পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রসঙ্গে ইকবাল

ইকবাল পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বলতেন বণিক সভ্যতা। তাঁর মতে এই সভ্যতার অভূতপূর্ব কারিগরী সমৃদ্ধি ঘটলেও মানবিক প্রগতির ক্ষেত্রে এর অর্জন সীমিত। তিনি এই সভ্যতাকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন এবং এর মর্মমূলে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর শিক্ষা জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কাটে ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে। দর্শনের ছাত্র তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রকৃত রূপটি পর্যবেক্ষন করেছিলেন। ইকবাল উপলব্ধি করেন আধুনিক ইউরোপের প্রযুক্তি ও কৌশলগত সমৃদ্ধি যত ব্যাপক হোক না কেন এর ভিত্তি দুর্বল। ইউরোপীয় সভ্যতার যে চাকচিক্য তা তৈরী হয়েছে অবিশ্বাসের সৌধের উপর। মধ্যযুগে সিজার ও পোপের আধিপত্যের লড়াইয়ে পোপের ক্ষমতা খর্ব করা হলে ধর্মকে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং মানুষের স্বাধীনতার নামে মানুষের উপর অবিশ্বাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। এই রাজনৈতিক – সামাজিক অব্যবস্থার মধ্যে জন্ম নেয় পুঁজিবাদের জুলুম। এ জুলুমের রাষ্ট্রীয় পরিণতি হিসেবে আসে জাতীয়তাবাদ যা জাতিতে জাতিতে হানাহানি আর বিপর্যয়ের সূচনা করে। ইকবাল লক্ষ্য করেছেন এই ঘোরতর অব্যবস্থার মধ্যে ত্রাণকারীর ভূমিকায় আসে কমিউনিজম যা কিনা এক নতুন রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ও স্বৈরাচারের জন্ম দেয়।

উপমহাদেশের বণিক শাসনের সূচনার পর থেকে মুসলিম সমাজ বিশেষত মুসলিম তরুণ সম্প্রদায় ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও দর্শনের অনুরাগী হতে শুরু করে। এ অনুরাগ পরবর্তীকালে পাশ্চাত্য প্রীতিতে পরিনত হতে শুরু করলে ইকবাল এ প্রক্রিয়াকে আত্মঘাতী হিসেবে বিবেচনা করেন। কারণ তাঁর কাছে পাশ্চাত্য সভ্যতা ছিল বস্তু সভ্যতার মডেল। পাশ্চাত্যের কারিগরী সমৃদ্ধি ও কৌশলগত প্রযুক্তি তাঁকে আকৃষ্ট করলেও এর অন্তঃসম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং নৈতিক অনগ্রসরতা এর অনিবার্য ধ্বংসকে ডেকে আনতে পারে বলেও ইকবালের মনে হয়েছিল।

ইকবাল তাই মুসলিম সমাজকে বণিক সভ্যতার এই ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের দিকে ইংগিত করে স্বীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হবার আহবান জানান। ইকবাল দেখেছেন মূল্যবোধের বিপর্যয়ের কারণে ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ কেমন মানবতা বিধ্বংসী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এবং তার অনিবার্য ফলাফল জুলুম ও শোষণের আকারে প্রাচ্যের দেশগুলোকেও গ্রাস করে চলেছে। তিনি তাঁর এক কবিতাইয় বলেছেন এই সভ্যতার ভিত্তি খুব দুর্বলঃ

শরাবখানার বুড়ো লোকটি বলছেন ফিরিঙ্গির ত্রুটির কথা

দুর্বল তার বুনিয়াদ , দেয়ালও কাঁচের।

(তরজমা- দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়)

ইকবাল ইউরোপীয় সভ্যতার সমালোচনা করেছেন। তিনি এ কথা বলে ইংগিত করতে চেয়েছেন বণিক সভ্যতার দুর্বল নৈতিক ভিত্তি ও বস্তুবাদী লোভ যে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে তা ক্রমে বিশ্বজনীনরূপে দেখা দেবে। এই সাবধানবাণী কবির দার্শনিক প্রজ্ঞারই নিদর্শন। কিন্তু তখনকার দেয়া কবির এ সাবধানবাণী ইউরোপ কানেই তোলেনি কিংবা মনে করেছে এটি একটি নতুনতর পূর্বদেশীয় দুর্জেয় চিন্তার প্রতিফলন মাত্র।  কিন্তু প্রকৃত অর্থে যখন বণিক সভ্যতার বুনিয়াদ নড়ে উঠলো, পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধ যখন পৃথিবী কাঁপিয়ে তুললো তখন ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা ইকবালের বিশ্বদৃষ্টির সমর্থন দিলেন এবং তা অবশ্য অনেকটা বাধ্যতা মূলকভাবে। ইকবাল মুসোলিনীকে নিয়ে লেখা এক কবিতায় বণিক সভ্যতার আধিপত্যবাদী চিত্র সম্বন্ধে ইংগিত করেছেনঃ

ইম্পিরিয়ালিজম্- এর দেহটা প্রকান্ড। হৃদয়টা অন্ধকার…

(তরজমা- অমিয় চক্রবর্তী)

ইকবাল পাশ্চাত্য সভ্যতার মৌলিক দুর্বলতাটি ধরতে পেরেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের আলো-ঝলমলে চেহারা মনোরঞ্জনকারী  হলেও এর ভঙ্গুর নৈতিক ভিত্তি একে করে তুলেছে দানবীয়। বিজলী বাতি পশ্চিমাদের নৈশকালীন অন্ধকার দূর করেছে ঠিক কিন্তু এর চিন্তার দিগন্তকে মেঘমুক্ত করতে পারেনি তেমনি পারেনি স্বর্গীয় আভা যুক্ত করতে । ইকবাল তাঁর লেনিন কবিতায় পরলোকগত এই বলশেভিকর জবানীতে ইউরোপের বিরূদ্ধে ধীক্কার জানিয়েছেনঃ

স্থাপত্য চাও তো দেখো ব্যাংকগুলোর দিকে

ধনিকের সৌধগুলি চার্চের চেয়ে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন।

বাণিজ্য- নিশ্চয় আছে , বস্তুত সেটা জুয়ো খেলা,

একজনের লাভে হাজারজনের মৃত্যু।

যে-মহাজাতি হারালো ভগবানের প্রসাদ ,

চরম তার উৎকর্ষ দেখো ইলেকট্রিসিটি এবং স্টিম ।

লক্ষ্মণ স্পষ্ট, – তকবির নামক দাবা- খেলিয়ে

করল বাজিমাত তদবির – দাবারুকে ।

সরাইখানার ভিতে লাগল ধাক্কা,

সরাই রক্ষকেরাও বসে ভাবছে

ভাগ্যের কথা ।

রাতে পথের লোকের মুখে দেখছে স্বাস্থ্যের রক্তিম আভা

তার কারণ ওদের শরাব-পান, অথবা কসমেটিক।

(তরজমা- অমিয় চক্রবর্তী)

ইউরোপের সামাজিক- রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইকবালকে শংকিত করেছিল। তাঁর সামনে ফুটে উঠেছিল পশ্চিমাদের ভঙ্গুর বিশ্বাস ও নৈতিকতাযুক্ত খোদাবিহীন সাম্রাজ্যের চেহেরা। তিনি ইউরোপের বিরাজমান অস্থিরতা ও মানবিক প্রকল্পের অনিশ্চয়তাকে যেমন দেখেছেন তেমনি এর বৈজ্ঞানিক প্রগতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইকবালের চিন্তা ও উপলব্ধি ধর্মের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠেছিল  এবং তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যতীত মানবতার জয়যাত্র কখনো স্থায়ী হয় না। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে এবং মানব প্রগতির ইতিবাচক সঞ্চয়ে ধর্মের অংশভাগটাই বড়। ইকবাল মনে করতেন ব্যক্তি ও সমাজ জীবন থেকে ধর্মের বিয়োজন নৈরাজ্যের জন্ম দেয়। ইউরোপীয়রা ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে পরিত্যক্ত ঘোষনা করে বিশৃংখলাকেই আমদানী করেছে মাত্র। যেমনঃ

ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করেছিল গোপন রহস্য

যদিও বিজ্ঞ লোকেরা তা প্রকাশ্যে বলেনি –

ডেমোক্রাসি হল সেই রাষ্ট্রবিধান

যাতে মানুষকে গোনা হয়, ওজন করা হয়না।

রাষ্ট্রশক্তি মুক্ত হল চর্চের হাত থেকে,

ইউরোপীয় পলিটিকস সেই দানব যার শিকল কেটেছে কিন্তু অন্যের সম্পত্তি যখন দানবের চোখে পড়ে, তখন

চর্চের দূতেরা চলে যুদ্ধবাহিনীর আগে-আগে।

ইউরোপীয় দার্শনিককে প্রশ্ন করা দরকার,

কেননা হিন্দুস্তান এবং গ্রীসও তার অনুসরণ করছে;

“তোমাদের সভ্যতার চরম কি এই যে পুরুষেরা চাকরি পায়না আর মেয়েরা পায়না স্বামী?”

হে খোদা,ইউরোপীয় পলিটিকস তোমার প্রতিদ্বন্ধী;

তবে তাদের শিষ্যেরা ধনী এবং বলবান। –

(তরজমা – অমিয় চক্রবর্তী)

ইকবাল তাঁর ফারসী মসনবী “পস চেহ্ বায়দ কর্দ অ্যয় আকরাম-এ-শার্ক- ইউরোপীয় সভ্যতার দুষ্টু সত্যকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন । এখানে তিনি ভারতের বিশেষভাবে প্রাচ্যের গোলামী-বন্ধত্বের জন্য বেদনা প্রকাশ করেছেন। এ লেখায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ কর্তৃক অর্থনৈতিক শোষণের রূপটি উদঘাটিত হয়েছে তেমনি আছে পাশ্চাত্য কিভাবে দুর্বল জাতিদের করায়ত্ব করেছে , কিভাবে তাদের বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছে মানুষকে গোলাম বানাতে। সবশেষে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক শঠতায় আক্রান্ত নিপীড়িত মানুষের হয়ে ইকিবাল প্রতিবাদ করেছেনঃ

মানবতা কাঁদে আজ ফিরিঙ্গ শোষণে,

বুনেছে সে লাশ বীজ চারি ধার ব্যেপে !

সে যেন মেষের বেশে বৃক, আশেপাশে

নিরীহ প্রাণীর দলে খুঁজছে শিকার!

সর্ব মানুষের ক্লেশ-দুঃখ তারই থেকে

সঞ্চারী মরণ সে যে দেহ ক্রিয়া মাঝে,

আমাদের ভাঙ্গা ঘরে জ্ঞানের ক্রিমিয়া!

হায়! ফিরিঙ্গির তাতে পৃথক প্রভাব !

আবিশ্ব কুখ্যাতি – অপব্যবহারে তার।

জিব্রাইল বলে ওঠে ইবলিশ, দাপটে!

ফিরিঙ্গি জ্ঞানের তলের মরনাস্ত্র গূড়

নতুন বিধ্বংসী এক নরনিধনের প্রস্তুত

দুর্বল জাতের পরে জুলুম শোষণে!

তারই মাঝে বিশ্বে নয়া নকশার বয়ান!

আশা না ঘোচাতে পারে কাফন ব্যাপারী।

(তরজমা – অমিয় চক্রবর্তী)

এই সভ্যতার লক্ষ্য তাই নিবদ্ধ হয়েছে মানুষকে নিয়ে বেসাতী করায়। ইউরোপীয় সভ্যতার বণিক চরিত্র দিয়ে ইকবাল মনে করেন পৃথিবীতে কোন মানবিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়ঃ

হে খোদা!

পাশ্চাত্যের রাজনীতি প্রতিদ্বন্ধী তোমার

কিন্তু পূজারী এর শুধু মাত্র

ধনিক সমাজ।

আগুন থেকে তৈরি করলে তুমি

একটি ইবলিস

আর সে তৈরি করলো

দুহাজার ইবলিস মৃত্তিকা থেকে।

(তরজমা- আবদুল মান্নান তালিব)

ইকবালের ধারণা বণিক সভ্যতার প্রাণ লুকিয়ে আছে ইহুদী মেধা ও মননর ভিতরে। পশ্চিমা চিন্তা ও দর্শনের মৌল কাঠামো যেমন নিয়ন্ত্রণ করছে ইহুদীরা তেমনি ওদের বণিক চরিত্র বিকাশের পথ ধরে বর্তমানে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জনের পেছনে ইহুদী কূটনীতিও কার্যকর রয়েছে। ইকবাল জানতেন কুরআনের বর্ণনা অনুসারে এবং ইতিহাসের সূত্র সন্ধান করলে ইহুদীদের ছলাকলা বেরিয়ে আসবে। আল্লাহর নির্দেশ লংঘন করে ইহুদীরা বারবার লাঞ্চিত হয়েছে। সেই নির্দেশ অমান্যকারীরা এখন খ্রিষ্টীয় সাম্রাজ্যের মন্ত্রণাদাতা হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছে । ইহুদী ছলাকলার তোড়ে সুবুদ্ধি ও ধর্ম রক্তাক্ত হয়ে উঠেছেঃ

এ বিপুল বিলাসিতা , কর্তৃত্ব , ব্যবসা-

জ্যোতিহীন বক্ষমাঝে অশান্ত হৃদয়,

ফিরিংগী মেশিনের ধোঁয়ায় অন্ধকার

চতুর্দিক, আইমন আধিত্যকা নয়

এটি, এখানে নয় তাজাল্লি বিচ্ছুরণ ।

জীবনের দ্বিপ্রহরে মরণ শয্যায়

শায়িত এ সভ্যতা, হয়তো পরিচালক

হবে এর পশ্চিমের ইহুদি সমাজ।

(তরজমা- আবদুল মান্নান তালিব)

পশ্চিমা সভ্যতার আলো-ঝলমলে চেহারা কি তবে প্রহেলিকা ! ইকবালের বিশ্বাস ইউরোপিয়ানদের চাকচিক্য ও জাকজমক ঠিকই আছে, কিন্তু তাতে নেই হযরত মুসার স্বর্গীয় জ্যোতি। সেখানে অনুপস্থিত ইব্রহীম খলিলের স্পর্শ যার কারণে আগুন পরিণত হয় ফুলের সৌরভে । বৈজ্ঞানিক প্রগতি ইউরোপে বর্তমান কিন্তু মানবিক বিকাশের ধারা স্তব্ধ। এমনকি আধুনিক কালের যে বহুল আলোচিত বিপ্লবী দার্শনিকেরা তারাও জ্ঞাত নয় এর পরিণতি কোথায় এবং এই শৃঙ্খল মুক্তির উপায় কিঃ

ইউরোপের শ্বেত প্রদীপের দিকে একবার তাকাও

সিকান্দারের আরশির চেয়ে মদের সুরাহী

ওদের বেশী রোশনায়।

সাকীর তনুকা ঝলসে ওঠে শরাবীর চোখে।

কিন্তু হায়!

মুসা কলিমের দীপ্তি থেকে তারা বঞ্চিত ।

কোথায় পাবে তারা খলিলের উত্তাপ?

জড়তার মাঝে আচ্ছন্ন যে জ্ঞান

মুহব্বতের মন্ত্রশক্তি সেখানে বিলুপ্ত;

পশ্চিমের দিগন্ত অস্থির নিঃশ্বাস পূর্ণ

ওদের চিন্তায় নেই স্থিরতার লক্ষণ

জ্ঞানের দিকপালেরা এখন পোষণ করছে

অধৈর্য আত্মা।

পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিতরে বস্তুবাদী আধিপত্যের পরিণতিতে ধর্মের মহিমা হয়েছে ভুলুণ্ঠিত। ধর্মের নৈতিক বন্ধন লাঞ্চিত সমাজে জড়বাদের পরিণতিগুলোও দৃশ্যমান। পশ্চিমের বস্তুবাদী নৈরাজ্যের একটি বর্ণনা ইকবাল তাঁর বিখ্যাত মাদ্রাজ বক্তৃতায় তুলে ধরেছেনঃ

আধুনিক মানুষ তার বুদ্ধির আবিষ্কার ও উপলব্ধি দ্বারা এতদূর সমাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে আধ্যাত্মিকতার আবেদন তার জীবনে আর নেই বললেই চলে । নিজ অন্তরের সাথেই তার যোগ নেই । চিন্তা-জগতে যেমন তার নিজের সাথে দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনেও তেমনি অপরের সাথে তার দ্বন্দ্ব। বিকট আত্মসর্বস্বতা , অফুরন্ত ঐশ্বর্য-পিপাসা তাকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে; অপরপক্ষে তার লাভ হয়েছে জীবনব্যাপী অবসাদ। বাহ্যতঃ যা সত্য, তা-ই তার কাছে চরম সত্য, তা-ই আজ তার প্রেরণার একমাত্র উৎস। জীবনের অনাবিষ্কৃত গভীরে লালিত সত্যের আমন্ত্রণ তার কাছে একান্ত ব্যর্থ । বস্তুবাদের পরিণতি যে জীবনে অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা ও অবসাদ ডেকে আনবে, হাক্সলি পরম বেদনার্ত চিত্তে এই আশংকাই করেছিলেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাণ যে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ তার অস্থির পীড়নে মানবতা জর্জরিত । পুঁজিবাদের দংশনে যেমন সামাজিক জুলুম হয়েছে বর্ধিত তেমনি সমাজবাদের বিনিময়ে পৃথিবী লাভ করেছে খোদাহীন দৌরাত্ম। এমনি যে ইউরোপীয় সভ্যতা তার অন্ধ অণুকরন ভারতীয় মুসলমানদের জন্য হবে আত্মঘাতী। ইকবাল মনে করতেন মুসলিম তরুণদের ইউরোপীয় চিন্তা ও দর্শনের প্রকৃত স্বরূপ আঁচ না করেই তার পেছনে ছোটা নির্থকঃ

সোফা তোমার ইউরোপের , গালিচা ইরানের

এমনি বিলাসিতা যখন দেখি তরুনদের –

মগজে খুন চাপে আমার। কিসের এত জোঁক?

কি দাম ধন-দৌলতের কিসের পেটা ঢাক?

কি হবে ফাঁকা শাহানশাহী এ শান-শওকত

বাহুতে যদি না থাকে কারও আলীর হিম্মত

যদি না পার দুনিয়াটাকে সুলেমানের মত

দু’পায়ে ঠেলে ফেলতে তবে দেমাগ কেন অত

মুসলিমের মেরাজ সেই আসক্তিহীনতা-

কোথায় পাবে চকচকে এ কালের সভ্যতা?

জাগে যখন যৌবনের শ্যেন দৃপ্ত প্রাণ

দেখে আপন মনজিল সে অসীম আসমান

আশা অমর, ধ্যান , জ্ঞানের মৃত্যু হতাশায়-

মনের চাবি কাঠি খোদার মুমিন শুধু পায়

তোমার নীড়ে নয় শাহের প্রাসাদ গম্বুজে

শাহীন তুমি বাঁধবা বাসা পাহাড়ে চূঁড়া খুঁজে।

( তরজমা- আবুল হোসেন)

মুসলিম তরুণদের ইউরোপীয় চিন্তা দর্শনে ভারাক্রান্ত হওয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি তাদের নৈতিক বিপর্যয়ের কার্যকারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। ইকবাল উল্লেখ করেছেন আধুনিক তরুণদের অন্তরে ধর্মানুরাগ নেই। তাদের আছে ক্ষুরধার জবান কিন্তু চোখে অনুতাপের অশ্রু অর্থাৎ খোদাভীরুতা থেকে তারা বঞ্চিত। ইকবাল প্রশ্ন করেন যে সভ্যতার নিজের বিপর্যয় ঠেকানোর মতো শক্তি নেই , কি করে সে অন্যের বিপদ হরণ করবে। আশ্চর্য যার নিজের নেই আলো সে কি করে অন্যকে পথ দেখাবেঃ

চোখে ঝলসানো সূর্যকর যাদের ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনা কিংবা যাদের দৃষ্টি প্রদীপ হয়েছে নিষ্প্রভ

কি করে পারস্য হেজায আহরন করবে

ওদের কাছে জীবনের রং

যারা নিজেরাই মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়েছে

তারা কি করে দেখাবে অন্যে বাঁচবার আশা।

ইকবাল তাই প্রাচ্যের আধুনিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার কারণ বণিক সভ্যতা প্রাচ্যের নৈতিক রীতি-বন্ধনকে কেটে ফেলতে উদ্যত। এক কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন ইউরোপীয়রা সর্বদাই প্রাচ্যের অধিবাসীদেরকে বক্র দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। প্রাচ্যের শুচিতার বিনিময়ে তারা তাদের দিয়েছে বিদ্বেষের মর্মপীড়া। যেমনি সিরিয়া তাদের দিয়েছে খ্রীষ্টের নৈতিক ব্যবস্থা , প্রকারন্তরে ইউরোপীয়রা সিরীয়দের শিখিয়েছে মদ,জুয়া আর বারবনিতার কদর্য ব্যবসাঃ

এই সিরিয়া দেশ ফ্রাঙ্কদের দিয়েছিল

দরদী পূন্যবন্ত এক পয়গম্বরকে,

পরিবর্তে ফ্রাঙ্করা সিরিয়াকে দিয়ে গেল

জুয়া মদ আর বেশ্যার ঝাঁক ।

( তরজমা- দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়)

সুতরাং প্রাচ্যের আধুনিকতায়নের তাগাদা নিরর্থক। এর অর্থ হলো পশ্চিমা জীবন-দর্শনের কাছে প্রাচ্যের অধিবাসীদের বিক্রি হয়ে যাওয়াঃ

আমার হৃদয় কম্পিত হয়

যখন শুনি প্রাচ্যের আধুনিকতা সজ্জার কথা

কিন্তু এ হলো ইউরোপের উন্মাতাল অনুকরণ ।

ইকবালের ভাবনায় জমা হয়েছিল এক বিশ্বাসী জীবনের রূপরেখা।এই বিশ্বাসের আলোকে তিনি জীবনের প্রতিটি কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার নৈতিকতা বর্জিত রূপটিকে তাই তিনি জীবন বিকাশের প্রতিবন্ধক মনে করতেন। তার অর্থ এই নয় ইউরোপীয়দের সকল কর্মকান্ডকেই তিনি পরিহার করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্যের কারিগরি সমৃদ্ধি তাকে মুগ্ধ করেছিল এবং তিনি এর সফলতাকে প্রাচ্যের অধিবাসীদেরও কাজে লাগানোর উপদেশ দিয়েছিলেন। কারন মানব প্রগতি সহায়ক যে কোনো উপকরণ তা যে স্থানেরই হোক না কেনো , আহরন করবার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি । পশ্চিমা সভ্যতার যা কিছু কল্যাণকর তা  গ্রহন করবার কথাও কবি একস্থানে উল্লেখ করেছেনঃ

পাশ্চাত্যের শক্তি নিহিত রয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানে

তোমার পাগড়ী তো জ্ঞান আহরনের পথে বাধা নয়।

হদিস

১) মুহম্মদ ইকবাল , ইসলামের ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন ।

ঢাকাঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৭ ।

১২৪৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ডাঃ ফাহমিদ-উর -রহমান

ডাঃ ফাহমিদ-উর -রহমান

জন্ম যশাের জেলায় ২৮ অক্টোবর, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। শৈশব ও কৈশাের যশাের জেলা স্কুল ও যশাের এম. এম. কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্ এন্ড সার্জন থেকে মনােরােগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ফাহমিদ-উর-রহমান মননশীল প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী। ছাত্র জীবন থেকে লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এবং পেশাগত জীবনের বাইরে তিনি নিরন্তর নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও বৈশ্বিকভাবে বাঙ্গালি মুসলমানের স্থান নির্ণয়ের কাজে। সাহিত্যের নেশা তাকে টেনেছে। পেশার প্রাচীর তার কলম আটকিয়ে রাখতে পারেনি। নেশা তার বিচিত্র। ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি - সকল বিষয়ে তার আগ্রহ। এর ভিতর দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী যা দিয়ে তিনি হাঁটেন বহু বিচিত্র পথে। শিখেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলতে। প্রবল সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসচেতনা তাকে তাড়িত করে, যার ফলে তার লেখায় থাকে তত্ত্ব, তথ্য ও ভাবুকতার এক অনন্যপূর্ব আস্বাদ, যা তাকে একজন মূলত আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে চিহ্নিত করে। তার এই সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসাকে বিদ্বৎসমাজ শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।
Picture of ডাঃ ফাহমিদ-উর -রহমান

ডাঃ ফাহমিদ-উর -রহমান

জন্ম যশাের জেলায় ২৮ অক্টোবর, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। শৈশব ও কৈশাের যশাের জেলা স্কুল ও যশাের এম. এম. কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এবং শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক, পরবর্তীতে বাংলাদেশ কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস্ এন্ড সার্জন থেকে মনােরােগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ফাহমিদ-উর-রহমান মননশীল প্রাবন্ধিক ও বুদ্ধিজীবী। ছাত্র জীবন থেকে লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এবং পেশাগত জীবনের বাইরে তিনি নিরন্তর নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও বৈশ্বিকভাবে বাঙ্গালি মুসলমানের স্থান নির্ণয়ের কাজে। সাহিত্যের নেশা তাকে টেনেছে। পেশার প্রাচীর তার কলম আটকিয়ে রাখতে পারেনি। নেশা তার বিচিত্র। ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্ম, সমাজ ও রাজনীতি - সকল বিষয়ে তার আগ্রহ। এর ভিতর দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী যা দিয়ে তিনি হাঁটেন বহু বিচিত্র পথে। শিখেছেন স্রোতের বিরুদ্ধে কথা বলতে। প্রবল সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসচেতনা তাকে তাড়িত করে, যার ফলে তার লেখায় থাকে তত্ত্ব, তথ্য ও ভাবুকতার এক অনন্যপূর্ব আস্বাদ, যা তাকে একজন মূলত আদর্শ সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে চিহ্নিত করে। তার এই সাংস্কৃতিক অনুসন্ধিৎসাকে বিদ্বৎসমাজ শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হয়েছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top