সূচনা
বর্তমান যুগে দুনিয়ার মানুষ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। মানুষের এই সমস্যার কোন সংখ্যা নেই, নেই কোন সীমা পরিসীমা। সমস্যার ব্যাপকতা ও গভীরতা অন্তহীন। সর্বদিকব্যাপী এ সমস্যার আঘাতে মানবতা আজ জর্জরিত, ক্ষত বিক্ষত। এক কথায় বলা চলে, আজকের মানুষের জীবনের আর এক নাম সমস্যা; শুধু সমস্যাই আজকের মানুষের প্রধানতম পরিচয়।
আজকের মানুষের সমস্যা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যেমন প্রচন্ডরূপ ধারণ করেছে তেমনি পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এর আঘাত আজ অত্যন্ত সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মানুষের সমস্যা বিশ্বরূপ লাভ করেছে, বিশ্ব সমস্যায় পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবন-পাত্র সমস্যা-সংঘাতের হলাহলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।
আজকের মানুষের যেমন খাওয়া পরার সমস্যা তেমনি সমস্যা থাকার, শিক্ষা লাভ করার, সমস্যা চিকিৎসার, সমস্যা কথা বলার, কাজ করার ব্যাপারে স্বাধীনতা না থাকার, সমস্যা সামান্যতম মৌলিক মানবীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার। কেননা আজ মানুষ সাধারণভাবে সব মানুষই এসব অনস্বীকার্য অধিকার হতে বঞ্চিত।
মানুষের এ সমস্যা যেমন বাইরের দিক থেকে, তেমনি মানুষের ভিতরকার দিক থেকেও, মানুষের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও। আর এ সমস্যা যেমন নিছক জীব হিসেবে- প্রাণী হিসেবে, আর সব জীব-তথা প্রাণীর মত; তেমনি মানুষ হিসেবে আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বেঁচে থাকার সমস্যাও আজ জটিল।
মানুষের এ সমস্যা সামগ্রিক সর্বাত্মক। বিশেষ কোন দেশের বিশেষ কোন লোক বা সমাজের নয়, এ সমস্যা হচ্ছে সারা পৃথিবীর মানুষের, দেশ জাতি-শ্রেণী বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের।
মানুষের সমস্যাবলী সম্পর্কে এমনি সামগ্রিক দৃষ্টিতেই আমার এ আলোচনা, বিশেষ কোন দেশ বা শ্রেণীর দৃষ্টিতে নয়। মানবীয় সমস্যা সম্পর্কে এ প্রাথমিক ও মোটামুটি ধরনের কথা কয়টি বলার পর কতগুলি মৌলিক ও প্রধান সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করতে প্রবৃত্ত হচ্ছি।
অন্ন–বস্ত্র–বাসস্থান–চিকিৎসা ও শিক্ষা সমস্যা
খাদ্য ও বস্ত্র মানুষের জীবন রক্ষার জন্যে অপরিহার্য। খাদ্য না হলে যেমন মানুষের জীবন বাঁচেনা, তেমনি মৌসুম উপযোগী বস্ত্র ও পোশাকের ব্যবস্থা না হলে মানুষের কষ্টের অবধি থাকে না। আর লজ্জা ঢাকবার জন্যই প্রয়োজনীয় বস্ত্র না হলে মানুষ পারে না মানুষের মতো মনুষ্যত্বের মর্যাদা রক্ষা করে বাঁচতে।
কিন্তু বর্তমানে দুনিয়ায় এমন অসংখ্য মানুষ রয়েছে, যারা দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায়না, না খেয়ে থাকতে বাধ্য হয়। তেমনি এমন অনেক মানুষও রয়েছে যারা মৌসুম উপযোগী পোশাক তো দূরের কথা, লজ্জা নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুটুকুও না পেয়ে উলংগ থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
কিন্তু দুনিয়ায় বাস্তবিকই কি খাওয়া পরার জিনিসের এত অভাব?
প্রথমেই দুনিয়ার খাদ্য সম্পদ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।
বর্তমানে পৃথিবীর খাদ্যোৎপাদনের পরিমাণ পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি। আজ মানুষের সংখ্যা যত না বেড়েছে- সত্যি কথা এই যে, খাদ্যের পরিমাণ বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি।
১৬৫০ সন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই তিন শতাব্দী কাল সময়ে দুনিয়ার জনসংখ্যা চারগুণ বেশি হয়েছে, আর খাদ্যোৎপাদনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও যন্ত্র পাতির আবিষ্কার উদ্ভাবনী হয়েছে শত শত গুণ বেশি।
১৬৫০ সনের দুনিয়া শিল্প ও বিজ্ঞানের দিক দিয়ে ছিল চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত, কিন্তু আজ মানুষ কয়েক মিনিটের মধ্যেই মহাশূন্যে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারছে, মানুষের তৈরি স্পুটনিক গ্রহজগত দখলের পরিকল্পনা করছে।
নিছক অর্থনৈতিক বিচারেও পৃথিবীতে খাদ্যের কোন অভাব হতে পারে না। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জে, ভি., বার্ণেল (MA.FR. ফিজিঙ্কের অধ্যাপক, বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি বিষয়ে বহুসংখ্যক গ্রন্থ প্রণেতা) বলেন:
“দুই বিলিয়ন একর চাষের জমিকে ইংল্যান্ডের প্রথায় চাষ করলে গোটা দুনিয়ার জনমানবের প্রয়োজনেরও অনেক বেশি ফসল ফলাতে পারা যায়। বার্নেল অনুমান করেছেন বর্তমান দুনিয়ায় প্রায় চার বিলিয়ন একর জমিতে চাষ করা হয় এবং এই পরিমাণ জমিতে ফসল ফলে। চার বিলিয়ন মানে চার শত কোটি একর (এক বিলিয়ন=একশত কোটি)। এই পরিমাণ জমি হচ্ছে সমগ্র স্থলভাগের শতকরা ১২ ভাগ মাত্র। অতএব বাকি জমির একটি নিম্নতম অংশও চাষযোগ্য করা হলে এবং তাতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রথা প্রয়োগ করা হলে যে দুনিয়ায় খাদ্যভাব বলতে কোন জিনিসের নাম গন্ধ পর্যন্ত থাকতে পারে না তা বলাই বাহুল্য।
এত হলো ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু বর্তমানের খাদ্যাভাব সমস্যার সমাধান কি করে করা যেতে পারে? প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে দুনিয়ার সত্যিই কি কোনো খাদ্যাভাব রয়েছে? হিসেব করে দেখলে দেখা যাবে, খাদ্যাভাব বলতে কোন জিনিস বর্তমানেও থাকতে পারে না। সি বি ফাস্ট (পলিটিক্যাল জিওগ্রাফী বিশেষজ্ঞ) বলেছেন। বর্তমানে যত পরিমাণ খাদ্য উৎপন্ন হয়, তা থেকেও এখনকার জনসংখ্যার তিন গুণ বেশি লোককে খাওয়ানো চলে।
ফাস্ট-এর একথা নিছক অনুমানভিত্তিক নয়, বাস্তব অবস্থার সতর্ক পর্যালোচনা ও সূক্ষ্ম হিসেব নিকেষের উপর ভিত্তি করেই তিনি একথা বলেছেন। কাজেই একথায় কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না যে, দুনিয়ায় মানুষের প্রকৃত খাদ্যাভাব বলতে কিছুই নেই।
কিন্তু তবু মানুষ-বহু মানুষ, কত মানুষ, তার সংখ্যা নির্ধারণ সম্ভব নয়- আজ না খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। খাদ্য সম্পদের এই বিপুল প্রাচুর্যের পরিপ্রেক্ষিতে মানবতার একাংশের এক বিরাট অংশের না খেয়ে থাকার বাস্তবিকই কোন কারণ রয়েছে। সে কারণ যে কি, তা পৃথিবীর মানব দরদী চিন্তাশীলদেরই বিচার্য।
পৃথিবীতে খাদ্যাভাব নেই, আছে খাদ্যের প্রাচুর্য। এ সত্ত্বেও যে মানুষ উপোস থাকতে বাধ্য হচ্ছে তার মূলে কয়েকটি মৌলিক কারণ রয়েছে। খাদ্য সম্পদের অপচয়, বিনষ্টকরণ এবং প্রয়োজন ভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থার অভাব এ কয়টিই তার মধ্যে প্রধান উল্লেখযোগ্য কারণ।
আমেরিকা প্রতি বছর লাখ লাখ টন খাদ্য নষ্ট করছে মুনাফার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য। ব্রাজিলের ‘ন্যাশনাল কফি কাউন্সিল’ নিয়মিতভাবে উৎপন্ন কফি সমুদ্রে নিক্ষেপ করে থাকে। কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ১৯৩৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তুলোর উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয় এবং উৎপন্ন তুলো নষ্ট করে ফেলার জন্য কৃষকদের জমির পরিমাণ অনুপাতে এক সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৪০-৪২ সনে মূল্য কমে যাওয়ার দরুন মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ভয়ে বিপুল পরিমাণ উৎপন্ন আলু সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। এইভাবে দুনিয়ার মানুষের খাদ্য ও নিত্যব্যবহার্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদীর যে অপচয় করা হয়, নষ্ট করে দেয়া হয়, তার সঠিক হিসেব করা আজও সম্ভব হয়নি। আর মুনাফা কম হওয়ার ভয়ে জরুরি জিনিসের উৎপাদন কমিয়ে দেয়া তো বর্তমানে দুনিয়ায় জাতিসমূহের জাতীয় মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে।
অথচ আল্লাহ তায়ালা এই জমি সৃষ্টি করেছিলেন এই জন্যে যে, যত বেশি সম্ভব ফসল ফলাতে হবে, উৎপন্ন ফসল সকল মানুষের মধ্যে ইনসাফ সহকারে বণ্টন করতে হবে। কোন জমিকে বেকার ফেলে রাখার কোন অধিকার কারো থাকতে পারেনা। জমির উৎপন্ন ফসল নষ্ট করে নিয়ে মানুষকে Essential Commodity থেকে বঞ্চিত করে অস্বাভাবিক মানে মূল্য বৃদ্ধি করে বিপুল মুনাফা করার অধিকারও কারোরই থাকতে পারে না।
কাজেই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, দুনিয়ায় না খাবার অভাব আছে, না পরিধেয় বস্ত্রের অভাব, না বস্ত্র তৈরির উপাদনের কোন অভাব। কিন্তু তবু মানুষ না খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে খাবার কিনতে পারে না বলে, প্রয়োজনীয় বস্ত্র সংগ্রহ করতে পারছেনা তা কিনবার সামর্থ্য নেই বলে। অর্থনীতিবিদ কার্লাইল লিখেছেন: “এক শ্রেণীর লোক চিৎকার করছে তাদের তৈরি বিশ লক্ষ জামা বেকার পড়ে আছে, তার খরিদ্দার কেউ নেই; আর অপর দিকে বিশ লক্ষ লোক চিৎকার করছে তাদের কাছে শরীর ঢাকবার মত বস্ত্র নেই বলে।” অথচ দুনিয়ায় এমন কোন নীতিও গ্রহণ করা হচ্ছে না, এমন ব্যবস্থাও অবলম্বন করা হচ্ছে না, যার অনিবার্য ফলে প্রত্যেকটি মানুষই তার খাদ্য ও বস্ত্র আপনা থেকেই লাভ করতে পারে। দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রও এর দায়িত্ব নিজ থেকে গ্রহণ করছে না।
খাওয়া পরার ব্যাপারে দুনিয়ার মানুষের এই বঞ্চনা যে কত ব্যাপক, তা দুনিয়ার সেরা ধনীদেশ আমেরিকার অবস্থা দেখলেই স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়।
আমেরিকায় সম্প্রতি বেকার লোকের সংখ্যা (রয়টার পরিবেশিত খবর অনুযায়ী) ৪৫ লক্ষ ৪০ হাজারের উর্ধ্বে এবং সেখানে এক বেলা না খেয়ে থাকে এমন লোকের সংখ্যা (প্রেসিডেন্ট কেনেডির ভাষায়) ১ কোটি ৭০ লক্ষ মার্কিন নাগরিক। আর আড়াই কোটি আমেরিকান পুষ্টিকর খাদ্য না পেয়ে অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
অথচ আমেরিকা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ধনী দেশ। দুনিয়ার শতকরা ছ’ভাগ লোক মাত্র আমেরিকায় বাস করে, আর খাদ্য শষ্য সেখানে উৎপন্ন হয় দুনিয়ার তুলনায় শতকরা ২০ ভাগ। দুনিয়ার স্বর্ণপুঁজির শতকরা ৮০ ভাগ ও রৌপ্যপুঁজির শতকরা ৬০ ভাগ আমেরিকার হাতে নিবদ্ধ ।
তা সত্ত্বেও আমেরিকায় যদি অত লোক বেকার হয়ে থাকে, অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে বা না খেয়ে থাকতে বাধ্য হয়, তাহলে দুনিয়ার অন্যন্য দেশে-বিশেষ করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনুগত দেশের লোকদের অবস্থা যে কিরূপ মারাত্মক, তা সহজেই অনুমেয়।
দুনিয়ার মানুষের থাকার সমস্যার কথাও আমরা এরই সঙ্গে দেখে নিতে পারি। আজ অনেক মানুষ ফুটপাতে, গাছের তলায় বা ছাদহীন ঘরে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। জাতিসংঘের সামাজিক কমিটিতে সেক্রেটারি জেনারেলের পেশ করা রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বিশ্বের সাড়ে ১২কোটি থেকে ১৭ কোটি পরিবারের বাসগৃহ নেই। এ অবস্থায় তারা বৃষ্টির পানিতে ভিজে, রৌদ্রের উত্তাপে শুকায়। পুত্র পরিজন নিয়ে এ অবস্থায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটানো যে কত মর্মান্তিক, তা আর কি বলবো। কিন্তু এর কারণ কি? কারণ হচ্ছে শুধু এই যে, তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা নেই বলে জমি কিনতে পারছে না, নিজস্ব জমি নেই বলে নির্মাণ করতে পারছে না নিজের জন্য বসবাসের স্থায়ী কোন ঘর। শুধু তাই নয়, দুনিয়ার অনেক মানুষই পায় না গৃহনির্মানের প্রয়োজনীয় উপাদান ও সামগ্রী।
অথচ না আছে দুনিয়ায় জমি-জায়গার কোন অভাব, না আছে দ্রব্য-সামগ্রী ও উৎপাদনের কোন কমতি। বিভিন্ন দেশে বিভক্ত এই দুনিয়ার কোন কোন অংশে রয়েছে সীমাহীন জনশূন্য এলাকা, আয়তনের তুলনায় লোকসংখ্যা সেখানে কম, যেমন আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ। আবার অনেক দেশে লোকবসতি প্রতি বর্গমাইলে আটশ থেকে দু’হাজার পর্যন্ত। ঘনবসতির এলাকার লোকদের এই জনশূন্য এলাকায় বসবাস করতে দেওয়া হলে দুনিয়ায় শুধু আজই নয়- কোন দিনই বোধ হয় স্থানাভাব ঘটতে পারে না। কিন্তু বিভিন্ন দেশের জাতীয় রাষ্ট্রগুলোই এ পথের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গ্রেট বৃটেনের রয়েল সোসাইটি অব হেলথ এর প্রেসিডেন্ট ও স্বাস্থ্য বিশারদ বলেন: দুনিয়ার জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করার জন্যে লোকদের উচিত পৃথিবী ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য গ্রহলোকে বসবাস করতে চেষ্টা করা। প্রতি বছর দুনিয়ায় এত সংখ্যক লোক বৃদ্ধি পাচ্ছে, যত লোক বর্তমানে রয়েছে বৃটেনে। কাজেই অপরাপর গ্রহজগতে বসবাস শুরু না করলে দুনিয়ার লোকবসতি সমস্যার সমাধান হতে পারে না।
আমাদের মতে অপরাপর গ্রহলোকে বসবাস শুরু করার প্রয়োজন এখনি দেখা দেয়নি। বর্তমান সময় পর্যন্ত এই ভূপৃষ্ঠেই এখনকার জনসংখ্যার তিন গুণ বেশি লোকের বাস হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার পরিধি বর্তমান অপেক্ষা চারগুণ বড়। কিন্তু জনসংখ্যা হচ্ছে এক কোটির কম। এই বিরাট মহাদেশে যদি দুনিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে লোক সরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়, তবে সেখানেই একশত কোটি লোক বাস করতে পারে। কানাডা ও আমেরিকার আয়তনও বিপুল ও বিশাল, সেখানেও ঘন বসতির এলাকা থেকে লোক সরিয়ে নেয়া যেতে পারে। সউদী আরবের আয়তন ভারতের এক চতুর্থাংশ মাত্র, আর জনসংখ্যা নব্বই লাখের বেশি নয়। সেখানে যদি ঘনবসতির মুসলিম এলাকা থেকে লোক সরিয়ে নিয়ে বাস করতে দেয়া হয়, আর সেজন্যে বার্ষিক কোটা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, তবে সেখানেই বিশ কোটি মানুষ খুব সহজেই বাস করতে পারে। আফ্রিকার বিরাট ভূখন্ড প্রায় শূন্য পড়ে আছে, একে বসবাসের উপযুক্ত করে তোলা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত স্থানাভাব থাকবে না ।
শিক্ষা মানুষের বুনিয়াদী প্রয়োজনের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাই মানুষকে অপরাপর জীব থেকে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দান করে, মানুষ লাভ করে মনুষ্যত্ব। এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকলে মানুষ পশুত্বের স্তর থেকে উর্ধ্বে উন্নীত হতে পারে না।
কিন্তু এই অপরিহার্য শিক্ষা থেকে দুনিয়ার অধিকাংশ লোকই আজ বঞ্চিত। অথচ দুনিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় নেই এমন কথা নয়। তবুও সাধারণভাবে দুনিয়ার মানুষ যে তার মৌলিক প্রয়োজনীয় শিক্ষা পাচ্ছেনা এতেও কোন সন্দেহ নেই। কেননা দুনিয়ার অধিকাংশ লোকই শিক্ষা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সম্বল থেকে বঞ্চিত। তাছাড়া এমন অনেক দেশও রয়েছে যেখানে বিশেষ পলিসি করে সাধারণ মানুষকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে, আর সৃষ্টি করা হচ্ছে একশ্রেণীর জর্জ বড়লোক। ফলে বলা যেতে পারে যে, শিক্ষা দুনিয়ায় এখনো কেবল মাত্র বড়লোকদেরই ভাগ্যলিপি, আর গরীব জনসাধারণ এক্ষেত্রেও অন্যান্য হাজারো ক্ষেত্রের মত চির অবহেলিত।
এ সম্পর্কে আর একটি কথা। দুনিয়ার মানুষ শিক্ষা আদৌ পাচ্ছেনা। একথাও অবশ্য নয়। হয়ত দুনিয়ার শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকদের সংখ্যা গুণেও শেষ করা যাবে না। কিন্তু যে শিক্ষা তারা পাচ্ছে, তা আর যাই হোক, মানুষকে ‘মানুষ’ করে না, মনুষ্যত্ব শিখায় না, মানুষ হিসাবে জীবন, যাপন করা-বসবাস করার শিক্ষা দেয় না। বর্তমানে যে শিক্ষা মানুষকে দেয়া হচ্ছে, তা মানুষকে পাখী বা জন্তু জানোয়ারের জীবন যাপন করার পদ্ধতি শিক্ষা দেয়। বর্তমানের শিক্ষা মানুষকে পাখীর মতো শূন্য লোকে উড়বার, সমাজ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিংস্র জন্তুর মত বিচরণ করার এবং অতল সমুদ্রে কুমির হাঙরের মত সাঁতার কাটার কৌশল শিখায়, এ ব্যাপারে দক্ষতার সৃষ্টি করে- এসবই ঠিক, কিন্তু তা মানুষ সুলভ গুণপনা ও জ্ঞান বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে জাগায় না।
রোগে-অসুখে চিকিৎসা লাভের অধিকার মানুষের সাধারণ অধিকার। কিন্তু দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও সমাজে সর্বসাধারণের এই অধিকার সাধারণভাবে স্বীকৃত হলেও কার্যত তাদের সে অধিকার দেয়া হয় না।
প্রায় দেশেই দেখা যায়, চিকিৎসা লাভের সুষ্ঠু ও উচ্চতম সুযোগ-সুবিধে কেবল বড় লোকেরাই পেয়ে থাকে। যাদের টাকা আছে তারা যেমন নিজস্বভাবে অর্থ খরচ করে চিকিৎসা লাভ করতে পারে তেমনি সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগও অবাধে ও পূর্ণমাত্রায়ই গ্রহণ করতে পারে তারাই। কিন্তু যাদের অর্থ নেই, তারা যেমন নিজস্বভাবে ডাক্তারের ডিজিট ও ঔষধের মূল্য আদায় করতে সমর্থ হয় না, তেমনি সরকারি ব্যবস্থাপনার সুবিধেটুকুও তারা ভোগ করবার সুযোগ পাচ্ছে না। এর মূলে সরকারি নীতির ভুলই একমাত্র কারণ নয়, চিকিৎসকদের এবং ঔষধ ব্যবসায়ীদের মহানুভবতা, মানবপ্রীতি ও জনসেবা সুলভ মনোবৃত্তির অভাব এবং তাদের অপরিসীম অর্থলোলুপতাও এক্ষেত্রে প্রচণ্ডভাবে কাজ করে, তাতে সন্দেহ নেই।
বস্তুতঃ বিশ্বমানবের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে মানুষের এই মর্মান্তিক অবস্থা মানুষের পরস্পরে এই অমানুষিক তারতম্যই আজ এক বিরাট ও মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষের এ সংকট এ সমস্যার আলোচনা বিশ্বপর্যায়ে অনুষ্ঠিত হলেও এর সমাধানের কোন কার্যকরী পন্থা গ্রহণ আজও সম্ভব হয়নি, মানুষের জীবনকে এ সংকট থেকে মুক্ত করা আজও এক সুখস্বপ্নেই পরিণত হয়ে রয়েছে।
পারিবারিক জীবনের সমস্যা
পারিবারিক জীবন মানব জীবনের এক প্রাথমিক ও ভিত্তিমূলক দিক, বিক্ষুব্ধ জীবন-সমুদ্রে পরিবার হচ্ছে নোঙর বিশেষ, শ্রান্ত-ক্লান্ত দূরপথের যাত্রীর জন্য এ হচ্ছে পান্থশালা।
পারিবারিক জীবনের মূলকথা হচ্ছে শান্তি, স্থিতি, গভীর বিশ্বাস ও ঐকান্তিক নির্ভরতা। যে পরিবারে এ ভাবধারা যথাযথভাবে বর্তমান, সে পরিবার মানুষের জীবনে বয়ে আনে অফুরন্ত কল্যাণের প্রস্রবণ। আর যেখানে তা নেই, সে পরিবার জাহান্নামের শামিল, জ্বালা-যন্ত্রণার তুষানল ।
বর্তমান সময় বিশ্ব মানবের পারিবারিক জীবন সাধারণ বিচারে দেখা যায় অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে। পরিবার থেকে বিদায় নিয়েছে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা, শান্তি ও নির্ভরতা। তার প্রতি রক্ত কণিকায় মিলেমিশে গেছে পুঞ্জ পুঞ্জ অবিশ্বাসের বিষ। আর তা সংক্রমিত হয়ে জর্জরিত করে তুলেছে পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে, স্বামী, স্ত্রী, সন্তান এবং পিতা ও মাতাকে। এক কথায় আজকের মানুষের পরিবার এক চরম ভাঙন ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেই সূচনা হয় একটি পরিবারের কিন্তু আজ সে সম্পর্ক শিথিল হয়েছে। আজ স্বামীর বিশ্বাস নেই স্ত্রীর প্রতি, স্ত্রীর কোন আস্থা-বিশ্বাস নেই স্বামীর উপর। উভয় উভয়কে সন্দেহের চোখে দেখতে বাধ্য হচ্ছে। হচ্ছে এই জন্যে যে, স্বামী নিজ স্ত্রীর অজ্ঞাতসারে কিংবা তার চোখের সম্মুখেই পরস্ত্রীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে, কাঁধ ও নিতম্বের উপর হাত রেখে নাচছে, রাত কাটাচ্ছে ভিন্ন মেয়েলোকদের সাথে। মিটিং করছে, ভ্রমণ করছে, পার্টিতে যাচ্ছে। স্ত্রীও আজ স্বাধীনা, স্বেচ্ছাচারিণী। ভিন পুরুষের সাথে বন্ধুতা পাতাচ্ছে, প্রীতি করছে, সান্ধ্যবিহারে যাচ্ছে, নাচের আসরে মিলিত হচ্ছে, নাচছে পরের হাতে হাত দিয়ে, বুকে বুক দিয়ে। অভিনয়ে ভিন্ন পুরুষের প্রেমিকা সাজছে, স্ত্রীর ভূমিকা অবলম্বন করছে। এরূপ অবস্থায় না স্ত্রী নিজকে স্বামীর নিকট অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে সপে দিতে পারে, না স্বামী এরূপ স্ত্রীকে একান্ত আপনার বলে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারে। অথচ দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য এর ভিতরেই নিহিত। পারিবারিক সংস্থার স্থিতি এরই উপর নির্ভরশীল।
ফ্রান্সের একটি ঘটনার কথা সংবাদপত্রে পড়েছিলাম। স্বামী সারা রাত নাইট ক্লাবে কাটিয়ে ঘরে ফিরে দেখতে পায় তারই স্ত্রী অপর এক অপরিচিত পুরুষের কণ্ঠলগ্ন হয়ে শুয়ে আছে।
এরূপ অবস্থায় কোন স্বামীই মাথা ঠিক রাখতে পারে না, তা বলাই স্বামী স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে তোমার কাছে এ কে শুয়ে আছে?
স্ত্রী কিন্তু এ প্রশ্নের জওয়াব দেয়ার কোন দায়িত্বই বোধ করে না, না পায় কোন ভয়। সে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে সারারাত কোথায় কাটিয়েছে?
এ কেবল একটি পরিবারেরই ব্যাপার নয়, পশ্চিমা দেশ ও পাশ্চাত্য সভ্যতায় প্রভাবান্বিত দুনিয়ার প্রায় সব পরিবারেরই এই ছবি। স্বামী নিজ বিবাহিতা স্ত্রীর ধার ধারে না, স্ত্রী পরোয়া করে না স্বামীর। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ইচ্ছা মত বিপরীত লিংগের বন্ধু জোগাড় করে নেয়, আর বিচরণ করে বেড়ায় যত্রতত্র। এর ফলে সমাজে জারজ সন্তানের জন্ম হচ্ছে গণ্ডায় গণ্ডায়। আমেরিকাতেই এসোসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার রিপোর্ট মতে, প্রতি বৎসর জারজ সন্তানের জন্ম হয় দু’লাখেরও বেশি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী শিশু সদন ব্যুরোর প্রধান মিসেস ক্যাথারিন বি, ও টিপার এর বিবৃতি অনুযায়ী বর্তমানে তাদের সংখ্যা ১,৪১,৬০০ হতে ২,০৮,৭০০ এর কোঠায় উন্নীত হয়েছে।
মানব শিশুর লালন পালন ও শিক্ষাদীক্ষা দানের দৃষ্টিতেও পারিবারিক জীবনের স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। এক কথায় পিতামাতার গভীর অকৃত্রিম স্নেহ মমতা দরদপূর্ণ লালনপালন ব্যতীত মানব শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ, উৎকর্ষ সাধন ও অগ্রগতি বিধান সুষ্ঠুরূপে আদৌ সম্পন্ন হতে পারে না। কিন্তু আজকের মানব শিশু পিতা-মাতার এ লালন-পালন থেকে বঞ্চিত। মা মার্কেট করছে, মিটিং ও পার্টিতে শরীক হচ্ছে, সিনেমা থিয়েটার বিচিত্রানুষ্ঠানে নাচে অংশ গ্রহণ করে বেড়াচ্ছে, নাইট ক্লাবে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে, কোন কোন মা আবার দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর শিশু সন্তানের লালন পালন ও দেখাশোনা সর্বতোভাবে সোপর্দ করে দিয়েছে ধাত্রীর উপর, দাসীর উপর। মা অফিসে বা কারখানায় কাজ করছে, আর শিশু-সন্তান বাড়িতে পড়ে থেকে ক্যাঁ ক্যাঁ করছে, কিংবা চাকর বাকর তার দেখা শোনা করছে। অথবা কিন্ডারগার্টেনে আর কোন কোন দেশে জাতীয় শিশু তহবিলে জমা করে দেয়া হচ্ছে।
এর ফলে যে আগামী মানব সমাজ গড়ে উঠছে, তাদের যেমন ব্যক্তিত্ব গঠন হচ্ছে না, তেমনি মজবুত হতে পারছে না তাদের নৈতিক মেরুদণ্ড। সব হতচ্ছাড়া ভ্যাগাবন্ড, লম্পট বদমায়েশ বা শয়তান প্রকৃতির মানুষ তৈরি হচ্ছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে ভবিষ্যৎ বংশধর কিরূপে গড়ে উঠছে, তা সঠিকরূপে আন্দাজ করার জন্যে নিম্নে একটি সাম্প্রতিক খবরের দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি,
“হটিংটন: গত শুক্রবার রুবালকরেজ কলেজের ১৬ বৎসর বয়স্কা ছাত্রী শরেনডান একটি দোনালা বন্দুক দিয়ে তাহার পিতা সিভটরডান এবং মাতা রোজকে হত্যা করে। ইহার ফলে নিজে এবং তাহার ১২ হইতে ২০ বৎসর পর্যন্ত বয়সের ৬ জন ভাইবোন এতিম হইয়া পড়ে।
এই হত্যাকাণ্ডের কারণ স্বরূপ উল্লেখ করা হইয়াছে যে, ছাত্রীটির পিতামাতা তাহাকে তাহার প্রেমিকের সঙ্গে সঙ্গদানের অবকাশ দিতে আপত্তি করে ও ছোট ভাই বোনদের দেখাশোনা করতে বলে। (দৈনিক আজাদ, ২২শে মে ৬১)”
দাম্পত্য জীবনের বন্ধন আজ শুধু শিথিলই হচ্ছে না, স্বামী স্ত্রীর উভয়ই একে অপরের নিকট অসহ্য হয়ে উঠছে। একজন অপর জনের কাছ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করছে। স্বামী হয়তো স্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ব্যভিচার বা পরপুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্কের মিথ্যে অভিযোগ তুলছে, আবার কোথায়ও স্ত্রী তুলছে স্বামীর বিরুদ্ধে এই জঘন্য অভিযোগ। আর এ উপায়েই একজন অপর জনের কাছ থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছে।
এরই ফলে তালাকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এক আমেরিকাতেই প্রতি তিনটি বিয়ের একটি অবশ্যই তালাকে পরিণত হচ্ছে। আর যেখানে সহজ উপায়ে তালাক লাভ সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে একজন অপরজনকে নিজ হাতে কিংবা অপর লোকের সাহায্যে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করছে না।
আজকাল এমন ঘটনাও ব্যাপকভাবে ঘটছে যে বয়স্কা মেয়ে কোন পুরুষ বন্ধুর সাথে পালিয়ে যাচ্ছে এবং কোথায়ও বা বিবাহিত হয়ে একত্রে থাকতে শুরু করছে, আর কোথাও বিবাহ ব্যতিরেকেই একত্রে থাকছে, সন্তান জন্মাচ্ছে। এমনও দেখা যায়, বাড়িতে কাউকে Paying guest রাখা হয়েছে- সে সুযোগে আপনার স্ত্রীর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হচ্ছে আর সে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মোটামুটিভাবে এই অবস্থাই চলছে দুনিয়ার প্রায় সব বড় বড় সভ্য দেশে। মুসলিম জাহানেও পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাব পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক জীবনে এমনি ভাঙ্গন ও বিপর্যয় দেখা দিতে শুরু করেছে, সে দেশে ঠিক যেসব অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বিগত একশ দেড়শ বছরের ইতিহাসে, মুসলিম জাহানে আজ সেগুলোই দেখা দেওয়া সবে মাত্র শুরু হয়েছে।
কোন কোন দেশে সরকারি নির্দেশ বলে পারিবারিক সংস্থা ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে ‘কমিউন’ প্রথার প্রচলন করা হয়েছে। কমিউনগুলো হচ্ছে ঠিক গুরু-মেষ, ছাগল প্রকৃতি গৃহপালিত পশুর হাধালের মত, একই স্থানে খাওয়া-থাকা মুতা-শোয়া’ সব চলছে। মানুষ সেখানে সর্বতোভাবে পশুর স্তরে নেমে গেছে। কিন্তু মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়া মানবীয় সমস্যার সমাধান নয়। মানুষের জীবনে তাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এমন আরো অসংখ্য সমস্যা যার কোন সমাধানই খুঁজে পাওয়া যায় না।
সামাজিক সমস্যা
বর্তমানে মানুষের সামাজিক জীবন অসংখ্য জটিলতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, সামাজিক জীবনে দেখা দিয়েছে নানাবিধ সমস্যা। মানুষ স্বভাবতঃই সামাজিক জীব হওয়া সত্ত্বেও এই সমাজ ও সামাজিক ক্ষেত্রই আজ মানুষের পক্ষে দুঃসহ হয়ে উঠেছে। এমন সব অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যার কারণে মানুষ আর সঠিকভাবে সামাজিক জীবন যাপন করতে পারছে না, সামাজিক জীবনের মর্যাদা, শান্তি ও সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক জীবনে স্বাভাবিক শান্তি মর্যাদা ও কল্যাণ লাভের জন্য সর্বপ্রথম বুনিয়াদী জিনিস হচ্ছে মানুষের ঐক্য- মানুষের একত্ব, সমাজের সকল মানুষ যে এক অবিভাজ্য, বংশ, বর্ণ, ভাষা, অর্থ, ভৌগলিক, আঞ্চলিকতা ও মর্যাদার নিক দিয়ে তাদের মধ্যে যে থাকতে পারে না কোন বিভেদ ও বৈষম্য, একথা আজ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। বরং আজকের মানুষ এসব দিক দিয়েই যেমন খণ্ড বিখণ্ড, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, তেমনি বিভেদ বৈষম্যের অসংখ্য প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের মধ্যে। ফলে মানুষের মধ্যে যেমন নেই ঐক্য, তেমনি নেই সকল মানুষকে এক ভাবা, সমান মনে করার ভাবধারা।
প্রথমে বংশভিত্তিক বিভেদের কথাই বলা যাক। বংশীয় আভিজাত্যবোধ অতীত কালের মত বর্তমানেও প্রচণ্ড আকার ধরণ করেছে। ছোট পর্যায়ে দেখা যায়, সৈয়দ, মোগল, পাঠান ইত্যাদি বংশের লোক অন্যান্য বংশোদ্ভূত লোকদের ঘৃণার চোখে দেখে থাকে, হীন ও নীচ মনে করে। এদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যেমন তারা রাজি হয় না, একত্রে উঠা বসা ও খাওয়া দাওয়া করতেও প্রস্তুত হয় না। মনে করা হয়, “আমরা উচ্চ ও শরীফ বংশের লোক, আর ওরা নীচ ও নগণ্য বংশ সম্বত।” এ বিভেদ সাধারণ স্তরের লোকের মধ্যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
বিরাট পর্যায়ে দেখা যায়, জাপানের বৌদ্ধধর্মবিশ্বাসী লোকেরা সেখানকার সম্রাটকে সূর্যদেবতার সন্তান- জনগণের বংশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বংশোদ্ভূত বলে বিশ্বাস করে, তাই তাকে কেবল আইনগত শাসক বলেই মনে করে না, দেবতার বংশধর- দেবতারূপে পূজাও করে। সম্রাটের প্রতি জনগণের এই ধারণা ও আচরণ কেবলমাত্র এজন্যেই সম্ভব হচ্ছে যে, তাদের বংশে ও সম্রাটের বংশে আসমান জমিনের পার্থক্য রয়েছে, তারা হীন ও নীচ বংশের লোক, আর সম্রাট হচ্ছেন উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ বংশোদ্ভূত। অথচ এ যে কত বড় মিথ্যে তা তাদের মনে কখনো জাগছেনা। ফলে তারা সম্রাটের মতই মানুষ, মানব বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও তারই অন্ধ পূজা ও দাসত্ব করে যাচ্ছে।
জার্মানীতে এই আভিজাত্যবোধের প্রাবল্য শেষ পর্যন্ত বিশ্ববাসীর পক্ষেই মারাত্মক আকার ধারণ করে। হিটলার এই বোধকে উত্তেজিত করে তোলে। তাদের মনে ব্যাপক ও প্রবলভাবে এই ধারণা জাগিয়ে দেয় যে, “আমরা আর্য বংশোদ্ভূত দুনিয়ার সকল মানুষের অপেক্ষা বংশের দিক দিয়ে উঁচু ও অভিজাত, অতএব দুনিয়াবাসীদের উপর প্রভুত্ব করার, শাসন চালাবার একমাত্র অধিকার আমাদেরই।” দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সৃষ্টির মূলে বৈষয়িক ও রাজনৈতিক কারণ আর যতকিছুই থাক না কেন, সেই সঙ্গে জার্মানীর জনগণের এই বংশীয় আভিজাত্যবোধও তীব্রভাবে বর্তমান, এতে কোন সন্দেহ নেই।
আর বর্ণবিদ্বেষ, এই বংশ বিদ্বেষের মাত্রাকে অতিক্রম করে গেছে। বর্তমানে দুনিয়ার কালো চামড়ার লোকেরা সর্বত্র ঘৃণিত, মানবীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িত। পক্ষান্তরে, শ্বেতাঙ্গদের এই বর্ণভিত্তিক আত্মগৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ কালোদের জীবনে নামিয়ে এনেছে হতভাগ্যের অমানিশা। আমেরিকায় এই বর্ণবিদ্বেষ ও বর্ণভিত্তিক ভেদাভেদের দরুন শতাব্দীকাল ধরে যে অমানুষিক নিপীড়ন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিগ্রোদের উপর, তার ইতিহাস নিঃসন্দেহে যেমন দীর্ঘ তেমনি মর্মবিদারক। সেখানে নিগ্রোদের সত্যিকারভাবে অধিকার নেই শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে একসাথে বসবাস করার, একই শিক্ষাই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করার, একই ট্রামে, বাসে, ট্রেনে ভ্রমণ করার, একই কাউন্সিলে সমান মর্যাদার সদস্য হিসেবে আসন গ্রহণ করার। এমনকি আদালতের বিচারের ক্ষেত্রেও তারা শ্বেতাঙ্গদের সমান সুবিচার লাভের অধিকারী নয়। একই ধরনের অপরাধের দন্ড শ্বেতাঙ্গদের বেলায় যা নিগ্রোদের বেলায় তা অবশ্যই তার একশ গুণ বেশি মরাত্মক হবে। আমেরিকার বাস্তব ঘটনাই এসব কথা প্রমাণ করছে। সেখানে কোন শ্বেতাংগ যদি কোন নিম্নো মহিলাকে ধর্ষণ করে, তাহলে আদালতে তার শাস্তি বড়জোর সামান্য কিছু জরিমানা অথবা দু’চারটি বেত্রাঘাত; কিন্তু কোনো নিগ্রো যদি শ্বেতাংগ মহিলার দেহ স্পর্শ মাত্র করে, তবে তার শাস্তি নির্ঘাৎ মৃত্যুদণ্ড এবং সত্য কথা এই যে, নিছক বর্ণবিভেদ ছাড়া এর মূলে অপর কোন কারণই নিহিত নেই।
কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের এই বিদ্বেষ, এই নিপীড়ন কেবল আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়, আধুনিক দুনিয়ার সবচেয়ে সুসভ্য বলে কথিত ইংরেজও এ ব্যাপারে কিছুমাত্র কম বলা যায় না। এই সেদিন মাত্র ইংল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডেই ওয়েন্ট ইন্ডিজদের বিরুদ্ধে এ বিদ্বেষ বাষ্পের প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়েছিল। আফ্রিকার মাউ মাউ অভ্যুত্থানের মূলে রাজনৈতিক কারণ ছাড়া এই বর্ণবাদগত কারণও কম কাজ করেনি।
ভাষা বিদ্বেষও দেখা যায় মাঝে মাঝে। কোথাও এক ভাষাভাষী লোক অপর ভাষাভাষীকে পছন্দ করতে পারছে না, নিজের ভাই বলে গ্রহণ করতে পারছে না। এর ফলে মাঝে মাঝে সুস্থ পরিবেশ ও শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবনেও অতি আকস্মিকভাবে নেমে আসে মৃত্যুর যবনিকা। প্রচীনকালে অন্যান্য ভাষাভাষীদের ঘৃণা করত ভাষার কারণে, মনে করত: তারা সব ‘আজম’-গোংগা-বোবা; সেখানে আজ আরবী ভাষার ভিত্তিতেই দুনিয়ার সাধারণ মুসলিমদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র এক জাতীয়তা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতে বাঙ্গালী অবাঙ্গালীদের মধ্যে এই ভাষাগত বিভেদ দেখা দিয়েছিল। ১৯৫৪ সনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৭ বৎসর পরে- পুর্ব পাকিস্তানের আদমজী জুটমিলে যে মারাত্মক ধরনের দাঙ্গা হয়েছিল তার মূলে অন্যান্য যত কারণই থাকনা কেন, বাঙ্গালী অবাঙ্গালী বিদ্বেষও ছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ। ভারতের আসাম প্রদেশে অসমীয়াভাষী ও বাংলাভাষীদের মধ্যে প্রবল বিদ্বেষ বিস্ফোরিত হয়েছে। ফলে বহু বাংলাভাষীকে প্রাণ দিতে হয়েছে, আর বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী অসমীয় নিজেদের শতাব্দীকালীন আবাসভূমি ত্যাগ করে বাংলা ভাষার কেন্দ্রে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। এখনো তার জের চলছে পুরাদমে।
সামাজিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্যে ব্যক্তিদের পারস্পরিক ক্ষেত্রে গভীর ঐক্য, মিল-মিশ ও ঐকান্তিকতার প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তিগত ও দলগত স্বার্থের সংঘাতে সামাজিক শৃংখলা ও শান্তি আজ বিনষ্ট প্রায় । সামাজিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য, মাতৃকারী বা সরদারী লাভের জন্য বহু মানুষ সমাজের এক শ্রেণীর লোকদের নিয়ে দল পাকায়, সমাজে দলাদলির সৃষ্টি করে। দলভারী করার বিভেদ ও হিংসাদ্বেষের সৃষ্টি করে। এজন্যে খুনখারাবী চালাতেও দ্বিধাবোধ করে না। ফলে সামাজিক শান্তি, শৃখংলা ও মানুষের নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে।
অর্থসম্পদ ও ধনদৌলত কমবেশি হওয়ার কারণে মানব সমাজে আজ দেখা দিয়েছে মারাত্মক শ্রেণী বিভেদ, মালিক ও মজুরে দেখা দিয়েছে সর্বদাহী প্রতিহিংসা। আধুনিক সমাজে এ সমস্যাও অতি আধুনিক।
আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে আজ প্রত্যেক ভৌগোলিক এলাকায় গড়ে উঠেছে এক একটি অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তা। এক জাতি অপর জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অপর জাতির মানুষ ধ্বংস হয়ে গেলে, কঠিন বিপদের সম্মুখীন হলেও তার প্রতিবেশী জাতির লোকদের সেজন্য কোন মাথা ব্যথা নেই, দুঃখ নেই, নিপীড়িত মানবতার প্রতি নেই কোন সহানুভূতি। এই স্বতন্ত্র জাতিগুলোই তার অন্তর্ভুক্ত জনগণের পক্ষে ‘খোদা’ স্বরূপ। এক একজন জাতীয়তাবাদী লোক আজ অকুণ্ঠিত আওয়াজে ঘোষণা করছে, My nation, Wrong or right
অর্থনৈতিক সমস্যা
বর্তমান দুনিয়ার মানুষ এক সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন। মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা আজ সারা দুনিয়ার এক অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু একশত বৎসর পূর্বে অন্তত পাক ভারতের ক্ষেত্রে পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেও- এরূপ অবস্থা ছিল না। তখনকার প্রায় প্রত্যেকটি মানুষই শ্রম ও চেষ্টা সাধনা করে নিজদের প্রয়োজন পূরণ করে নিতে পারত। কিন্তু বর্তমান অবস্থা হচ্ছে এই যে, ইউনেস্কোর (Unesco) এক রিপোর্ট অনুযায়ী দুনিয়ার তিন ভাগের দু’ভাগ লোকই কঠিন দারিদ্রে (Abject poverty) নিমজ্জিত [Amrita Bazar Patrica July-30-1955]। যেসব দেশে বাহ্যত:- খুবই স্বাচ্ছন্দ্য ও সচ্ছলতা পরিপুষ্ট হয়, সেখানেও এই সচ্ছলতা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধনীলোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সাধারণ জনতার অবস্থা মর্মান্তিকই রয়েছে। আমেরিকা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধনীদেশ, ইতিপূর্বে তার উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু সেখানকার পনেরো ষোল কোটি অধিবাসীর মধ্যে মাত্র ১৪৮ জন লোকই হচ্ছে কোটিপতি। আর এরাই সমগ্র দেশের শিল্প ও বাণিজ্য দখল করে আছে। বৃটেনের অর্ধেক বাসিন্দা চরম দারিদ্র্যে দিন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। চার্লস কিংসলে (Charles Kingsle) নামক এক ইংরেজ একবার বলেছিল, “ইংল্যান্ড কেবল ধনশালী লোকদেরই জন্যে খুশিময় স্থান। কিন্তু আমার মত দরিদ্রের পক্ষে এ কঠিন জায়গা।”
দুনিয়ার এ দুটো বড় ধনী দেশের অবস্থাই যখন এরূপ, তখন অন্যান্য অনুন্নত দেশের অবস্থা যে কি, তা না বললেও চলে। কিন্তু এর কারণ কি?
এক কথায় বলা যেতে পারে, বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুস্পষ্ট শোষণমূলক, বিপুল ও বিরাট সংখ্যক মানুষকে শোষণ করে, বঞ্চিত করে, প্রতারিত করে, অল্প সংখ্যক লোক সমস্ত ধন সম্পদ কুক্ষিগত করে নিচ্ছে এবং নিজেদের আয়েশ আরাম ও বিলাসিতার প্রাসাদ গড়ছে তালার পর তালা।
পুঁজিবাদী দেশ, আধা পুঁজিবাদী আধা সামন্তবাদী দেশ, আর সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রকৃতই কোন পার্থক্য নেই।
আজকের দুনিয়ার জমি ক্ষেত আর শিল্প কারখানায় কোটি কোটি মজুর দিন রাত খাটছে, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করছে; কিন্তু না পাচ্ছে উপযুক্ত মজুরি, না পাচ্ছে পেটভরা দুবেলার ভাত, না পাচ্ছে মানবোপযোগী সম্মান ও মর্যাদা, না পাচ্ছে একবিন্দু শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা।
এই মজুরদের খাটিয়ে যে মুনাফা লাভ করা হয়, তার খুব সামান্য এবং নগন্য অংশই তাদের ভাগে পড়ে। বরং শতকরা আশিভাগ মুনাফাই মালিকপক্ষ হরণ করে নেয়, লুটে নেয় সবটুকু মজা আর সার।
বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক লেন-দেন সুদের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। কি আভ্যন্তরীণ লেনদেন, ব্যবসায়, আর কি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও ঋণ, সবক্ষেত্রে সুদই হচ্ছে একমাত্র ভিত্তি। সুদ ছাড়া এসবের কোন একটি কাজই সমাধা করা যায় না। ফলে সাধারণভাবে ব্যক্তি ও জাতির নিকট সঞ্চিত অর্থসম্পদ শোষিত হয়ে পুঁজিবান ব্যক্তি ও জাতির পকেটস্থ হচ্ছে। একদিকে অর্থ নিঃশেষে শূন্য হয়ে যাচ্ছে, আর অপরদিকে তাই সঞ্চিত হয়ে পাহাড় সমান স্ফীত হয়ে উঠছে। বর্তমানের অর্থব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতিই হচ্ছে এই। ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবার পর তৎকালীন অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
জুয়াখেলার নানাবিধ ধরন, রূপ ও পদ্ধতি আজ মানব সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। এক শ্রেণীর মানুষ এর মাধ্যমে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, আর একশ্রেণীর মানুষ ভাগ্যের খেলায় রাতারাতি লক্ষপতি হয়ে উঠছে। কেবলমাত্র টেলিফোনের সাহায্যে পণ্য ক্রয় ও বিক্রয়ের কাজ করে এক শ্রেণীর লোক আজ বিপুল মুনাফা লুটে নিচ্ছে। অথচ এভাবে অর্থোপার্জন করায় না থাকে বিশেষ কোন দায়িত্ব বা ঝুঁকি, না প্রয়োজন হয় কোন শ্রম বা খাটুনীর। ফলে সাধারণভাবে প্রায় সকল মানুষের মনে অগণিত অর্থলাভের এবং রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবার এ ধরনের সব পথ-পন্থা ও উপায়ের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা জন্মাচ্ছে, শ্রমবিমুখ মানুষের অধিকাংশ এদিকে আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
আর শ্রম-খাটুনী ও দায়িত্ব এবং ঝুঁকির কাজসমূহ, যা না হলে কোন জাতি সত্যিকারভাবে গড়ে উঠতে পারে না- দিন দিন পরিত্যক্ত হচ্ছে। মানুষ হয়ে উঠছে অলস, সুখপ্রিয়, বিলাসী ও সুযোগসন্ধানী। সাধারণভাবে মানব জাতির এ কর্মবিমুখতা ভবিষ্যতের মানুষের জন্যে কঠিন বিপদ ঘনিয়ে দিতে পারে, একথা আজ চিন্তাশীলমাত্রকেই ভাবিয়ে তুলবে।
রাজনৈতিক সমস্যা
বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছে। একটি দেশের ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে এই জটিলতা কুণ্ডলী পাকিয়ে পাঁকিয়ে বিরাট আকার ধারণ করে, গ্রাস করে নেয় সারা বিশ্বকে।
একটি দেশের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জটিলতার বীজ উপ্ত হয়। একজন ব্যক্তি ক্ষুদ্র পরিবেশে প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করতে চেষ্টা করে, অপর কারো সাথে সংঘর্ষ হলে তাকে পরাজিত করে নিজস্ব প্রভাবকে প্রবল ও স্থায়ী করে নেবার জন্যে সে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সেজন্যে সে নানা প্রলোভন দেখিয়ে অপর লোকদের নিয়ে দল জোটায়। ফলে এই প্রতিযোগিতা বিভিন্ন পার্টি ও দলের মধ্যে চলতে শুরু করে। একদল অপর দলের বিরুদ্ধে প্রচার চালায়, বিরোধী দলের নেতা ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাঁদা ছুড়া-ছুড়ি করে, কুৎসা রটায়, জনসমক্ষে হীন প্রমাণিত করার জন্যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করতেও দ্বিধাবোধ করে না। ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ক্ষমতালোভ এবং জনগণের উপর নিরংকুশ কর্তৃত্ব করার লিপসা দলীয় ও গোষ্ঠীগত পর্যায়ে অভিব্যক্ত হয়। কোথাও একটি দল নানাবিধ অপকৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতা দখল করে, আর কোথাও অস্ত্রের প্রাবল্যে দেশের কোটি কোটি জনগণকে পদানত করে নেয়। কায়েম করে এক দুর্ভেদ্য ডিক্টেটরী শাসন। আজ বেশ কয়েকটি দেশেই এ ডিক্টেটরী শাসন কায়েম রয়েছে। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জটিলতার এ এক ভয়াবহ অবস্থা।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জটিলতার মূলেও ঠিক এ জিনিসই কাজ করে। উপনিবেশবাদই হচ্ছে এ যুগের এক বিরাট বিশ্বসমস্যা। ইউরোপ আমেরিকা ও চীন রাশিয়ার উপনিবেশবাদ আজও দুনিয়ার বিপুলসংখ্যক মানুষকে কতগুলি বড় বড় দেশকে পদানত ও পর্যুদস্ত করে রেখেছে। কেবলমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিতেই এসব দেশকে পদানত করে রেখে তারা সন্তুষ্ট থাকেনি, সে সঙ্গে এসব পদানত দেশে বিজয়ী জাতিগুলি নিজদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও ভাবধারা জীবনযাপন পদ্ধতি ও মূল্যমান চাপিয়ে দিতেও প্রবলভাবে চেষ্টা করছে। কোন এক মুহূর্তে এ পদানত জাতিগুলির মনে আজাদী লাভের চেতনা জাগ্রত হতে না পারে, তার জন্যেও এদের চেষ্টার অবধি নেই। এতদা শর্তেও যদি কোথায়ও আজ আন্দোলনের উন্মেষ ঘটেছে তাহলে সশস্ত্র দমন নীতির মাধ্যমে গোটা দেশ ও জাতিকেই নিষ্পেষিত করে ছেড়েছে। এককালে সমগ্র এশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার উপর ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী তথা উপনিবেশবাদ জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। ক্রমে এক একটি জাতি এ অধীনতম নাগ-পাশ থেকে মুক্তিলাভ করেছে বটে; কিন্তু এখনও আফ্রিকার বিরাট অংশ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের তলে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে, আজাদীর জন্য আর্তনাদ করছে।
একদিন সমগ্র আরব দেশই ছিল ইংরেজের কবলিত-পদানত। আজ এর মধ্যে যেসব দেশকে আমরা স্বাধীন দেখতে পাচ্ছি, আজাদী লাভের জন্যে তাদের বড় রক্তাক্ত সংগ্রাম করতে হয়েছে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত চালাতে হয়েছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। আজাদী লাভের জন্য বিরাট কোরবানি দিতে হয়েছে তাদের। স্বাধীন মুক্ত আরব জাহানকে নানাবিধ কুচক্রে জড়িয়ে পদানত করে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের চেষ্টা এখনো শেষ হয়নি।
আফ্রিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদ নিঃশেষে মরে যাচ্ছে। কিন্তু শ্বেতাংগ ঔপনিবেশিকগণ এখনো তার স্মৃতি জাগ্রত রাখবার জন্যে শেষ চেষ্টায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। তাদের ইচ্ছা হচ্ছে দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার পতাকা চিরতরে উড্ডীন রাখা, এ বিরাট অঞ্চলের বিপুল ধন-সম্পদ কেবল মাত্র ইউরোপীয়দের ভোগদখলের জন্যে কুক্ষিগত করে রাখা। এসব দেশের প্রকৃত বাসিন্দাগণ নিজেদের দেশেই সকল প্রকার মানবীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত দক্ষিণ রোডেশিয়া ও মধ্য আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী স্যার রয় ওয়েলেনস্কি (Sir Ray Welensky) এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র বর্ণ ও বংশের ভিত্তিতে লক্ষ লক্ষ আফ্রিকান ও এশীয় মানুষকে মানবীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে এবং আফ্রিকায় আর এক কংগো সৃষ্টির চেষ্টায় মেতে উঠেছে।
এসব প্রাচীন ধরনের ঔপনিবেশিকতা ছাড়াও আমেরিকার পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিকতা ও চীন-রাশিয়ার সাম্যবাদী সমাজতান্ত্রিক ঔপনিবেশবাদ আধুনিক যুগের অবদান। আমেরিকা স্বাধীন দুনিয়ার অনুন্নত দেশসমূহে বিস্তার করেছে আন্তর্জাতিক সাহায্যদানের এক দুর্ভেদ্য ষড়যন্ত্র জাল। জাতীয়তাবাদী চীন এবং রাশিয়ার অন্যান্য কয়েকটি দেশই আজ এ ফাঁদে পড়ে ছটফট করছে। চীন ব্যতীত সমগ্র কমিউনিস্ট জগতই আজ রাশিয়ার সাম্যবাদী সাম্রাজ্যবাদের জালে বন্দী। মধ্য এশিয়ার প্রায় সমগ্র মুসলিম এলাকাকে রাশিয়া গ্রাস করে নিয়েছে। আফগানিস্তানকে নুতনভাবে রাশিয়ার কবলিত করা হচ্ছে। আর পাকিস্তানের দিকে করাল জিহবা লালায়িত হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা কিউবাকে প্রায় গ্রাস করে নিয়েছে। রাশিয়ার কবলে একবার পড়ে গেলে নিষ্কৃতি লাভের আর কোন উপায়ই যে থাকে না তা আজ কারও অজানা নেই। হাঙ্গেরীর আজাদীকামী যুবশক্তি একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল রাশিয়ার অক্টোপাস হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের রাশিয়া প্রেরিত ট্যাংক ও মেশিনগানের তলায় পড়ে নিমর্মভাবে নিষ্পেষিত ও চূর্ণবিচূর্ণ হতে হয়েছে। আজ হাঙ্গেরী এক বিরাট সমাধিক্ষেত্র।
চীনের সাম্যবাদী সাম্রাজ্যবাদের লেলিহান জিহবা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলির দিকে বিলোলিত। বার্মা ও ভারতে গেরিলা সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছে। তিব্বতকে ইতিপূর্বেই গ্রাস করে নিয়েছে চীন। চীনের এ সাম্রাজ্যবাদও যে নিছক রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ নয়, তার প্রমাণ তিব্বত দখল করেই চীন সেখানে শুরু করেছে কমিউনিজমের ব্যাপক প্রচারণা। চরিত্রের দিক দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জবরদস্তি করে ব্যাভিচারী হতে বাধ্য করেছে।
কিউবা, কংগো, লাওস ও ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশকে কেন্দ্র করে বর্তমানে রুশ আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী চক্রদ্বয়ের চাপ প্রবল আকার ধারণ করেছে। একটি দেশ অপরটিকে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ বলে গাল দিচ্ছে; অথচ কার্যত উভয়ই সেখানে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ ছাড়া আর কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক সমস্যা
উপরে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা প্রসংগে যা কিছু বলা হয়েছে, তাই হচ্ছে বর্তমান দুনিয়ার আন্তর্জাতিক জটিল সমস্যার যতরূপ। বিচ্ছিন্নভাবে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী চক্রদ্বয়ের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছে, তাই বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিশ্ব পরিস্থিতিকে চরমভাবে অশান্ত, অনিশ্চিত ও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। পূর্বর মত এই খণ্ডদ্বন্দ্বই যে এক সর্বগ্রাসী বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করতে পারে তাতে আজ কারুরই সন্দেহ থাকতে পারে না। উভয় চক্রই দুনিয়ার সামনে বিশ্বশান্তি স্থাপনের সংকল্প প্রকাশ করছে, যুদ্ধে বিরাগ-অনাসক্তি এবং শান্তির জন্যে একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছে বলে প্রচার করছে এবং দুনিয়ার যেখানে যতবড় সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রই তারা করুক না কেন, কেবলমাত্র শান্তি স্থাপনই তাদের চরম লক্ষ্য বলে ঘোষণা করতেও লজ্জাবোধ করছে না। সেই সংগে অপর শিবিরকে নিজদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সমর সজ্জার কথা জানিয়ে হুমকি দিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না।
বিশ্বযুদ্ধ যেকোন মুহূর্তেই যেকোন ছুতায় বাজতে পারে, শিবিরদ্বয়ের কর্তাদের ভাষণ-বক্তৃতা ও তৎপরতা লক্ষ্য করলেই তা’ নিশ্চিতরূপে বুঝা যায়। আর যুদ্ধ বাঁধলে সাম্রাজ্যবাদীদের আপাত লাভ যে রয়েছে তা অতীত ইতিহাসই আমাদিগকে নিঃসন্দেহে জানিয়ে দেয়। অথচ অতীত যুদ্ধসমূহের মারাত্মক পরিণতির কথা যাদের মনে জাগরূক রয়েছে, তারা কিছুতেই যুদ্ধ সৃষ্টির কোন অবস্থাকেই মন দিয়ে স্বীকার করে নিতে পারে না; বরং যুদ্ধের নাম শুনলেই তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।
তাই যুদ্ধের বিশেষ করে বর্তমান আণবিক যুগের যে কোন যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে বিশ্বের জনগণেরই গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। এ দৃষ্টিতে পৃথিবীর অতীত অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা এখানে করা যাচ্ছে।
যুদ্ধ সেকালে ও একালে
বর্তমান শতকের প্রথমার্ধেক কালের মধ্যেই পর পর দুটো বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হল। কিন্তু সে যুদ্ধ প্রাচীনকালের মত যুদ্ধ নয়। প্রাচীনকালে চেঙ্গীস খাঁ, হালাকু যা করেছে যুদ্ধ, করেছে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ও আলেকজান্ডার দি গ্রেট; তাদের যুদ্ধের বিপুল লোকক্ষয় ও সম্পত্তি বিনাশ হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সে ক্ষয় ও ক্ষতির কোন তুলনাই হতে পারে না এ শতকের যুদ্ধের সাথে। প্রাচীন যুদ্ধের মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের মর্মান্তিক স্মৃতি জনগণের হৃদয়পট থেকে নিঃশেষে মুছে যাবার আগেই পর পর দুটো বিশ্বযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হল।
পূর্বে মানুষকে আমরা, এ যুগের লোকেরা মুর্খ, অশিক্ষিত, বর্বর বলে ঘৃণা করি; কিন্তু এই শতকের সভ্য মানুষেরাই বা কোন সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছে তা একবার ভেবে দেখা দরকার।
তা’ ছাড়া পূর্বে যুদ্ধ হত খুবই সীমাবদ্ধ আকারে। যার বা যাদের স্বার্থে যুদ্ধহত, কেবল সেই বা তারাই ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হত। বেসামরিক লোকদের সাধারণত তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হত না। নিরো ও তৈমুর লঙের যুদ্ধ তো বর্তমান শতকের দুটি মহাযুদ্ধের সামনে একেবারে নগণ্য- অনুল্লেখযোগ্য। আজ ক্ষমতার প্রভাব-প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্বের লোভ, আন্তর্জাতিক বন্দরে বাজার সৃষ্টির মতলবে বড় বড় ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র একেবারে অন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের মর্মবিদারী হাহাকার রাষ্ট্রদুরন্ধরদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। বিজ্ঞানের অবদান অতি আধুনিক আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা যে যুদ্ধ হয়, তা’ কেবল যোদ্ধা ও শত্রুদেরই ধ্বংস করে না, বেসামরিক নিরীহ জনগণকেও চূড়ান্তভাবে ধ্বংস ও সর্বশান্ত করে দেয়। নিশ্চিহ্ন করে দেয় যুদ্ধ এলাকার বিরাট জনপদ, শহর নগর গ্রাম; এক একটি বিরাট ভূখন্ডকে পর্যন্ত নাস্তানাবুদ করে দেয় ।
১ম মহাযুদ্ধ ও তার কারণ
কিন্তু যুদ্ধ কেন বাধে, কেন এক এক ব্যক্তি- একটি দেশের বিরাট বাহিনী ধ্বংস যজ্ঞে মেতে উঠে? এ নির্ভুল জবাব প্রত্যেকটি যুদ্ধের ইতিহাস আলোচনা ও যাচাই করলেই পাওয়া যেতে পারে।
প্রথম মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয় কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণে; রাজনৈতিক আক্রোশ প্রতিহিংসা ও রাষ্ট্র-সীমা বৃদ্ধিকরণের মতলবে। এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে রাশিয়া, ফ্রান্স, গ্রেটবৃটেন, ইটালী প্রভৃতি বড় বড় দেশ ও রাষ্ট্র। এরা পরস্পরের বিরুদ্ধতা ও শত্রুতার বশবর্তী হয়ে একে অপরের নিধনযজ্ঞে লেগে যায়।
রাশিয়া ও বৃটেনের মধ্যে শত্রুতার বীজ উপ্ত হয়েছিল ১৯০৪ থেকেই। ইটালী ও ফ্রান্সের মধ্যে তিউনিসিয়া নিয়ে বিবাদ চলে আসছিল ৫০ বৎসর থেকে। বৃটেন ও ফ্রান্স চৌদ্দশতক থেকেই একে অপরের প্রকাশ্য দুশমন হয়ে রয়েছিল। আর সার্বিয়া ছিল অস্ট্রিয়ার দুশমন। ইটালী যুদ্ধে যোগদান করেছিল শুধু এমন কতগুলি স্থান দখল করার মতলবে, যা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার অধীনে ছিল।
পৃথিবীর এই প্রথম মহাযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ ধ্বংস হয়েছিল, হয়েছিল পঙ্গু, অঙ্গহীন, অন্ধ-বধির ও জখমী। বহু লক্ষ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে নির্মমভাবে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
প্রথম মহাযুদ্ধের প্রায় বিশ বৎসর পরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, প্রথম মহাযুদ্ধের পর বড় বড় বিজয়ী রাষ্ট্রগুলোর মাঝে যে ভার্সাই সন্ধি অনুষ্ঠিত হয়, তাতেই এই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বীজ বপন করা হয়েছিল। তাছাড়া ইংরেজ দীর্ঘকাল ধরে সারা পৃথিবীব্যাপী যে জঘন্যধরণের কূটনীতি চালিয়ে ছিল, তার ফলে মানব জীবনের চরম অশান্তি ও বিপর্যয় শুরু হয়েছিল।
ভার্সাই সন্ধির ফলে অস্ট্রিয়ার অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তাকে ভাগ করে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরী, চেকোশ্লোভাকিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া নামে কয়েকটি দেশের জন্ম দান করা হয়। এর কিছু অংশ দেওয়া হয় ইটালীকে।
ইরাক, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে ইংরেজ বিদ্রোহ শুরু করিয়ে দেয়। ফলে সুযোগ বুঝে ইংরেজ ইরাক দখল করে বসে। সিরিয়া ফ্রান্সের অধীন হয়ে যায়। লেবানন নামে এক নুতন রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং বালফোর ঘোষণার ফলে আরব জগতের বুকে ইসরাইল রাষ্ট্রকে এক বিষাক্ত ফোঁড়া হিসাবে বসিয়ে দেয়া হয়।
ভার্সাই সন্ধির ফলে সবচেয়ে বড় আঘাত পড়ে জার্মানীর উপর। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তাকে কোণঠাসা করে দেয়া হয়, নিরস্ত্র করা হয়। তাকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হয়। জার্মানী এরূপ অবস্থা মেনে নিতে কিছুতেই রাযী হতে পারেনা। কাজেই এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে জার্মানী কৃতসংকল্প হয়। প্রথমেই জার্মানী চেকোশ্লোভাকিয়ার নিকট থেকে জার্মান এলাকা ফেরত নিয়ে নেয়। আর পোল্যান্ডের কাছ থেকে ট্রানজিট এবং করিডর ফিরিয়ে পাবার জন্য দাবি পেশ করা হয়। এর ফলেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগুন দাউ দাউ করে জলে উঠে এবং অনতি বিলম্বে তাতে জড়িত হয়ে পড়ে দুনিয়ার বড় বড় রাষ্ট্র ও দেশ।
এ আলোচনার ফলে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে, পররাষ্ট্র লোলুপতা, সাম্রাজ্যবাদ, দুর্বল জাতিকে কোণঠাসাকরণ, অধিকৃত দেশের জনগণকে সকল প্রকার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি চালানোই হচ্ছে এসব যুদ্ধ সংঘর্ষের মৌলিভূত কারণ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলে ১৯৩৯ সন থেকে ৪৫ সন পর্যন্ত। এতে দুনিয়ার মানুষের চরম ধ্বংস সাধিত হয়। জাতিসংঘের একটি কমিশন এই ধ্বংসযজ্ঞের বিস্তারিত বিবরণ, তথ্য ও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছে। তা থেকে যে লোমহর্ষক তথ্য জানা গেছে, এখানে তার কিয়দাংশ পেশ করা হচ্ছে। এ থেকে বিরাট বিপুল ধ্বংস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যেতে পারে
এ যুদ্ধে সারা দুনিয়ায় মরেছে ও জখমি হয়েছে সাড়ে ছয় কোটি লোক। পনেরো কোটি লোকের ঘর-বাড়ি জ্বলে ভস্ম হয়ে গিয়েছে। আড়াই কোটি লোক নিজের দেশ, ঘর-বাড়ি, জন্মভূমি ও বিষয় সম্পত্তি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে ভিন্ন দেশে- দূরতম কোন দেশে নির্বাসিত হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এ যুদ্ধে যত ধনদৌলত ও দ্রব্যসামগ্রী বরবাদ হয়েছে, তা’ যদি দুনিয়ার মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা হতো তা’হলে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, আয়ারল্যান্ড, সোভিয়েট রাশিয়া ও বেলজিয়ামের বাসিন্দাদের প্রত্যেকটি পরিবারকে ৮ হাজার টাকার দ্রব্য-সামগ্রী, একখানা করে পাকা বাড়ি, ৬০ হাজার টাকার ফার্নিচার ও ৩ লক্ষ টাকা নগদ দেয়া যেতো। এছাড়াও দু’লক্ষ লোক বাস করে এমন প্রত্যেকটি শহরের নিম্নোক্ত খাতসমূহে নিম্নোল্লেখিত হার অনুযায়ী বন্টন করা যেত।
১। সাড়ে সাইত্রিশ কোটি টাকা লাইব্রেরি করার জন্যে।
২। সাড়ে সাইত্রিশ কোটি টাকা স্কুল কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার জন্য এবং
৩। সাড়ে সাইত্রিশ কোটি টাকা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য।
অপর এক আনুমানিক হিসাব মতে, এ যুদ্ধে বিভিন্ন জাতি যা কিছু খরচ করেছে, সেই বিত্ত সম্পত্তি ও অর্থ সম্পদ যদি দুনিয়ার আড়াই শত কোটি লোকের মধ্যে সমান হারে ভাগ করে দেয়া হতো তা’হলে দুনিয়ার এক একটি ব্যক্তি ত্রিশ হাজার করে টাকা পেত।
অর্থাৎ দশ জন লোকের এক একটি পরিবার তিন লক্ষ টাকার মত পেতে পারত, যার দ্বারা প্রত্যেকটি পরিবার প্রতিমাসে আড়াই শত টাকা করে খরচ করে এক শত বৎসর কাল পর্যন্ত অনায়াসেই জীবন যাপন করতে পারত।
প্রসংগত: উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একা বৃটেনই এ যুদ্ধে দৈনিক পনেরো মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি আমাদের টাকার হিসাবে প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করেছে।
কিন্তু এ হলো মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলার হিসাব নিকাশ। এক একটি যুদ্ধে যে কি ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করে এবং মানব জীবনের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে যে কতখানি ব্যাহত করে, তা এ হিসাব নিকাশ থেকে সুস্পষ্টরূপে অনুভব করা যায়। কিন্তু এখন যদি কোন বিশ্বযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা কিছুতেই প্রাচীনকালের সিকান্দার নিপোলিয়নের যুদ্ধের মত হবেনা, হবেনা ১ম ও ২য় মহাযুদ্ধের মত বরং তা যে এসবের তুলনায় শতগুণ বেশি ধ্বংস ডেকে আনবে, তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। তা ছাড়া আগের এ যুদ্ধগুলো যে যুগে অনুষ্ঠিত হয় তাকে বিজ্ঞানের বস্তুবিজ্ঞান ও যন্ত্রবিজ্ঞানের দিক দিয়ে বড়জোর যৌবনকাল বলা যেতে পারে। বর্তমানে বিজ্ঞানের যে উৎকর্ষ ও অগ্রগতি হয়েছে, অন্য কথায় যত মারণাস্ত্র এ যুগে আবিষ্কৃত হয়েছে, পূর্বে তার অস্তিত্ব ছিল না। কাজেই এখনকার যুদ্ধ নিশ্চিত রূপেই হবে সর্বংসী ও চুড়ান্ত ধ্বংসকারী। এখনকার আণবিক বোমা বিগত যুদ্ধে ব্যবহৃত আণবিক বোমার তুলনায় ২৫ হাজার গুণ বেশি ধ্বংসাত্মক। বিজ্ঞানীগণ বলেছেন: বর্তমানে কেবল দুটে হাউড্রোজেন বোমা দিয়ে সারা দুনিয়াকে নিঃশেষে ধ্বংস করা যেতে পারে। অথবা উত্তর মেরুতে একটি আর দক্ষিণ মেরুতে একটি হাইড্রোজেন বোমা ছাড়লে এমন সাংঘাতিকভাবে বিস্ফোরণ হবে যে, সেখানকার কেবল বরফ গলেই সারা দুনিয়ার সমুদ্রসমূহে এক মহা প্লাবন ও পানিস্ফীতি ঘটাবে, যার ফলে ধরিত্রির বুকের সমস্ব মানুষ ও সভ্যতা-তামাদ্দুনের সব নাম-নিশানা পর্যন্ত ধুয়ে মুছে শেষ করে দেবে। মানুষের নিজের হাতের তৈরি জিনিস দ্বারা এরূপ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের অনুষ্ঠান করার সুযোগ-সুবিধে ইতিপূর্বে ইতিহাসের আর কোন অধ্যায়ে কখনো সম্ভব হয়নি।
শান্তি স্থাপনের চেষ্টা ও ব্যবস্থা
এতক্ষণ পর্যন্ত যা কিছু আলোচনা করা হল, তা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, দুনিয়ার বড় বড় রাষ্ট্রকর্তা ও পুরস্করগণ বিশ্বমানবতাকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করার জন্যে সকল ব্যবস্থাপনাই সম্পূর্ণ করে নিয়েছে; এখন শুধু সুইচ অন করার কাজটুকুই বাকি। আর যে মুহূর্তে তা হয়ে যাবে, সেই মুহূর্তেই দেখা যাবে, সারা পৃথিবী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু বিশ্ব মানব কি চির দিনই কেবল ধ্বংসযজ্ঞে মেতে রয়েছে, ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য কি পৃথিবীতে কোন চেষ্টাই করা হয়নি? -হয়নি, একথা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত একদিকে যেমন ধ্বংসের লীলা সৃষ্টি করা হয়েছে তেমনি অপর দিকে নানাভাবে চেষ্টাও করা হয়েছে এই সর্বধ্বংসী যুদ্ধ প্রতিরোধ ও বিশ্বশান্তি স্থাপনের জন্যে।
লীগ অব নেশন্স
এই পর্যায়ে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টার ফলে ১৯২০ সনে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে গঠিত হয় লীগ অব নেশন্স। প্রায় বিশ বৎসর পর্যন্ত দুনিয়ার বড় বড় রাষ্ট্র ধুরন্ধরগণ এ মারফতে বিশ্বে শান্তি স্থাপনের জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে।
কিন্তু এ চেষ্টায় আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার কোন অস্তিত্ব ছিল না। রাষ্ট্র ধুরন্ধরদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে চরম স্বার্থপরতা, মুনাফেকী ও পরস্পরের বিরুদ্ধে কুটিল হিংসা ও ষড়যন্ত্র দেখা গেছে। যারাই শান্তি স্থাপনের কাজে বাহ্যত ব্যস্ত, তারাই প্রকৃতপক্ষে ব্যস্ত ছিল বিশ্বব্যাপী চরম অশান্তির বীজ বপনের কাজে, গোপনে ও সন্তর্পণে। ফলে আগ্নেয়গিরির উপর প্রাসাদ নির্মাণের মতই লীগ অব নেশন্স কাজ করতে শুরু করল। দুনিয়ার বিজয়ী দেশের কর্তাগণই ইহার উপর কর্তৃত্ব করতে লাগল। ইকবালের ভাষায় এরা সব ছিল ‘কাঞ্চনচোর’। ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সুচিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই লীগ অব নেশন্স তাসের ঘরের মত চুরমার হয়ে যায়। যুদ্ধ প্রতিরোধ ও শান্তি স্থাপনের এ প্রচেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ হয়।
জাতিসংঘ
এরপর বিশ্বশান্তি স্থাপনের দ্বিতীয় প্রচেষ্টার ফলে গঠিত হয় বর্তমান জাতিসংঘ (United Nations Organizations) দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানী, ইটালী ও জাপান মিত্র পক্ষের নিকট পরাজয় বরণ করে। তখন ২৫শে জুন সানফ্রান্সিসকোতে ৫০ জাতির সম্মেলনে এক চার্টারে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে এই জাতিসংঘ গঠিত হয়। দুনিয়ার জনগণের এ প্রতিনিধিরা বিশ্ববাসীকে যুদ্ধের মারাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার সংকল্প ঘোষণা করে এ চার্টারের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষের প্রতি ইনসাফ, আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন, প্রশস্ততর স্বাধীন উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন, সকলে মিলে এক রক্ষা বুহ্য রচনা, সম্মিলিতনীতিতে কাজ করা, অকারণ অস্ত্র ব্যবহার রোধ এবং সকল মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণ বিধানের প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করা হয় এই চার্টারে।
স্বীকার করতে হবে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিশ্বশান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে UNO এক অতুলনীয় প্রচেষ্টা। এত বড় ও এত বিরাট ক্ষমতা-ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান রচনা মানুষের ইতিহাসে এটাই হচ্ছে প্রথম ঘটনা।
প্রসঙ্গত: UNO এর পরিচয় দানের উদ্দেশ্যে এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা আবশ্যক বোধ হচ্ছে। তাতে এক দিকে যেমন এর ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যাবে, তেমনি এত বড় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিশ্বশান্তি স্থাপনের ব্যাপারে যে বিরাট কল্যাণের আশা করা যেতে পারে, তাও বুঝা যাবে। আর সেই সঙ্গে এ ব্যর্থতা যে কত বড় ব্যর্থতা, মানবতার চরম ব্যর্থতা তাও উপলব্ধি করা যাবে।
জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় অফিস বিল্ডিং মানহাটন দ্বীপে ৬ ব্লকে ১৮ একর জমির উপর স্থাপিত। ৩৯ তলার একটি বিরাট প্রাসাদ নির্মাণে দুনিয়ার মানুষের ব্যয় হয়েছে মোট ২১ কোটি ৩৮ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনের জন্য প্রতি বৎসর খরচ হচ্ছে ৪০ কোটি ডলার।
এর সমগ্র প্রাসাদটিই এয়ার কন্ডিশান করা। শীতাতপের কোন বালাই নেই সেখানে। এখানে একটি ভুগর্ভস্থ গ্যারেজ রয়েছে, যাতে একই সংগে আড়াই হাজার মোটর গাড়ী থাকতে পারে। কিন্তু কার্যতঃ এ প্রতিষ্ঠান দুনিয়ার আড়াই শত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না, পারছে না দুর্বল জাতিগুলোকে বড় বড় জাতিগুলির হামলা শোষণ ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে।
এর সেক্রেটারিয়েটে এমন বৈদ্যুতিক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে, যাতে করে কেন্দ্রীয় অফিস থেকে জরুরি কাগজপত্র ও ফাইল ইত্যাদি নিমেষমাত্রের মধ্যে বিল্ডিং এর অন্যান্য সমস্ত কক্ষে পৌঁছে যেতে পারে ।
কিন্তু কার্যত: এ প্রতিষ্ঠানকে দুনিয়ার সেরা বেনিয়া রাষ্ট্রগুলো এমনভাবে করায়ত্ত করে রেখেছে যে, হকদারকে হক পৌঁছে দেয়ার কোন ব্যবস্থাই এর দ্বারা করা সম্ভব হচ্ছে না। সেখানে পৌঁছতে পারছে না দুনিয়ার দুঃখ জর্জরিত মযলুম জাতিগুলির রক্তলেখা কোন চিঠি ।
এর জেনারেল এসেম্বলীতে বক্তৃতা শোনবার জন্যে এমন সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে যে, একই বক্তৃতাকে (বক্তৃতা চলাকালেই) বিভিন্ন জতির প্রতিনিধিরা নিজ নিজ কানে এয়ারফোন লাগিয়ে একই সময় রুশ, ফরাসী, চীনা ও ইংরেজী ভাষায় শুনতে পারে।
বক্তৃতা শোনবার ও কথা বুঝবার এ এক অতুলনীয় ব্যবস্থা, তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও দুনিয়ার মযলুম মানবতার আর্তনাদ তারা শুনতে পায় না। নিপীড়িত মানবতার জন্যে এ প্রতিষ্ঠান কার্যত: কিছুই করতে পারছে না।
এই প্রসাদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা রক্ষার জন্যে এর পাথর, ‘ছংগে’ মম’র এর গালীচা চেয়ার, টেবিল, আলমারী ও অন্যান্য সাজসজ্জা, সরঞ্জাম-সামান এর সদস্য দেশগুলি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
একে সজ্জিত করেছে সকল দেশের লোকেরা, এক মনে এক ধ্যানে। উদ্দেশ্য ছিল একে গড়বার ব্যাপারে দুনিয়ার জাতিগুলো যেমন ঐক্য, সামা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে, তেমনি ঐক্য,
সাম্য ও আন্তরিকতার সাথে তারা সকলে মিলে চেষ্টা করবে বিশ্বশান্তি স্থাপনের জন্যে, সেজন্যে এদের পরস্পরের মধ্যে দেখা দেবে না কোন মতবিরোধ, হিংসা বিদ্বেষ। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, দুনিয়ায় শান্তি সংস্থাপনের ব্যাপারে প্রতিনিধি জাতিগুলোর মধ্যে না আছে কোন মতৈক্য, না আছে আন্তরিকতা ও অকপটতা।
জাতিসংঘের মত বিরাট ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান বর্তমান থাকা সত্ত্বেও আজ এক জাতি অপর জাতিকে পদানত করে রেখেছে, গোলাম বানিয়ে দুচ্ছেদ্য জিঞ্জীরে বেঁধে রেখেছে। U.N.O. র সদস্য ও জাতিসংঘ ঘোষিত মানবীয় অধিকার চার্টারে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র কেবলমাত্র মেশিনগান ও ট্যাংকের বলে অপর রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হরণ করে নিচ্ছে, চালাচ্ছে অত্যাচার নিষ্পেষণের স্টীমরোলার। নিজ দেশের জনগণের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার কেবলমাত্র গায়ের জোরেই কেড়ে নিচ্ছে, কিন্তু জাতিসংঘের এই বিরাট প্রতিষ্ঠান নির্বাক নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকছে, কার্যত: কিছুই করতে পারছে না। এক একটি সদস্য রাষ্ট্র অপর সদস্যরাষ্ট্রের কিয়দংশ অস্ত্রবলে দখল করে নিচ্ছে, চিৎকার করছে, ফরিয়াদ করছে মযলুম রাষ্ট্র ও জনতা, কিন্তু জাতিসংঘ নীরব দর্শক বিরাট পাষাণ প্রতিমূর্তি হয়ে থাকছে, কিছুই করছে না বা করতে পারছে না। কোন কোন প্রধান ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র আবার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের সাহায্যে ইনসাফের সকল প্রস্তাব প্রচেষ্টাকেই বানচাল করে দিচ্ছে। কিন্তু জাতিসংঘ অক্ষম, পঙ্গু, স্থবির, পাহাড় হয়ে রয়েছে ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারছে না। জাতিসংঘের সদস্য দুই প্রতিবেশীরাষ্ট্রের মধ্যে যুগযুগ ধরে চলছে মারাত্মক বিবাদ ও দ্বন্দ্ব, কিন্তু জাতিসংঘ না পারছে এই বিবাদের ইনসাফপূর্ণ মীমাংসা করতে, না পারছে বিবাদমান সদস্য রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে কোন মিলন সৃষ্টি করতে।
দুনিয়ার স্বাধীন মানুষদের সমন্বয়ে গড়া এ জাতিসংঘ দুনিয়ার মানুষকে স্বাধীনতা দিতে পারেনি। এখনো দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ নিতান্ত গোলামী জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে; কিন্তু তবু জাতিংঘের উপর পত্ পত্ করে উড়ছে মানবীয় স্বাধীনতার পতাকা। কাজেই একথা দ্বিধাহীন কণ্ঠেই বলা যেতে পারে যে, U.N.O তার উদ্দেশ্য পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আফ্রিকার মাউমাউ আন্দোলন ও বৃটিশের অমানুষিক দমন নীতি, আলজেরিয়ার আন্দোলন ও ফরাসী সরকারের নিষ্পেষণ নীতি, কংগো, লাওস ও কিউবার অবস্থা, তিব্বত ও কাশ্মীর সমস্যা জাতিসংঘের চোখে অংগুলি দিয়ে প্রমাণ করছে যে, “তুমি লীগ অব নেশনের চেয়েও লজ্জাস্করভাবে ব্যর্থ হয়েছো।”
কিন্তু এর ব্যর্থতার কারণ কি? আমার মতে এর সাংগঠনিক দিকে এমন কতকগুলি ত্রুটি রয়েছে যার দরুণ এ ব্যর্থতা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে ভেটো ব্যবস্থা অন্যতম প্রধান। বড় শক্তিগুলোকে ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা ও অধিকার দেওয়া হয়েছে। কোন প্রস্তাব তাদের কারো মর্জি বা স্বার্থের বিপরীত হলেই ভেটো প্রয়োগ করে বসে। জাতিসংঘের সমস্ত ক্ষমতা, কর্মতৎপরতা সেখানে এসেই স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন সিদ্ধান্তই তা বিশ্বমানবের পক্ষে যতই কল্যাণকর হোক না কেন গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ কার্যত কয়েকটি বড় বড় রাষ্ট্রের একচেটিয়া ইজারাদারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এর কারণ হচ্ছে এই যে, কার্যত: সমস্ত ইখতিয়ার তো সিকিউরিটি কাউন্সিলের হাতে নিবদ্ধ। আর তার স্থায়ী সদস্য হচ্ছে জাতীয়তাবাদী চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, বৃটেন ও আমেরিকা এই পাঁচটি দেশ মাত্র। এদের একটি দেশও কোন ব্যাপারে মতবিরোধ করলে, রাজী না হলে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। কাজেই দুনিয়ার এ বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর কোনও একটি যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও মানবতার মুক্তির কোন কার্যক্রম সমর্থন করতে পারে না, তা নিঃসন্দেহে বোঝা যায়। তারা ইচ্ছে করলে দুনিয়ার যে কোন দেশ বা অঞ্চলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আদৌ সমর্থন না করারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, সেজন্যে না কেউ তাদের কাছে কৈফিয়ৎ চাইতে পারে, না কারো কাছে তাদের জওয়াবদিহি করতে হতে পারে। জাতিসংঘ চার্টারের ২৫ ধারা অনুযায়ী সিকিউরিটি কাউন্সিলের রায় মানতে সকলেই একান্তভাবে বাধ্য। তাহলে একথা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, জাতিসংঘ দুনিয়ার মযলুম মানবতার মুক্তির পথ নির্দেশ করতে পারে না। এ হচ্ছে মানবতার চির দুশমন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর শানিত হাতিয়ার বিশেষ।
সবচেয়ে বড় কথা, সর্বজাতির এই বিরাট প্রতিষ্ঠানের সামনে এমন কোন সম্মিলিত আদর্শের অস্তিত্ব নেই, যার কাছে সকলেই নির্বিবাদে আত্মসমর্পণ করতে পারে, যার ভিত্তিতে নিজদের পারস্পরিক সকল বিরোধ ও মনোমালিন্য দূর করে নিতে পারে। ফলে আণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে একটি কমিশন নিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও তা নিয়ন্ত্রিত হতে পারছে না, তার নিয়ন্ত্রণ যেনে নিচ্ছে না কেউই।
সর্বজাতি পুলিশ বাহিনী
জাতিসংঘের এই ব্যর্থতা, পঙ্গুতা ও অকর্মণ্যতা দেখে প্রাক্তন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড এটলী সম্প্রতি এক ভাষণে বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক পুলিশ বাহিনী গঠন করা আবশ্যক। জাতিসংঘের হাতে নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই বলে তার কোন সিদ্ধান্তই কার্যকরী হতে পারছে না। অতএব জাতিসংঘের হাতে এই আন্তর্জাতিক পুলিশ বাহিনী থাকা একান্তই আবশ্যক। তাহলে জাতিসং স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করতে পারবে।
এ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা মেনে নেয়া কঠিন। বর্তমানে শুধু প্রস্তাব পাস করা ও সিদ্ধান্ত করার ক্ষেত্রেই যখন জাতিসংঘ কোন নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করতে পারছে না, পারছে না দুনিয়ার জাতিসমূহের প্রতি নির্বিশেষ ও নিরপেক্ষ ইনসাফ করতে, তখন তার হাতে আন্তর্জাতিক পুলিশ বাহিনী থাকলে কোন কল্যাণ লাভ করা সম্ভব হবে? এখনি যখন পক্ষপাতিত্ব ও না-ইনসাফী হয়ে যাচ্ছে, তখন তার হাতে পুলিশ বাহিনী থাকলে তাও যে সেই পক্ষপাতির ও জুলুমের কাজে ব্যবহৃত হবে, তা কে রোধ করতে পারবে? শক্তি বা হাতিয়ার নিজেই কখনো শাস্তি স্থাপন করতে পারে না, সেজন্য সর্বপ্রথম চাই শাস্তি স্থাপনের জন্য অপরিহার্য নিরপেক্ষ ও ইনসাফের নীতি এবং সর্বজনগ্রাহ্য এক উন্নত আদর্শ ।
বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব
জাতিসংঘের যুদ্ধপ্রতিরোধ ও বিশ্বশান্তি স্থাপন ক্ষমতার প্রতি হতাশ ও নিরাশ হয়ে একালের সেরা দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বার্ট্রান্ড রাসেল বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেছেন। তিনি মনে করেন, এই বিশ্বরাষ্ট্র গঠন না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বের যুদ্ধাশংকা তিরোহিত হতে পারে না, পারে না বিশ্ব সমস্যার সমাধান হতে। কিন্তু বিশ্বরাষ্ট্র যে হাওয়ার উপর কায়েম হতে পারে না, তার জন্যে চাই বিশ্বমত এমন একটি মতাদর্শ যা দুনিয়ার সব মানুষ, সব জাতি অকুণ্ঠভাবে মেনে নিতে পারে, অন্তত মেনে নিতে কোন দুর্লংঘ্য বাধা হতে পারে না। এবং বর্তমান বিশ্বের জাতিগুলোর সামনে এই বিশ্বমত বলতে যে কিছুই নেই, একথা রাসেল এত বড় দার্শনিক হয়েও খেয়াল করলেন না কেন তা বুঝে উঠা মুশকিল ব্যাপার।
রাসেলের প্রস্তাবে বলা হয়েছে। এই বিশ্বরাষ্ট্র গঠন করতে হবে ফেডারেশন পদ্ধতিতে। অর্থাৎ বর্তমান দুনিয়ার জাতীয় রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে বিশ্বরাষ্ট্র গঠন করা হবে, সর্বজাতির সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে।
কিন্তু দুনিয়ার জাতীয়তাবাদের পরিণাম ও বর্তমান জাতিসংঘের দৃষ্টিতে স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ জাতিসমূহের ভূমিকায় দৃষ্টিতে প্রস্তাবিত বিশ্বরাষ্ট্রের ব্যর্থতাও পরিস্ফুট হয়ে উঠে। কেননা দুনিয়ায় আজ পর্যস্তকার যুদ্ধবিগ্রহগুলো তো জাতীয়তা জাতীয় হিংসা বিদ্বেষ ও পররাষ্ট্র লোলুপতার কারণে সংঘটিত হয়েছে, Nationalism।
বর্তমান Nationalism ই হচ্ছে বিশ্বশান্তি স্থাপনের পথে প্রধানতম বাধা। একথা প্রত্যক্ষ করার পর সেই জাতীয়তাভিত্তিক বিশ্বরাষ্ট্রের সাফল্যে আশাবাদী হওয়া কি করে সম্ভব হতে পারে? আজ এ জাতিগুলোকে আদর্শানুগ করে তোলার এক গ্রন্থিতে বেঁধে রাখার রজ্জু কি আছে? মধ্যযুগের ইউরোপে পোপদের কর্তৃত্বই ছিল জাতিসমূহের মিলসূত্র, সব জাতিই পোপদের কর্তৃত্ব অন্ধভাবে মেনে নিত, কিন্তু এখন সে পোপতন্ত্রের অবসান হয়েছে। বর্ণ, ভাষা, ধর্ম কোন কিছুই বিশ্বজাতিসমূহের মাঝে মিলন ও ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে না। তাহলে এ বিশ্বরাষ্ট্র কায়েম হতে পারে কিরূপে, কায়েম হয়ে টিকতেই বা পারবে কয়দিন, আর নিরপেক্ষ ইনসাফ কায়েম করাই বা তার পক্ষে কি করে সম্ভব?
বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টা
আণবিক যুদ্ধের আশংকায় ভীত-বিহবল পৃথিবীর বিজ্ঞানীগণের ধারণা: জাতিসংঘই আণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারে। সম্প্রতি ৭২০ জন বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবি জাতিসংঘের নিকট সেজন্যে এক আবেদন পেশ করেছেন। এ আবদনের ফল যে কিছুই নয়, কেবল আবেদন নিবেদন ও স্বাক্ষর অভিযান দ্বারাই যে আণবিক যুদ্ধের আশংকা তিরোহিত হতে পারে না, এ সোজা কথাটুকু বিজ্ঞানী বুদ্ধিজীবীদের বোঝা উচিত। যার হাতে এ অস্ত্র রয়েছে, সে যদি এর ব্যবহারের পথে কোন বাধার সম্মুখীন না হয়, নিজের ভেতরেও সেজন্য কোন তাকীদ অনুভব না করে, তাহলে কেবল বিজ্ঞানীদের আবেদনের কারণে তার ব্যবহার কেউ বন্ধ করবে না।
বিশ্ব সমস্যা সমাধানের কার্যকরী পথ
এই আলোচনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত মানব জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক ও বিভাগের প্রকৃত সমস্যা সুপরিস্ফুট করে তুলতে চেষ্টা করা হয়েছে, সেই সঙ্গে ইশারা ইঙ্গিতে একথাও বুঝাতে করা হয়েছে যে, এসব সমস্যার সমাধানের জন্য আজ যত চেষ্টাই করা হয়েছে, তা সবই নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এতে করে জনগণের মনে এ প্রশ্ন তীব্রভাবে জাগতে পারে যে, তাহলে মানবতার মুক্তি কোথায়, কিভাবে সম্ভৰ সমস্যাসমূহের সমাধান, কিরূপে সম্ভব অপেক্ষাকৃত উন্নত পদ্ধতিতে বিশ্বশান্তি স্থাপন?
এ সম্পর্কে আমাদের চূড়ান্ত মত এই যে, ইসলামী জীবনাদর্শ ব্যতীত মানব জীবনের এই সব সমস্যার কোন সমাধানই সম্ভব নয়। আদর্শ ও নীতির দিক দিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করলেই একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হতে পারে। আর বিশ্বসমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হতে পারে না বিশ্বরাষ্ট্র ব্যতীত, হতে পারে না বিশ্বশান্তি স্থাপন ।
কিন্তু এ বিশ্বরাষ্ট্রের জন্যে অপরিহার্য হচ্ছে একটি বিশ্বমত, নির্বিশেষে সর্বজন গ্রাহ্য একটি মতাদর্শ। এরূপ একটি বিশ্বমত হতে পারে শুধু তাই, যাতে সর্বপ্রথমেই স্বীকৃত হবে দুটো কথা
১। বিশ্ব স্রষ্টার প্রভুত্ব, সার্বভৌমত্ব এবং
২। বিশ্বমানবের একত্ব, ঐক্য, একবংশ জাত ও পরস্পর ভাই ভাই হওয়া। বর্তমান দুনিয়ার মতবাদসমূহের মধ্যে ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন মতই এইরূপ আদর্শিক বুনিয়াদ ছাড়া বিশ্বরাষ্ট্রও সম্ভব নয়, বিশ্বশান্তিও স্থাপিত হতে পারে না।
বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘কোন আন্তর্জাতিক প্রভুত্ব সম্পন্ন শক্তির সম্মুখে পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার না করলে অকৃত্রিম আত্মসমর্পণের সাথে নিজেকে সোপর্দ না করলে দুনিয়ার মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই আন্তর্জাতিক প্রভুত্বসম্পন্ন শক্তি কে, এরূপ এক সত্তা পেশ করতে পারে কোন মতাদর্শ?
ইসলাম খোদা সম্পর্কে যে ধারণা ও আকীদা পেশ করেছে তার দৃষ্টিতে ইসলামের খোদাই হতে পারেন সেই আন্তর্জাতিক প্রভুত্ব ও মর্যাদাসম্পন্ন সত্তা। দুনিয়ার অপর কোন মতবাদ খোদা সম্পর্কে সেরূপ ধারণা কেন দেয়নি, যাতে করে তাদের মত অনুযায়ী খোদাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পন্ন সত্তারূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। অতএব বিশ্বরাষ্ট্র স্থাপন ও বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্যে ইসলামের খোদাকে চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব ও প্রভুত্বের মালিক সত্তা মনে করেই এদিকে অগ্রসর হতে হবে। কেবল জাতিসমূহের সমন্বয়ে গঠিত World state ই একাজ করতে সমর্থ হবে না, যেমন আজ পর্যন্ত তেমন কোন প্রতিষ্ঠানই তা করতে পারেনি।
দ্বিতীয় বিষয় সম্পর্কে বিবেচনা করলেও আমরা দেখতে পাই, দুনিয়ার মতবাদগুলি মানুষকে মানবতাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে দিয়েছে এবং সে ভাগের ভিত্তি হচ্ছে বংশ, বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা এবং শ্রেণী- অর্থনৈতিক শ্রেণী। আর গণতন্ত্রের যুগে তা হচ্ছে ভৌগোলিক আঞ্চলিকতা ভিত্তিক জাতীয়তা। পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, মানুষের পরস্পরের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ সৃষ্টির এ মতগুলোই হচ্ছে মূলগত কারণ। মতবাদের জগতে একমাত্র ইসলামই হচ্ছে এমন এক আদর্শ, যাতে মানুষকে এসব বৈষয়িক ও বস্তুমূলক জিনিসর ভিত্তিতে ভাগ করেন। এগুলোর দিক দিয়ে মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, ইসলাম সেগুলোকে অতি স্বাভাবিক পার্থক্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে; কিন্তু এগুলোর ভিত্তিতে মানবতার মধ্যে অধিকারও মর্যাদার ক্ষেত্রে কোনরূপ পার্থক্য, তারতম্য ও অগ্রাধিকার সৃষ্টি করতে ইসলাম আদৌ প্রস্তুত নয়। ইসলাম মানুষের মধ্যে শুধু মাত্র একটি দিক দিয়েই পার্থক্য করে, তা হচ্ছে ইসলাম পালন করা ও না করার দিক। কিন্তু এ কারণেও মানুষের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করা হয় না, অগ্রাধিকার ও মর্যাদার দিক দিয়ে পার্থক্য করা হয় মাত্র।
মতবাদসমূহের পরিণাম
দুনিয়ায় মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনের সূচনা থেকেই বিভিন্ন মতবাদেরও সূচনা হয়েছে। কতশত মতবাদ যে দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত মানুষের নিকট পেশ করা হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বর্তমানে মতবাদ হিসেবে যে কয়টির স্থিতি এখনো দেখা যায়, তার মধ্যে রাজতন্ত্র, ডিক্টেটরশিপ, গণতন্ত্র ও কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র- এ কয়টিরই নাম করা যেতে পারে। আমরা পূর্বের দীর্ঘ আলোচনায় দেখেছি যে, এ মতগুলোর কোনটিই মানুষের জীবন-সমস্যার সুষ্ঠু ও সঠিক কোন সমাধানই দিতে পারেনি। বরং দুনিয়ার যাবতীয় সমস্যাই মূলত: সৃষ্টি হয়েছে এসব মতবাদের কারণে। এ গুলোর এ ব্যর্থতার পর মানবতা হয়ত আশান্বিত হয়ে থাকতে পারে যে, এতদাপেক্ষাও উন্নত ও কল্যাণকর কোন মতাদর্শ রচিত হবে এবং মানবতার যাবতীয় সমস্যার সমধান করে দেবে। কিন্তু বিগত তিন চারশ বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস একথা প্রমাণ করে যে, কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের পর আর কোন মতাদর্শই মানবসমাজে রচিত হয়নি, উদ্ভাবিত হয়নি। এতে করে একথা জোর করেই বলা যেতে পারে যে, দুনিয়ায় আর কোন নতুন মতবাদ আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, আদর্শ ও মতবাদের দিক দিয়ে দুনিয়ার মানবতা বন্ধ্যা হয়ে গেছে। বর্তমানের মতবাদসমূহের তুলনায় উন্নত ও অধিকতর মানবতাবাদী আর কোন মতবাদ রচিত হওয়া বাস্তবিকই সম্ভব নয়। আমি আবার বলছি, মানুষের জন্য সামগ্রিক কল্যাণের নিয়ামক হতে পারে কেবলমাত্র সেই মতাদর্শ, যা যুগপতভাবে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার একই মূলসূত্রভিত্তিক সমাধান পেশ করতে পারবে। এরূপ মতবাদ ইসলাম ভিন্ন আর কিছুই হতে পারে না। কাজেই এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আমরা বাধ্য হচ্ছি, এ সিদ্ধান্ত ছাড়া বিশ্বের মানবতার কোন গতিই নেই যে, ইসলাম হচ্ছে বিশ্বমানবতার ভবিষ্যৎ, একমাত্র রক্ষাকবচ। এই ইসলামকে বাস্তবায়িত করা না হলে দুনিয়ার ধ্বংস অনিবার্য।
এজন্য দুনিয়াবাসীর সামনে দুটো মাত্র পথ খোলা রয়েছে। হয় ইসলামকে পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে এবং তারই ভিত্তিতে মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে এ ধ্বংসোন্মুখ বিশ্বকে রক্ষা করতে হবে। আর তা না হলে চূড়ান্তভাবে ধ্বংসকে বরণ করে নিতে হবে। সে ধ্বংস যে কবে হবে তা যদিও নির্দিষ্ট করে বলা যায় না; কিন্তু ধ্বংস যে নিশ্চিত, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার মাঝখানে তৃতীয় কোন পথ হতে পারে না।
কাজেই আজ ইসলামের ‘প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমি বিশ্ব-মানবকে কোরআনের আকুল আহ্বান জানাচ্ছি:
تعالوا إلى كلمة سواء بيننا وبينكم الا نعبد إلا الله ولا نشرك به شيئا ولا يتخذ بعضنا بعضا أربابا من دون الله
-“এসো হে মানুষ! এমন একটি কথার দিকে, যা তোমাদের ও আমাদের মাঝে সব দিক দিয়েই সমান। তা হচ্ছে এই যে, (আমরা ও তোমরা মিলে এই নীতি অবলম্বন করব যে,) আমরা এক আল্লাহ ব্যতীত আর কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করব না, তাঁর সাথে কাউকেই (কোন জিনিসকেই) শরীক করব না: এমনকি আমরাও পরস্পর পরস্পরকে রব বলে মেনে নেব না; খোদাকে বাদ দিয়ে।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৬৪)
নবী করীম (সা.) বলেছেন:
إن ربكم واحد وإن أباكم واحد كلكم من آدم وآدم من تراب
-“নিশ্চয়ই তোমাদের খোদা এক এবং সকলের পিতা নিশ্চয়ই একজন। অর্থাৎ তোমরা সকলেই আদম বংশজাত। আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।
সৃষ্টিকর্তার একত্ব ও তওহীদ-বিশ্বাস মানুষের জন্যে অপরিহার্য, নিরপেক্ষ ও সার্বভৌম শক্তি উপস্থাপিত করে। যে সমাজের মানুষ ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে খোদাকেই একমাত্র সার্বভৌম সত্তারূপে স্বীকার করে নেয়, সে সমাজে ব্যক্তিদের জীবনে প্রকৃতই কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে না, কোন সমস্যা দেখা দিলেও খোদায়ী সার্বভৌমত্তের বুনিয়াদে তার সুষ্ঠু সমাধান অনতিবিলম্বে করে যেতে পারে। এ আলোচনায় সবিস্তারে যে সব সমস্যার উল্লেখ করা হয়েছে তার কোন একটি ও এমন নয়, যার সমাধান খোদায়ী সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে করা যায় না। বিশেষতঃ মানবীয় প্রভুত্বের কারণে বিশ্বব্যাপী যে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে তা নিমিষে নিঃশেষ হতে পারে। কেননা খোদাকে চূড়ান্ত সার্বভৌম শক্তিরূপে মেনে নিলে কোন ব্যক্তিই নিজে প্রভুত্বের লোভী হতে পারে না। এরই সঙ্গে সারা বিশ্বের সমগ্র মানুষের একত্ব ও অভিন্নতার ধারণাকেও মিলিয়ে দেখা আবশ্যক। সমগ্র মানুষ যদি পরস্পরকে একই বংশোদ্ভূত ও সমান ভাই মনে করতে পারে, তা হলে বর্তমান সময়ে মানুষের পরস্পরে যে হিংসা দ্বেষ, যে শ্রেণী-পার্থক্য, যে উঁচু নিচের, আশরাফ আতরাফের, কালো ধলার তারতম্য রয়েছে, যা মানুষের জীবনকে আজ দুর্বিসহ করে তুলেছে, তা নিমিষে বিলীন হয়ে যেতে পারে এবং এ দু’য়ের বিনিময়ে স্থাপিত হতে পারে এমন এক বিশ্বরাষ্ট্র, যা বিশ্বমানবের কোন সমস্যাকেই অসমাধিত রাখবে না। এ বিষয়টিকে আমাদেরকে আরো একটু গভীর দৃষ্টিতে সবিস্তারে বিচার করে দেখতে হবে। অন্যথায় এ কথা কয়টির গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করা যাবে না। সেজন্যে এখানে আরো খানিকটা আলোচনা করা যাচ্ছে।
উপরে যে দুটো নীতির কথা বলা হয়েছে তা স্বীকার করে নিলে সবচেয়ে বড় কাজ হবে এই যে, মানুষের চিন্তা ও মানসিকতার এক আমূল পরিবর্তন সূচিত হবে। প্রাচীন অবস্থার অবসানে সৃষ্টি হবে এক নতুন রকমের চিন্তা ও মানসিকতা। চিন্তাপদ্ধতি, জীবনের উদ্দেশ্য, চেষ্টা সাধনা ও যাবতীয় কাজ কর্মের লক্ষ্য বদলে যাবে। এক কথায় বলা যায়, এ নীতি গ্রহণ করলে প্রাচীন মানুষ থেকে এক নতুন মানবসমাজ গড়ে উঠবে। বর্তমানের বস্তুবাদী ও জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী খতম হয়ে গিয়ে সেখানে দৃঢ়মূল হবে খোদাবাদী দৃষ্টি। জীবন দর্শন ও জীবন বিধানও সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হবে। বস্তুত: ইসলাম খোদা সম্পর্কে যে ধারণা পেশ করেছে, তার কাছে দুনিয়ার অন্যান্য দার্শনিক ও ধর্মবিদদের পেশ করা ধারণার কোন তুলনা কোন সামধ্যই হতে পারে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে খোদা কেবলমাত্র সর্বাত্মক, সর্বজ্ঞ ও মহান, পবিত্র সত্তাই নন, তাঁর সাথে মানুষের দৈনন্দিন জিন্দেগীর সরাসরি সম্পর্কও রয়েছে। মানব জীবনের জন্যে তিনি সব সময়ই বিধান ও ব্যবস্থা প্রেরণ করেছেন। আর তার সর্বশেষ বিধান পাঠিয়েছেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদের (সাঃ) মারফতে, যা কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হবে। সূরা বাকারার ২৫৫ আয়াতে আল্লাহ নিজেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,
الله لا إله إلا هو الحي القيوم – لا تأخذه سنة ولا نوم – له ما في السماوات وما في الأرض
ইসলামের এ তওহীদ দর্শনের ভিত্তিতে আমরা পাঁচটি মূলনীতি অনায়াসে পেতে পারি, যার ভিত্তিতে বর্তমান দুনিয়ার মানুষের সর্ববিধ সমস্যার সমাধান অতি সহজেই লাভ করতে পারি। মূলনীতিগুলো যথাক্রমে এখানে পেশ করা যাচ্ছেঃ
১। দুনিয়ার কোন ব্যক্তি বা জাতি নিজের ও নিজ দেশ ও জাতির নিরঙ্কুশ সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ ও ব্যবহারের অধিকারী হতে পারে না। এ মূলনীতি গ্রহণ ও কার্যকরী হলে একদিকে যেমন ব্যক্তিদের পরস্পরের ঝগড়া বিবাদ ও হিংসাদ্বেষের অবসান হবে, তেমনি মানবীয় প্রভুত্বের কারণে উদ্ভূত এই যুদ্ধ-বিগ্রহ, রেষারেষি, হিংসা-দ্বেষ ও লুঠতরাজজনিত অশান্তিরও মুলোৎপাটন হতে পারে।
২। সারা দুনিয়ার সার্বভৌমত্ব ও প্রভুত্বের একচ্ছত্র মালিক হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ।
দুনিয়ার সব মানুষ ও সব জাতি তাঁরই অধীন, তারই প্রজা। প্রথমেই নেতিবাচক মূলনীতির পর এ অস্তিবাচক মূলনীতি প্রভুত্ব সার্বভৌমত্বের যাবতীয় কোন্দল দূর করতে পারে। তাছাড়া এর ভিত্তিতে এই বিশ্ব প্রকৃতিতে মানুষের যে আসল ও প্রকৃত মর্যাদা তা সুপ্রকট হয়ে উঠে। আল্লাহ তায়ালা এই দুনিয়ার কাউকেই প্রভুত্ব ও চূড়ান্ত মালিকানা কর্তৃত্ব দান করেননি। বরং মানুষকে করেছেন এ দুনিয়ায় তাঁর প্রতিনিধি, তাঁর কর্মচারী। এদের কাজই হচ্ছে সকল ব্যাপারে প্রকৃত মালিক খোদার মর্জি মোতাবেক কাজ করা, তাঁরই সন্তোষ বিধানকে লক্ষ্যস্থলে পরিণত করা। এ নীতি মানুষের প্রকৃতি ও মনস্তত্ত্বের সাথেও পূর্ণসামঞ্জস্যশীল। তাই খোদাকে একমাত্র চূড়ান্ত প্রভু ও সার্বভৌম শক্তিরূপে মেনে নিতে কারো মনে কোন দ্বিধা বা সংকোচ থাকতে পারে না। মানুষের গোলামী করায় মানুষের যে কোন মর্যাদাই থাকতে পারে না, বরং তার বদলে সকল মানুষ মিলে এক খোদার গোলামী করায় যে সাম্য ও শান্তি বিরাজমান, এ কথা সকলের পক্ষেই সহজবোধ্য হতে পারে।
তাহলে, মানুষ জীবনবিধান ও আইন কানুন কোথা থেকে পাবে, মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তেই যার প্রয়োজন দেখা দেয়? এর জবাব তৃতীয় মূলনীতিতেই পাওয়া যায়।
৩। দুনিয়ার প্রত্যেকটি দেশ ও জাতির একমাত্র কাজ হচ্ছে প্রকৃত মালিক ও বিধানদাতার দেয়া বিধান সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ ও অনুসরণ করে চলা, যা তিনি তাঁর নবীদের শেষ নবীর মাধ্যমে নাজিল করেছেন। আল্লাহ বাস্তবিকই মানব জাতিকে নিরুদ্দেশ ও অন্ধকারে হাতড়ে মরার জন্যে সৃষ্টি করেননি; নিতান্ত অসহায় করেও ছেড়ে দেননি এই পৃথিবীতে। বরং সব সময়ই তিনি পথ নির্দেশ করেছেন, জীবন যাপনের সার্বিক বিধান দান করেছেন, দিয়েছেন শাসন ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় আইন-কানুন।
৪। দুনিয়ায় সব মানুষ শুরু থেকেই মানুষ এবং একই মা ও বাবার ঔরসজাত সন্তান। স্মরণাতীতকাল থেকে মানুষে মানুষে বর্ণ, বংশ ও ভাষা ইত্যাদির দিক দিয়ে তারতম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব কারণে পার্থক্য করা হচ্ছে তাদের মৌলিক মানবীয় অধিকারে।
বর্তমানেও এ জিনিস প্রচণ্ডরূপে বর্তমান। ফলে মানুষের পরস্পরে হিংসা দ্বেষ, রেষারেষি ও টানা হেঁচড়া প্রাণান্তকর হয়েছে। আজ পর্যন্ত কোন চেষ্টা ও ব্যবস্থাই এর অবসান করতে সমর্থ হয়নি, কিন্তু খোদার তাওহীদ-দর্শনই হচ্ছে এসব শেষ করার একমাত্র অমোঘ হাতিয়ার। আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেছেন জলদ গম্ভীর স্বরে:
ياأيها الناس إنا خلقناكم من ذكر وأنثى وجعلناكم شعوبا وقبائل لتعارفوا إن أكرمكم عند الله أتقاكم إن
الله عليم خبيره
“হে মানব জাতি, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একই পুরুষ (পিতা) ও স্ত্রী (মাতা) থেকে এবং তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন কবীলা ও গোত্রে এ উদ্দেশ্যে যে, তোমরা পরস্পরের নিকট পরিচিত হবে। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মাঝে অধিক সম্মানার্হ ব্যক্তি সেই, যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুই জানেন, সব বিষয়ে ওয়াকিফহাল।” (সূরা হুজরাত, আয়াত-১৩)
৫। এই জীবনের অবসানের পর আর একটি জীবন আসবে, যেখানে সব মানুষই উপস্থিত হবে, হতে বাধ্য হবে খোদার সম্মুখে এবং সেখানে নিজ নিজ দুনিয়ার জীবনের কাজ কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিবে ।
এ নীতিটি প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন সুষ্ঠু ও সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ মূলনীতি বিশ্বাস না করলে কোন মানুষই মানবতার নিঃস্বার্থ খেদমত করতে পারে না। পারে না মানুষ অপর মানুষের উপর থেকে যুলুম শোষণ নির্যাতন বন্ধ করতে। এটি বিশ্বাসই মানুষকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পাপ ও অন্যায় আচরণ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম। এ বিশ্বাসের প্রভাবে মানুষের মনস্তত্ত্বে, মানসিকতায়, দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজে কর্মে, আচরণে, চেষ্টা সাধনা ও শ্রমমেহনতে এক মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। বিশ্বে প্রকৃত ও স্থায়ী শান্তি সর্বক্ষেত্রে সর্বব্যাপী শান্তি-স্থাপন করার উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না এ বিশ্বাস ছাড়া। এ বিশ্বাস হচ্ছে ইসলামী আদর্শের অন্যতম ভিত্তি।
আন্তর্জাতিক ক্ষমতা–ভারসাম্য
বর্তমান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেখানে মাত্র দুটো শিবিরের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব দেখা যায় এবং যার ফলে যুদ্ধাশংকা দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে, এর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে আবশ্যক হবে দুনিয়ার নিরপেক্ষ কতগুলি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি তৃতীয় শিবির গঠন করা। উপরে ইসলামের যে দুটো বুনিয়াদের উল্লেখ করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে যদি একটি রাষ্ট্র কোথাও স্থাপিত হয়, তাহলে অনতিবিলম্বে আরো কতগুলো নিরপেক্ষ এবং উক্ত বুনিয়াদঘয়ে বিশ্বাসী রাষ্ট্রের এক আন্তর্জাতিক জোট তৈয়ার হতে পারে এবং এ রাষ্ট্রজোটই উভয় শিবিরের মাঝখানে থেকে ক্ষমতার এক ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারে। এ রাষ্ট্রজোট যেমন নিজদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রকে গড়ে তুলবে উক্ত বুনিয়াদদ্বয়ের ভিত্তিতে গড়া জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী, তেমনি উভয় শিবিরের মাঝখানে তা বিশ্বমানবতাকে এক তৃতীয় আলোকজ্জ্বল পথের সন্ধান দেবে। এ রাষ্ট্রজোট যদি মাঝখানে থেকে আণবিক শক্তির ন্যায় সকল প্রকার প্রলযংকরী অস্ত্রের ব্যবহার করার বিরোধিতা করে, যুদ্ধ না করার জন্যে যদি ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপের সৃষ্টি করে, তাহলে, বর্তমানের যুদ্ধাশংকা অপেক্ষাকৃতভাবে অনেকখানি হ্রাস পাবে। এ রাষ্ট্রজোট যদি সত্যিই আদর্শবাদী ও নীতিপরায়ণ হয়, মানবকল্যাণকর নীতির উপর যদি দৃঢ়তাসহকারে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাহলে বর্তমান দুনিয়ার শক্তিদ্বয়ও তাকে সমীহ না করে কিছুতে পারবে না, একথা নিঃসন্দেহ।
বর্তমানের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের জন্যে এ অপরিহার্য ভূমিকা কে কেন গ্রহণ করবে, তাই হচ্ছে আজকের এক অমোঘ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের জওয়াব দিতে পরে কে? আমাদের বিচারে এ প্রশ্নের সঠিক ও বাস্তব জওয়াব দিতে পারে একমাত্র পাকিস্তান, পাকিস্তানই আজ এক আন্তর্জাতিক ইসলামী জোট তৈরী করে দুনিয়ার পরিস্থিতিই বদলে দিতে পারে অতি সহজেই, কিন্তু পাকিস্তান এ কঠিন- এ বিরাট দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত কিনা, তা এখানকার অধিবাসী জনগণেরই বিবেচ্য। (ইসলামী সেমিনারের প্রথম দিনের (৩রা মার্চ ৬১) প্রথম অধিবেশনে প্রদত্ত উদ্বোধণী ভাষণ)
১৯৩২ সনে লীগ অব নেশান্স এর International Institute of Intellectual co-operation এর ফরমায়েশ অনুযায়ী প্রফেসর আইনস্টাইন দার্শনিক ফ্রয়ডের নিকট জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মানবতাকে যুদ্ধের নির্মমতা থেকে রক্ষা করা যায় কি?”
বহু বৎসর অতীত হয়ে গেছে এ প্রশ্ন উঠেছিল, এরপর আর একটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে গেছে; কিন্তু এর সঠিক জওয়াব আজও দেওয়া হয়নি। এর জওয়াব দুটো দিক দিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে ।
যুদ্ধ একেবারে হতে পারবে না যে কাজ করলে বা যে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, তা গ্রহণ করে যুদ্ধাশংকা সম্পূর্ণরূপে দূর করে দেওয়া। তখন আণবিক যুদ্ধের কোন আশংকাই থাকবে না, তার সম্ভাবনাই একেবারে শেষ হয়ে যাবে, এরূপ জওয়াব একমাত্র খোদাই দিতে পারেন, অপর কোন শক্তি নয় ।
আর একটি জওয়াব হচ্ছে, যুদ্ধের প্রকৃত কারণ, মানবীয় প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের দাসত্ব খতম করা। এরূপ করতে পারলে নিঃসন্দেহে যুদ্ধাশংকা দূর হবে।
আমাদের কর্তব্য হচ্ছে দুনিয়া থেকে মানবীয় প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব খতম করা | এবং খোদায়ী প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় বুনিয়াদে প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্যে সাধনা করা, সংগ্রাম করা, জিহাদ করা।
-এ জওয়াব কি আমাদের ভাল লাগে?


