বিশ্ব-সাহিত্য বলতে বিদগ্ধ মহল এ বিশ্বের ক্লাসিক সাহিত্যকেই মনে করেন। হোমার, বাল্মিকী, ব্যাস, তোবাহ বা ওলড টেস্টামেন্ট, রাজা আর্থারের রাউন্ড টেবিলের গল্প (King Aurthur and his round table), আরব্য উপন্যাস, শেকসপীয়র, গ্যেটে, তলস্তয় ও রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীকে বিশ্ব-সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ অবদান বলে গণ্য করেন। এ তালিকাকে নিখুঁত বলে গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই। যেহেতু মানব-জীবনের কোনো শেষ সীমা আজও নির্ধারিত হয়নি এবং ভবিষ্যতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও উন্নততর অবদানের সম্ভাবনা রয়েছে- এজন্য গোঁড়া ভক্তের মতো পণ্ডিতজনের এ সংখ্যাকে সর্বশেষ বলে গ্রহণ করা যায় না। তবে এ নির্দিষ্ট সংখ্যা থেকে তাঁদের বিচারের মানদণ্ড আবিষ্কার করা যায় কিনা তা ভেবে দেখার বিষয়।

কেন এগুলোকে বিশ্বের সেরা সাহিত্য বলে তাঁরা গ্রহণ করেছেন এবং কালের অমোঘ প্রবাহ অতিক্রম করে কেন এগুলো এখনও মানব-জীবনে টিকে রয়েছে- তার অনুসন্ধান করলে, দেখা যায়, তাতে মানব-জীবনেরই চিরন্তন রূপ প্রতিফলিত হয়েছে- এবং তাতে সে জীবনের সমালোচনা রয়েছে- এ জন্যে তারা আজও টিকে রয়েছে। হোমার বা বাল্মিকী অংকিত চরিত্রের প্রত্যেকটিই এক একটা প্রতীক (type) এবং তারা মানব- জীবনের এক একটা বিশিষ্ট দিকের প্রতিনিধি। হোমারের অংকিত ট্রয়ের রাজকুমার প্রায়াম দস্যু প্রকৃতির অদম্য দুঃসাহসী যুবক। তার বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে হেলেনকে জোর-জবরদস্তি করে অপহরণ করেছে। এ অপহরণ করার যে প্রবৃত্তি মানব-মানসে রয়েছে- সেই প্রবৃত্তি তাকে এ অপকর্ম করার প্রেরণা যুগিয়েছে। এজন্য তাকে মানব- মানসে ক্রিয়াশীল দুষ্প্রবৃত্তির প্রতিনিধি বলা যায়। রামায়ণে চিত্রিত রাজা রামচন্দ্রকে তেমনি মানব-জীবনের অপর এক বৃত্তির প্রতিনিধি বলা যায়। তিনি পিতৃসত্য পালনের জন্য চতুর্দশ বৎসর বনবাস ক্লেশ সহ্য করতেও প্রস্তুত ছিলেন, এবং প্রায়মের মতো পাপাচারী রাজা রাবণের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাকে বধ করেছেন। তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপারে তিনি ম্যাকিয়াভ্যালীর সেই নিন্দিত নীতি- The end justifies the means লক্ষ্যের যথার্থ দ্বারাই মাধ্যম গ্রহণের সার্থকতা স্বীকৃতি লাভ করে’- গ্রহণ করেছেন। এ নীতির আলোকে রাম ভ্রাতৃ-যুদ্ধে লিপ্ত বালিকে বধ করেছেন। ভ্রাতৃ-বিরোধ বিচ্ছিন্ন বিভীষণের সাহায্য গ্রহণ করেছেন। তেমনি গণ-মানসের সন্তোষের জন্য পতিব্রতা সীতাকেও ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। এজন্য তাকে মানব-জীবনের একটা টাইপ বা প্রতীক বলা যায়। শেকসপীয়রের অংকিত চরিত্রগুলোতে সেরূপ প্রতীকী চরিত্র রয়েছে। হ্যামলেট নাটকের নায়ক রাজকুমার হ্যামলেট আপনার চাচা কর্তৃক নিহত পিতার সংস্রবে আসার কোনো সুবিধা পাননি। পিতৃহন্তা ও বিপিতা চাচার আশ্রয়ে প্রতিপালিত এ কুমার একাধারে প্রেমিক ও দার্শনিক। ছেলে-বেলা থেকেই সন্দেহের বীজ তার মানসে ক্রিয়াশীল। তাই মানব-জীবনের সবগুলো উত্থান পতনকে তিনি যেমন আপাতদৃষ্ট রূপে গ্রহণ করতে পারেননি, তেমনি এ বিশ্বচরাচরের রূপকে তার প্রকৃত রূপ বলে গ্রহণ করতেও তিনি সম্মত হননি। শেকসপিয়রের অপরাপর নাটকগুলোতে তেমনি মানব চরিত্রের এক একটা বিশিষ্ট প্রতীক বিশেষভাবেই ফুটে উঠেছে। অদম্য সাহসের অধিকারী অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষার দ্বারা সকল সময়ই পরিচালিত ম্যাকবেথ তেমনি মানব-মানসের এক অতি উজ্জ্বল প্রতীক। আরব্য উপন্যাসের নায়ক নায়িকারাও তেমনি মানব-জীবনের এক একটা বৃত্তি বা প্রবৃত্তির প্রতীক। অত্যাচারী তথাকথিত খলিফা হারুন-আল্-রশীদের শাসনকালে রচিত এ গ্রন্থখানাতে যে সব চরিত্র বর্ণনা করা হয়েছে, তারা সকলেই-প্রতীকী জীবনের পুরুষ ও নারী। সিন্দাবাদ নাবিকের জীবনে যেমন ধন-লিপ্সার বাসনা প্রকাশ পেয়েছে, এবং তা লাভ করার জন্য তিনি সাত সাগরে পাড়ি জমাচ্ছেন, তেমনি সে ধনকে অতি সহজে লাভ করার প্রতীক হিশাবে দেখা দিয়েছে- আলীবাবা। অর্থাৎ তাঁর প্রত্যেকটি চরিত্রই সে ধর্ম পালন করছে।

 

আধুনিককালে যারা বিশ্বের ক্লাসিক হিসাবে গণ্য হয়েছেন, তাদের মধ্যেও এক প্রতীক চিত্রণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। মহাকবি গ্যেটে তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য ফাউস্টের মধ্যে একদিকে ফাউস্ট অপরদিকে মেফিস্টোফেলিসের চিত্র অংকিত করে মানব-জীবনের সে আদর্শিক দ্বন্দ্বের সত্যই প্রচার করেছেন। ফাউস্টের জীবনে অবিরাম সে মেফিস্টোফেলিসের সঙ্গে সংগ্রামে পর্যবসিত হয়েছে।

লেভ তলস্তয়ের উপন্যাসগুলোতে তেমনি কতকগুলো প্রতীকী চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর “আনা কারেনিনা” এক হতভাগ্য মহিলার জীবনের করুণ কাহিনী। তিনি তাঁর এক প্রেমিকের দ্বারা প্রলুব্ধা হয়ে গর্ভবতী হয়েছেন- অথচ সে অবস্থায়ও তাঁর উদার হৃদয় স্বামীকে তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত। তবে সামাজিক জীবনে তাঁর স্থান অবশ্যিই অত্যন্ত নীচ পর্যায়ে, ‘অধঃগ্রামী’ হবে বলে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। “রেজারেকশন” নামক উপন্যাসে মহামতি তলস্তয় তাঁর নায়িকার ক্যটুলা ম্যাসলভাকে অতিশয় পতিত জীবনের মধ্যেও মানবতার এক প্রতীক হিশাবে চিত্রিত করেছেন। মানবতার এ অভূতপূর্ব প্রতীক ম্যাসলভা তাঁর এক অনন্য সৃষ্টি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যেই সে প্রতীকী ধর্মের রয়েছে অভিব্যক্তি। সেখানে ব্যক্তি-জীবনের যেমন প্রতিক্রিয়ার ফল রয়েছে তেমনি সমষ্টি জীবনেরও প্রতিক্রিয়ার ফল সন্নিবেশিত হয়েছে। জীবনে বিশ্ব-চরাচরের নানাবিধ বিষয়ের ক্রিয়াকলাপের যে প্রতিক্রিয়া তাঁর জীবনে দেখা দিয়েছে তার অভিব্যক্তি, রয়েছে- তাঁর বিভিন্ন রচনায়। এ রচনার প্রেক্ষাপটে যে-সৃষ্টিশীল প্রতিজ্ঞা কার্যকরী তিনি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ নন, তিনি বিশ্ব-মানবের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ। “গীতাঞ্জলী”, “নীতিমাল্য” প্রভৃতি পর্যায়ে তিনি বিশ্ব-মানব-জীবনকে সমর্পণ করতে চেয়েছেন পরম মঙ্গলময় এবং পরম সুন্দর এক অতীন্দ্রিয় সত্তার নিকট। এ সত্তার নিকট নতি স্বীকার এবং তার সত্তায় ব্যক্তি-জীবনের অহংকার ও স্বাতন্ত্র্যের বিলোপ মানব জীবনে এক আকাঙ্খিত বিষয়। সেরূপ মানব- জীবনের আশা-ভরসা নানা আদর্শিক বিষয়ের কামনা তাঁর বিরাট রচনার মধ্যে বর্তমান। তাঁ রচিত নাটকগুলো যে প্রতীকধর্মী সে সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। “রক্ত-করবী’র প্রধান চরিত্র নন্দিনী মানব-মানসেরই একটা সার্বজনীন আকাঙ্ক্ষার রূপ নিয়ে অপ্রাকৃত জীবনের ধনমদ্রমত্তের বাসনায় অন্ধ সোনার পুরীতে অবস্থিত জাল ছিঁড়ে তাদের প্রকৃতিস্থ করতে চায়। এতে যে বলিষ্ঠ প্রতীক সৃষ্টির বাসনা প্রকাশ পেয়েছে তা বিশ্ব- সাহিত্য অনন্য।

এ প্রতীক যেমন সর্বসাধারণের জীবনের নানাবিধ আশা-আকাঙ্ক্ষার হতে পারে- তেমনি মানব-সমাজের মধ্যে উদ্ভুত নানা শ্রেণী, নানান জাতি, নানা কর্মে লিপ্ত মানুষের হতে পারে। যাঁরা মানব-জীবনকে তাঁদের রচনায় এভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁদের রচনার মধ্যে আবার মূল্যবোধও প্রকাশ পেয়েছে। যদিও ধর্মগুরুদের আদেশ-নির্দেশের মতো তা প্রকাশ পায়নি তবুও মানব-চেতনার নানাবিধ বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রতীকগুলোর মধ্যে কোনটার পক্ষে তাদের সহানুভূতি রয়েছে তা অতিশয় কুশলী তুলির মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। গভীর রাত্রিতে সমুদ্রের পারে আবির্ভূত রাজা ডানকানের প্রতি, না উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ ম্যাকবেথের প্রতি শেকসপিয়রের সহানুভূতি রয়েছে তা অতি সহজেই বুঝতে পারা যায়। ম্যাকবেথের স্বগত উক্তিতে তার জীবনের গভীর তলদেশ থেকে উত্থিত নৈতিক চেতনা তাকে যখন ভীষণভাবে আক্রমণ করে পীড়িত করতে থাকে, তখন তার উক্তিতে শেকসপীয়রের মূল্যবোধেরও পরিচয় স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। এজন্য বিশ্বসাহিত্যে প্রতীকধর্মী রূপের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টিকুশলী সাহিত্যিকেরা কবির যে মূল্যবোধ রয়েছে- তাকে অনস্বীকার্য বলা যায়। মূল্যেরও আবার তারতম্য রয়েছে। এ দুনিয়ার সমাজে মানবতাবাদ ক্রমশই বিকশিত হচ্ছে। কাজেই এককালে যা মানব-জীবনের অবশ্যম্ভাবী রূপে গ্রহণীয় ও সহনীয় ছিলো- বর্তমান কালে তা নেই। অনাগত ভবিষ্যতে আরও উচ্চ- পর্যায়ের মূল্যমান এ দুনিয়ায় অভ্যুত্থিত হ’লে-মানব-জীবনের কার্যকরী নানাবিধ মূল্যমান স্নান হয়ে যেতে পারে। অনাগত যুগের সাহিত্যে তাই ভালো-মন্দের বিচার আজকের দিনের মতোই হবে-তা বলা যায় না। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় মানবতাবাদের বিস্তৃতির ফলে যে পরিবেশে বর্তমান মানব-সমাজ রয়েছে, তা থেকে বিচ্যুত হয়ে সে সমাজের অধঃপতন হবে না, হবে আরোহণ। এজন্য অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে এমন কোনো মূল্যমানের অভ্যুদয় হবে না তার পূর্ববর্তী মূল্যমানকে বিচ্যুত করে মানব-সভ্যতার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করে। মানব-জীবনে এমন সব চিরস্তন বৃত্তি ও প্রবৃত্তি রয়েছে যে- গুলোর সন্তোষ বিধানের জন্য মানুষ চিরকালই চেষ্টা করবে এবং তাদের মধ্যে মানব- জীবনের পক্ষে অনুকূল দলের সঙ্গে প্রতিকূল দলের সংঘর্ষ অনিবার্যভাবে দেখা যাবে।

 

বিশ্ব-সাহিত্যের অপর লক্ষণের মধ্যে পাওয়া যায় স্থান-কাল-জাত-পরিবেশের প্রভাব। হোমারের মহাকাব্যে গ্রীস ও ট্রয়ের যুদ্ধে দেবদেবীগণও যোগদান করেছেন। তেমনি রামায়ণ ও মহাভারতে যেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে-তাতে মানব-বংশ বহির্ভূত বীরগণ অংশগ্রহণ করেছেন। ধর্মের অংশে যুধিষ্ঠিরের এবং পবনের অংশে ভীমের জন্ম হলেও ইন্দের অংশে অর্জুনের জন্য। তেমনি অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের অংশে নকুল ও মহাদেবের জন্ম। এরা সম্পূর্ণভাবে দেব বংশ সম্ভূত না হলেও দেব ও মানবের মধ্যবর্তী অতি-মানবিক বংশ সম্ভূত ছিলেন। রামচন্দ্র সীতা উদ্ধার কল্পে যে-সেনাবাহিনীকে গঠন করেছিলেন- তাতে বানর বংশীয় সৈন্যও যোগদান করেছিলেন। সে-যুগে দেব-দানব ও মানুষে অথবা মানুষ ও পশুতে তেমন পার্থক্য দেখা দেয়নি বলে এরূপ চরিত্র সৃষ্টিতে ব্যাস অথবা বাল্মিকী কোনো দ্বিধাবোধ করেননি।

তাহলে ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে আমরা কতকগুলো লক্ষণ পাচ্ছি। তাতে মানব-মানসের কতকগুলো বৃত্তি ও প্রবৃত্তির প্রতীককে কাব্যের বা নাটকের নায়ক-নায়িকারূপে প্রদর্শন করা হয়েছে। তাতে নানা ব্যবসায় বা কর্মজীবনের পার্থক্য রয়েছে। তাতে যেমন রাজা- মহারাজা রয়েছেন, তেমনি অতিশয় দীন দুঃখী মানুষও রয়েছে। তাতে ব্যক্তি-জীবনের এক বৃত্তির সঙ্গে অপর বৃত্তির যেমন সংগ্রাম রয়েছে, তেমনি এক শ্রেণীর লোকের সঙ্গে অপর শ্রেণীর লোকেরও সংগ্রাম রয়েছে। তাতে পরিবেশের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে এবং তার মধ্যে মূল্যবোধের প্রকাশও রয়েছে।

এ মানদণ্ডের আলোকে নজরুল ইসলামের রচনাকে বিচার করলে তাঁকে বিশ্ব- সাহিত্যিকদের আসনে স্থান দান করা যায় কি না-তা-ই বিশেষভাবে বিচার্য। তবে তার পূর্বে নজরুলের জীবনে যে পরিবেশ কার্যকরী ছিল তাও ভেবে দেখতে হয়। কারণ আমরা পূর্বেই দেখেছি- পরিবেশের ছাপ সকল বিশ্ব-কাব্যেই বর্তমান। নজরুলের জন্ম হয়েছে অত্যন্ত দরিদ্র কিন্তু অভিজাত পরিবারে-পরিবারের মধ্যে তাঁর ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি-চর্চা থাকলেও, দারিদ্র্যের কঠোর নিষ্পেষণে তাঁকে লেটো দলে বা রুটির দোকানের চাকুরি গ্রহণ করতে হয়েছে। যে-সমাজে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন সে-সমাজের মুসলিমের অবস্থাও তখন অত্যন্ত শোচনীয়। বঙ্গদেশবাসী মুসলিম সমাজ তখন ইংরেজ সরকারের অত্যাচারে অত্যন্ত দুরবস্থায় অধঃপতিত হয়ে, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাবে নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমির আলী, মুনশী মেহেরুল্লাহ প্রমুখ নেতাদের দ্বারা পুনর্বার আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তবে জীবনের অধিক সংখ্যক ক্ষেত্রেই তারা অপর সমাজের লোকদের দ্বারা নানাভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। কেবল বঙ্গদেশে নয়, ভারতের সর্বত্রই মুসলিম সমাজের এই একই দশা। গুটিকতক করদ মিত্র রাজ্যের নওয়াব এবং বঙ্গদেশে গুটিকতক জমিদারের সৃষ্টি করে ইংরেজ সরকার বিজিত মুসলিম সমাজকে পদানত করে রেখেছে। কেবল এ উপ-মহাদেশে নয়- সারা বিশ্বেই মুসলিমদের অত্যন্ত হীন অবস্থা। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিরাট ভূখণ্ডের মালিক এবং মক্কা মদীনা তথা জাজিরাত-উল আরবের সংরক্ষণকারী তুর্কির সুলতান বলকান যুদ্ধের পরে হৃতসর্বস্ব। পরবর্তীকালে প্রথম মহাসমরের পরে একেবারে নিঃস্ব।

দেশের সর্বত্রই রয়েছে অনাচার অত্যাচারের প্রবাহ। ধনী কর্তৃক নির্ধনকে শোষণ সামাজিক জীবনে নির্বিবাদে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আশরাফ আতরাফের ভেদ ধর্মের বিধান বলে গৃহীত হয়েছে। হিন্দু অথবা ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সতত বিবাদ বিসংবাদ দেখা দিচ্ছে। কথাকথিত পুরোহিত বা মোল্লা সমাজের লোকেরা এই বিবাদকে ধর্মীয় প্রেরণাজাত বলে প্রচার করছেন। সত্যিকার দেশপ্রেমিক লোকেরা সমাজে কোন স্থান পাচ্ছে না। বাংলা অগ্নিযুগের বিপ্লববাদীদের কঠোর হস্তে দমন করা হচ্ছে। মানবতাবাদের আলোকে তৎকালীন ভারতীয় শিক্ষালয়গুলোতে কোনো শিক্ষাদান করা হচ্ছে না। এরূপ পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে মানুষ মানবিক জীবন যাপন করতে পারে না। তার বিরুদ্ধে একমাত্র বিদ্রোহ ব্যতীত অপর কোনো পন্থা নেই। তাই নজরুল তাঁর কাব্য-জীবনের সূচনায়ই এক প্রচণ্ড বিদ্রোহের গর্জন করেছেন। সে গর্জনের পূর্ণ অভিব্যক্তি ‘বিদ্রোহী’তে দেখা দিয়েছে বটে, তবে তার অভ্যুদয় হয়েছে ‘শাতিল-আরব’, ‘মুহররম’ প্রভৃতি কবিতায়। এ বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে যে আদর্শ রয়েছে বিদ্রোহের গর্জনের মধ্যেও তার আভাস ও ইঙ্গিত রয়েছে এবং পরবর্তীকালে তা “নতুন চাঁদ” প্রভৃতি কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘বিদ্রোহী’ই নজরুল মানস-ভাণ্ডারের চাবিকাঠি। তাতে যে বিভিন্ন চিন্তার স্রোত রয়েছে সে স্রোতগুলো তাঁর পরবর্তী রচনার মধ্যে নিজের স্বকীয় রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

এ পরিদৃশ্যমান বিশ্বভুবনে এবং মানব-জীবনে যত সব বিষয়আশয় রয়েছে এবং তার মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোলাহল রয়েছে তাকে জয় করে তা থেকে উত্তরণ ছিলো ‘বিদ্রোহী’র লক্ষ্য। এজন্য। তাঁর এ রচনার মধ্যে অসংগতি রয়েছে বলে কোনো কোনো সমালোচক মন্তব্য করেছেন। যিনি ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ বিশ্ব বিধাতৃর বিস্ময় রূপে দেখা দিয়েছেন- তিনিই আবার ‘ষোড়শীর হৃদি সরসিজ প্রেম উদ্দাম’ রূপে কিভাবে দেখা দিতে পারেন? অথবা তিনি বিষ্ণু বক্ষ হতে যুগল কন্যা কেন ছিনিয়ে আনবেন? তিনি ‘জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’ই বা ধরবেন কেন? বা ‘অর্ফিয়াসের বাঁশের বাঁশরী’ই হবেন কেন? এ সকল চরিত্রের মধ্যে অধিকাংশ প্রতীক। মানব-মানসে ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ উদ্দাম প্রেমের যে স্থান রয়েছে, তেমনি লক্ষ্মী সরস্বতী নামক যুগল কন্যার অধিকারী বিষ্ণুর প্রতিও হিংসা রয়েছে। তেমনি বিরাট ও বিপুল অগ্নিপাখার অধিকারী জিব্রাইলের প্রতিও রয়েছে। এজন্য তাঁর এসব উক্তিতে অসংগতি দেখা দেয়। এ প্রতিভাসিত জগতের মধ্যে যাতে কোনো অসংগতি বা ভেদাভেদ থাকে না তার জন্যই বিদ্রোহীর এ হুংকার। তবে ‘বিদ্রোহী’তেই নজরুল ইসলামের কার্য জীবনের নানাবিধ সংকেত থাকলেও এখানেই তাঁর কাব্য-জীবনের ইতি হয়নি। ‘বিদ্রোহী’তে প্রকাশিত এক একটা প্রতীক পরবর্তীকালে তাঁর স্বকীয় পরিধির মধ্যে ‘চমৎকার রূপ লাভ করেছে। ‘বিদ্রোহী’তে প্রকৃতি-প্রীতি Paganism- এর যে সুর উঠেছে এবং এ বিশ্বের স্থিতি ও ধ্বংসের মধ্যেও তাঁর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অবকাশ পেয়েছে তার পরিচয় আমরা পাই:

আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা

কভু ধরণীরে করি বরণীয়া কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা

তার একক পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে:

আজ কাশ বনে কে শ্বাস ফেলে যায়

মরা নদীর কূলে

ও তার হলদে আঁচল চলতে জড়ায়

অড়হরের ফুলে।

মানব-মানসে স্বাশ্রয়ী হওয়ার যে-আদিম প্রবৃত্তি রয়েছে এবং যার প্রকাশ ‘বিদ্রোহী’তে জাজ্বল্যমান তারই অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে:

তোমার দত্ত হস্তেরে বাঁধে কার নিপীড়ন চেড়ী

আমার স্বাধীন বিচরণ কার আইনের বেড়ী

ক্ষুধা তৃষ্ণা আছে আছে মোর প্রাণ

আমিও মানুষ আমিও মহান

আমার অধীন এ মোর রসনা এই খাড়া গর্দান

মনের শিকল ছিঁড়েছি পড়েছে হাতের শিকলে টান

এতদিনে ভগবান-

(ফরিয়াদ।)

আত্ম-সংরক্ষণের উপবৃত্তি হচ্ছে আত্ম-প্রতিষ্ঠা। সে আত্ম-প্রতিষ্ঠারই এক রূপ যৌন- বাসনা। এ যৌন-বাসনার প্রকাশ কবির ভাষায় অনুপম রূপ লাভ করেছে:

সখি পাতিসনে শিলাতলে পদ্ম-পাতা

সখি দিসনে গোলাপ ছিটে খাস লো মাথা

যার অন্তরে ক্রন্দন

করে হৃদি মন্থন

তারে হরি চন্দন

কমলী মালা

সখি দিস নে লো, দিস নে লো বড় সে জ্বালা!

আত্ম-প্রতিষ্ঠার উপ-প্রবৃত্তির মধ্যে যুথচারী প্রবৃত্তি অত্যন্ত প্রকটমান। এ প্রকৃতিই মানুষকে অন্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে আত্ম-প্রতিষ্ঠা লাভে উদ্বুদ্ধ করে। নজরুলের ভাষায় এ প্রবৃত্তিরই দান সাম্যবাদের প্রকাশ অনন্য:

গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান

যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীষ্টান।

(সাম্যবাদী।)

ঐতিহ্য-চেতনা থেকেই স্বদেশপ্রেমের সৃষ্টি, সে স্বদেশপ্রেমের মূলমন্ত্র হচ্ছে আপনার দেশ থেকে অপর জাতির শাসন ও শোষণের অবসান। নজরুল স্বদেশপ্রেমের প্রতিনিধি হয়ে বলেছেন:

কান্ডারী তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর

বাঙ্গালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর।

যে ঐতিহ্যচেতনার মধ্যে আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধও রয়েছে:

জুলফিকার, হায়দরী হাঁক আজও হজরত আলীর

শাতিল আরব, শাতিল আরব জিন্দা রেখেছে তোমার তীর

(শাত-ইল-আরব)

তাঁকে প্রায়ই অপবাদ দেওয়া হয়, তাঁর কাব্যে বা জীবনে কোনো দার্শনিক মতবাদ নেই; সে অপবাদের জ্বলন্ত প্রতিবাদ হিসাবে বলা যায়:

আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন

খুঁজি তারে আমি আপনায়

আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি

আমারি তিয়াসী বাসনায়-

——————————

আমারই রচিত কাননে বসিয়া

পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া

যে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া

আপনারই গলে দুলে হায়।

(আপনি-পিয়াসী, ছায়ানট)

আমার সঙ্গে পরমাত্মার একটা মধুর সম্পর্ক সম্বন্ধে তার বর্ণনা বিশ্ব-সাহিত্যে বিরল। পরমাত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন:

আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল আমার দেউল-

আমারই আপন দেহ

আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর

অন্তরে মন্দির সেহ।

(বন-গীতি)

এ দেহেরই মধ্যে যে প্রাণের ঠাকুর নিত্য তার লীলায় মত্ত রয়েছেন-সে সম্বন্ধে কবি নি:সন্দেহে:

এ দেহেরই রঙ মহলায়

খেলিছে লীলা-বিহারী

মিথ্যা মায়া, এ কায়া

কায়ায় হেরি ছায়া তারি।

(গুল-বাগিচা)

এতে স্পষ্টই বোঝা যায় মানব-মানসের এমন কোনো বৃত্তি বা প্রবৃত্তি নেই যার সন্তোষ বিধানের জন্য তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে ত্রুটি করেননি।

এজন্যেই তাঁকে বিশ্ব-সাহিত্যের কবি-সভায় স্থান পাওয়ার যোগ্য বলে দাবী করা যায়। তবে এখানে একটা বিঘ্ন রয়েছে। যাঁরা ক্লাসিক হিসাবে বিশ্ব-সাহিত্যে স্থান পেয়েছেন তাঁদের রচনা নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে- রামায়ণ, মহা-ভারত বা ইলিয়ড ওডিসি সমৃদ্ধভাবে গ্রন্থাকারে দেখা দিয়ে আজও রসগ্রাহী মহলে রস পরিবেশন করছে। তেমনি শেকসপীয়রের নাটকগুলোও এখনও মঞ্চে পরিবেশিত হয়ে মানব-চিত্তে নানা সমস্যার সাড়া জাগাতে সক্ষম হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের রচনাবলীর মধ্যে নাটকগুলো এখনও অভিনীত হচ্ছে। নজরুল ইসলামের রচনাবলীতে বেশির ভাগ রয়েছে কবিতা ও গান। এগুলো পাঠ ব্যতীত অন্যভাবে পরিবেশিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই অল্প। এজন্য তার প্রচার অত্যন্ত সীমিত। তাঁর রচনাকে নাট্যাকারে প্রকাশ করে তার ভাবধারা বিশ্ববাসীর নিকট পেশ করা যায় কিনা- আজকের দিনে এ পরীক্ষা হবে আমাদের কর্তব্য। আমরা দেখতে পেয়েছি জীবনের এমন কোনো স্তর নেই যার সম্বন্ধে তিনি বিশ্বজনের প্রতিনিধি হয়ে সে সম্বন্ধে আলোকপাত করেননি। তাঁর প্রতিটি কবিতায় মানব-জীবনের কোনো- না কোনো বৃত্তির প্রতীকী রূপ দেখতে পাওয়া যায়। যে-অপূর্ব প্রতিভার অধিকারী হয়ে নজরুল এ দুনিয়ায় এসেছিলেন এবং যে প্রতিভার অপূর্ব ছটায় একদা বাংলা তথা ভারতের কাব্য-গগন আলোকিত হয়েছিলো- তার সম্যক বিকাশ হয়নি। নিদারুণ দারিদ্র্য স্বীয় সমাজের হেনস্থা ও অবহেলা তাতে মহাপ্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছে। চল্লিশ বৎসর পার হতে না হতে তিনি মানসিক স্তব্ধতা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। যদি তিনি দীর্ঘায়ু হতেন, তা’হলে তাঁর কাছ থেকে এ বিশ্ব আরও অনেক কিছু আশা করতে পারতো। তবুও যা কিছু তিনি দান করেছেন- তাকে বিশ্ব-সাহিত্যের পর্যায়ে অল্প আয়াসেই উত্তোলন করা যায়।*

 

*অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-কানাইলাল গঙ্গোপাধ্যায়কৃত গ্যোটের তরজমা পুস্তকের ভূমিকা দ্রষ্টব্য।

৩৯৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top