আবু যায়েদ আল বালখী, ইসলামী সভ্যতার একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, আখলাকবিদ, চিকিৎসাবিদ ও ভুগোলবিদ। মহান এই চিন্তাবিদ ও চিকিৎসক ২৩৬ হিজরি (৮৫০) সালে তৎকালীন খোরসানের (বর্তমান আফগানিস্তান) এর বালখ শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মহান এই আলেম ও চিন্তাবিদ তাফসির, দর্শন, আখলাক, চিকিৎসাবিদ্যা ও ভুগোলসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসকল গ্রন্থের মধ্যে তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হল “مصالح الابدان والأنفس” (“মাসালিহুল আবদান ওয়াল আনফুস”) অর্থাৎ শরীর ও রূহের সুস্থতা। এই গ্রন্থটিতে তিনি শরীর ও আখলাক বিষয়ক দুইটি বিষয়কে আলাদাভাবে আলোচনা করার কারণে এই গ্রন্থকে মাকালাতাইন বলেও অভিহিত করা হয়। এই গ্রন্থে তিনি যেমন তৎকালীন সময়ের চিকিৎসা বিদ্যাকে তুলে ধরেছেন একইভাবে চিকিৎসাবিদ্যা ও আখলাককে একত্রিত করে স্বতন্ত্র একটি শাস্র হিসেবে রূপদান করে জ্ঞানের একটি নতুন ধারার সূচনা করেছেন। আর এই বিষয়টি-ই তাকে অনন্যতা দান করেছে। তিনি ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসাবিদগণ চিকিৎসা বিষয়ক অনেক গ্রন্থ রচনা করলেও রূহের সুস্থতাকে বিবেচনায় নিয়ে তার পূর্বে অন্য কেউ জ্ঞানগতভাবে গ্রন্থ রচনা করেননি বলে তিনি দাবী করেছেন। সেই অর্থে রুহানী ও বাদানী (শারিরিক) বিষয়কে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করেন।
বালখী রুহানী তিব্ব ( আত্মিক চিকিৎসা) ও বাদানী তিব্ব (শারীরিক চিকিৎসা) নামক পরিভাষাদ্বয়ের অভিন্ন শব্দ তিব্ব (চিকিৎসা) কে মুভমেন্ট পয়েন্ট হিসেবে ধরেছেন এবং এই ভাবে তিনি রূহ ও শরীরের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া (interaction) সুস্থতা ও অসুস্থতার দিক থেকে কোন বিষয়ের সৃষ্টি করতে পারে সেটা বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে তিনি মানুষকে রূহ ও শরীরের সমন্বয়ে গঠিত একটি সৃষ্টজীব হিসেবে তুলে ধরে সেটার আলোকে চিকিৎসাবিদ্যার পথকে উম্মোচিত করে দিয়েছেন।
তাঁর সমসাময়িক প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু বকর আর রাযি রচিত ‘তিব্বুর রুহানী’ নামক গ্রন্থে আর রাযীও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে ধারণা করা হয়ে থাকে যে আবু বকর আর রাযী বালখীর ছাত্র ছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে দর্শন ও চিকিৎসাশাস্র পড়েছেন। এই অর্থে রাযী তাঁর-ই চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই গ্রন্থ রচনা করেছেন।
মানুষ যেহেতু রূহ ও শরীরের সমন্বয়ে গঠিত এই অর্থে বালখীর মতে অসুস্থতার কারণ সমূহকে বিবেচনা করার সময় শারীরিক ও আত্মিক উভয় কারণকে একত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। তাঁর এই চিন্তাটি আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যার psychosomatic নামক পরিভাষার কাছাকাছি। বলা যায় যে, তিনি এই বিষয়েকে এত আগেই একটি গ্রন্থাকারে তুলে ধরেছেন। এছাড়াও প্রাকৃতিক পরিবেশ, আবহাওয়া, শারীরবৃত্তীয় গঠনের পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়া, জৈবিক সম্পর্ক, ঘুমের মত বিষয়সমূহ যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী নিয়ে দীর্ঘ বিশ্লেষণের পর বালখী উক্ত গ্রন্থে শরীর ও রূহের চিকিৎসার জন্য মিউজিকের গুরুত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। নিয়ন্ত্রণহীন ক্রোধ, অযথা ভীতি এবং গভীর সংশয় সমূহের মত মানসিক চাপসমূহ মানুষের জীবনে খারাপ প্রভাবের সৃষ্টি করতে পারে এবং এর ফলে স্নায়বিক রোগের পাশাপাশি মানুষের আখলাকী আচরণের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে তিনি এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বালখী রুহানী চিকিৎসা নামক পরিভাষাটিকে একই সাথে সাইকোথেরাপী এবং আখলাকের দিকে ইঙ্গিত করেছেন । এই অর্থে এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা, আখলাক ও সাইকোলজিকে একত্রিত করে নতুন একটি ধারার সূচনা করেছিলেন।
তথ্যসুত্রঃ İslâm Ansiklopedisi