জ্ঞান অর্জন করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বই পড়া। বই পড়ার ব্যাপারে আমাদের আলেমগণ বিভিন্ন সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনাসমূহ প্রদান করেছেন, যা আমাদেরকে আল্লাহর সন্তোষভাজন একজন বান্দা এবং মর্যাদাপূর্ণ ও হিকমত সম্পন্ন একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।
১. পড়া শুরু করার পূর্বে নিয়ত করো। ইমাম শাফেয়ী বলেন, “যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান অর্জন করতে চায়, সে জ্ঞানের বরকতে উপনীত হয়।” জ্ঞানকে শুধুমাত্র তথ্য হিসেবে নয়—জ্ঞান যেন তোমার রূপান্তর ঘটায়, বিকশিত করে এবং হাকীকতের নিকটবর্তী করে।
২. অল্প করে হলেও প্রতিদিন পড়ো। ইবনে খালদুন বলেন, “জ্ঞানকে যদি ছোট ছোট অংশে গ্রহণ করা হয়, তবে সে জ্ঞান স্থায়ী হয়।” একসাথে বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করে পরে হাল ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে, দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পড়ার জন্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এটি মানস (যিহিন) ও কলবকে জাগ্রত রাখে।
৩. পড়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করো। ইমাম গাজ্জালী বলেন, “জ্ঞান অর্জনের জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত সময় হলো, যখন যিহিন বা মানস সবচেয়ে শাণিত থাকে।” সে সময়টি হলো ফজরের পর ও রাতের নিরবতা।
৪. পড়ার পূর্বে নিজেকে প্রস্তুত করো। বই হাতে নেওয়ার আগে নিজের অন্তরকে ফাঁকা করো। দৈনন্দিন সমস্যা, মোবাইল ও ব্যস্ততা থেকে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্ত রাখো। বইয়ের দিকে রূহানী দৃষ্টিতে অগ্রসর হও—তাহলেই বইও নিজেকে তোমার সামনে মেলে ধরবে।
৫. মোবাইলকে এক পাশে রেখে দাও। বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ভার্চুয়াল জগৎ। ইবনুল জাওযী বলেন, “মানসকে মশগুল করে রাখে এমন সব বিষয়ই অন্তরে পর্দা সৃষ্টি করে।” পড়ার সময় পুরো মনোযোগ বইয়ের দিকে রাখো।
৬. বই পড়ার সময় হাতে কলম রাখো। বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি বলেন, “মুতালাআ মূলত লেখার মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।” পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো দাগ দিয়ে চিহ্নিত করো। কলম যিহিনকে গভীর করে তোলে, চিন্তাকে স্থায়িত্ব দেয়।
৭. যে অংশ বোঝা যায় না, তা পাশ কাটিয়ে যেও না। বরং সেখানে থেমে চিন্তা করো ও অনুধাবনের চেষ্টা করো। ইমাম ইবনে রুশদ বলেন, “যিহিন মূলত কষ্টের মাধ্যমে পরিপক্ব হয়।” সহজে পাওয়া জ্ঞান নয়, কষ্ট করে অর্জিত জ্ঞানই পরিবর্তন আনে।
৮. একসাথে অনেকগুলো বই পড়ার পরিবর্তে একটি বই মনোযোগ দিয়ে পড়ো। অনেক বিষয়ে একসাথে পড়া যিহিনের মনোযোগ নষ্ট করতে পারে। যে বই হৃদয়ে গেঁথে যায়, তা শত বইয়ের চেয়েও উত্তম।
৯. বই পড়াকে রুটিনে পরিণত করো। নীরব, সুন্দর ও আলোকোজ্জ্বল একটি স্থানে পড়ার সময়কে যেন ইবাদতের মতো মনে হয়—হাকীকত এমন পরিবেশেই উদ্ভাসিত হয়।
১০. পড়ার সময় বইয়ের প্রতি সম্মান দেখাও। ইমাম মালেক যখন জ্ঞানের মজলিসে যেতেন, তখন সর্বোৎকৃষ্ট পোশাক পড়তেন। তুমি জ্ঞানের প্রতি যত সম্মান দেখাবে, ততই জ্ঞান তোমার প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করবে। বই রহস্যে পূর্ণ এক বন্ধু, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো।
১১. বিষয়ভিত্তিক বই নির্বাচন করো। শুধুমাত্র জনপ্রিয় বা প্রস্তাবিত বই নয়; যে বিষয়ে তোমার জানা প্রয়োজন, সেই বিষয়ে লেখা বই পড়ো। যে বই তোমার রূহের তৃষ্ণা মেটাবে, সেই বই-ই তোমার জন্য উপযুক্ত।
১২. যিহিন ক্লান্ত বা ব্যস্ত থাকলে পড়ো না। কারণ ক্লান্ত মানসিকতা নিয়ে বইয়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় না। ইবনে হাযম বলেন, “জ্ঞান অর্জনকারীর প্রথম দায়িত্ব নিজের মননকে পরিশুদ্ধ করা, এরপর হাকিকতের দিকে ধাবিত হওয়া।”
১৩. বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করো—ফিকশন, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য ও জীবনীমূলক বই পড়ো। এতে দুনিয়াকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখতে শিখবে। জ্ঞানকে এক চোখে নয়, অনেক চোখে দেখার চেষ্টা করো।
১৪. যা পড়বে, তা অন্যকে বোঝানোর চেষ্টা করো। বুঝানোর কেউ না থাকলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বোঝাও, অথবা নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখো। এতে স্মরণশক্তি বাড়বে ও অর্থ স্থায়িত্ব পাবে।
১৫. যা শিখবে তা জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করো। কেবল জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না। ইমাম আযম আবু হানিফা বলেন, “জ্ঞান তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা কাজে রূপান্তরিত হয়।”
১৬. তোমার নোটগুলো সংরক্ষণ করো। ভুলে যাওয়া জ্ঞানকে স্মরণে রাখার জন্য ডায়েরি রাখো। প্রতিটি লাইন হলো অতীতের ‘তুমি’র বর্তমান ‘তুমি’কে পাঠানো এক শুভেচ্ছা।
১৭. বইয়ের সঙ্গে চিন্তার সম্পর্ক তৈরি করো—এটি যিহিনকে গভীরতা দান করে।
১৮. নিজে পড়ার জন্য মাসিক ও বাৎসরিক লক্ষ্য নির্ধারণ করো। লক্ষ্যহীনতা মানে পথ হারানো, আর পরিকল্পনা হলো বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করার চাবিকাঠি।
১৯. প্রভাবিত করা লাইনগুলো লিখে রাখার জন্য নির্দিষ্ট ডায়েরি রাখো। একদিন সেই লাইনগুলোই তোমাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলবে।
২০. লাইব্রেরি পর্যবেক্ষণ করো। যে বই আকর্ষণ করে না, তা এক পাশে রাখো—প্রতিটি বইয়ের নিজস্ব সময় আছে। সময় এলে সেই বই-ই নিজে থেকেই তোমাকে ডাক দেবে।
২১. পঠিত বিষয়কে আত্মস্থ করার জন্য সময়ের প্রয়োজন। ধৈর্য ধরো। জ্ঞান যিহিনে স্থান পাওয়ার পূর্বে তা হৃদয়ের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে যেতে হয়।
২২. যেসব বই পড়তে কষ্ট হয়, সেগুলোকে ভয় পেয়ো না। কঠিন বই যিহিনকে উন্মুক্ত করে এবং রূহে গভীরতা নিয়ে আসে। সহজে পাওয়া তথ্য নয়—যে জ্ঞান কষ্ট করে অর্জিত হয়, সেটাই তোমাকে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানী করে তোলে।
২৩. পড়ার সময়কে পবিত্র মনে করো। যেমন নামাজ নির্ধারিত সময়ে আদায় করো, তেমনি পড়াশোনাও নির্ধারিত সময়ে করো। কারণ এটিও আত্মশুদ্ধির একটি পথ।
২৪. পড়াশোনার অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করো—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা বই পাঠের গ্রুপে। এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করা অন্যদেরকেও উৎসাহিত করবে।
২৫. বইয়ের সঙ্গে গল্প করো। বইকে কেবল জ্ঞানের উৎস হিসেবে নয়, এক বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো দেখো। তারা তো সারাক্ষণ তোমার সঙ্গেই থাকে—তাদের কথাও শুনে দেখো।
২৬. লেখকের জীবনী জানার চেষ্টা করো। এতে লেখকের উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে এবং বইটি তোমার সঙ্গে আরও গভীরভাবে সংযোগ স্থাপন করবে।
২৭. বইয়ের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করো। একসাথে পড়া, আলোচনা করা তোমাকে প্রাণবন্ত রাখবে। ইমাম শাফেয়ী বলেন, “একজন ভালো বন্ধু—জ্ঞানের অর্ধেক।”
২৮. নিজের জন্য একটি ‘বুক কর্নার’ তৈরি করো। এমন একটি স্থান, যা হবে তোমার চিন্তা, ধ্যান ও তাফাক্কুরের কেন্দ্র।
২৯. অল্প সময়ের জন্য নয়—সারাজীবন পড়ো। পড়া যেন একটি সাময়িক শখ না হয়ে ওঠে, বরং একটি জীবনধারা হয়। প্রতিটি বয়স ও অবস্থার জন্য উপযুক্ত বই আলাদা হয়ে থাকে।
৩০. বইয়ের মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলো। যে বিষয়গুলো পড়ো, তা-ই ধীরে ধীরে তোমার চিন্তা, কথা ও আখলাক গঠন করে। তুমি যা পড়ো, তা-ই একদিন হয়ে উঠবে।
৩১. পড়ার সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করো:
“হে আল্লাহ! এই জ্ঞানের মাধ্যমে আমার অন্তরকে আলোকিত করে দাও।”
জ্ঞান এক ধরনের নূর—দোয়ার মাধ্যমে তা অন্তরে সহজে প্রবেশ করে।
৩২. এমন মনোযোগ সহকারে পড়ো যেন পৃথিবী থেমে যায়। যখন কেউ মনপ্রাণ দিয়ে পড়ে, তখন দুনিয়ার অন্য সবকিছু গৌণ হয়ে যায়। সেই মুহূর্তেই সত্যিকারের শেখা শুরু হয়।
৩৩. ভালোভাবে বুঝার জন্য মাঝে মাঝে উচ্চস্বরে পড়ো। শ্রবণ তথ্যকে দ্রুত যিহিনে স্থান দিতে সাহায্য করে।
৩৪. চোখ বুলিয়ে পড়া আর গভীর পাঠ এক নয়। ধীরে পড়ো, প্রতিটি বাক্য চিন্তা করে পড়ো। প্রতিটি শব্দ যেন মুক্তার মতো—তাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। ইমাম গাজ্জালী বলেন, “প্রত্যেকটি হরফ হিকমত ধারণ করে।”
৩৫. কোনো কোনো বই কেবল একটি লাইনের জন্য পড়া হয়। সেই একটি লাইনই পুরো জীবনধারাকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।
৩৬. যা শিখবে, কেবল নিজের মধ্যেই রাখো না—লিখে ফেলো, আলাপ- আলোচনা করো। জ্ঞান যত বেশি ভাগ করা যায়, তা তত বেশি বরকতময় হয়ে ওঠে।
৩৭. পড়া যেন তোমাকে অহংকারী না করে তোলে। জ্ঞান বাড়লে বিনয়ও বাড়া উচিত। যে নিজেকে জানে, সে কখনোই নিজের জ্ঞানের ভারে ভেঙে পড়ে না।
৩৮. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—পড়াকে শুধু একটি কাজ মনে না করে আত্মশুদ্ধির একটি উপায় হিসেবে দেখো। যদি তোমার নিয়ত খালেস হয় এবং দিক সঠিক হয়, তবে বই তোমাকে তোমার সীমা ছাড়িয়ে উচ্চতর মর্যাদায় নিয়ে যাবে।
৩৯. প্রখ্যাত দার্শনিক মোল্লা সাদরা বলেন, “বই পড়ার উদ্দেশ্য হলো নিজেকে বইয়ের মাঝে ডুবিয়ে রাখা নয়; বরং রূহকে জাগ্রত করা। বাহ্যিক আকার থেকে অর্থের জগতে প্রবেশ করলেই আত্মা আলোকিত হয়।”
৪০. ইমাম গাজ্জালী বলেন, “নিঃসন্দেহে জ্ঞান একটি নূর। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান অর্জন করা ইবাদত; জ্ঞানের অনুসন্ধান করা জিহাদ; আর অজ্ঞকে শিক্ষা দেওয়া সদকা।”

অনুবাদ ও সংকলন: বুরহান উদ্দিন আজাদ।


