বায়তুল মুকাদ্দাসের উপর ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্বের প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চলল। এ সময়ের মধ্যে এমন কোন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, যে কারণে পবিত্রভূমিতে ইসরাইলী দানবের জবরদস্তিমূলক দখলদারিত্ব কায়েম রাখতে হবে। তারা সেখানকার দুর্বল ও নিরীহ মুসলমানদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করে চলেছে। বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্র আঙ্গিনায় নগ্ন ও অশ্লীল কর্মকাণ্ড করছে। সেখানে সৈনিকদের প্যারেড করে তাদের অবৈধ দখলদারিত্বের অপরাধ প্রদর্শনী করছে। মোটকথা, অসভ্য ও বর্বর কোন শত্রুর পক্ষ থেকে যেসব আচার-ব্যবহার হওয়ার কথা তা সবই হয়েছে।

 

পক্ষান্তরে আমাদের অবস্থা দেখুন! এই দুঃখ ও হতাশাজনক পরাজয়ে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের বিশেষ বৈঠকের প্রয়োজন আছে কি না- এটাই আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। এ শৈথিল্যের দরুন ইসরাইলের হাত দিনকে দিন বড় হচ্ছে, সাহস বৃদ্ধি পাচ্ছে। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধমূলক কোন প্রতিউত্তর দেয়া হয়নি।

 

৫ই জুনকে প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ দিবস হিসেবে চালু করে এই দিনে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মিছিল, সমাবেশ ও বক্তৃতার মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলবে হবে। এত বড় জুলুম ও অন্যায়ের ব্যাপারে একেবারে নীরব থাকার চেয়ে এমন প্রতিবাদী কিছু কথাও তো মন্দ নয়। বস্তুত বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধার ও মুক্ত করার জন্য যে দালান ও ফটক সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর অশ্বারোহী সৈনিকদেরকে আগুন ও রক্তের সাথে হোলি খেলতে দেখেছে, সেই ঘর উদ্ধারের এ চেষ্টা তেমন কিছু নয়। তারপরও গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু কিছু রাষ্ট্রপ্রধান একান্তভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৫ই জুন ‘গরম বক্তৃতা’ ও বিক্ষুব্ধ স্লোগানের প্রদর্শনী করে সামান্য কিছু চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু এ চেষ্টার উদাহরণ ঠিক ঐ লোকের মত, যার শরীরে ফোঁড়া উঠার দরুন সে তার রক্তের পরিশুদ্ধি চিন্তা না করে কেবল বাহ্যিক ঔষধ ব্যবহার করে উপশমের ব্যবস্থা করতে চায়। ইসরাইল মুসলিমবিশ্বের জন্য একটি রক্তাক্ত জখম। আর এর চিকিৎসা কেবল উপরাংশে পাউডার বা মলম ব্যবহার করলেই হবে না। কারণ, এ ধরনের চিকিৎসা দ্বারা যদিও বিষাক্ত উপসর্গ থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি লাভ করা যায়, কিন্তু কিছুদিন পর শরীরের অন্য অংশে এই উপসর্গের আত্মপ্রকাশ আবার ঘটে। সুতরাং আমাদের মূলচিন্তা ও গবেষণার বিষয় হচ্ছে ঐ বিষাক্ত  পদার্থটি কি? যা কখনো ফিলিস্তিন সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, আবার কখনো কখনো সাইপ্রাস, কাশ্মীর, ইথিওপিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে এর বিষাক্ত ছোবল পরিলক্ষিত হয়। আমাদের মধ্যে এর অনুপ্রবেশ ঘটলই বা কি করে? অধিকন্তু এর থেকে মুক্তির পথই বা কি?

 

বিষয়টি দীর্ঘ হলেও জটিল নয়। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-

وعد الله الذين امنوا منكم وعملوا الصلحات ليستخلفنهم في الارض كما استخلف الذين من قبلهم.

অর্থ: “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে আল্লাহপাক তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, নিশ্চয়ই তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে তার খেলাফত প্রদান করবেন। যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে খেলাফত দান করেছিলেন।” (সূরা আন নূর, আয়াত-৫৫)

 

আমরা যদি বিশ্বাস করি যে, বিশ্ব পরিমণ্ডলের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা ও মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং তাঁর আদেশ ব্যতীত এখানে কিছু হতে পারে না। পৃথিবীতে যত ধরনের বিপ্লব ও পরিবর্তন ঘটেছে সব তাঁরই আদেশ ও ইচ্ছাই ঘটেছে। আমরা যদি আরও বিশ্বাস করি যে, পবিত্র কোরআন আল্লাহর কালাম এবং তাতে একটি শব্দও ভুল নেই। তাহলে আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তা ও উপলব্ধি করতে হবে, আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পবিত্র কোরআনের এই ওয়াদা কেন পূরণ করা হচ্ছে না? পৃথিবীতে আমাদের শক্তি অর্জিত হচ্ছে না কেন? আমরা ভয়-ভীতি থেকে নিরাপদ হতে পারছি না কেন? তাহলে কি আল্লাহপাকের এই অঙ্গীকার প্রতারণামূলক? (নাউযুবিল্লাহ) একটু ন্যায়নীতির সাথে গভীর চিন্তা করলে আল্লাহপাকের এই অঙ্গীকারের যথার্থতা ও সত্যতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। কেননা, ইসলামী ইতিহাসের প্রথম যুগে বিশ্ববাসী এই অঙ্গীকারের অপরূপ কারিশমা অবলোকন করেছে। বস্তুত বর্তমানে আমাদের যে বিপর্যয় ও দুরবস্থা তা মূলত ঈমান ও সৎকর্মশীলতার ঘাটতি ও অভাবের অনিবার্য ফল। যা পবিত্র কোরআনে ঐ অঙ্গীকারের জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।

 

নিকট অতীত ইতিহাসের প্রতি সামান্যতম দৃষ্টিপাত করলেও একথার সত্যতা ও যথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। বস্তুত আমাদের সামগ্রিক বিপর্যয় শুরু হয়েছে তুরস্কের খেলাফতে উসমানিয়ার পতন থেকে। তখন মুসলিমবিশ্ব যে দূরবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল মূলত তা ছিল ইসলামের শত্রুদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পেতে রাখা ফাঁদে জড়িয়ে যাবার অনিবার্য ফল। যা আমরাও বেশ আগ্রহবশতই গ্রহণ করেছিলাম। সেই ফাঁদ হচ্ছে, পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা। যে প্রসঙ্গে লর্ড ম্যাকলের ভাষ্য- “এই শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে এমন এক প্রজন্ম সৃষ্টি করা, যারা বর্ণ ও বংশের ক্ষেত্রে স্বগোত্রীয় হলেও মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা ও রীতি-নীতির ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ হবে।” যে শিক্ষা ইউরোপে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল, সেই শিক্ষার সাথে মুসলমানরাও পরিচিত হয়ে উঠবে এটাতো বেশ সুন্দর প্রস্তাব। কিন্তু যে নীতি ও পদ্ধতির উপর স্থাপিত ঐ শিক্ষা ব্যবস্থা তা যুবকদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। তাতে মুসলিম যুবকদেরকে নিজের পারিবারিক জীবনদর্শন সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ রাখা

হয়েছে। পক্ষান্তরে পাশ্চত্য জীবনদর্শনের প্রীতি ও শ্রেষ্ঠত্বকে ওদের কোমল হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে। ফলে এদের জীবনদর্শন আমূল পবির্তন হয়ে গেছে। যে দীনের মধ্যে ওদের যাবতীয় উন্নতি ও সাফল্য নিহিত ছিল সেই দ্বীনের প্রতি ওদের কোন খেয়াল নেই। সেই দ্বীন বরং আজ বাস্তব জীবনে সঙ্গতিহীন পূর্বসূরীদের এক পবিত্র সম্পদ হিসাবেই গণ্য।

 

মুসলমানদের মধ্যে এই বিষাক্ত ছোঁয়ার যে বিস্তৃতি ঘটেছে এর তালিকা বিরাট দীর্ঘ। তবে এর মধ্যে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হচ্ছে (Nationalism) জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিকতা, যা মুসলমানদের পাহাড়সম দৃঢ়তাপূর্ণ ঐক্যকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছে। ইসলামের শত্রুরা হাজার বছর অনুধাবন করেছিল যে, মুসলিম ঐক্যই তাদের জন্য সব থেকে বড় বাধা। তাই ওরা ওদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের আঞ্চলিক ধারণা এমনভাবে প্রচার ও প্রসার করতে লাগলো, যেন এছাড়া মানুষ সভ্যই হতে পারে না। ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভাবাধীন ঐসব যুব শ্রেণী, যারা পশ্চিমা যে কোন স্লোগানকেই গ্রহণ করতে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকে।-তারা এই দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে সাদরে গ্রহণ করে ঐ ফাঁদে জড়িয়ে গেল- যা তাদের জন্য পেতে রাখা হয়েছিল।

 

আরব দেশগুলোর জাতীয়তাবাদের (Nationalism) ইতিহাস পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই মতবাদের সেখানকার একেবারে প্রথমদিকের প্রবক্তা হয় খৃষ্টান, না হয় ইহুদী। বর্তমান যুগের ওরিয়েন্টালিস্ট ফিলিপ হিট্টি তার ‘ইসলাম ও পাশ্চাত্য’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন-

বস্তুত এলাকায় (আরব অঞ্চলে) সিরিয়া লিবিয়ার খৃষ্টানরাই এই পাশ্চাত্য উপকরণ ধ্যানধারণার (Nationalism) ভিত্তি স্থাপন করেছে। পক্ষান্তরে মিশরে বৃটেনের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকে ঐসব কবি সাংবাদিক সম্পর্কে স্বাধীনভাবে লেখালেখি শুরু করে এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যা (Nationalism) জাতীয়তাবাদেরঅগ্নি স্ফুলিঙ্গপ্রজ্জ্বলিত করেছিল। মতবাদটির মত নতুন নতুন শব্দ চয়ন করে পুরাতন শব্দগুলোকে সংশোধন উন্নয়ন করা হয়। কারণ, খেলাফতে উসমানিয়ার বেষ্টনী থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন হওয়া মূলত মতবাদ প্রতিষ্ঠার উপর নির্ভর ছিল। (Islam and the west, New york, ১৯৬২, p. ৯১)

 

নিকট অতীতের আরব ইতিহাসবেত্তা জর্জ এন্তোনিয়ুসের (George Antonius) ‘আরব জাগরণ’ (The Arab Awake) বইয়ে বিষয়টিকে আরও বিশদ ও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তাতে তিনি লিখেন-

সুলতান আব্দুল হামীদ ক্ষমতারোহণের দুই বছর পূর্বে ১৮৭৫ সালে বৈরুত সিরীন প্রোটেস্টান্ট কলেজে পড়ুয়া পাঁচ খৃষ্টান ছাত্র সর্বপ্রথম আরব জাতীয়তাবাদের সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। অতঃপর তারা মুসলমানদেরকে এর সাথে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে লাগল এবং অল্পকিছু দিনের মধ্যেই তারা বিভিন্ন ধর্মের ২২জনকে নিজেদের সংগঠনের সদস্য করে নিল।

এই বইয়ে আরেকটু পরে যেয়ে জর্জ এন্তোনিয়ুস লিখেছেন-

আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী শীর্ষস্থানীয় দুইজন হচ্ছে নাসেফ ইয়াযুজী বুট্রস বুস্তানী। উভয়ই লেবাননী খৃষ্টান ছিল।দেশপ্রেম ঈমানের অংশএই স্লোগান সর্বপ্রথম বুট্রসই উত্তোলন করেছিল।

লেখক এ-ও লিখেছেন যে,

“প্রথমদিকে মুসলমানরা এ আন্দোলনকে তেমন পছন্দ করেনি; বরং বেশ খারাপ বলেই মনে করত। কিন্তু পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে তারাও এ বিষয়ে একমত হয়ে গেল।”

এন্তোনিয়ুসের ভাষ্যে-

“So it came to pass that the ideas which had originally been sown by the chirstians were now roughly at the-turn of the century finding an increasingly receptive soil among the Muslim.

” অর্থাৎ “যার ফলাফল হচ্ছে, যে মতবাদের বীজ বপন করেছিল মূলত খৃষ্টানরা, সেই মতবাদ মুসলমানদের মধ্যে ধীরে ধীরে বেশ সাদরে গৃহীত হল এবং তা যথেষ্ট ঊর্বরক্ষেত্র পেয়ে গেল।”

 

অনুরূপভাবে তুর্কি-যুবকদের উপর এ শিক্ষার প্রভাবে তুর্কি জাতীয়তাবাদের ভূত সওয়ার হল। সেখানেও এ মতবাদের স্থপতি হচ্ছে খৃষ্টান। তুরস্কের জনপ্রিয় লেখিকা খালেদা আদীব খানম তার Conflict East and West in turkey বইয়ে লিখেছেন-

“একদিকে তুর্কি মুসলমান যুবকরা গণতন্ত্রের দাবী উঠাল, অন্যদিকে ওসমানী সালতানাতের খৃষ্টান অধিবাসীরা জাতীয়তাবাদের ষড়যন্ত্র করল।” (পৃষ্ঠা-৫১)

এভাবে ওরা (খৃষ্টানরা) আরব ও তুর্কিদেরকে পরস্পরের বিরোধিতায় উদ্বুদ্ধ করল। ফলে সমগ্র মুসলিমবিশ্ব যেখানে ওসমানী খেলাফতের অধীনে এক ও অভিবক্ত ছিল, তা নিমিষে বিভক্ত হয়ে গেল। অতঃপর এসব বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট দেশকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে কিছুদিন রাখার পর ইসলামের শত্রুরা স্বাধীনতা দিয়েছে বটে। কিন্তু নতুন শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে মুসলমানদের মানসিকতার আদল পরিবর্তন হওয়ায় চেতনা ও বাস্তবতার ক্ষেত্রে তারা মূলত আজীবন পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণাধীনই থেকে গেল।

 

আধুনিক মিশর (Modern Egypt) বইয়ে লর্ড ক্রমার (Lord Cromer) ইংরেজদের কর্মকৌশল যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে যেয়ে লিখেছেন-

“ইংল্যান্ড তার সাম্রাজ্যের ‘নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন এলাকাকে যত শীঘ্র সম্ভব স্বাধীনতা দিতে প্রস্তুত ছিল। কারণ, সেসব এলাকায় ইতোমধ্যে এমন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন লোক তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যারা পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির পূর্ণ ধারক-বাহক হিসেবে নিজ নিজ দেশ শাসনে ছিল প্রস্তুত। কিন্তু-

Under no circumstances would the British Government for a single moment to create an independent Islamic state”

অর্থাৎ, “এসব এলাকায় স্বাধীন ইসলামী সরকার কোন অবস্থাতেই এক মুহূর্তের জন্যও বৃটিশ সরকার মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।”

মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শত শত বছরের পরিশ্রমের ফল হচ্ছে এই জাল বা ফাঁদ, যা শেষ পর্যন্ত সত্য সত্যই কার্যকর হল। প্রথমত মুসলিমবিশ্বকে ছোট ছোট দেশে বিভক্ত করে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। এবার ওদের উপর পাশ্চাত্য সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তি বাধাহীন হয়ে গেল। যাকে ইচ্ছা সরাসরি গোলাম বানিয়ে রাখল। আর যাকে ইচ্ছা শর্তের উপর নামের স্বাধীনতা দিল। কিন্তু তাকেও এমন এমন স্থায়ী সমস্যায় জড়িয়ে রাখল, যে সমস্যার আদৌ কোন সমাধান সম্ভব নয়।

এই সেই উদ্দেশ্য যা ওসমানী খেলাফত টিকে থাকা পর্যন্ত পশ্চিমারা কখনও অর্জন করতে পারেনি। কারণ, শেষ পর্যন্তও ওসমানী খেলাফত মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ অভিন্ন প্রাচীর ও দুর্গ হিসেবেই কাজ করেছে এবং এর কারণে মুসলমানদের অধিকার হরণ করা যে কারো জন্যে বিরাট দুরূহ ব্যাপার ছিল। ফিলিস্তিন সমস্যার প্রতি লক্ষ্য করলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। শত শত বছর পূর্ব থেকে এই এলাকা ইহুদীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত। ফলে বৃটেন যখন ইহুদীদেরকে উগান্ডায় আবাস গড়ার প্রস্তাব করে তখন তারা তা অস্বীকার করে। বরং এর পরিবর্তে ফিলিস্তিনে আবাস গড়ার উদ্দেশ্যে ১৯০২ সালে সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামীদের কাছে Theodore Herzl কে প্রধান করে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। তাদের পক্ষ থেকে সুলতানকে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আবাস গড়ার অনুমতির বিনিময়ে তুরস্কের সমস্ত বৈদেশিক ঋণ আদায় করে দেয়ার প্রস্তাব করা হল। কিন্তু সুলতান এর প্রতিউত্তরে যা বলেছিলেন তা ছিল খেলাফতকে সব থেকে বড় শত্রু মনে করে যারা, সেই আরব জাতীয়তাবাদীদের জন্য বিরাট দিকনির্দেশনা ও পাথেয়।

 

সুলতান আব্দুল হামীদের উত্তরটা Theodore Herzl তার নিজ ডাইরিতে এভাবে লিখেছেন-

“D. Herzl কে জানিয়ে দাও! যতদিন ওসমানী খেলাফত থাকবে ততদিন যেন ফিলিস্তিনে ইহুদী রাষ্ট্র বা শাসন কায়েমের অভিলাষ পরিহার করে। তা কেবল তখনই সম্ভব, যখন ওসমানী খেলাফত একটি অতীত স্বপ্ন হয়ে যাবে। (Quoted by Myr. Ghulam Mohammad: of Indonesia Muslim News Karachi, May 1968 р. 8)

সুলতান আব্দুল হামীদের এই উত্তরের পর ওসমানী খেলাফতের বর্তমানে ফিলিস্তিনে ইহুদী বসতি স্থাপনে ওরা সম্পূর্ণভাবে নিরাশ হয়ে পড়ে। অতঃপর খেলাফতের উপর আঘাত করার পুরো চেষ্টা শুরু করে। পশ্চিমা শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটিয়ে ধর্মহীনতা ও জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তারা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে সফলতা পেয়ে যায়। পক্ষান্তরে ওসমানী খেলাফত সত্যিই কাল্পনিক ও অতীতের হয়ে পড়ে। এর ফলাফল হিসেবেই আজকের ইসরাইল নামক ইহুদী রাষ্ট্র। শুধু এক ইসরাইলই নয়; বরং মুসলিমবিশ্বের সামগ্রিক সমস্যাবলি এরই ধারাবাহিকতাস্বরূপ।

 

এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুসলমানদের মনোযোগকে এই দিকে আকর্ষণ করা যে, ঐসব সমস্যা ও বিপর্যয় থেকে সত্যিই যদি আমরা মুক্তি চাই, তাহলে গত দেড়শত বছর যাবত গৃহীত নিজেদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মনীতির বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করতে হবে।

 

আমাদের মূল সমস্যা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ, যা আমাদের স্বতন্ত্র জীবনধারাকেই বিনাশ করে দিয়েছে। ফলে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আমাদের শক্তির মূল উৎস ঈমান ও সৎকর্মশীলতা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গিয়েছি। আমাদের অবস্থা পথহারা ঐ পথিকের মত, যে পথ হারিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনে। আমরাও প্রতারণার শিকার হয়ে কেবল ধ্বংস আর অধঃপতনের পথেই চলছি। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল, বার বার প্রতারিত হওয়ার পরও আমরা আবার প্রতারণার শিকারে পরিণত হচ্ছি। আর ঐসব প্রতারকচক্র আমাদেরকে ধ্বংসের জন্য নতুন নতুন গর্তের ও ধ্বংসের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে।

 

দুঃখজনক ব্যাপার যে, এই সত্য ও বাস্তবতাটুকু এখনও মুসলিমবিশ্ব উপলব্ধি করতে পারেনি। ইসরাইলের কাছে আমাদের একের পর এক পরাজয়ের পরও আমাদের হুঁশ হল না, চৈতন্য ফিরল না। প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস পতনের চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার-এই ঘটনা থেকে আমাদের কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারা। আমাদের, বিশেষ করে আরববিশ্বের জীবনধারা মূলত পাশ্চাত্যের ধর্মহীন জীবন-পদ্ধতিরই অন্ধ অনুকরণ। যা একদিকে ভোগ-বিলাসের উদ্দীপনাকে যেমন চরম আগ্রহী করে তুলেছে, অন্যদিকে তেমনি কর্মস্পৃহা ও উদ্যমশীলতার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি করেছে এবং আল্লাহ ও ইসলামের পরিবর্তে ‘আরব জাতীয়তাবাদ’, ‘মাতৃভূমিপ্রীতির’ স্লোগান ও আন্দোলনের পেছনে মরিয়া হয়ে লেগে এবং পারস্পরিক অনৈক্যের দরুন আজ আমরা ছিন্ন-ভিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছি। ৫ই জুনকে কেবল

 

ইহুদী অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ নয়; বরং নিজেদের ঐ মানসিক রোগের প্রতিষেধক হিসেবেও গ্রহণ করতে হবে। যার কারণে আজ ইহুদীদের মত বর্বর সম্প্রদায়কে নিয়ে আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে। ইসরাইলের দখলদারিত্ববিরোধী বিভিন্ন প্রস্তাব ও পদ্ধতি অবলম্বনের সাথে সাথে আমাদের মন-মানসিকতা ও অন্তরে ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষক ও পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার যে দখলদারিত্ব জেঁকে বসে আছে, এর বিরুদ্ধেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অনারবদের অবৈধ দখল থেকে যেমন ফিলিস্তিন স্বাধীন ও মুক্ত করার দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে, তেমনি ঐসব অনারব চিন্তা-চেতনার প্রভাব থেকেও নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে, যা আমাদেরকে আমাদের দীন, ঈমান এবং সিরাতে মুস্তাকিম থেকে দূরে সরিয়ে ধর্মহীনতা, প্রবৃত্তি পূজা, ভোগ-বিলাসিতা ও চৈতন্যহীনতার বশবর্তী করেছে। যার কারণে আজ আমরা অন্যদের খেলনায় পরিণত হয়েছি। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ‘পাশ্চাত্য অনুকরণের’ মত ভয়ঙ্কর প্রবণতা প্রতিরোধ করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত  আমাদের উপর ‘ইসরাইলের মত’ হাজার হামলা আপতিত হবে। কারণ, এসব সাময়িক ব্যবস্থা পরিকল্পিত ঐসব সমস্যার কোন সমাধান বয়ে আনতে পারবে না।

 

কিছুদিন পূর্বে ফিলিস্তিনের প্রধান মুফতি পাকিস্তান সফরে আসলে রাওয়ালপিণ্ডিতে এক বক্তৃতায় বলেন-

“ওসমানী খেলাফতের পতনের পর সমগ্র মুসলিমবিশ্বের দৃষ্টি এখন পাকিস্তানের প্রতি নিবদ্ধ। যাকে সমগ্র মুসলিম জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হয়। কারণ, বর্তমান বিশ্বে পাকিস্তানই একমাত্র দেশ যা ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”

 

বিজ্ঞ মুফতি সাহেবের এই বিশ্লেষণ শতভাগ বাস্তব ও যথাযথ। তাই পাকিস্তানের জনগণ ও শাসকদের দায়িত্ব হল অতীতের তিক্ত-অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সমগ্র মুসলিম জাতির মনোবাসনা পূরণ করা এবং পাশ্চাত্য অনুকরণের ধ্বংসাত্মক পথ পরিহার করে ইসলাম প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করা। যা কেবল পাকিস্তানের শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নতি সাধন করবে না; বরং সম-সাময়িক অন্যান্য মুসলিম দেশকেও বর্তমান দুরবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার পথে উদ্বুদ্ধ করবে।

 

টীকাঃ

১. বায়তুল মাকদিসের বর্বোরোচিত ইসরায়েলী আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে, মুফতী তাকী উসমানীর দেয়া এ বক্তব্য এখনো প্রাসঙ্গিকতা রাখে। বিশেষত, যেহেতু এখনো ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইলের নারকীয় গণহত্যা ও মুসলিম বিশ্বের নীরবতা বিদ্যমান!

১১১৪ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top