ইসলামী চিন্তা “জীবন দর্শন ও সৃষ্টিতত্ত্ব” অনেক গভীর এবং বহুমাত্রিক উপলব্ধির মাধ্যমে শুরু হয়ে থাকে। যদি কোনো দর্শন ও চিন্তা অনেক বেশি যৌক্তিক, অনেক গভীর এবং বহুমাত্রিক না হয়, তাহলে সেই চিন্তা ও দর্শন কেবলমাত্র ইতিহাসের একটি উপাদান হিসেবে কাজ করে। আমরা এই সকল গুণের অধিকারী নই বলে আজ আমরা ইতিহাসের গতিপথকে পরিবর্তনে কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার করতে পারছি না। আজ ইতিহাস আমাদেরকে যে দিকে ইচ্ছা সে দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আজ আবার নতুন করে সূচনা করার প্রয়োজন। বিশেষ করে যুব সমাজের নতুন করে চিন্তা করা প্রয়োজন। আমরা কেন এবং কিভাবে আজকের এই অবস্থায় এসে উপনীত হলাম ? এই ব্যাপারে কোনো রাখঢাক না রেখে নিজেদের সকল ভুলকে সামনে রেখে গভীর ভাবে আত্মসমালোচনা করা প্রয়োজন। তবে এই আত্মসমালোচনা সঠিক ভাবে করার জন্য আজকের দুনিয়ার হাল-হাকীকত সম্পর্কে ও দুনিয়ার গতিপথ সম্পর্কে সামগ্রিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা অতীব জরুরী। আর এটার জন্য প্রয়োজন সমালোচনামূলক চিন্তায় (Critical Thinking) ও বিশ্লেষণী চিন্তায় (Analytical Thinking) পারদর্শিতা অর্জন করা। আজ আমার এই সকল গুণাবলীর অধিকারী নই বলে, যুগজিজ্ঞাসার জবাব এবং বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। গভীর উপলব্ধি বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে,

ইসলাম মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলার পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বমানবতাকেও উদ্দেশ্য করে কথা বলে থাকে। আমরা বলে থাকি যে, আমরা জগত সমূহের প্রভু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপরে ঈমান এনেছি। আমাদের এই স্বাক্ষ্য আমাদেরকে এই বিশ্বজগতের প্রতি আমাদের দায়িত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই স্বাক্ষ্য আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই বিশ্বজগতের আমানত আমাদের উপরে অর্পিত হয়েছে।

বিশ্বজগত সমূহের প্রভু মহান আল্লাহর দিকে ধাবমান হওয়ার অর্থ হল, এই বিশ্ব জাহানের ব্যাপারে একটি উপলব্ধি থাকা জরুরী। তাই বিশ্বজনীন একটি ভাষা ও দায়িত্ববোধের চেতনাও আমাদের মধ্যে জাগ্রত হওয়া জরুরী। কিন্তু আমরা মুসলমান হিসেবে আমাদের উপর এই অর্পিত দায়িত্ব পালন করছি বলে দাবী করতে পারি না। কারণ, ইসলাম আমাদেরকে সমগ্র বিশ্বজগত ও সমগ্র সময়কে পরিবেষ্টনকারী একটি বিশ্বদর্শন দেয়ার পরেও আমরা আজ স্থানীয় ও সাময়িক সময়ের জন্য নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করে নিয়েছি।

আমরা আজ নিজেদেরকে ছোট ছোট কক্ষের ভেতরে বন্দী করে বাতুলের মত এই সকল ছোট ছোট কক্ষে নিজেদের ভবিষ্যৎকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই সকল ছোট ছোট কক্ষে অবস্থান করে আমাদের কারোর পক্ষেই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা সম্ভবপর নয়।

সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদীরা আমাদেরকে এমনভাবে বেষ্টন করে রেখেছে যে, আমরা কোন বিষয়ে কথা বলবো আর কোন কোন বিষয়ে চুপ থাকবো, সেটাও তারা আমাদেরকে নির্ধারণ করে দিচ্ছে। আমরা আজ স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীনভাবে কথা বলতেও সক্ষম নই। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা প্রয়োজন।

উপরোল্লেখিত চিন্তাদর্শন ও বিশ্বদর্শন থেকে আজ আমরা দূরে সরে যাওয়ার কারণে, আমরা আমাদের সত্যিকারের সমস্যা সমূহের সমাধান তো দূরে থাক, সমস্যা সমূহকে উপলব্ধিও করতে পারছি না। সত্যিকারের সমস্যা সমূহকে বুঝার জন্য ও উপলব্ধি করার জন্যই ইতিহাসকে খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরী। 

জরুরী ভিত্তিতে উপলব্ধি করা প্রয়োজন এমন কোনো কোনো বিষয় রয়েছে যেগুলোকে আমরা এখনো উপলব্ধি করতে পারিনি।আমার মতে সেই বিষয় সমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আজ আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, সেই সমাজে ইসলাম আজ রেফারেন্সের উৎস নয়। ইসলাম ও কোরআন আজ আমাদের সমাজে বৈধ নয়। বর্তমানে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, আইন ও শাসন ব্যবস্থায় কোথাও ইসলামের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। ইসলাম কেবলমাত্র আমাদের সমাজে আনুষ্ঠানিকতার নাম। আমাদের এই দেশে অধিকাংশই নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করে থাকে, কিন্তু এই দেশেও আজ ইসলামের অন্টোলজিক কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। ইসলামের মূল প্রাণসত্ত্বা যেন গ্রহণযোগ্যতা না পায়, তাই সেটাকে সিস্টেমেটিক ভাবে বাঁধাগ্রস্থ করা হয়েছে। 

ইসলামকে আক্রমণকারী, ইসলাম বিধ্বংসী সকল প্রতিষ্ঠান ও আদর্শ আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে  বৈধ। পুঁজিবাদী পরিভাষা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ, সেক্যুলার পরিভাষা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নিউ লিবারেল পরিভাষা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ আমাদের দেশ ও সমাজের ভাগ্য নিয়ন্তা। এই সকল পরিভাষা এবং প্রতিষ্ঠান সমূহ-ই মূলত আমাদের সমাজকে তাদের লক্ষ্যপানে ধাবিত করে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইসলামী পরিভাষা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ আজ আমাদের সমাজে অপাংক্তেয়। সমাজকে গঠন করার ক্ষেত্রে এবং নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ইসলামের ন্যূনতম কোনো প্রভাব নেই। এই প্রভাবকে ধ্বংস করা হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও ইতিহাস দার্শনিক আর্নল্ড টয়েনবী ১৯২৩ সালে একটি লেখা লেখেন, সেই লেখায় তিনি বলেন, তুরস্ক তার নিজের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়ে তার শত্রুদের সংস্কৃতিকে আমদানি করে নিয়ে এসেছে। এই আমদানিকৃত সংস্কৃতি অল্প দিনের মধ্যেই তুরস্ককে অনেক বড় একটি হুমকির মুখে ফেলে দিবে।

সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম দেশ সমূহকে শোষণ করার পূর্বে তাদের মন-মস্তিষ্ককে শোষণের উপযোগী করে গড়ে তুলে। মুসলমানদের মন, মানস ও চিন্তাকে শোষণের উপযোগী করে গড়ে তোলার কারণে মুসলমানগণ নিজেদের জন্য কোনটি ক্ষতিকর আর কোনটি কল্যাণকর এর মধ্যে বিভাজন করতে পারেনি। এর প্রভাব আজও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকায় আজও আমরা আমাদের চিন্তা, ইতিহাস, শিল্প, দর্শন, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে সঠিকভাবে পাঠ করতে পারছি না। 

আজ আমরা যেই দেশে বসবাস করছি সেই দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও পরিভাষাই ১৭৮৯ সালে ঘটে যাওয়া ফরাসী বিপ্লব থেকে কপি করা হয়েছে। কপি করা এই সকল পরিভাষা ও প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান নিয়ে বিতর্ক করার পরিবর্তে এবং এই সকল পরিভাষা ও প্রতিষ্ঠানের স্থলে আরও উন্নত পরিভাষা ও প্রতিষ্ঠানকে প্রতিস্থাপন করার পরিবর্তে যে কপি করেছে তাকে নিয়ে বিতর্ক করে ১০০ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। কি কপি করেছে সেটা নয়, বরং যে কপি করেছে তাকে নিয়ে বিতর্ক করে সময় নষ্ট করেছি। কী কপি করল ? কেন কপি করলো ? এগুলার গুণগত মান নিয়ে কোনো কথা বলিনি।

মুসলিম উম্মাহ যেদিন থেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত হয়েছে, সেদিনের পর থেকে নিয়ে মুসলমানগণ মৌলিক কোনো কিছু উদ্ভাবন করতে পারছে না। নিজের চিন্তা, নিজের ভাষা, নিজের স্টাইল, নিজের গল্পকে সাজিয়ে উপস্থাপন করতে পারছে না। আজ আমাদের হাতে এমন কোনো প্রস্তাবনা নেই, যা আমরা যুক্তির ভিত্তিতে আজকের বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে পারবো। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার মতো কোনো জিনিসই আমরা উদ্ভাবন করতে পারিনি। কারণ মুসলমানগণ এক দিক থেকে উপনিবেশবাদীদের হাতে শোষিত হয়েছে আর অপর দিক দিয়ে ঐতিহ্য রক্ষার নামে ভেতর থেকে তথা কথিত রক্ষণশীলদের দ্বারাও শোষিত হয়েছে। ফলাফলের দিক দিয়ে তাকালে দেখতে পাই উভয়ের প্রভাব ছিল একই।

আমরা অনেক সময় মনে করে থাকি যে, আমাদের সকল সমস্যা বাহির থেকে আমাদের শত্রুরা আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথচ এমন অনেক সমস্যা আছে যা নিত্যনতুন ভাবে আমরাই তৈরি করে যাচ্ছি। কিন্তু এই সকল সমস্যা নিয়ে আমরা নির্বিকার! আভ্যন্তরীণভাবে আমাদের সমাজকে চিন্তাবিহীন করে ফেলার কারণে বাহিরের চিন্তা আমাদেরকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। আমরা যদি আমাদের সমাজকে গতিশীল চিন্তার অধিকারী বানাতে পারতাম, তাহলে বাহিরের চিন্তা আমাদেরকে এত বেশী কাবু করতে পারতো না। আমাদের সমাজ আজ এমন একটি ধারাকে দ্বীনে রূপান্তরিত করেছে যে, তারা আকলকে সব সময়  ছোট করে দেখে থাকে। আমরা মাঝে মধ্যেই শুনে থাকি ‘আকল দ্বারা এই কাজ করা সম্ভব নয়’! অথচ ইসলাম আকল ও রূহ উভয়কেই গুরুত্ব দিয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করেছে বলেই ইসলাম এত ভারসাম্যপূর্ণ এক জীবন বিধান। 

আমাদের সমাজ যদি চিন্তা করার যোগ্যতাকে হারিয়ে না ফেলতো, তাহলে এই কথা অকপটেই বলতে পারতো, ‘যে সমাজে ইসলামের কোনো বিধান জারি নেই, যে সমাজে কোরআন কোনো রেফারেন্স নয়, সে সমাজে মাযহাব নিয়ে বিতর্ক করার কি মূল্য আছে’!  যেখানে গাছই নেই সেখানে গাছের পাতা নিয়ে বিতর্ক করার অর্থ কী ?

আজ আমার ভাবতেই অবাক লাগে, আমাদের সমাজে এমন অনেকের জন্ম হয়েছে যারা দ্বীনে মুবীন ইসলামকে কেবলমাত্র ব্যাক্তিগত জীবনের সাথে সম্পৃক্ত বলে ঘোষণা করছে। যারা এই সকল কথা বলছে, তারা আবার নিজেদেরকে বড় বড় চিন্তাবিদ বলেও দাবী করছে। ইসলামকে রাষ্ট্রনীতি থেকে বাদ নিয়ে কেবলমাত্র ব্যাক্তি পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসার মত আত্মঘাতি চিন্তা আর কি হতে পারে? আজ এই ধরণের কথা বার্তা অনেকেই খুব সহজেই বলতে পারছে। কেন? এ সকল কথা আমাদের জন্য অনেক বড় অশনি সংকেত।

আমি বিন্দুমাত্রও অতিরঞ্জিত করে বলছি না, এই সকল চিন্তার বিরুদ্ধে কথা না বলার কারণে, এদেরকে জবাব না দেয়ার কারণে এবং আমাদের অনভিজ্ঞতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেকেই আজ ইসলামকে জৈন-বৌদ্ধ ধর্মের মতো ভাবা শুরু করেছে। কারণ রাষ্ট্রনীতিতে আজ ইসলামের বিন্দুমাত্র কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই।

বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেন,“তোমরা কোরআন বলতে বুঝেছো মৃত লাশের পাশে বসে ইয়াসিন পাঠ করা। এছাড়া কোরআন থেকে তোমরা আর কিছু শিখতে পারোনি।” যে কোরআন এসেছে আমাদের জীবনকে সুন্দর করার জন্য ও মানবতার কল্যাণ সাধনের জন্য আজ আমরা সেই কোরআনকে বানিয়েছি মৃতদের কিতাব।

মহাকবি মেহমেদ আকিফ এরসয় বলেন, “জেনে রেখো, কোরআন কবরের পাশে বসে ও মৃত লাশের পাশে বসে পড়ার জন্য নাযিল হয়নি, কোরআন নাযিল হয়েছে কোরআনের আলোকে জীবন পরিচালনার জন্য”। 

আজকে যদি আমাদের সমস্যা সমূহের কারণ চিহ্নিত করতে চাই, তাহলে প্রথমে আমাদের নিজেদের দিকে তাকিয়ে আমাদের দুর্বলতা সমূহকে চিহ্নিত করতে হবে। যদি আমরা আমাদের নিজেদের কাছে পরাজিত না হতাম, তাহলে আমাদের যুবকরা আজ সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও অর্থনৈতিক শোষণকে পরাভূত করতে পারতো। আজকে আমাদের চিন্তা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সম্পূর্ণরূপে ইউরোপ কেন্দ্রিক পরিভাষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা সেক্যুলার একটি শক্তির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত। সেক্যুলারিজম প্রশ্নেও আজ আমরা সেক্যুলারিজমকে সমালোচনা করে ইসলামের আলোকে কোনো জবাব দিতে পারছি না। ইসলামের আলোকে জবাবটি কেমন জবাব হতো? সেক্যুলারিজম যে শুধুমাত্র ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান ধর্মের উপর ভিত্তি করে গঠিত একটি চিন্তা, এমনটাও তুলে ধরা যেতো। 

আমরা যদি সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারতাম, আকলকে যদি আমরা গুরুত্ব দিতাম, তাহলে সেক্যুলারিজমের এই একচ্ছত্র আধিপত্যের বিস্তার ঘটতো না। আজ আমরা সেক্যুলারিজমের প্রশ্নে সকলেই চুপ, কিন্তু ইসলামকে নিয়ে বিতর্ক করছি প্রতিনিয়ত। সেক্যুলারিজম আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি এবং রেফারেন্স, কিন্তু ইসলাম কোনো মূলনীতিও নয় রেফারেন্সও নয়। এখানে যে কত বড় একটি দ্বৈততা, এটা কি আপনারা দেখতে পান না? 

সেক্যুলারিজম প্রভাবশালী ও সকল কিছুকেই নিয়ন্ত্রণকারী এবং সকল প্রকার বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ইসলাম? ইসলামের সকল বিষয় নিয়ে আজ বিতর্ক করা হচ্ছে, অনেক নাদানরাও আজ ইসলামকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করার কেউ যেন নেই! এর মূল কারণ কি? এর মূল কারণ হলো, আমাদের দ্বীনি জীবন- তাওহীদে যে সামগ্রিকতা, সেই সামগ্রিকতা হারিয়ে ফেলেছে, ইসলামের যে আসল (মূলনীতি) রয়েছে সেগুলো আজ ছিন্ন- ভিন্ন। আর এর প্রতিটি অংশই নিজেকে পূর্ণাঙ্গ বলে দাবী করছে! প্রতিটি অংশই নিজেকে সম্পূর্ণ দাবী করার কারণে এক হতে পারছে না। প্রতিটি অংশই নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করছে, আর এদের মধ্যে না আছে কোনো সংলাপ, না আছে কোনো যোগাযোগ।

ইসলামকে আজ এক দিক থেকে জাতীয়করণ করা হয়েছে, সেক্যুলারাইজেশন করা হয়েছে, বাতিনীকরণ করা হয়েছে, কিছু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এর সকল কিছুর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো ‘ইসলামকে জাতিরাষ্ট্রের সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা রাখা হয়েছে।’

প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রই আজ ইসলামকে ঢালরূপে ব্যবহার করে নিজের ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে। এই সকল জাতিরাষ্ট্রসমূহ যখন কোনো গঠনগত সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন নিজেদের মতো করে ইসলামকে ব্যবহার করে থাকে। ইতিহাসে জাতিরাষ্ট্রের মত দুর্বল কোনো রাষ্ট্র-ধারণা আর নেই। কারণ জাতিরাষ্ট্র কেবলমাত্র জাতি এবং মাটির উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়ে থাকে। এই জন্য প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রই জাতীয়তাবাদী হতে বাধ্য। জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে বন্দী করে রাখা কোনো দ্বীনি জীবনের ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই। তুর্ক ইসলাম, আরব ইসলাম, পারসিয়ান ইসলাম, ইউরোপিয়ান ইসলাম এগুলা ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। এগুলোর সাথে মোকাবেলা করার উপায় একটাই, আর সেটা হলো এগুলোকে ঢালাওভাবে অস্বীকার করা। আর যাই হোক না কেন, এই সকল চিন্তাকে কোনো ক্রমেই ডিফেন্ড করা যায় না। এগুলোকে ডিফেন্ড করার মতোও কিছু নেই।

 ইতিহাসকে আমাদের খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কিন্তু আজ মুসলিম উম্মাহ অনেক শক্তিশালী নেশা দ্রব্য সেবন করছে, আর এই সকল নেশা দ্রব্যের ফলে তাদের পক্ষে আজ ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই সকল নেশা দ্রব্যসমূহ হল দ্বীনি পপুলিজম এবং পলিটিক্যাল পপুলিজম। দ্বীনি পপুলিজম এবং পলিটিক্যাল পপুলিজম এর মধ্যে অর্গানিক একটি সংযোগ রয়েছে। আমরা যদি দ্বীনের সামগ্রিকতাকে তাওহীদি চেতনার আলোকে বুঝতে পারতাম, তাহলে এই সকল পপুলিজমকে মোকাবেলা করতে পারতাম। 

আমাদের প্রজন্ম ছিল ঘুমন্ত একটি প্রজন্ম। তাই এখন তোমরা যারা যুবক, তোমাদের দায়িত্ব অনেক। আমাদের প্রজন্ম জেগে উঠার প্রয়োজন বোধ করেনি, কারণ ইতিহাসকে তারা সেভাবে বুঝে উপলব্ধি করতে পারেনি। আজ আমাদের সমাজে ইতিহাস দর্শন ও  রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপারে কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। তোমরা যারা যুবক আছো, এখনই তোমাদেরকে এই বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। 

সর্বাগ্রে যুবকদেরকে যে গুনটি অর্জন করতে হবে সেটি হল, কেউ যেন তোমাদেরকে নিজেদের স্বার্থে প্রোপাগান্ডা চালানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার সাহস করতে না পারে। তোমরা যেনো নিজেরাই তোমাদের অবস্থানকে নির্ধারণ করতে পারো, এই যোগ্যতা যেভাবেই হোক তোমাদেরকে অর্জন করতে হবে। 

 তোমাদের চিন্তা চেতনা যেন উম্মুক্ত থাকে। সকল সংস্কৃতি ও চিন্তাকে পড়ার মত মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে। তবে এই ক্ষেত্রে বাছাই করার মত যোগ্যতাও তোমাদের মধ্যে থাকতে হবে। কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ, কোনটি দ্বীনে মুকাররাম ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এটা বাছাই করার মত ক্ষমতা তোমাদের থাকতে হবে। আর এই জন্য প্রয়োজন ক্রিটিক্যাল ও এনালিটিক্যাল থিঙ্কিং। নিজেদেরকে কোনো কক্ষের মধ্যে বন্দী করে রাখবে না। আমাদের মুসলিম উম্মাহর অন্যতম একটি সমস্যা হলো আমরা চিন্তার চেয়ে ব্যাক্তিকে বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এমন এমন মানুষকে আমাদের সামনে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয়, যাদের নিজস্ব কোনো চিন্তা নেই। আর থাকলেও সেই চিন্তার কোনো মূল্য নেই, তবু আমাদেরকে প্রতারিত করার জন্য তাদেরকে সামনে আনা হয়ে থাকে। 

আমাদের মুসলিম সমাজে কেবলমাত্র একজন ব্যাক্তি তথা দলীয় প্রধান রাজনীতি করে থাকেন আর দলের সকলেই তার অনুসুরণ করে থাকেন। যার কারণে আমাদের সমাজে কোনো রাজনৈতিক দর্শন গড়ে উঠেনি। ইতিহাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের ইতিহাস আবেগ নির্ভর ও যুদ্ধ নির্ভর হওয়াতে ইবনে খালদুনের পরে আর কোনো ইতিহাস দর্শন আমরা দাঁড় করাতে সক্ষম হইনি!

 হিজরী পঞ্চম শতাব্দী কাল থেকে তাকলীদের যুগ শুরু হয়, সেই সময়ের পর থেকে নিয়ে মুসলমানগণ আকল, চিন্তা, জীবন এবং ইতিহাসকে বন্ধ করে রেখেছে। কারণ আমরা মনে করে থাকি যে, ঐ সময়ের আলেমগণ অনেক আত্মবিশ্বাসের সাথে সকল সমস্যার সমাধান করে গেছেন, তাই আমাদের এখন আর কোনো কিছু করার নেই। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি যে, সময় পরিবর্তনশীল। সময় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দিকে মোড় নিয়ে বাঁক পরিবর্তন করে এবং আমাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন একটি অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

ইতিহাসে বিগত ৫০০ বছরে কি ঘটেছে, এই বিষয়ে আজ আমাদের প্রতিটি যুবকের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। এবং এই ৫০০ বছরে দুনিয়াকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তনকারী কিছু ঘটনা ঘটেছে। এই সকল ঘটনা সম্পর্কে তোমাদের মস্তিষ্কে সঠিক জবাব প্রস্তুত থাকা জরুরী। বিশেষ করে ইউরোপীয়ান রেনেসাঁ এবং এনলাইটেন্টমেণ্ট এর সময়ে কি হয়েছে ? এটার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ছিলেন সর্বোচ্চ ১০ জন। আজকে সমগ্র দুনিয়ার মানুষ মূলত এই ১০ জনের চিন্তা নিয়েই গবেষণা করছে। বিশ্বের চিন্তার ইতিহাস আজ এই ১০ জন মানুষ দ্বারাই প্রভাবিত। এই সকল দার্শনিকগণ রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেন্টমেন্ট পর্যন্ত যে সকল চিন্তা উদ্ভাবন করেছিলেন, সেগুলোই আজ দুনিয়ার অন্টোলজিক ও এপিস্টেমলজিক মূলনীতি সমূহের প্রতিনিধিত্ব করছে।

আজকে আমরা অন্টোলজিক ও এপিস্টেমলজিক সাম্রাজ্যবাদের শিকার। কিন্তু আমরা তা বুঝতেই পারছি না। কারণ ইসলামের অন্টোলজির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই, কিন্তু সেক্যুলারিজম, ক্যাপিটালিজম ও নিউ-লিবারেল অন্টোলজির গ্রহণযোগ্যতা আছে। রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেনমেন্ট যুগের ঐ সকল বড় বড় দার্শনিকরা এই সকল চিন্তাকে সামনে আনে ও যুক্তির ভিত্তিতে মানুষের সামনে তুলে ধরে এবং পরবর্তীতে এই সকল চিন্তাকে তাদের কলোনি স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বজনীন করে তুলে ও বিশ্ববাসীর উপর জোরপূর্বকভাবে চাপিয়ে দেয়। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মাধ্যমে তারা এই সকল চিন্তা সমূহেকে আমাদের জীবন ধারার সাথে মিশিয়ে দেয়।  

আজ আমাদের একটা কিছু করা প্রয়োজন, কোনো না কোনো জায়গা থেকে শুরু করা প্রয়োজন। তোমাদের প্রজন্ম যদি ইসলামী জ্ঞান, ইসলামী ভাষা এবং ইসলামী চিন্তাকে স্বাধীন করতে না পারে এবং এইগুলোকে তাওহীদের আলোকে, বর্তমান দুনিয়ার প্রেক্ষাপটের আলোকে ঢেলে সাজিয়ে অন্টোলজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করাতে না পারে, তাহলে এই উম্মাহর সত্যিকারের মুক্তি প্রায় অসম্ভব। যত দিন না আমরা এই কাজে সফল হবো, ততদিন পর্যন্ত আমাদের মুক্তির আশা করা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। 

সেক্যুলার জ্ঞান, সেক্যুলার ভাষা এবং সেক্যুলার চিন্তা দ্বারা ইসলামী সভ্যতার প্রতিষ্ঠা করার কথা চিন্তাও করা যায় না। এটাও একটা বাতুলতার নাম। আমরা আমাদের প্রতিটি কথাতেই সভ্যতার কথা বলি, পলিটিক্যাল পপুলিজমের নামে প্রতিদিন আমরা নতুন নতুন সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করি। এটা কি আপনারা একবারও চিন্তা করেন না যে, সেক্যুলার জ্ঞান, সেক্যুলার ভাষা এবং সেক্যুলার চিন্তা দ্বারা কিভাবে ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? এটা কি আপনাদের মাথায় একবারও আসে না?

সেক্যুলার জ্ঞান, সেক্যুলার ভাষা এবং সেক্যুলার চিন্তায় প্রতিষ্ঠিত একটি সভ্যতা তো ইতোমধ্যে আছেই। সভ্যতা নামক যে দানব আমাদেরকে শাসনের নামে শোষণ করছে, এটা সেক্যুলার জ্ঞান, সেক্যুলার ভাষা এবং সেক্যুলার চিন্তা দ্বারাই-তো প্রতিষ্ঠিত। যদি সেক্যুলার জ্ঞান, সেক্যুলার ভাষা এবং সেক্যুলার চিন্তা দ্বারা একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাহলে সেখানেই যোগদান করুন। এত কষ্ট করার কী দরকার? 

আপনারা কি মনে করেন যে, আমরা একটি সভ্য দুনিয়ায় বসবাস করছি? যে দুনিয়ায় মানুষকে ভিন্ন চিন্তার কারণে, ভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের কারণে, ভিন্ন মাযহাবের কারণে, ভিন্ন ভাষার কারণে হত্যা করা হয়। সেই দুনিয়া কিভাবে সভ্য হতে পারে! মানুষের গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং মাযহাব নিয়ে বিতর্ক করা এবং একে অপরকে একারণে শত্রু ভাবার অর্থ হলো আমাদের মনুষত্ববোধ কমে যাচ্ছে। আজকে যদি আমরা ইসলামী চেতনাকে হারিয়ে না ফেলতাম, তাহলে আজ আমরা এই সকল বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতাম না। যে দুনিয়ায় ইসলামী জ্ঞান স্বাধীন নয়, এবং এর অন্টোলজিক কোনো গ্রহণযোগ্যতা  নেই, সে দুনিয়ায় আমাদের পক্ষে কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। ব্যাক্তিগত জীবনে যারা দ্বীনদার, তাদেরকে নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। সেটাকে আমি বিতর্কের বিষয়বস্তুও বানাতে চাই না। কিন্তু আমাদের সকলের সামনেই একটি বাস্তবতা রয়েছে। 

আজকে দুনিয়ার ব্যাপারে যে দৃষ্টিভঙ্গি, এই দৃষ্টিভঙ্গির মূলে রয়েছে অ্যাংলো- স্যাক্সন ওয়ার্ল্ড ভিউ। তারাই আজ তাদের চিন্তা-দর্শন দিয়ে এই দুনিয়াকে যে দিকে ইচ্ছা, সে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এই অ্যাংলো-স্যাক্সন ওয়ার্ল্ড ভিউ আমাদেরকে ততটুকু ধর্মীয় স্বাধীনতাই দিয়ে থাকে, যতটুকু তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। অর্থাৎ ইসলামকে ব্যাক্তি জীবনে নামিয়ে নিয়ে আসা তথা ব্যাক্তিগত ইসলাম। আপনি ব্যাক্তিজীবনে ইসলামকে যতই পালন করুন না কেন, এটা তাদের জন্য কোনো হুমকি নয়। সামাজিক ভাবে ইসলাম পালন আজ নিষিদ্ধ, রাজনৈতিকভাবে ইসলাম পালন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ইসলামও নিষিদ্ধ। আমরা যে আমাদের জীবনকে তাদের অধীনে পরিচালিত করছি, আমরা তা জানিও না। এক অর্থে বলতে গেলে, তারা আমাদের প্রতি দয়া করে যতটুকু ইসলাম পালনের সুযোগ দেয় ততটুকুই পালন করতে পারছি। এই জন্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন সমূহকে আজ প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে এবং এই সকল আন্দোলন ক্রমেই নির্জীব হয়ে পড়ছে। 

সকল ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের মানুষকে, সমগ্র বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করবে এমন একটি আন্দোলন আজ আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। আমাদের ভাষা আজ বিশ্বজনীন নয়, আমাদের ভাষা আজ মানুষকে আন্দোলিত করে না, তাদের হৃদয়ের ব্যাথাকে আজ আমরা বুঝতে অক্ষম। আজ আমরা ইতিহাসের কেন্দ্রে নয়, ইতিহাসের বৃত্তের বাইরে আজ আমাদের অবস্থান। ইতিহাসের কেন্দ্রকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কোনো ইতিহাস দার্শনিক আজ আমাদের নেই। এই দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। 

আরো একটি নতুন বিষয় আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই, আমরা শুনে থাকি যে ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড’! এর  চেয়ে আর বড় অপমান আমাদের জন্য কি হতে পারে ? এই ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড’ আমাদেরকে বর্বর বলে অভিহিত করে থাকে। এই ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড’ এর নামে তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদকে  বৈধ করেছে, তাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে  বৈধ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। আমরা যদি দুনিয়াকে ইউরোপের চোখে না দেখে আমাদের চোখে দেখতাম তাহলে এই সকল বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেতাম। বর্তমান সময়ে, এই তথাকথিত ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড’  দুইটি বিষয়ের উপর তার সালতানাতকে টিকিয়ে রেখেছে :

                                 ১) মানবাধিকার

                                 ২) যৌন স্বাধীনতা

তাদের তৈরি করা সেই মানবাধিকারে মুসলমানের কোনো অধিকার নেই। এর পরও এই পরিভাষা মুসলিম দেশ সমূহে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য । আমাদের দেশ সমূহকে যখন ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের শত শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের মা-বোনদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সমূহকে লুণ্ঠণ করা হচ্ছে, তখন এই ‘ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড’ বোবার ভূমিকা পালন করছে।

কিন্তু একজন ইউরোপিয়ানের অধিকারের জন্য, কোনো কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সাম্রাজ্যবাদী যে কোনো ব্যাংককে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তারা সারা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিতে পারে। অফিসিয়াল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে আমরা মিটিং মিছিল করে থাকি, কিন্তু আন-অফিসিয়াল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা সকলেই নিশ্চুপ কেন? কারণ আমরা কোন বিষয়ে কথা বলবো আর কোন বিষিয়ে চুপ থাকবো সেটা আমরা নয় তারাই নির্ধারণ করে দেয়। আমরা দ্বীনি, পলিটিক এবং মিডিয়া পপুলিজমের দেওয়া নেশাদ্রব্যে বুদ হয়ে আছি। আমাদের হুঁশ নেই। 

যৌন স্বাধীনতা কিংবা এই ধরণের আরও অন্যান্য স্বাধীনতার নামে আজ সকল ধরণের অশ্লীলতা ও বেহায়াপনাকে মর্ডানিজমের নামে প্রাতিষ্ঠানিকরণ করা হচ্ছে। এর জন্য  তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন ভাষা। আজ যৌন স্বাধীনতার আলাদা একটি ভাষা রয়েছে। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, হেডোনিজমকে আজ স্বাধীন অধিকার বলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করা হচ্ছে। 

কেন এগুলো হচ্ছে ? কারণ আমরা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। আমরা দুনিয়াকে নতুন কোনো কিছু দিতে পারছি না। নতুন কিছু করার সাহসও আমাদের নেই। কারণ, তথাকথিত ঐতিহ্য আমাদেরকে নতুন সৃষ্টিতে উৎসাহিত করে না। আমাদের কাছ থেকে তাদের চাওয়া হল, তাদের অনুসরণ ও পুনরাবৃত্তি । যে সংস্কৃতি অন্ধ অনুকরণ ও পুনরাবৃত্তির উপর নির্ভর করে চলে, তার পক্ষে  কোনো দিন কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। সে কখনোই ‘আমি’ হতে পারবে না, তাকে সব সময় ‘অন্য’ হয়েই থাকতে হয়।  

এই জন্য আমি যুবকদেরকে বলি, “আমাদের কাছে না এসে তোমাদের নিজেদের কাছে ফিরে যাও।” নিজের চিন্তাকে বিকশিত করার জন্য যোগ্যতা অর্জন করো। আমরা যারা তোমাদের চেয়ে বয়সে বড়, আমাদের সাথে পরামর্শ করো, আমাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতার গল্প শোনো, কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নাও। আমাদেরকে অতিক্রম করো। যেমন আমার বয়স ৭৭ বছর, আমি ১০০ বছর আগের বা আমার সময়ের চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করছি। কিন্তু তোমরা যদি আমাকে অনুকরণ ও পুনরাবৃত্তি করো, তাহলে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছু হবে না। তোমরা তোমাদের সময়কে ধরো, তোমাদের সময়ের আলোকে কিছু করার চেষ্টা করো। 

তোমরা আধুনিক সময়ের স্পন্দনকে বুঝার চেষ্টা করো। আমাদের প্রজন্ম সব সময় তাদের অতীতকে বুঝায়, তাও আবার এমনভাবে, যেন তাদের কোনো ভুলই ছিল না। তাই সেখান থেকে কোনো শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হয় না। অতীতের বিজয়, অতীত অতীতই। আচ্ছা আজকে যে আপনার পরিবার এবং আপনার দেশকে সেক্যুলারিজম বিজয় করে নিয়েছে এই ব্যাপারে কী বলেন?

যারা আজ যুবকদেরকে নসিহত করেন, তাদের জানা উচিত আজকের যুবকরা তথ্য-প্রযুক্তির যুগের প্রজন্ম। তাদের এখন কী করা প্রয়োজন, তাদেরকে সেটা বলা দরকার। কেন আমরা আমাদের যুবকদেরকে সব সময়ে অতীতের চিন্তা থেকে, অতীতের দর্শন থেকে উদাহরণ দেই? কারণ আজকে তাদের কী করা প্রয়োজন, তারা কেমন যুগে বাস করছে এটা আমরা নিজেরাই জানি না। 

আরেকটি বিষয়, যে সকল উস্তাজের কাছ থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো, তারা যেন তোমাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে হরণ করতে না পারে। এই সুযোগটা কাউকে দেওয়া যাবে না। আমরা যারা বয়স্ক আছি তারাও যেন আমাদের যুবকদের স্বাধীন চিন্তা ও মন-মানসকে আমাদের দখলে নেয়ার চেষ্টা না করি। 

তোমরা যদি আমার অন্ধ অনুকরণ করো, তাহলে সেটা হবে চিন্তাগতভাবে আত্মহত্যার শামিল। তোমরা এসেছো এই পৃথিবীকে বিনির্মাণ করার জন্য। 

আমাদের যারা অতীতের আলেম উলামা, চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আছেন, তাদেরকে তাদের সময়ের আলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। তাঁরা এসে আমাদের বর্তমান সময়ের সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে না। তাঁরা চলে গেছেন এবং আল্লাহর  দরবারে তাঁদের আমলের পুরস্কার তাঁরা পাবেন। 

আমি নিজেও যদি বলি আমার বই সমূহ পড়ো, তাহলে আমার বই তোমরা পড়বে না। যদি কোনো উস্তাজ বা কেউ বলেন আমি এই বই লিখেছি, তোমরা সবাই পড়ো এর চেয়ে বড় সমস্যা আর কি হতে পারে? যারা তোমাদের সকল কাজেই হস্তক্ষেপ করে, তাদের থেকে দূরে থাকবে। 

যারা তোমাদেরকে বলে আমাকে অনুসরণ করো তাকে অনুসরণ করবে না, তোমরা সারা দুনিয়াকে অনুসরণ (পর্যবেক্ষণ) করবে। সমালোচনামূলক একটি মস্তিষ্ক নিয়ে সকল চিন্তা, সংস্কৃতি ও দর্শনকে পর্যবেক্ষণ করবে। নিজেদের একটি গুহায় আবদ্ধ করে রাখবে না, কারণ মুসলমান হওয়ার অর্থই হল বিশ্বজনীন হওয়া। এমন চিন্তা ও ধারা উদ্ভাবন করো, যেটা সমগ্র দুনিয়ার জন্য কাজে লাগবে। কারণ আমাদের রব হলেন রাব্বুল আলামিন, আমাদের নবী হলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন, আর আমাদের কিতাব হলো হুদাল লিন্নাস। তাহলে আমরা কিভাবে স্থানীয় হতে পারি?

একজন উস্তাজ, একটি চিন্তা, একটি বিশ্লেষণের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে রাখার অর্থ হলো, একটি তাকদীরের আত্মাহুতি। আজ আমরা উম্মাহ হিসেবে নিজেদেরকে আত্মাহুতি দিচ্ছি। কারণ আজ আমাদের সবারই একজন উস্তাজ রয়েছে, তার একটি চিন্তা রয়েছে, আর আমরা সকলেই তার সেই চিন্তার অনুকরণ ও পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছি।

কিছুদিন আগে আমি একটি কনফারেন্সে বলেছিলাম, যেখানে ইসলামের একটি রুকন পর্যন্ত স্বাধীন ও বৈধ নয়, সেখানে এত বড় বড় মসজিদ নির্মাণ কী অর্থ বহন করে? আর এই সকল জাঁক-জমকপূর্ণ মসজিদের জন্য কত টাকা যে খরচ করা হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমি তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম, বড় বড় চিন্তার জন্য, চিন্তা কেন্দ্রের জন্য, আমরা কয়টাকা খরচ করি?

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন

১০৯৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top