মানুষের জীবনে বিশ্বাসের গুরুত্ব নিম্নরূপ,

  • প্রথমত: বিশ্বাস একজন বিশ্বাসী ও আল্লাহর মধ্যে খুব গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং সেই সম্পর্ককে বিকশিত করে যা বিশ্বাসী হৃদয়কে ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং নিশ্চয়তায় পূর্ণ করে।
  • দ্বিতীয়ত: বিশ্বাস মানুষের জীবনযাত্রা ইতর প্রাণি থেকে ভিন্নতর করে তোলে। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। তাকে সৃষ্টিজগতের সকল কিছুর চেয়ে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সম্মানিত করা হয়েছে, নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। সে পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। ফেরেশতারাও ভাবতেন যদি মানুষের মতো তাদেরকেও এত সম্মানিত করা হতো! দ্বীন মানুষকে অনুধাবন করার আহ্বান জানায় যে, তার সত্তার যে অংশে আল্লাহ রূহ ফুঁকে দিয়েছেন, সে অংশে তার শক্তি নিহিত এবং যে অংশ পোড়া কাদামাটি থেকে তৈরি, সে অংশে তার দুর্বলতা নিহিত। জীবনের তুচ্ছ অসারতার কাছে মানুষের নতিস্বীকার করা উচিত নয় যা তাকে বিপথগামী করে। মানুষের উচিত সর্বদা উচ্চ মূল্যবোধের আকাক্সক্ষী হওয়া।
  • তৃতীয়ত: বিশ্বাস এ বিশাল সৃষ্টিজগতের সাথে মানুষের সম্পর্কের পরিধিকে বিস্তৃত করে। মানুষ এ সৃষ্টিজগতে অনুপ্রবেশকারী নয়। আর এ সৃষ্টিজগতও তার শত্রু নয়, বা তাকে তাড়া করে বেড়ানো রহস্য নয়। বরং মানুষের খেদমতের জন্যই এটি সৃষ্টি করা হয়েছে যা আল্লাহর অস্তিত্বের অন্যতম নিদর্শন। সব মানুষ তার ভাই-বোন। তার মতো তারাও আল্লাহর বান্দা এবং আদম (আ.)-এর বংশধর।
  • চতুর্থত: বিশ্বাস মানুষকে অনন্তকালীন জীবনের নিগূঢ় রহস্য সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে শেখায়। মানুষের জীবনের গল্প জন্মের মাধ্যমে শুরু হয়ে মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় না! জীবনের তেমন নয়, যেমনটা বলে থাকে অবিশ্বাসীরা। তারা বলে,

إِنْ هِىَ إِلَّا حَيَاتُنَا ٱلدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا نَحْنُ بِمَبْعُوثِينَ

“একমাত্র দুনিয়ার জীবনই আমাদের জীবন। এখানেই আমরা মরি-বাঁচি এবং আমাদের কখনো পুরুজ্জীবিত করা হবে না। (সূরা মুমিনুন : ৩৭)

বরং জীবন তেমন, যেমন বলেছেন উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রা.)। তিনি বলেছেন,

“তোমাকে অনন্তকালের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। মৃত্যু শুধুমাত্র একটি বাহন যা তোমাকে মৃত্যুপরবর্তী জীবনে নিয়ে যাবে।”

জীবন আসলে এমনই। এ সকল মূল্যবোধ মানুষকে তার অস্তিত্ব ও সৃষ্টির হাকীকত এবং জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে উপলব্ধি করায়। আর এ মূল্যবোধগুলো আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান থেকে উদ্ভূত হওয়া এক একটি স্তম্ভ, যেগুলোর উপর ভিত্তি করে খোদায়ী ধর্মগুলো সৃষ্টি হয়েছে।

 

বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন : একটি প্রয়োজনীয়তা

বিশ্বাসকে পুনরুজ্জীবিত করা আবশ্যকীয়। মানুষ ও জীবনে এর গঠনমূলক প্রভাব পুনরুদ্ধার করার জন্য আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো উচিত।

দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান চিন্তাধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থা যে দর্শন বেছে নিয়েছে, তা বস্তুবাদী প্রযুক্তিগত এবং অভিজ্ঞতামূলক জ্ঞানের প্রতি অধিক মনোযোগী, সেইসাথে ধর্মকে উপেক্ষাকারী, এমনকি ধর্মের প্রতি আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণকারী।

মূলত বর্তমান চিন্তাধারা ও শিক্ষাব্যবস্থা ধর্মকে বাতিল ঘোষণাকারী পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং ধর্মের বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী যুদ্ধ ঘোষণাকারী মার্কসবাদীদের দ্বারা প্রভাবিত।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণাধীন স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্ম শিক্ষা ক্লাস করানো হয় না, আর যদি করানো হয়, তবে তা গুরুত্বের দিক থেকে একদম শেষে থাকে। ধর্ম শিক্ষা করাকে এখন আর বড় সম্মানের কোনো বিষয় হিসেবে ভাবা হয় না। ধর্ম ক্লাসগুলোকে বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি বিরক্তিকর বিষয় হিসেবে দেখা হয়। অবস্থা এমন যে, স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দিনে বা সপ্তাহে এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে ধর্ম ক্লাস করতে বাধ্য করা হয় যেন! উপরন্তু সমালোচকদের সমালোচনা এড়ানোর জন্য এ সময়টাকেই যথেষ্টের চেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়।

অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যায়, বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার গতি হারানোটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়। এ শিক্ষাব্যবস্থায় সেই রূহের অভাব রয়েছে, যা মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করে এবং তাকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনে। এ তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে মুসলিম কবি ও দার্শনিক আল্লামা মুহম্মদ ইকবাল বলেছিলেন, “এটি চোখকে শেখায় না কীভাবে অশ্রু ঝরাতে হয়, এটি হৃদয়কে শেখায় না কীভাবে আল্লাহর স্মরণে বিনীত হতে হয়।”

বর্তমান গণমাধ্যমও এ অসুস্থ শিক্ষাব্যবস্থার চেয়ে ভালো অবস্থানে নেই। এটি সত্য যে, গণমাধ্যম এ আধুনিক দুনিয়ায় ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টিকারী একটি মাধ্যম এবং জনমত গঠনে সক্ষমতার ফল স্বরূপ এটি সংস্কৃতি অভিমুখী। কিন্তু বর্তমান গণমাধ্যমও স্বচ্ছ নয়; বরং নির্দিষ্ট কিছু ঐতিহ্য, ধারণা বা দল দ্বারা প্রভাবিত যা মানুষকে দুর্নীতির ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

আর এসব মূলত ধর্মে অবিশ্বাসী দর্শনকে বেছে নেওয়ার ফল।

বিশ্বাস মূলত একটি অভয়ারণ্য বা আশ্রয়স্থল। জান্নাত প্রাপ্তির পথ কষ্ট ও প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ, অন্যদিকে জাহান্নামের পথ লালসায় পরিপূর্ণ। যদি আমরা আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী না হই, তবে আমাদের পক্ষে সেই কষ্ট ও প্রতিবন্ধকতাগুলো সহ্য করা, সেইসাথে লালসাকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে না। আর এ আধ্যাত্মিক শক্তি আমাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতে সক্ষম রাখবে, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহর পথে থাকি। এটি আমাদেরকে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণগুলো, অর্থাৎ জীবনের লোভ-লালসা এবং ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করতে সক্ষম করে তোলে। আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দীর্ঘ এ অনিশ্চিত যাত্রায় বিশ্বাস আমাদের জন্য বিধানস্বরূপ।

বিশ্বাসই আধ্যাত্মিক শক্তির সৃষ্টিকারী। বিশ্বাস আমাদেরকে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রেরণা যোগায়। এটি পরম করুণাময় আল্লাহর ইবাদতকে এতটাই পরিপূর্ণ করার প্রেরণা দেয় যে, ইবাদত আমাদের জীবনের প্রশান্তিতে পরিণত হয়। এটি আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে সময়নিষ্ঠ হতে সাহায্য করে, যা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী বোধ করায়। আমরা নফল ইবাদত করি যাতে এই ইবাদতগুলো আমাদেরকে আল্লাহর ভালোবাসার কাছাকাছি নিয়ে আসে। মহামহিম আল্লাহ যদি কাউকে ভালোবাসেন, তাহলে তিনি তার শ্রবণশক্তি হয়ে যান, যা দিয়ে সে শোনে এবং তার দৃষ্টিশক্তি হয়ে যান, যা দিয়ে সে দেখে, তার হাত হয়ে যান, যা দিয়ে সে আঁকড়ে ধরে এবং তার পা হয়ে যান, যা দিয়ে সে হাঁটে। সে যদি তার কাছে চায়, তবে তিনি তাকে দেন, সে যদি তার কাছে নিরাপত্তা চায়, তবে তিনি তাকে রক্ষা করেন এবং নিরাপত্তা প্রদান করেন।

বলা বাহুল্য, বিশ্বাস শুধু মানুষকে পরকালীন চির সুখের পথেই পরিচালনা করে না, বরং তা ইহকালীন জীবনে সুখের কারণও বটে। সকল মানুষই জীবনে সুখ কামনা করে, কিন্তু খুব কমই তা অনুভব করার সুযোগ পায়। অনেকেই সুখের আশায় কোনো বিষয়ের প্রতি এতটাই মোহ তৈরি করে যে, এটির পেছনে বুনো হাঁসের মতো রুদ্ধশ্বাসে ছুটে বেড়ায়, এই আশায় যে, এটি তাদের সুখ দেবে। অথচ এটি মরুভূমির মরীচিকার মতো, যাকে তৃষ্ণার্তরা পানি মনে করে ছুটে যায়, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে কিছুই খুঁজে পায় না।

একমাত্র বিশ্বাসই মানুষকে মানসিক সুখ এবং শান্তি দিতে পারে। এ মর্মে আল্লাহ বলেন,

ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ ٱللَّهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ ٱللَّهِ تَطْمَئِنُّ ٱلْقُلُوبُ

“যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর যিকিরে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়; জেনে রেখো, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।” (আর রাদ : ২৮)

এটি সত্য যে, টাকা দিয়ে মানুষ অনেক কিছুই কিনতে পারে এবং টাকা হয়তো তার চাহিদার কিছুটা পূর্ণ করতে পারে। কিন্তু মানুষের সমস্ত প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং টাকা কখনোই তাকে সত্যিকার সুখ কিনে দিতে পারে না। সুখ বাজারে বিক্রি করার মতো বিষয় নয়। এটি একটি আত্মিক তৃপ্তির অনুভূতি যার সম্পর্কে আমাদের একজন দরিদ্র এবং ধার্মিক পূর্বপুরুষ বলেছিলেন, “রাজারা যদি আমাদের সুখের পরিমাণ বুঝতেন, তবে তারা এটি নিয়ে আমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন।”

বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের জন্য জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। মানুষ বর্তমানে একটি রিমোট নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে বসবাস করে। রিমোট কন্ট্রোলে একটি চাপ দেওয়ার মাধ্যমেই সে জীবনের বিলাসিতা উপভোগ করে। বিষয়টা এমন, যেন কয়েক ডজন সিনেট তার সেবায় নিয়োজিত রয়েছে! রিমোট কন্ট্রোল চাপার সাথে সাথে সে দূরত্ব জয় করে নিতে পারে। সে সোফায় আরামে বসে এমনভাবে সবকিছু নড়াচড়া করতে পারেন যেন সে ক্ষমতাশালী কারুন! এমনকি সে তার চারপাশের সকল কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে কোনো বোতাম চাপার ঝামেলা ছাড়াই! অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিজ্ঞান মানুষকে শারীরিক আয়েশ এনে দিয়েছে, কিন্তু এটি একই সাথে তাকে মানসিক শান্তি থেকেও বঞ্চিত করেছে। বিজ্ঞানের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, জীবনের সমাপ্তির বিষয়টা বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অন্যদিকে বিশ্বাসের লক্ষ্যই হলো মানুষের জীবনের সুন্দর সমাপ্তি প্রদান। বিশ্বাস মানে ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা। এটি মানুষকে নিজেকে পবিত্র করতে উদ্বুদ্ধ করে। এটি তাকে তার লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠতে এবং শ্রেষ্ঠ অবস্থানে পৌঁছাতে যথেষ্ট শক্তি এবং প্রেরণা দেয়। এটি যৌবনের উন্মাতাল কামনা-বাসনাকে দমন করে। এটি মানুষকে শেখায় কীভাবে প্রলোভনের কাছে হার না মানা দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি অর্জন করতে হয়, যে ইচ্ছাশক্তির বলে সত্যবাদী ইউসুফের (আ.) পাপের প্রলোভন থেকে বাঁচার জন্য কারাগারের অপমানকে শ্রেয় মনে করেছেন। তিনি বলেছিলেন,

قَالَ رَبِّ ٱلسِّجْنُ أَحَبُّ إِلَىَّ مِمَّا يَدْعُونَنِىٓ إِلَيْهِ ۖ

“হে আমার রব! এরা আমাকে দিয়ে যে কাজ করাতে চাচ্ছে তার চেয়ে কারাগারই আমার কাছে প্রিয়! (সূরা ইউসুফ : ৩৩)

বিশ্বাস আত্মত্যাগের প্রসঙ্গে মানুষকে ইসমাইলের মতো ধৈর্যশীল হতে শেখায়। তাঁর পিতা ইব্রাহীম (আ.) তাঁকে আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে বলেছিলেন,

تَرَىٰ ۚ قَالَ يَـٰٓأَبَتِ ٱفْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِىٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّـٰبِرِينَ

“এখন তুমি বল তুমি কি মনে করো?’ সে বললো, ‘হে পিতা! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে, তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।” (সূরা আস সাফফাত : ১০২)

পিতার প্রশ্নের উত্তরে তিনি আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।

শুধুমাত্র সত্যিকারের বিশ্বাসই সৎ গুণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি নৈতিক আদর্শ ও আখলাকী মূল্যবোধ প্রদান করতে সক্ষম। ইতিহাস এ সত্যের সাক্ষী যে, কোনো জাতি যখন সৎ কাজ করা ছেড়ে দেয়, তখন তারা বিশৃঙ্খলা, নিষ্ক্রিয়তা এবং সৃজনশীলতার অভাবের মধ্যে নিপতিত হয়। নৈতিক আদর্শবিহীন একটি জাতি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি। প্রখ্যাত কবি আহমদ শাওকির একটি কবিতার লাইন ছিলো এমন, “কোনো জাতি যদি তাদের নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে, তবে তারা মৃতের মতোই ভালো হয়ে যায়, যার কোনো কিছু করার ক্ষমতা থাকে না এবং মৃত দেহের জন্য শেষকৃত্য ও তার দুর্ভাগ্যের জন্য অশ্রুপাত করা ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারি না।”

বর্তমানে নেতৃস্থানীয়রা প্রায়ই তাদের জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের উপর নীতি-নৈতিকতা সংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। সম্ভবত তারা ভুলে গেছেন যে, আইন মানুষের চিন্তা বা অনুভূতির পথকে পরিবর্তন করতে পারে না। একমাত্র যে বিষয়টি মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে, পারে তা হলো তার আকল। আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিটি মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, কোনো আইন এর উপর ক্ষমতা রাখে না। অবশেষে নেতৃস্থানীয়রা শৃঙ্খলা আনয়নের মরিয়া প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পরে সমাজে, রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে এবং ষড়যন্ত্র, স্বার্থপরতা ও লালসা সত্য, ভালো ও দায়িত্ব-কর্তব্যের উপর প্রাধান্য লাভ করে। ফলশ্রুতিতে অপরাধ, নানাবিধ সংকট ও কেলেঙ্কারি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

ব্রিটিশ বিচারকরা একটি বিখ্যাত মামলার রায় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, “আইন, নৈতিক মান এবং বিশ্বাসের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া একটি সমাজের উন্নতি হতে পারে না। এ তিনটিই সমাজের ঐক্যবদ্ধতার জন্য অপরিহার্য।”

বিশ্বাস মুসলমানদের সুপ্ত শক্তির উদ্রেক ঘটায়। মুসলমানদের রক্তে প্রবাহিত আল্লাহ ও পরকালের প্রতি এ অদম্য বিশ্বাস তাকে অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম করে এবং অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্বাস হলো মানুষের সহজাত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং আত্মকেন্দ্রিকতার প্রতিষেধক। এটি তাকে শেখায় যে, দানশীলতা ও পরোপকারের জন্য আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন,

“অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল : ০৭)

“আর যে ব্যক্তি সৎকাজ করবে এবং সেইসাথে সে মুমিনও হবে, তার প্রতি কোনো জুলুম বা অধিকার হরণের আশঙ্কা নেই।” (সূরা ত্বাহা : ১১২)

“আল্লাহ কারো ওপর এক অণু পরিমাণও জুলুম করেন না। যদি কেউ একটি সৎকাজ করে, তাহলে আল্লাহ‌ তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে তাকে মহাপুরস্কার প্রদান করেন।” (সূরা নিসা : ৪০)

বিশ্বাস মানুষকে অনেক বেশি আধ্যত্মিক শক্তি দেয়, যা তাকে আল্লাহর হুকুমের অনিবার্যতার প্রতি আস্থাশীল হতে শেখায়। আল্লাহ তার জন্য যা লিখে রেখেছেন তা কেউ পরিবর্তন করতে পারবে না। আল্লাহর হুকুম একটি নির্ধারিত বিধান। যদি আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন যে, কারো ভালো বা খারাপ কোনো কিছু ঘটবে, তবে কেউ তা থামাতে পারবে না। এবং যদি আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন যে এটি ঘটবে না, তবে কেউ তার বিপরীত কিছু করতে পারবে না। প্রতিটি প্রাণির রিযিক এবং মৃত্যুর সময় নির্ধারিত। কোনো মানুষ অন্য মানুষের ভালো করতে চাইলে ততক্ষণ পর্যন্ত সফল হবে না যতক্ষণ না আল্লাহ তা চান, আবার কেউ যদি কারো ক্ষতি করতে চায়, সে ততক্ষণ পর্যন্ত সফল হবে না যতক্ষণ না আল্লাহ তা চান। তাকদীরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস জিহাদ (আল্লাহর পথে সংগ্রাম) এবং দাওয়াতকে (ইসলামের পথে আহ্বান) মুসলমানদের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।

পারস্যের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে রাসূল (স.)-এর একজন সাহাবী পারসিকদের এক নেতার কাছে নিজেদের পরিচয় এভাবে দিয়েছিলেন, “আমরাই তোমাদের ভাগ্য! আল্লাহ আমাদেরকে তোমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ প্রেরণ করেছেন, যেভাবে তোমরাও আমাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং তোমরা যদি মেঘপুঞ্জের উপরেও অবস্থান করো, তোমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে আকাশে আরোহণ করাবেন, বা তোমাদেরকে নামিয়ে এনে আমাদের সাথে যুদ্ধ করাবেন!”

বিশ্বাস মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব এবং স্নেহের বন্ধনকে শক্তিশালী করে এবং তাদেরকে চির সবুজ, তারুণ্যদীপ্ত ও সাফল্যমণ্ডিত রাখে। বিশ্বাস মুসলমানদের মধ্যে আত্মীয়তার অনুভূতি সৃষ্টি করে, যার ফলে তারা একটি পরিবারের মতো হয়ে ওঠে। মহান আল্লাহ বলেন,

“মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” (সূরা হুজুরাত : ১০)

বিশ্বাসের শক্তি মানুষকে বিভক্তকারী জাতি, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল, শ্রেষ্ঠ, বংশ, ভাগ্য এবং অনুরূপ সকল বাধা অতিক্রম করতে পারে। এ শক্তি পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে একটি নতুন ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যা জন্ম ও বিয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট আত্মীয়তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। যখন এ অনন্য সম্পর্কের শিকড় মজবুত হয়, মুসলমানরা তখন তাদের জন্ম এবং রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের চেয়ে বিশ্বাসে তাদের এ ভাইদেরকে বেশি প্রাধান্য দেয়।

এ সুন্দর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশে কেউ কারো বিরুদ্ধে ক্ষোভ পোষণ করতে পারে না; একে-অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, হিংসায় লিপ্ত হয় না; জীবন নিয়ে অহেতুক গরিমায় ডুবে থেকে একে অপরকে তুচ্ছ করে না। আল্লাহর কাছে জীবন একটি মশার পালকের চেয়ে বেশি কিছু নয়! রাসূল (স.) হিংসাকে জাতির রোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং রূপক অর্থে এটিকে চেঁছে ফেলার যন্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন, কারণ এটি ধর্মকে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে দেয়। অন্যদিকে বিশ্বাস পারস্পরিক শত্রুতাকে মুছে দেয়। এটি মানুষের হৃদয়ে তার পথ খুঁজে নেয় এবং হৃদয়কে অন্য সকল বিশ্বাসীর জন্য উৎসারিত ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং উদারতা দিয়ে পূর্ণ করে তোলে। এ প্রসঙ্গে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন,

“তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার মুসলমান ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করবে, যা সে তার নিজের জন্য পছন্দ করে।” (আল লুলু ওয়াল মারজান : ২৮১)

“আল্লাহর শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনো, আর ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পূর্ণ ঈমাদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসো।” (মুসলিম)

পরার্থপরতার এ অসাধারণ উপমা একমাত্র মুসলিম সমাজেই বিদ্যমান যা কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। বিশ্বাসই এ পরার্থপরতার উদ্রেক ঘটায়। পরার্থপরতা শুধুমাত্র একটি আভিধানিক শব্দ নয়, এটি একটি মনোভাব এবং আচরণ। এটি একজন মুসলমানের মনে তার অন্য মুসলমান ভাইদের জন্য দায়িত্বানুভূতি জাগিয়ে তোলে, যার ফলে সে নিজের চেয়ে তার মুসলমান ভাইদেরকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এটি তাকে অনেক কষ্টের মধ্যেও টিকে থাকার এবং তার মুসলমান ভাইদের উপকারের জন্য প্রচেষ্টা চালানোর সাহস দেয়। এটি তাকে তার মুসলমান ভাইদের জীবন রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে শেখায়। এটি তাকে তার মুসলমান ভাইদেরকে খাবার দিতে শেখায় এবং তাদের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করায়, যেমন ছিলেন আনসারদের (সাহায্যকারীদের) সাহাবীরা। আনসাররা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বেই ঈমান এনে দারুল হিজরাতে বসবাস করছিলেন, আর হিজরত করতে আসা মুহাজিরদেরকে অকাতরে সাহায্য করতেন। তারা নিজেরা যতই অভাবগ্রস্ত হোন না কেন, নিজেদের চেয়ে অন্যদেরকে অগ্রাধিকার দিতেন।

আল্লাহ বলেন,

“মূলত যেসব লোককে তার মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই সফলকাম।” (সূরা হাশর : ০৯)

এই অভূতপূর্ব ভ্রাতৃপ্রেম এবং পরার্থপরতার অনুভূতিগুলো মানুষের অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্থায় অর্থাৎ সর্বাবস্থায় সহযোগিতা এবং দানশীলতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

হাদীসে এসেছে,

“রাসূল (স.) বলেছেন, ‘একজন মুমিন আরেকজন মুমিনের নিকট একটি দালানের মতো, যার প্রতিটি অংশ একে অপরকে শক্তিশালী করে।” এ কথা বলে তিনি তার হাত আঙ্গুল দিয়ে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেন।” (আল লুলু ওয়াল মারজান : ১৬৭০)

“তুমি মুমিনদেরকে নিজেদের প্রতি ক্ষমাশীল হিসেবে দেখতে পাবে, পরস্পরের মাঝে ভালোবাসাপূর্ণ ও দয়াশীল হিসেবে দেখতে পাবে, যা একটি দেহের সাথে তুলনীয়। যখন শরীরের একটি অংশ অসুস্থ হয়, তখন সমগ্র শরীরই এ কষ্ট (নিদ্রাহীনতা ও জ্বর) ভাগ করে নেয়।” (আল লুলু ওয়াল মারজান : ১৬৭১)

সর্বোপরি, বিশ্বাস হলো মুক্তির চাবিকাঠি। বিশ্বাস বন্যা থেকে রক্ষাকারী নৌকার মতো। আল্লাহ বলেন,

وَكَيْفَ تَكْفُرُونَ وَأَنتُمْ تُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ ءَايَـٰتُ ٱللَّهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُۥ ۗ وَمَن يَعْتَصِم بِٱللَّهِ فَقَدْ هُدِىَ إِلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ

“তোমাদের জন্যে কুফরীর দিকে ফিরে যাবার এখন আর কোন সুযোগটি আছে, যখন তোমাদেরকে শুনানো হচ্ছে আল্লাহ‌র আয়াত এবং তোমাদের মধ্যে রয়েছে আল্লাহ‌র রাসূল? যে ব্যক্তি আল্লাহ‌কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরবে, সে অবশ্যই সত্য সঠিক পথ লাভ করবে।” (সূরা আলে ইমরান : ১০১)

 

অনুবাদঃ মুহসিনা বিনতে মুসলিম।

৪০৬ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top