বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক মহান রাব্বে কারীমের নামে। দরূদ ও শান্তির বার্তা প্রেরিত হোক আমানাতদার সৎ বান্দার উপর, যাকে বিশ্বজাহানের রহমত হিসেবে এবং হেদায়েত অনুসন্ধানীদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মানুষ তার ভেতরে থাকা সত্যিকারের ক্বলব, আকল ও রূহের দর্শন পেয়েছে। যাকে প্রেরণ করা হয়েছে জুলুমপূর্ণ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে আদালত ও হেদায়েতের পথে নিয়ে আসার জন্য।
সম্মানিত সুধী, বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম এবং কর্তব্যপরায়ণ ও ন্যয়ানুরাগ ব্যক্তিবর্গ, শুরুতেই সবাইকে ইসলামের সম্ভাষণ জানাই, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলার কর্তৃক ইস্তাম্বুলে আয়োজিত এই ৫ম সাধারণ অধিবেশনে উপস্থিত হতে পেরে সত্যিই আমি আনন্দিত বোধ করছি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এবং মিথ্যাচার সত্ত্বেও ইস্তাম্বুলে আপনাদের এই আগমন সত্যি শহরটির জন্য সুফল বয়ে আনবে। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম মুসলিম উম্মাহর জন্য আশীর্বাদ হয়ে থাকবে। তবে, নিজেদের ভেতরের একতা ব্যতীত প্রখ্যাত স্কলার এবং তীক্ষ্ণ ধীসম্পন্ন চিন্তাশীলগণও মুসলিম উম্মাহর কোনো ভবিষ্যত বিনির্মাণ করতে পারবে না। আমি খুব আনন্দিত যে, আপনাদের মতো ধীসম্পন্ন স্কলার এবং চিন্তাশীলদের একত্রিত হবার মতো একটা পরিবেশ ইস্তাম্বুলে তৈরি হয়েছে।
সুপ্রিয় ভাই এবং বোনেরা,
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বৈশ্বিক শান্তি বিনির্মাণ এবং বিশ্বকে পুনর্গঠন করার জন্য ইসলামকে সংবিধান হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এছাড়াও আপনারা জানেন যে, মানুষের সাথে তার নিজ সত্তা, অন্যান্য মানুষ এবং মহাবিশ্বের মাঝে সম্পর্ক তৈরি করার জন্যও ইসলাম এসেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই সমগ্র বিশ্বজাহান মহান আল্লাহর সৃষ্টি; এবং আমরাও, তবে তার বান্দা হিসেবে। অতএব, এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বিশ্বজাহান এবং আমরা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
পক্ষান্তরে, তথাকথিত আধুনিক দার্শনিকরা এই বন্ধনকে বস্তুবাদী সম্পর্কে পরিণত করেছে। অথচ, ইসলাম বলেছে, মানুষরা হলো বিশ্বজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি অর্থাৎ আশরাফুল মাখলুকাত। আর আমাদের মানুষদেরকে এই লক্ষ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে, আমরা আরব-অনারব ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র বিশ্বে আদালত প্রতিষ্ঠা করবো। আমাদের সকলকে সমতা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই তাকওয়া ব্যতিত আর কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের মাঝে কোনোরূপ ভেদাভেদ থাকবে না। আর আমরাই হচ্ছে সকল জালিম এবং আগ্রাসন পরিচালনাকারীদের প্রধান শত্রু। কুরআনের ভাষ্যে, “একমাত্র জালেম ছাড়া আর কেউ শত্রু হতে পারে না।”
সম্মানিত সুধীমণ্ডলী,
সুলহ, ইসলাহ, মাসলাহাত, ফাসাদ, ইফসাদ ও মাফসাদাত ইসলামী জ্ঞানতত্ত্ব এবং ইসলামী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পরিভাষা। কারণ, ফিকহে ইসলামী বা ইসলামী সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম একটি মূলনীতি হলো, আদালত প্রতিষ্ঠা করা এবং জুলুম প্রতিহত করা। বিষয়টির অন্যতম দলিল হলো একটি সার্বজনীন মূলনীতি,
“দুনিয়াতে মাসলাহাত প্রতিষ্ঠা হলেই আল্লাহর ওয়াদা পূরণ হয়ে যায়।”
কিন্তু, বর্তমান বিশ্বে মাসলাহাতকে পুঁজি করে অসংখ্য বিধ্বংসী সব কর্মকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। বিষয়টা যেন এই আয়াতটিরই প্রতিচ্ছবি,
“যখন তাদের বলা হয়, তোমরা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না। তখন তারা বলে, আমরা মাসলাহাত প্রতিষ্ঠাকারী।”
আর বর্তমান বিশ্বে যা ঘটছে, এটা জুলুম ও নৃশংসতা ছাড়া আর কিছুই না। আল্লাহ বলেন,
“যখন সে কর্তৃত্ব লাভ করে, পৃথিবীতে তার সমস্ত প্রচেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করে বিপর্যয় সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত ও মানব বংশ ধ্বংস করার কাজে। অথচ আল্লাহ (যাকে সে সাক্ষী মেনেছিল) বিপর্যয় মোটেই পছন্দ করেন না।”
আর তাই আমাদেরকে এখন পৃথিবী থেকে মাফসাদাত প্রতিহত করে মাসলাহাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মূলত, এখানেই আসে নবীর ওয়ারিস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একজন আলেমের দায়িত্ব পালনের বিষয়। একজন আলেম শুধু জ্ঞানের দিক থেকেই নবীর ওয়ারিশ নয়, অথবা সুনির্দিষ্ট কিছু নস মুখস্থকরণ ও মিম্বারে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রেই ওয়ারিশ নয়, বরং ওয়ারিশ হিসেবে তার দায়িত্ব হচ্ছে, দুনিয়াতে ইসলাহ ও মাসলাহাত প্রতিষ্ঠা করা এবং বর্তমান জুলুমপূর্ণ ব্যবস্থা থেকে আদালতপূর্ণ সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করা। বর্তমান বিশ্বের জনসাধারণ এখন সাধারণ স্কলারের বিপরীতে মুসলিহ আলেম বা ভবিষ্যত বিনির্মানকারী স্কলারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। আল্লাহর ভাষায়,
“তোমার রব এমন নন যে, তিনি জনবসতিসমূহ অন্যায়ভাবে ধ্বংস করবেন, অথচ তার অধিবাসীরা ভবিষ্যত বিনির্মানকারী।”
মাফসাদাত প্রতিহত করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিবগুলোর মধ্য থেকে একটি। আর মাফসাদাত উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সময় কাজটার আবশ্যকতা আরো বৃদ্ধি পায়। বর্তমান মুসলিম উম্মাহ আজ মাফসাদাতের নিকৃষ্ট বেড়াজালে বন্দী। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলই আজ মাফসাদাতের বিষাক্ত থাবায় পর্যদুস্ত। এমন একটি সময়ে একমাত্র ইত্তিহাদ ও মাসলাহাতকে কেন্দ্র করে জ্ঞানার্জন করা ওলামায়ে কেরামই এই অবস্থা থেকে উম্মাহকে উত্তোরণের পথ বাতলে দিতে পারে।
এখন এপর্যায়ে এসে আমরা দু’টি বার্তা দিয়ে যেতে চাই।
প্রথম বার্তাটি মুসলিমদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের প্রতি।
বর্তমানে এমন অরাজকতার সময়ে মহান আল্লাহ আপনাদেরকে ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। আপনাদের এই সক্ষমতা রয়েছে যে, আপনারা যেকোনো বিষয়ের আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। এই ক্ষমতার মাধ্যমে আপনি আপনার দেশ ও জাতিকে সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে পারেন অথবা অজ্ঞতা ও জুলুমের মধ্যে নিপতিত করে রাখতে পারেন।
মাসলাহাতকে পুঁজি করে দেশের উন্নতির পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘন বা কোনো ফাসাদ সৃষ্টি করা অনেক প্রাচীন একটা রীতি। এ’সব ক্ষমতাবানদের বলতে ইচ্ছে হয়, আল্লাহর সৃষ্টির উপর ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে কোন প্রশান্তিটা পেয়ে থাকেন আপনারা? মাসলাহাতের নামে মানুষের অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ভেতরে কোন উপকার নিহিত আছে?
আমাদের প্রথম বার্তাটা আপনাদেরই প্রতি, নিজেদের মহান এই দায়িত্বকে সঠিকভাবে পালন করে আপনারা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিষয়াদির সাক্ষী হতে পারেন! কারণ, ন্যায়পরায়ণ শাসক হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে অন্যতম একটা নেয়ামত। পাথর এবং গাছেরা পর্যন্ত তাদের জন্য দোয়া করে।
অতএব, আপনাদের প্রতি অনুরোধ রইলো, আলমদেরকে তটস্থ করে না রেখে তাদের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করুন। তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিবেন না। কারণ, সভ্যতা পুনর্গঠনে আপনার কাজে তাদের মতো সহযোগী আর কাউকে পাবেন না। এই বিষয় আলোচনাকালে সৌদি আরবের সম্মানিত শাসকদের নাম উল্লেখ প্রণিধানযোগ্য।
তাঁদের উদ্দেশ্যে আমাদের বার্তা হলো, প্রতিটি দেশ ও তার অধিবাসীদের নিজস্ব সার্বভৌমত্ব রয়েছে। একমাত্র শোষক ব্যতিত আর কেউ এটাকে অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু, উম্মাহ এখন মুসলিহ আলেমের দিকে চেয়ে রয়েছে। আলেমগণ নিজেদের দেশের অধিবাসী হলেও তাদের প্রভাব সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আর তাই, আলেমগণ শুধু তার জন্মভূমির সম্পদ নন, তাঁরা সমগ্র বিশ্বের সম্পদ।
সমগ্র বিশ্বের ওলামায়ে কেরামের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা সৌদি শাসকের নিকট থেকে তাঁর দেশের স্কলারদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে চাই। তারা তো কোনো অপরাধ করেননি। মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি, তাঁরা দেশ ও জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সেবক। কিন্তু, ন্যয়পরায়ণ শাসকের নিকট থেকে যেমন উত্তর পাওয়া যায়, সেভাবে কি আমরা আমাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো পাবো সৌদি শাসকের নিকট থেকে? সুবিশাল আশা নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে রইলাম।
আজ আমরা ইলম, হিকমত ও দাওয়াহ সমৃদ্ধ এই অধিবেশন থেকে জামাল খাসোগি (রহ.)’র পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি। বলতে দ্বিধা নেই, তুরস্কের মাটিতে তাঁর মৃত্যুবরণে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। এই ক্ষতি এতোটাই অপূরণীয় যে, এই শোকে মর্মর সাগরের পানিও কৃষ্ণ সাগরের পানির মতো কালো হয়ে যাতে পারে। যেহেতু আমরা এখনও তাঁর জানাযা আদায় করতে পারিনি, তাই সৌদি শাসকের নিকট তাঁর মরদেহ প্রকাশ করে ইস্তাম্বুলে পাঠানোর অনুরোধ করছি, যেন আমরা ওলামায়ে কেরাম জনসাধারণকে সাথে নিয়ে তাঁর জানাযা পড়তে পারি। আমরা সকলেই একসাথে তাঁর জানাযা আদায় করতে চাই। তবে, সেটা গায়েবানা জানাযা নয়। কারণ, কবরে রাখার পূর্বে এই জানাযার মাধ্যমে সম্মানিত হওয়াটা তাঁর অধিকার। জান্নাতে তাঁর সর্বোচ্চ মাকামের জন্য আমরা মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করি এবং হত্যাকারীদের জন্য ধ্বংস কামনা করি।
আমার দ্বিতীয় বার্তাটি মুসলিম উম্মাহর বিশিষ্ট স্কলার, চিন্তাবিদ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি।
উম্মাহর পূর্ববর্তী ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন এবং আমাদের প্রতিষ্ঠানসমূহের সিস্টেম্যাটিক উন্নয়ন প্রয়োজন। যেনো আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে সমাজের নিকট রোল-মডেলে পরিণত হতে পারি।আমাদের যে ইন্সটিটিউটসমূহ হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার সূতিকাগার ছিলো, সেগুলো আজ সাধারণ সমাজ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ—উভয় স্থানেই তার গতিময়তা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, ইন্সটিটিউটগুলোর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলে যাওয়া।
ফলশ্রুতিতে, ইন্সটিটিউটগুলো পরবর্তীতে তার নেতৃত্ব হারিয়ে শুধু প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং জনসাধারণও এদের ব্যাপারে সবাই সন্দিহান হয়ে পড়েছে। আবার কোনো কোনো ইন্সটিটিউট বৈশ্বিকতা হারিয়ে নিজেদেরকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ করে নিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক স্কলারগণও এই পথে হেঁটেছেন। ফলে, উম্মাহর পুনর্গঠনের বিপরীতে উম্মাহ আরো ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে।
আমরা তাঁদেরকে এই ঐক্যবদ্ধতার অধিবেশন থেকে বার্তা দিতে চাই,
আল আযহার ও আয-যায়তুন বিশ্ববিদ্যালয়, সমগ্র বিশ্বের ফতওয়া ও দাওয়াহ ইন্সটিটিউট, বিশেষ করে, মুসলিম বিশ্বের সকল স্কলারদেকে বলতে চাই, আসুন, ভ্রাতৃত্ব ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীকে আবার নতুন করে সাজাই। যেখানে অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে ছাপিয়ে ক্ষমার প্রবণতাটা সমুন্নত হবে। যার মাধ্যমে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী এক অরাজকতার পর উম্মাহ আবার স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। আসুন, আমরা চিন্তার মতপার্থক্য ও মাযহাবকেন্দ্রীক বিতর্ককে তদস্থলে রেখে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। আসুন, আমাদের সকলের ঐশীশক্তিকে কাজে লাগাই উম্মাহর উত্তরণের জন্য। যে উম্মাহর প্রত্যেকেরই স্রষ্টা, নবী ও জীবনধারণের উদ্দেশ্য একই। যেন আমরা সমগ্র বিশ্বে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে সমুন্নত করতে পারি, যে রাষ্ট্রগুলো নিয়ে কেয়ামতের দিনে নবী (সা.) গর্ব করতে পারবেন। কাব্যিক ভাষায়,
“দেশ ও জাতি গড়ার কারিগর হে ওলামায়ে কেরাম, তোমরাই যদি বাতিকগ্রস্ত হয়ে থাকো, তাহলে জাতির কাণ্ডারি কে হবে?”
শ্রদ্ধেয় সুধী এবং বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম,
যখন সবার আখলাকী উন্নয়ন সম্ভব হবে, তখন সমাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পুনর্গঠিত হতে শুরু করবে। আমাদের সমাজ দীর্ঘ একটা সময় ধরে আখলাকী সমস্যায় জর্জরিত। এ সমস্যার অসংখ্য কারণ রয়েছে। তবে, এখন সবগুলো উল্লেখ করা সম্ভব নয়। কিন্তু, সমস্যাগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটা হচ্ছে, আখলাকের সাথে সম্পর্কহীনতা। অথচ, এই আখলাকের মাধ্যমেই আমরা সত্য-মিথ্যা ও ভালো-মন্দ পার্থক্য করতে শিখি। আর এই আখলাকহীনতাই আজ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। মূলত, এই আখলাকহীনতা ও বস্তুবাদী মানসিকতার জন্যই আজ আমরা পর্যদুস্ত।
বিজ্ঞানভিত্তিক ইন্সটিটিউট এবং মুসলিহ ওলামায়ে কেরামের মাঝে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক তৈরিই হবে উম্মাহর পুনর্গঠনের মূল পদক্ষেপ। নচেৎ, এই পুনর্গঠন কীভাবে সম্ভব হবে, যখন সমাজ দেখবে এদের সমাজ চালানোর ভিন্ন ভিন্ন নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে!? কারণ, বস্তুবাদী দর্শনে প্রভাবিত বিজ্ঞানের বহু ব্যাখ্যা আজ ওলামায়ে কেরামকে বিজ্ঞানের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। যদিও এখানে, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উপকারিতা-ও অন্যতম একটা কারণ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু সত্যিকারার্থে, আমাদের সম্মুখীন হওয়া সমস্যাগুলো আসলে কিছুই না। সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে মূলত কলোনাইজেশন, দাসত্ব, জুলুম ও অজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে, বা এগুলোর ছত্রছায়ায়।
কিন্তু, অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠী আবার এই সমস্যা সমাধানকল্পে ইতিহাস পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে প্রতিশোধের আশ্রয় নিচ্ছে। এখন মূলত আমাদের নিজেদেরকে দায়ী করে প্রশ্ন করা উচিত, আমরা কী ছিলাম আর কোন ভুলে আমরা এই অবস্থানে পৌঁছলাম? এবং আমরা তখন কী করেছিলাম, যখন এই সমস্যাগুলো আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিলো?
এমন পরিস্থিতিতে যখন মুসলিম বিশ্বের কোথাও থেকে গোলাবারুদের ঘ্রাণ আসে, তখন আমাদের একটাই চাওয়া এবং একটাই দায়িত্ব-কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়; তা হলো, যেকোনো পন্থায় আমাদের মুসলিমদের রক্ত ঝড়ানো বন্ধ করা। এই সমস্যা সমাধানকল্পে অনেকে আবার আমাদেরকে উম্মাতান-ওয়াসাতান থেকেও সরিয়ে নিয়ে আসছে।
সম্মানিত বিজ্ঞ স্কলারগণ,
আজকের এই অধিবেশনের মূল লক্ষ্য হলো, আমাদের আলেমগণেরই মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করা। ভ্রাতৃত্ব, মাসলাহাত, ন্যায়, সত্য ও আদালত প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে যাওয়া। আমাদের এমন আলেম হওয়ার শপথ নেওয়া যে, যারা হজ্জের বিশাল সমাগমের সময়েও ছোট্ট একটা পিঁপড়ার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলবে। কারণ, নিরপরাধ মানুষ হত্যার ব্যাপারটা নিয়েও আমরা আজ ভয়ে জোরালো বিরোধিতা করতে পারি না।
আমার এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়,
আমাদের বিবেক ফিরিয়ে আনার জন্য এই ঝরানো রক্তগুলো কি যথেষ্ট নয়?
অত্যাচার, ঔদ্ধত্য, অপমান, অসম্মান করে কি এখনও আত্মতৃপ্তি হয়নি?
আসুন, আমরা গতানুগতিক সবকিছু থেকে বেরিয়ে আমাদের জ্ঞান, মন এবং কলমগুলোকে আবারো কাজে লাগাই। আসুন, সকল ধরনের ফিতনা দূরীকরণে আমাদের কণ্ঠকে আবারো সমুন্নত করি। আজকের এই অধিবেশন যেন আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শক্তিশালী করার অধিবেশনে পরিণত হয়।
যুগশ্রেষ্ঠ সম্মানিত স্কলারগণ,
ইসলাম দু’টি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত—একত্ববাদ এবং একতা। অর্থাৎ, আল্লাহর একত্ববাদ এবং উম্মাহর অভ্যন্তরীণ একতা। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা যেন এই আয়াতটাকে প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি,
“যারা নিজেদের আলাদা আলাদা দ্বীন তৈরি করে নিয়েছে আর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রত্যেক দলের কাছে যা আছে তাতেই তারা মশগুল হয়ে আছে।”
এটা সত্য যে, পশ্চিমা ও ওরিয়েন্টালিস্টরা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মুসলিমদের মাঝে বিভক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু, এরচেয়েও মারাত্মক যে বিষয়টা আমাদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করেছে, তা হলো আমাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কারণ, নিকটবর্তীদের নিকট থেকে যে সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়, সেগুলোই সবচেয়ে বেশি গভীর।
পরিশেষে বলতে চাই,
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, আমাদের মাঝে মতপার্থক্য থাকার পরেও উম্মাহর পুনর্গঠন এবং উম্মাহর মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদেরকে আত্মত্যাগ করা। ওয়াল্লাহি, শান্তি প্রতিষ্ঠাই হবে আমাদের সকল সমস্যা সমাধানের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। ওয়াল্লাহি, উম্মাহর মধ্যকার একতাই আমাদের বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করবে।
কিন্তু, শয়তান তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেই থাকবে। তবে, একমাত্র উলামায়ে কেরামই সে প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করতে পারে। এবং এই আয়াতকে আমরা আমাদের স্লোগান বানাতে চাই,
“আমি তো আমার সাধ্য অনুযায়ী সংশোধন (পুনর্গঠন) করতে চাই। যা কিছু আমি করতে চাই তা সবই আল্লাহর তাওফীকের ওপর নির্ভর করে। তাঁরই ওপর আমি ভরসা করেছি এবং সব ব্যাপারে তাঁরই দিকে রুজু করি।”
দরূদ ও শান্তির বার্তা প্রেরিত হোক সকল নবীদের সর্দার মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর পরিবারবর্গ এবং সাহাবীদের উপর। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক মহান রাব্বে কারীমের নামে (শেষ করছি)। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।