আল-কুরআনের শব্দের মিল ও সাদৃশ্য সম্পর্কে অন্যান্য লেখকগণ যা কিছু আলোচনা করেছেন, আমি তার ওপর শুধুমাত্র একবার দৃষ্টি প্রদান করে আল-কুরআনের শৈল্পিক বিন্যাসের ঐ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই, যে সম্পর্কে এখন বিস্তারিত কিছু আলোচনা হয়নি এবং তা এ পুস্তকের বিষয়বস্তুর সাথেও সংশ্লিষ্ট। বিশেষ করে আল-কুরআনের উচ্চারণের সাদৃশ্যতা।

আমি এর আগে আভাস দিয়েছি যে, কুরআনে কারীমের মধ্যে সুর ও ছন্দ (শব্দের উচ্চারণ সাদৃশ্যতা) আছে এবং তার কিছু প্রকার ও ধরন আছে। যা তার বক্তব্য উপস্থাপনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেহেতু সমস্ত কুরআন-ই ছন্দবদ্ধ সেহেতু সর্বত্রই সুর ও তাল বিদ্যমান। দেখা গেছে একই শব্দের বিভিন্ন অক্ষর এবং একই আয়াত ও তার শেষ শব্দ ছান্দিক নিয়ম-কানুন মেনে চলে। চাই সে আয়াত ছোট হোক কিংবা বড়। বাক্যের শেষ শব্দের মধ্যে সেই মিল কিভাবে হয়, সেসব বাক্য সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে চাই। কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে:

وَمَا عَلَّمْنَهُ الشَّعْرَ وَمَا يَنْبَغِى لَهُ ، إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرُ وَقُرْآنٌ مُّبِينٌ

আমি তাঁকে (অর্থাৎ রাসূলকে) কবিতা বা কাব্য শিক্ষা দেইনি। আর তা তাঁর জন্য শোভাও পায় না। এতো একটি স্মারক যা সুস্পষ্ট কুরআন (হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে)। (সূরা ইয়াসীন : ৬৯)

একথাটি হচ্ছে কাফিরদের ঐ অভিযোগের জবাব, যা সূরা আম্বিয়ায় বলা হয়েছে:

بَلِ اقْتَرَهُ بَلْ هُوَ شَاعِرٌ

(তারা বলতো) সে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে, না বরং সে একজন কবি।

(সূরা আল-আম্বিয়া: ৫)

আল-কুরআন ঠিকই বলেছে, এটি কাব্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- আরববাসী যারা একে কবিতা বা কাব্য বলতো তারা কি পাগল ছিল, না কবিতা ও কাব্য সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল? নিশ্চয়ই নয়। যেহেতু তারা একে কাব্য বলেছে কাজেই এর মধ্যে অবশ্যই কবিতা ও কাব্যের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আছে যার যাদুকরী আবেশে তারাও মোহবিষ্ট হয়েছিল। কুরআনের উচ্চারণ সাদৃশ্যতা ও তার সৌন্দর্য সম্পর্কে তাদের কান পরিচিত ছিল, ফলে এটি যে একটি কাব্য তা তারা বুঝতে পেরেছিল। আমরা যদি কেবল মাত্রা ও অন্তমিলের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তবু বুঝা যায় কাব্য ও কবিতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য সেখানে বিদ্যমান।

তাছাড়া কুরআন গদ্য ও পদ্য উভয়কেই সুন্দরভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছে। আল-কুরআন মাত্রা )وزن( ও অন্তমিল )قافیه( থেকে স্বাধীন এবং এতে মিল থাকতেই হবে এরূপ কোন বাধ্যবাধকতা কুরআনের নেই। তবু সেখানে সুর ও ছন্দ বর্তমান। আয়াতের শেষে মিত্রাক্ষরের প্রয়োজন, সে প্রয়োজনও কুরআন অবশিষ্ট রাখেনি। সেই সাথে আমরা ওপরে কাব্যের যে বৈশিষ্ট সম্পর্কে আলোচনা করেছি সেগুলোও সে ধারণ করে নিয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় কুরআনে গদ্য ও পদ্য উভয় বেশিষ্ট্য বৈশিষ্ট্যমান।

সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ যখন কুরআন তিলাওয়াত করে তখন বাহ্যিক উচ্চারণে সে মাত্রা ও অন্তমিল দেখে, বিশেষ করে এ ব্যাপারটি ছোট ছোট আয়াত সম্বলিত সূরাগুলোতেই দৃষ্টিগোচর হয়। অথবা ঐ সমস্ত জায়গায় যেখানে কোন ঘটনাচিত্র উপস্থাপন করা হয়। অবশ্য দীর্ঘ আয়াতের সূরাগুলোতেও এটি আছে তবে তা এতোটা স্পষ্ট নয়। নিচের উদাহরণটি লক্ষ্য করুন, যেখানে সুর, ছন্দ ও মাত্রার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে:

وَالنَّجْمُ إِذَا هَوَى – مَاضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى – وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الهوى – إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى – عَلَمَهُ شَدِيدُ القُوى – ذُو مِرَّةٍ – فَاسْتَوى – وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى – ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى –

নক্ষত্রের কসম, যখন তা অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট কিংবা বিপথগামী নয় এবং প্রবৃত্তির তাড়নায়ও কথা বলে না। কুরআন ওহী, যা প্রত্যাদেশ হয়। তাকে শিক্ষাদান করে এক শক্তিশালী ফেরেশতা। সহজাত শক্তিসম্পন্ন, সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল ঊর্ধ্ব দিগন্তে। (সূরা আল-নজম: ১-৮)

فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوادنى – فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى – مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى – أَفَتُمْرُونَهُ عَلَى مَا يَرَى

অতপর নিকটবর্তী হলো এবং ঝুলে রইলো, তখন ব্যবধান ছিল দুই ধুনক কিংবা তার চেয়ে কম। তখন আল্লাহ্ তার বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার, তা প্রত্যাদেশ করলেন। রাসূলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে। তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখেছে? (সূরা নজম: ৯-১২)

وَلَقَدْ رَاهُ نَزَلَةً أخرى – عِنْدَ سِدْرَة المُنْتَهى – عِنْدَهَا جَنَّةُ الماوى – إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى – مَازَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى – لقَدْ رَأَى مِنْ أَيْتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى

নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল, সিদরাতুল মুনতাহার কাছে, যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত। যখন বৃক্ষটি যা দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার তা “দিয়ে আচ্ছন্ন হচ্ছিল। তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়নি এবং সীমালংঘনও করেনি। নিশ্চয়ই সে তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছে।

(সূরা আন-নাজম: ১৩-১৮)

أَفَرَءَ يْتُمُ اللَّهَ وَالْعُزَّى – وَمَنْوةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى –

তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত ও উজ্জা সম্পর্কে এবং তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে?

(সূরা আন-নজম: ১৯-২০)

الكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنْثَى.

পুত্র সন্তান কি তোমাদের জন্য আর কন্যা সন্তান আল্লাহ্ জন্য?

(সূরা নজম: ২১)

تِلْكَ إِذَا قِسْمَةٌ ضِيزى –

এ ধরনের বণ্টন তো খুবই অসঙ্গত বণ্টন।

(সূরা আন-নজম: ২২)

উল্লেখিত আয়াতগুলোর শেষাক্ষরে মাত্রার প্রায় মিল আছে। কিন্তু আরবী ছন্দের মাত্রার চেয়ে তা কিছুটা ভিন্ন। সব আয়াতের শেষেই মিত্রাক্ষর এক ধরনের। মাত্রা ও মিত্রাক্ষরের বদৌলতে প্রশিট আয়াতের সাথে অপর আয়াতের একটি মিল সংঘটিত হয়েছে। ফলে বিচ্ছুরণ ঘটেছে অপূর্ব সুর মূর্ছনার। এই যে মিল ও সাদৃশ্য তার আরেকটি কারণ আছে, অবশ্য তা মাত্রা ও মিত্রাক্ষরের মতো এতোটা উজ্জ্বল নয়। কেননা তা একক শব্দ, অক্ষরের বিন্যাস এবং বাক্যে শব্দসমূহের বিন্যাসের কারণে সৃষ্টি হয়। তার অনুভূতি ও উপলব্ধির পরিধি, দ্বীনি চেতনা এবং সুর ও সঙ্গীতের উপভোগের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য অন্তরার সুরেলা আওয়াজ এবং বেসুরো আওয়াজের মধ্যে পার্থক্য করা যায়, শুধুমাত্র বাক্যান্তে মিত্রাক্ষর হলেই তাকে সুর বা ছন্দ বলে অভিহিত করা যায় না।

উল্লেখিত আয়াতগুলো ছোট ছোট বিধায় তা থেকে সৃষ্ট সূর-তরঙ্গের স্থায়িত্বও খুব দীর্ঘ নয়। তবে সব আয়াতের ছন্দ ও মাত্রা এক। তাই সব আয়াতে মিল আছে। এসব আয়াতে শেষ অক্ষর এক রকম হতে হবে এরূপ কোন বাধ্যবাধকতা নেই।

যেমন আধুনিক সাহিত্যে কোন গল্প-উপন্যাস লিখার সময় এদিকে নজর দেয়া হয় না, কুরআনী সুর ও ছন্দের বেলায় এসব কিছুকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে। অনেক আয়াত থেকে তো স্পষ্ট বুঝা যায় বাক্যান্তে মিলের জন্য সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে তা করা হয়েছে। যেমন নিচের আয়াতটি লক্ষ্য করে দেখুন।

أَفَرَءَ يْتُمُ اللَّهَ وَالْعُزَّى – وَمَنْوةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرَى –

যদি এভাবে বর্ণনা না করে নিচের মতো করে বর্ণনা করা হতো:

أَفَرَيْتُمُ اللَّهَ وَالعُزَّى – وَمَنْوةَ الثَّالِثَةَ –

তাহলে অন্তমিলে পার্থক্য সৃষ্টি হতো এবং ছন্দপতন ঘটতো। তদ্রূপ নিচের আয়াতও:

الكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنْثَى – تِلْكَ اذا قِسْمَةٌ ضيزى .

যদি এভাবে উল্লেখ না করে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা হতো:

الكُمُ الذَّكَرُولَهُ الْأُنثى – تلكَ قِسْمَةُ ضيزى .

তাহলে ছন্দের মিল হতো না। ‘ইযান’ শব্দটি দিয়ে সেই মিলকে পুরো করা হয়েছে।

তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, ‘আল উখরা’ (أخرى) এবং ‘ইযান’  শব্দ দুটো ছন্দের মিল ছাড়া আর অন্য কোন কারণে নেয়া হয়নি, এ দুটো অতিরিক্ত শব্দ। আসলে এ দুটো অতিরিক্ত শব্দ নয় বরং বাক্য বিন্যাসের জন্য সূক্ষ্ম অপরিহার্যতার কারণেই এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এটি আল-কুরআনের আরেকটি শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য। একটি বিশেষ অর্থে আল-কুরআনে এ ধরনের শব্দ চয়ন করা হয়েছে এবং সাথে সাথে সেই শব্দটি সুর ও তালের মাত্রাকেও ঠিক রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

যেমন আমরা আলোচনা করেছি, আল-কুরআনের এক আয়াতের সাথে আরেক আয়াতের উচ্চারণের সময় এক ধরনের ছন্দের মিল লক্ষ্য করা যায় এবং শেষে মিত্রাক্ষর দৃষ্টিগোচর হয়। আবার অনেক জায়গায় শব্দ নির্বাচন এমনভাবে করা হয়েছে, যেখানে একটি শব্দ আগ-পাছ করলেই সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়।

প্রথম অবস্থা: প্রথম অবস্থা হচ্ছে কোন শব্দের স্বাভাবিক অবস্থাকে পরিবর্তন করার উদাহরণ। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর একথাটি যা কুরআন হুবহু নকল করেছে:

قَالَ أَفَرَءَ يْتُمْ مَّا كُنْتُمْ تَعْبُدُونَ – أَنْتُمْ وَآبَاؤُ كُمُ الْأَقْدَمُونَ – فَإِنَّهُمْ عَدُولِي الْأَرَبِّ العَلَمِينَ – الَّذِي خَلَقَنِي فَهُوَ يَهْدِيْنِ – وَالَّذِي هُوَ يُطْعِمُنِي وَيَسْقِينِ – وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ – وَالَّذِي يُمِيتُنِي ثُمَّ يُحْيِينَ – وَالَّذِي أَطْمَعُ أَنْ يُغْفِرْ لِي خَطِئَتِي يوم الدين –

(ইবরাহীম (আ) বললো: তোমরা কি তাদের সম্পর্কে ভেবে দেখেছ, যাদের পূজা করে আসছ, তোমরা এবং তোমাদের পিতৃপুরুষেরা? বিশ্ব প্রতিপালক ব্যতীত তারা সবাই আমার শত্রু। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং পথ দেখিয়েছেন। তিনি আমাকে আহার ও পানীয় দান করেন। যখন আমি রোগাক্রান্ত হই, তখন তিনিই আরোগ্য দান করেন। তিনি আমাকে মৃত্যু দেবেন আবার তিনিই পুনুরুজ্জীবিত করবেন। আমি আশা করি তিনিই বিচারের দিনে আমার ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেবেন।

(সূরা আশ-শুয়ারা: ৭৫-৮২)

উল্লেখিত আয়াতে ‘ইয়াহদিনি’ بهدین ‘ইয়াসকিনি’ يسقین ‘ইয়াশ ফিনি يشفين এবং ‘ইউনি’ يُحين শব্দের শেষ থেকে উত্তম পুরুষের ‘ইয়া’-কে বিলুপ্ত করা হয়েছে। কারণ ‘তা’বুদুনা’ تَعْبُدُونَ ‘আল আকদামুনা’ الاقدَمُونَ শব্দদ্বয়ের মতো ‘নুন’-এর মিত্রাক্ষর বহাল রাখার জন্য।

এমনিভাবে নিচের আয়াত ক’টিতেও ‘ইয়া’ কে বিলুপ্ত করা হয়েছে:

والفَجْرِ – وَلَيَالٍ عَشْرٍ – والشفْعِ والوَتْرِ – وَالَّيْلِ إِذَا يَسْرِ – هَلْ فِي ذَلِكَ قَسَمٌ لِذِي حِجْرٍ –

শপথ ফজরের, শপথ দশ রাতে, শপথ তার যা জোড় ও বেজোড় এবং শপথ রাতের যখন তা গত হতে থাকে। এর মধ্যে আছে শপথ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য।

(সূরা আল-ফজর: ১-৫)

উল্লেখিত আয়াতে ‘ইয়াসরী’ (يَسرى) শব্দের ‘ইয়া’ করা হয়েছে, যেন ‘আল-ফাজরি’ (الفجر) ‘আশরীন’ (والوتر) ইত্যাদি শব্দসমূহের সাথে মিল থাকে।

নিচের আয়াতগুলোও এখানে উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে।

فَتَوَلَّ عَنْهُمْ يَوْمَ يَدْعُ الدَّاعِ إِلَى شَيْءٍ نُكْرٍ – خُشِعًا أَبْصَارُهُمْ يَخْرُجُونَ مِنَ الْأَحْدَاثِ كَأَنَّهُمْ جَرَادُ مُنْتَشِرُ – مُهْطِعِينَ إِلَى الداع ، يَقُولُ الْكَفِرُونَ هَذَا يَوْمٌ عَسِرُ

অতএব তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। যেদিন আহ্বানকারী আহ্বান করবে এক অপ্রিয় পরিণামের দিকে। তারা তখন অবনমিত নেত্রে কবর থেকে বের হবে, যেন বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল। তারা আহ্বানকারীর দিকে দৌড়াতে থাকবে। কাফিররা বলবে: এটি কঠিন দিন।

এ আয়াতে ‘আদ দায়ি’ (ভূমি) শব্দের শেষ থেকে যদি ‘ইয়া’-কে বিলুপ্ত করা না হতো তবে মনে হতো এ পংক্তিতে ছন্দপতন ঘটেছে। আর এ ত্রুটি কারো নজর এড়াত না। তেমনিভাবে নিচের আয়াতটি লক্ষ্য করুন:

ذَلِكَ مَا كُنَّا نَبْغِ ، فَارْتَدَّ عَلَى آثَارِهِمَا قَصَصًا

(মূসা বললেন:) আমরাতো এ জায়গাটিই খুঁজছিলাম। অতপর তারা নিজেদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চললো।

(সূরা আল-কাহফঃ ৬৪)

এ আয়াতেও যদি تیغ শব্দটি এভাবে تبغى লিখা হতো তবে মিলের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হতো।

তদ্রূপ যদি নিচের আয়াতগুলো থেকে আসল ‘ইয়া’ এবং উত্তম পুরুষের ‘ইয়া’- এর শেষ থেকে বিরতিসূচক ‘হা’ কে বিলোপ করা হয় তবে অবশ্যই ছন্দ পতন ঘটবে।

وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ – فَأَمُّ هَاوِيَةٌ – وَصَا أَدْرَكَ مَاهِيَهِ – نَارٌ حَامِيَةٌ –

আর যার পাল্লা হাল্কা হবে, তার ঠিকানা হাবিয়া। তুমি কি জানো তা কি? তা হচ্ছে জ্বলন্ত আগুন।

(সূরা আল ক্বারিয়া: ৮-১১)

নিচের আয়াতটিও লক্ষ্য করুন:

فَامَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَبَاهُ بِيَمِينِهِ ، فَيَقُولُ هَاؤُمُ اقْرَهُ وَأَكِتَبِيه – إِنِّي ظَنَنْتُ أَنِّي مُلْقٍ حِسَابِيْهِ – فَهُوَ فِي عِيْشَةٍ رَاضِيَةٍ –

অতপর যার আমলনামা ডানহাতে দেয়া হবে, সে বলবে: নাও তোমরা আমার আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসেবের মুখোমুখি হতে হবে। অতপর সে সুখ-স্বাছন্দে জীবন যাপন করবে।

(সূরা হাক্কাহ: ১৯-২১)

দ্বিতীয় অবস্থা: শব্দের সাধারণ অবস্থার কোনরূপ পরিবর্তন করা হয়নি বটে কিন্তু কৌশলী বিন্যাসে তা হয়ে উঠেছে ছন্দময়। যদি সেই বিন্যাসে সামান্যতম হেরফের করা হয় তবে ছন্দের মিল আর অবশিষ্ট থাকে না। নষ্ট হয়ে যায় সুর ব্যঞ্জনা।

ذِكْرُ رَحْمَتِ رَبِّكَ عَبْدَهُ زَكَرِيا – اذْنَادَى رَبَّهُ نِدَاءً خَفِيًّا – قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّي وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا – وَلَمْ أَكُن بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا

এটি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়ার প্রতি। যখন সে তাঁর পালনকর্তাকে নিভৃতে আহ্বান করেছিল এবং বলেছিল: হে আমার রব্ব! আমার অস্থি বয়স ভারাবনত হয়েছে। বার্ধক্যে মাথা সুশুভ্র হয়েছে কিন্তু আপনাকে ডেকে কখনো বিমুখ হইনি। (সূরা মারইয়াম: ২-৪)

ওপরের আয়াতে যদি শুধুমাত্র ‘মিন্নী’ منی শব্দটিকে পরিবর্তন করে ‘আল আজমু’ العظم শব্দের পূর্বে এনে এভাবে বলা হয় যে, قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ مِنِّي الْعَظْمُ তবে স্পষ্টতই বুঝা যায় উক্ত বাক্যে ছন্দ বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। শুধুমাত্র ছন্দ ও মাত্রা ঠিক রাখার জন্যই ‘মিন্নী’ منی শব্দটিকে যথাস্থানে স্থাপন করা হয়েছে। এবার দেখুন কতো সুন্দর মিল দেয়া হয়েছে। বাক্যের প্রথম দিকে বলা হয়েছে : قَالَ رَبِّ إِنِّي এবং তারপরই বলা হয়েছে :

وَهَنَ الْعَظْمُ مِنّى

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, আয়াতের ভেতর সুর ও ছন্দ এতো সূক্ষ্ম, শুধু অনুধাবন করা যায় কিন্তু ব্যক্ত করা যায় না। আগেও আমরা এ ব্যাপারে কিছুটা আলোচনা করেছি। এ ধরনের সুর ও তাল একক শব্দ সমষ্টি কিংবা একই বাক্যের বিন্যাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা অনুধাবন করতে হলে একমাত্র আল্লাহ্ প্রদত্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়েই সম্ভব, অন্য কোনভাবে নয়।

উপরোক্ত আলোচনা একথারই ইঙ্গিত করে যে, আল-কুরআনের বর্ণনা রীতিতে সুর ও ছন্দের ভিত্তি পাওয়া যায়। কিন্তু তা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করতে হয়। তা এতো স্পর্শকাতর যে, শাব্দিক সাধারণ বিন্যাসের ব্যতিক্রম হলেই ছন্দপতন ঘটে যায়। অথচ তা কবিতা বা কাব্য নয়। এমনকি তা কাব্যের নিয়ম-নীতি মেনে চলতেও বাধ্য নয়। কিন্তু মানুষ একে এমনভাবে সাজানো ও বিন্যাসিত দেখতে পায়, যে কারণে তারা একে কাব্য না বলে কি যে বলবে তাও ভেবে পায় না।

 

অনুবাদঃ মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মুমিন।

 

৪৬ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top