(প্রবন্ধটি ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে দারুল উলুম দেওবন্দে ছাত্রদের এক সভায় পাঠ করা হয়। পরে তা পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়।)
হে ছাত্রসমাজ! আমাদেরকে সর্ব প্রথম জানতে হবে, একটি দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও তার পরিচয় কি? দ্বীনী প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসা হল- এ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কর্মক্ষেত্র। এখানে মানুষ তৈরি করা হয়, দ্বীনের কান্ডারী ও ইসলামী সভ্যতার যুগের সিপাহসালার তৈরি হয়। দ্বীনী গবেষণা প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসা হল, মুসলিম বিশ্বের পাওয়ার হাউস। যেখান খেকে মুসলিম উম্মাহ তথা সারা দুনিয়ায় আলোক-রশ্মি বিতরণ করা হয়। দ্বীনী প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসা হল, এমন এক কারখানা, যেখানে মানুষের মন-মানস, ধ্যানধারণা ও চিন্তা-চেতনা বিকশিত হয়, যেমন সৃষ্টিকুলের প্রতিটি অণু-পরমাণুর বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়।
এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করে। তার শাসন সারা দুনিয়ায় চলে কিন্তু দুনিয়ার কোন শাসন তার উপর চলে না।
দ্বীনী প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসার সম্পর্ক কোন বিশেষ কালের সাথে নয়। সুনির্দিষ্ট কোন তাহযীব-তমদ্দুন, কৃষ্টি-কালচার বা ভাষা ও সাহিত্যের সাথে নয়। তাই, তার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা বা তার স্থায়িত্ব নিয়ে দ্বিধাবোধ করার কোন অবকাশ নেই। কারণ, মাদরাসার সম্পর্ক হলো সরাসরি নবুয়তে মুহাম্মাদীর সাথে, যা চিরন্তন ও সার্বজনীন। যে মানবতা সদা গতিশীল ও যে জীবন সদা চলমান, তার সাথে রয়েছে মাদরাসার সম্পর্ক। মাদরাসা মূলত প্রাচীনত্ব ও নতুনত্বের বিতর্ক থেকে সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে। কারণ, এতে নবুয়তে মুহাম্মাদীর অবিনশ্বরতা এবং মানব জীবনের উন্নতি-অগ্রগতি উভয়টিই পাওয়া যায়।
প্রিয় ছাত্রসমাজ! কোন দ্বীনী প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসাকে যদি শুধু একটি মিউজিয়াম বা অতীত স্মৃতি সংরক্ষণের কেন্দ্র মনে করা হয়, তাহলে এটি হবে বড় আপত্তিকর বিষয়। আমাদের মনে করা উচিত, দ্বীনী প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসা হল এক শক্তিশালী ও মজবুত ঘাঁটি। উন্নতি- অগ্রগতি ও জীবন পরিচালনার এক জীবন্ত কেন্দ্র। তার এক প্রান্ত নবুয়তে মুহাম্মাদীর সাথে এবং অপর প্রান্ত মানবজীবনের সাথে সংযুক্ত। মাদরাসা নবুয়তে মুহাম্মাদীর জীবন্ত ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে জীবনরূপ ক্ষেত-খামারে তা সিঞ্চন করে।
দ্বীনী প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসা যদি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অবহেলা করে, তাহলে সেই জীবনরূপ ক্ষেত-খামার শুষ্ক হয়ে যাবে, মানবতার অপমৃত্যু ঘটবে। আর তখন নবুয়তে মুহাম্মাদীর ঝর্ণার প্রবাহ বাকী থাকবে না। মানবতার পিপাসাও নিবৃত্ত হবে না।
রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবূয়তের ঝর্ণাধারা সদা-সর্বদা অবারিত, সকলের জন্য উন্মুক্ত। এতে কোন কার্পণ্য নেই, মানবতার ভিক্ষার ঝুলির প্রতি তার কোন বিমুখিতা নেই।
প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র জবান থেকে যেমন একদিকে ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللَّهُ يُعْطِي
“আমি তো শুধু বণ্টনকারী আর আল্লাহ হলেন দাতা।”
অপরদিকে মানবতা চিৎকার করে বলছে-
هَلْ مِنْ مَزِيدُ هَلْ مِنْ مَزِيدُ
“আরো পেতে চাই, আরো পেতে চাই।”
প্রিয় যুবসমাজ! ইসলামী সভ্যতার গবেষণা প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসার চেয়ে ব্যস্ত, গতিশীল ও প্রাণবন্ত কোন প্রতিষ্ঠান এ দুনিয়াতে থাকতে পারে না। মানব জীবনের সমস্যার কোন শেষ নেই, পরিবর্তন-পরিবর্ধনেরও কোন সীমা নেই। তার চাহিদা, ভুল-ভ্রান্তি, পদস্খলন ও গুনাহ বেশুমার। অতএব, মাদরাসা যেহেতু এ বৈচিত্র্যময় জীবন পরিচালনার দায়িত্বভার নিজ কাঁধে বহন করেছে, তাই তার অবসর নেওয়ার সুযোগ কোথায়? দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্মব্যস্ত থাকলেও তার অবসর নেয়ার সুযোগ আছে; কর্মবিরতির পথ আছে। কিন্তু দ্বীনী প্রতিষ্ঠান অথবা মাদরাসার অবস্থা সেরূপ নয়। দুনিয়ার সকল মুসাফির বিশ্রাম নিতে পারে কিন্তু মাদরাসার জন্য মুহূর্ত পরিমাণ বিশ্রাম নেওয়ার কোন কল্পনাও করা যায় না।
জীবন প্রবাহে যদি স্থীরতার অবকাশ থাকতো, তাহলে মাদরাসার জন্যও সামান্য বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু জীবনের গতিধারা যেহেতু থামবার নয়, তাই মাদরাসার কর্মবিরতির কোন প্রশ্নই আসে না।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিরীক্ষণ করা, নতুন নতুন প্রশ্নের সমাধান দেয়া এবং বিভ্রান্ত মানুষকে দিক-নির্দেশনা দান করা মাদরাসার দায়িত্ব। মাদরাসা যদি তার যাত্রাপথে পিছনে থেকে যায় বা ক্লান্ত হয়ে কোথাও যাত্রা বিরতি করে অথবা মনোরম কোন দৃশ্য দেখে তার মন এর প্রতি আসক্ত হয়ে যায়, তাহলে এ গতিশীল জীবনের নেতৃত্ব দেবে কে? নবুয়তের চিরন্তন শাশ্বত পয়গাম তাকে কে শুনাবে?
মাদরাসার জন্য কোন রকম নিস্ক্রিয়তা, কর্মবিমুখতা ও নেতৃত্ব থেকে দূরে থাকা আত্মহত্যারই শামিল; যা মানবতার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কোন আত্মসচেতন ও দায়িত্বশীল মাদরাসার ক্ষেত্রে তা কল্পনাও করা যায় না।
সম্মানিত ছাত্রবন্ধুগণ!
সম্মানিত উস্তাজগণের ও মাদরাসার ছাত্র হিসাবে আপনাদের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুমহান। দুনিয়াতে এরচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সামগ্রিক ও ব্যাপক দায়িত্ব বর্তমান যুগ-সন্ধিক্ষণে আর কোনো দল বা সংগঠনের আছে বলে আমি মনে করি না। পুনর্বার সে কথাটি ভেবে দেখুন যে, আপনাদের সম্পর্কের সূতিকার একপ্রান্ত নবুয়তে মুহাম্মাদীর সাথে জুড়ে রয়েছে, তো অপর প্রান্ত বাস্তব জীবনের সাথে। এ সুমহান গৌরব ও গুরুত্বপূর্ণ যিম্মাদারীর অধিকারী হওয়া আপনাদের মহত্ত্বের সবচেয়ে বড় দলীল।
আমার প্রিয় তালিবানে ইলম! আপনারা নবুয়তে মুহাম্মাদীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যেমন বড় সৌভাগ্য ও সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন, তেমনি এক বিরাট যিম্মাদারী আপনারা নিজ স্কন্ধে বহন করছেন। আপনাদের নিকট বাস্তবসম্মত আক্বীদা-বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় দৌলত রয়েছে, যা অন্য কারো কাছে নেই।
নবূয়তে মুহাম্মাদীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে আপনাদের উপর অসংখ্য দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। সুতরাং আপনার নিকট পাহাড়সম দৃঢ়-মজবুত ঈমান থাকতে হবে এবং এমন সাহসের অধিকারী হতে হবে, যাতে সারা দুনিয়ার বিনিময়ে হলেও কেউ আপনাদের ঈমানী চেতনা ও ধর্মীয় আদর্শ ক্রয় করার কল্পনাও করতে না পারে।
আপনাদের হৃদয়ে ঈমান সংরক্ষণ করার জযবা থাকতে হবে, এর উপর গর্ববোধ করতে হবে এবং সর্বান্তকরণে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। আপনাদের অন্তরে ধর্ম সম্পর্কে সততা, যৌক্তিকতা ও চিরন্তনতার সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে। তার অসীম শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব ও নির্ভুলতার ইয়াকীন রাখতে হবে।
আপনার নিজস্ব মতাদর্শের পরিপন্থী সব কিছুকে জাহিলিয়াতের মীরাস মনে করতে হবে।
আপনারা আল্লাহ্র নির্দেশাবলী, রসূলের হিদায়াত শোনার সাথে সাথে যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠবেন سَمِعَنَا وَأَطَعْنَا “আমরা শুনলাম ও মানলাম”। তেমনিভাবে জাহেলিয়াতের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও তার নীতিমালার কথা শুনে ব্যর্থহীন ভাষায় বলে উঠবেন:
كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى
تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَةً .
“আমরা তোমাদের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম। তোমরা যতদিন এক আল্লাহকে বিশ্বাস না করবে ততদিন তোমাদের ও আমাদের মাঝে শত্রুতা ও সংঘাত বিদ্যমান থাকবে।” [সূরা মুমতাহিনা: ৪]
দুনিয়াতে ইসলামই একমাত্র মুক্তির পথ। রসূলের আদর্শই একমাত্র শান্তির প্রতীক। তাঁর অনুকরণেই নিহিত রয়েছে সফলতা ও কামিয়াবীর চাবিকাঠি। ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির শ্রেষ্ঠত্ব এরই মাঝে লুকায়িত রয়েছে, এ বিশ্বাস হৃদয়- মনে বদ্ধমূল করতে হবে। একথা তো বাস্তব সত্য-
محمد عربی کہ ابروئے ہر دوسر است
کسیکه خاک درش نیست خاک بر سر او
“মুহাম্মাদ আরাবীই হচ্ছেন সম্মান ও মর্যাদার একমাত্র উৎস-স্থল,
তাঁর পদতলে যে নিজেকে বিলীন করতে না পারে, তার ধ্বংস অনিবার্য।”
ইলমে নবুয়তকে যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সার-নির্যাস মনে করতে হবে। দুনিয়ার মানব রচিত বস্তুকেন্দ্রিক তত্ত্ব-দর্শন, যুক্তি ও তর্ক-জ্ঞানকে কল্প-কাহিনীর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া যাবে না।
আপনাদের কাছে তাওহীদের পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে এবং এর উপর অবিচল আস্থা রাখতে হবে। শিরক্, কুফর ও প্রতিমা পূজার দর্শন যতই আকর্ষণীয় পন্থায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিভাষায় উপস্থাপন করা হোক, সেগুলোকে তুচ্ছ মনে করতে হবে। زُخْرَفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا “অন্তঃসার শূন্য, চাকচিক্যময় ভাষা” বলেই সেগুলোকে আখ্যা দিতে হবে।
সুন্নাতে রসূলের প্রতি আপনাদের লালায়িত হতে হবে এবং (خَيْرُ الْهُدْي هَدْىَ مُحَمَّدٍ (ص “রসূলের আদর্শকে সর্বোত্তম আদর্শ” হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে। বিদ’আত-কুসংস্কারের ক্ষতি এবং আল্লাহ্য় দরবারে তা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার ইয়াকীন রাখতে হবে।
মোটকথা, আপনাদের বিশ্বাস, মতাদর্শ, রুচিবোধ, ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা- চেতনায়; বরং দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কার্যকলাপে নবুয়তে মুহাম্মাদীর ব্যাপকতা ফুটে উঠতে হবে।
ছাত্র ও আলিমগণের বৈশিষ্ট্যঃ
বন্ধুগণ! দুনিয়াতে অন্যান্য মানুষের তুলনায় আপনাদের বিশেষত্ব রয়েছে অনন্য। কারণ, তারা মোটামুটি ঈমান আনলেই যথেষ্ট হবে। কিন্তু আপনাদের ঈমান মজবুত হওয়ার সাথে সাথে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও দৃঢ় আস্থা থাকতে হবে। শুধু মুখে স্বীকার করাই যথেষ্ট নয়; বরং তার দাওয়াতও দিতে হবে। সাধারণ লোকদের ঈমান শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে, কিন্তু আপনাদের ঈমান তাদের উপর প্রভাব বিস্তারকারী হতে হবে। হাজারো, লক্ষ মানুষের ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করে দেয়ার শক্তি থাকতে হবে। আর এটা তখনি সম্ভব যখন আপনার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ সবকিছু একমাত্র আল্লাহ্র জন্য উৎসর্গ করা হবে এবং তাগূতী শক্তির প্রতি আপনাদের মনোভাব হবে ঠিক তেমন, যেমন রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
يَكْرَهُ أَنْ يَعُودَ إِلَى الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ
“জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হতে যেমন মানুষ ভয় পায়, ঈমান আনার পর কুফরের প্রতি ধাবিত হওয়াকে ঠিক তেমনি ভয় পাবে।”
সাধারণ মানুষের কাছে নবুয়তের শিক্ষা মোটামুটি থাকলেই যথেষ্ট। কিন্তু ইলমে নবুয়তে আপনাদের সুগভীর জ্ঞান থাকতে হবে। এর প্রতি চরম আবেগ- উৎকণ্ঠা এবং সর্বস্ব বিলীন করে দেয়ার মানসিকতা লালন করতে হবে। তা না হলে মানুষকে আল্লাহ্য় দিকে দাওয়াত দেয়ার বিষয়টি কল্পনাও করা যায় না। বরং এ ফিতনার যামানায় নিজেদের পুঁজি ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে।
আধ্যাত্মিক গুণাবলীঃ
নবুয়তে মুহাম্মাদীর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার ও সুবিপুল সম্পদ রয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে:
فَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُؤَرِثُوا دِينَارًا وَلَا دِرْهَبًا وَإِنَّ مَا وَرَثُوا هَذَا الْعِلْمَ
“আম্বিয়ায়ে কিরাম টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাননি। তাঁরা তো শুধু পরবর্তীদের জন্য ইলমের মীরাস রেখে গিয়েছেন।”
কুরআন-হাদীস ও ফিকহ্ যথেষ্ঠ পরিমাণে সংরক্ষিত আছে। আলহামদু লিল্লাহ্! আর এ কারণে বর্তমান যুগে আপনাদের এ মাদরাসা উলুমে নবুয়ত শিক্ষাদানের এক বিরাট কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
উপরোক্ত জ্ঞান-ভাণ্ডারের সাথে সাথে আধ্যাত্মিক শিক্ষা, অভ্যন্তরীণ গুণাবলীও নবুয়তে মুহাম্মাদী দান করেছে। কুরআন-হাদীস ও ফিকহশাস্ত্র তথা জাহেরী উলূম যেমন যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত হয়ে আসছে, তেমনি আধ্যাত্মিক গুণাবলীও যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামত পর্যন্ত উভয় জ্ঞান সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছেন।
আধ্যাত্মিক গুণাবলী হলো ইয়াকীন, ইখলাস, তায়াল্লুক মাআল্লাহ, খুশু-খুযু’ দরদ, মুহব্বত, তাওয়াক্কালতু ‘আলাল্লাহ ইত্যাদি। এ উভয় জ্ঞানের সমষ্টির নাম হচ্ছে ইলমে নবুয়ত। ইরশাদ হচ্ছে-
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوا عَلَيْهِمْ أَيْتِهِ وَ
يُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ.
“তিনি এমন সত্তা যিনি নিরক্ষর মানুষের মধ্যে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁর আয়াত তিলাওয়াত করেন, লোকদের পূত-পবিত্র করেন, কিতাবুল্লাহর জ্ঞান ও হিকমত শিক্ষা দান করেন।” [সূরা জুমু’আ : ২]
অতএব, নবুয়তে মুহাম্মাদী থেকে শুধুমাত্র জাহিরী জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করলে আর আধ্যাত্মিক গুণাবলী ত্যাগ করলে নবুয়তের পূর্ণাঙ্গ ওয়ারিস হওয়া যাবে না। সঠিক অর্থে তাদেরকে নায়েবে রসূল বলা যাবে না।
দুনিয়াতে যাঁরা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রতিনিধি হয়েছেন, ইসলামের পয়গাম আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন, তাঁরা ইলমে নবুয়তের আংশিক আমানতদার ছিলেন না, জাহিরী উলূম ও আধ্যাত্মিক গুণাবলী উভয় দৌলতের তাঁরা অধিকারী ছিলেন। বর্তমান যামানাতেও ইসলামের দাওয়াত ও তার বিপ্লব সাধন করতে হলে শুধুমাত্র ইলমে নবুয়তের একাংশ দ্বারা তা করা যাবে না। যে বুজুর্গানে দ্বীনের সাথে আপনাদের সম্পর্ক রয়েছে, তাঁরাও উভয় গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। অতএব, আপনারাও যদি খাঁটি নায়েবে রসূলের আসনে সমাসীন হতে চান, তাহলে নিজেদের মধ্যে জাহিরী উলূম ও আধ্যাত্মিক গুণাবলী উভয়টির সমন্বয় সাধনের চেষ্টা চালাতে হবে। এছাড়া যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান হলো কাগজের ফুলের ন্যায়, যাতে নেই কোন খোশবু, নেই কোন সজীবতা। দুনিয়ার বাজারে কাগজের ফুলের কোন অভাব নেই। আমরা শত চেষ্টা করেও এতে তেমন কিছু সংযোজন করতে পারব না। এখানে তো নবুয়তের বাগানের সজীব তরতাজা ফুলের প্রয়োজন, যার সুগন্ধিতে দিক-দিগন্ত মোহিত হয়ে যাবে এবং তার সামনে দুনিয়ার সমস্ত ফুল লজ্জায় মাথানত করে দিবে।
فَوَقَعَ الْحَقُّ وَ بَطَلَ مَا كَانُوا
“সত্য বিকশিত হলো আর তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণিত হলো।”
দ্বীনী প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসাসমূহে আধ্যাত্মিক গুণাবলীর অবক্ষয়ঃ
আপনারা কিছু মনে করবেন না, আমিও আপনাদের মত একজন। আমাদের এ সমস্ত দ্বীনী মাদরাসায় অনেকদিন থেকে সেই তরতাজা সুগন্ধময় ফুল তৈরি হচ্ছে না। দিন দিন আমাদের মাঝে নৈতিক অবক্ষয় নেমে আসছে। হৃদয় পাষাণ করে রেখে আমাদের শুনতে হবে এবং বিবেচনা করতে হবে এ বিষয়টি কতটুকু সত্য যা কবি বলেছেন:
اٹھا میں مدرسہ و خانقاہ سے نمناک
نه زندگی نہ محبت نہ معرفت نه نگاه
“মাদরাসা ও খানকাহ হতে অশ্রুসিক্ত নয়নে বেরিয়ে এলাম কিন্তু
পেলাম না তো সেথায় আবে হায়াত,
মুহব্বত, মা’রেফাত ও প্রকৃত অর্ন্তদৃষ্টির সন্ধান।”
এ নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে অতীতের তুলনায় শত-সহস্র গুণ ছাত্র প্রতি বছর ফারেগ হলেও, সমাজের উপর এর কোন কার্যকরী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছে না।
কয়েকজন বিপ্লবী মানুষঃ
এ উপমহাদেশে অতীতে খাজা মু’ঈনুদ্দীন আজমিরী (রহ.), সাইয়িদ আলী হামাদানী কাশ্মিরী (রহ.)-এর মত সহায়-সম্বলহীন বুযর্গানে দ্বীন এসেছেন এবং তাদের হৃদয়ের উষ্ণতা, আবেগ-ব্যাকুলতা ও ঈমানের আলোক-রশ্মি দ্বারা সারা দেশ আলোকোজ্জ্বল করেছেন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী (রহ.) মুঘল সম্রাজ্যে এক বিস্ময়কর বিপ্লব সাধন করতে সক্ষম হোন। তাঁর নীরব ও মৌন প্রচেষ্টায় বাদশাহ আকবরের সিংহাসনে আমরা আওরঙ্গজেবের মত দ্বীনী ব্যক্তিত্ব সমাসীন হতে দেখেছি। শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রহ.) এসে এ সুবিশাল রাজ্যের গতিধারা সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দেন। তিনি মানুষের চিন্তা-চেতনা ও প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেন। হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.) অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে এবং মুসলমানদের অধঃপতনের যুগে ইসলামের এক সুদৃঢ়-মজবুত দুর্গ নির্মাণ করেন এবং ইসলামী শিক্ষার নিথর দেহে সঞ্জীবনী শক্তি ফিরিয়ে আনেন। কিছুদিন পূর্বে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) দ্বীনী দাওয়াত ও ঈমানী মেহনতের এক নতুন চেতনা দান করেছেন। মোট কথা-
جہانے زام و گرکون گرد یک مرد خود آگاهی
“এক-একজন আত্মসচেতন ব্যক্তি এসে পৃথিবীকে নতুন রঙ্গে রঙ্গিণ করে দিয়েছেন।”
আজ আমাদের ফারেগ ছাত্রদের মধ্যে সে সকল গুণ ও রূহ নেই, যার দ্বারা মানুষ নিজেদের আত্মপরিচয় লাভ করবে এবং জীবনের গতিধারা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে।
আজকের যুগ বড়ই বাস্তবতার যুগ। মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সামনেই সে শুধু মাথানত করে। উন্নত মস্তিষ্কের সামনেই সে বিনয়াবনত হয়। শূন্য হৃদয় পূর্ণ হৃদয়ের কাছে, নিরুত্তাপ মন-মগজ ঊষ্ণতার কাছেই হার মানে। আমাদের মাদরাসাসমূহে চিন্তা-চেতনার অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হৃদয়ের স্থবিরতাও বেড়ে চলেছে। বক্তা ও ওয়ায়েযদের এখন কোন অভাব নেই। কিন্তু একথা বাস্তব সত্য যা কবি জিগরের ভাষায় ফুটে উঠেছে-
آنکھوں میں سرور عشق نہیں
چھرے پر یقین کا نور نہیں“ চোখে নেই প্রেমের আনন্দ, চেহারায় নেই ঈমানের নূর।”
দ্বীনী প্রতিষ্ঠান বা মাদরাসাসমূহের স্থবিরতাঃ
দ্বীনী মাদরাসাসমূহ যা এক সময় রূহানিয়াতের প্রাণকেন্দ্র ছিল, বিপ্লবী মানুষ যেখান থেকে সৃষ্টি হতো, সেখানে আজ স্থবিরতা, হীনম্মন্যতা ও হতাশা বিরাজ করছে। আজ মাদরাসার সংখ্যা, ছাত্রের সংখ্যা, কিতাবাদির সংখ্যা এবং শিক্ষাসামগ্রীর সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এর জীবনীশক্তি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে আসছে, হৃদয়ের স্পন্দন দূর হয়ে যাচ্ছে। কোন দরদী ও চিন্তাশীল মানুষ এ পথ দিয়ে অতিক্রম করলে তার দম বেরিয়ে আসতে চায়। ব্যাথা- বেদনায় কাতর হয়ে তার মন এ প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে-
خدا تجھے کسی طوفاں سے آشنا کر دی
کہ تیرے بحر کے موجوں میں اضطراب نہیں
نخوتی دارند و کبرے چوشھاں
چاکری خواهند از اهل جہا” আল্লাহ তা’আলা তোমকে কোন তুফানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিন,
কারণ তোমার তরঙ্গমালায় সেই স্পন্দন নেই।
কিতাব থেকে তুমি বিচ্ছিন্ন নও,
তবে কিতাবের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই।”
আজ তো মাদরাসার জন্য তুফানের দোয়া করতেও ভয় হয়। বর্তমানে মাদরাসাসমূহে তুফানের কিছু নিদর্শনাবলী দেখা যাচ্ছে। তবে তা হচ্ছে বাইরের ঝড়ো হাওয়া, যা মাদরাসার দেয়ালের সাথে টক্কর খাচ্ছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের আওয়াজ ছাত্রদের কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে।
এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, যে সমস্ত দাওয়াত ও আন্দোলন, সাংগঠনিক তৎপরতা, স্লোগান ও হাঙ্গামা আজকের আধুনিক শিক্ষায়তনে বিবর্জিত ও উচ্ছিষ্ট মনে করা হয়, সেগুলোকে আমাদের মাদরাসাসমূহে পূনর্বাসন করা হচ্ছে। যাদের দুনিয়ার ইমাম, যুগের নেতা এবং মর্যাদার শীর্ষচূড়ায় আরোহণ করার প্রয়োজন ছিল, তারা ধর্মহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুসারী হতে পেরে আজ গর্ববোধ করছে!
کر سکتے تھے جو اپنے زمانہ کی امامت
وہ کنھ دماغ اپنے زمانہ کے ہیں پیرو ”
“যুগের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা যাদের ছিল,
তারাই আজ যামানার গোলামী করছে।”
মাদরাসার সবচে’ বড় ফিতনা হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হীনম্মন্যতার ব্যাধি, যা ঘূণের ন্যায় কাঠকে খেয়ে শেষ করে ফেলে। কোন প্রতিষ্ঠান যদি হীনম্মন্যতার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার জীবনীশক্তি লোপ পেয়ে যায়, বেঁচে থাকার অধিকার সে হারিয়ে ফেলে।
হীনম্মন্যতা কেন?
প্রিয় বন্ধুগণ! আপনারা আজ এ হীনম্মন্যতার শিকার কেন? সাধারণ লোকদের হীনম্মন্যতায় তাদের ঈমান-আক্বীদা ও আমলের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। কিন্তু আম্বিয়ায়ে কিরামের যারা প্রতিনিধি, ইলমে নবুয়তের যারা ধারক-বাহক তারা যদি এ হীনম্মন্যতার ব্যাধিতে আক্রান্ত হোন, তাহলে এটা হবে তাদের নবুয়তের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞতার সুস্পষ্ট দলীল এবং নবুয়তের বিশ্বাস না থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ। আপনারা তো ঐ সমস্ত মহামণীষীর অনুসারী, যাঁদের, ব্যাপারে মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী (রহ.) যথাযথ বলেছেন:
نخوتی دارند و کبرے جو شہاں
چا کری خواهند از اہل جہاں
“শাহী জাঁকজমক ও মান-মর্যাদার আসনে যারা একদিন অধিষ্ঠিত ছিলেন,
তাদের উত্তরসূরীরাই আজ দুনিয়াদারের নিকট চাকরি ভিক্ষা করছে!”
শেখ সাদী (রহ.)-এর ভাষায় তাঁদের চিত্র এভাবে ফুটে উঠেছে:
سهان بی کله و خسروان بی کمر اند
“তাঁরা ছিলেন মুকুটবিহীন রাজা ও সহায়-সম্বলহীন বাদশাহ।”
আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদাবোধঃ
আপনাদের নিকট যে মহামূল্যবান দৌলত রয়েছে, দুনিয়াবাসী তা হতে বঞ্চিত। আপনাদের সীনায় ইলমে নবুয়ত সংরক্ষিত রয়েছে, যা দুনিয়ার মানুষ হারিয়ে আজ গভীর অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে; অশান্তি, অস্থিরতা, অরাজকতা, সন্ত্রাস এবং যাবতীয় ফিতনা-ফাসাদে জড়িয়ে পড়েছে। আপনারা নিজেদের সাদাসিধে জামা, শীর্ণকায় দেহ ও খালি পকেটের দিকে লক্ষ্য করবেন না। আপনাদের সীনার ভিতরে কত মহামূল্যবান মণি-মুক্তা সঞ্চিত রয়েছে তা চিন্তা করুন। পূর্ণিমার সেই উজ্জ্বল চাঁদ আপনাদের হৃদয়ে লুকিয়ে আছে।
بر خود نظر کشاز تہی دامنی مرنج
ور سینے تو ماہ تمامی نهاده اند
“নিজের শূন্য আঁচলের দিকে তাকিয়ে তুমি ব্যথিত হয়ো না,
তোমার সীনায় তো লুকিয়ে আছে পূর্ণিমার সেই উজ্জ্বল চাঁদ।”
আপনারা মনে রাখবেন, লজ্জা ও অপমান এগুলো মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। বহির্জগতের সাথে এর সম্পর্ক খুবই কম। নিজেকে হেয় মনে করা মুলত এক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থারই নাম। এখান থেকেই হীনম্মন্যতাবোধ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
মানুষের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, দুর্বলতা ও ইতস্ততাবোধ প্রকৃতপক্ষে আত্মমর্যাদা উপলদ্ধির অভাবে হয়ে থাকে। যখন তার মনে সন্দেহ হয় যে, অন্যজন তাকে হেয় মনে করে, মানব সমাজে তার কোন মূল্য নেই, এ ধরনের দ্বিধা ও সন্দেহের কারণে সে নিজেই নিজের উপর জুলুম করে বসে।
স্মরণ রাখবেন, যে নিজেকে হেয় মনে করে, তাকে কেউ সম্মানী বানাতে পারে না। নিজের কাছে নিজের মূল্য না থাকলে কার প্রয়োজন আছে তাকে মূল্যায়ন করার? যে নিজের মনে ঠাঁই পায় না, এ বিশাল দুনিয়ার কোথাও তার ঠাঁই নেই। মন সংকীর্ণ হলে পৃথিবীটাও সংকীর্ণ মনে হবে, আর প্রশস্ত হলে পৃথিবীটাও প্রশস্ত-মনে হবে। মানুষকে সর্বপ্রথম দেখতে হবে, তার কাছে নিজের কি পরিমাণ মূল্য আছে। সে নিজকে যতটুকু সম্মানী করে? নিজের সাথে নিজের আচরণ কি ধরনের? যে ব্যক্তি নিজকে লাঞ্ছিত, অপমানিত, অসহায়, অকর্মণ্য, নিরর্থক ও অপদার্থ মনে করে, দুনিয়াতে তার সম্মান পাওয়ার আর কোন আশা নেই। এ বাস্তবতাটিকেই দানবীর হাতেম তাঈ তাঁর কবিতায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন:
وَنَفْسُكَ أَكْرِمُهَا فَإِنَّكَ ان تهن
عَلَيْكَ فَلَنْ تَلْقَى مِنَ النَّاسِ مُكْرِمًا
“তুমি নিজেকে সম্মান দাও, কারণ নিজকে যদি অপদার্থ,
লাঞ্ছিত মনে কর, তাহলে মানুষের কাছে কোনদিন সম্মান পাবে না।”
বন্ধুগণ! আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, আমরা হীন নই। শুধুমাত্র হীনম্মন্যতার ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমাদের আত্মপরিচয় না থাকার কারণেই এ ব্যাধির সৃষ্টি হয়েছে। এর সুচিকিৎসা হলো, আমরা কোন মাকামে আছি, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা এবং আমাদের সহায়-সম্বল ও পুঁজির যথাযথ নিরীক্ষণ করা। দুনিয়ার পরিবর্তন ও চিন্তাধারার পরিবর্তন মূলত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের উপরই নির্ভরশীল। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেদিন পরিবর্তন হবে, সেদিন দেখবেন দুনিয়াতেও পরিবর্তন ঘটেছে। হীনম্মন্যতার এ ভয়ানক মূর্তি যা আমাদের মন ও মস্তিষ্কের উপর চেপে রয়েছে এবং হৃদয়-মনে সদা ভীতির সঞ্চার করছে, তা একদিন দূরীভূত হয়ে যাবে। কবি যথার্থই বলেছেন:
اور اگر با خبر اپنی شرافت سے ہو
تیری سپہ انس و جن تو ہے امیر جنود“স্বীয় আত্মমর্যাদার সন্ধান পেলে মনে হবে যে, তুমিই তো প্রধান সেনাপতি, আর মানব-দানব সবই তোমার অধীনস্থ বাহিনী।”
যারা এই উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত দৌলত ও মর্যাদা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, সারা পৃথিবী তাদের কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছে। কোন রাজত্ব তাঁদের খরিদ করতে পারেনি। দুনিয়ার বড় বড় প্রলোভনের সামনে তাঁরা মাথানত করেননি। সহাস্য বদনে তাঁরা সবকিছু প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বলে দিয়েছেন:
بروایں دام بر مرغ و گرنه
که عنقا را بلند است آشیانه
“চলে যাও তুমি, এ দামে এ ধরনের কোন পাখি খরিদ করতে পারবে না, এর মূল্য তো আরো অনেক অনেক বেশি।”
যারা নিজেদেরকে স্বার্থের বিনিময়ে বিক্রি করতে পারে, সেসব আত্মভোলা, অসচেতন মানুষের লম্বা লম্বা দাস্তানে মানব সভ্যতার ইতিহাস আজ কলংকিত। কিছু সচেতন, আল্লাহ্ ভীরু এ আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মনীষীর বদৌলতেই মানবতার মান আজও শীর্ষে রয়েছে। জীবনের ইজ্জত আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের কারণেই টিকে আছে।
বন্ধুগণ! মানব জীবনের স্থায়িত্ব ও তার ক্রমধারা টিকিয়ে রাখার জন্যে খাদ্য, বস্ত্র ও জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের যেমন দরকার রয়েছে; তেমনি জীবনের মান-মর্যাদা, গাম্ভীর্য ও মানবতার ইজ্জত টিকিয়ে রাখার জন্য এমন কিছু মহামনিষীর প্রয়োজন যারা জড়বাদী এ দুনিয়ার মাঝে নবুওয়তী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেন, বস্তুকেন্দ্রিক উপায়-উপকরণের অনীহা প্রকাশ করবেন এবং নিঃসঙ্কোচে তাদের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হবে:
أَتْمِدُّونَنِ بِمَالٍ فَمَا آتَانِيَ اللهُ خَيْرٌ مِمَّا آتَاكُمْ بَلْ أَنْتُمْ بِهَدِيَّتِكُمْ تَفْرَحُونَ
“তোমরা কি আমাকে এ সমস্ত ধন-সম্পদ দিয়ে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে যা দিয়েছেন তা তোমাদের সম্পদের তুলনায় অনেক অনেক উত্তম। তোমরাই বরং তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে খুশি হয়ে থাক।” [সূরা নামল: ৩৬]
যেদিন এ আওয়াজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে এবং সারা দুনিয়া নিলামের বাজারে পরিণত হবে, ঈমান-আমল, বিবেক-বুদ্ধি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান কোন না কোন দামে খরিদ করা যাবে, প্রাণী ও জড়বস্তুর ন্যায় মানুষ পণ্যে পরিণত হবে, সেদিন এ দুনিয়া বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। মানবতার মান-মর্যাদা তখন আর কিছুই বাকী থাকবে না।
বর্তমান যুগ-সন্ধিক্ষণে আপনাদের দায়িত্ব মানবতার মর্যাদা ও নবুয়তের সম্মান টিকিয়ে রাখা। একমাত্র আপনারাই এ দায়িত্ব পালন করবেন। অন্য কারো কাছ থেকে তা আশা করা যায় না। যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উদরপূর্তিকেই সবচেয়ে বড় লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেছে, তাদের কাছ থেকে এ দায়িত্ব পালনের আশা করা সম্পূর্ণ বৃথা। শুধুমাত্র আপনারাই এ গুরুদায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা রাখেন। আপনাদের পূর্বসুরীগণের মধ্যেই তো ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর মতো আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আদর্শবান মানুষ অতিবাহিত হয়েছেন। আব্বাসীয় খিলাফত যাঁদেরকে কোনকিছুর বিনিময়ে খরিদ করতে পারেনি। ইমাম গাযযালী (রহ.)-এর মতো সৎ সাহসী ও বলিষ্ঠ হিম্মতের অধিকারী ব্যক্তি অতীত হয়েছেন, যিনি খিলাফতের ইঙ্গিত সত্ত্বেও বাগদাদের নিযামীয়া মাদরাসার প্রধান শিক্ষকের পদ নিতে রাজী হননি। খলীফার পরই যা সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সম্মান বলে বিবেচিত হতো, তা তিনি গ্রহণ করেননি। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সম্রাট জাহাঙ্গীরের সামনে মাথানত করার পরিবর্তে গোয়ালিয়র কারাগারের অন্ধকার কুঠরীকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
আপনাদের পূর্বসূরীগণের মধ্যে আরো রয়েছেন হযরত মির্জা মাযহার জানে জানান (রহ.)। দিল্লীর সম্রাট যাঁর কাছে পয়গাম প্রেরণ করেছিলেন যে, আল্লাহ্ আমাকে এতবড় সালতানাত দান করেছেন, আপনি এর কিছু অংশ গ্রহণ করুন। তখন তিনি বলেছিলেন আল্লাহ্ তা’আলা তো সমগ্র বিশ্ব জাহানকে ” مَتَاعٌ الدُّنْيَا قَلِيلٌ তুচ্ছ-সামান্য বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর এর একটিমাত্র অংশ আপনার অধিকারে রয়েছে। অতএব, এ থেকে কিছু অংশ গ্রহণ করার জন্য আমি কিভাবে হাত বাড়াতে পারি? একবার নওয়াব আসিফ জাহ তাঁর সামনে মুদ্রা পেশ করলে তিনি তা গ্রহণ করেননি। নওয়াব বললেন, এ মুদ্রাগুলো আপনি গ্রহণ করে অভাবীদের মাঝে বিতরণ করে দিন। তখন তিনি উত্তর দিলেন, দান কিভাবে করতে হয় তা আমার চেয়ে আপনিই ভাল জানেন। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আপনি নিজেই বণ্টন করতে করতে যান। চলার পথেই তা শেষ হয়ে যাবে। আপনাদের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন হযরত শাহ গোলাম আলী সাহেব দেহলবী (রহ.)। টুংকি প্রদেশের গভর্নর নওয়াব মীর খাঁ তাঁর খানকাহতে বাৎসরিক ব্যয় খাতে কিছু টাকা ধার্য করতে চাইলে তাকে উত্তর লিখেন:
ما آبروئے فقر و قناعت نمی بریم
با میر خان بگوں کہ روزی مقدر است
“দরিদ্রতা থাকা সত্ত্বেও অল্পে তুষ্টির গুণ আমাদের মধ্যে রয়েছে।
মীর খাঁকে বলে দাও যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের রিযিক নির্ধারিত আছে।”
আপনাদের আরেক পূর্বপুরুষ ছিলেন মাওলানা আব্দুর রহীম রায়পুরী (রহ.)। দশ পয়সা বেতনের শিক্ষকতাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন; কিন্তু বেরেলী কলেজের আড়াইশত টাকা বেতনের অধ্যাপনা করতে রাজি হননি। তিনি প্রফেসরের সম্মানজনক পদকে এ বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে কি উত্তর দিব?
হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর ব্যাপারে তো আপনারা জানেন যে, তিনি আলীগড়ের এক ধার্মিক ব্যক্তির কাজ করতেন মাত্র দশ টাকা বেতনে। আম্মা ইন্তেকাল করলে আরো দু’টাকা এ থেকে কমিয়ে নেন। এর কারণ তিনি বলেছিলেন যে, প্রতি মাসে আমি দু’টাকা মায়ের পিছনে খরচ করতাম। তার ইন্তেকালের পর আমার এটাকা খরচের অতিরিক্ত হয়ে যায়। আমি কিয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে এ টাকার জবাবদিহি থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই।
আপনাদের পূর্বসুরীগণ নিকট অতীতে কত বড় ত্যাগ ও কুরবানীর নজীর স্থাপন করেছেন। অল্প বেতনে মাদরাসার শিক্ষকতা করেছেন। আর কলেজ- ইউনিভার্সিটির মোটা অংকের বেতনের চাকুরিকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন এবং সীমাহীন ত্যাগ ও কষ্টে জীবন কাটিয়েছেন-
أُولَئِكَ أَبَائِ فَجِئْنِي بِمِثْلِهِمْ يَا جَرِيرُ الْمَجَامِعَ
“এরূপ ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষগণ; তোমাদের পক্ষে সম্ভব হলে এমন দৃষ্টান্ত পেশ কর দেখি।”
এ পথ ভোগ-বিলাসের নয়ঃ
বন্ধুগণ! আপনারা এরূপ মনে করবেন না যে, যামানার বিবর্তন, প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণের আধিক্য, সাহস ও হিম্মতের দূর্বলতা ইত্যাকার সমকালীন বিষয় সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। যার ফলে আমি আপনাদের কাছে মাওলানা আব্দুর রহীম রায়পুরী (রহ.) ও মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর মত ত্যাগ ও কুরবানীর নজীর স্থাপন করার আহ্বান জানাচ্ছি। তবে একথা অবশ্যই স্মরণ রাখবেন যে, আপনাদের এ পথ নিঃসন্দেহে ত্যাগ ও কুরবানীর পথ, সীমাহীন কষ্ট ও কঠোর সাধনার পথ। এ পথ দুনিয়া উপার্জন ও মান-মর্যাদা লাভের পথ নয়। এ পথে قُدْ كُنْتُ مَرْجُوًا قَبْلُ هَذَا “তোমার কাছে তো আমাদের বড় আশা ছিল”-এর তিরস্কার শুনতেই হবে। আর:
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيُوةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيْهِ وَ رِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى .
“আমি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ ভোগ- বিলাসের যে সকল উপকরণ দিয়েছি, আপনি সেদিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। আপনার পালনকর্তার দেয়া রিযিক অনেক উত্তম এবং অধিক স্থায়ী।” [সূরা ত্বাহা : ১৩১]
এর সবক অবশ্যই নিতে হবে। তবে এর পুরস্কার কি হবে, তাও শুনে নিন:
وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا لَمَّا صَبَرُوا وَكَانُوا بِأَيَاتِنَا يُوْقِنُونَ
“ধৈর্যধারণ এবং আমার নিদর্শনাবলীর প্রতি বিশ্বাস থাকার কারণে আমি তাদেরকে আমার নির্দেশিত পথ পরিচালনায় নেতৃত্বের মসনদে সমাসীন করেছি।”
মাওলানা রূমী (রহ.) এটাকে তাঁর ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন:
معده را بگزار سوئے دل خرام سلام
“উদরপূর্তির ভাবনা পরিত্যাগ করে হৃদয়কে বিকশিত করার চেষ্টা কর,
মহান প্রভুর পক্ষ থেকে পাবে তুমি শত সহস্র অভিনন্দন।”
যুগের অসহায়ত্ব ও তার চরম পিপাসাঃ
আপনারা যে হীনম্মন্যতার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন, এর একটা কারণ, আত্মমর্যাদাবোধের অভাব। কিছুক্ষণ পূর্বেই আমি তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছি। দ্বিতীয় কারণ হলো, এ দুনিয়ার আবর্তন-বিবর্তন সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা নেই। আপনারা জানেন না, এ জগত কত অসহায়, তার পিপাসা কত তীব্র। আপনারা তো এ যামানার দিকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকান। কারণ, তার সাথে আপনাদের কোন পরিচয় নেই। একটু কাছে গেলে উপলব্ধি করতে পারবেন, এ যামানা কি পরিমাণ দেউলিয়া হয়ে আছে। স্বয়ং যামানাই তার দেউলিয়াপনার তীব্রতা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তার মুদ্রার জালিয়াতি ধরা পড়েছে। তার সকল দর্শন, মতবাদ ও জীবন ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। সকল স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
উলূমে নবুয়তের যে মহান সম্পদ আপনাদের দান করা হয়েছে, হীনম্মন্যতার কারণে তা জনসম্মুখে পেশ করতে আপনারা সংকোচবোধ করেন। আপনারা মনে করেছেন যে, এ যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান, পলিটিক্স ও অর্থনীতির চরম উন্নতি ঘটেছে; এখানে আমাদের সেই প্রাচীন থিওরী ব্যর্থ। অথচ, বর্তমান যামানা শান্তির তালাশে অস্থির। তাদের নিদ্রা আজ হারাম হয়ে গিয়েছে।
জাতি আজ তৃষ্ণার্ত। তারা এমন কিছু লোকের অপেক্ষায় রয়েছে, যারা তাদের নতুন পথ দেখাবে। রসূলুল্লাহ (সা.)-এর শান্তির পয়গাম শুনাবে এবং ইসলামের চিরন্তন সত্য তাদের সামনে তুলে ধরবে।
ہمہ آہوان صحر اسر خود نهاد ہبر کف
با مید آں کہ روزے بشکار خواہی آمد
“জঙ্গলের সমস্ত হরিণ ক্ষুধার জ্বালায় মাথায় হাত রেখে বসে আছে এ আশায় যে, হয়ত একদিন আমাদের কাঙ্ক্ষিত খাবারের আগমন ঘটবে।”
নবুয়তী ইলমই হলো প্রকৃত জীবন পাথেয়ঃ
আপনারা যেসব বিষয়কে মামুলি মনে করেন এবং যেসব ব্যাপারে আপনাদের হৃদয়ে তেমন কোন মমত্ববোধ নেই, সেসব বিষয় নিয়ে আমি বড় বড় ডিগ্রীধারীদেরকে মাথা ঘামাতে দেখেছি। তাদের সামনে যখন আমি আম্বিয়ায়ে কিরামের কথা নিঃসঙ্কোচে ব্যক্ত করেছি, তখন মনে হলো যেন পাহাড়ের শীর্ষ চূড়া থেকে তাদেরকে সম্বোধন করা হচ্ছে। আর তারা এমনভাবে উৎসাহের সাথে শ্রবণ করছে যেন ইতঃপূর্বে তা আর কোনোদিন শ্রবণ করেনি।
দুনিয়ার বাজারে দুনিয়াবী সম্পদ এবং সেখানকার তৈরি পণ্য সামগ্রী নিয়ে গেলে, তা প্রত্যাখ্যাত হবেই। তখন আর এ অভিযোগ পেশ করা যাবে না যে, .بِضَاعَتُنَا رُدَّتْ إِلَيْنَا আমাদের পণ্য-সামগ্রী গৃহীত হয়নি।’
দুনিয়া আপনাদের কাছে আশা করছে যে, আম্বিয়ায়ে কিরামের শান্তির পয়গাম আপনারা তাকে শুনাবেন, চিরন্তন সত্য তার কাছে পেশ করবেন। বিশ্ব জাহান আজকেও তার সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত রয়েছে। যেমন খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকে সীমিত গণ্ডির ভেতরে তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়েছিল।
এ কথা সত্য যে, আপনাদের কাছে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সৌর বিজ্ঞানের মুষ্টিমেয় কিছু পৃষ্ঠা রয়েছে। এর তুলনায় ইউরোপের কাছে রয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক মহাসমুদ্র। একথাও সত্য যে, আপনারা ইউরোপকে গ্রীক দর্শনের থিওরী দ্বারা ভয় দেখাতে পারবেন না। কারণ, তার জীবনীশক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আপনাদের কাছে আম্বিয়ায়ে কিরামের আনীত যে বিদ্যা ভাণ্ডার সংরক্ষিত আছে, তা থেকে ইউরোপ-এশিয়া এখনো বঞ্চিত রয়েছে।
তারা হয়তো আপনার চিন্তা-গবেষণা ও যুক্তি-তর্কের মাঝে কিছুটা হলেও খুঁত বের করতে সক্ষম হবে কিন্তু আম্বিয়ায়ে কিরামের মুজিযাসমূহ নির্ভুল; চিন্তা- গবেষণা ও যুক্তি-তর্কের ঊর্ধ্বে তার স্থান। অতএব, আপনারা এ মূল শক্তি ও প্রকৃত সম্পদ নিয়ে পূর্ণ ইয়াক্বীন ও আস্থার সাথে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন; প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ময়দানে কাউকে দেখতে পাবেন না।
আপনাদের কাছে মানবতার সুমহান পয়গাম, চিরন্তন সত্য ও রবের জ্ঞানের ভাণ্ডার রয়েছে। মহান সত্তার সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে আপনারাও হয়েছেন মহিমান্বিত ও উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত।
জীবনের সাথে ইলমের সম্পর্ক এবং এজন্য পূর্বপুরুষগণের প্রচেষ্টাঃ
প্রিয় ভাইয়েরা! আমি পূর্বেই বলেছিলাম যে, আপনাদের একপ্রান্ত নবুয়তে মুহাম্মাদীর সাথে সংযুক্ত। এ কারণে কি কি দায়িত্ব আপনাদের পালন করতে হবে, তার বিস্তারিত আলোচনা এতক্ষণ পর্যন্ত পেশ করা হলো। এ কথাও আমি পূর্বে বলেছিলাম যে, আপনাদের অপর প্রান্ত হলো বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত। এ হিসেবে আপনাদের দায়িত্ব কী, কিরূপ কাজ করলে আপনারা জবাবদিহিতা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবেন, তা এখন আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
আম্বিয়ায়ে কিরামের মাধ্যমে আমাদেরকে যে জ্ঞান ও মূলনীতি দান করা হয়েছে, এতে বিন্দু পরিমাণ সংযোজন-বিয়োজন করা সম্ভব নয়। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এতে কোনো প্রকার রদবদল হতে দেননি। এ মহামূল্যবান জ্ঞান ভাণ্ডার তার নিজস্ব আকৃতিতে আমাদের পর্যন্ত তাঁরা পৌঁছিয়েছেন। এর সাথে সাথে তাঁরা এ সুমহান জ্ঞান ভাণ্ডারকে বাস্তব জীবনের সাথে সম্পৃক্ত করতে আজীবন মেহনত করেছেন, নিজেদের প্রখর মেধাকে কাজে লাগিয়ে তাকে জীবন্ত, আমলযোগ্য ও অনুকরণীয় প্রমাণিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বাস্তব সম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার কারণে সমকালীন যুগের উর্বর মস্তিষ্কের লোকজন সহজেই তা গ্রহণ ও হজম করতে সক্ষম হয়। তৎকালীন যুগের জ্ঞান- বিজ্ঞান ও ইসলামী রত্ন ভাণ্ডারের মাঝে কোন প্রকার তারতম্য ও বিরোধ সৃষ্টি হয়নি।
সেকালের বুযর্গানে দ্বীন শরীআতের মূলনীতি ও ধর্মীয় মতাদর্শকে তার নিজস্ব আকৃতিতে সংরক্ষণের ব্যাপারে পাহাড়ের ন্যায় মজবুত ও সুদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু তাঁরা এগুলোর ব্যাখ্যা, উপস্থাপনা এমন সাবলীল ও চমৎকার ভাষায় করেছেন যে, রেশমের কোমলতা ও ফুলের আকর্ষণীয়তা এতে বিদ্যমান ছিল। তাদের কর্মতৎপরতায় মূলত হযরত আলী (রা.)-এর সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ হিদায়াতের চিত্র ফুটে উঠত:
كلِّمُوا النَّاسَ عَلَي قَدْرِ عُقُوْلِهِمْ أَتُرِيدُونَ أَنْ يُكَذِّبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ
“তোমরা মানুষের সাথে তাদের বুঝবার সামর্থ্য অনুযায়ী কথা বল। তোমরা কি চাও যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.)-কে মানুষ মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক?”
এ কারণেই তাঁরা সমকালীন মেধা, বিবেক-বুদ্ধি ও মননশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী শরীআতকে উপস্থাপন করেছেন।
হিজরতের তৃতীয় শতকে বাদশাহ্ মামুনুর রশীদ ও মু’তাসিম বিল্লাহ্র তত্ত্বাবধানে এবং গ্রীক দর্শনের প্রভাবে মুতাযিলা মতবাদ মানুষের মন-মগজকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। জনসাধারণ এটাকেই যুক্তি ও তত্ত্বভিত্তিক মতবাদ বলে ভাবতে থাকে, যামানার ফ্যাশন ও উন্নত চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক মনে করতে থাকে; সে যুগে ইমাম আবুল হাসান আশআরী (রহ.) এ ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা বুলন্দ করেন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা বিশ্বাস, সুন্নাত ও শরীআতকে তাদের পরিভাষা ও বাচনভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে লাগলেন। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যেই সে মতবাদের অসারতা প্রমাণিত হয় এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মাঝে দ্রুতগতিতে হীনম্মন্যতার যে হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল, তা হঠাৎ থেমে যায়।
আবূ বকর আস সায়রাফী বলেন- “মুতাযিলারা অনেক উঁচু আসনে সমাসীন হয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের প্রতিরোধ করার জন্যে শায়খ আবুল হাসান আশআরী (রহ.)-কে সৃষ্টি করেন। তিনি তাঁর মেধা, বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তির ভিত্তিতে তা সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম হন।” আর এ সুমহান কীর্তির কারণে আবু বকর ইসমাঈলীর মত দূরদর্শী ব্যক্তিও তাঁকে উম্মতের একজন মুজাদ্দিদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
ইমাম আবুল হাসান আশআরী (রহ.)-এর ওফাতের পর তাঁর চিন্তা- চেতনার অনুসারীগণ এ ধারা অব্যাহত রাখেন। যার ফলে কাযী আবু বকর বাকেল্লানী (রহ.), শায়খ আবূ ইসহাক ইসফারায়েনী (রহ.)-এর মত আলেম এবং আল্লামা আবু ইসহাক সিরাজী ও ইমামুল হারামাইনের মত শিক্ষাবিদ তৈরি হন। তাঁরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব এ দুনিয়াতে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেযুগে গ্রীক দর্শনের জ্ঞান-ভাণ্ডার ধীরে ধীরে আরবী ভাষায় স্থানান্তরিত হচ্ছিল এবং দার্শনিকগণ একে বড়ই পূত- পবিত্র ও নির্ভেজাল হিসেবে প্রচার করছিল; যার ফলে তা সত্য-মিথ্যার মানদণ্ডে পরিণত হয়েছিল। এর মোকাবিলায় ইলমে কালাম অত্যন্ত স্থবির ও নির্জীব হয়ে পড়েছিল, অন্ধ অনুকরণের ভূত তাদের উপর চেপে বসেছিল। কালাম শাস্ত্রবিদ আলিমগণ শুধু আশআরী ও মাতুরিদী আকাইদ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তা প্রমাণ করার জন্য সেকালের যুক্তি ও দলীলসমূহ ঐ পরিভাষাতে পেশ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। অথচ সমকালীন যুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন যুক্তি, তত্ত্ব ও উপস্থাপনার মাধ্যমে আকাইদসমূহ জনগণের কাছে পেশ করা সময়ের দাবি ছিল।
ইমাম আবুল হাসান আশআরী (রহ.)-এর যুগ ছিল দর্শনশাস্ত্রের শৈশবকাল। তখন মুসলিম বিশ্বে সবেমাত্র তার পরিচয় হতে চলছিল। হিজরী পঞ্চম শতকে গিয়ে তা পূর্ণ যৌবনে উপনীত হয়। তখন মানব জীবনের সাথে তার গাঢ় সম্পর্ক হয়ে যায়। ঐ মুহূর্তে একজন সচেতন, তীক্ষ্ণ মেধা ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী সুমহান ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা এমন সংকটময় মুহূর্তে ইমাম গাজ্জালি (রহ.)-এর মত একজন যুগান্তকারী ও কালজয়ী ব্যক্তিকে সৃষ্টি করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থরাজির মধ্যে ইসলামের আকাইদ ও মূলনীতিকে নতুন আঙ্গিকে, অভিনব পদ্ধতিতে ও অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে হাজারো বিভ্রান্ত, দিশেহারা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে অস্থির মানুষ প্রশান্তির সন্ধান পায়; ঈমান ও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
তখনকার যুগে ইমাম গাযযালী (রহ.)-এর সুমহান দ্বীনী খিদমতকে যদিও অনেক কালাম শাস্ত্রবিদ আলিমগণ কোন মূল্যায়ন করেননি, বরং ইলমে কালামের মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রকার অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকেন। ফলে, তার জবাবে ইমাম গাযযালী (রহ.) ‘ফায়সালুত-তাফাররুকাহ বায়নাল ইসলাম ওয়াল যান্দাকাহ’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্ব তাঁর এ সংস্কারমূলক কীর্তির ভূয়সী প্রশংসা করে।
ইমাম গাযযালী (রহ.) ঈমান-আক্বীদা বিধ্বংসী গ্রীক দর্শনের জবাবদানের জন্য তা গভীরভাবে অধ্যয়ন করার প্রয়োজন অনুভব করেন। তাই তিনি দু’বছর দর্শনশাস্ত্রের উৎস অনুসন্ধানে ব্যয় করেন। তার আক্বীদা-বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিকে খুব ভালভাবে আত্মস্থ করেন যেমনটি তিনি ‘আল-মুনকিষ মিনাদ-দলাল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি সর্বপ্রথম ‘মাকাসিদুল ফালাসাফাহ’ এবং এরপর ‘তাহাফুতুল ফালাসাফাহ’ নামে দু’টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইমাম গাযযালী (রহ.) ‘তাহাফুতুল ফালাসিফা’ লিখে দর্শন শাস্ত্রের শীর্ষ মহলে প্রস্তরাঘাত করেন। পশ্চিমা বিশ্বের ঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের ভাষায় বলতে পারি যে, তাঁর এ হামলার প্রভাবে দর্শনশাস্ত্রের ভিত্তি শতাব্দীকাল যাবত নড়বড়ে থাকে। প্রায় নব্বই বছর পর দার্শনিক ইবন রুশদ ‘তাহাফাতুত তাহাফুত’ লিখে সে হামলার জবাব দানের চেষ্টা করেন।
ইমাম গাযযালী (রহ.)-এর পর দর্শনশাস্ত্রের মূল ভিত্তির উপর আঘাত হানার প্রয়োজন ছিল। উত্তর-প্রতিউত্তর ও অভিযোগের তীর দ্বারা তার প্রাচীর ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে এ সত্য প্রমাণ করার দরকার ছিল যে, শুধুমাত্র অনুমান ও অলীক কল্পনার উপর ভিত্তি করেই এ শাস্ত্রের জন্ম হয়েছে। এর জন্য সুবিস্তর জ্ঞানের অধিকারী, দর্শনশাস্ত্রের তথ্য উদঘাটনকারী একজন গবেষক, পর্যালোচক ও শক্তিশালী লেখকের প্রয়োজন ছিল। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ছিলেন এ কাজে যথোপযুক্ত ব্যক্তি। সর্বদিক দিয়ে তাঁর যোগ্যতা ছিল। তিনি তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে, বিশেষত ‘আর-রাদ্দু আলাল-মানতিকিয়্যীন’ প্রণয়ন করে দর্শনশাস্ত্রের পুরো কাঠামোকে অসাড় ও ভিত্তিহীন প্রমাণ করেন। তাঁর গবেষণামূলক সে সকল গ্রন্থ আজো মন ও মস্তিষ্কে স্পন্দন সৃষ্টি করে। মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রখর ও কর্মমূখর করে তুলে।
অপরদিকে ফালসাফা ও ইলমে কালাম মিলে যখন মানুষের মন-মগজে যুক্তি ও বুদ্ধির রাজত্ব বিস্তার করল এবং মুসলিম সমাজে সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড একমাত্র যুক্তিবাদ-এর কুপ্রভাব ছড়িয়ে দিল, তখন এর বিরুদ্ধে মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রহ.) কলম ধরলেন। তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘মসনবী শরীফ’ মূলত সপ্তম শতাব্দীর যুক্তিবাদের মোকাবিলায় এক প্রতিবাদী গ্রন্থ। এতে তিনি আকাইদ ও ইসলামের মৌলনীতি প্রমাণ করার জন্য নূতন নূতন উদাহরণের মাধ্যমে দলীল পেশ করেছেন, যা একসাথে মন ও মস্তিষ্ক উভয়টিকে প্রভাবান্বিত করে, সকল প্রকার দ্বিধা ও কলুষতা থেকে মুক্ত করে আত্মাকে বিশুদ্ধ করে তোলে। এ কালজয়ী গ্রন্থের প্রভাব আজো এ দুনিয়ায় বিদ্যমান রয়েছে। দার্শনিকদের মন-মগজে তা অব্যর্থ তীরের ন্যায় কাজে করে যাচ্ছে।
হাফিয ইবন তাইমিয়া (রহ.) ও মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী (রহ.)-এর পর দর্শনশাস্ত্রের এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। ইলমে তাসাওউফ ও আখলাকের সীমানায় তা অনুপ্রবেশ করে এবং রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থাতেও হস্তক্ষেপ শুরু করে। অতএব, তা প্রতিহত করার জন্য শুধু ইলমে ইলাহিয়াত ও ইলমে কালাম যথাযথ ছিল না; বরং ফালসাফা ও দর্শনশাস্ত্রের সর্বগ্রাসী হামলা দমন করার জন্য এমন সুমহান বিপ্লবী ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিল, যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন গ্রীকদর্শনের জ্ঞান, মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারার জ্ঞান, সমাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শনশাস্ত্র, তাসাউফ তথা সর্ববিষয়ে গভীর ও বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞান। এ পরিস্থিতিতে যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)-এর মত ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা’ ও ‘ইযালাতুল খিফা’ লিখে তিনি ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন, একাডেমিক পরিসরে ইসলামকে অভিনব পদ্ধতিতে জীবন্ত ও গতিশীল ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এবং সকলের হৃদয়ে উলামায়ে কিরামের মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছেন।
১৭৫৭ সালে ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তারের পর, নতুন নতুন ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। খ্রিস্টান মিশনারীগণ ইসলামের উপর প্রকাশ্যে আক্রমণ শুরু করে দেয়। উলামায়ে কিরামকে তারা মোকাবিলা করার আহ্বান জানাতে থাকে। এহেন সংকটময় মুহূর্তে পাদ্রীদের যাবতীয় অভিযোগ খণ্ডনের জন্য বাইবেল ও তার ব্যাখ্যা, সংকলনের ইতিহাস এবং খ্রিস্টধর্মের সাথে ইসলামের সংঘাতপূর্ণ বিষয়াবলী গভীরভাবে অধ্যয়ন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এহেন মুহূর্তে হযরত মাওলানা রাহমাতুল্লাহ্ কিরানভী (রহ.) এ ময়দানে বীরদর্পে এগিয়ে আসেন। ‘ইযহারুল হক’ ও ‘ইযালাতুল আওহাম’ এর মত গ্রন্থ প্রণয়ন করে খ্রিস্টধর্মের প্রচার-প্রসারে এক দুর্দমনীয় আঘাত হানেন। হিন্দুস্থান থেকে মিসর, তুর্কিস্তান পর্যন্ত কোথাও তাঁর প্রণীত এ গ্রন্থগুলোর কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। খ্রিস্টান বিশেষজ্ঞগণ আজ পর্যন্ত এগুলোর মোকাবিলা করার সাহস পায়নি।
তদানীন্তন ইংরেজ সরকারের ছত্রছায়ায় আর্য সমাজও ইসলামের মৌলিক আক্বীদা-বিশ্বাসে আঘাত হানা শুরু করে। পৃথিবীর নতুনত্ব, প্রাচীনত্ব, আল্লাহ্ তা’আলার সত্তা ও তাঁর গুণাবলী, হায়াতুন্নবী, কিবলা, পুনরুত্থান এবং এ ধরনের আরো অনেক মাসয়ালার উপর তারা যুক্তিভিত্তিক অভিযোগ পেশ করতে থাকে। আর এগুলো খণ্ডনের জন্য ইলমে কালামের প্রাচীন প্রমাণাদী ও তার উপস্থাপন পদ্ধতি তেমন কার্যকরী ছিল না। হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.) এ অভাব পূরণে এগিয়ে আসেন এবং ইলমে কালামের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। অত্যন্ত সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় ছোট ছোট উদাহরণ এবং সহজ ও বোধগম্য প্রমাণাদি দ্বারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কঠিন মাসয়ালার সমাধান পেশ করেন। ‘তাকরীরে দিলপজীর’, ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’, ‘আবে হায়াত’ ও ‘কেবলা নুমা’ গ্রন্থগুলো তাঁর অসাধারণ মেধা, সুরুচি ও সুক্ষ্মদর্শী হওয়ার প্রমাণ বহন করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাঞ্জাব প্রদেশে আরেক ফিতনার জন্ম নেয়। যা ছিল মূলত নবুয়তে মুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত বিদ্রোহ। ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাস ধ্বংস করে এক নতুন নবুয়ত ও ইমামতের প্রাসাদ নির্মাণ করাই ছিল তার লক্ষ্য। এ ফিতনার মোকাবিলায় কয়েকজন দূরদর্শী বিজ্ঞ আলিমেদ্বীন ময়দানে নেমে এলেন। তন্মধ্যে সাইয়িদ মুহাম্মাদ আলী মুঙ্গরী (রহ.) ও সাইয়িদ আনোয়ারশাহ কাশ্মীরি (রহ.) বিশেষ কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে গিয়েছেন।
যুগের দাবি
উপরোক্ত বিশদ বিবরণ এ জন্য পেশ করা হলো, যাতে আপনারা অনুমান করতে পারেন যে, আমাদের পূর্বসূরী উলামায়ে ইসলাম তাঁদের মেধা, দূরদর্শিতা ও প্রতিভাকে দ্বীনের স্বার্থে কাজে লাগাতে কোন প্রকার ত্রুটি করেননি, যাত্রাপথে কোথাও বিশ্রাম নেননি, যামানার নেতৃত্ব কখনো তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায়নি; যুগের বিবর্তন ও কালের গতিধারা অনুধাবন করতে কখনো তাঁরা ত্রুটি করেননি। যুগ চাহিদা অনুসারে দ্বীনের স্বার্থে যে পদ্ধতি অবলম্বন করার দরকার ছিল, নিঃসঙ্কোচে তাঁরা তা অবলম্বন করেছেন। সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে তাঁরা ইসলামকে সংরক্ষণ করার অঙ্গীকার করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন দল বা গোষ্ঠীর চিন্তাধারা অনুসরণ করে তাঁরা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেননি।
ভারত ও মিসরে যখন ইসলামের উপর ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস ও শিক্ষা- সংস্কৃতির মাধ্যমে হামলা শুরু হলো এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের লেখকগণ সত্যনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন মুসলিম মণীষীগণের উপর নানা ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করে ইসলামের অবকাঠামো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে চাইলো তখন উলামায়ে কিরামের মধ্য হতে একদল বিদগ্ধ লেখক, সাহিত্যিক ও কলম সৈনিক এদের মুকাবিলাতে সামনে অগ্রসর হন এবং তাঁরা ঐ সকল বিষয়ে কলম ধরেন। তাঁদের রচনাগুলো ইসলামী বিষয়ের পাশাপাশি উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের রত্ন ভাণ্ডার হিসেবে আজো সংরক্ষিত আছে। শত-সহস্র আধুনিক শিক্ষিত লোক তাঁদের রচিত গ্রন্থগুলো পাঠ করে ঈমানের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের মানসিক প্রশান্তি লাভ হয়েছে ও হৃদয়ের যাবতীয় অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা বিদূরীত হয়েছে এবং ইসলামের সাথে আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাওলানা শিবলী নুমানীর ‘আল-ফারুক’ ‘আল- জিযিয়াতু ফিল ইসলাম’ ও ‘কুতুবখানায়ে ইস্কান্দারিয়া’ অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
পাঠ্য তালিকায় সংযোজন-বিয়োজনঃ
স্বয়ং আপনাদের পাঠ্যপুস্তক এ বাস্তবতার সাক্ষ্য বহন করে যে, আমাদের দূরদর্শী উলামায়ে কিরাম বিভিন্ন প্রয়োজনকে মেনে নিতে এবং যুগ সমস্যা- সমাধানে অতি জরুরী ও কল্যাণকর যে কোন বস্তুকে গ্রহণ করতে তাঁরা কখনও পিছপা হননি।আপনাদের এ পাঠ্য তালিকা বিভিন্ন যুগের নানা পরিবর্তন, বিভিন্ন মতাদর্শ ও ইলমী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করছে। শুধুমাত্র বিগত শতাব্দীতে সামান্য কিছু বিষয় ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন ঘটেনি। অথচ এ যুগেই রাজনীতির পরিবর্তন ও মানুষের চিন্তা-চেতনা মন-মস্তিষ্কের বিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রচলিত পাঠ্য তালিকায় বৈধ ও জরুরী সংস্কার সাধনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ও সময়ের বড় দাবি ছিল।
ধর্মীয় নেতৃত্বদানের জন্য বহুমুখী যোগ্যতার প্রয়োজনঃ
প্রিয় তালিবে ইলমগণ বর্তমানে বৈপ্লবিক যুগে ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদান ও ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন এবং এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বতা প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু তার আলোচনা করা বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করাই যথেষ্ট নয়; বরং এর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি ও বহুমুখী প্রতিভার প্রয়োজন। আপনারা ইসলামের বীর সিপাহী। জীবন- সংগ্রামে জয়ী হতে আপনারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেনা ছাউনীতে যারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, তাদের জন্য নতুন-পুরাতন অস্ত্র ও যুদ্ধকৌশল নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া বড়ই ভয়ংকর ও বিপদজনক বিষয়। সিপাহীর কাছে অস্ত্রের নতুনত্ব ও প্রাচীনত্ব বলতে কিছু নেই। সে তো শুধু এ বিষয়টি নিরীক্ষণ করবে যে, যুদ্ধের ময়দানে কোন ধরনের অস্ত্র কার্যকরী হবে। আর কিরূপ রণকৌশল অবলম্বন করলে বিজয় ছিনিয়ে আনা যাবে। সিপাহীর জন্য অস্ত্রবিশেষের সাথে শত্রুতা পোষণ করা বা মিত্রতা দেখানোর কোনই অবকাশ নেই। সুনির্দিষ্ট কোন রণকৌশলের সাথেও তার সম্পর্ক রাখার সুযোগ নেই। তাকে তো সব ধরনের প্রয়োজনীয় অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বীরদর্পে ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে।
আরবের এক কবি অনেক আগেই বলে দিয়েছেন:
كُلُّ امْرَي يَسْعَى إِلَى يَوْمِ الْهِيَاجَ بِمَا اسْتَعَدًّا
“যে যা প্রস্তুত করেছ, তা নিয়েই রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়।”
নতুন মতাদর্শ সম্পর্কে গভীর ও বিশ্লেষণধর্মী জ্ঞানের প্রয়োজনঃ
বন্ধুগণ! আপনাদেরকে সাম্প্রতিককালের মতাদর্শ, আন্দোলন, বিপ্লব ও ফিতনা সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞানার্জন করতে হবে। তবে অপরিপক্ক ও স্বল্পজ্ঞান অজ্ঞতার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। আজ আমাদের মাদরাসাসমূহে ফ্যাশন রূপে অনেক দর্শন, মতবাদ ও আন্দোলনের নাম নেয়া হয়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সে সম্পর্কে তাদের কাছে ন্যূনতম জ্ঞানও নেই; গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী অধ্যয়ন তো অনেক দুরের কথা, এ বিষয়ে মোটামুটি ধারণাও নেই। বর্তমানে গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী অধ্যয়ন করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা অত্যন্ত জরুরী। এ কাজটি কঠিন মনে হলেও এর প্রয়োজন অনেক। মাদরাসার পক্ষ থেকে সুশৃঙ্খলভাবে তা অধ্যয়ন করার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে হলেও এটিকে অবশ্যই আয়ত্ত করতে হবে।
নতুন অধ্যয়নের সংকট ও দায়িত্বঃ
আমাদের মাদরাসাসমূহে নিত্য-নতুন অধ্যয়নের পরিধি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে। তবে আমার দুঃখ হয় এ কারণে যে, সে অধ্যয়নে নেই কোন গভীরতা ও ভারসাম্যতা। আমি সাধারণ জ্ঞানার্জনে ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ প্রদান করে থাকি। তবে আপনারা জেনে রাখুন, নিঃসঙ্কোচে আমি বলছি, এ কাজটিকে যত সহজ মনে করা হয়, তা এত সহজ নয়। এর জন্য গ্রন্থ নির্বাচন, বিন্যাস এবং একজন অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার প্রয়োজন। তবে এর পূর্বে নিজের ধ্যান- ধারণা ও মননশীলতা সঠিকভাবে যাচাই করে নিতে হবে। অধ্যয়নের পর লব্ধ জ্ঞানকে বিন্যস্ত করতে হবে এবং সঠিক স্থানে তা প্রয়োগ করতে হবে।
সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক তালিম-তরবিয়ত পেয়ে যদি কেউ তৈরি হয়ে যায়, তাহলে সে সব ধরনের অধ্যয়ন থেকে উপকৃত হতে পারবে। শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞান এমনকি অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় দ্বারা দ্বীনের এমন খিদমত ও মহৎ কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে; যা অনেক সময় মৌলিক বিষয় দ্বারাও করা যায় না। আর তখন আল-কুরআনের এ সত্যটি ফুটে উঠবে:
بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَبَنًا خَالِصًا سَائِفًا لِلشَّرِبِينَ.
“রক্ত ও গোবরের মধ্য থেকে খাঁটি ও তৃপ্তিদায়ক দুধ নির্গত হয়ে আসে।” [সূরা নাহল: ৬৬]
আর যদি এরূপ না হয়; ধর্মীয় নীতিমালা ও তার মৌলিক বিষয়সমূহ মন ও মস্তিষ্কে শক্তিশালী প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারে; বরং রুচিহীন ও বক্র মানসিকতা বিরাজ করে, তাহলে বিভ্রান্তি কখনো দূর হবে না, সঠিক জ্ঞানার্জন করা সম্ভব হয়ে উঠবে না,
هرچه کرد علتی علت شود.
“যেখানে হাত দেয় সেখান থেকেই ভ্রান্তি বেরিয়ে আসে।”
মাতৃভাষা ও সাহিত্যের সাথে সম্পর্কঃ
আমি এ সুযোগে আপনাদেরকে আরো দু’টি বাস্তবতার দিকে নিয়ে যেতে চাই। প্রথমত কোন দেশে দ্বীনী খিদমত, তার প্রচার-প্রসার এবং চলমান জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে হলে সেখানকার ভাষা ও সাহিত্যের সাথে পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক রাখতে হবে, সুস্থ মস্তিষ্ক ও সুরুচির অধিকারী হতে হবে, সঠিক মান-সম্পন্ন ও জীবন্ত ভাষায় লেখা ও বলার যোগ্যতা থাকতে হবে। আর তখনই দ্বীনের দাওয়াত সে দেশে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে যখন তার মাঝে দিলের অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা বিরাজমান থাকে।
একথা সর্বজন স্বীকৃত ও মনস্তাত্বিক যে, আল্লাহ্ তা’আলা আম্বিয়ায়ে কিরামকে পর্যন্ত স্বজাতির সামনে কথা বলার জন্য এবং তাদের দিল ও দেমাগকে প্রভাবিত করার জন্য প্রাঞ্জল ও মধুর ভাষায় তাদের মনোভাব ব্যক্ত করার অসাধারণ ক্ষমতা দান করেছিলেন। যেমন ইরশাদ হচ্ছে:
إِنَّا جَعَلْنَهُ قُرْءُ نَّا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ.
“নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে আরবী ভাষায় নাযিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার।” [সূরা যুখরুফ: ৩]
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:
بِلِسَانِ عَرَبِيٌّ مُبِيْنٍ
“আমি সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় নাযিল করেছি।”
[সূরা শু’আরা : ১৯৫]
আরো ইরশাদ হচ্ছে:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ
“আমি প্রত্যেক রসূলকে তার স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি।” [সূরা ইব্রাহীম: ৪]
চিন্তাশীল, গবেষক ও তত্ত্বজ্ঞানী উলামায়ে কিরাম মনে করেন যে, স্বজাতির ভাষা বলতে শুধুমাত্র উক্ত ভাষা বুঝা ও তাদেরকে বুঝানোর যোগ্যতা- এর নাম নয়; বরং যুগের সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যের মানদণ্ডে উন্নীত ভাষাকেই, বরং তাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকে বুঝানো হয়েছে। এর প্রমাণ হলো যে, আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে لتبين “যেন আপনি সুস্পষ্টভাবে তাদের সামনে ব্যক্ত করতে পারেন।” অন্যদিকে রসূলে করীম (সা.) বলেছেন اَنَا اَفْصَحُ الْعَرَبِ অর্থাৎ “আমি সর্বোৎকৃষ্ট আরবী ভাষাজ্ঞানের অধিকারী।”
আপনারা জানেন, ইসলামের ইতিহাসে যারা সংস্কার ও সংশোধনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং মুসলমানদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন; তাঁরা সাধারণত ভাষা ও সাহিত্যে পারদর্শী ছিলেন। শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর উপদেশবাণীর রত্ন-ভাণ্ডার ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ইমামে রব্বানী মুজাদিদ্দে আলফে সানী (রহ.)-এর মাকতুবাতসমূহের সাহিত্যগত মান, সাবলীলতা, প্রাঞ্জলতা ও মাধুর্যপূর্ণ ভাষা আবুল ফযল ফয়জীর রচনা সামগ্রীকেও হার মানিয়েছে। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রহ.)-এর ‘হুজ্জাতুল্লাহি বালেগাহ’ আরবী সাহিত্যে এমন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যে, ‘মুকাদ্দামায়ে ইবন খালদুন’-এর পর পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এর কোন নযীর পাওয়া যায় না। ফারসী ভাষাতেও শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রহ.) যথেষ্ট কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর রচিত ‘ইযালাতুল খাফা’ কিতাবের কিছু কিছু অংশ ফারসী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নমুনার স্বাক্ষর বহন করে।
এতো হলো তখনকার কথা, যখন আরবী, ফারসী এদেশের মুসলমানদের ভাষা ছিল। পরবর্তীতে উর্দু ভাষা চালু হওয়ার পর, স্বয়ং হযরত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী (রহ.)-এর সাহেবযাদাগণ সে ভাষাতেই সর্বপ্রথম কলম ধরেন এবং গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু করেন। শাহ্ আব্দুল কাদের (রহ.) কর্তৃক কুরআনুল কারীমের অনুবাদ দিল্লীর ভাষা শৈলীর সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ভাষার সৌন্দর্য ও নির্ভরযোগ্য কারণে তা ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে উন্নত মর্যাদা পেয়েছে। হযরত কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর গ্রন্থগুলোতে এমন সাবলীল ও মাধুর্যপূর্ণ ভাষা স্থান পেয়েছে, যার ফলে জটিল ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো সহজে অনুধাবন করতে তেমন বেগ পেতে হয় না।
এদেশে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত উলামায়ে কিরামই ভাষা ও সাহিত্যে নেতৃত্ব দান করেছেন। সাহিত্যের পথিকৃৎ হিসেবে তাঁরাই পরিচিত ছিলেন। খাজা আলতাফ হুসাইন আলী, মৌলবী নযীর আহমাদ দেহলভী, মাওলানা শিবলী নুমানী প্রমুখ উলামায়ে কিরাম ছিলেন উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত স্থপতি। তাঁদের সূক্ষ্ম রুচিবোধ, উন্নত মানসিকতা এবং রচনা সামগ্রীর এমন মূল্যবান রত্ন-ভাণ্ডার রয়েছে, যা উর্দু ভাষায় উজ্জ্বল নমুনা হয়ে আছে। মাওলানা হাবীবুর রহমান খান শেরওয়ানী (রহ.) ও দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার মহাপরিচালক মাওলানা সাইয়িদ আব্দুল হাই (রহ.) রচিত গ্রন্থরাজি উর্দু গদ্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ এবং ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা ও মাধুর্যপূর্ণ উপস্থাপনার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত।
মাওলানা সাইয়িদ সুলায়মান নদভী (রহ.) তাঁর তথ্যবহুল আলোচনা ও সাহিত্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধমালা দ্বারা উর্দুকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছিয়েছেন। তাঁর গ্রন্থরাজিকে আজো ভাষা ও সাহিত্যের মাপকাঠি মনে করা হয়। মাওলানা আবুল কালাম আযাদের রচনা সামগ্রী উর্দু ভাষায় নতুন শক্তি যুগিয়েছে এবং নতুন বর্ণনাভঙ্গি শিক্ষা দিয়েছে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আল-হেলাল’ পত্রিকার যাদুময় বর্ণনা পুরো হিন্দুস্থানে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এখনো সাহিত্যাঙ্গনে তার এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
উলামায়ে কিরামের জাগ্রত মস্তিস্ক ও যুগ-সচেতনতার ফলশ্রুতিতে তাদেরকে কখনোই এদেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও জাতীয় চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন বা অবচেতন বলে অপবাদ দেয়া যায় না। তাঁরা তো এদেশের মাটি ও মানুষ থেকে আলাদা থাকার কোন প্রচেষ্টা চালাননি। অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের মত যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে তাঁরা কখনো পিছিয়ে থাকেননি। বরং দ্বীনের দাওয়াত ও ইসলামের পয়গাম পৌঁছাতে দেশের প্রচলিত ও সাহিত্যাঙ্গনে প্রভাব সৃষ্টিকারী ভাষা ব্যবহার করেছেন।
সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো, তাঁদের নীতিকে আঁকড়ে ধরা এবং এ পূত- পবিত্র উত্তরাধিকারের যথাযথ সংরক্ষণ করা। আমরা যদি দ্বীনের কার্যকরী খিদমত করতে চাই, নিজেদের আক্বীদা-বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি সর্বমহলে পৌঁছে দিতে চাই, তাহলে আমাদের বক্তব্য ও লেখনিতে সাবলীল ও মাধুর্যপূর্ণ ভাষা এবং আধুনিক ভাষাশৈলী ব্যবহার করতে হবে। আপনাদের বক্তৃতা ও রচনা সামগ্রী সমসাময়িক সাহিত্যের মানদন্ডে উন্নীত করতে হবে। আর তা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও বুজুর্গানে দ্বীনের আদর্শের পরিপন্থী নয়; বরং তা দ্বীনি হিকমতের মৌলিক দাবি।
আরবী ভাষায় দক্ষতাঃ
সাম্প্রতিককালে আরবী ভাষা একটি জীবন্ত ও শক্তিশালী ভাষা। আরব বিশ্বে তা এখন উন্নতি-অগ্রগতির শীর্ষস্থান দখল করে আছে। রচনা-গ্রন্থনা, বক্তৃতা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দর্শন, আইন তথা সর্বস্তরে আরবী ভাষায় প্রচলন রয়েছে।
আমাদের দ্বীনী মাদরাসাগুলোতে একটি ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে যে, তাফসীর, হাদীস ও ফিকহশাস্ত্রের কিতাবগুলো প্রাচীন আরবী ভাষাতে সীমাবন্ধ; বর্তমানে তার কোন ব্যবহার নেই। আধুনিক আরবী ভাষা নামে সম্পূর্ণ একটি নতুন ভাষার জন্ম হয়েছে, যার অধিকাংশ শব্দই ইংরেজী ও ফারসী ভাষা থেকে উদ্ভূত।
এ ভুল ধারণার ফলে আমাদের অনেক আলিম ও তালেবে ইলমের হৃদয়ে আরবী ভাষার প্রতি চরম অনীহা ও হতাশাবোধ জন্ম নিয়েছে। আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, তাহলে অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে, আধুনিক আরবী ভাষার অস্তিত্ব বলতে কোনকিছুই নেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা আরব মুলুকে একাডেমিক পর্যায়ে এবং জ্ঞানী-গুণী ও বিজ্ঞ মহলে যে ভাষার প্রচলন রয়েছে, তা কুরআন-হাদীস, জাহিলিয়াত ও ইসলামী যুগের খুব নিকটবর্তী। নতুন প্রয়োজনের ক্ষেত্রেও তারা সেই প্রাচীন যুগে প্রচলিত ভাষা ও কুরআন-হাদীসের রত্ন-ভাণ্ডার থেকে উদ্ভাবন করে শব্দ প্রয়োগ করেছেন। এ বিস্ময়কর কাজের জন্য তাঁরা হাজারো বার মুবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য।
মিসরে নেপোলিয়ানের হামলার পর পাশ্চাত্য সমাজের যে সমস্ত শব্দ আরবী ভাষায় প্রবেশ করেছে, তা এক এক করে সবগুলোকে বাদ দেয়া হয়েছে এবং এ স্থলে আরবী শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে আরব দেশসমূহের ভাষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা উন্নতির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে, এ ময়দানে কাজ করতে হলে এখন অনেক প্রস্তুতি ও কঠিন সাধনার প্রয়োজন রয়েছে।
আমাদের মাদরাসাসমূহে যে পদ্ধতিতে আরবী ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তা দ্বারা আরব বিশ্বে একাডেমিক কোন খিদমত করা বা দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব সম্পাদন করা সম্ভব নয়। আরব দেশসমূহে দ্বীনী দাওয়াত পরিচালনা করতে হলে এবং হিন্দুস্থানের দ্বীনি কার্যক্রমসমূহের পরিচয় তাদের সামনে তুলে ধরতে হলে ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ, হিন্দুস্থান আরব বিশ্ব হতে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না।
বিশ্ব রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। আর তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যেক মুসলমানের দৃষ্টিতে তা এখন বিশ্বের হৃৎপিণ্ড ও কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যদি উলামায়ে কিরাম সুসম্পর্ক বজায় না রাখেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সঠিক দিক- নির্দেশনা প্রদান না করেন, তাহলে তা নিজেদের জন্য এবং এ দেশের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অতএব, আরবী চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের মাদরাসাসমূহের বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
ভাষা ও সাহিত্য জীবন্ত ও গতিশীল বিষয়। এ ব্যাপারে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সামান্যতম দুর্বলতা থাকলে দীর্ঘকাল সেই ক্ষতির খেসারত বরদাশত করতে হবে।
সঠিক আক্বীদা-বিশ্বাসের হিফাজতঃ
বন্ধুগণ! আমি আপনাদের অনেক সময় নিয়েছি। তবে-
لذيذ بود حکایت در از گفتم
“ঘটনা ছিল মাধুর্যপূর্ণ, তাই কথা দীর্ঘ করলাম।”
এখন আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পূর্বে, সর্বশেষ একটি কথা বলতে চাই। তবে কথাটি সর্বশেষে হলেও তার গুরুত্ব কোন দিক দিয়ে কম নয়। তা হলো, আমাদের পূর্বসুরী উলামায়ে কিরামের সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তাঁরা মুসলমানদের দ্বীনী মর্যাদাবোধ ও ধর্মীয় অনুভূতি সংরক্ষণ করেছেন। যুগের কোন ফিতনার সম্মুখে তাঁরা মাথানত করেননি এবং অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার ব্যাপারে কোন প্রকার দূর্বলতা ও অলসতা প্রদর্শন করেননি। আপনাদের পূর্বসুরীদের মধ্যে শাহ্ মুহাম্মাদ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) ও রশীদ আহমাদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর দিকে তাকিয়ে দেখুন। দুনিয়ার জীবনে তাঁরা সবকিছু মেনে নিতে পারতেন কিন্তু তাঁরা বিদ’আত ও কুসংস্কারকে কখনো মেনে নিতে পারেননি। পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁরা আজীবন লড়াই করেছেন। ইংরেজ শাসনামলে যখন এদেশে পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি- নীতি ও নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণার বন্যা বইতে শুরু করলো, তখন তাঁরা নিজস্ব মতাদর্শের উপর পাহাড়ের মত অবিচল ছিলেন; তা থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হননি। আপনাদের পূর্বসুরী উলামায়ে কিরাম শরীআতের ব্যাপারে অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও আত্মমর্যাদার পরিচয় দান করেছেন, যার ফলে তাঁরা শেষ পর্যন্ত কোন বিদ’আতের বৈধতার ফতওয়া দান করেননি। ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান যথাযথভাবে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব তাঁরা পালন করেছেন; এতে সামান্যতম সংযোজন-বিয়োজন তাঁরা মেনে নেননি। তাঁদের দূরদর্শিতার কারণে কোন বিদ’আত ইসলামের মূলনীতিতে প্রবেশ করার সুযোগ পায়নি। তাঁরা মানুষের ঘৃণা, তিরস্কার, বয়কট, কুফরের ফতওয়া এবং যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করেছেন, তবুও নিজস্ব মতাদর্শকে কখনো ত্যাগ করেননি। এর ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলমান আজ বিদ’আতের পরশ থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে। আল্লাহ্ তা’আলা দ্বীন ও শরীআতের অতন্দ্র প্রহরী বুজুর্গানে দ্বীনের রূহকে শীতল করুন এবং উম্মতের পক্ষ হতে তাঁদের মেহনতের উত্তম বিনিময় দান করুন।
آسماں ان کی لحد پر شبنم افشانی کرے
سبز ہے نورستہ اس گھر کی نگہبانی کرے
“আকাশ তাদের কবরগাহে রহমতের বারি বর্ষণ করুক।
সবুজ গম্বুজ তাদের গৃহের হিফাযত করুক।”
আজ আমরা ঐ সমস্ত বুজুর্গানে দ্বীনের অর্ন্তদৃষ্টি, দূরদর্শিতা ও ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছি। তাঁরা নিজেদের দায়িত্ব অত্যন্ত সুদক্ষতা ও নিপুণতার সাথে পালন করেছেন। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে-
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَّنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا .
“মুমিনদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে, যাঁরা আল্লাহ্রর সাথে কৃত ওয়াদা বাস্তবায়ন করেছে; কেউ জীবন দিয়েছে আর কেউ তার প্রতীক্ষায় রয়েছে। আর তাঁদের মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি।” [সূরা আহযাব: ২৩]
আমি আপনাদের কাছে একথা বলে যেতে চাই যে, এ হলো আপনাদের প্রিয় ও মাহবুব সম্পদ। তাঁরা তো নিজেদের জানকে ঢাল বানিয়ে ইসলামের এ বাগিচা সংরক্ষণ করেছেন; হৃদয়ের তপ্ত খুন প্রবাহিত করে এর বৃক্ষরাজিতে সিঞ্চন করেছেন এবং তাঁরা আমাদেরকে শিক্ষাদান করেছেন যে, ইসলামের এ বাগিচা সংরক্ষণ এভাবে করতে হয়।
آغشته ایم ہر سرخارے بخون دل
قانون با غبائی صحرا نوشته ایم
“কাঁটা বনে হৃদয়ের লহু প্রবাহিত করে লিখে গেলাম
মরুর বুকে ফুল ফোটাবার রীতি।”
ইসলামের এ সম্পদ আজীবন আমাদের বক্ষে ধারণ করে রাখতে হবে এবং এটাকে সবচে’ মূল্যবান সম্পদ মনে করতে হবে।
আপনাদের কাছে আমার হৃদয়ের বন্ধুসূলভ অভিযোগ হলো, আপনারা আকাবিরের সে আদর্শ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছেন- আপনাদের উচিত ছিল, তাঁদের প্রতিভা ও চেতনাকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা, তাঁদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণেই তো আজ আপনারা অনেক মানুষের কাছে ঘৃণিত ও অবাঞ্ছিত হয়ে আছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপনাদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের নাম ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে অবহিত নন। আপনারা কতজন মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর জীবন বৃত্তান্ত ও অবদান সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন? ‘সীরাতে মুসতাকীম’ ও ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ কতজন পড়েছেন? তাওহীদ ও সুন্নাতের সঠিক পরিচয় আপনাদের মধ্যে কতজন তুলে ধরতে পারবেন?
আপনাদের পূর্বসূরী বুজুর্গানে দ্বীন তো বলতে পারতেন যে, আইয়ামে জাহেলিয়াতে ঈমানের অর্থ কি ছিল? কুরআনে কারীম তাদেরকে কেন মুশরিক বলেছে? তাওহীদের স্তর, শিরকের অর্থ, বিদআতের মর্ম ও তার ক্ষতি সম্পর্কে তারা তো যথেষ্ট প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন।
আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত এ সমস্ত বিষয়ে একেবারেই জ্ঞান রাখেন না।
আধুনিক যুগের ফিতনাঃ
একথা তো সত্য যে, বর্তমান দুনিয়াতে নিত্য-নতুন ফিতনার আবির্ভাব হচ্ছে। অভিনব রূপ নিয়ে প্রাচীন জাহিলিয়াত আত্মপ্রকাশ করছে। আগেকার যুগে বিদ’আত পর্যন্ত ফিতনা সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা প্রকাশ্যে মূর্তিপূজার রূপ নিচ্ছে। বর্তমান সময়ের এ সকল ফিতনা আমাদের ধর্মীয় চেতনা, আমাদের দ্বীনি মূল্যবোধ ও আমাদের আক্বীদা-বিশ্বাসের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এখন দেখতে হবে, যারা বিদ’আত ও প্রচলিত কুসংস্কার বরদাশত করতে পারেননি, তাঁরা এ সমস্ত প্রতিমা সংস্কৃতি কিভাবে মেনে নিবেন? এ ব্যাপারে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপদ্ধতি কি হবে?
আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের ধর্মীয় চেতনা ও আপোসহীন ইসলামী মূল্যবোধ স্বীকার করি। সৃষ্টি ও স্রষ্টার সামনে একথার সাক্ষ্য দিতে কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করব না যে, তাঁরা বাতিল শক্তির সামনে কখনো মাথানত করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি। এখন দেখতে হবে, আমাদের পরবর্তী বংশধরগণ আমাদের সম্পর্কে কি মন্তব্য করে এবং ইতিহাস কিভাবে আমাদেরকে স্মরণ করে।
আধুনিক যুগের দায়িত্বঃ
বন্ধুগণ! মহান আল্লাহ্ তা’আলা যে যুগের জন্য আমাদেরকে নির্বাচন করেছেন, তার প্রতি বিরাট যিম্মাদারী রয়েছে। সাথে সাথে তার মর্যাদা ও বিনিময়ও রয়েছে অনেক বেশি। দায়িত্বে অবহেলা করা ও পলায়নপর মনোবৃত্তি রাখা পৌরুষসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাজ নয়।
অতএব, জীবনের অবশিষ্ট সময়টুকু আপনারা মূল্যায়ন করুন। যামানার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আল্লাহ্ তা’আলা আপনাদেরকে যোগ্যতম মুরুব্বী এবং দয়ালু উস্তাদ নসীব করেছেন। দ্বীনী পরিবেশ ও খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানে এনেছেন। সুতরাং, যামানার নাযুকতা ও দায়িত্বের ব্যাপকতা উপলব্ধি করুন। নিজেকে কর্মক্ষম ও প্রাণবন্ত করে গড়ে তুলুন। জাতি আপনাদেরকে মূল্যায়ন করবে।
غافل منشیں نہ وقت بازیست
وقت ہنر است و کار سازیست
“অলস হয়ে বসে থেকো না, সময় তো ফিরবার নয়,
সময় হচ্ছে গতিশীল, তাকে মূল্যায়ন করলেই পাবে তুমি জ্ঞানের আধার।”


