১৯৯৯ সালে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের আবির্ভাব। কয়েক মাস পরেই যখন Yeltsin অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করেন আর পুতিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের শাসকগণ আবারও অবাক হয়ে যায় যে কিভাবে এই অপরিচিত ব্যক্তি মিডিয়ার সামান্য সাহায্য নিয়ে এত বিপুল সংখ্যক সমর্থন পেল।
পুতিনের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় সাত বছর আগে, আর আমি তখন নতুন রাশিয়ায় তার এই দ্রুত আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিস্মিত ছিলাম না। আমাদেরকে পুতিনের কাছে উপস্থাপন করেন Yevgeny Primakov, যিনি ‘রাশিয়ান কিসিঞ্জার’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তার সাথে আমার মস্কোতে স্নায়ু যুদ্ধের সময় বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিলো যখন আমি প্রেসিডেন্ট কেনেডি, জনসন, নিক্সন এবং ফোর্ড এর উপদেষ্টা ছিলাম। প্রিমাকভ কোনো যেন-তেন চিন্তাবিদ ও লেখক ছিলেন না। তিনি বিশ্বের জাতীয় নেতাদের সাথে গোপন আলোচনা পর্যালোচনায় ক্রেমলিনের বিশেষ দূত ছিলেন। Yeltsin যখন তার উপদেষ্টা আনাতোলি সোবাচকে রাশিয়ার সবচেয়ে ভালো এবং যোগ্য লোকদের খুঁজে বের করা ও বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োগের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তখন পুতিন ছিলেন সেই তালিকার শীর্ষে, যিনি সে সময় তার নিজ শহর সেন্ট পিটার্সবার্গের একজন স্থানীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাই বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো শেখাতে প্রিমাকভ পুতিনকে তার অধীনে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে প্রিমাকভ কিসিঞ্জারকে পুতিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ধীরে ধীরে তাদের মাঝে সম্পর্ক আরো গভীর হতে থাকে। প্রিমাকভ ও কিসইঞ্জার দীর্ঘ সময় নিয়ে পুতিনকে ভূ-রাজনীতি এবং ভূ-নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, কেননা তারা পুতিনের মধ্যে একজন শক্তিশালী নেতার বৈশিষ্ট্য দেখেছিলেন। এটা পুতিনের ভূ-রাজনীতি সম্পর্কিত দীর্ঘ পাঠ শোনার সক্ষমতাও দেখিয়েছিলো, কেননা আমি শেখার ক্ষেত্রে তড়াহুড়ো করতাম।
১৯৯২ সালে, আমি সিএসআইএস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের একজন মিটিং অর্গানাইজার এর কাছ থেকে একটি কল পেয়েছিলাম যাতে আমাকে কিসিঞ্জার এবং সোবচাকের সভাপতিত্বে মার্কিন-রাশিয়া সেন্ট পিটার্সবার্গ কমিশনে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। উদ্দেশ্য হবে পশ্চিমাদের সাথে ব্যবসা ও ব্যাংকিংয়ের রাস্তা তৈরীর জন্য নতুন রাশিয়ান নেতৃত্বকে সাহায্য করা। পশ্চিমা সদস্যদের বেশিরভাগই হবেন প্রধান মার্কিন ও ইউরোপীয় কোম্পানির সিইও এবং একইসাথে নতুন রাশিয়ান সরকারের প্রধান কর্মকর্তা। আমি একজন বিশেষজ্ঞ হিসাবে সেখানে উপস্থিত থাকবো। আমাকে বলা হয়েছিল যে “মিস্টার প্রিমাকভ” ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করেছেন যে আমি এখানে অংশগ্রহণের জন্য সময় দিতে পারব কিনা। আমি এই ধরনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আর সেই সাথে আমি উদীয়মান রাশিয়ান নেতৃত্ব সম্পর্কে, বিশেষ করে পুতিন সম্পর্কে খুবই কৌতূহলী ছিলাম।
প্রথম মিটিংয়ে আসার পর, আমি দেখলাম বেশ কিছু লোকজন কিসিঞ্জার এবং অন্য একজনের চারপাশে জড়ো হয়েছে, আমাকে বলা হলো ইনি পুতিন। একজন কর্মকতা আমার দিকে এসে বললেন যে, প্রিমাকভ তাকে বলেছেন আমাকে যেন পুতিনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আমার আসার ঘোষণা দিতেই কিসিঞ্জারের আলোচনা থামিয়ে দিলেন। পুতিন উষ্ণভাবে জানালেন যে, আমি ওয়াশিংটন থেকে পৃথিবীটা কিভাবে দেখি এ নিয়ে তিনি আমার সাথে কথা বলার অপেক্ষায় ছিলেন। আমরা মিটিংয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললাম, আর ডিনারে তিনি তার দোভাষীকে সাথে নিয়ে আমার মুখোমুখী বসলেন। সেই ডিনারে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যবসায়িক সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে আপনার পশ্চিমা ব্যবসায়ী আর আমার রাশিয়ান সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বড় বাধাটি কী?
আমি মাথা খাঁটিয়ে উত্তর দিলাম: “আইনিভাবে সংজ্ঞায়িত সম্পত্তির অধিকার না থাকা – সেগুলি ছাড়া বিরোধ মীমাংসার কোন ভিত্তি নেই।” “ওহ, হ্যাঁ”, তিনি বললেন, “আপনাদের সিস্টেমে বিরোধ সমাধান করা হয় অ্যাটর্নিদের ঘণ্টাপ্রতি ফি প্রদানের মাধ্যমে, কোনো কোনো সময় বিবাদটিকে আদালতে উপস্থাপন করা হয় যা সাধারণত কয়েক মাস সময় নেয়, আর সাথে ঘণ্টাপ্রতি অ্যাটর্নি ফিও জমা হয়। “তিনি বলে চললেন,” রাশিয়াতে বিরোধ সাধারণত মীমাংসা করা হয় সাধারণ বিচার বুদ্ধি দিয়ে। যদি বিবাদটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি কিংবা অর্থ-কে কেন্দ্র করে হয়, তাহলে দুই পক্ষই নিজেদের মধ্য থেকে একটি ডিনারে প্রতিনিধি প্রেরণ করে। প্রত্যেকেই সশস্ত্র অবস্থায় থাকবে। একটি রক্তাক্ত ও ভয়ানক ফলাফলের আশঙ্কার মধ্যে থেকে দুই পক্ষই সম্মত হওয়ার মত সমাধান খুঁজে বের করে। এক্ষেত্রে, ভয় সাধারণ জ্ঞানের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।”
তিনি তার সেইদিনের যুক্তি সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছিলেন। কোনো চুক্তি না হলে মীমাংসার জন্য প্রচন্ড ভীতিকর কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়। প্রতিপক্ষকে জোর করে ভয়ংকর কোনো কিছুর মুখোমুখি করার বিষয়টিতে তাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। মূলত তিনি আমার কাছে আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে ইউক্রেনের বর্তমান চরম সংকটাবস্থার বর্ণনা করছিলেন। পুতিন জানেন রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী স্থল যুদ্ধ চালাতে পারবে না। তিনি আরো দেখছেন যে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ চরম অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে মিডটার্ম নির্বাচনের মুখোমুখী হচ্ছেন আর এ অবস্থায় তিনি বৈদেশিক কোনো সমস্যার দিকে খুব বেশী গুরুত্ব দিতে পারবেন না। দুই পক্ষের কাছে চুক্তি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
অন্য একটা ব্যাপারে, পুতিন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওয়াশিংটনে মূলত কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেখানে প্রেসিডেন্ট আর কংগ্রেসের মধ্যে এত জটিলভাবে ক্ষমতা ভাগ করা থাকে। তিনি আরো বলেন, প্রেসিডেন্টের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো কিসিঞ্জার আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন, কিন্তু কিভাবে হাউস, সিনেট আর নির্বাহী শাখাগুলোর রাজনৈতিক ঐক্যমত অর্জন করা হয়েছিলো তা স্পষ্ট করতে পারতেন না। এটা স্পষ্ট ছিল যে তাকে আমার কর্মজীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে বিশেষ ধারণা দেওয়া হয়েছিল। তিনি বললেন কিসিঞ্জার ক্ষমতাধর লোকদের সাথে ডিনারে কিংবা তাদেরকে গাইড করতে অনেক কিছু নিয়ে সাক্ষাৎ করতে পছন্দ করতেন এবং তিনি আমাকে আরো বলেন যে, তাকে জানানো হয়েছে যে আমি ঐকমত্য গঠনের জন্য ব্যাকরুম বা অন্তরালের মিটিং পছন্দ করি আর বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ করে দিই।
আমি ওয়াশিংটনের অনেক কুটনৈতিক ব্যাক্তির স্বার্থ রক্ষা করে চলার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি যার মধ্যে কংগ্রেস, প্রধান সংস্থাগুলি এবং জটিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলো রয়েছে, যেগুলো কোন সিদ্ধান্তের কারণে প্রভাবিত হতে পারে। আমি তাকে নিক্সনের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে প্রথম সাক্ষাতের কথা বলেছিলাম, যিনি বলেছিলেন যে তিনি উভয় প্রধান দলের নেতাদের কাছ থেকে আমার শক্তিশালী সমর্থন দেখে অভিভূত হয়েছেন। যাই হোক, তিনি আরো বলেছিলেন, এর কারণে হোয়াইট হাউসে তার কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে – তাই তাকে সত্যিই জানতে হবে যে আমি রিপাবলিকান নাকি ডেমোক্র্যাট। যার উত্তরে আমি বলেছিলাম, “হ্যাঁ।”
নিক্সন যখন জিজ্ঞাসা করলেন এর মানে কী, আমি বললাম যে, আমি কোনো পক্ষপাতমূলক যোদ্ধা নই বরং আমি একজন সমস্যা সমাধানকারী। কোনো সমস্যার সমাধান পেতে আমি সবসময় সেই সমস্যার উপর নির্ভর করে উভয় পক্ষের মূল ব্যাক্তিদের সাথে কাজ করতে প্রস্তুত থাকব। মনে হচ্ছিলো, পুতিন এটা শুনে বেশ মজা পেয়েছে। পুতিন সম্পর্কে আমি যে ধারণা নিয়ে ফিরেছিলাম তা হচ্ছে, সে এমন একজন মানুষ যিনি পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানী আর ওয়াশিংটনে আমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়া অন্যান্য রাজনীতিবিদদের তুলনায় অনেক বেশী বুদ্ধিমান। বিষয়টি আমাকে শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়, আমি মূলত একটি সিসিলিয়ান এলাকায় বড় হয়েছিলাম, এলাকাটি ছিল মাফিয়াদের নিয়মনীতির মধ্যে যেখানে পরিকল্পনাবিহীন সব অপরাধ নিষিদ্ধ। মনে হয় পুতিনের মধ্যে সিসিলিয়ান মাফিয়া বসের প্রবৃত্তি রয়েছে; যেকোনো কিছুতে সহজেই পুরস্কৃত করা, কিন্তু কোনো নিয়ম ভাঙ্গলে মরণপণ ঝুঁকি।
রাশিয়ার নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার সেই সময়ের দিকে ফিরে তাকালে আমি সেই বহু বছরের অচল ব্রেজনেভ প্রেসিডেন্সির কথা মনে করতে পারি, পরবর্তীতে এন্ড্রোপভ আর চেরেনেঙ্কো তাদের সংক্ষিপ্ত প্রেসিডেন্সির সময়ে একই পথের অনুসরণ করেছেন। ইয়েল্টসিনের ভালো আইডিয়া ছিলো কিন্তু সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন আর তা থেকে দূরে সরে গেছেন। রাশিয়ার একজন শক্তিশালী নেতার খুবই প্রয়োজন ছিলো – আর এজন্যই পুতিন এগিয়ে গিয়েছেন।
আসলে পুতিন নিজেকে কিভাবে দেখেন! তিনি বেশ কয়েকবার পিটার দ্যা গ্রেটের ব্যাপারে প্রশংসা করেছেন, তাই আমি খুব ভালোভাবেই নিশ্চিত হয়েছিলাম যে তিনি নিজেকে তার (পিটার দ্যা গ্রেটের) অবতার (প্রতিমূর্তি) হিসেবে দেখেন। আমি ১৯৮৮ সাল থেকে ক্রেমলিনের অতিথি না হলেও আমাকে বলা হয়েছিলো পুতিন বিভিন্ন মিটিং রুমে পিটার দ্যা গ্রেটের প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে রাখতেন। বাইডেন, ন্যাটো, ইউক্রেনের জন্য এর ভাবার্থ কি তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে (***সম্ভবত পিটার দ্যা গ্রেটের সেই রুশ সম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে***)। যা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে পুতিনের কাছে আরো বেশি কিছু আছে (*** বাইরে থেকে যা দেখা যায় পুতিনের পরিকল্পনা তার চেয়ে আরো বড়।***)
লেখকঃ হারল্যান্ড মলমগ্রেন
লেখক একজন ভূ-রাজনৈতিক কৌশলবিদ, মধ্যস্থতাকারী, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি, লিন্ডন বি জনসন, রিচার্ড নিক্সন এবং জেরাল্ড ফোর্ডের প্রাক্তন সহযোগী।
অনুবাদক: নাজমুস সাকিব নাঈম।