিটামিন ও সিনেমার ইতিহাসের মতো বিষয়ও তার পড়ার তালিকাভুক্ত হয়।

উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে পড়বার সময় দর্শন ও সুফীবাদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। এসময় তার পিতার প্রতিষ্ঠিত Centre for the Propagation of Islamic Truths আলোচনায় আলীর অনেক বন্ধু-বান্ধব অংশগ্রহণ করলেও তিনি তার জ্ঞানী পিতার ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতেই থাকা বেশী পছন্দ করতেন। যদিও পরবর্তীকালে আলী স্বীকার করেছেন তার ব্যক্তিত্ব নির্মাণে এবং তার ভিতরকার স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা ও বিশ্বাসের ধারণা তৈরীতে তার পিতার প্রেরণাই ছিল মুখ্য। একই সাথে বাসায় বসে নিজের মতো করে পড়াশুনা তাকে আরো স্বনির্ভর ও ভয়ানক রকম আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। পরবর্তীতে এসময়কার অবস্থা সম্বন্ধে তিনি একটু গর্বের সাথেই উচ্চারণ করেছিলেন:

In each of my classes I was 100 lessons ahead of the rest of the class and 99 ahead of my teachers.

তার পড়াশুনার মধ্যে ধর্মীয় বিষয়সমূহের চেয়ে সাহিত্য ও দর্শনই ছিল প্রিয় বিশেষ করে ইরানী ঔপন্যাসিক সাদেকী হেদায়েত, ইরানী কবি নিমা ইউশিজ, আখবানে সালেস ও বেলজীয় লেখক মরিচ মেটারলিংক এসে জায়গা করে নেয়। মেটারলিংকের একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি শরিয়তিকে কিভাবে দর্শনের ব্যাপারে আগ্রহী করেছিল তাও তিনি বিশদভাবে বলেছেন। উদ্ধৃতিটি ছিল এরকম: When we blow out a candle, where does its flame go?

শরিয়তির বর্ণনা থেকে জানা যায়, তার তরুণ বয়সে এই সর্বভুক পড়াশুনা তাকে এক ভয়ংকর আত্মা, মনন ও ব্যক্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয়। বিশেষ করে মেটারলিংক, শপেনহায়ার, কাফকা ও সাদেকী হেদায়েত পড়তে গিয়ে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। তার নিজেকে দার্শনিকভাবে মৃত মনে হয় যার পরিণতি হয় আত্মহত্যা অথবা উন্মাদ হয়ে যাওয়া। আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এই পৃথিবীর অস্তিত্ব ভাবা তার জন্য অবান্তর মনে হয় এবং তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। এই রকম মানসিক অবস্থায় মাশায়ে এক রোমাঞ্চকর শীতের রাত্রিতে তিনি যখন আত্মঘাতী হওয়ার কথা ভাবছেন তখন তিনি মওলানা রুমীর মসনভীর মধ্যে প্রশান্তি, আশ্বাস ও নিরাপত্তা খুঁজে পান। রুমীর মসনভী হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনের সারাৎসার। সেই রাতে মসনভীর বাণী ও চিন্তা শরিয়তিকে আত্মহনন থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং রুমীর আধ্যাত্মিকতা তার ভবিষ্যৎ জীবনের পাথেয় ও নির্দেশিকা হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে শরিয়তি যখন মানবমুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন তখন তিনি আধ্যাত্মিকতার সাথে সমতা ও স্বাধীনতা, এই তিন বৈশিষ্ট্যকে মানুষের মৌলিক অধিকার ও চাহিদা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

১৯৫০ সালে শরিয়তি হাইস্কুল ছেড়ে মাশাদ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই দু’বছর পর তিনি স্নাতক হন। আগেই বলেছি রুমীর প্রভাবে এসময় তার মনের অস্থিরতা, কুয়াশা, দার্শনিক দ্বিধা, অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাসের জ্বালামুখ শান্ত হয়ে আসে এবং ইসলামকে তিনি নতুন করে জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর বিচারে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার মুক্তিমন্ত্র হিসেবে আবিষ্কার করেন। একই সাথে রসুল (সঃ) এর বিপ্লবী সাহাবী আবু জর গিফারীকে নতুন ইসলামী সমাজের জন্য মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেন। শরিয়তির ইসলামে ফিরে আসা ও নব আবিষ্কৃত প্রশান্তির নমুনা দেখতে পাওয়া যায় ১৯৫৩ থেকে ৫৬’র মধ্যকার সময়ে তার লেখা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বই তারিখ-এ-তাকামল- এ-ফালসাফা (History of the Development of Philosophy) ও আবু জর গিফারী-তে। দু’টি বইতেই তিনি ইসলামকে সমকালীন অন্যান্য দার্শনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারা থেকে পৃথক করে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন এবং ইসলামকে তার অন্তর্মুখীনতা ও অতীতমুখীনতা থেকে বের করে এনে সমকালীন সামাজিক সমস্যার সাথে মিলিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে এর আধুনিকায়ন ও রাজনীতিকরণের চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া তিনি এখানে একজন প্রত্যয়ী মুসলমানের উদ্দেশ্য ও তার রাজনৈতিক-সামাজিক ভূমিকার কথা বলেছেন। এ দু’টো বইতে নেহজাদ-এ-খোদা- পারাস্তান-এ-সোশালিস্ট (Movement of God-Worshipping Socialists) কর্মীদের চিন্তাভাবনার প্রভাব সুস্পষ্ট ভাবে পড়েছে, যারা এক সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও ড. মোসাদ্দেককে সমর্থনের সূত্রে তার পিতার Centre for the Propagation of Islamic Truths এর সাথে যুক্ত হয়েছিল এবং সেই সাথে শরিয়তিও তাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন।

শরিয়তি তার বই আবু জর গিফারীতে নিজের জন্য একটি ‘হিরো’, ‘মডেল’ এবং একই সাথে ‘সিম্বল’ তৈরি করেছেন যে কিনা দরিদ্র, মজলুম অথচ সচেতন মুসলমানদের ‘প্রকৃত ইসলামকে’ রক্ষা করতে ধন-সম্পদ, ক্ষমতা এমনকি ধর্মীয় কর্তৃত্বকেও অস্বীকার করতে পারে। এ বইতে দেখানো হয়েছে এক ব্যক্তি কিভাবে ইসলামী সাম্রাজ্যের ক্ষমতাবান শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।

আসলে আবু জর হচ্ছে শরিয়তির প্রতীকী সৃষ্টি। এটা তাদের জন্যই লেখা হয়েছিল যারা নাকি পরবর্তীকালে তার কাছাকাছি এসেছিল এবং একই সাথে তার চিন্তাভাবনা দ্বারাও উজ্জীবিত হয়েছিল। এ বই হচ্ছে সেই সব প্রত্যয়ী, অপরাজেয় ও বিপ্লবী মুসলমানদের জন্য যারা সমতা, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার ও মুক্তির বাণী প্রচার করে থাকে।

এ বইয়ের ঐতিহাসিকতা বিচার মুখ্য নয়। এর মধ্যে আমরা দেখি ভবিষ্যৎ শরিয়তির পূর্ণ সম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতিকে যেখানে তিনি এক অবিশ্বাসের যুগে বসে ইসলামের নীতি ও মূল্যবোধের কথা দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারণ করেছেন এবং সমকালীন জুলুমবাজ সরকারের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণে ছিলেন অকপট ও দ্বিধাহীন। মোটকথা শরিয়তির আবু জর আবিষ্কার তাকে আশ্বস্ত করেছিল সামাজিক সুবিচার, সমতা, মুক্তি ও সমাজতন্ত্রের যে ধারণা পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের সূত্র ধরে ইরানে পৌঁছেছিল তা আসলে ইসলামের নীতি ও ঐতিহ্যের অংশ। এই কারণেই শরিয়তি গর্বের সাথে দাবি করতে পেরেছিলেন:

Abu Zar is the fore father of all post French Revolution egalitarian schools.

এটা সত্য তরুণ বয়সে শরিয়তির আবু জরকে নিয়ে এক ধরনের অতিভক্তি থাকলেও পরিণত বয়সে তা অবিমিশ্র শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হয় এবং তার প্রতি আন্তরিকতায় তার কখনোই ঘাটতি হয়নি। তিনি তার বইতে আবু জরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন:

…the righteous and responsible Muslim who resisted all deviations from the egalitarian and fraternal Islam of the Prophet.8

এক সময় শরিয়তি নিজেকে আবু জরের অনুসারী হিসেবে দাবী করেন এবং বলেন তার ব্যাখ্যাত ইসলাম, শিয়াবাদ, আদর্শ ও কর্মসূচী আসলে আবু জরের দৃষ্টান্ত থেকেই পাওয়া। শরিয়তি নিজের সম্পর্কে বলেছেন তার আজকের অবস্থানের সাথে আবু জরের সংগ্রাম ও অবস্থানের মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ নেই। এই কারণেই শরিয়তির ইন্তেকালের পর তার অনুরাগীরা তাকে একালের আবু জর হিসেবে সম্মানিত করে। এমনকি আবু জর সম্পর্কে রসুলের (সঃ) বিখ্যাত উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে শরিয়তির অনুসারীরা তার সম্পর্কে বলে:

He lives alone, he dies alone, and he shall be resurrected alone.

– তিনি একাকী জীবন ধারণ করেছেন, একাকী ইন্তেকাল করেছেন এবং একাকী তার পুনরুত্থান ঘটবে।

 

তিন

পঞ্চাশের দশকে ইরানে রেজা শাহ পাহলভীবিরোধী আন্দোলন রীতিমত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল এবং এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন সেখানকার জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক নেতা ড. মোসাদ্দেক। মোসাদ্দেকের স্বল্পকালীন গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী সরকার তখনকার মতো হয়ে উঠেছিল ইরানের স্বাধীনতাকামী মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে। সকল জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীর মতো তরুণ শরিয়তিও সেদিন মোসাদ্দেকপন্থী মিছিল, সমাবেশ ও আলোচনায় সক্রিয় অংশ নেন। এসময় মাশাদে শরিয়তিসহ ১৬ জন তরুণ বুদ্ধিজীবী যারা মোহাম্মদ তকি শরিয়তির ইসলামী কেন্দ্রটির সাথে যুক্ত ছিলেন, আস্তিক সমাজতন্ত্রীদের আন্দোলনের (Movement of God Worshipping Socialists) সাথে যুক্ত হন। আস্তিক সমাজতন্ত্রীরা ইসলামের সাথে সমাজতন্ত্রের এক ধরনের মিল মিশাল দেন এবং দাবি করেন ইসলামের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা হচ্ছে তৌহীদভিত্তিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামান্তর। তাদের পত্রিকা সরাসরি সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদ উৎখাতের আহ্বান জানায় এবং হযরত রসুল (সঃ) ও ইমাম আলীকে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রকৃত পূর্বসূরী হিসেবে উল্লেখ করে। আস্তিক সমাজতন্ত্রীদের এই আন্দোলন পরবর্তীকালে মোসাদ্দেকপন্থী জাতীয় ফ্রন্টের সাথে মিলিতভাবে হিজবে ইরান Iran Party গঠন করে। তারও পরে এটি নাম বদলে প্রথমে জমিয়ত আজাদী-এ-মরদম-এ-ইরান (League for the Freedom of the Iranian People) এবং মোসাদ্দেক সরকারের পতনের পর হিজব- এ-মরদম-এ-ইরান (Party of the Iranian People) নাম নেয়। এসব আন্দোলনের সাথে আলী শরিয়তি কোনো না কোনভাবে জড়িত ছিলেন।

১৯৫৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ড. মোসাদ্দেকের জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটলে ইরানের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এক বড় রকমের ধাক্কা খায় এবং মোসাদ্দেকের স্বল্পায়ু সংসদীয় গণতন্ত্রের এই পরিণতিতে জনপ্রিয় আন্দোলনের কর্মীরা হতাশায় ভুগতে থাকে। ইরানী সমাজের এই ধরনের পরিস্থিতিতে আলী শরিয়তি দ্বিতীয়বারের মতো ব্যক্তিত্বের সংকটে পড়েন এবং ১৯৫৬ থেকে ৫৮ সালের মধ্যে তিনি বারবার আত্মমূল্যায়ন করেন ও সমাধানের পথ খুঁজতে থাকেন। মোসাদ্দেকের পতনে তিনি এতখানি মর্মাহত হন যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে তার বিশ্বাস দোদুল্যমান হয়ে ওঠে। একদিকে যেমন তিনি স্বাধীনতার প্রতি গভীর অনুরাগ ও মোসাদ্দেককে এর প্রতীক হিসেবে খাড়া করেন পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রকে একটি দুর্বল রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবেও তিনি মূল্যায়ন করেন। মোসাদ্দেকের পতনের পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকাতো ছিলই, এর সাথে যুক্ত হয়েছিল একশ্রেণীর সুবিধাভোগী দেশীয় সামরিক ও রাজতান্ত্রিক এলিট গোষ্ঠী ও সুযোগ সন্ধানী একদল দরবারী আলেম। এই ত্রয়ী শক্তিকে আলী শরিয়তি তার অসাধারণ মনন ও শ্লেষের মিশ্রণে জনপ্রিয় একটি ফারসী বাকরীতি নির্মাণ করে চিহ্নিত করেন। এটি হলো জার-ও-জুর-ও-তাজবীর যার অর্থ সম্পদ, জুলুম ও প্রতারণা। শরিয়তি সম্পদকে পুঁজিবাদের সাথে, সাম্রাজ্যবাদকে জুলুমের সাথে এবং সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকে প্রতারণার সাথে তুলনা করেছেন।

১৯৫৩’র অভ্যুত্থানের পর শরিয়তি মোসাদ্দেকপন্থী National Resistance Movement এর সাথে যুক্ত হন। এইসব দিনের কথা স্মরণ করে শরিয়তি পরবর্তীকালে উল্লেখ করেছেন সেসময় তিনি স্বৈরাচারী পাহলভী সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ও সমাবেশ সংগঠনের চেষ্টা করতেন এবং বই ও প্রচারপত্র প্রকাশ করতেন। এসব কারণে তিনি তখন স্বল্প মেয়াদে জেলও খাটেন। রাজনৈতিক কর্মসূচীর পাশাপাশি ১৯৫৪ সালে শরিয়তি ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিয়ে পাসও করেন। এ সময় তিনি খোরাসান পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন এবং এখান থেকেই তার কবি ও সাহিত্য প্রতিভার সত্যিকারের বিকাশ ঘটে। ১৯৫৪ সালে মাশাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিভাগে শরিয়তি ভর্তি হন। নিজের শিক্ষকতার চাকরির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষা কার্যক্রমেও তিনি অসাধারণ সাফল্যের পরিচয় দেন। সাহিত্যের প্রতি তার সহজাত অনুরাগ ও ভালবাসা, পাঠ্য বিষয়ের উপর তার অধিকার ও জ্ঞান তাকে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। মাশাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহলেও তার একটি পরিচিতি গড়ে ওঠে। শুধু কবি হিসেবে নয় এসময় প্রথাবিরোধী, প্রগতিশীল ও ইসলামের আধুনিক ব্যাখ্যাতা হিসেবেও তার নাম উচ্চারিত হতে থাকে। ১৯৫৭ সালে পাহলভী সরকার National Resistance Movement এর নেতা কর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে। আলী শরিয়তি ও তার পিতা তকি শরিয়তিসহ National Resistance Movement এর ১৪ জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে গ্রেফতার করে তেহরান নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে কারাবন্দী করা হয়। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল এরা মোসাদ্দেকপন্থী। এক মাস পর আলী শরিয়তিকে মুক্তি দেয়া হয়। কারামুক্তির পর মাশাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরিয়তি ফারসী সাহিত্যে বিএ ডিগ্রি নেন। পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের কারণে বিদেশে পড়বার জন্য তাকে বৃত্তি দেয়া হয়। ১৯৫৯ সালে শরিয়তি প্যারিসে গমন করেন।

 

চার

প্যারিস কি শরিয়তিকে কাছে টেনেছিল অথবা শরিয়তি প্যারিসকে ভালবেসেছিলেন তা বলা শক্ত ব্যাপার। শরিয়তি যদি নিছক প্যারিসে লেখাপড়া করতেই আসতেন তবে তার এখানে পাঁচ বছরের অবস্থান নিছক বৈচিত্র্যহীন একটা ঘটনা হয়ে থাকতো। কিন্তু শরিয়তির প্যারিস জীবন কেটেছে একদিকে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চায় অন্যদিকে বিপ্লব ও মানবমুক্তির স্বপ্ন দেখে। প্যারিসের সাথে তৈরি হয় তার এক দ্বন্দ-মধুর সম্পর্ক। শরিয়তি যখন প্যারিসে যান তখন তিনি ছিলেন ইরানের প্রাদেশিক স্তরের একজন তরুণ ভাবুক। প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় পুঁজিবাদী অবক্ষয় ও নৈতিক বিচ্যুতির ছড়াছড়ি বিশেষ করে রাস্তার মেয়ে, ক্যাবারে, ক্যাসিনো তাকে হতচকিত করে দেয়। শরিয়তির মনে হয় এই সভ্যতার কাছে সংস্কৃতির ভিন্নতা সত্ত্বেও যে কেউ ধরা দিলে এটি তাকে গিলে হজম করে ফেলে এবং তার আধ্যাত্মিকতা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে এক দুর্জেয় বস্তুসভ্যতার পূজারী বানিয়ে দেয়। অন্যদিকে প্যারিসের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি, এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আলোকিত চেহারা তাকে সম্মোহিত করে। পরবর্তীকালে শরিয়তি স্বীকার করেছেন প্যারিসের শিক্ষকরা তাকে হাত ধরে জ্ঞানের রাজ্যের সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে আসে যেখানে তিনি মানবীয় উৎকর্ষতার এক উজ্জ্বল চেহারা দেখতে পান, যা ছাড়া তার মনে হয় তিনি অসম্পূর্ণ ও অপরিণত রয়ে যেতেন।

প্যারিসে বসে শরিয়তির মনে হয় পশ্চিমী আধুনিকতা, বস্তুগত সমৃদ্ধি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রভৃতির ধারণা এখানে আগত তৃতীয় দুনিয়ার বুদ্ধিজীবীদের হতবুদ্ধি করে দেয় এবং তারা তাদের বিশ্বাসকে পশ্চিমী বুর্জোয়া চিন্তাভাবনার আলোকে নতুন করে নির্মাণ করে। তারা যখন দেশে ফিরে যায় তখন তারা পশ্চিমী মডেলের উপর ভিত্তি করে তাদের স্বদেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা নেয়। শরিয়তির দৃষ্টিতে এইসব বুদ্ধিজীবীরা: … such intellectuals became the Trojan horse of colonialism and imperialism, further cementing the dependence and under development of third-world countries.

শরিয়তি পশ্চিমী সভ্যতার আলোকিত বা বিকৃত করার উভয় সামর্থ্যকে বিশ্লেষণ করেন। একই সাথে তিনি পশ্চিমের অভিঘাতে তৃতীয় দুনিয়ায় দুই দল বুদ্ধিজীবীর উত্থানকেও চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। প্রথম দল নিজেদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে পুরোপুরি পশ্চিমী মূল্যবোধ ও আদর্শকে আপন করে নিয়েছেন। এই সব পশ্চিমীকৃত বুদ্ধিজীবীরা, শরিয়তির নিজের বুদ্ধিজীবীতার সংজ্ঞায় যারা পড়েন না তারা অহর্নিশ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনধারাকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ ও ‘অপর্যাপ্ত’ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং আধুনিকতা ও সভ্যতার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় দল শরিয়তি যাদেরকে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী বলেছেন তারা নবী রসুলদের ওহীর যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তাদের ঐতিহ্যকে এই অবিশ্বাস ও যুক্তির যুগে বহন করে চলেছেন। আলী শরিয়তি মনে করেন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী হচ্ছে সেই যার থাকবে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জনগণের চেতনা কেন্দ্রে টোকা দেয়ার ক্ষমতা। এই কাজ করতে হলে তার দরকার হবে নিজ সমাজ ও বিশ্বাস সম্পর্কে গভীর জানাশোনা। সেই হিসেবে বলা যায় আলী শরিয়তি ছিলেন মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মডেল।

আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের কাছে ইসলাম মানে হচ্ছে কুসংস্কার, অচলতা, জীবন বিমুখতা ও প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লা মৌলভীদের ধর্মের রক্ষক হিসেবে দাপাদাপি। এটির চরিত্র হলো প্রগতি ও পরিবর্তন বিরুদ্ধ। বুদ্ধিজীবী হিসেবে শরিয়তির ভূমিকা হচ্ছে ইসলামকে তিনি গতিশীল ও কর্মোদ্দীপক ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার কথা হলো ইসলামের প্রকৃত বাণী ও নীতিসমূহ আসলে মুক্তি, স্বাধীনতা, সমতা ও আধ্যাত্মিকতার ধারণা নিয়েই কাজ করে এবং এটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ইসলামের আগমন। নিজের ব্যাখ্যাত ইসলাম চিন্তা থেকে শরিয়তি প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লা ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর ব্যাখ্যাত ইসলামকে পৃথকভাবে দেখেছেন, যারা নাকি ইসলামকে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার হিসেবে অনেক সময় ব্যবহার করেছে। আলী শরিয়তি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন, এমনকি মুসলিম দেশগুলোর আধুনিকায়নের নামে তিনি অন্ধ পশ্চিমীকরণের বিপক্ষেও ছিলেন কিন্তু তার এই পশ্চিম বিরোধিতার মুড কখনো সাম্প্রদায়িকতার সীমা স্পর্শ করেনি। তিনি তার পশ্চিমী শিক্ষকদের ঋণ অকুষ্ঠভাবে স্বীকার করেছেন এবং তাদের কাছ থেকেই তিনি তাদের সমাজের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিটি গ্রহণ করেছেন। শরিয়তির পশ্চিমী শিক্ষা শিয়াবাদের উপর অশিয়াদের বৌদ্ধিক ও মননশীল লেখালেখি ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দিকে তার চোখ খুলে দেয়। শেষ পর্যন্ত তার শিয়াবাদ প্রথাগত শিয়া চিন্তাভাবনা থেকে ভিন্ন রকম হয়ে দাঁড়ায়। নিছক শিয়া আত্মপরিচয়ের বদলে তিনি বর্তমানের আর্থ-সামাজিক ইস্যুগুলোর ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণে আগ্রহী ছিলেন বেশি। সংস্কারক হিসেবে তিনি সেইসব ইসলামবাদীদের অগ্রাধিকার দিয়েছেন যারা নাকি ইসলামের একটি সমতাবাদী, মানবিক, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও অপরাজেয় ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে। শিয়াবাদী বুদ্ধিজীবী ও আইনজ্ঞ ছাড়াও শরিয়তি নিজ প্রয়োজনে উদারভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে সাহায্য নিয়েছেন। যার ফলে সমালোচকরা তাকে সুন্নী বা ওহাবী হয়ে গিয়েছে এমন অভিযোগও করেছে। এমনকি তিনি ফরাসী ক্যাথলিক ইসলামবাদী লুই ম্যাসিগনন, ইহুদী বুদ্ধিজীবী ম্যাক্সিম রডিনসন, খ্রিস্টান চিকিৎসক ও লেখক সুলায়মান কাতানী ও জর্জ জুরডাকের লেখালেখির উদাহরণ দিয়ে বলেছেন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে এদের আগ্রহ, সচেতনতা ও উদারতার মূল্যচেতনা থেকে প্রথাগত শিয়া উলেমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

শরিয়তি তার ফরাসী শিক্ষক লুই ম্যাসিগননকে নিয়ে ‘My Idol’ বলে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। প্যারিসে অবস্থানকালে ১৯৬০-৬২’র মধ্যে তিনি এই শিক্ষকের অধীনে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। ঐ নিবন্ধে তিনি ম্যাসিগননকে একজন সত্যিকারের মননশীল প্রতিভা, পূর্ণ মনুষ্যত্বসম্পন্ন ও প্রেমময় আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছেন। শরিয়তি তার আত্মকথায় জানিয়েছেন ম্যাসিগননের স্পর্শে তার অন্তর্জগতে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়।

 

প্যারিসে আসবার পর শরিয়তি রুমীর মসনভী পড়ে এই কামনা করেছিলেন তিনি যেন পশ্চিমী সমাজের ভয়াবহ বস্তুবাদিতা ও দুর্জেয়তা থেকে নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারেন। ম্যাসিগননকে আবিষ্কার করে শরিয়তি সেই পশ্চিমী বিকল্প খুঁজে পান। রুমী যেমন করে তার প্রথম যৌবনে দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা এনে দিয়েছিলেন তেমনি করে ম্যাসিগনন পরিণত যৌবনে তাকে আশ্বস্ত করেন। তার সম্পর্কে শরিয়তি লিখেছেন: He taught me the art of seeing’। প্যারিসে বসে শরিয়তি ম্যাসিগননকৃত বই ‘সালমান ফারসীর’ ইরানী ভাষায় তরজমা শুরু করেন।

প্যারিসে ম্যাসিগননের পরে শরিয়তি সবচেয়ে উদ্বুদ্ধ হন রাশিয়ায় জন্ম ইহুদী পন্ডিত জর্জ গুরভিচের সাহচর্যে যিনি আমৃত্যু ফ্যাসিস্ট ও স্ট্যালিনবাদী স্বৈরাচারের সাথে লড়াই করেছেন এবং আলজেরিয়ায় ফরাসী উপনিবেশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। সমাজবিজ্ঞানে গুরভিচ ছিলেন শরিয়তির গুরু এবং এই গুরুর মধ্যে তিনি পশ্চিমের আবু জরকে আবিষ্কার করেছিলেন। পিতার কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেছিলেন গুরভিচ যেভাবে মানুষের উপর সবরকমের অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন তাই আসলে শিয়াবাদের মূল চেতনা যার থেকে আজকালকার প্রথাগত আলেমরা সরে এসেছেন।

শরিয়তি প্যারিসে অবস্থানকালে যেমন নিত্য নতুন চিন্তাভাবনার মুখোমুখি হয়েছেন তেমনি বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, কবি ও শিল্পীদের বক্তৃতা শুনেছেন, তাদের বই পড়েছেন। কখনো তাদের সাথে ভাব বিনিময় করেছেন এবং সেখানকার শিল্পী ও স্থপতিদের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। এই সময় আলজেরিয়ার মুসলমানরা ফরাসী উপনিবেশের বিরুদ্ধে এক জীবন-মরণ জেহাদে লিপ্ত ছিল। আলজেরিয়ার মুসলিম জনতার উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই লড়াই থেকে শরিয়তি নিজেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারেননি। তিনি নিজেকে এর সাথে শরিক হিসেবেই পুরো ঘটনাপ্রবাহকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। এই উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের একটি সশস্ত্র চরিত্র ছিল অবশ্যই কিন্তু এ লড়াই বিশ্বের বিশেষ করে তৃতীয় দুনিয়ার বিভিন্ন ভাবুকদের সাম্রাজ্যবাদের অন্তর্গত চরিত্র নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল। এ প্রসঙ্গে ফ্রানজ ফ্যাননের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ফ্যানন আলজেরিয়ার উপনিবেশবিরোধী বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন এবং বহু লেখালেখি করেছিলেন। ফ্যাননকে ইউরোপে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জাঁ পল সাত্রে। ফ্যাননের সাথে শরিয়তির যোগাযোগ হয়েছিল বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে ইসলামের ভূমিকা নিয়ে তারা মতবিনিময় করেছিলেন যা ফ্যাননের একটি আগ্রহের বিষয় ছিল। শরিয়তি ফ্যাননের A Dying Colonialism Wretched of the Earth বই দু’টো ফারসীতে তরজমা করেছিলেন। বিশেষ করে শেষোক্ত বইটিতে আলজেরিয় বিপ্লবের যে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ রয়েছে তাকে তিনি সাম্রাজ্যবাদনির্ভর পাহলভী সরকারের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ফ্যানন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে তৃতীয় বিশ্বের সংহতি ও আন্তর্জাতিকতাবাদের উপর জোর দিয়েছেন এবং ইউরোপীয় উন্নয়নের মডেলের বাইরে তৃতীয় বিশ্বের ‘নতুন মানুষ’, ‘নতুন তত্ত্ব’ ও ‘নতুন ইতিহাস’ নির্মাণের কথা বলেছেন। শরিয়তি এই চিন্তারই প্রতিধ্বনি করে ইরানী জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। এসময় শরিয়তির লেখালেখিতে ফ্যাননের বাকরীতির প্রভাব দেখা যায়:

Come friends, let us abandon Europe, let us cease this nauseating. apish imitation of Europe Let us leave behind this Europe that always speaks of humanity, but destroys human beings whenever it finds them.

শরিয়তি ফ্রানজ ফ্যাননের মতো আফ্রিকার বিপ্লবী চিন্তাবিদ উমর উজগানকেও ইরানীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তার বই আফজাল আল জিহাদ ফারসীতে তরজমা করেন। তখনকার মতো তার মনে হয়েছিল আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে জনপ্রিয় ইসলামী আন্দোলন ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের ধরন ইরানী মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট তৈরিতে সহায়ক হবে।

ইউরোপের বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখি ও সংস্পর্শ শরিয়তির চিন্তাভাবনাকে উন্মুক্ত করেছিল অবশ্যই কিন্তু তাকে বশীভূত করতে পারেনি। বরং এটি তার ধারণা ও চিন্তাগুলোর মৌলিকত্ব ও নতুনত্ব বিকাশে সহায়তা করেছে। কখনো কখনো তিনি ইউরোপীয় চিন্তাকে নিজের ছাঁচে গড়েও নিয়েছেন।

প্যারিসে শরিয়তি সমাজ বিজ্ঞানী জাক বারকির ক্লাস করেছেন এবং ধর্মের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বুঝবার চেষ্টা করেছেন। সাত্রের কাছ থেকে তিনি মানবীয় স্বাধীনতা ও সবধরনের জুলুমের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহের দায়কে বুঝেছেন। জা ককতু তাকে দেখিয়েছেন মানুষের সর্বোত্তম বিকাশের দিকটি। নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আলেক্স ক্যারেল তাকে দেখান কিভাবে বিশ্বাস ও বিজ্ঞান একসাথে কাজ করতে পারে।

শরিয়তির প্যারিস জীবন শুধুমাত্র পড়াশোনা, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও চিন্তাবিদদের সাহচর্যেই কাটেনি। তিনি রীতিমত সেখানকার মোসাদ্দেকপন্থীদের সাথে কাজ করেছেন এবং আলজেরিয়ার স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে প্রচার প্রপাগান্ডা চালিয়েছেন। ইউরোপের মোসাদ্দেকপন্থীদের পত্র পত্রিকায়ও তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। আলজেরিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি একবার পাহলভী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করবার পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে ইরানের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা বিবেচনা করে শরিয়তি সে পরিকল্পনা প্রত্যাহার করেন। ১৯৬৩ সালে তেহরানের রাস্তায় পাহলভীবিরোধী দাঙ্গায় ইরানী উলমারা নেতৃত্ব দেন এবং সেবারই ইমাম খোমেনী ইরানী জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রধান নেতৃত্ব অর্জন করেন। শরিয়তি প্যারিসে বসে সে ঘটনা সামনে রেখে একটি উদ্দীপক প্রবন্ধ লেখেন যার শিরোনাম ছিল ‘জাতীয় নেতা মোসাদ্দেক, ধর্মীয় নেতা খোমেনী’। ঐ বছরই সোরবোর্নে শরিয়তি তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ পেশ করেন ও তা গৃহীত হয়।

তার অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল বলখের প্রতিভা (The Merits of Balkh); সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ডিগ্রির কারণে ব্যক্তিগতভাবে শরিয়তির চাকরি বাকরির জন্য সুবিধা হয় সত্য কিন্তু তার প্যারিসের কর্মমুখর জীবন, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা, লেখালেখি, স্বাধীনতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা ইরানী জনগণের জাগরণ ও মুক্তির পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সন্দেহ নেই।

 

পাঁচ

পাঁচ বছর পর ১৯৬৪ সালে শরিয়তির দেশে ফেরার মুহূর্তে তার জন্য অপেক্ষা করছিল চরম উৎকণ্ঠা ও পাহলভী সরকারের নিরাপত্তা বিভাগের লোকজনদের চাপিয়ে দেয়া লাঞ্ছনা। কোথায় ইরান তার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রত্যাবর্তনে তার যোগ্য সম্মান দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেবে, উল্টো ইরান সীমান্তে পৌঁছানোর সাথে সাথে স্ত্রী ও সন্তানদের সামনে। তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন তার পিতার সাথে তাকে দেখা করতে দেয়া হয়নি। এমনকি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার উচ্চতর ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও তাকে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতা করতে বাধ্য করা হয়েছে। আজীবন মাতৃভূমি তার জন্য কারাগার সদৃশ হয়ে উঠেছিল, কারণ নির্জনতা, ঘাত-প্রতিঘাত আর নানা রকমের জুলুম তার উপর নেমে এসেছিল। একই সাথে এই প্রক্রিয়া, শরিয়তিকে করে তুলেছিল দুর্ভেদ্য এবং তার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয়ী। বেশ কয়েক বছর পর তাকে মাশাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। নতুন পরিবেশে তরুণ প্রজন্মকে হাতে ধরে গড়ে তুলবার দায়িত্ব নিয়ে শরিয়তি কাজে নেমে পড়েন। তার ক্লাস করবার জন্য ছাত্রদের মধ্যে নজিরবিহীন উৎসাহ সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার ক্লাস ছিল রীতিমত একটি ঘটনা। ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে ইসলামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিষয়বস্তুকে চয়ন করে তিনি তার যুক্তি পেশ করতেন। শরিয়তির পশ্চিমী শিক্ষার স্টাইল ও ভাষ্য তাকে একজন উৎকৃষ্ট শিক্ষকে পরিণত করে এবং প্রতিদিনের আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোকে ইসলামের সাথে যুক্ত করে তিনি ইসলামী নীতির আলোকে এর সমাধান বাৎলে দিতেন। শরিয়তির শিক্ষাপ্রণালীর ধরন ও অন্তর্গত বিষয়বস্তু ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষাধারার মধ্যে রীতিমত বৈপ্লবিক ও নতুন মূল্যবোধ সম্পন্ন। তার শিক্ষাপদ্ধতি ছাত্রদের মধ্যে নতুন চিন্তার উদ্রেক করতে সাহায্য করতো এবং তার বিষয়বস্তুর অপ্রতিরোধ্য শক্তি ছাত্রদের নিত্য নতুনভাবে উজ্জীবিত করতো।

 

এই সময় শরিয়তি তার লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হন এবং তিনি সম্ভাবনাময় তরুণ ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। শরিয়তি ইসলামী বুদ্ধিজীবীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও কার্যকারিতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, বিপ্লবের বাহক হিসেবে বুদ্ধিজীবী ও জনতার সাথে তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে। শরিয়তি বলতে চান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যারা ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন চান তাদের উচিত হবে এখানকার মানুষের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে জানা এবং সেই ভাষায় কথা বলা। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তারাই যেহেতু সচেতন অংশ, সুতরাং জনগণের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান তারা করতে পারবেন না যতক্ষণ না তারা তাদের জনগণের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাষার মাধ্যমে তাদের সাথে যোগ স্থাপন করতে পারছেন। শরিয়তি জোর দিয়ে বলেছেন জনগণের এই ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাষার মূল প্রোথিত আছে ইসলামের মধ্যে। শরিয়তি আরো বলেছেন ইরানের প্রাক-ইসলামী ঐতিহ্য গৌরবের বিষয় কিন্তু তা আজ মৃত ও জনগণকে উজ্জীবিত করতে অসমর্থ্য। শরিয়তি তাই যুক্তি দেন ইরানের আত্মপরিচয় হবে পুরোপুরি ইসলামী। বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের জনগণকে উজ্জীবিত করবার প্রয়োজনে ইসলামের ভাষা, প্রতীক, উপমা ও আদর্শকে তাই পুরোপুরি বোঝা ও ব্যবহার করা চাই। অবশ্য শরিয়তি ইসলামী আদর্শের সংস্কার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন যাতে একে আখেরাত উপযোগী নিশ্চল ও অন্তর্মুখী এক মতবাদের পরিবর্তে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের উদ্দেশ্য সাধনে সক্ষম একটি বিপ্লবী ও বিদ্রোহী ধর্মে রূপ দেয়া যায়। শরিয়তি আজকের যুগে ইসলামের এই বিপ্লবী রূপান্তরকে বলেছেন রেঁনেসা।

আলী শরিয়তি এ সময় তার দুটো বিখ্যাত বই প্রকাশ করেন। একটি হচ্ছে কভীর- মরুভূমি, অন্যটি এসলাম শেনাসী- ইসলামী আদর্শ। কভীর হচ্ছে শরিয়তির এক আধ্যাত্মিক ভ্রমণ কাহিনী যেখানে এক সুফী তার মনের ভিতরে চলা অনন্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম ঠেলে ঠেলে এক গূঢ় রহস্যের জগত, যাকে তাসাউফের পরিভাষায় বলে মারিফাত, তার সন্ধানে ছুটে চলেছে। কভীরে মূলতঃ শরিয়তির গভীর বিশ্বাসের কথাই ফুটে উঠেছে, যেন তিনিই ছিলেন ইরানের বিশ শতকের মসীয়াহ। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের যুগে তার দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শোষিত মানুষের মুক্তি অর্জনই ছিল তার লক্ষ্য। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তার নিজের ব্যক্তিগত ভাগ্য বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি দুর্বলতাকে শক্তিতে, নৈরাশ্যকে আশাবাদে, সমাধানহীনতাকে সমাধানযোগ্য করে তুলেছিলেন। এক্ষেত্রে তার অস্ত্র ছিল তার নিজের মত করে তৈরি করে নেয়া এক সুফীবাদী প্রশান্তি। কভীরের মধ্যে তার উদ্বেগ, একাকিত্ব, শূন্যতা, অস্থিরতা, বিমূঢ়তা এবং অনিশ্চয়তার ছায়া দেখা গেলেও শেষে আমরা খুঁজে পাই আশার আলো। কভীর হচ্ছে শরিয়তির আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক, সকল বিপত্তি উপেক্ষা করে যা তার বিপ্লবী লক্ষ্য ও কর্মসূচীর সফলতার ঘোষণা। শরিয়তি পরবর্তীকালে উল্লেখ করেছেন যদি তাকে দুটো বই পছন্দ করতে বলা হয় তাহলে তিনি নিজের জন্য কভীরকে ও জনগণের জন্য এসলাম শেনাসীকে নির্বাচিত করবেন। এসলাম শেনাসী হচ্ছে মাশাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া ইসলাম সম্পর্কিত বিচিত্র বিষয়ের উপর শরিয়তির বক্তৃতাসমূহের একটি সংগ্রহ। সত্যিকার অর্থে এর মধ্যে তার চিন্তাভাবনার বীজ লুকিয়ে আছে, যা তিনি পরবর্তীকালে প্রয়োজনানুসারে সম্প্রসারিত করেছিলেন। এসলাম শেনাসীতে শরিয়তি যেমন একদিকে পশ্চিমীকৃত বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা করেছেন তেমনি স্বার্থপর, সুযোগ সন্ধানী দরবারী আলেমদেরও তিনি ছাড় দেননি। পশ্চিমীকৃত বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন এরা দেশের বাস্তবতা ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে স্বাধীন চিন্তা করতে অক্ষম। পশ্চিমের চোখ দিয়ে চিন্তা, বিচার ও লেখালেখিতে এরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে তিনি দরবারী আলেমদের সামনে রেখে বলেছেন তার এ বই সত্যিকার ইসলামের রূপ উন্মোচন করবে যার থেকে বর্তমানের আলেমদের ব্যাখ্যাত ইসলামকে তিনি পৃথক করেছেন। শরিয়তি এখানে প্রকৃত ইসলামের ১৪টি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন যা তিনি ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক উৎস যেমন কুরআন, হাদিস, চার খলিফা, শিয়া ইমাম প্রভৃতি থেকে চয়ন করেছেন। এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে শিয়া অশিয়া নির্বিশেষে সকল উৎসের ব্যবহার তার মুক্তচিন্তার প্রমাণ যা প্রথাগত ইরানী উলেমাদের বিরাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এসলাম শেনাসীতে প্রথমতঃ শরিয়তি সত্যিকারের ইসলামের এক আধুনিক, সমতাবাদী ও গণতান্ত্রিক চেহারা তুলে ধরেছেন।

দ্বিতীয়তঃ এখানে তিনি সত্যিকার ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রধান বাধাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সবশেষে তিনি বলতে চেয়েছেন মুসলমানরা কেবল তৌহিদের নীতি প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রধান বাধাগুলো অপসারণ করতে পারে।

আলী শরিয়তি তিনটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এসলাম শেনাসীতে তার চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেছেন। তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতা ও আধুনিকতার প্রতিবন্ধক হিসেবে যে অভিযোগ আনা হয় তার জওয়াব দেয়া। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন ইসলাম ও আধুনিকতা কোন পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় নয়। উল্টো আধুনিকতা ইসলামেরই মৌল চিন্তাভাবনার অংশ এবং তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন যুক্তি ও ধর্ম একই সাথে বসবাস করতে পারে।

শরিয়তি ডারউইনীয় বিবর্তন চিন্তা প্রসঙ্গে বলেছেন কুরআনের নিজস্ব ধারার বিবর্তন চিন্তা আছে। কুরআনের বিবর্তন চিন্তা দিয়ে ডারউইনীয় বিবর্তনবাদকে ব্যাখ্যা ও কখনো কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়।

রাজনৈতিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে বলা যায় ইসলামী নীতি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক। কেননা শুরা, ইজমা, ইজতিহাদ, চিন্তার স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা এগুলো পুরোপুরি গণতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতেই ইসলামে বিকাশ লাভ করেছে।

ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন এটি সমতা, শোষণ মুক্তি, শ্রেণী বিভাজন প্রতিরোধ ও জনভোগ্যতার ক্ষেত্রে সমানাধিকারের নীতিতে বিশ্বাসী।

সকল মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে কুরআনের এই নীতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শরিয়তি বলেছেন এর থেকে ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও অধিকারের ধারণাই ব্যক্ত হয়েছে। নারী-পুরুষ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে শরিয়তি বলেছেন ইসলাম ঠিক পশ্চিমী ধারণার লৈঙ্গিক সমতায় বিশ্বাস করেনা, ইসলাম নারী ও পুরুষকে তার প্রাকৃতিক অবস্থান (Natural Position) ও অধিকারের মধ্যে ব্যাখ্যা করতে চায়। ইসলামী দর্শন প্রসঙ্গে শরিয়তি যুক্তি দেন মানুষ একই সাথে মুক্ত আবার পরাধীন। সে একই সাথে আত্মনিয়ন্ত্রণ কর্তা ও নিয়তির শিকল দ্বারা আবদ্ধ। হেগেলীয় সমাজ বিকাশের ধারণাকে উল্টিয়ে শরিয়তি বলেন মানুষের ইতিহাস হচ্ছে: The progression of history towards the awakening of God in man.

 

একই সাথে হেগেলীয় দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নয়-প্রতিনয়-সমন্বয়ের (Thesis- Antithesis-Synthesis) ধারণা দিয়ে তিনি ইতিহাসের ধারাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন এবং সমাজ প্রগতি ও ইতিহাসের গতিমানতার পিছনে মানুষকেই নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

শরিয়তি ইসলামের যে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় আদর্শবাদ যেমন আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও ওহীর ধারণার সাথে উদারনৈতিক চিন্তা যেমন যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার একটা সমন্বয় করার চেষ্টা আছে। শরিয়তির এই উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার পিছনে তার প্রথম জীবনে আস্তিক সমাজতন্ত্রীদের সাহচর্যের একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায় যা একদিকে পশ্চিমীকৃত বস্তুবাদী অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক উলেমা উভয়কেই ক্ষুব্ধ করে।

এসলাম শেনাসীতে শরিয়তির দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল যারা খোদায়ী শাসন ও মানুষের উৎকর্ষতার প্রতিবন্ধক তাদেরকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। মূলত এখানে তিনি রাজতন্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক উলেমাদের দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন। তিনি মনে করেন পৌত্তলিকতা মানে শুধু আল্লাহকে অস্বীকার করা নয়, এর আধুনিক প্রকাশ হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি বা শক্তির কাজকর্ম যা কিনা আল্লাহকে কার্যক্ষেত্রে অপসারণ করে এবং তার একচ্ছত্র অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শরিয়তি এই ধরনের পৌত্তলিকতাকে বলেছেন সামাজিক শিরক যার উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ব্যক্তিপূজা, চরিত্রপূজা এবং সেইসব মানবীয় সম্পর্ক যেখানে এক মানুষ আরেক মানুষের চূড়ান্ত বাধ্যগত, তার আদেশ নির্দেশের উপর নির্ভরশীল। শরিয়তি লিখেছেন: Anyone who imposes his will on the people and rules according to his own whim, has made a claim to being God and whoever accepts such a claim is a polythiest, since absolutist rule, will, power, dominance and ownership is only in God’s monopoly.

শরিয়তি মনে করেন এই ধরনের সামাজিক শিরক যেমন রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, অভিজাততন্ত্রের মধ্যে বিদ্যমান তেমনি ধর্মীয় চরিত্র নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক উলমাদের মধ্যেও একইভাবে অবস্থান করছে।

এসলাম শেনাসীতে শরিয়তি তার তৃতীয় উদ্দেশ্যের কথা বলতে যেয়ে উল্লেখ করেছেন সত্যিকারের মুসলমানদের এই ধরনের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। শরিয়তি মনে করেন সকল প্রকারের অবৈধ কর্তৃত্ব যা নাকি সবরকমের বিকৃতি, অপরাধ ও দুষ্টচক্রের হোতা তাকে মোকাবিলা করতে হবে। তৌহীদের নীতিতে আস্থাবান হয়েই কেবল এই ধরনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। শরিয়তি তৌহীদের নীতিতে নির্ভরশীল মানুষকে বলেছেন মুবাহিদ যার চরিত্রের বর্ণনা তিনি এমনিভাবে দিয়েছেন:

independent, fearless, selfless, dependable and wantless individual, who bowed to no other authority than to God.১০

শরিয়তি বর্ণিত এই মুবাহিদ যারা নাকি ইসলামী বিপ্লবের তুর্যবাদক হিসেবে আবির্ভূত হবে তারাই পারবে একালের পৌত্তলিক শক্তি স্বৈরতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও দরবারী আলেমদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। শরিয়তির মূল্যায়ন হলো শোষক শ্রেণী সাধারণত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এরা হয় নিপীড়ক শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছে অথবা নিজেরাই নিপীড়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শরিয়তি তাই ইসলামকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন।

একটি হচ্ছে শোষক শ্রেণীর হাতে বন্দী অচল ও জীর্ণ ইসলাম যাকে তিনি বলেছেন Institutionalized Islam এবং যাকে তিনি সবসময় ঘৃণা করেছেন; আর একটি হচ্ছে বিদ্রোহী ও সত্যিকারের ইসলাম যার কাজ হচ্ছে অনবরত জুলুম ও অপচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা। শরিয়তি ছিলেন এই দ্বিতীয় দলেরই প্রবক্তা।

 

ছয়

মাশাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিয়তির অধ্যাপনা, ব্যাপক জনপ্রিয়তা বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্যে তার বিপ্লবী বাণীর প্রভাব কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিয়তির ক্লাসকে তারা আর সহ্য করতে রাজি হয়নি এবং অকালে বাধ্যতামূলকভাবে তাকে অবসর দিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসর প্রাপ্তির পর শরিয়তির জন্য আরো বিপুল ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় এবং তিনি ১৯৭১ সালে তেহরানে চলে আসেন। এখানকার বিখ্যাত হুসাইনিয়া এরশাদ মাদরাসাকে কেন্দ্র করে তিনি তার উদ্দীপক বক্তৃতা, ক্লাস ও লেখালেখি পুনরায় শুরু করেন যা তরুণদের মধ্যে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৭১ থেকে ইরানের রাজনৈতিক ঘটনাবলী অস্থির হয়ে ওঠে যা হুসাইনিয়া এরশাদে শরিয়তির ভূমিকাকে আরো বিপ্লবী করে তোলে। রেজা পাহলভীর স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ধুমায়িত হতে থাকে এবং বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র গেরিলারা সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এসব সশস্ত্র গেরিলারা কেউ কেউ মার্কসবাদী কায়দায় বিপ্লব করতে চেয়েছিল, কেউ কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষপাতী ছিল। এসব গেরিলা নেতৃত্বের অনেকেই শরিয়তির পরিচিত ছিল। যদিও তিনি নিজে ইরানের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিপ্লবের জন্য তখনকার মত প্রস্তুত হয়নি বলে এই ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিলেন না এবং তিনি নিজের মত করে এক ধরনের ঐতিহাসিক নিয়তিবাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এরপরেও দেখা যায় তিনি রেজা পাহলভীর বিরুদ্ধে পরিচালিত সশস্ত্র বিদ্রোহের ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন থাকতে পারেননি।

১৯৭১ সালে রেজা পাহলভী পারসিপোলিসে সম্রাট সাইরাসের সমাধির পাশে জাঁকজমকের সাথে ইরানী রাজতন্ত্রের ২৫০০ তম বার্ষিকী উদযাপন করেন এবং শাহ ইরানকে বিশ্বের মহান সভ্যতার দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। শরিয়তি হুসাইনিয়া এরশাদে বসে বক্তৃতা দেন পাঁচ হাজার বছরের শোষণ, বঞ্চনা, অবিচার, শ্রেণী বিভাজনের বিরুদ্ধে। শরিয়তি প্রকাশ্যে শাহ’র মহান সভ্যতা তৈরি প্রসঙ্গে বলেন এই লোকটি জনগণকে শোষণ ও কিছু তেজস্বী বক্তৃতা দেয়া ছাড়া এদেশের জন্য আর কিছু করেনি। একই বক্তৃতায় শরিয়তি ইরানের মানুষের জন্য হযরত আলীর মত একজন ত্রাণকর্তার দরকার বলে তার বলিষ্ঠ মতামত দেন যে কিনা জনগণকে মুক্ত করে পুনর্বার সত্যিকার ইসলামী নীতির মাধ্যমে ইনসাফকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর শরিয়তি হুসাইনিয়া এরশাদে তার বিখ্যাত ‘একজন প্রকৃত শিয়ার দায়িত্ব’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন। এখানে তিনি শিয়াবাদকে আলাভী ও সাফাভী শিয়া এই দুই ভাগে ভাগ করেন। তার মতে সাফাভী শিয়া হচ্ছে কর্তৃত্বকামী জুলুমবাজ ব্যক্তিদের হাতে ব্যবহৃত শিয়াবাদ যা কিনা নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার প্রতীক। অন্যদিকে তিনি প্রকৃত শিয়া বলতে আলাভী শিয়া বা হযরত আলীর অনুসারীদের উল্লেখ করেছেন এবং তাদেরকে বিপ্লবী বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তার মতে আলাভী শিয়ারা জীবনের বিনিময়ে হলেও অবিচার ও জুলুমের মোকাবিলা করে, ন্যায়পরায়ণ, সৎ ও নির্ভীক শাসককে প্রতিষ্ঠা করে এবং সবধরনের জুলুম, শোষণ, স্বৈরাচার, অবিচার, শ্রেণী শোষণ, অজ্ঞতা, মূর্খামী ও ভয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

উপরোক্ত সংজ্ঞার আলোকে একজন প্রকৃত শিয়ার দায়িত্ব স্পষ্ট। শরিয়তি তাই নির্দ্বিধায় আহ্বান জানান বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার শীর্ষে শাহর অবস্থান তাকে পুরোপুরি উৎখাত করার। শরিয়তি তার শ্রোতাদের স্মরণ করিয়ে দেন ইমাম হুসাইনের অসীম ত্যাগ ও শাহাদাতের কথা পাশাপাশি ইয়াজিদের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জুলুমের কথা। এই বক্তৃতায় শরিয়তি তার বিখ্যাত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শ্লোগান উচ্চারণ করেন:

Every month of the year is moharram, every day of the month is ashura and every piece of land is Karbala.১১

শিয়া কালচারের সাথে যাদের পরিচয় আছে তাদের কাছে শরিয়তির এই উপমা ও বাণী অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন সময় উপস্থিত হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের এখন প্রয়োজন শাহ ও তার নিপীড়ক ব্যবস্থাগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করা। তিনি ইরানকে ন্যায়-অন্যায়, পবিত্র-কলুষ, ভাল-মন্দের ঐতিহাসিক সংগ্রামের রণভূমি হিসেবে উল্লেখ করেন। ইরানের শিয়া ইতিহাসের স্মৃতি জাগিয়ে তিনি মোহররম, আশুরা ও কারবালার প্রতীক ব্যবহার করেন এবং ইরানীদের আবেগকে উজ্জীবিত করে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ডাক দেন। আট বছর পর ইরানী বিপ্লবের মুহূর্তে শরিয়তির এই শ্লোগান সেখানকার লাখো জনতার মুখে উচ্চারিত হয়।

শরিয়তির এই সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বানের কয়েক সপ্তাহ পর কর্তৃপক্ষ হুসাইনিয়া এরশাদকে বন্ধ করে দেয় এবং তার বিপ্লবী কণ্ঠকে রোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ শরিয়তির বিপ্লবী বক্তব্যের শক্তিকে ঠিকমত ওজন করতে পারেনি। কারণ শরিয়তির বক্তব্য আসলে ইসলামের বৈপ্লবিক বাণীর নির্যাস, যাকে নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা কর্তৃপক্ষের পক্ষে এত সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই শরিয়তির বিপ্লবী সাহিত্যের প্রভাবকে স্তব্ধ করার জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে কারারুদ্ধ ও অনুতাপ করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শাহর নিরাপত্তা কর্মীরা বুঝতে পারেনি একজন বিপ্লবীকে কারারুদ্ধ করা যায় কিন্তু অনুতাপে বাধ্য করানো সম্ভব নয়।

অবস্থা আঁচ করে শরিয়তি গা ঢাকা দিয়েছিলেন কিন্তু কর্তৃপক্ষ তার বৃদ্ধ পিতা ও শ্যালককে জিম্মি করে তাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। শরিয়তিকে ১৯৭৩ সালে কুখ্যাত কোমিথ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অশেষ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে বাধ্য করা হয়। তিনি দুই বছর কারাবাস করেন। ১৯৭৫ সালে তার বিশেষ ব্যক্তিগত বন্ধু আলজেরিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতেফেলেকা, প্যারিসে থাকাকালে শরিয়তি যার সাথে আলজেরীয় মুক্তি সংগ্রামীদের পক্ষে কাজ করেছিলেন, তার মুক্তির জন্য অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ইরান সরকার তাকে মুক্তি দিলেও কড়া নজরদারির মধ্যে রাখে।

 

সাত

এ সময়ের মধ্যে শরিয়তির সমস্ত বইপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং কারো কাছে সেগুলো পাওয়া গেলে তারও গ্রেফতারের সম্ভাবনা থাকতো। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর যা হয় তার বই পত্রের উপর আইনী নিষেধাজ্ঞা তার পাঠকপ্রিয়তা ভয়ানক রকম বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে তার কারাবাস তার ভক্তদের কাছে তার খ্যাতিকে বৈপ্লবিক ভাবমূর্তিতে উত্তীর্ণ করে।

শরিয়তির কারামুক্তির পর তার দিন কাটে কিছুটা নির্জনতায়, কিছুটা পুরনো ঘটনার রোমন্থনে এবং কিছুটা লেখাপড়া করে। ১৯৭৭ সালের ১০ জানুয়ারি ইরানের দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক নেতা ইমাম খামেনেই, আয়াতুল্লাহ মোতাহ্হারী, ফখরুদ্দীন হেজাজীসহ কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে একটি আকর্ষণীয় আলোচনায় বসেন তিনি। এখানে তিনি সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। তিনি যুক্তি দেন বর্তমানের ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের ধারাকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি পক্ষের আক্রমণ থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে রক্ষা করতে হবে। তিনি মনে করেন ইসলাম অন্যান্য আদর্শের জন্যও একটা বড় রকমের হুমকি কেন না এর রয়েছে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, স্বৈরাচারবিরোধী, পুঁজিবাদবিরোধী মূল্য চেতনা। শরিয়তির মতে ইসলামের সাথে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের সম্পর্ক সমন্বয় সাধক নয় বরং বিরোধিতা পূর্ণ। সেক্ষেত্রে মার্কসবাদের সাথে ইসলামের মতপার্থক্য একেবারে অবিরোধী নয়। শরিয়তি মনে করেন সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ হচ্ছে ইসলামের সরাসরি শত্রু, মার্কসবাদীরা প্রতিদ্বন্দ্বী।

এমত পরিস্থিতিতে শরিয়তি ইসলামী আদর্শের উপর ভিত্তি করে একটি ইসলামী মেনিফেস্টো প্রণয়নের উপর জোর দেন এবং পুনঃনির্মিত একটি ইসলামের বিশ্বদৃষ্টি দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করবার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। উল্লেখ্য, শরিয়তি তার বাকি জীবন এ লক্ষ্য পূরণে কাজ করে গেছেন।

 

শরিয়তির এসময়কার লেখালেখি মূলতঃ তিনটি বিষয় নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। তিনি বলতে চেয়েছেন দুনিয়ার ইতিহাসের যতরকম আন্দোলন, আদর্শবাদ, দর্শন, ধর্ম ও বিপ্লব হয়েছে তা এই তিনটি প্রত্যয়কে অনুসরণ করে হয়েছে। শরিয়তির এই ত্রিতত্ত্ব হচ্ছেঃ (১) প্রেম ও আধ্যাত্ম (২) স্বাধীনতা ও (৩) সামাজিক ন্যায়

আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে তিনি বলেছেন এটি হচ্ছে মানুষের প্রাকৃতিক সত্তার সাথে মিশে আছে। এটি মানুষকে তার পার্থিব কলুষতার বাইরে এক স্বর্গীয় পরিশুদ্ধির দিকে নিয়ে যায়।

কারামুক্তির পর তিনি স্বাধীনতাকে নানাভাবে স্তব করেছেন। এমনকি কবির মত করে লিখেছেন: Freedom, blessed freedom.১২ অবশ্য স্বাধীনতা বলতে তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতাকেই বুঝিয়েছেন এবং স্বৈরতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণের হাত থেকে স্বাধীনতার কথা বলেছেন। ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন এর সীমা সরহদ থাকা দরকার। তিনি মনে করেন স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য থাকা চাই যথার্থ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক সচেতনতা ও পরিপক্বতা। এই ধরনের স্বাধীনতার জন্য শরিয়তি মনে করেন একজন বিপ্লবী রাজনীতিকের দরকার যিনি কিনা সমাজের অজ্ঞানতা ও অবিচারকে দূর করার জন্য জনগণের এক বৈপ্লবিক পরিশুদ্ধি ও শিক্ষার কর্মসূচী হাতে নিতে পারবেন। ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শরিয়তি বলেছেন আংশিক স্বাধীনতা। অন্যদিকে ইসলামী নীতি-নির্ধারিত স্বাধীনতাকে তিনি মনে করেন এটি মানুষের সকল রকমের বন্ধন থেকে মুক্তি দেবে।

শরিয়তির শেষ দিককার লেখালেখিতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ের আভাস দেয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন পুঁজিবাদকে ধ্বংস করা চাই কারণ এটি শুধু অবিচার, শোষণ ও অসমতামূলক নয়, এটি একই সাথে অনৈতিক ও সবরকমের খোদায়ী মূল্যবোধের বিকৃতি সাধনকারী। শরিয়তির দৃষ্টিতে একমাত্র আধ্যাত্মিক সমাজতন্ত্র, সমতা ও ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই কারণেই শরিয়তির ব্যাখ্যাত ইসলামে সমাজতন্ত্র ও বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তিনি তার ব্যাখ্যাত ইসলামী সমাজতন্ত্রের পক্ষ নিয়েছেন এই কারণে যে এটি:

founded on a socialist economic system governed by ethical and spiritual values firmly based on the Islamic belief in God.১৩

 

আট

১৯৭৭ সালের মে মাসে আলী শরিয়তি শাহের নিরাপত্তা বাহিনী সাভাকের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইরান ত্যাগ করেন এবং লন্ডনে পৌছান। শরিয়তির দীর্ঘ অনুপস্থিতি সাভাককে সন্দেহপরায়ণ করে তোলে এবং বিদেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে অনুরোধ করে শরিয়তি অবৈধভাবে দেশ ত্যাগ করেছেন। সুতরাং তাকে খুঁজে যেন নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। পরবর্তী মাসে তার দুমেয়ে সুসান ও সারা লন্ডনে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে নিয়ে লন্ডনের সাউদাম্পটনের একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। পরবর্তী দিন ১৯ জুলাই খুব সকালে সেই বাসার মেঝেতে শরিয়তির মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়। মাত্র ৪৪ বছরে এই বুদ্ধিজীবীর রহস্যময় মৃত্যুতে ইরানী জনগণ শাহের সাভাককেই প্রথম সন্দেহ করে এবং সাভাকই যে এ মৃত্যু ঘটিয়েছে তা ইরানীরা বলতে থাকে। কারণ এর মাধ্যমে শাহর সরকার তার এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বুদ্ধিজীবীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

শাহের অনুচররা শরিয়তিকে হত্যা করেছে কিন্তু তার বিপ্লবী মতাদর্শ নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। তার মৃত্যুর মাত্র দুবছরের মধ্যে ইরানী জনগণের জাগ্রত অভ্যুত্থানের মুখে সাম্রাজ্যবাদের এই শিখন্ডীর দুঃশাসনের পতন ঘটে এবং ইরানী জনগণ শরিয়তির দেখানো বিপ্লব ও রক্তের মধ্য দিয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

একথা বলা অতিশয়োক্তি হবে না ইরানী বিপ্লবের ঘটনাবহুল মুহূর্তগুলোতে শরিয়তির প্রভাব ও ছবি অনেক বড়ই মনে হয়েছে বিশেষ করে তার জনপ্রিয় শ্লোগানগুলো ইরানী জনগণের মনের গভীরে গিয়ে টোকা দিয়েছে। তার বিখ্যাত শিয়াবাদের ইসলামী ধারণা অবশ্যই জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে বিশেষ করে তরুণদেরকে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে প্রাণিত করেছে। তার সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো তিনি ইসলামকে এক বৈপ্লবিক মতাদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন বিশেষ করে অন্যান্য বিপ্লবী আদর্শের সাথে ইসলামও যে বড় ভূমিকা রাখতে পারে এটা তিনি ধর্মহীন অন্যান্য সামাজিক গ্রুপগুলোকে বুঝিয়েছেন। বিপ্লবোত্তর ইরানের সকল উলামারা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন শরিয়তি ছিলেন ইরানী বিপ্লবের অগ্রপথিক যিনি একটি জনগোষ্ঠীর মানস পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ইরানী বিপ্লবের রাজনৈতিক শিল্পী যদি হন ইমাম খোমেনী, তাহলে আলী শরিয়তি হচ্ছেন এর বুদ্ধিবাদী শিল্পী।

 

 

গ্রন্থ  ঋণ:

১. “Ali Rahnema, Ali Shariati Teacher, Preacher, Rebel”, in Pioneers of Islamic Revival. London: Zed Books Ltd., 1994.

২ প্রাগুক্ত।

৩. Shariati, Collected Works.

৪. প্রাগুক্ত।

৫. প্রাগুক্ত।

৬. প্রাগুক্ত।

৭. Quoted in Karen Armstrong. The Battle for God. New York: The Random House Publishing Group, 2001.

৮. “Ali Rahnema, Ali Shariati Teacher, Preacher, Rebel”, in Pioneers of Islamic Revival.

৯. প্রাগুক্ত।

১০. প্রাগুক্ত।

১১. Quoted in Karen Armstrong, The Battle for God.

১২. “Ali Rahnema, Ali Shariati Teacher, Preacher, Rebel”, in Pioneers of Islamic Revival.

১৩. প্রাগুক্ত।

১৭৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

জন্ম
যশাের জেলায় ২৮ অক্টোবর, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে।

শৈশব ও কৈশাের
যশাের জেলা স্কুল ও যশাের এম. এম. কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্ এন্ড সার্জন থেকে মনােরােগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

ফাহমিদ-উররহমান মননশীল প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী। ছাত্র জীবন থেকে লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এবং পেশাগত জীবনের বাইরে তিনি নিরন্তর নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও বৈশ্বিকভাবে বাঙ্গালি মুসলমানের স্থান নির্ণয়ের কাজে। সাহিত্যের নেশা তাকে টেনেছে। পেশার প্রাচীর তার কলম আটকিয়ে রাখতে পারেনি। নেশা তার বিচিত্র। ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি - সকল বিষয়ে তার আগ্রহ। এর ভিতর দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী যা দিয়ে তিনি হাঁটেন বহু বিচিত্র পথে। শিখেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলতে। প্রবল সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসচেতনা তাকে তাড়িত করে, যার ফলে তার লেখায় থাকে তত্ত্ব, তথ্য ও ভাবুকতার এক অনন্যপূর্ব আস্বাদ, যা তাকে একজন মূলত আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে চিহ্নিত করে। তার এই সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসাকে বিদ্বৎসমাজ শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।
Picture of ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

ডাঃ ফাহমিদ উর রহমান

জন্ম
যশাের জেলায় ২৮ অক্টোবর, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে।

শৈশব ও কৈশাের
যশাের জেলা স্কুল ও যশাের এম. এম. কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্ এন্ড সার্জন থেকে মনােরােগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।

ফাহমিদ-উররহমান মননশীল প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী। ছাত্র জীবন থেকে লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এবং পেশাগত জীবনের বাইরে তিনি নিরন্তর নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও বৈশ্বিকভাবে বাঙ্গালি মুসলমানের স্থান নির্ণয়ের কাজে। সাহিত্যের নেশা তাকে টেনেছে। পেশার প্রাচীর তার কলম আটকিয়ে রাখতে পারেনি। নেশা তার বিচিত্র। ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি - সকল বিষয়ে তার আগ্রহ। এর ভিতর দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী যা দিয়ে তিনি হাঁটেন বহু বিচিত্র পথে। শিখেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলতে। প্রবল সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসচেতনা তাকে তাড়িত করে, যার ফলে তার লেখায় থাকে তত্ত্ব, তথ্য ও ভাবুকতার এক অনন্যপূর্ব আস্বাদ, যা তাকে একজন মূলত আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে চিহ্নিত করে। তার এই সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসাকে বিদ্বৎসমাজ শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top