কালচার কি

আমাদের কালচারের কথা জানিতে হইলে আগে বুঝিতে হইবে কালচারটা কি? কালচারের প্রতিশব্দরূপে আমরা সাধারণত ‘কৃষ্টি’, ‘সংস্কৃতি’, ‘তহযিব’ ও ‘তমদ্দুন’ শব্দগুলি ব্যবহার করিয়া থাকি। ধাতুগত অর্থের দিক হইতে বিচার করিলে কিন্তু এর একটাও কালচারের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হইতে পারে না। তবে ‘কৃষ্টি’ শব্দটা কর্ষণ, কালটিভেশন বা চাষ অর্থে কালচারের পরিভাষারূপে ব্যবহার করা হয় বলিয়া অন্য দুইটি শব্দের চেয়ে এইটাই কালচারের বেশি কাছাকাছি-ইংরেজীতে যাকে বলা হয় রিফাইনমেন্ট, আরবীতে যাকে তাহযিব বলা হয়, সংস্কৃতি শব্দটা সেই অর্থে ব্যবহার করা যাইতে পারে। তমদ্দুন শব্দটা নাগরিক অর্থে কালচার অপেক্ষা সিভিলিযেশনের প্রতিশব্দ-রূপেই অধিকতর উপযোগী।

কিন্তু এসব বিতণ্ডা নিরর্থক। কারণ, খোদ কালচারের অর্থ লইয়াই ইংরাজী সাহিত্য এবং ইউরোপ ও আমেরিকার পণ্ডিতদের মধ্যে ঘোরতর মত-বিরোধ রহিয়াছে। সে মত-বিরোধ এত তীব্র যে বাংলায় আমরা ঐ তিনটি শব্দের যে-কোনও একটিকে স্বচ্ছন্দে কালচারের প্রতিশব্দরূপেই বেদেরেগ ব্যবহার করিতে পারি।

কালচারের সংজ্ঞা দেওয়া খুবই কঠিন। এত কঠিন যে উনিশ শতকের মধ্যভাগ হইতে বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পুরা একশ বছরের দীর্ঘ মুদ্দতে ইউরোপ- আমেরিকার দুইজন পণ্ডিতও এ ব্যাপারে একমত হইতে পারেন নাই। তার উপর অনেকেই আবার কালচার ও সিভিলিযেশনকে একই অর্থে ব্যবহার করিয়া বিষয়টাকে আরও জটিল ও সমস্যাটাকে আরও ঘোরালো করিয়া ফেলিয়াছেন। ফলে অবস্থা এই দাঁড়াইয়াছে যে, কালচারকে ডিফাইন করার আর কোনও উপায় নাই; বিশ্লেষণ দ্বারাই উহাকে বুঝিতে হইবে।

 

ইংরাজী সাহিত্যে কালচার শব্দটা প্রথম আমদানি করেন ফ্রান্সিস্ বেকন ষোল শতকের শেষদিকে। উহাকে ডিফাইন করার চেষ্টা করেন সর্বপ্রথম ম্যাথু আর্নন্ড ইংলণ্ডে এবং ওয়ান্ডু ইমার্সন আমেরিকায় উনিশ শতকের মাঝামাঝি; কিন্তু কালচার শব্দের যে অর্থে তাঁরা উহার সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করিয়াছিলেন শব্দটা বেশিদিন সে অর্থে সীমাবদ্ধ থাকে নাই। বিশ শতকের মাঝামাঝি রবার্ট এযরা পার্ক ও টেইলার প্রভৃতি মার্কিন পণ্ডিত এবং টার্নার ও লাঞ্ছি প্রভৃতি ইংরাজ পণ্ডিতগণের লেখায় কালচার শব্দটা অনেক ব্যাপক ও গভীর অর্থে ব্যবহৃত হইতে শুরু করে। এর ফলে শব্দটা নতুন তাৎপর্য গ্রহণ করে। কিন্তু তাতে সমস্যা মিটে নাই। বরঞ্চ শব্দটা ব্যাপকতর ও গভীর হইয়াছে। সম্প্রতি পশ্চিমা সাহিত্যে ‘কালচার’ শব্দটা আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হইতে শুরু করিয়াছে। সেখানে ‘পলিটিক্যাল কালচার’, ‘এথিক্যাল কালচার’, এস্থেটিক কালচার’, ‘রিলিজিয়াস কালচার’ ইত্যাদি কথার প্রচলন হইয়াছে। এসব কথা কিন্তু ‘এগ্রিকালচার’, ‘হটি কালচার’ বা ‘ব্লাড কালচার’ ইত্যাদি টার্মের মত অকৃষ্টিক কোন বিশেষ বিষয় বা বস্তু-জ্ঞাপক নয়। বরঞ্চ মানুষের মন ও মস্তিষ্ক বিকাশের বিশেষ স্তর-বোধক। তার মানে, কোনও সমাজ বা জাতির মনে কোনও এক ব্যাপারে একটা স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার-বিধি, মোটামুটি সার্বজনীন চরিত্র, ক্যারেক্টার, আচরণ বা আখলাকের রূপ ধারণ করিলেই সেটাকে ঐ ব্যাপারে ঐ মানবগোষ্ঠীর কালচার বলা হইয়া থাকে। এ অবস্থায় আজিকার পরিবেশে কালচার সিভিলিযেশনের সীমা-সরহদ্দ ঠিক রাখা এখন খুবই কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। তবু কালচার ও সিভিলিযেশন যে এক নয়, সেটা আমাদের বুঝিতে হইবে। সভ্য জগতের মনীষীরাও সে চেষ্টা করিতেছেন। কারণ এটা যুগের দাবি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপ্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারের দ্বারা দুনিয়াটা যতই ছোট হইতেছে, কালচারের অটনমির প্রয়োজনীয়তা ততই তীব্রভাবে অনুভূত হইতেছে। ফলে কালচার ও সিভিলিযেশনের সীমা নির্ধারণ অত্যাবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। এ সীমা নির্ধারণ ডেফিনিশন দ্বারা সম্ভব নয়-বিশ্লেষণ দ্বারাই তা করিতে হইবে। এখানে সে চেষ্টাই আমি করিতেছি।

 

কালচার বনাম সিভিলিযেশন

সহজ কথায় ব্যষ্টি বা ইন্ডিভিজুয়্যালের যা ব্যক্তিত্ব বা পার্সন্যালিটি, সমষ্টি বা কমিউনিটির তা-ই কালচার। আমরা যখন কোন একজন লোক সম্বন্ধে বলি: ‘লোকটার পার্সন্যালিটি আছে’, তখন আমরা সেই লোকটির এমন কতকগুলি গুণ- সমষ্টির দিকে ইশারা করি, যেগুলি ঐকান্তিকভাবে তার নিজস্ব এবং যারা দ্বারা সে অপর সাধারণ হইতে পৃথক। অথচ ঐ গুণ-সমষ্টি বা পার্সন্যালিটি ঐ লোকটির বিশেষত্ব নয়। কারণ পার্সন্যালিটি আরও অনেক লোকের আছে। পার্থক্য শুধু এই যে, সকলের পার্সন্যালিটি রূপে-গুণে এক নয়। ব্যক্তিত্বে-ব্যক্তিত্বে সুস্পষ্ট পার্থক্য রহিয়াছে। এ পার্থক্যের দ্বারাই তাদেরে চিনা যায়। ঐ পার্থক্যটুকুই তাদের নিজস্বতা। নিজস্বতাই ঐ পার্থক্যের প্রাণ। ঐটুকুই ব্যক্তিত্ব।

ঠিক তেমনি, সকল লোক-সমষ্টিরই অর্থাৎ সব কমিউনিটি সমাজ বা জাতিরই একটা নিজস্ব সমবেত ব্যক্তিত্ব বা কর্পোরেট পার্সন্যালিটি আছে। তারই নাম ঐ লোক- সমষ্টি বা কমিউনিটির কালচার। এই লোক-সমষ্টি বা কমিউনিটিকে আমরা অবস্থা- ভেদে জাতি বা ন্যাশন, উপজাতি বা ন্যাশন্যালিটি, সমাজ বা সোসাইটি, এমন কি পরিবার বা ফ্যামিলি বলিতে পারি, বলিয়া থাকি।

জাতি বা ন্যাশন শব্দটা ইদানিং বেশির ভাগ রাষ্ট্রীয় অর্থেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। নৃতাত্ত্বিক এথনিক্যাল বা র‍্যাশিয়াল অর্থে ততটা নয়। ধর্মীয় অর্থে ত নয়ই। একটি রাষ্ট্রের সব নাগরিক মিলিয়াই ন্যাশন বা রাষ্ট্রীয় জাতি, নৃতত্ত্ব, ধর্ম ও ভাষার দিক দিয়া এক না হইলেও। যেমন আমরা বাংলাদেশীরা এক রাষ্ট্রীয় জাতি বা ন্যাশন, যদিও নৃতত্ত্ব ধর্ম ও ভাষার দিক হইতে আমরা এক নই। অপর দিকে, রাষ্ট্রের নাগরিক না হইলে নৃতত্ত্ব ধর্ম ও ভাষার দিক হইতে এক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের লোক হইয়াও এক ন্যাশন হয় না। যেমন পশ্চিম বাংলার লোকেরা ভাষা ও নৃতত্ত্বের দিক হইতে আমাদের গোষ্ঠী ও সমাজের লোক হইয়াও আমাদের সাথে এক জাতি বা ন্যাশন নয় এবং ভারতীয় মুসলমানেরা ধর্ম, নৃতত্ত্ব ও ভাষার দিক হইতে এক গোষ্ঠী এক সমাজের লোক হইয়াও আমাদের ন্যাশনের লোক নয়।

কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় জাতির পার্সন্যালিটি অর্থাৎ কালচার এক নাও হইতে পারে। একই ন্যাশনের ভিতরে একাধিক ন্যাশনালিটি থাকিতে পারে। তৎকালীন যেমন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা একই রাষ্ট্রীয় ন্যাশনের অন্তর্ভুক্ত হইয়াও পৃথক ও স্বতন্ত্র ন্যাশনালিটি এবং পৃথক ও স্বতন্ত্র কর্পোরেট পার্সন্যালিটির অধিকারী ছিল। দুই অঞ্চলের কালচারও তাই স্বতন্ত্র ছিল।

 

কালচার ও সিভিলিযেশনের পার্থক্য

এইখানেই আমরা সভ্যতা বা সিভিলেয়েশন হইতে কৃষ্টি বা কালচারকে আলাদা করিয়া দেখিবার মতো আলোর সন্ধান পাই। আগেই বলিয়াছি, কালচার আমাদের কর্পোরেট পার্সন্যালিটি বা সমবেত ব্যক্তিত্ব। এইবার আরেকটু সহজ করিয়া বলি- কালচার আমাদের সামাজিক আমিত্ব। আমরা যা আছি তা-ই কালচার। পক্ষান্তরে সভ্যতাটা কি? কালচারকে মানুষের ব্যক্তিত্বের সাথে তুলনা করিলে সিভিলিযেশনকে মানুষের সম্পদের সাথে তুলনা করা যায়। অর্থাৎ আমাদের যা আছে, তাই আমাদের সিভিলিযেশন। কথাটার আরও একটু তফসির করা দরকার। ‘আমরা যা আছি’‘আমাদের যা আছে’ কথা দুইটির মধ্যে যে মৌলিক প্রভেদ আছে, সেদিকে আমাদের নযর দেওয়া উচিত। কাজটা বেশি কঠিন নয়। আমার আমিত্ব ও আমার সম্পত্তির মধ্যে যে পার্থক্য সুস্পষ্ট, তা মনে রাখিলেই কালচারটা বোঝার কাজ সহজ হইবে। এই দিক হইতে একটু তলাইয়া বিচার করিলে এটাও স্পষ্ট হইয়া আসিবে যে, এই কারণেই এক জাতির একাধিক কালচার থাকিতে পারে বটে, কিন্তু একাধিক সিভিলিযেশন থাকিতে পারে না। অপর দিকে তেমনি বহু জাতির এক সিভিলিযেশন থাকিতে পারে বটে, কিন্তু এক কালচার থাকিতে পারে না। কারণ কালচারের নিজস্বতা বা জাতীয় বা জাতীয় রূপ থাকিতেই হইবে; পক্ষান্তরে সিভিলিযেশনের কোন জাতীয় রূপ থাকিতে পারে না। একটা দৃষ্টান্ত দিয়া কথাটা বুঝাইবার চেষ্টা করিব:

আমরা যখন মিসরীয়, আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, আর্য, গ্রীক, রোমান আরব বা চীনা সভ্যতার কথা বলি, তখন কোন ভৌগোলিক দেশের বা রাষ্ট্রীয় জাতির সভ্যতার কথা বুঝাই না-বুঝাই একটা যুগের সভ্যতা। শিক্ষা-দীক্ষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে, দর্শন-সাহিত্যে, শিল্প-বাণিজ্যে, কলা-কারিগরিতে মানুষের সামগ্রিক অগ্রগতির নামই সভ্যতা। মানবমনের ক্রমবিকাশের ইহা নিদর্শন। সে কারণে গভীরতা ও ব্যাপ্তিতে প্রসার লাভ সভ্যতার স্বভাব। বনের আগুনের মতো নিজের আলোকে ও দাহিকা শক্তিতে বিস্তার লাভই ইহার অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তি। আগুন যেমন ইন্ধন হইতে ইন্ধনান্তরে ছড়াইয়া পড়ে, সভ্যতাও তেমনি জাতি হইতে জাত্যন্তরে ছড়াইয়া পড়ে। জ্ঞান যেমন শিক্ষক হইতে আরও বড় হইয়া ছাত্রের মধ্যে বিকশিত হয়, সভ্যতাও তেমনি শিক্ষক-জাতি হইতে শিষ্য-জাতিতে অধিকতর উন্নত ও প্রসারিত হয়। সভ্যতা ক্রমবিকাশমান। জ্ঞানের মতোই সে অক্ষয়, আগুনের মতই সে অনির্বাণ। কাজেই অতীতের ঐ সব সভ্যতার সাথে কোন একটা বিশেষ মানব-গোষ্ঠীর নাম সংযুক্ত  থাকার অর্থ এই নয় যে, ঐ ঐ সভ্যতা শুধু ঐ ঐ মানব-গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বস্তুত ঐ সব সভ্যতার ফল ঐ ঐ মানব-গোষ্ঠীর বাহিরের লোকেরাও ভোগ করিয়াছিল। প্রদীপ যার আংগিনাতেই জ্বলুক, পথচারীও সে আলোকের সুবিধা ভোগ করিবে।

একেবারে ঘরের কাছের নযির লওয়া যাক। বর্তমান যুগের সভ্যতাকে আমরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইউরোপীয় সভ্যতা বলিতাম। ঐ সভ্যতার নেতৃত্ব এখন আমেরিকার হাতে চলিয়া যাওয়ায় উহাকে আমরা এখন ওয়েস্টার্ন সিভিলিযেশন বা পশ্চিমা সভ্যতা বলিয়া থাকি। মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই সভ্যতা অচিন্তনীয় উন্নতি বিধান করিয়াছে। পাকা রাস্তা, মোটরগাড়ী, রেলগাড়ী, হাওয়াই জাহাজ, পোস্ট-টেলিগ্রাম, টেলিফোন, রেডিও-টেলিভিশন ইত্যাদি যোগাযোগ ব্যবস্থায়, ক্যামেরা, মুভি ক্যামেরা, টেক্সিকালার, থ্রি ডাইমেনশন, মঞ্চ ও পর্দা ইত্যাদি চারুশিল্পে, রোটারি মেশিন, লাইনোটাইপ, মনোটাইপ ইত্যাদি। জ্ঞান ও শিক্ষা বিস্তারের সাজ-সরঞ্জামের আবিষ্কারে, শিল্প-সাহিত্যের উন্নতিতে, ইঞ্জেকশন- অপারেশন, রেডিওলজি, কার্ডিওলজি প্রভৃতি চিকিৎসা প্রণালীতে, স্টিলফ্রেমের শতাধিক তলার আকাশ-চুম্বী ইমারতে উঠানামার জন্য লিফট-এস্কেলেটার স্থাপনায়, বিদ্যুৎ ও এটম শক্তিকে মানবের সেবায় নিযুক্তিতে, শূন্যলোকে গ্রহ-উপগ্রহ পরিভ্রমণের বাস্তব আয়োজনের সাফল্যে মানব-মনের যে অভাবনীয় বিকাশ লাভ ঘটিয়াছে এবং ফলে মানুষের বৈষয়িক জীবনে যে সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং তাদের নৈতিক জীবনে যে উন্নতি (অথবা যদি বলিতে চান অবনতি) হইয়াছে, তার সামগ্রিক নামই বর্তমান যুগের সভ্যতা। পশ্চিমা জাতিসমূহ এই সভ্যতার স্রষ্টা বলিয়া এর নাম পশ্চিমা সভ্যতা। কিন্তু তাই বলিয়া এই সভ্যতার ফল কি আমরা পূরবীরাও ভোগ করিতেছি না? পশ্চিমাদের আবিষ্কৃত যন্ত্রাদি ও তাদের তৈরী জিনিস-পত্র ব্যবহার করিয়াই শুধু আমরা সন্তুষ্ট থাকিতেছি না। নিজেরাও সে সব তৈরী করিতেছি। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, আর্টে-সাহিত্যে, শিল্প-বাণিজ্যে, আমরা পশ্চিমাদের সমান ও মতন হইবার চেষ্টা করিতেছি। স্বয়ং পশ্চিমারাও আমাদের সব শিখাইবার ও আমাদের মান উন্নত করিবার জন্য সযত্নে ও সাগ্রহে চেষ্টা করিতেছে। ফলে এই সভ্যতার সুযোগ ও সুবিধা পশ্চিমাদের মতোই আমরাও ভোগ ও ব্যবহার করিতে পারিতেছি। যে যেই পরিমাণে তা পারিতেছে, তার জীবনের মান ও মনের দিগন্ত সেই পরিমাণে উন্নত ও প্রসারিত হইতেছে। সেই হেতু ও সেই পরিমাণে দেশ ও জাতি-নির্বিশেষে গোটা দুনিয়ার মানুষ বর্তমান সভ্যতার অংশীদার। কাজেই পশ্চিমা সভ্যতাটা নামে পশ্চিমা ও অবদানে ইউরোপ-মার্কিন হইলেও আসলে এটা কোন এক জাতির বা জাতি-সমষ্টির সভ্যতা নয়, বর্তমান যুগের সভ্যতা। এইভাবে সভ্যতাটা আসলে যুগেরই বৈশিষ্ট্য, কোন জাতি বা দেশের বৈশিষ্ট্য নয়। বর্তমান যুগের সভ্যতা সম্বন্ধে যা সত্য, অতীতের সভ্যতা সমূহ সম্বন্ধেও তা-ই সত্য ছিল।

কালচারের ধারক পাড়াগাঁ কিন্তু কৃষ্টি সম্বন্ধে এ কথা বলা যাইতে পারে না। আগেই বলিয়াছি, কৃষ্টি সামাজিক ব্যক্তিত্ব। সামাজিকতা পল্লী-জীবনের বৈশিষ্ট্য। এই দিক হইতে কালচারের ধারক ও বাহক পল্লীগ্রাম। শহরে সামাজিক জীবনের অভাব। সেখানে প্রতিবেশিত্ব গড়িয়া উঠিতে পারে না। শহরের বাসিন্দাদের অধিকাংশই ভাসমান জনতা। আজ এ এখানে, কাল ও ওখানে। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি-বাকরির সমাবেশ হইতেই শহরের পত্তন ও প্রসার। তাতে নিত্য-নূতন লোকের আমদানি। পুরাতনের রফতানি। ওদের মধ্যে প্রতিবেশিত্ব গড়িয়া উঠিবার সময়ই হয় না। শহরের বুনিয়াদী বাশিন্দাদের মধ্যে মহল্লায়-মহল্লায় যে একটা প্রতিবেশিত্ব চালু ছিল, তাও ভাংগিয়া গিয়াছে বা যাইতেছে। শহরের উন্নতি শ্রীবৃদ্ধি ও পুননির্মাণের বন্যায় ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের থ্রাস্ট বা ধাক্কায় ঐ সব যে কোথায় ভাসিয়া যাইতেছে, তার ঠিক-ঠিকানা নাই। পক্ষান্তরে পাড়াগাঁয়ে এই প্রতিবেশিত্ব স্বাভাবিক। সেখানে এক বাড়িতে একজনের অসুখ হইলে সারা গ্রামে রটিয়া যায়। শহরে পাশের বাড়িতে লোক মরিয়া গেলেও কেউ খবর রাখে না। পাশের বাড়িতে কে বা কারা থাকে, তাদের পরিবারে লোক কত, কে কি করে, অনেক সময় তাও আমরা জানি না। জানিতে পারি না। জানিবার অবসর নাই। শহরের সবাই আমরা কাজের লোক। অতিমাত্রায় ব্যস্ত।

পারতপক্ষে কেউ পায়ে হাঁটিয়া চলে না। রিক্সা-ট্যাক্সি-মোটরে ছুটাছুটি। দৌড় ছাড়া গতি নাই। নষ্ট করিবার সময় নাই। এই পরিবেশে প্রতিবেশিত্ব বা আত্মীয়তা গড়িয়া উঠিতে পারে না। পরিচয় যা ঘটে, তা নিতান্ত বৈষয়িক সংক্ষিপ্ত, দুই দণ্ড বসিয়া আলাপ করিবার সময় নাই। যাদের আছে তারা ক্লাবে যায়। ক্লাব প্রতিবেশিত্ব নয়। কাজেই শহরবাসীর চাল-চলন, স্বভাব-চরিত্র, ভাব গতিক এক হইতে পারে না। ফলে শহরের বাশিন্দারা হয় মাল্টিকালার; শতরংগা; রং-বেরং এর লোক। পক্ষান্তরে পল্লীর লোকেরা হয় ইউনিকালার বা একরংগা। শহরের জনতার পরিবর্তন ঘটিতেছে প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়, প্রতি মিনিটে। পল্লীর লোক দাদা-পরদাদার আমল হইতে চৌদ্দ পুরুষ ধরিয়া একই জায়গায় একই ধরনে বসবাস করিতেছে। এই কারণেই পল্লী-গ্রামের লোকদের মধ্যে সুখে দুঃখে হাসি-কান্নায় একটা আন্তরিক সমবেদনা ও আত্মীয়তা গড়িয়া উঠিয়াছে। এই আত্মীয়তা হইতে তাদের আনন্দে-উল্লাসে, আমোদ-প্রমোদে, শোকে-মাতমে, অভাবে-অনটনে, আচারে-ব্যবহারে, পোশাকে-পরিচ্ছেদে, চিন্তায়-ভাবনায়, প্রথায়-সংস্কারে, কাহিনী-কিংবদন্তিতে, এমন কি ভূত-প্রেত দর্শনে-শ্রবণে, একটা একাকারত্ব বা ইউনিফর্মিটি দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছে। পল্লী-জীবনের অচঞ্চলতার মতই এই ইউনিফর্মিটি অচঞ্চল ও স্থায়ী। উপরে বর্ণিত সামাজিক আচারের সমাবেশ ও সমষ্টিই জাতির কালচার।

পল্লী-জীবনের ঐ ইউনিফর্মিটিই কালচারের বুনিয়াদ। এই জন্যই কালচারটা মূলত এবং প্রধানত পল্লীর সম্পদ। পল্লী জীবনই সে সম্পদের ধারক ও রক্ষক।

 

শহর কালচারের স্রষ্টা

অপর দিকে শহর শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-সাহিত্য ও রাষ্ট্র পরিচালনার কর্ম-কেন্দ্র। ঐ সব কাজ কর্ম উপলক্ষ্যে দেশ-বিদেশের হরেক রকমের লোকের সেখানে সমাবেশ। তাদের ধর্ম-ঈমান, আচার-অনুষ্ঠান, চিন্তা ভাবনা, খোরাক-পোশাক, চাল-চলন, বিদ্যা-বুদ্ধি এক নয়। এদের আলাপ-পরিচয় মিলামিশাও স্থায়ী নয়। এমন পরিবেশ ইউনিফর্মিটি ঐক্য ও আত্মীয়তা, এক কথায় কালচার, গড়িয়া উঠার অনুকূল নয়-সে কথা একটু আগেই বলিয়াছি। কিন্তু এর একটা ভাল দিকও আছে।

নিত্য-নতুন লোকের আসা যাওয়া, কাজ- কর্মে তাদের আলাপ-পরিচয় ও পরস্পরের ভাবের আদান-প্রদান হয় শহরে। তাতে নিত্য-নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ হয় তাদের। তাদের সকলের দৃষ্টিভংগিতেই আসে একটা উদারতা। এক জায়গায় বসিয়া বায়স্কোপে বিদেশে দেখার মতোই শহরের লোকেরা ঘরে বসিয়া দুনিয়া দেখে। নিত্য-নতুন সমস্যার সৃষ্টি ও সমাধান দেখে তারা চোখের সামনে। এইভাবে আসে তাদের মধ্যে নতুন চিন্তাধারা। তাতে বিচার-বুদ্ধিতে তাদের আসে উদারতা। মনে আসে প্রসারতা। তারা লাভ করে বিদেশীর ভাল জিনিস গ্রহণ করিবার ক্ষমতা, আর নিজেদের খারাপ জিনিস বর্জন করিবার সাহস। পল্লী- জীবনে যেসব বিশ্বাস থাকে তাদের ঈমানের অংগ, শহর-জীবনে বিজ্ঞান-প্রভাবিত মুক্তবুদ্ধির বিচারে সে সবই হইয়া পড়ে নির্বোধ কুসংস্কার। তাই পাড়াগাঁয়ে যারা সন্ধ্যা বেলায়ই বাড়ির পাশের ছোট শেওড়া গাছটিতে ভূত-প্রেত দেখে, তারাই শহরে আসিয়া বড় বড় বটগাছে অমাবস্যার রাত্রেও ভূত-প্রেত দেখে না।

বহুদর্শনের ফলে শহরবাসীর এই যে মনের বিকাশ ও দৃষ্টির প্রসারতা, এটা তারা লাগাইতে চায় নিজের সমাজের ও দেশের কাজে। অপরের দেখাদেখি নিজের লোককে ভাল করিয়া তুলিবার প্রবল ইচ্ছা জাগে তাদের অন্তরে। তারা হইয়া উঠে রিফর্মিস্ট। তারা নিজেদের চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে, ঈদে-পার্বণে, এমনকি ধর্ম-বিশ্বাসে, এক কথায় নিজেদের কালচারে, সংস্কার প্রবর্তন করিয়া সেটাকে করিতে চায় অধিকতর ভব্য, শালীন সুন্দর। শিক্ষা-কেন্দ্র, সাহিত্য-সংঘ সংবাদপত্র-পত্রিকার অফিস, রংগমঞ্চ, ক্লাব-রেস্তরাঁ, মসজিদ-মন্দির, গির্জায় প্রাচুর্য থাকে শহরেই। এই সব জায়গা হইতেই নতুন নতুন ভাব চিন্তা জন্ম ও প্রসার লাভ করে। রাস্তাঘাট, টেন, মোটরবাস, ডাক-তার ইত্যাদি যানবাহনের ক্রমবর্ধমান বিস্তারে ঐ সব নতুন চিন্তাধারা ছড়াইয়া পড়ে মফস্বলে। মফস্বলের লোকেরা সকল চিন্তা ও কাজে অনুকরণ ও অনুসরণ করে শহরবাসীকে। এইভাবে শহরে কালচার সৃষ্টি হইয়া বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছুরিত হয় পল্লী-জীবনে। শহরে করে যা সৃষ্টি, পল্লীকরে তা ধারণ ও পালন।

 

কালচার ও সিভিলিযেশনের সীমারখা

অতএব দেখা গেল, শহর সভ্যতা-ভিত্তিক এবং পল্লী কৃষ্টি-ভিত্তিক-এ কথাও যেমন নিরাধারা বলা যায় না, সভ্যতা শহরবাসী এবং কৃষ্টি পল্লীবাসী-একথাও তেমনি চোখ বুজিয়া কওয়া যায় না। এই কারণেই সিভিলিযেশন ও কালচারে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা এত কঠিন। এ ছাড়াও আরেকটা অসুবিধা আছে। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যার খানিকটা কালচার, আর খানিকটা সিভিলিযেশন। উদাহরণস্বরূপ বিয়ার কথাটাই ধরা যাউক। বিয়া-প্রথাটা সভ্যতা। যে দেশ ও সমাজে বিবাহ প্রথা চালু নাই, সে দেশ ও সমাজকে সভ্য বলা যায় না। সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্ররা জানেন যে, আদিকালে মানুষের মধ্যে বিবাহ-প্রথা ছিল না। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথা সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংগ হিসাবে একরূপ আইনে পরিণত হইয়াছে। কাজেই বিবাহটা সভ্যতা। কিন্তু বিবাহের রসুম বা প্রণালী সভ্যতা নয়, কালচার মাত্র।

বিয়ার রসুমের খুঁটিনাটি এক-এক দেশে এক-এক জাতিতে এক-এক রকম। এক দেশে দুলা-দুলহান নিজেরা দেখাশোনা ও কোর্টশিপ করিয়া বিয়া করে, আরেক দেশে দুলা-দুলহানের দেখাশোনা হয় না। তাদের বাপ-ভাই মুরুব্বিরাই বিয়া ঠিক করেন। এক দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে বিয়া হয়, আরেক দেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিয়া হয়। এক দেশে বা এক জাতিতে বরপক্ষ দেয় কাবিন ও দেনমোহর, আরেক জাতিতে কন্যাপক্ষ দেয় পণ ও যৌতুক। এক দেশে পুরুষ-নারীকে বিয়া করে, আরেক দেশে নারী করে পুরুষকে। এক দেশে একই সময়ে একাধিক বিয়া করা বেআইনী, আরেক দেশে এক সঙ্গে চার বা তারও বেশি বিয়া করা যায়। এক দেশে তালাক বা বিবাহ-বিচ্ছেদের দস্তুর আছে, আরেক দেশে তা নাই। এক দেশে বিধবারা বিয়া করতে পারে, আরেক দেশে পারে না। এক দেশে আত্মীয়-অনাত্মীয় নির্বিশেষে যে কেউকে বিয়া করা যায়, আরেক দেশে তা চলে না-এই সব নিয়ম-কানুনের একটা সিভিলিযেশনের প্রশ্ন নয়, কালচারের প্রশ্ন মাত্র। তার মানে এই সব নিয়ম কানুনের পার্থক্যের দরুন কোন জাতি সভ্য বা অসভ্য বিবেচিত হয় না, বরং এ সবই বিভিন্ন সত্য জাতির নিজ নিজ বিশেষ সামাজিক বা ধর্মীয় ব্যবস্থা; সুতরাং তাদের কালচারের অংগ।

যৌন-সমতার প্রশ্নটাও তাই। নারীকে নরের অধীন দাসী-বান্দী গৃহপালিত জীব বা পণ্য মনে করা অসভ্যতা। কি পারিবারিক সামাজিক জীবনে উভয়ের কর্তব্যের পৃথকীকরণটা অসভ্যতা নয়, কালচারের পার্থক্য মাত্র।

বিয়ার বেলা যেমন, জন্মের বেলায়ও তেমনি। সন্তান জন্মের সময় বিভিন্ন দেশে ও ভিন্ন-ভিন্ন জাতিতে বিভিন্ন প্রথা চালু আছে। কোনও দেশে ও জাতিতে সন্তানের জন্মে আকিকা দেওয়া হয় এবং আকিকা দেওয়ার সময়েই নাম রাখা হয়। আরেক দেশে সন্তানকে ধর্মস্থানে ধর্মযাজকের কাছে লইয়া যাওয়া হয় এবং সেখানেই তার নামকরণ হয়। এক দেশে প্রতিবছর সন্তানের জন্মবার্ষিকী পালন করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজন তাকে উপহার-উপঢৌকন দেয়, আরেক দেশে সন্তানের জন্ম-তারিখটি আলগোছে ভুলিয়া যাওয়া হয়। এক দেশে ছেলেদের খৎনা করান হয়, আর এক দেশে হয় না।-এ সবই কালচারের অংগ, সিভিলিযেশনের অংগ নয়। কিন্তু সন্তান জন্মের সময় ছেলে- সন্তান রাখিয়া মেয়ে সন্তানকে নদীতে ভাসাইয়া দেওয়া হইলে তাকে আর কৃষ্টি- অকৃষ্টির প্রশ্ন বলা যায় না। -তা হইয়া পড়ে সভ্যতা-অসভ্যতার প্রশ্ন।

জন্মের সময় যা, মৃত্যুর সময়েও তাই। এর খানিকটা সভ্যতা, খানিকটা কৃষ্টি। যেমন ধরুন, মৃত্যুর পর লাশটার গোশত খাইয়া ফেলিলে বা শিয়াল-কুত্তার ও চিল-শকুনের খাওয়ার জন্য ফেলিয়া দিলে সেটা হইবে অসভ্যতা। আর সযত্বে সাড়ম্বরে সে লাশটারে সৎকার করাটা হইবে সভ্যতা। এই সৎকারেরও আবার বিভিন্ন রূপ হইয়া, থাকে। বিভিন্ন দেশে ভিন্ন-ভিন্ন জাতিতে বিভিন্ন প্রণালীতে তা করা হয়। সে প্রণালীগুলি হইবে ঐ ঐ দেশ বা জাতির কালচার। এই ধরুন, কোন দেশে বা জাতিতে লাশ পুড়াইয়া ফেলা হয়; কোন দেশে বা জাতিতে তা মাটিতে পুঁতিয়া ফেলা হয়। পুড়াইয়া ফেলা ও পুঁতিয়া ফেলাও আবার ভিন্ন-ভিন্ন রকমের হইতে পারে। কেউ কাঠ-লাকড়িতে পুড়ায়, কেউ বিজলির তাপে পুড়ায়। পুঁতিবার বেলাও তেমনি এক জাতি লাশ সযত্বে ধুইয়া-মুছিয়া নয়া কাপড় পরাইয়া খুশবু লাগাইয়া দাফন করে; আরেক জাতি লাশটি কাঠের বাক্সে ভরিয়া মাটিতে চাপা দেয়। এক জাতি তাদের মৃত ব্যক্তিদেরে বিশালায়তনের ফুল-বাগিচাওয়ালা গোরস্থানে পৃথক পৃথক সমাধি দখল করিতে দিতেছে; আর এক জাতি তাদের মৃত ব্যক্তিদে’র স্বল্পায়তনের শ্মশানঘাটের ছাই হইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে বাধ্য করিতেছে। এ সবই বিভিন্ন জাতির বা মানব-গোষ্ঠীর কালচারের অংশ। সিভিলিযেশনের সংগে এ সবের কোন সম্পর্ক নাই। কিন্তু এই কালচারই একদিন সিভিলিযেশনের প্রশ্ন হইয়া উঠিতে পারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যদি ভবিষ্যতে প্রমাণিত হয় যে, এই দুই প্রথার কোনও একটি বা উভয়টি মানব-স্বাস্থ্যের পক্ষে অকল্যাণকর, তখন উহা আর কালচারের প্রশ্ন থাকিবে না; হইয়া উঠিবে উহা সিভিলিযেশনের প্রশ্ন। দৃষ্টান্তস্বরূপ সতীদাহের কথা বলা যায়। মৃত স্বামীর চিতায় বিধবা পত্নীকে পুড়াইয়া ফেলা একদা কোন কোন জাতির কালচারের অংগ ছিল। কিন্তু উহা সিভিলিযেশনের পরিপন্থী বিবেচিত হওয়ায় এখন পরিত্যক্ত হইয়াছে। কাজেই দেখা গেল, এই সব ব্যাপারের খানিকটা কালচার আর খানিকটা সিভিলিযেশন।

মানুষের ভাষা, উপাসনা-প্রণালী এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিরও খানিকটা কালচার, আর খানিকটা সিভিলিযেশন। বর্ণমালাযুক্ত ভাষা মানুষের সভ্যতার নিদর্শন; কিন্তু হরফের আকৃতি ও ডাইনে-বামে উপরে নিচে লেখার প্রণালী কালচারের নিদর্শন। গির্জা-মন্দির-মসজিদে প্রার্থনা-উপাসনা করা, রোযা-নামায পড়া, সন্ধ্যা-আহ্নিক করা, বুকে ক্রস ঝুলান, ধর্মস্থানে গমন, কবর যিয়ারত, এমনকি পীরের দরগায় শিরনী ও কালীবাড়িতে কবুতর মানত করা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই মানুষের কালচারের অংগ। সিভিলিযেশনের সংগে এর কোন সম্পর্ক নাই; অর্থাৎ এই সব ক্রিয়া-কলাপ এইরূপে করিলে সভ্যতা হইবে, আর ঐ ধরনে করিলে তা অসভ্যতা হইবে, এমন কোন কথা নাই। কিন্তু এই সব কালচারের প্রতিপালনে পূজা-অর্চনা বা ইবাদত-বন্দেগি করিতে গিয়া উপাস্য দেবতার ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য প্রাণী বলি দিলে উহা আর কালচারের প্রশ্ন থাকে না, হইয়া পড়ে তা সিভিলিযেশনের প্রশ্ন।

 

ধর্ম ও কৃষ্টির সীমারেখা

এইখানে ধর্ম ও কৃষ্টির সীমারেখা সম্বন্ধে দুই একটা কথা নিতান্ত প্রাসংগিক হইয়া পড়িতেছে। কারণ উপরে যে সব ক্রিয়া-কলাপের দিকে ইশারা করা হইল, তার অনেকগুলিই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংগ। রিলিজিয়ান ও কালচারের বাউন্ডারি নির্দেশ এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। কালচার ও সিভিলিযেশনের সীমা নির্ধারণই ইহার প্রতিপাদ্য। তবু কালচারের কথা বলিতে গেলে ধর্মের কথা স্বতঃই আসিয়া পড়ে বলিয়া এখানে অতি সংক্ষেপে ধর্ম ও কালচারের সীমা নির্দেশের চেষ্টা করিতেছি।

ধর্ম ও কৃষ্টির সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়; কিন্তু তা হইলেও দুইটা এক বস্তু নয়। এক কথায় বলা যায় ধর্ম কালচারের নির্যাস; পোটেনটাইড্ কালচার দার্শনিক ম্যালিনস্কির ভাষায় ‘মাস্টার ফোর্স অব হিউম্যান কালচার’। কাজেই ধর্মের সবটুকুই কালচার, কিন্তু কালচারের সবটুকুই ধর্ম নয়। সহজে বুঝিবার জন্য কালচারকে গাছের সংগে তুলনা করিলে ধর্মকে গাছের ফলের সঙ্গে তুলনা করিতে হয়। গাছ হইতে রিলিজিয়ান ও রিলিজিয়ান হইতে কালচারের উৎপত্তি। গাছ কিন্তু ফলের মত নিটোল ও অনাবিল নয়। তেমনি ভাল-মন্দ ও ফুল-কাঁটা লইয়াই কালচার।

 

কালচারের ব্যাপকতা

এমনিভাবে মানুষের গৃহনির্মাণ পোশাক-পাতি, রান্না-বান্না, খেলা-ধূলা, নাচ-গান, মায় ওয়ারিসী আইন-কানুন পর্যন্ত সব ব্যবস্থার মধ্যেই খানিকটা কালচার ও খানিকটা সিভিলিযেশন রহিয়াছে। মানুষ আদিকালে বনে-জংগলে-গুহায় বাস করিত। স্থায়ী বাসগৃহ নির্মাণ করিয়া তারা সভ্য হইয়াছে। স্থপতি বিদ্যার উৎকর্ষ সাধন করিয়া অধিকতর সভ্য হইয়াছে। কাজেই আবাসগৃহ নির্মাণ সভ্যতা। কিন্তু স্থাপত্যের রূপ কি হইবে, দালান-ইমারত চূড়াওয়ালা বা গম্বুজওয়ালা হইবে, না চৌকোণা বা চ্যাপ্টা হইবে, ইট-পাথরের হইবে, না কাঠ বাঁশের হইবে- এ সব কালচারের ব্যাপার। কাপড় পরা-না-পরাটা সভ্যতার প্রশ্ন। কিন্তু কি ধরনের পোশাক পরা হইবে, প্যান্ট না পাজামা, কোট না কোর্তা, শাড়ি-সেলওয়ার, না স্কার্ট-গাউন সেটা কালচারের প্রশ্ন। মাছ-গোশত-তরকারি রাঁধিয়া খাইবে, না কাঁচা খাইবে-এটা হইবে সভ্যতার প্রশ্ন। কিন্তু কি প্রণালীতে রান্না করিবে, কোন্টা খাইবে, আর কোল্টা খাইবে না, কোন্টা হালাল, কোল্টা হারাম, কি ধরনের পাক-প্রণালী পছন্দের, পেস্টিপ্যাটিস ভাল, না রসগোল্লা-সন্দেশ ভাল-এ সব কালচারের প্রশ্ন। খেলা-ধূলাকে মানুষের কর্মজীবনের স্বাভাবিক অংগ স্বীকার করা সভ্যতা। কিন্তু খেলার বিভিন্ন রূপ ফুটবল না রাগবি, ক্রিকেট না বেসবল, পলো না ঘোড়দৌড়, হকি না ডাংগুলি-এসব সভ্যতার প্রশ্ন নয়, কালচারের প্রশ্ন মাত্র। সংগীত ও নৃত্যকে চারুশিল্পের অন্তর্গত করা সভ্যতা। কিন্তু নাচ-গানের বিষয়বস্তু, ধরন ও প্রণালীটা কালচারের ব্যাপার। সম্পত্তির মালিকানার স্বীকৃতি সভ্যতার নিদর্শন। কিন্তু সে সম্পত্তির ওয়ারিস নির্ধারণ ও বণ্টন-প্রণালীটা কালচার মাত্র।

কালচারের উৎস

উপরের আলোচনা হইতে ইহা প্রমাণিত হইতেছে যে, যে মন ও মস্তিষ্ক মানুষকে অন্যান্য জীব-জন্তু হইতে পৃথক করিয়াছে, সেই মনের বিকাশের নাম কালচার, মস্তিষ্কের বিকাশের নাম সিভিলিযেশন। আগের আলোচনা হইতে এটাও স্পষ্ট হইয়াছে যে, এই নির্ধারণও নিক্তির ওজনে নিখুঁত নয়, মাত্র মোটামুটিভাবে সত্য। সভ্যতা বুদ্ধির বস্তু বলিয়াই সে নিজের জোরে রাজ্য জয় করে। প্রসার ও বিস্তার লাভ করে। হৃদয়ের সাথে সভ্যতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য নয়। তাই গ্রহণকারীকে অন্তর দিয়া সভ্যতা গ্রহণ করিতে হয় না। তার কোনও দরকারও নাই। এ্যারোপ্লনকে শয়তানের কল বলিয়াও অনেকে হাওয়াই জাহাজে চড়িয়া হজ করিতে যাইতেছেন। অন্যান্য সব সম্পদের মতোই সভ্যতার সাফল্য তার প্রয়োজনে।

আজিকার যান্ত্রিক সভ্যতাই তার প্রমাণ। প্রয়োজনের তাকিদেই সারা দুনিয়া এই পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণ করিয়াছে। মস্তিষ্কের ব্যাপার বলিয়া ইহা গ্রহণ করিতে কারও কোন অসুবিধা হয় নাই। দুনিয়ার সব দেশেই ইহা খাপ খাইয়া গিয়াছে। প্রকৃতির বিধানেই ইহা ঘটিয়াছে। কথাটা সহজে বুঝিবার জন্য আমরা সভ্যতাকে ইমারতের সংগে তুলনা করিতে পারি। আর কালচারকে তুলনা করিতে পারি এবং আগেই করিয়াছি, গাছের সংগে। ইমারত মাটি হইতে রস গ্রহণ করে না। কাজেই যে-কোন সরঞ্জামের যে-কোনও প্লানের ইমারত যে-কোনও দেশে নির্মিত হইতে পারে। কিন্তু গাছকে মাটি হইতে রস সংগ্রহ করিয়া বাঁচিতে হয়। সেজন্য যে-কোনও গাছ দুনিয়ায় যে কোনও দেশে লাগান যায় না। মাটি রস সংগ্রহের উপযোগী না হইলে চারা লাগাইলেও তা বাঁচে না।

কালচার সম্বন্ধেও এই কথা। যে-কোন দেশের কালচার, তা যতই সুন্দর হউক না কেন, অন্য যে-কোন দেশে চালান যাইবে না। স্থানীয় রসের অভাবে তা মারা যাইবে। কারণ আগেই বলিয়াছি কালচারটা মনের বস্তু, মস্তিষ্কের বস্তু নয়। এই দিক হইতে বিচার করিয়া বলা যায় সিভিলিযেশন একটা র‍্যাশনাল কনস্ট্রাকশন; আর কালচার একটা ইমোশন্যাল গ্রোথ।

ঠিক এই কারণেই দুনিয়ার লোককে যত সহজে পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণ করান গিয়াছে, তত সহজে পশ্চিমা কৃষ্টি গ্রহণ করান যায় নাই। সভ্যতা প্রসার লাভ করে বিজয়ীর বেশে। পশ্চিমা জাতিসমূহ রাজ্য বিস্তারে ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে তিনশ’ বছর ধরিয়া সারা দুনিয়ায় প্রভুত্ব করিয়াছে। এই উপলক্ষে তারা জগতবাসীর কাছে নিজেদের সভ্যতা প্রচার করিয়াছে। বিশ্ববাসী তা গ্রহণও করিয়াছে।

নিজেদের সভ্যতার সাথে সাথে পশ্চিমারা নিজেদের কালচার প্রচারে চেষ্টাও কম করে নাই। কিন্তু শহরের মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া সাধারণভাবে দুনিয়ার সব দেশের জনগণ পশ্চিমা কালচার গ্রহণ করে নাই। শাসক জাতির কালচারের প্রবল স্রোতের মুখেও তারা নিজেদের কালচার মজবুত হাতে ধরিয়া রাখিয়াছে। এটা মানুষের দর্প নয়, প্রকৃতির দর্প। সব দেশের মাটি পশ্চিমা কালচারের চারা গাছের রস যোগাইতে পারে নাই বলিয়াই এইরূপ ঘটিয়াছে।

 

বৈচিত্র্য অপরিহার্য

এটা কি অন্যায় হইয়াছে? পশ্চিমা কালচার গ্রহণ না করিয়া পূরবীরা কি ভুল করিয়াছে? এটা কি তাদের কুসংস্কারী মনোভাবের জন্য হইয়াছে? এটা কি তাদের সংস্কার-বিরোধী নস্টালজিয়া? তারা কি জানে না, কি জিনিস তারা হারাইতেছে? না, প্রকৃত অবস্থা তা নয়। মানব জাতির কল্যাণের খাতিরেই তা ঘটিয়াছে। যে বৈচিত্র্যে বিশ্বের সৌন্দর্য নিহিত, স্রষ্টার কারিগরির অসাধারণত্বের যা নিদর্শন, তারই খাতিরে প্রকৃতি এরূপ ঘটাইয়াছে।

ধরুন, এমন যদি না হইত, দুনিয়ার সব জাতি যদি পশ্চিমা কালচার গ্রহণ করিত, তবে অবস্থা কি দাঁড়াইত? সভ্যতার দিক হইতে দুনিয়া যেমন একাকার হইয়া গিয়াছে, কালচারের দিক হইতেও তেমনি সব জাতি একরংগা হইয়া যাইত। দেহের রং অবশ্য এক হইত না। কিন্তু মনের রং এক হইয়া যাইত। তাতেও কার কি লোকসান হইত?

মানবতার লোকসান হইত দুই দিক হইতে। প্রথমত, দুনিয়ার বৈচিত্র্য নষ্ট হইত। বিভিন্ন জাতির জাতীয় বৈশিষ্ট্যের অবসান ঘটিত। হাজার ফুলের বাগিচা যে দুনিয়া, সেটা পরিণত হইত এক রংগা গেন্দা ফুলের ক্ষেত্রে। দুনিয়ার সব জাতি নকল পশ্চিমা জাতিতে পরিণত হইত। লাখ লোকের সমাজের মধ্যে দুই-চারজন মাত্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন থাকিয়া বাকী সব লোক ব্যক্তিত্বহীন হইলে সমাজের অবস্থা যা দাঁড়াইবে, দুনিয়ার সব জাতি নিজ নিজ কালচারের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়া পশ্চিমা কালচার গ্রহণ করিলে বিশ্ববাসীর অবস্থা দাঁড়াইবে ঠিক তাই।

দ্বিতীয়ত, দুইচারজন লোক বা শ্রেণীবিশেষ বাদে সমাজের আর সব লোক ব্যক্তিত্বহীন হইলে সে সমাজ সচেতন সমবেত গণ-জীবন থাকিবে না, হইয়া যাইবে রাখালের পরিচালনায় একপাল গরু। স্বকীয় কালচার বা ব্যক্তিত্বহীন জাতিসমূহ ঠিক তেমনি পশ্চিমা রাখালের অধীনে গরুর পাল হইয়া যাইত। ফলে পশ্চিমা জাতিসমূহ ছাড়া আর সব জাতি হারাইত স্বাধীন চিন্তা, কর্মোদ্যম ও সৃষ্টির অভিলাষ। বিশ্ব সভ্যতায় তাদের কোনও অবদান থাকিত না। কার্যত তারা পরিণত হইত প্রাণহীন যন্ত্রে।

কাজেই দেখা গেল, লোক-সমাজে আদর-কদর, মান-ইয্যৎ পাইতে হইলে যেমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হইতে হয়, তেমনি বিশ্ব-সমাজে আদর-কদর ও মান-মর্যাদা পাইতে হইলে আমাদের জাতিকেও হইতে হইবে সমবেত ব্যক্তিত্বের, মানে নিজস্ব কালচারের অধিকারী। নিজস্ব কালচারের প্রয়োজন এইখানেই।

 

বৈচিত্র্য স্বাভাবিক

মনে রাখা দরকার, ব্যষ্টির ব্যক্তিত্ব যেমন, জাতির ব্যক্তিত্বও তেমনি, কদাচ নিখুঁত, ত্রুটিহীন হইতে পারে না। মারিয়া-পিটিয়া যেমন ব্যক্তিত্ব হয় না, ছাঁচে ঢালিয়া তেমনি কালচার হয় না। আগেই বলিয়াছি, কালচারটা ডিযাইন করা কনস্ট্রাকশন নয়। ওটা গাছের মতই ন্যাচারেল গ্রোথ। বলা যায় ওটা প্রকৃতির তৈরী নদী। মানুষের হাতে-কাটা খাল নয়। দুই কূল ছাপিয়া দুই পাড় ভাংগিয়া ইচ্ছামতো চলাই নদীর ব্যক্তিত্ব। কৃত্রিম খালের মতো তার দুই পাড় শানে-বাঁধা নয়। এই জন্যই দোষে-গুণে যেমন ব্যক্তিত্ব, ভাল-মন্দেই তেমনি কালচার। দুনিয়ার সব কালচারের শুধু গুণগুলি বাছিয়া লইয়া একটা নিখুঁত সুন্দর কালচার গড়িবার চেষ্টা করিয়া দেখুন, পারিবেন না। সেটা কালচার হইবে না, হইবে বড় জোর কালচারের ল্যাবরেটরি। মিউযিয়াম হইবার সম্ভাবনাই বেশি।

এর কারণও সুস্পষ্ট। মানুষ ফেরেশতা নয়। দোষে-গুণেই তারা মানুষ। তাদের এ দোষ-গুণের বিশেষত্ব এই যে এক দিক হইতে যেটা দোষ, আর এক দিক হইতে সেটাই সবলতা। ধরুন, মানুষের রাগের কথা। এক সময়ে এটা দোষ। কিন্তু সময়ান্তরে এটাই গুণ। নিষ্ঠুরতারই আর এক নাম বীরত্ব। কাপুরুষতাকেই সময়বিশেষে সহিঞ্চুতা বলা হয়। আহাম্মকির সাধু নাম সরলতা।

কালচারের বেলাও তাই। একের জন্য যা দোষ, অপরের জন্য তাই গুণ। এটাই তাদের পার্থক্য। এই পার্থক্যটুকুই যার তার বৈশিষ্ট্য। হুবহু ব্যষ্টির ব্যক্তিত্বের মতোই। একটা দৃষ্টান্ত লওয়া যাউক। হাত-পা, চোখ-মুখ, নাক-কান, খানা-পিনা, হাগা-মুতা এবং জন্ম-মৃত্যু কোনও ব্যাপারেই জানোয়ার ও মানুষের মধ্যে কোনও পার্থক্য নাই। মন ও মস্তিষ্কের দোহাই দিয়া তাহাদের মধ্যে যে পার্থক্য করি, তাও বড় ক্ষীণ। বানরের বেলায় সে পার্থক্যের সীমা কোথায়। শুধু মন-মস্তিষ্কের নয়, তাদের অন্তরও আছে। তাহারা ও হাসে-কাঁদে। ভাষাও তাদের একটা আছে।

 

বৈশিষ্ট্য কি?

তথাপি মন-মস্তিষ্ক ও অন্তরের এক স্তরে জানোয়ার ও মানুষের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য স্থূল দৃষ্টিতে যতই ক্ষীণ হউক না কেন ঐ পার্থক্যটুকুই মানুষের নিজস্বতা। ঐ টুকুই তার বৈশিষ্ট্য।

ব্যক্তিত্ব ও কালচারের বেলাও অবিকল তাই সত্য। হাজার বিষয়ে এক ও সদৃশ হইয়াও সামান্য দুই-এক বিষয়ে তারা পৃথক স্বতন্ত্র ও অসদৃশ। দেখা যাইবে সবই ত এক। তবে আর পার্থক্যটা কি? হাঁ, আছে। ঐ যে মানুষের ভিড়ের মধ্যে মাত্র এক ইঞ্চি বেশি লম্বা একটা লোক দেখা যাইতেছে, ঐ দৈর্ঘ্যটুকুই তার বিশেষত্ব। হাতে পায়ে রং চেহারায় কথাবার্তায় সব ব্যাপারেই আর সবার সাথে তার মিল আছে। কারণ সেও মানুষ। মানুষ না হইয়া সে যদি একটা খুঁটি বা উট হইত, তবে তার উচ্চতা তার বৈশিষ্ট্য হইত না।

তেমনি আগে কালচার হইতে হইবে। তারপর আসিবে কালচারের বৈশিষ্ট্য। সব কালচারের মধ্যে ঐক্য মিল ও সাদৃশ্য থাকিবে হাজার। আর পার্থক্য থাকিবে মাত্র দুই একটি। ঐ পার্থক্যটুকুই তাদের বৈশিষ্ট্য। অপরের চোখে বা বিজ্ঞানের বিচারে সে পার্থক্যটুকু তুচ্ছ হইতে পারে। কিন্তু ঐ কালচারের জন্য তুচ্ছ নয়। খুব ছোট দৃষ্টান্ত দিয়াই বিচার করা যাউক। মুসলমানের নূরের দাম হিন্দু-খৃস্টানের কাছে যা, হিন্দুর টিকির দাম মুসলিম-খৃস্টানের কাছে তাই। আবার খৃস্টানের ক্রসের দামও হিন্দু-মুসলমানের কাছে তুচ্ছ। ইহুদি-মুসলমানরা তাদেরা ছেলেদের কেন খৎনা করায় এটা হিন্দু-খৃস্টানরা বুঝিতে না পারিলেও ইহুদি মুসলমানরা কিন্তু কাজটাকে তাদের কালচারের ফান্ডামেন্টাল মনে করে। বিশ্ব-কবি রবীন্দ্রনাথ পোশাকে অত বাবু ও চেহারায় তাত সুন্দর হইয়াও মোচ দিয়া তাঁর অমন সুন্দর মুখখানা ঢাকিয়া রাখিতেন। সে জন্য আমরা তাঁর মুসলমান-খৃস্টান ভক্তদের অন্তরে দুঃখের অন্ত ছিল না। সম্রাট শাহজাহান ও স্যার সৈয়দ আহমদের মতো না হউক, মার্কস-এংগেলের মতো মোচ তিনি রাখিলেন না কেন? কারণ ওটা কালচার।

ঠিক তেমনি দাড়ি-গোঁফের বেলা হিন্দু-খৃস্টানেরা এত বিলাসী ক্লিনশেভার হইয়াও বগলতলা ও নাভির নিচে সম্বন্ধে অত সঞ্চয়ী কেন, মুসলমানরা তা বুঝে না। পোশাক-পাতিতে অত টাকা-পয়সা খরচ করিয়াও পশ্চিমা মেয়েরা পিঠ ও হাঁটুর নিচ ঢাকিবার কাপড়ের পয়সা জুটাইতে পারে না কেন, আমরা পূরবীরা তার কারণ খুঁজিয়া পাই না।

পক্ষান্তরে আমরা আমাদের মেয়েদের অত-অত কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকিয়া রাখি কেন, তা বুঝাও পশ্চিমাদের পক্ষে কম কঠিন নয়। পশ্চিমাদের ক্লাব-লাইফ ও ঢিলা-ঢালা দাম্পত্য জীবন দেখিয়া তাদের মেয়েদের জন্য আমরা কত আফসোস করি। কিন্তু আমাদের এক সংগে একাধিক বিবি লইয়া ঘর করিতে দেখিয়া পশ্চিমারাও আমাদের নারীজাতির জন্য কম আফসোস করে না। আমরা মুসলমানরা আরবী-ফারসীতে সুন্দর-সুন্দর অর্থপূর্ণ নাম রাখি। হিন্দুরা সংস্কৃত-হিন্দীতে সুন্দর অর্থজ্ঞাপক নাম রাখে। কিন্তু পশ্চিমা খৃস্টানরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও সভ্যতা-ভব্যতায় অত উন্নত হইয়া যা তা অর্থহীন ও কদর্য নাম রাখিতে লজ্জা পায় না। আমরা যাকে অখাদ্য মনে করি, অনেক সভ্যজাতি তাই খায় পরম লযযতের সাথে। বিজ্ঞানী দার্শনিকের কাছে এ সব ব্যাপারে যতই ছোট হউক না কেন, এ সবের মধ্যেই নিহিত কালচারের পার্থক্য। আসলে এ সবের সমষ্টির নামই কালচার। এই সব ব্যাপার দিয়াই আমাদের কালচারের বিচার করিতে হইবে।

 

[‘বাংলাদেশের কালচার’ থেকে গৃহীত]

৯৮০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top