উম্মাহর আলেমগণ ও দায়ীগণের প্রতি শায়খ আল কারযাভীর উপদেশ

উম্মাহর আলেমগণ এবং দায়ীগণের প্রতি এসব নির্দেশাবলী অনুসরণ করার অনুরোধ করছি যেন তাঁরা তাদের রব, দীন এবং উম্মাহর প্রতি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন।

প্রথমতঃ তাঁদের আনুগত্য হবে শুধুমাত্র মহিমান্বিত রব এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি; জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেম, অথবা শাসক, রাজনীতি কিংবা জনগণের প্রতি নয়, যদি না তারা ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করে।

দ্বিতীয়তঃ প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (সা) সঠিক সুন্নতের অনুসরণ করা। এক্ষেত্রে ইসলামের রুহকে বুঝার জন্য পূর্ববর্তী মুজতাহিদগণের অনুসরণ করা, যারা শতাব্দীকাল ধরে উগ্রপন্থীদের তৈরী করা বিকৃতি, প্রতারকদের প্রতারণা ও মূর্খদের ব্যাখ্যা থেকে ইসলামকে মুক্ত করার জন্য সর্বদা কাজ করে গেছেন।

তৃতীয়তঃ অত্যাচারী ও তাদের সহযোগীদের মুখের উপর সত্য কথা বলা, সৎ কাজের আদেশ করা আর অসৎ কাজের নিষেধ করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো শক্তিকে ভয় না করা; ঠিক তাঁদের মতো – “যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে থাকে, তাঁকেই ভয় করে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। আর হিসাব গ্রহণের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট।” (আল আহযাবঃ ৩৯)

চতুর্থতঃ মুয়ায ইবনে জাবাল এবং আবু মুসা আল-আশয়ারীর (রা) প্রতি রাসূলের (সা) দেয়া উপদেশ সবসময় মনে রাখা। তাদেরকে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় রাসূল (সা) বলেছিলেন, “সব কিছু সহজ করবে, কোনো কিছুকে কঠিন করবে না। সবাইকে সহযোগিতা করবে আর বিচ্ছিন্ন হবে না।” আলেম ও প্রবক্তাদের জন্য এই নির্দেশনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ! আর বিশেষ করে আমাদের  এই সংকটাপন্ন  সময়ে তাদের এই নির্দেশনাটা আরো বেশি প্রয়োজন! এর মানে হচ্ছে, তাদেরকে বিশৃংখলার পরিবর্তে মারহামাতের, আর কঠোরতার পরিবর্তে নম্রতার অধীকারী হতে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা মারহামাতকে পছন্দ করেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা রাসূলকে (সা) উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্তের হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো।” (আল ইমরানঃ ১৫৯)

আর নম্রতা বলতে আমি বুঝিয়েছি উসূলে ফিকহের ভিত্তিতে নম্রতা, কাজের উদ্দেশ্যের দিক থেকে নয়। এর ভিত্তিতেই মানুষের সাথে আচরণ করতে হবে। আমাদের উচিত যেসব মুসলিম ফরজগুলো সঠিকভাবে আদায় করে আর বড় বড় গুনাহসমূহ থেকে দূরে থাকে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করা, আর তাদের মধ্যে এই অনুভূতির সৃষ্টি করা যাতে তারা যেন মনে করে তারা আমাদেরই একজন। এক্ষেত্রে যদি তারা মতবিরোধ ও সন্দেহপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় জোর দিয়েও পালন করে থাকে, তাদের সাথে বিরোধ না করে আমাদের উচিত হবে তাদেরকে হিকমতের সাথে অধিকতর ভালোর দিকে আহবান করা । এই ধরণের মুসলমানদের সাথে শত্রুতা করা এবং তাদেরকে ইসলামের বাইরে মনে করা চরম ভুল ও উম্মাহর জন্য বিপজ্জনক।

পঞ্চমতঃ আপনারা এই সময়ের সন্তান, আপনারা আপনাদের সময়ের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানেন। এই সময়ের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা আপনাদের দায়িত্ব। দয়া করে আপনাদের ছাত্রদের ও শ্রোতাদের ঐতিহাসিক বিতর্কগুলোতে লিপ্ত রেখে বর্তমানকে ও বর্তমানের চ্যালেঞ্জকে দৃশ্যপট থেকে দূরে সরিয়ে দিবেন না।

আমি এখানে আজকের চ্যালেঞ্জ বলতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়া নাস্তিকতা, পৌত্তলিকতা ও মূল্যবোধহীনতার প্রবল স্রোতকে বুঝাচ্ছি। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, ইসলাম এবং প্রাচ্য ও পশ্চিমের আক্রমণাত্মক স্রোতের যুদ্ধ, যা আমাদের শিশুদের নাস্তিকতা শেখাচ্ছে, বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং আমাদের মূল্যবোধ আর নিয়ম-নীতিকে মূল্যহীন হিসেবে উপস্থাপন করছে। এই বিধ্বংসী ঢেউগুলি আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাদের প্রয়োজন এদিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ নিবদ্ধ করা; আমাদের সমস্ত চিন্তাভাবনা এবং প্রচেষ্টাকে এই দিকে পরিচালনা করা উচিত যাতে করে আমরা আমাদের উম্মাহর সৌন্দর্য ও সত্যতা রক্ষা করতে পারি এবং উম্মাহকে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি।

ষষ্ঠতঃ ইতিহাসের স্বর্ণযুগ থেকে গ্রহণ করার মতো একটি মুলনীতি হলো, “যার উপর আমরা একমত হয়েছি তাতে একে অপরকে সাহায্য করি আর যাতে আমাদের মতভেদ রয়েছে তাতে একে অপরকে ছাড় দেই।”

সপ্তমতঃ যুগের জ্ঞান থেকে জ্ঞান অর্জন করে নিজেদের তৈরী করা। ইমাম আল গাজ্জালীর পক্ষে দর্শনের সমালোচনা করা, ন্যাচারাল সায়েন্সকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং দার্শনিকদের অসংলগ্নতা দেখানো সম্ভব হতো না, যদি না তিনি দর্শন, ন্যাচারাল সায়েন্স কিংবা অন্যান্য জ্ঞানে দক্ষতা অর্জন না করতেন।

তেমনিভাবে, শায়খ আল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াও সমস্ত বিপথগামী দলের ভুল-ত্রুটিগুলো ব্যাখ্যা করেননি যতক্ষণ না তিনি তাদের, এমনকি ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কিতাবসমূহ থেকে তাদের বিশ্বাস ও শিক্ষা সম্পর্কে সুচারুভাবে অধ্যয়ন করেছেন। এজন্য তিনি কেবলই সাধারণ একজন ইমাম ছিলেন না, বরং ব্যক্তিত্বের দিক থেকেও তিনি ইমাম ছিলেন, যা তার বিচক্ষণতার দ্বারাই প্রমাণিত। বর্তমানে আমাদের সময়ে এমন আলেমগণের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যারা যতটা সম্ভব আধুনিক সংস্কৃতি, মনোবিজ্ঞান, সামাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি, ফিকহ, দর্শন আর এর মতবাদসমূহ, এবং ইতিহাস নিয়ে অধ্যয়ন করবে।

অষ্টমতঃ এসব কিছু শুধুমাত্র তখনই সম্ভব হবে, যখন তাদেরকে এই ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত করা যাবে যে, তারা কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল ও মসজিদের সরকারী কর্মচারী। আর তাদের মধ্যে এই অনুভূতির সৃষ্টি করতে হবে যে, তারা দাওয়াতের একচ্ছত্র ধ্বজাধারী, চিন্তাশীল মানুষ। সুতরাং কর্মচারী আর দায়ীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, একজন কর্মচারী ইসলামের উপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করে; আর একজন দায়ী ইসলামের জন্যই বাঁচে এবং ইসলামের জন্যই মৃত্যুবরণ করে।

নবমতঃ মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক আলেমের একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকা এবং যোগাযোগ রক্ষা করা। মুসলিম আলেমগণের প্রত্যেকেই নিজেদের সমাজে একেকটি বড় শক্তি। তাদের প্রত্যেকের একটি আলাদা সামজিক প্রভাব রয়েছে, সেই সাথে বিশাল সংখ্যক শ্রোতা, অনুসারীও আছে। আপনাদের উচিত নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ করা এবং সমাজের প্রত্যেক স্তরে সমন্বয় ও সহযোগিতা করার চেষ্টা করা।

ইসলামের শত্রুরা আলেমদেরকে বিভক্তকারী ছোট খাটো বিষয়গুলো সম্পর্কে জানে। তাই তারা সেগুলোকে শক্তিশালী ও বড় করে দেখায় এবং সেগুলোকে চলমান রাখার জন্য কাজ করে  থাকে এবং প্রয়োজনে একে অপরকে আঘাত করার জন্য ব্যবহার করে। তারা মুসলমানদের একটি দলকে বিভ্রান্ত করে এভাবে যে- “আমরা অমুক দলের বিরুদ্ধে তোমাদের সাথে আছি।”; কিন্তু সত্য হচ্ছে যে তারা আমাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এবং আমাদের প্রত্যেকের শত্রু। আসলে এটি একটি নোংরা কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া এবং তাদের ষড়যন্ত্র তাদের দিকেই ফিরিয়ে দেওয়া আমাদের মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্য।

সর্বশেষ, উম্মাহর সম্মানিত আলেমদের অনুরোধ করবো এমন প্রতিটি  আহবানের পাশে দাঁড়ানো, যারা সঠিক দিক নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামকে আরও একবার মানব সভ্যতার নেতৃত্বে ফিরিয়ে দিতে এবং সমাজকে আবারো ইসলামের আলোকে বিনির্মাণ করতে কাজ করছে। তারা হেদায়েত, কর্ম, ত্যাগ আর পরিশ্রমের সারিতে অগ্রগণ্য, কুরআন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে “আর তার কথার চেয়ে কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকাজ করে এবং বলে, ‘নিশ্চয়ই আমি মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত’।” (ফুসসিলাতঃ ৩৩)।

 

অনুবাদঃ নাজমুস সাকিব নাঈম।

১৫৭৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top