আমরা জানি যে, বীজ হল খাদ্যের প্রধান উপাদান। হাজার হাজার বছর ধরে বীজ প্রকৃতিতে স্ব-উত্থিত হয়েছে এবং ১০,০০০ বছর আগে ফসল রোপণ করে উৎপাদন করা শুরু হয়েছে। বীজ আল্লাহর এমন একটি নেয়ামত যে, মাটিতে পুঁতে দিলে নিজে নিজেই চারা দেওয়া শুরু করে । আর ভালভাবে দেখভাল করলে তা থেকে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া সম্ভব । এ বীজের উপর একজন কৃষকের জীবিকা থেকে শুরু করে একটি দেশের অর্থনীতি পর্যন্ত নির্ভরশীল ।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো ২ টি ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ – প্রযুক্তি ও খাদ্য । এই ২ টি বিষয় যে দেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে তারা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারবে আর সেইসাথে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও ধারণ করবে ।
মানবসভ্যতার জন্যে সর্বদাই হুমকিস্বরূপ জায়নবাদী গোষ্ঠী এ বিষয়টি আগেই ধরতে পেরেছিল । নিজেদেরকে সকল মানবজাতির উপর শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করার অসুস্থ চিন্তা বরাবরই তাদের হিংস্র থেকে হিংস্রতর করে দিয়েছে । এরই অংশ হিসেবে ১৯০০ সালের শুরুর দিকে দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে তৈরি হয় রকফেলার ফাউন্ডেশন ( রকফেলার পরিবারের গড়া ), যারা পরবর্তীতে কার্নেগী, হ্যারিমান, গেট্স ও অন্যান্য ক্ষমতাধর পরিবারগুলোকে নিয়ে একত্র হয়ে বিশ্বকে নিজ ক্ষমতায় নেওয়ার চেষ্টা করার পরিকল্পনা করে এবং তারই অংশ হিসেবে পৃথিবীতে অপ্রয়োজনীয় (তাদের মতে) বংশগুলোকে (অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতিকে) চিরতরে মুছে ফেলার জন্যে পদক্ষেপ নিয়ে এগোনোর চিন্তা মাথায় নেয় । এর জন্যে তারা সকল ধরণের ক্ষমতাধর ব্যাক্তিদের হাত করে নেওয়ার চেষ্টা করে, প্রতিপত্তির লোভ দেখিয়ে কিংবা ভয় দেখিয়ে, তা যেভাবেই হোক না কেন ! তারা সমগ্র দুনিয়াতে নিজেদের শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা শুরু করে নিজেদের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই । এমনকি হিটলার যখন চরম জনপ্রিয় তখন হিটলারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে নিজেদের অনেক কাজ করিয়ে নেয় ।
সমগ্র বিশ্বের শাসন করার চেষ্টায় রকফেলার ও সহঘরানার অন্যান্য ফাউন্ডেশনগুলো জাতিসংঘ ও সহযোগী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে নিজেদের অনুকূলে বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নিতে থাকে । তাদের শোষণের হাতিয়ার বড় বড় কল-কারখানাগুলোর জন্যে সেসময় অনেক শ্রমিকের দরকার পরে । শহরে অবস্থিত পুঁজিবাদীদের সেসকল কল-কারখানাগুলোর জন্য সস্তা শ্রম সরবরাহের নিমিত্তে কৃষক ও গ্রামে বসবাসকারীদের গ্রাম থেকে শহরগুলিতে স্থানান্তরিত করার বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিতে থাকে। অল্পোন্নত ও অনুন্নত দেশগুলোতে মূলত সিংহভাগ মানুষের পেশা কৃষি আর এই কৃষির উপর সরকারের সহযোগিতা কমানোর জন্যে অব্যাহত চাপ দেওয়া, বিভিন্ন রোগ জীবাণু ও ক্ষতিকর পোকামাকড়ের উৎপাত বাড়াতে পরোক্ষভাবে চেষ্টা করা, নিজেদের কোম্পানিগুলোর সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতির জন্যে বাজার সৃষ্টি করার মত প্ল্যানগুলো এসবের অন্যতম ।
একই সাথে তারা নিজেদের পণ্যের জন্যে সেসব দেশে বাজার উন্মুক্ত করছে, নিজেদের বীজের উপর এসকল দেশকে নির্ভরশীল করছে আর পাশাপাশি সেসব দেশের মাটি পরবর্তীতে কৃষির জন্যে ধীরে ধীরে অনুপযোগী করে গড়ে তুলছে, যার ফলে কৃষক কৃষি কাজের প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে । শহরগুলোর আলিশান জীবনযাত্রা ও সুযোগ সুবিধাগুলো এমন চিত্তাকর্ষী করে গড়ে তোলা হয়েছে যে, গ্রাম ছেড়ে শহরেই যেন প্রকৃত সুখ এমনটি ভেবে শহর নামক মরিচিকার পিছনে ছুটতে বাধ্য হয়েছে লাখ লাখ কৃষক পরিবার।
রকফেলার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় কারগিল(Cargill) কোম্পানি ও পরবর্তীতে নব্য প্রতিষ্ঠিত ডুপন্ট/পাইওনিয়ার(DuPont/pioneer), বায়ার (Bayar), মনসান্টো(Monsanto,বর্তমানে বায়ার কর্তৃক ক্রয়কৃত) এবং সিনজেনটা (Syngenta) 1980 সালের পর থেকে হাইব্রিড বীজ এর উপর গবেষণা ও উৎপাদন জোরদার করছে। এগুলো ছাড়াও বাসফ (BASF) হাজেরা (Hazera) প্রমুখ কোম্পানিগুলো হাইব্রীড বীজ ও কীটনাশক তৈরিতে এবং পৃথিবীতে বাজারজাতকরণে সামনের সারির স্থানগুলো দখল করে বসে আছে । তারচেয়েও বড় বিষয় হল, এসকল বীজ ও কীটনাশক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আবার মানুষের জন্যে ঔষধ ও তৈরি করছে ! উপরল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিভাগই একই কিংবা ভিন্ন নামে ঔষধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে সমগ্র পৃথিবীতে । এমনকি বীজ, কীটনাশক ও ঔষধ তৈরিতে তারা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এমন এক বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে যে, তাদের অগোচরে কেউ এগুলো তৈরি ও করতে পারবে না । করলেও সেগুলো বাজারজাত করা অসম্ভবপ্রায় ।
আফ্রিকা সহ ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে জমির উর্বরতা নষ্টের পিছনেও মানববিধ্বংসী এসব বড় কোম্পানিগুলোর হাত রয়েছে । এক সময় অতিউর্বর আফ্রিকার মাটি এখন স্বকীয়তা হারাবার পথে, অপরদিকে অশিক্ষা, বাহ্যিক চাকচিক্যময় ইউরোপীয় প্রভাব, লুটপাট এসব আফ্রিকানদের অন্য দেশে পাড়ি জমাবার পথে ধাবিত করছে উন্নত জীবনযাত্রার সোনার হরিণ বধ করার নিমিত্তে । কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হল, সেসব দেশে গিয়েও তারা শ্রমিক হিসেবে সাম্রাজ্যবাদীদের জন্যেই হাঁড় ভাঙ্গা শ্রম দিচ্ছে। এভাবেই তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ আফ্রিকার কৃষি ও মানুষেরা । শুধু আফ্রিকাই নয়, এশিয়ার ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশই এই মরিচিকার পিছে ছুটে নিজেদের শেষ করে দিচ্ছে।
সবুজ বিপ্লব(Green revolution) এর সময়ে ও ৮০’র দশকের পর পৃথিবীতে ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে হাইব্রিড বীজ ব্যাবহারের প্রতি গুরুত্ব বাড়ানো হয় । আসলে হাইব্রিড বীজ ফসলের উৎপাদন বাড়ালেও উৎপাদনের বিভিন্ন ধাপে উচ্চ মাত্রায় কীটনাশক, সেচ ও সার ব্যাবহার করার প্রয়োজন পরে । অন্যদিকে, এই বীজগুলি পরবর্তী বছরে একই ফল এবং পণ্য উৎপাদন করে না, তাই তারা প্রতি বছর বীজ কিনতে বাধ্য হয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে কৃষক প্রতি বছর হাইব্রিড বীজের পিছনে টাকা খরচ করছে, অর্থাৎ কোম্পানিগুলির কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করছে।
পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু সেই তুলনায় কৃষি জমি বাড়ছে না, এই অজুহাতে কৃষকদের হাইব্রিড বীজ ব্যাবহারে বেশী বেশী উদ্বুদ্ধ করা হয় দিনকে দিন । সেই সাথে স্থানীয় জাতের বীজে যে ফলন পাওয়া যায় সেগুলো দেখতেও হাইব্রিড জাতের মত হৃষ্ট পুষ্ট হয় না । এজন্যে মানুষ কেনার সময় হাইব্রিড জাতের প্রতি বেশী ঝুঁকে পরেছে । কৃষকেরাও তাই বেশী বেশী হাইব্রিড জাত উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে ।
হাইব্রিড বীজগুলো নিজেদের মধ্যে শঙ্করের মাধ্যমে উৎপন্ন করা হলেও পরবর্তীতে জেনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম (GMO) বীজের উৎপাদন শুরু করা হয়েছে । GMO এর বৈশিষ্ট্য হল, এর জিনের ভিতরে অন্য কোন জিনের (হতে পারে অন্য কোন উদ্ভিদের কিংবা প্রাণীর) প্রবেশ করানোর মাধ্যমে ঐ বীজের কোন একটি ক্ষমতা বৃদ্ধি করা । যেমন, ধানের পোকার আক্রমন থেকে রক্ষার জন্যে ঐ পোকার জন্যে ক্ষতিকর এমন কোন কিছুর জেনেটিক বৈশিষ্ট্য বীজের ভিতরে ঢুকানো যাতে করে ফসলের অঙ্কুরোদ্গম থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত ঐ পোকা আক্রমণ না করতে পারে ।
এটি আপাতদৃষ্টিতে কার্যকরী মনে হলেও এক্ষেত্রে পরবর্তীতে ঐ পোকার বদলে অন্য কোন ক্ষতি যে দেখা দিবে না তার কোন নিশ্চয়তা কেও দিতে পারবে না । তার উপর ডিএনএ রিকম্বিনেশনের (জিন প্রবেশ করানোর পদ্ধতি) সময় যে অন্য কোন জেনেটিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিন ও যে প্রবেশ করবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না কখনই । হতে পারে সেই জিন মানুষের জন্যে আরও ভয়ানক! আর যাদের চিন্তাই হল মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করা, তারা যে GMO এর মাধ্যমে মানুষের জন্যে ভালো কিছু নিয়ে আসবে সেধরনের চিন্তা করাটাও বোকামি বলা চলে।
১৯০০ এর শুরুর দিকে বিশ্বের অনেক দেশ নিজেদের বীজগুলো সংরক্ষণের জন্যে নিজস্ব জাতীয় বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এবং নিজস্ব জাতগুলো সেখানে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোতে থাকে । বিশ্বের সমস্ত দেশ থেকে বীজগুলো নিজেদের আয়ত্তে রাখার জন্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও তাদের সংগঠনগুলো নতুন পরিকল্পনা করে । তারা জাতীয় বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র গুলোর থেকে বীজ নেওয়ার জন্যে আন্তর্জাতিক বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র খোলার পরিকল্পনা করে এবং তারই নিমিত্তে রকফেলার ফাউন্ডেশন, গেটস ফাউন্ডেশন সহ এরকম সাম্রাজ্যবাদী সংগঠনগুলো নরওয়ের সভালবার্ড (Svalbard) দ্বীপে আন্তর্জাতিক বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয় ।
সভালবার্ড (Svalbard) দ্বীপে এটি করার কারণ এখানে প্রচুর বরফ থাকে এবং এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত না করতে পারে । এই কারণগুলোকে প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে নিয়ে তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে কেন এরকম একটি আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ কেন্দ্রের দরকার। এভাবে বুঝিয়ে কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে চাপ প্রয়োগ করে বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই তারা বীজ সংরক্ষণ করে আসছে । ২০০৮ সালে এই কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এবং বাংলাদেশ সহ প্রায় সকল দেশের বীজই এখানে সংরক্ষিত (!) রয়েছে ।
এসকল বীজগুলো মূলত আমরাই তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি, জেনে কিংবা না জেনে । ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর তাদের জাতীয় বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্র থেকে অনেক বীজের নমুনা হারিয়ে যায় । সেগুলো পরে কোথায় গেছে কেও ই জানে না। এমনকি সিরিয়া সঙ্কট শুরু হওয়ার পর সিরিয়ার যে বীজের নমুনাসমূহ সভালবার্ড (Svalbard) এ ছিল, সেগুলোর সঠিক কোন হদিস পাওয়া যায়নি । এগুলোর বেশিভাগ ই জায়নবাদি শক্তিদের হাতে চলে গেছে বলে ধারণা করা হয় । উন্নত ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের আশায় হাইব্রিড ও জিএমও এর কার্যক্রম চালানো হচ্ছে বলা হলেও মূলত এসবের পিছনে মূল উদ্দেশ্য মানুষকে নিজেদের জিম্মায় রেখে তাদের শোষণ করা । আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জায়নবাদীদের অন্যতম হোতা হেনরি কিসিঞ্জারের একটি উক্তি রয়েছে,
“যদি আপনি তেল নিয়ন্ত্রণ করেন তবে দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, যদি আপনি খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করেন তবে আপনি বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন আর এই খাদ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই এর মূল উপাদান বীজকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে”।